মাথার উপর আকাশে চৈত্রের দাহ। অশ্বারােহী নজদেহে প্রাণপণে কলগা আকর্ষণ করে চলেছেন। বেগবান অশ্ব বাধা পেয়ে মাঝে মাঝে প্রতিবাদ জানাচ্ছে হ্রষাধ্বনি তুলে।
জরাগ্রস্ত কম্পিত কলেবর যযাতি পিপাসায় কাতর হয়ে পড়লেন। শুক্রাচার্যের আশ্রম ছাড়িয়ে এসেছে বহুক্ষণ, কিন্তু ধীর গতির জন্য এখনও অতিক্রম করতে পারেননি দানবরাজ বৃষপর্বার রাজ্য। একটা দীর্ঘশ্বাস বুকের গভীর থেকে উঠে মিলিয়ে গেল চৈত্রের তপ্ত হাওয়ায়। গতকালও তিনি গিয়েছেন এ পথে। অশ্বকে কষাঘাত করে দ্রুত গতিতে পৌঁছে গিয়েছেন শুক্রাচার্যের আশ্রমে।
মধ্য যৌবনেও যযাতি বিক্রমকেশরী। কিন্তু একটি দিনের ব্যবধানে কী অবিশ্বাস্য পরিণতি তার দেহের। অভিশপ্ত যযাতি আজ পলিত কেশ, স্বলিত দস্তু, লােল চর্ম, ক্ষীণ দৃষ্টি এক বৃদ্ধ।
ওঃ কী ভীষণ, কী ভীষণ পরিণতি আমার। কথা কাট উচ্চারণ করার সময় উত্তেজনায় কম্পিত হল দেহ। সঙ্গে সঙ্গে শিথিল হক্ত থেকে স্বলিত হয়ে পড়ল বলগা। রাজা যযাতি চলমান অশ্ব থেকে পড়ে গেলেন অনুর্বর প্রান্তরে। শিক্ষিত অশ্ব প্রভুর পতনের পর স্থির হয়ে দাড়িয়ে রইল। | কতক্ষণ পরে একটা মুহার ভিতর থেকে যেন জেগে উঠলেন রাজা যযাতি। ভূমিশয্যা থেকে প্রান্তরের কঠিন মৃত্তিকায় উঠে বসলেন। সঙ্গে সঙ্গে চতুর্দিক থেকে ধ্বনিত হল শুক্রাচার্যের ধিক্কার, কী প্রতিজ্ঞা করেছিলে তুমি আমার কন্যা দেবযানীকে গ্রহণের কালে? মিথ্যাচারী, তুমি না বলেছিলে, আমি অন্য কোনও নারীর সঙ্গে সহবাসে লিপ্ত হব না? দেবযানী হবে আমার অদ্বিতীয়া। নীতিভ্রষ্ট, তুমি অসুরকন্যা শর্মিষ্ঠার সঙ্গে সংগােপনে লিপ্ত হলে ব্যভিচারে। তুমি তার গর্ভে করলে পুত্র উৎপাদন। মদমত্ত যযাতি, রাজা হয়ে মনে করেছ সর্বশক্তির অধীশ্বর তুমি। যে যৌবনমদে মত্ত হয়ে তুমি বিস্মৃত হলে তােমার শপথ বাক্য, সেই যৌবন এই মুহূর্ত থেকে হরণ করলাম আমি। জর্জরিত হবে কামনায়, কিন্তু তােমার ওই অক্ষম দেহ আক্ষেপে মুছিত হয়ে পড়বে মাত্র। ভােগের বস্তু সম্মুখে দেখে হৃদয় তােমার হাহাকার করে উঠবে। কিন্তু অক্ষম ওই দেহ দগ্ধ হয়ে যাবে কামনার ‘অগ্নিতে।
কাতর কণ্ঠে আর্তনাদ করে উঠলেন যযাতি, প্রভু, দয়াময়, সংবরণ করুন আপনার ক্রোধ। আমি স্বীকার করছি আমার অপরাধ। আমি ব্যভিচার-দোষে দুষ্ট। আমি মিথ্যাচারী, সর্বপ্রকার শাস্তির যােগ্য আমি। কিন্তু প্রভু, আমার অন্তরে কামনার অগ্নি আজও অনির্বাণ। ঐশ্বর্য, রাজ্য, যৌবন, সকল ভােগই এখনও আমার অপূর্ণ। আমাকে জরা দিয়ে আপনি মৃত্যুর অধিক যন্ত্রণায় নিক্ষেপ করবেন না। তার চেয়ে কৃপা করে আমাকে মৃত্যু দিন প্রভু।
মুহূর্তে ক্রোধ সংবরণ করলেন ঋষি শুক্রাচার্য। বললেন, ব্যর্থ হবে না আমার অভিশাপ। তবে কেউ যদি তােমার জরা গ্রহণ করে তার যৌবন তােমাকে দান করে তবে কেবল তুমি তােমার পূর্বাবস্থা ফিরে পেতে পারাে।
চতুর্দিকে উথিত শব্দ মিলিয়ে যেতে লাগল দিগন্তে। রাজা যযাতি সম্মােহ থেকে উঠে
লীলারহস্য দাঁড়ালেন। চৈত্রের তপ্ত রবিকরে আবার তিনি পিপাসার্ত হয়ে তাকাতে লাগলেন জলাশয়ের সন্ধানে।
প্রান্তরের দক্ষিণ সীমায় একটি নস্থলী। যযাতি অশ্বারােহণে সেই কাননভূমির দিকে অগ্রসর হলেন। হঠাৎ তার কানে এসে পৌছল জলচর প্রাণীদের কলধ্বনি। তিনি মনে মনে জলাশয়ের অবস্থান সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে প্রবেশ পথের সন্ধান করতে লাগলেন। অচিরে তিনি দেখতে পেলেন লতা পুষ্প শােভিত তােরণ পথ। অভিশপ্ত রাজা যযাতি সেই পথে প্রবেশ করলেন কাননে। সম্মুখে স্বচ্ছ সরােবর। তৃষ্ণার জলে পূর্ণ সে জলাশয়। রাজা অশ্ব থেকে অবতরণ করে অগ্রসর হলেন স্ফটিক নির্মিত সােপানের অভিমুখে। একবুক পিপাসা নিয়ে তিনি জলের সমীপবর্তী হলেন। কাকচক্ষু জল স্থির হয়ে আছে। নীলাকাশের প্রতিবিম্ব পড়েছে তার উপর। ঠিক যেন একখানি স্বচ্ছ দর্পণের উপর নিখুঁত প্রতিচ্ছবিটি। রাজা যযাতি অঞ্জলিবদ্ধ হাত নিয়ে নত হলেন, জলপানের আশায়।
কিন্তু এ কার ছবি ফুটে উঠল জলের দর্পণে! কাকে দেখতে গিয়ে তৃষ্ণার্ত রাজা যযাতির অঞ্জলিবদ্ধ হাত খসে পড়ল। জলপানের আকুল বাসনা বিকৃত এক বেদনার স্পর্শে স্তব্ধ হয়ে মধ্য যৌবনের দীপ্তিতে ভাস্বর যযাতি দেখতে লাগলেন জরার ভারে আক্রান্ত আর এক যাতিকে।
নবাগত এক অতিথিকে দেখে জলে তরঙ্গ তুলে এগিয়ে আসছিল হংসশ্রেণি। তাদের আন্দোলনে ভেঙে গেল রাজা যযাতির বিকৃত প্রতিকৃতি। হংসশ্রেণির উপর কৃতজ্ঞ রাজ্জা এতক্ষণে আকণ্ঠ পান করলেন সুশীতল সলিল। পানশেষে উঠে এলেন স্ফটিকমণ্ডপে। সেখানে উপবেশন করে তাকাতে লাগালেন চতুর্দিকে। ঋতুরাজ সস্তের রঙিন পতাকা উড়ছে অরণ্য বিটপীর শাখায় শাখায়। বসস্তু সখা মদন তার নিক্ষিপ্ত বাণে বিহুল করে তুলেছে কনভূমি। রাজা যযাতি সম্মুখের শাল্মলী তরুর শাখভরা রক্ত পুষ্পের দিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে রইলেন। অন্তরে তার শুরু হল রক্তক্ষরণ। তিনি এই রক্তরাঙা বসন্তের গবাক্ষ পথে আর এক নবীন বসন্তের ছবি দেখতে লাগলেন।
সেদিনও দানবরাজ বৃষপর্বার এই কাননভূমিতে শুরু হয়েছিল বসন্তের লীলা। অশােকে শিমুলে পলাশে সে কী প্রমত্ততা। বিরহিণী বকুল মাটিতে ঝরাচ্ছিল তার অশ্রু। মধুকের শাখায় শাখায় গুঞ্জন করে ফিরছিল মধুকর।
সহসা আমঞ্জরীর অন্তরালে ডেকে উঠল কোকিল। অমনি চারিদিক থেকে শুরু হয়ে গেল কোকিলের কলতান। সে যেন এক প্রতিযােগিতা। পিয়াল শাখায় বাঁধা কুসুম-দোলনায় দুলছিল দ্বাদশটি তরুণী কন্যা। তারা আমঞ্জরীর আড়ালে লুকিয়ে থাকা কোকিলটিকে বিভ্রান্ত করছিল তাদের ডাকে। | কাননভূমির বাইরে সেদিনও অশ্বারােহণে এসেছিলেন এক তরুণ। মৃগয়ায় এসে এক তরুণী। হরিণীর পশ্চাদ্ধাবন করতে গিয়ে তিনি পথ হারিয়েছিলেন। তৃষ্ণায় কাতর হয়ে সেই রাজবেশধারী তরুণ এসে দাঁড়িয়েছিলেন অসুররাজ বৃষপর্বার এই কাননভূমির বহির্ভাগে।
প্রবেশের পথ না দেখে সেই তরুণ যুবা লতাগুল্মের আচ্ছাদন সরিয়ে পত্রান্তরাল থেকে দেখেছিলেন একটি আশ্চর্য ছবি। তিনি জলতৃষ্ণা ভুলে আর এক গভীর তৃষ্ণায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন।
অচ্ছেদ সরােবরের জলে খেলা করছিল হংস কারণ্ডবের দল। তারা সূর্যের সােনালি শরগুলির ভয়ে যেন ডুব দিয়ে লুকোচ্ছিল জলের তলায়। আবার উঠছিল, আবার লুকোচ্ছিল।
তরুণীরা দুলছিল ফুলের দোলনায়। তারা লাবণ্যময় বাহ উত্তোলন করে ধরেছিল পুষ্পে গাঁথা । চরণ মৃত্তিকায় আঘাত হেনে তাদের তুলে নিয়ে যাচ্ছিল শূন্যে। তাদের নানা বর্ণরঞ্জিত সুক্ষ্ম উত্তরীয় কণ্ঠ বেষ্টন করে উড়ছিল দুই প্রান্তে। মনে হচ্ছিল পক্ষযুক্ত দেবকন্যারা নির্জন নন্দন কাননে আনন্দের পরাগ ছড়াতে উড়ে ফিরছে।
কতক্ষণ চলল এমনি দোলন লীলা। সঙ্গে সঙ্গে চলল গান আর গ্রীবা বাঁকিয়ে কথার চতুরালি।
মুগ্ধ হয়ে দেখছিলেন তরুণ। সহসা সব কিছুকে স্তব্ধ করে দিয়ে নেমে এল তরুণী কন্যারা হিন্দোলা ছেড়ে।
সামনেই বৃত্তাকার স্ফটিক নির্মিত পুষ্পপত্ৰ আচ্ছাদিত লতামণ্ডপ। সেখানে দ্বাদশটি সখী খুলে ফেলল তাদের অঙ্গবাস। প্রতি তরুণের হৃদস্পন্দন যেন বন্ধ হয়ে আসছিল।
তরুণীরা কঙ্কতিকা চালিয়ে কেশগুচ্ছ বিন্যাস করল। তারপর চুড়া করে বেঁধে নিল কেশকলাপ। | হংসশ্রেণি জলের বুকে ছােট ছােট তরঙ্গ তুলে এগিয়ে আসছিল। সহসা করতালি দিতে দিতে হটে গেল দ্বাদশটি তরুণী। তারা প্রায় একই সঙ্গে ডানা মেলে শ্বেত রাজহংসীর মতাে ঝাপিয়ে পড়ল জলে।
হংসের শ্রেণি এখন দ্রুত পাখা টেনে ঢেউ কেটে পালাচ্ছে বিপরীত মুখে। তাদের পশ্চাতে। তাড়া করে চলেছে সন্তরণ-পটু কন্যারা। হংসপক্ষ সঞ্চালিত জলবিন্দু এসে পড়ছে পশ্চাদবর্তী কন্যাদের চোখে মুখে আর কেশশুচ্ছে। ঠিক যেন মুক্তোর মালায় সজ্জিত হয়েছে কেশকলাপ।
এবার শুরু হল জলকেলি। ডুব দিয়ে কোনও কন্যা অন্যজনের চরণ ধরে আকর্ষণ করছে। কেউ বা সবলে নিমজ্জনের ব্যবস্থা করছে কোনও দুর্বল সখীর। কোনও তরুণী কটিদেশ জলমগ্ন করে মুখের জল ফুৎকারে ছুড়ে দিচ্ছে শূন্যে। অমনি সেই জলকুয়াশায় সূর্যালােক পড়ে সৃষ্টি করছে বর্ণাঢ্য ইন্দ্রধনু।
নাচুড়ায় সেই ইন্দ্রধনুর লীলা দেখে মনে হচ্ছিল, সুমেরু শিখরে রামধনু উদিত হয়েছে। জলক্রীড়া শেষ করে সােপানে চরণ-স্পর্শ রেখে উঠে আসছিল কন্যারা। তারা কেশগুচ্ছ থেকে জল নিষ্কাশন করে আবার তা চুড়াবদ্ধ করে নিচ্ছিল। সহসা কোথা থেকে ছুটে এল এক ঝলক ঘূর্ণি হাওয়া। পলাশ, শিমুল, বকুলের ফুল ঘুরতে লাগল একাকার হয়ে। সেই ঘূর্ণিতে লতামণ্ডপে তরুণীদের রেখে দেওয়া বেশবাস উড়ে চলল ইতস্তত। এখন তরুণীরা ক্ষিপ্র পদসঞ্চালনে এক একটি বস্তু কুড়িয়ে নিয়ে আবৃত করতে লাগল অঙ্গ।
অসুররাজ বৃষপর্বার কন্যা শর্মিষ্ঠা ছুটে গেল জল-কিনারায়। যে বস্ত্রখানি জল স্পর্শ করতে চলেছিল সেখানি এস্তে আকর্ষণ করে জড়িয়ে নিল অঙ্গে।
সঙ্গে সঙ্গে সেখানে ছুটে এল আর এক তরুণী। শর্মিষ্ঠার দিকে তঞ্জনী তুলে বলল, আশ্চর্য স্পর্ধা তােমার শর্মিষ্ঠা, আমার বস্ত্র তুলে তােমার দেহ আবৃত করছ।
বিশ্বাস করাে দেবযানী, তােমার আর আমার পরিধেয়ের বর্ণ প্রায় এক, তাই ভুল হয়ে গেছে। ক্রুদ্ধ দেবযানী বলল, ভুল কক্ষনও নয়, এ তােমার ইচ্ছাকৃত।
শর্মিষ্ঠা এবার নিজেকে স্থির রাখতে পারল না। কঠোর কণ্ঠে বলল, সত্যিই আমি নির্বোধের মতাে কাজ করেছি। আমার বােঝা উচিত ছিল একজন দানগ্রহণকারী ব্রাহ্মণ কন্যা আর একজন রাজকন্যার বস্ত্র কখনও এক হয় না।
কী বললে?
যা সত্য তাই বললাম! তুমি আমার পিতার গুরু শুক্রাচার্যের কন্যা, তাই তােমাকে সমাদরে আমাদের দলে টেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু আমি জানতাম না তােমার ব্রাহ্মণত্বের এত অহংকার।
নিশ্চয়ই। শ্রেষ্ঠ বর্ণে জন্মেছি, অহংকার থাকবে না! দেবতাদের সঙ্গে যুদ্ধে যখন তােমার দানবকুলের যােদ্ধারা নিহত হয় তখন মৃতসঞ্জীবন সুধা দিয়ে কে বাঁচায় তাদের? তাই তাে আমার পিতাকে তােমার পিতা মাথার মুকুটমণি করে রেখেছে।
তােমার পিতার কথা আর বােলাে না দেবযানী। সভার কাজ শেষ করে যখন আমার পিতা বিশ্রামগুহে যান তখন তােমার পিতা শুক্রাচার্য তার পশ্চাতে গমন করেন। পিতা যখন অর্ধশায়িত থাকেন তখন তােমার পিতা নিশ্লাসনে বসে তার সাংসারিক প্রার্থনা জানিয়ে যান। পিতা সেগুলি মজুর করলে তবেই তােমাদের ভরণপােষণ চলে।
একটু থেমে আবার বলল, এই যে বস্তুটি তুমি পরছ, এ-ও আমার পিতার কাছ থেকে ভিক্ষা করে নেওয়া।
গুরুকন্যার সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় তা জানাে না, বলেই ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে শর্মিষ্ঠার কেশাকর্ষণ করল দেবযানী।
সঙ্গে সঙ্গে প্রলয় ঘটে গেল। শর্মিষ্ঠা সজোরে আঘাত করে দেবযানীকে ফেলে দিল জলে। তারপর দেবযানীর বস্ত্র মাটিতে ফেলে রেখে সখীদের নিয়ে দৃপ্ত পায়ে চলে গেল স্থান ত্যাগ করে।
তরুণ অশ্বারােহী সব কিছুই লক্ষ করলেন। কন্যারা যখন কানন থেকে নিষ্ক্রান্ত হল তখন তরুশ সন্ধান পেলেন প্রবেশ পথের। তারপর তারা দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলে তিনি প্রবেশদ্বার দিয়ে দ্রুত অগ্রসর হলেন। | দেবযানী সরণে অপটু ছিল না, কিন্তু সে যে স্থানে পড়েছিল সে স্থানটি দৃঢ় জলজ উদ্ভুিদে পূর্ণ হয়েছিল। শত চেষ্টাতেও দেবযানী সেই উদ্ভিদের তন্তু বন্ধন ছিন্ন করতে পারল না। তার মুক্তির আকুলতা যত বাড়ল, বন্ধন তত দৃঢ় হল।
তরুণ সরােবর তীরে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি? | কাতর কণ্ঠে দেবযানী বলল, আপনি ঈশ্বরপ্রেরিত। আমি মৃত্যু-পাশে জড়িয়ে পড়েছি, দয়া করে উদ্ধার করুন।
তরুণ তখন শর্মিষ্ঠা-পরিত্যক্ত বস্ত্রখানি ভূমিতল থেকে তুলে নিয়ে একপ্রান্ত ধরে অন্য প্রান্ত ছুড়ে দিলেন দেবযানীর দিকে। দেবযানী বন্ধুপ্রান্ত ধারণ করলে তিনি সজোরে তাকে আকর্ষণ করলেন কুলের দিকে। ছিন্ন হয়ে গেল বহ্মনপাশ, কিন্তু সেই মুহূর্তে বসন্তস মন দুটি তরুশ তরুণীর হৃদয়কে আর এক বন্ধন-পাশে বেঁধে ফেললেন।
অগভীর জলে দাড়িয়ে দেবযানী বলল, আমার বসনখানি সিঞ্চ, তাই এ বস্ত্র পরিধান করে আপনার সম্মুখে দাঁড়ানাে আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
বিপরীত দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে তরুণ যুবা পুরুষটি বললেন, আমার মস্তকের উষ্ণীষটি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের এক বস্ত্রখণ্ড দিয়ে তৈরি। আপনার অসম্মতি না থাকলে আমার উষ্ণীষ আপনার অঙ্গ স্পর্শ করে ধন্য হতে চায়!
দেবযানী অপরিচিত যুবার কথায় রােমাঞ্চিত হল। সে গ্রহণ করল তরুণের উষ্ণীষ। তা থেকে সযত্নে রত্নমালা মুক্ত করে সে পরিধান করল।
তীরে যখন দেবযানী উঠে দাঁড়াল তখন তাকে জলকন্যা বলে ভ্রম হচ্ছিল।
দেবনাই প্রথমে কথা বলল, আপনি আমার প্রাণদান করলেন, আমি চিরদিন আপনার কাছে ঋণী হয়ে রইলাম।
যুবাপুরুষ এতক্ষণে দেবযানীর দিকে ফিরে বললেন, আমি তৃষ্ণায় কাতর হয়ে সম্পূর্ণ অপরিচিত এই কাননভূমিতে এসে পড়েছিলাম। আপনাকে দেখে আমার তৃষ্ণা দূর হল।
কপট কৌতুকে দেবযানী বলল, আমি তাে জানি, তৃষ্ণা কোনওদিন দূর হয় না। ঘনিষ্ঠ হতে চাইলেন তরুণ, কী নাম তােমার?
অন্তরঙ্গতার স্পর্শে রােমাঞ্চিত হল দেবযানী। বলল, আমি দানবগুরু মহর্ষি শুক্রাচার্যের কন্যা। দেবযানী আমার নাম। কিন্তু আমার প্রাণদাতার পরিচয়টি এখনও জানা হয়নি আমার।
আমি মহারাজ নহুষের পুত্র যযাতি।
দেবানী সসম্রমে বলল, মহারাজ নহুষের নাম ভুবনবিদিত। শুনেছি তার দেহান্তরাপ্তি হয়েছে। | তােমার অনুমান সত্য কন্যা। তাই এ নবীন বয়সে পিতৃসাম্রাজ্য রক্ষার গুরুদায়িত্ব আমার ওপর এসে পড়েছে।
আশ্চর্য, আপনি মহারাজ যযাতি। আমার প্রগলভতা মার্জনা কৱে সশ্রদ্ধ অভিবাদন গ্রহণ
আপনি ব্রাহ্মণকন্যা, আমি ক্ষত্রিয়, তাই বর্ণশ্রেষ্ঠের প্রতি আমার অভিবাদন জানাচ্ছি। দেবযানী সসংকোচে বলল, আমি সামান্য নারী, আপনার মতাে মহাসম্মানীয় ব্যক্তির অভিবাদন গ্রহণের যােগ্য নই। আমার পিতার প্রতি সম্মান জানালে সেটি শােভনীয় হয়। তােমার পিতার চরণ দর্শন করা কি সম্ভব হবে।
ক্ষণকাল চিন্তা করে দেবযানী বলল, মহারাজ, একটি গুরুতর সমস্যার সমাধান আগে আমি করে নিতে চাই। তারপর আপনাকে পিতার সম্মুখে উপস্থিত করার বাসনা। আপনি কি সপ্তাহ অন্তে এই কনস্তে আর একটিবার দর্শন নিয়ে যেতে পারেন না?
তােমার ইচ্ছার কাছে আমি আত্মসমর্পণ করছি না। একটি তরুণী হরিণীকে অরণ্য মধ্যে দেখতে পেয়ে আমি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। তাকে শরাঘাত করতে পারিনি। অশ্ব ফুটিয়ে তাকে ধরে বন্দি করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে চোখের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যাবার আগে এতদুর পথ আমাকে আকর্ষণ করে এনেছে। | দেবযানী সকৌতুকে বলল, এমনও তাে হতে পারে মহারাজ সে হরিণী আপনার আয়ত্তের বাইরে চলে যায়নি। তাকে তাড়না না করে হৃদয়ের আমন্ত্রণ জানালে হয়তাে সে নিয়ে এসে ধরা দেবে।
রাজা যযাতি কৌতুকের অর্থ বুঝলেন। তিনি বললেন, আমার মনে হয় সেই পলাতকা হরিণীটি মায়াবী। সে আমার প্রাণে তৃষ্ণা জাগিয়ে এই সরােবর তীরে আকর্ষণ করে এনেছে। তারপর কখন তার রূপ বদলে এক পরমা সুন্দরী কন্যায় রূপান্তরিত হয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
ধরা পড়ে গিয়ে রক্তারুণ হয়ে উঠল দেবযানীর মুখমণ্ডল। সে কথাস্তরে যাবার চেষ্টা করে বলল, এই নিন মহারাজ আপনার মুক্তামালা। এটি সূত্র দিয়ে জড়ানাে ছিল আপনার উল্লীষে।
মালাটি হাতে নিয়ে যযাতি বললেন, এটি উষ্ণীষেরই মালা। এখন উষ্ণীষ যার অধিকারে এ মালাও তার। অনুমতি হলে এ মালাটি তার হাতেই ফিরিয়ে দিই।
দেবযানী মন্ত্রক নত করল। রাজা যযাতি দেবযানীর হৃদয়ের ভাষা পাঠ করে পুলকিত হলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে তুলে ধরলেন দেবযানীর আনত মুখ। কণ্ঠে পরিয়ে দিলেন মুক্তার মালা।
দেবযানীর চোখ দুটি বন্ধ হয়ে এল। দুটি নিটোল মুক্তা বিন্দু গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। তুমি কাদছ দেবযানী?? আনন্দের ভার বইতে পারছি না বলে। তুমি সম্মতি দিলে রাজা যযাতি তার পরিপূর্ণ প্রতিশ্রুতি দেবে দেবযানী।
আমি কুমারী মহারাজ। পিতার অধীন। আমার ইচ্ছা থাকলেও স্বেচ্ছাচারী হবার অধিকার নেই। তাই এ সপ্তাহের অন্য দিনটিতে আপনাকে এই বনপ্রান্তে আসার অনুরােধ জানিয়েছি।
অন্তরে অনির্বাণ আকাক্ষার আগুন জ্বালিয়ে নিয়ে স্বরাজ্যে ফিরে গেলেন মহারাজ যযাতি। দেবযানী আশ্রম কুটিরে ফিরে এলে উদ্বিগ্ন শুক্রাচার্য বললেন, এত বিলম্ব কেন মা? প্রভাতে মান সমাপন করে তুমি সত্বর তরুআলবালে জলসিঞ্চন করাে, আজ তার ব্যতিক্রম ঘটেছে। ধেনুগুলি এখনও অভুক্ত, তারা তােমার হাতে ছাড়া আহার্য গ্রহণ করে না। নিশ্চিত কোনও বিপর্যয়ে পড়েছিলে, না হলে এত বিলম্ব তােমার দ্বারা সম্ভব নয়। আমি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন রয়েছি
পিতার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে কান্নায় ভেঙে পড়ল দেবযানী। বিস্মিত শুক্রাচার্য কন্যাকে বুকে টেনে নিয়ে বললেন, কী হয়েছে মা? আমি আর এ রাজ্যে থাকতে চাই না বাবা। আমাকে পরিষ্কার করে সকল কথা খুলে বলে। রাজা বৃষপর্ব যদি আমার পিতার চেয়ে সম্মানে বড় হন, আর তার প্রদত্ত অন্ন বস্ত্র ছাড়া। যদি আমাদের ভিক্ষাবৃথি অবলম্বন করতে হয়, তা হলে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু ভাল।
তুমি এসব কী বলছ?
আমি ঠিক বলছি বাবা। আজ স্নানের ঘাটে শর্মিষ্ঠা আমাকে এসব কথা বলেছে। তুমি নাকি রাজার কাছে সব কিছু প্রার্থনা করে নাও।
কুদ্ধ শুক্রাচার্য বললেন, আমি কারু দয়ার দান গ্রহণ করি না। যুদ্ধে মৃত দানবদের সঞ্জীবনী সুধার প্রভাবে বাঁচিয়ে দিই তাই রাজা আমাকে কিছু দিতে পেরে কৃতার্থ হয়।
দেবযানী বলল, আমাকে শর্মিষ্ঠা জলজ উদ্ভিদে পূর্ণ মৃত্যুর ফাদে ঠেলে ফেলে দিয়ে পালিয়ে যায়, এক দয়ালু রাজা সেই মহা বিপদ থেকে আমাকে উদ্ধার করেন।
আশ্চর্য! এ সকল ঘটনার কিছুমাত্র আমার গােচরে ছিল না।
দেবযানী বলল, আমি অপরাধীর শাস্তি চাই বাবা। আর পুরস্কৃত করতে চাই আমার প্রাণদাতাকে। না হলে এ দেশ আমি ত্যাগ করব।
শুক্রাচার্য দেবযানীকে সঙ্গে নিয়ে চললেন রাজ-সন্নিধানে। গুরু শুক্রাচার্যকে দেখে সিংহাসন থেকে নেমে এসে রাজা বৃষপর্ব পাণ্যার্থ দান করলেন। অতঃপর উপযুক্ত আসনে পিতা-পুত্রীকে বসিয়ে নিজে সিংহাসনে বসে বললেন, কী করণীয় আমায় আদেশ করুন প্রভু।
শুক্রাচার্য বললেন, তােমার কাছে বিচারের প্রত্যাশায় এসেছি। কীসের বিচার প্রভু? কে সেই অপরাধী যে রাজগুরুকে অসম্মান করতে সাহস পায় ? তােমার কন্যা। শর্মিষ্ঠা।
হ্যা, তােমার কন্যা শর্মিষ্ঠা। আমি তােমার কাছে ভিক্ষা করে অন্ন বস্ত্রের সংস্থান করি। আজ স্নানের ঘাটে তােমার কন্যা দেব্যানীকে এসব কথা বলেছে। শুধু তাই নয়, সে আমার কন্যাকে জলের মধ্যে ফেলে হত্যা করতে চেয়েছিল। দেবযানী আর একটি দিনও এ রাজ্যে থাকতে চায় না। আমিও মনে মনে চিন্তা করেছি, যেখানে শ্রদ্ধা নেই সেখানে অবস্থান করা কোনও মতেই শ্রেয় নয়।
রাজা সিংহাসন থেকে নেমে এসে গুরুর কাছে করজোড়ে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনি অনুগ্রহ করে আমাকে পরিত্যাগ করবেন না প্রভু। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, আপনার কন্যা শর্মিষ্ঠাকে যে শাস্তি দেবে তা শর্মিষ্ঠা পালন করতে বাধ্য থাকবে।
এরপর রাজা বৃষপর্ব দেবযানীকে লক্ষ করে বললেন, বলাে দেবযানী, তুমি তােমার সখী শর্মিষ্ঠাকে কীরূপ শাস্তি দিতে চাও?
স্পষ্ট কণ্ঠে দেবযানী বলল, ওর অহংকার চুর্ণ হােক আমি চাই। ও সারাক্ষণ অনুগত দাসীর মতাে থাকবে আমার সঙ্গে সঙ্গে।
রাজা বৃষপর্বা বললেন, অবশ্যই তােমার ইচ্ছা পালিত হবে দেবযানী।
রাজা বৃষপর্ব ডেকে পাঠালেন শর্মিষ্ঠাকে। শর্মিষ্ঠা নতমুখে এসে দাঁড়াল সভার সামনে। রাজা সমস্ত ঘটনা ব্যক্ত করে বললেন, তুমি অপরাধী, সুতরাং দেবযানীর দেওয়া শাক্তি গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত হও।
শর্মিষ্ঠা বলল, আমার মানবকুলের মঙ্গলের জন্য এ শান্তি আমি মাথা পেতে নিলাম।
আশ্রম কুটিরে ফিরে এসে দেবানী শুক্রাচার্যকে বলল, বাবা আমি আমার প্রাণদাতার কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কীসের প্রতিশ্রুতি মা? যে প্রাণ উনি দয়া করে রক্ষা করেছেন সেই প্রাণ ওঁকে উৎসর্গ করতে চাই।
আমার কোনও অসম্মতি নেই দেবযানী। যে তােমার প্রিয় সে আমার স্নেহের ছাগী। তা ছাড়া যযাতি রাজচক্রবর্তী।
নির্দিষ্ট দিনে যযাতি এলেন রাজা বৃষপর্বার সেই কাননে। তার জন্য প্রতীক্ষা করে বসে ছিল দেবযানী। রাজা যযাতি এলে তাকে পিতার কাছে নিয়ে এল সে। যযাতি অভূমি লুষ্ঠিত হয়ে প্রণাম করলেন অসুরগুরু শুক্রাচার্যকে
আসন গ্রহণ করাে পুত্র। যযাতি মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইলেন। উপবেশন করাে মহারাজ যযাতি। প্রভু, আপনি আসন গ্রহণ না করলে আমি তাে উপবেশন করতে পারি না।
শুক্রাচার্য বললেন, আমি তােমার শিষ্টাচার পরীক্ষা করছিলাম যযাতি। যথার্থই মহৎ বংশে জন্ম তােমার।
নিজে শুক্রাচার্য আসন গ্রহণ করে রাজা যযাতিকে পাশে বসালেন। রাজ্যের কুশল তাে? দেব-দ্বিজ আর প্রজাকুলের শুভেচ্ছায় রাজ্যের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল প্রভু।
তুমি যে প্রজাকুলকে তােমার রাজ্যের কুশলের সঙ্গে জড়িত করলে সেজন্যে তােমার রায়ের স্থায়িত্ব সম্বন্ধে আমি নিঃসন্দেহ হলাম।
দেবযানী পিতাকে অভ্যস্তরে আহ্বান জানিয়ে বলল, অতিথি সৎকারের ব্যবস্থা হয়েছে।
শুক্রাচার্য যযাতির কর ধারণ করে অভ্যন্তরে নিয়ে গেলেন। সেখানে ফলাহারের আয়ােজন ছিল। আচমনের জল নিয়ে রাজা যযাতি হস্তমুখ প্রক্ষালন করলেন। তার পর শুক্রাচার্য উপবেশন করলে তিনি আসন গ্রহণ করলেন।
যৎকিঞ্চিৎ ফলাহারের পর শুক্রাচার্য রাজা যযাতিকে নিয়ে গেলেন আশ্ৰমবেদিকায়। সেখানে হরীতকী আস্বাদন করতে করতে শুক্রাচার্য বললেন, দেবযানী ‘আমার প্রাণাধিক কন্যা। সে উপযুক্ত কারণেই তােমাতে আসক্ত হয়েছে। এখন তুমি তােমার অন্তরে কোনও দ্বিধা না রেখে দেবযানীকে পত্নীরূপে গ্রহণ করতে ইচ্ছুক কিনা বলাে?
আপনি আদেশ করলে আমি শুচিশুদ্ধা দেবযানীকে উপযুক্ত মর্যাদা দিয়ে রাজগৃহে নিয়ে যাই।
শুক্রাচার্য বললেন, যখন তােমরা পরস্পরকে উপযুক্ত কারণে হৃদয় দান করেছ তখন আমার আন্তরিক সম্মতি অবশ্যই পাবে। কিন্তু উভয়ের মিলনের পূর্বে আমার কয়েকটি কথা
উৎসুক শ্রোতার ভূমিকায় উৎকর্ণ হয়ে বসে রইলেন রাজা যযাতি। একটু চিন্তামগ্ন থেকে শুক্রাচার্য বললেন, বড় আদরের কন্যা আমার দেবযানী। বড় অভিমানী সে। তুমি উচ্চ কুলােব সত্য কিন্তু দেবযানী সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণকুলে জন্মলাভ করেছে। সে যখন স্বেচ্ছায় তোমাকে বরণ করেছে তখন আমার দিক থেকে কোনও প্রতিবন্ধকতা। থাকতে পারে না। শুধু একটি বাক্য তােমাকে দান করতে হবে যযাতি। বলুন প্রভু।
আমার কন্যা অদ্বিতীয়া হয়ে থাকবে তােমার অন্তপুরে, কেবল এই প্রতিশ্রুতি আমি তােমার কাছে চাই।
আমি এ বিষয়ে আপনাকে বাক্যদান করছি প্রভু। দেবযানী ছাড়া আমার অন্তঃপুরে দ্বিতীয় কোনও মহিষী থাকবে না। | তােমার প্রতিশ্রুতি পেয়ে অন্তরে বড় শান্তি লাভ করলাম যযাতি। আমি এখন মুক্তচিত্তে তােমাকে কন্যা সম্প্রদানে প্রস্তুত।
দানবরাজ বৃষপর্ণা দেবযানীর বিবাহের উপযুক্ত আয়ােজন করে দিলেন। তিনি ও তাঁর মহিষী সর্বক্ষণ উপস্থিত থেকে দেবযানীর বিবাহ সুসম্পন্ন করলেন।
পতিগৃহে যাত্রাকালে সুসজ্জিত চতুর্দোলায় আরােহণ করল দেবযানী, আর দাসী শর্মিষ্ঠা আরােহণ করল সাধারণ এক শিবিকায়।
রাজকন্যা আজ ভাগ্যদোষে দাসী। শর্মিষ্ঠা পরিধান করল না কোনও মূল্যবান বস্ত্রালঙ্কার। সে অতি সাধারণ পরিচারিকার বেশে মহারানি দেবযানীর চতুর্দোলার পাশে পাশে শিবিকা আরােহণে রাজপুরীর উদ্দেশে যাত্রা করল। পিতামাতা নীরবে অশ্রু মােচন করলেন। কিন্তু আশ্চর্য শর্মিষ্ঠা। পিতৃরাজ্য ছেড়ে চলে যাবার সময় তার চোখে একবিন্দু অশ্রু কেউ দেখল না। একটি বাক্যও উচ্চারিত হল না তার মুখ দিয়ে। শর্মিষ্ঠার সখীরা রাজকন্যার এই পরিণতিতে অঝোরে ঝরাল চোখের জল।
রাজগৃহে সপ্তদিবস উৎসব অবসানে যখন সকলেই ক্লান্ত অবসন্ন তখন শয়নগৃহে প্রবেশ করতে গিয়ে রাজা যযাতি থমকে দাঁড়ালেন। সুসজ্জিত শয্যায় দেব্যানী ন্দ্রাচ্ছন্ন, তার চরণ সংবাহন করছে একটি কান্তিময়ী কন্যা। গৃহকোণে রক্ষিত মণি দীপাধারে প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ। আলাে আঁধারের রহস্যময় লীলায় কন্যাটিকে বড় রহস্যময়ী বলে মনে হল। রাজা গৃহে প্রবেশ না করে অলিন্দে দাঁড়িয়ে কতক্ষণ দেখলেন ন্যাটিকে। যদিও সে পরিচারিকার কাজ করছিল তবু রাজা যযাতির অভিজ্ঞ চোখ তাকে পরিচারিকা বলে মেনে নিতে পারল না।
কতক্ষণ এমনি পদসংবাহনের পর যখন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন দেবযানী পার্থ পরিবর্তন করল তখন চরণতলে রক্ষিত গাত্রবস্ত্রখানি বক্ষ পর্যন্ত টেনে দিয়ে উঠে এল কন্যাটি।
অলিন্দের এক পার্শ্বে রক্ষিত দীপটি তখন বায়ুতাড়িত হয়ে নিভে গেছে। অন্ধকারে চিত্রার্পিতের মতাে দাঁড়িয়ে আছেন রাজা যযাতি।
পরিচারিকাটি রহস্যময় আলােকে উদ্ভাসিত গুহ থেকে অন্ধকার অলিন্দে প্রবেশ করলে রাজা যযাতি তার পথরােধ করে মৃদু কণ্ঠে বললেন, কে তুমি কন্যা ?
প্রভু আমি মহারানির পরিচারিকা।
মহারাজ বললেন, তােমার কাজ থেকে তা প্রমাণিত হলেও তােমার সারা অবয়বের কোথাও সে প্রমাণ নেই।
মহারাজ, সামান্য পরিচারিকা ছাড়া অন্য কোনও পরিচয় আজ আর আমার নেই। তুমি কি মহারানির পিত্রালয় থেকে এসেছ? মহারাজের অনুমান যথার্থ। কী নাম তােমার পিতার ? মহারাজ, প্রশ্ন করে আমাকে বিব্রত না করলে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব। কিন্তু কন্যা, পিতার নাম জিজ্ঞাসার পর নিরুত্তর থাকার একটি মাত্রই কেবল অর্থ হয়। আর সে অর্থ তােমার মতাে বুদ্ধিমতী কন্যার অজানা থাকার কথা নয়।
অন্ধকারে রাজা যতি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্নার শব্দ শুনতে পেলেন। তিনি কোন সহৃদয় স্বরে বললেন, আমি তােমাকে আঘাত করতে চাইনি কন্যা। তুমি পরিচারিকা, এ সত্যটুকু স্বীকার করে নিতে আমার মন চাইছে না। ঠিক আছে, পরিচয়দানে বাধা থাকলে তােমাকে পীড়িত করব না।
কন্যা বলল, আপনার সহৃদয় বাক্য আমার মনের ক্ষতে শান্তির প্রলেপ বলে মনে হচ্ছে। আমি আপনাকে পরিচয় দিতে পারি কিন্তু সামান্য একটি প্রতিশ্রুতি আমাকে দিতে হবে। বলাে কীসের প্রতিশ্রুতি, নিশ্চয়ই তা রক্ষিত হবে।
আমি যে মহারাজকে আমার পরিচয় দিয়েছি একথা যেন আমাদের মহামান্যা মহারানির কাছে প্রকাশ না পায়।
কথা দিচ্ছি, কোনও রকমেই তা মহিষীর কর্ণগােচর হবে না। আমি দানবরাজ বৃষপর্বার একমাত্র কন্যা শর্মিষ্ঠা। তুমি সেই দানবকন্যা যে দেবযানীকে পুষ্করিণীতে মৃত্যুর মাঝে ফেলে দিয়েছিল?
একটি বচসার পরিণতিতে আমি তাকে সরােবরে ঠেলে ফেলে দিই সত্য, কিন্তু তার মৃত্যু হােক, এ আমি অন্তর থেকে চাইনি। আমি জানতাম না মহারাজ যে সরােবরের ওই অংশে কঠিন মৃত্যুর ফান পাতা আছে। আমি সহজ বিশ্বসেই জানতাম, সস্তরণ পটু দেবযানী সহজেই জল থেকে উঠে আসবে।
আমি তােমার কথায় সম্পূর্ণ বিশ্বাস করছি শর্মিষ্ঠা। আমি ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম। পত্রান্তরাল থেকে সবই আমি দেখেছি। আমিই তােমরা চলে যাবার পর জলাশয় থেকে দেবযানীকে উদ্ধার করি।
শর্মিষ্ঠা বলল, ঘটনা যাই হােক, আমি যখন ওকে জলে ফেলেছি তখন আমিই অপরাধী মহারাজ। আর আমার সে অপরাধের শাস্তি দিয়েছেন আমার পিতা দেবযানীর ইচ্ছা অনুযায়ী। আমি নতমস্তকে দেবযানীর দাসীত্ববরণ করেছি।
মহারাজ যযাতি দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করে বললেন, বিধাতার কী নিষ্ঠুর পরিহাস। মহাশক্তিধর সানরাজকন্যার এ কী পরিণতি!
মহারানি হয়তাে আপনার প্রতীক্ষায় রয়েছেন মহারাজ, আপনি গৃহে প্রবেশ করুন। তুমি বিলক্ষণ জানাে শর্মিষ্ঠা, দেবযানী নিদ্রাগতা। শর্মিষ্ঠা বলল, সুপ্তি যে-কোনও মুহূর্তে জাগরণে রূপান্তরিত হতে পারে। তােমার সেবা মহারানির সুপ্তিকে গাঢ় করেছে শর্মিষ্ঠা।
তবু বলি মহারাজ, আপনার সঙ্গে এই অন্ধকার অলিন্দে এক দাসীর বাক্যালাপ শােনও নয়, সমীচীনও নয়।
মহারাজ যযাতি বললেন, আজ তােমাকে মুক্তি দিলাম শর্মিষ্ঠা, কিন্তু রাজকন্যা শর্মিষ্ঠা দাসী, এ কথা আমার অন্তর থেকে কোনওদিন মুছে যাবে না। ‘প্রভু, দাসীকে মনে রেখে কী লভি আপনার?
এখানে লাভালাভের প্রশ্ন নয় শর্মিষ্ঠা। একটা অসত্য অবিচারকে নীরবে মেনে নেবার ভেতর মনের একটা প্লানি থেকে যায়। তােমাকে যে মুহূর্তে দেখব সেই মুহূর্তে মনে পড়ে যাবে বিরাট এক অবিচারের কথা, যার প্রতিকারের কোনও পথ নেই। রাজা হয়ে এই অক্ষমতার কথা অন্তর থেকে মুছে ফেলি কী করে বলাে। তাই একটি অবিচার আর একটি নারী চিরদিন গাঁথা হয়ে থাকবে আমার অন্তরে।
একটু থেমে রাজা যযাতি বললেন, শর্মিষ্ঠা, বিধাতার ইচ্ছা হলে আমাদের দেখা হবে পুনর্বার। এখন রাত্রি গভীর হল। তােমার আমার উভয়েই বিশ্রামের প্রয়ােজন।
অন্ধকারে একটি প্রণাম নিবেদিত হল রাজা যযাতির চরণে। যযাতিও কম্পিত একটি দেহ দুই বলিষ্ঠ বাহুতে ধারণ করে ভূতল থেকে তুলে ধরলেন।
এক নিশীথে দেবযানী রাজা যযাতিকে বলল, মহারাজ, আমার একটি অনুরােধ আছে। যযাতি বললেন, মহারানির যে-কোনও অনুরােধই মহারাজের কাছে আদেশ। পরিহাস নয় মহারাজ। আমার সমস্তু কথা শুনে কর্তব্য স্থির করুন। বলাে দেবযানী।
আমার পিত্রালয় থেকে একটি দাসী এসেছে। সে উচ্চবংশের কন্যা, কিন্তু একটি গর্হিত কাজের জন্য তার এই দাসীত্ব। তার সৌন্দর্য, আচার ব্যবহার রাজগৃহের সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তার সম্বন্ধে রাজপুরীর সকলেই কৌতুহলী। তাকে প্রশ্ন করে বিশেষ কিছু জানতে না পেরে পুরীরা আমাকে প্রশ্ন করতে শুরু করেছে। আমি চাই না পিতৃগৃহের কোনও ঘটনা এখানে প্রকাশ পাক, আর তাই নিয়ে রাজ-অপুরচারিণীরা অলস আলােচনায় মেতে উঠুক। | একটু থামল দেবযানী। মহারাজ যযাতি বললেন, এত ভাবনার কী আছে। দাসীটিকে মুক্তি দিয়ে তার পিতৃগৃহে পাঠিয়ে দাও, তা হলেই দেখবে দু’দিনে সব প্রশ্ন, সব কৌতুহলের অবসান হয়েছে।
না, তা হয় না মহারাজ। ও চিরজীবন আমার দাসীত্বের অঙ্গীকার নিয়েই এখানে এসেছে। যদি আপনি ওর জন্যে আপনার রাজ্যের কোনও নিভৃত উদ্যানে কুটির নির্মাণ করে দেন তা হলে সবার দৃষ্টির অলক্ষ্যে দাসীটি থাকতে পারে।
সে আর এমন কী অসাধ্য ব্যাপার দেবযানী। আমি অচিরেই তার ব্যবস্থা করছি। কিন্তু একটি প্রশ্ন, স্থানটি কি রাজগৃহের সন্নিকটে হবে না দূরে?
আমি দাসীটিকে রাজগৃহের কোনও সংশ্রবের ভেতরেই জড়াতে চাই না, তাই এ রাজ্যের মধ্যে যতটা দূরে সম্ভব তার বাসস্থানের ব্যবস্থা করলে ভাল হয়। | মহারানি, তােমার প্রস্তাব শিরােধার্য। পক্ষকালের ভেতর তােমার দাসী তার নতুন আবাসে যাত্রা করতে পারবে।
মহারাজ যযাতির আদেশে রাজ্যের প্রান্তসীমায় অবস্থিত কাননভূমিতে নির্মিত হল দাসী। শর্মিষ্ঠার নতুন বাসস্থান। সুপক্ক ফলভারে অবনত বৃক্ষ, কাননের শােভা ও সম্পদ বাড়িয়ে তুলেছিল। নির্জন কাননটি অহিংস শশক ও হরিণের নির্ভয় বিচরণক্ষেত্র। প্রভাত ও সন্ধ্যায় পাখিদের আনন্দ কুজনে সমস্ত বনস্থলী মুখরিত। একটি ক্ষুদ্র জলাশয় তার অতি স্বচ্ছ হৃদয়ে আকাশের গ্রহনক্ষত্র, মেঘপুঞ্জকে ধরে রেখে সুখতৃপ্ত গৃহবধুর মতাে অবস্থান করে। কাননের এক প্রান্তে এক মালীর কুটির। সে তার স্ত্রীর সঙ্গে বাস করে সেই কুটিরে আর কাননের রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিযুক্ত থাকে।
শর্মিষ্ঠা সেই নির্জন কাননভূমিতে এসে সুখী হয়ে উঠল। রাজা যযাতির আদেশে প্রভুভক্ত উদ্যানরক্ষক শর্মিষ্ঠার সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে দৃষ্টি রাখল।
এদিকে রাজপুরীতে দেবযানী আশ্বস্ত হল, শর্মিষ্ঠাকে নির্জন-নির্বাসনে পাঠিয়ে বারে বারে অকারণ কৌতূহলী প্রশ্নের মুখােমুখি হতে হল না তাকে।
সুখে দিন কাটে দেবযানীর। রাজা যযাতির শুধু প্রিয়তমা পত্নীই সে নয়, অদ্বিতীয়াও বটে। ধীরে ধীরে দেবযানীর নারীজীবনের পূর্ণবিকাশ ঘটল মাতৃত্বে। রাজা যযাতি লাভ করলেন প্রথম সস্তান। রাজগৃহে সে কী সমারোহপুর্ণ উৎসবের ঘটা। শুক্রাচার্যকে তৃপ্ত করতে দানবরাজ বৃষপর্ব পাঠালেন মহামূল্য উপহার নবজাতকের জন্য। কিন্তু বুকখানা বিদীর্ণ হয়ে গেলেও একবার খোঁজ নিতে পাঠালেন না কন্যা শর্মিষ্ঠার। | নবজাতকের আগমন উপলক্ষে রাজ্যের নানাস্থান থেকে এলেন সামন্ত নৃপতিরা। আত্মীয়স্বজনে রাজপুরী পূর্ণ, কিন্তু এই মহাব্যস্ততার মধ্যে একবারও সেব্যানীর মনে পড়ল না দাসী শর্মিষ্ঠার কথা। এ আনন্দযজ্ঞের কোথাও স্থান হল না শর্মিষ্ঠার। কেবল একজন সমস্ত হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে লাগল নির্জন কনবাসিনী শর্মিষ্ঠার ভারাক্রান্ত হৃদয়ের কথা।
উৎসব-দীপ প্রজ্জ্বলিত হয়েছিল, আবার তা নির্বাপিত হল। আত্মীয় বন্ধুজন ফিরে গেল যে যার আবাসে। রাজা যযাতি অবসর বুঝে একদিন একাকী অম্বারােহণে চললেন কাননভূমির দিকে।
একাকী দিন কাটে শর্মিষ্ঠার। রাজগৃহ থেকে ভােগ্যবস্তু এনে দেয় উদ্যানরক্ষক। তার স্ত্রী প্রয়ােজনে এসে দাঁড়ায় শর্মিষ্ঠার পাশে। কিন্তু পার্থিব সকল অভাব মিটে গেলেও কী এক অপূরণীয় অভাব শর্মিষ্ঠার শূন্য হৃদয় জুড়ে হাহাকার করতে থাকে।
সন্ধ্যায় চাঁদ উঠল অরণ্যশিল্পে। জলের দর্পণে আশ্চর্য প্রতিবিম্ব পড়ল তার। সরােবর সােপানে বসে অন্যমনে শর্মিষ্ঠা চেয়ে চেয়ে দেখছিল জল-দর্পণে চাদের উজ্বল ছবি, আর ভাবছিল নিজের ব্যর্থ জীবনের কথা। হঠাৎ তারই সমুখের জলতলে পড়ল একটি ছায়া। সে মুহুর্তে চমকিত হয়ে ফিরে তাকাতেই দেখল, মহারাজ যযাতি সহাসাে তার দিকে চেয়ে আছেন।
মহারাজ!
উঠে পড়াতে যাচ্ছিল শর্মিষ্ঠা, রাজা যযাতি তাকে বাধা দিয়ে বসালেন। নিজে বসলেন তার পাশটিতে।
শর্মিষ্ঠা সংকোচে সরে যেতে গিয়ে আবার বাধা পেল। তুমি তাে দাসী নও শর্মিষ্ঠা, তুমি রাজকন্যা। রাজরক্ত বইছে তােমার দেহে। আমাকে মান দিয়ে অপরাধী করবেন না মহারাজ। আমি মহারানি দেবযানীর ক্রীতদাসী।
যযাতি শর্মিষ্ঠার একখানি হাত ধরে বললেন, তুমি দেবযানীর দাসী হতে পারে কিন্তু আমার নও। আমার দৃষ্টিতে তুমি আজও সম্মানীয়া রাজকন্যা। যে-কোনও শ্রেষ্ঠ পুরুষের প্রার্থিত রমণীরত্ন তুমি।
পূর্ণচন্দ্রকে সাক্ষী রেখে সেদিন যযাতি আপন প্রসারিত বক্ষে টেনে নিলেন দানবকন্যা শর্মিষ্ঠাকে। বললেন, আজ থেকে দেবযানীর মতাে তােমারও রইবে এ বক্ষের ওপর পূর্ণ অধিকার। দাসী হয়ে এতবড় অধিকার প্রভু! না শর্মিষ্ঠা, এই মুহূর্ত থেকে তােমাকে দিলাম পত্নীর সমস্ত মর্যাদা।
দুটি হাতে আঁখি আবৃত করে কঁাদল শর্মিষ্ঠা। একটু শান্ত হয়ে বলল, কত মহৎ আপনি। কিন্তু মহারাজ, একটি অনুরােধ রক্ষা করতে হবে। নিশ্চয়ই রাখব শর্মিষ্ঠা। এবারও তা হলে আপনাকে গােপন রাখতে হবে আমাদের সত্যিকারের পরিচয়। কেন শর্মিষ্ঠা ?
দুটি কারণে মহারাজ। দেবযানীর কাছে রয়েছে আমার দাসীদের অঙ্গীকার। আর অন্য কারণটি হল, দেব্যানীর ক্রোধ থেকে মহারাজের পরিত্রাণ। | মহারাজ যযাতি কিছু সময় ভেবে বললেন, কিন্তু তােমাকে রাজপুরীতে না নিয়ে গেলে রানির পূর্ণ মর্যাদা তুমি পাবে কী করে?
রাজপুরী আমার আকাক্ষিত স্থান নয় মহারাজ। আপনার ভালবাসা পেয়েছি আমি। আজ আমার চোখে এই অরণ্য রাজগৃহের চেয়েও রমণীয়। সেখানে আমার রাজার ওপর সহস্র মানুষের অধিকার। রাজসভায় সভাসদ আর প্রজাকুল আপনাকে অধিকার করে থাকে, অন্তঃপুরে দেবযানী। এখানে নির্জনে যেদিন আপনি চরণধুলি দেবেন, সেদিনটি আর কারও নয়, একান্ত আমার। এ অরণ্য, দিনরাত্রি, এর চম্প্রসুর্য, পশুপক্ষী, ঋতু সবই আমাদের দু’জনের ভালবাসার সঙ্গে জড়িয়ে রইল। দেব্যানী থাক কোলাহল আর সম্পদ নিয়ে, আমাকে দিন অরণ্যের এই শান্তি। প্রথম প্রভাত, প্রথম ফুটে ওঠা কুসুম কলি, প্রথম পাখির কাকলি হােক আমাদের ভালবাসার রং, রূপ আর মন্ত্র। আমার প্রতীক্ষার পথ বেয়ে আপনি আসবেন, এর চেয়ে বড় পাওয়া আমার কী আছে মহারাজ।
তাই হবে শর্মিষ্ঠা। তুমি আজ থেকে হবে এ অরণ্যভূমির অধিশ্বরী। আমাদের এই গােপন মিলনের কথা জানবে শুধুমাত্র কাননরক্ষক। তার ওপরেই থাকবে তােমার পরিচর্যার ভার। আমি তার সততা, সেবা, প্রভুভক্তি লক্ষ করেছি, সে তােমার উপযুক্ত সেবক হতে পারবে।
মহারাজ, আপনার উদ্যানরক্ষক দেবলের স্ত্রী সরযু প্রতিদিন আমার খোঁজ নিয়ে যায়। সাধারণ কুলে তার জন্ম, কিন্তু মহারাজ, হৃদয় তার অনেক উচ্চ।
রাজা যযাতি বললেন, কতদিন তােমার কথা ভেবেছি শর্মিষ্ঠা কিন্তু পথ খুঁজে পাইনি। আজ তােমাকে নিজের করে নিতে পেরে আমার সকল খোঁজার শেষ হল।
আমি আজ আমার সব হারিয়ে যা পেলাম তা আমার জীবনের সবসেরা ধন, মহারাজ।
পঞ্চবর্ষের শিশু পুরু বনের আলােছায়ায় খেলা করে। নিরীহ হরিণ শিশু, চঞ্চল শশক, ক্ষিপ্রগতি কাঠবেড়ালি তার খেলার সঙ্গী। জন্মলগ্ন থেকে উদার প্রকৃতির সঙ্গে পুরুর পরিচয়ের শুরু। সে পরিচয় বয়সের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে চলেছে। শর্মিষ্ঠা তার এই দুরন্ত শিশুটিকে সামলাতে পারে না। এই আছে দৃষ্টির ভিতর, এই অন্তরালে! অরণ্যের আড়াল রচনা করে সে মায়ের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে। মাকে ভয় দেখিয়ে কাতর করে দিতে পারলে তার খেলার আনন্দ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে।
বাবা মানুষটি তার কাছে সম্পূর্ণ চেনা নয়, তাই এক রহস্য, কৌতুহল তাকে ঘিরে বিরাজ করে পুরুর শিশু-মনে।
রাজা যযাতি এসে পুত্র পুরুকে বুকে তুলে নেন। পুরু প্রথমে অপরিচয়ের দৃষ্টিতে বাবার মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখে। তারপর সন্দেহের অবসানে ভাব হয় বাবার সঙ্গে।
পুরুর সবচেয়ে পছন্দ বাবার অশ্বটি। পিতার সঙ্গে ওই দ্রুতগামী অশ্বে আরােহণ করে সে যখন কানন পথে ঘুরে বেড়ায় তখন যে তার আনন্দের শেষ থাকে না। এতে তার ক্লান্তি নেই। অশ্ব হতে বরং তার মা যখন তাকে নামিয়ে আনে তখন সে কান্নায় শক্ষিত করে তােলে সমস্ত কাননভূমি। | কোনও কোনও দিন রাজা যযাতি পুত্রের মাথায় পরিয়ে দেন তার মাথার মুকুট। কিন্তু আশ্চর্য, এই একটি ক্ষেত্রে পুরুর প্রতিবাদ সসাচ্চার হয়ে ওঠে। সে সঙ্গে সঙ্গে রাজমুকুট মাথা থেকে নামিয়ে ফেলে দেয়।
শর্মিষ্ঠা রাজার দিকে তাকিয়ে বলে, ও যে কোনওদিন রাজমুকুট পরবে না, এটা তারই প্রমাণ।
যযাতি বলেন, আমার ধারণা তােমার ঠিক উলটোটি শর্মিষ্ঠা। যে স্বেচ্ছায় মুকুট চায় না, মুকুট আপনিই তখন তার শিরে শােভা পায়।
এখন খেলার নতুন সাথী জুটেছে পুকুর। দেবল আর সরযুর একটি ফুলের মতাে ছোট্ট মেয়ে হয়েছে। সারাদিন সেই মেয়েটির সঙ্গে খেলা করে ক্লান্ত হয় না পুরু। মেয়েটি পুকুর আকস্মিক অত্যাচারে ভয় পায় না। পুরু তাকে জোরালাে শব্দ তুলে শাসন করতে গেলে সে তার সাদা কচি কচি দাঁতগুলি দেখিয়ে দেয়। তাই পুরুর কঠোর শাসনে কোনও সুফল দেখা দেয় না। | দুজনে প্রকৃতির নিয়মে আর মুক্ত প্রকৃতির সান্নিধ্যে ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠে। তাদের সহজ দৃষ্টি কেমন যেন জিজ্ঞাসু আর গভীর হতে থাকে। এতদিনের চেনা তারা তবু আজকাল দুজনের মাঝে কেমন এক অচেনা অজানার পরদা দুলতে থাকে।
সরযুর কন্যা শ্রুতি শর্মিষ্ঠার নয়নের মণি। শ্রুতির স্বভাবে, আচরণে এমন এক শান্ত, বিন ভাব আছে যা শর্মিষ্ঠার অন্তরকে গভীরভাবে আকর্ষণ করে। শ্রুতিকে দেখলে মনে হয় সে যেন ভােরের আকাশ। তার চোখের দ্যুতি যেন পুব আকাশের প্রতি তারার থেকে নেওয়া। তেমনই গিন্ধ, তেমনই উজল।
এক সন্ধ্যায় চাঁদ উঠেছে আকাশে। বনের পথে আলাে আঁধারের রহস্যময় আলপনা। কে যেন কমান্ত জুড়ে পরিচালনা করছে শ্রুতিমধুর এক সংগীতের আসর। | শর্মিষ্ঠার কুটিরে কথায় কথায় সন্ধ্যা নামলে ঘরে ফেরার জন্য চঞ্চল হয়ে উঠল শুতি। যদিও পথ বিগ্নসংকুল নয় তবু শ্ৰতিকে একা গৃহে পাঠাল না শর্মিষ্ঠা। পুরু চলল শ্রুতির সঙ্গী হয়ে। এই প্রথম কথা বলল পুরু, যে কথা আগে কোনওদিনই তার মুখে উচ্চারিত হয়নি। তুমি কত সুন্দর শ্রুতি।
এই আলােছায়ার আলপনা আঁকা পথের চেয়েও সে সুন্দর এই আলপনার ভেতর নেই।
খুঁজে দেখাে, বনের গাছে গাছে ডালে ডালে, ফুলে ফুলে আরও কত সুন্দর রয়েছে। সে সুন্দর সত্যিই চোখকে তৃপ্তিতে ভরে দেয় কিন্তু শ্রুতির সৌন্দর্য একেবারে আলাদা।
কী রকম? শ্রুতির সৌন্দর্য যে-কোনও একটি মনকে সুধায় ভরে দেয়। হঠাৎ শ্রুতি বলল, আমার মন কেমন করে উঠছে। তোমার কথা শুনে দু’চোখ কেন ভরে উঠল জলে। মনে হচ্ছে একটা ব্যথার ঝড় আমার সারা বুক জুড়ে বইতে শুরু করে দিয়েছে।
জানাে শ্রুতি, একে বুঝি ভালবাসা বলে।
শ্রুতি পুরুর একখানা হাত ধরে তার নিবিড় সান্নিধ্যে যেতে যেতে বলল, এর নাম যদি ভালবাসা হয় তা হলে ভালবাসার চেয়ে ভাল আর কিছু নেই।
এরপর বদলে গেল অরণ্যের রূপ। নতুন অর্থ নতুন ভাবনা নিয়ে এল ষড় ঋতু। অরণ্যে ফুল ফুটল সুতির জন্য। সে ফুল নিজের হাতে তুলে শ্রুতির খোঁপায় পরিয়ে দিল রাজকুমার পুরু। সেই মুহূর্তে ফুল আর ফুল রইল না, ক্ষতির কাছে সেই ফুলের আর এক নাম হল ভালবাসা।
দ্বিপ্রহরে প্রখর তপন তাপে যখন চরাচর স্তব্ধ তখন তরু শাখে ঘুঘু ডাকে। সে ক্লান্ত করুণ সুরে একটানা ডেকে যায়। শ্রুতির মনে হয় তারই অন্তরের কারা যেন ঘুঘুর করুণ সুরে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।
বর্ষার মেঘ বনস্থলীতে নেমে আসে এক বুক কান্না নিয়ে। দীর্ঘশ্বাস মােচন করতে করতে শুরু হয় অঝােরে বর্ষণ। সুতি কুটিরের নিভৃত বাতায়নে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার দুটি আঁখি নিরন্তর করে চলে অশ্রুপাত। | বসন্তের বনে রঞ্জিন উত্তরীয় ওড়ে। নিজের কুটির থেকে জননী শর্মিষ্ঠার কুটিরে যাবার পথে বারে বারে ধর্মকে দাড়ায় শুতি। অরণ্যের আড়ালে থেকে পুরু কি তার রঙিন উত্তরীয় উড়িয়ে তাকে কাছে ডাকছে। সহসা কোকিলের ডাকে এ কার আকুল করা আহ্বান।
জ্যোৎস্না রাতে নিজের শয্যায় শুয়ে ঘুম আসে না পুরুর। অরণ্যের কীটপতঙ্গ শুরু করে দেয় ঐকতান বাদন। মনে হয় কোনও নর্তকী সুরলােক থেকে নেমে এসে নৃত্য শুরু করে দিয়েছে জ্যোৎস্নালােকিত রাত্রির বনবাসরে।
কাকে দেখে চমকে শয্যায় উঠে বসে পুরু। ওই তাে কিংশুক বনে দাড়িয়ে আছে সে নর্তকী। জ্যোৎস্নার শুভ্র অবাসে তনুদেহটি ঢাকা। কে ওই নর্তকী, নীরবে দাঁড়িয়ে কার কাছে পাঠাচ্ছে তার বাণীহারা ব্যাকুল আহ্বান?
সহসা শয্যা ত্যাগ করে নিশীথে অরণ্যে নিশি-পাওয়া মানুষের মতাে ঘুরে ফেরে পুরু। তার মনে হয় ওই নর্তকী আর কেউ নয়, তারই মানসী শ্রুতি।
দানবরাজ বৃষপর্বার কন্যা পুরুর জননী। রাজগৃহে শৈশবকাল থেকেই তাকে শিক্ষা করতে হয়েছে নৃত্যগীতাদি কলাবিদ্যা। এই অরণ্যনিবাসে সে বিদ্যা ব্যর্থ হয়ে যেত যদি না শ্রুতিকে শিক্ষার্থিনীরূপে পেতেন জননী শর্মিষ্ঠা। শুতি আজ তারই কৃপায় নৃত্য-পটীয়সী।
একদিন অরণ্যের গভীরে চলে গিয়েছিল শ্রুতি আর পুরু। সেখানে প্রকৃতির খেয়ালে সৃষ্টি হয়েছিল আশ্চর্য এক লতাবিতান। মাঝে প্রস্তুরের মসৃণ এক বেশি। চতুর্দিকে সপ্তপর্ণীর সবুজ সমারােহ। তাদের প্রসারিত ডাল থেকে শূন্যে দােল খাচ্ছিল মালতীলতার পুষ্পস্তবক। সেই নিভৃত নৃত্য-মণ্ডপের মাঝখানে দাড়িয়ে সেদিন নাচের পরীক্ষা দিয়েছিল শ্রুতি পুরুর সামনে। | পুরুর মনে হয়েছিল, যে শ্রুতিকে সে এতকাল ধরে চিনে এসেছে এ সে নয়। ইন্দ্রসভার কোনও সুর-নর্তকী শ্রুতির রূপ ধরে নেচে চলেছে। কী অপূর্ব শিক্ষা শুতির। কে বলবে সামান্য এক উদ্যানরক্ষকের কন্যা সে!
একদিন রানি শর্মিষ্ঠার পূজাগৃহের দেবতার জন্য ফুলের মালা গেঁথে নিয়ে যাচ্ছিল শ্রুতি, পথে দেখা হল পুরুর সঙ্গে।
পুরু বলল, আজ রাজনৰ্তকীকে দেখছি মালিনীর বেশে। কার কণ্ঠের মালা নিয়ে চলে সংগােপনে।
দেবতার। ভাগ্যবান তােমার দেবতা। ভগবান কি ভাগ্যবান হন, যে তার সেবা করার সুযােগ পায় সেই নিজেকে ভাগ্যবান মনে
দেখি তােমার মালা, কী নিখুত গ্রন্থনা তােমার। সাদা লাল হলুদ ফুলগুলি চলেছে যেন শােভাযাত্রায়। বাঃ সবুজ পাতাগুলিকে কেটেছে ঠিক ফুলের মতাে করে। তােমার হাতের ছোঁয়ায় ধন্য হল গাছের ফুল।
তি বলল, আমরা উন্যানরক্ষক, মালাকার। গাছের ফুলেই আমাদের সকল কাজ। তাই বৃক্ষ আমাদের চোখে দেবতা। ছোটবেলায় মা-বাবার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরেছি কাননের অভ্যন্তরে। চিনেছি ফুল, লতা, পাতা, অজ গাছপালা। আবার যখন তারা ফুল তুলতে গেছেন তখন সাজি নিয়ে ঘুরে ফিরেছি সারা উদ্যানে।
যেদিন নিজে ফুল তুলতে বেরিয়েছি সেদিন প্রথমেই শুদ্ধ হয়েছি স্নান করে। তারপর বৃক্ষের কাছে বাবার শেখানাে প্রার্থনা উচ্চারণ করেছি।
হে বৃক্ষদেবতা, তুমি আমার অপরাধ নিয়াে না। আমার প্রতি প্রসন্ন হও। যিনি সকলকে সৃষ্টি করেছে সেই ঈশ্বরের উদ্দেশে নিবেদন করবার জন্য আমি তােমার শাখার ওই ফুলগুলি প্রার্থনা করছি।
বাবা বলেন, অতি প্রত্যুষে ফুল তুলতে বৃক্ষের কাছে যেতে হয়। সে সময় ভােরের বাতাস বয়ে আসে। শাখা, পত্র, পুষ্প সে বাতাসের স্পর্শে জেগে ওঠে। সে সময় বৃক্ষদেবতার দিকে চেয়ে প্রার্থনা করলে, তার স্পষ্ট সম্মতির ছবিটি দেখা যায়। কখনও ডালগুলি নড়ে ওঠে, কখনও ফুলগুলি ঝরে পড়ে।
পুরু বলল, কেবল তো দেবপুজা নয়, সংসার জীবনে আরও বহু অনুষ্ঠান আছে সে সকল অনুষ্ঠানের জন্য ফুল সংগ্রহ করতে গিয়ে কি তােমরা একই প্রার্থনা জানাও ? না, প্রতি অনুষ্ঠানের ভিন্ন ভিন্ন প্রার্থনা। যেমন বিবাহের অনুষ্ঠানে আমরা বলি আজ ভিন্ন দুটি হৃদয় একত্রিত হচ্ছে। তারা প্রার্থনা করছে তােমার পুষ্পের পবিত্রতা, সৌরভ আর সৌন্দর্য। তারা দুটি হৃদয়ের অক্ষয় বন্ধনের জন্য চাইছে তােমার পুষ্পে গ্রথিত একটি মালিকা। আবার যখন মনুষ্যগণ দেবান পিতৃযানে গমন করেন তখন প্রার্থনা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
হে বৃক্ষদেবতা, ইহলােকে যে দেহধারী তােমার নিত্য কৃপা লাভ করে ধন্য হত, যাকে তুমি অশেষ করুণায় কাষ্ঠ, পুষ্প, ফলদান করতে, সে আজ পার্থিব সকল বন্ধন ছিন্ন করে ঊর্ধ্বলােকে চলেছে। আজ সেই গতাসুকে তােমার শেষ পার্থিব দানটুকু অর্পণ করাে।
শ্ৰতি থামল। পুরুর মনে হচ্ছিল, তির কণ্ঠ নিঃসৃত কথাগুলি জবের মতাে উচ্চারিত হচ্ছে।
পুরু কতক্ষণ নীরবে থেকে বলল, তােমার হাতের তৈরি মালা পাবার জন্য দেবতা উৎসুক হয়ে আছে। তােমার পথ আগলে আর দাঁড়াব না শুতি। | হঠাৎ শ্রুতি আর একটি মালা পত্রপুট থেকে বের করে বলল, তুমি আমার এ মালাটি গ্রহণ করলে আমার আজকের মালা গাঁথা সার্থক হবে কুমার। কিন্তু শ্রুতি, তুমি তাে মালা নিয়ে চলেছ মায়ের মন্দিরে দেবতাকে দেবে বলে।
এক দেবতার মালা আমি রেখে দিয়েছি আমার পত্রপুটে আর এক দেবতা আমার সামনে। পথের দেবতাকে তুষ্ট করেই তাে পথ চলতে হয়। | শ্রুতি মালাটা এগিয়ে দিতেই পুরু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
কী হল, আমার গাঁথা মালা তােমার পছন্দ হল না? পুরু হেসে বলল, দেবতা কি নিজে ভক্তের হাত থেকে মালা নিয়ে নিজের গলায় পরে তি? শুতি সংকুচিত হয়ে বলল, কিন্তু রাজকুমারের গলায় মালা পরাই এমন সাহস আমার কই।
আচ্ছা শ্রুতি, দেবতা রাজকুমার না ভেবে আমাকে কি তুমি কেবল তােমার আজন্মের খেলার সঙ্গী ভাবতে পারাে না।।
সে তাে আমার নিত্যদিনের ভাবনা কুমার। তা হলে সেই সঙ্গীর গলায় কি পরিয়ে দিতে পারাে না তােমার মালা?
শ্রুতি এগিয়ে এসে তার কম্পিত হাতে পুরুর গলায় মালাখানা পরিয়ে দিয়ে অস্ত্র পায়ে পালাতে গিয়ে বাঁধা পড়ল পুরুর বলিষ্ঠ বাহবন্ধনে। | পুরু বলল, একটু আগে দুটি হৃদয়কে মালার বাঁধনে বাঁধার কথা বলছিলে না? তবে মালা পরিয়ে পালাচ্ছে কোথায়?
শুতির চোখে জল ঝরছিল। সে বলল, আমি যখন অবুঝ কিশােরী ছিলাম তখন তােমার সঙ্গে সারা কাননে ঘুরে ঘুরে খেলা করেছি। তখন বুঝিনি তােমার আমার পার্থক্য কোথায়। কিন্তু আজ তরুণী শুতি জানে তার সীমার বাঁধন। তুমি রাজার সন্তান আর আমি অতি সাধারণ এক মালাকারের মেয়ে।
পুরু তেমনই শ্রুতিকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ রেখে বলল, আমার পিতা মহারাজ যযাতি একথা সত্য হলে আমি যে রাজপুত্র একথা অস্বীকার করতে পারি না, কিন্তু শ্রুতি তুমি বলতে পারাে, আমার জীবনধারণে, আচরণে কোথাও কি রাজকুমারের পরিচয় আছে?
শ্রুতি পুরুর দিকে অপলকে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, তােমার আকৃতি, তােমার প্রকৃতি, তােমার ঔদার্য তােমাকে রাজকুমার বলে চিনিয়ে দিয়েছে। আমি একটুও ভুল করিনি কুমার। হীরক থাকে খনির অন্ধকার গর্ভে, তাকে চিনে নিতে রত্নসন্ধানীর কিন্তু কোনও ভুলই হয় না।
তুমি কি তা হলে আমাকে মান দিয়ে দূরে সরিয়ে রাখবে তি? কাছে নি এমন সাহস কই। আবার দূরে সরাই এমন শক্তি নেই।
তুমি মালিনী আর আমি রাজকুমার এমন বিভেদের ছবি কি কোনওদিন ফুটে উঠতে দেখেছ আমার মুখে?
তাই তাে আজকাল আমি আরও সংকুচিত হয়ে থাকি কুমার। তুমি যদি পার্থক্যটুকু স্পষ্ট করে তুলতে তােমার আচরণে তা হলে আমার কোনও সংকোচ, কোনও ভাবনাই থাকত না। আমি আমার সােজা পথটা দেখতে পেতাম। কিন্তু তুমি এমন উদার হৃদয় মেলে দাঁড়িয়ে আছ বলেই আমি আমার পথ দেখতে পাচ্ছি না। চোখের জলে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে।
পুরু বলল, আজ থেকে শ্রুতি স্পষ্ট হােক তোমার ধারণা, আমি তােমাদেরই একজন। এর চেয়ে বড় পরিচয় আর আমার কিছু নেই। তুমি যদি আমাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার না করে তা হলে পৃথিবীতে এমন কোনও শক্তি নেই যা আমাদের বিচ্ছিন্ন করতে পারে। আমার জীবন আমার যৌবন এই মুহূর্ত থেকে তােমার কাছে সমর্পণ করলাম শ্রুতি।
আয়ত অপলক দুটি চোখ ভেসে যাচ্ছে জলে। শ্রুতি প্রায় অবরুদ্ধ গলায় বলল, যদি কোনওদিন তুমি এ নবাসের খেলা ফেলে রাজপুরীতে ফিরে যাও তা হলে কথা দাও এ কাননভূমিতে তােমার শুতিকে রেখে যাবে। শ্রুতি প্রতীক্ষা করে থাকবে তার ভালবাসার ধনের জন্য। সে আসবে অশ্ব ছুটিয়ে কোনও এক সন্ধ্যালয়ে। তখন একদিকে চলবে সূর্যাস্তের সমারােহ অন্যদিকে সন্ধ্যার আয়ােজন। শুতি তার প্রিয়কে সেই লগে বরণ করবে সন্ধ্যাদীপের আরাত্রিকে! অরণ্যের আড়ালে পূর্ণ চন্দ্রের উদয় হবে, পুরু আর তার শ্রুতির পূর্ণ মিলন দেখবে বলে। | তাই হবে —তি। ভাগ্যচক্রে যদি কোনওদিন রাজপুরীতে যেতে হয় তা হলে তুমি থাকবে এই অরণ্যনিবাসে পুরুর অদ্বিতীয়া হয়ে। আমি আসব আমার শ্রুতির প্রতীক্ষার পথ ধরে। এই নির্জন কনভূমিতে সেদিন হবে আমাদের সর্বোত্তম মিলন।
কে তুমি যুবক? আমি এই অরণ্যবাসী। আপনি আমার অভিবাদন গ্রহণ করুন মহারানি। তুমি কী করে আমার পরিচয় পেলে যুবক?
আপনার চতুর্দোলে রাজগৃহের সূর্যলাঞ্ছিত কেতন উড়ছে। মহারানি ছাড়া কার থাকবে ওই চতুর্দোলে আরােহণের অধিকার!
যুবক, তুমি সাধারণ অরণ্যবাসী নও। তােমার তীক্ষ্ণ ধারণাশক্তি আমাকে বিস্মিত করেছে। আমি অতি সাধারণ মহারানি। যে-কোনও মানুষের পক্ষেই এ ধারণা সম্ভব। কী নাম তােমার? পুরু নামেই আমি পরিচিত। কিন্তু মহারানি, কেবল একটি কৌতুহল। কী সে কৌতুহল?
এ কন প্রদেশে মহারানির কোনওদিনই পদার্পণ হয়নি, আজ তার শুভ আগমনের কারণটুকু জানার কৌতূহল।
মহারাজ গেছে বন্ধু রাজ্যে মৃগয়ায়, তাই অবসর পেয়ে বহু বর্ষ পরে বাইরে বেরিয়েছি এই বনভূমি দর্শন করতে। এখানে আমার এক দাসী আছে বলে জানি। বহু বহু যুগ পরে তার সঙ্গেও একবার দেখা করতে চাই।
আপনার দাসী? হ্যা আমারই দাসী, রাজপুরীতে তাকে না রেখে এই অরণ্যভূমিতেই রাখার ব্যবস্থা হয়েছিল। কী নাম তার মহারানি? শর্মিষ্ঠা। তুমি কি এ অরণ্যলােকে এ নামের কোন রমণীকে চেনাে?
অফুটে বলল পুরু, প্রথম আঁখি মেলে তাকেই চিনেছিলাম এ জগতে, এখনও প্রতিদিন তার দিকে চেয়ে চেয়ে দেখি তবু চেনা আমার শেষ হয়নি।
রানির দিকে চেয়ে সুস্পষ্ট স্বরে বলল, চিনি মহারানি। বহু পরিচিত তিনি।
শর্মিষ্ঠার কুটিরথানা আমাকে দেখিয়ে দিতে পারাে যুবক? তার জন্যে তােমার উপযুক্ত পারিশ্রমিক মিলবে। কতটুকু পারিশ্রমিক আপনি আমাকে দিতে পারবেন মহারানি ? তুমি কী চাও বলাে। আমি ‘হাই দেবার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। সত্যে বাঁধা পড়লেন কিন্তু মহারানি। শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানী কথনও সত্যস্রষ্টা হয় না। আপনাকে আগে পৌছে দিই আপনার দাসীগৃহে তারপর আমার পারিশ্রমিক আমি চেয়ে নেব।
বেশ, তাই চলল। কিছু পথ অরণ্যছায়ে আসার পর পরিচ্ছন্ন কয়েকখানি পর্ণকুটির দেখা গেল। সামনে স্বচ্ছ সলিলা এক সরােবর, কুমুদ করে পূর্ণ।
এই আপনার দাসী শর্মিষ্ঠার গৃহ। অনুগ্রহ করে এবার আমার প্রতি পারিশ্রমিক দিন। বলাে কী চাও? আচ্ছা এই নাও আমার বাম অনামিকার রত্ন অঙ্গুরীয়। তােমার প্রত্যাশা যে এতদূর যেতে পারেনি তা আমি নিশ্চয় করে বলতে পারি। | না মহারানি, আমি অরণ্যের অধিবাসী, তাই রত্নের স্বপ্ন আমি দেখি না। আমার পারিশ্রমিকের প্রত্যাশা একটু ভিন্ন।
বলাে কী চাও? এবার তােমার প্রার্থনাই আমি পূর্ণ করব।
সামনে তাকিয়ে দেখুন, এইমাত্র যিনি দেবালয় থেকে বেরিয়ে এসে আপনাকে সম্মুখে দেখে থমকে দাঁড়িয়েছে বিস্ময়ে, তিনি আমার জননী শর্মিষ্ঠা।
তােমার জননী? শর্মিষ্ঠা তাে বিবাহিতা নয়। কী নাম তােমার পিতার? মহারাজ যযাতি। যযাতি তােমার পিতা। মহারাজ যযাতি। উচ্চ হাস্যে বিদীর্ণ হল বনভূমি। শর্মিষ্ঠা, আমার পরিচর্যার অঙ্গীকারে নিয়ে আসা হয়েছিল তােমাকে। কিন্তু আমার পরিবর্তে মহারাজই পেলেন তােমার সেবার অধিকার। তা ছাড়া এমনই কায়-মন-প্রাণে মহারাজের সেবা করলে যে তার চমৎকার পুরস্কারও তিনি তােমাকে দিয়ে দিলেন। হ্যা, এখন বলাে যুবক কী পারিশ্রমিক তুমি চাও?
দাসিত্ব থেকে আমার মায়ের মুক্তি।
কিন্তু শােনাে যুবক, তােমার জননী দাসিত্ব থেকে মুক্তি পেলেও তােমার পিতার মুক্তি নেই।
শর্মিষ্ঠা আর্তস্বরে বলল, ক্ষমা করাে দেবযানী। নিরপরাধ আমাদের মহারাজ যযাতি। নারী আমি, অগ্নিশিখার মতাে আকর্ষণ করেছি পুরুষরূপী পতঙ্গকে। তুমি আমাকে শাস্তি দাও। আমি মুক্তি চাই না। তােমার কাছে আবার অঙ্গীকার করছি চির দাসিত্বের।।
আর ফিরিয়ে নিতে পারি না শর্মিষ্ঠা। ফেরালেই সত্যভ্রষ্ট হতে হবে। তবে মহারাজের প্রতি তােমার ভালবাসার কথা ভুলব না কোনওদিন।
দেবযানী ত্রস্ত পায়ে ফিরে যাচ্ছিল তার চতুর্দোলের দিকে, সামনে গিয়ে পথ আগলে দাড়াল
করজোড়ে বলল, জননী, গৃহে পদার্পণ না করেই কি ফিরে যাবেন? কর্কশ কন্ঠে বলল দেব্যানী, আমাকে জননী বলে সম্ভাষণ কোরাে না যুবক। একজন শঠ, কামাচারীর গােপন খেলা থেকে তােমার জন্ম। তুমি মহারানি বলেই আমাকে সম্ভাষণ করাে। তাই করছি মহারানি। সামান্য পর্ণকুটির থেকেও অতিথি এসে ফিরে গেলে গৃহস্থের
এ গৃহ তাে তােমার নয় যুবক। এ অরণ্য, এ গৃহ রাজ পরিবারের অধিকারে। কেবল দাসী শর্মিষ্ঠাকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে মাত্র। কল্যাণ অকল্যাণের কোনও প্রশ্নই এখানে ওঠে না।
নীরবে দাঁড়িয়ে রইল পুরু। ক্ষিপ্ত দেবযানী এক্ত পায়ে চলে গেল চতুর্দোলে আরােহণের
শর্মিষ্ঠা কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল, এ তুই কী করলি পুরু। আমার বন্ধন মােচন করতে গিয়ে
করে থাকার চেয়ে সত্যের উজ্জ্বল আলােকে মুহূর্তকাল থাকাও পরম শাস্তির। আর কোনও ভয় নেই মা। সদা ব্ৰক্ত ভীত হয়ে আর আমাদের প্রতি পল-অনুপল কাটাতে হবে না। সত্যের মুখােমুখি হয়ে বাঁচার শক্তি আমরা অর্জন করেছি। | তােমার মতাে সন্তান গর্ভে ধারণ করে আমি গর্বিত পুরু। কিন্তু বারবার আমার চোখের ওপর ভেসে উঠছে মহারাজের মুখ। দেবযানীর মুখােমুখি দাঁড়িয়ে কত অসহায় হয়ে পড়বেন তিনি। এই দৃশ্য কল্পনা করে আমি চোখের জল রােধ করতে পারছি না বাবা।
ধৈর্য ধরাে মা। যিনি সত্যের অধিষ্ঠাতা তিনিই আমার পিতাকে মিথ্যার আবরণ ভেঙে
কুটিরে কয়েকটি দিন বিশ্রাম-সুখ ভােগ করতে। এসেই শুনলেন সকল সমাচার।
শর্মিষ্ঠা বলল, ক্ষমা করুন মহারাজ আপনার নির্বোধ পুত্র পুরুকে। অনীর বন্ধন মােচন করতে গিয়ে সে পিতার ভয়ংকর পরিণতির কথা ভাবেনি।
পুরুকে কাছে ডাকলেন মহারাজ যযাতি। মাথায় হাত রেখে বললেন, পুত্র, আজ তুমি আমাকে সকল ভয় থেকে মুক্ত করলে। আমি তােমার কাছ থেকে সত্যের মুখােমুখি গাড়াবার
রাজগৃহে ফিরে এলেন মহারাজ যযাতি। অন্তুর ভরে আছে তার সত্যের শক্তিতে। সারা দিনমান রাজকার্য সেরে নিশাকালে তিনি প্রবেশ করলেন বিশ্রাম নিকেতনে।
আজ দেবযানীর শয়নকক্ষ বহু দীপালােকে উদ্ভাসিত। পুষ্প দিয়ে সুসজ্জিত রাজশয্যা। কক্ষন্দরে এসে দাঁড়ালেন মহারাজ যযাতি। এগিয়ে এল দেবযানী, আসুন মহারাজ, বীরকে বরণের জন্য সামান্য এ আয়ােজন। তােমার এ আচরণ অস্বাভাবিক দেবযানী।
বীর পূজার এ ধরনের অনুষ্ঠান আগে কোনওদিন তােমাকে করতে দেখা যায়নি, তাই মহারাজ, আগে কি এ নির্বোধ দেবযানী জানতে পেরেছিল, মহারাজ যযাতি বহু কীর্তির অধীশ্বর? শুধু পশু নিয়ে মৃগয়াতেই তাঁর কৃতিত্ব নয়, নারীও তার মৃগয়ার অন্যতম লক্ষ।
মহারাজ, মৃগয়ায় যখন ব্যায় আহত হয় তখন সে কি তার আঘাতকারীকে কাছে পেলে দিতে পারে যে অনুষ্ঠানে তােমাকে মহারানির মর্যাদায় একান্ত পাশটিতে রাখেনি যযাতি।
স্বীকার করছি মহারাজ। তবে কেন এই পরিহাস? আরও শােননা, দেশদেশান্তর থেকে শ্রেষ্ঠ রত্ন ব্যবসায়ী এলে সর্বাধিক মূল্যে যে রত্ন আমি ক্রয় করেছি, তা কার জন্য? ওই যে তােমার কণ্ঠে, বাহুতে, কর্ণে আর শিরে মহার্ঘ্য রত্নদীপ্তি, তা কি যযাতির ভালবাসার দান নয়?
হৃদয়ের অধিকারী যে নারী, তার কাছে পৃথিবীর সঞ্চিত রত্নের ভাণ্ডারও অতি তুচ্ছ। সে নারী শুধুমাত্র পুরুষের অচঞ্চল হৃদয়টিকে সম্বল করে পথে প্রান্তরে ঝড়ঝঞ্জা, দারিদ্র মাথায় নিয়ে হাসি মুখে কাটিয়ে দিতে পারে মহারাজ।
তােমার যুক্তি স্বীকার করি দেবানী। তবুও একবার ভেবে দেখাে শর্মিষ্ঠার কথা। সে রাজকন্যা হয়েও সামান্য অপরাধে কী অসামান্য শাস্তি ভােগ করেছে।
মহারাজ দেখছি আগেই সকল সংবাদ অবগত হয়েছে।
মহারানি, শুধু একটি প্রশ্ন তােমাকে আমি করতে চাই, সত্যিই কি জলাশয়ে নিক্ষেপ করে শর্মিষ্ঠা তােমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল?
কোনও কথাই আমি ভুলিনি দেবযানী। তােমাদের সেদিনের স্নানলীলা থেকে সব কিছুই আমি প্রত্যক্ষ করেছিলাম। তুমি একটা বিবাদের পরিণতিতে আঘাত পেলে এবং মৃত্যুর ফাঁদে
মহারাজ, শর্মিষ্ঠার দোষগুণ বিচারের ভার কি আপনার ওপর ছিল, না সে ঘটনা আপনার কোনওটাই নয়, তবে আমি প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম বলে বিচারের ন্যায়-অন্যায় সম্বন্ধে প্রশ্ন তােলার অধিকার জন্মেছে।
মহারাজ, আমি শর্মিষ্ঠার বিচার নিয়ে নতুন করে কোনও কথাই তুলতে চাই না। শুধু একটি প্রশ্ন, আমার পিতৃগৃহ থেকে আগত দাসী শর্মিষ্ঠার ওপর আমার একান্ত অধিকার আছে কি
তােমার অধিকার আমি অস্বীকার করি না দেবযানী।
তা হলে আর একটি প্রশ্নের উত্তর দিন, আপনার অধিকারভুক্ত রাজ্যের কোনও অংশ যদি কেউ কৌশলে আত্মসাৎ করে তা হলে আপনি কি নীরবে তা সহ্য করবেন না শাস্তিবিধান শান্তিই তার প্রাপ্য। শর্মিষ্ঠা আমার দাসী, তাকে আপনি সংগােপনে অধিকার ও ভােগ করেছেন, সুতরাং বিচারে
অন্তরধর্মে আমি দোষী কি না জানি না তবে রাজ-ধর্মানুযায়ী আমি অপরাধী। আমি নতমস্তুকে মেনে নেব দেবযানী।। | না মহারাজ, আমি আপনার বিবাহিতা স্ত্রী। স্বামীর বিচার স্ত্রী হয়ে নিজের হাতে আমি করতে চাই না। আপনি চলুন আমার পিতার কাছে। সব কিছু বিচার করে তিনি যা স্থির করবেন তাই আপনাকে মাথা পেতে নিতে হবে। আর বিবাহের সময় পিতার কাছেই তাে আপনি বেশ, কালই যাত্রা করব তােমার পিতৃগৃহে। সত্যকে আবৃত রেখে যে অন্যায় করেছি তার শুক্রাচার্য বললেন, যদু কোথায়? তাকে তাে দেখছি না মা। পিতার মতাে বৃহস্কন্ধ, আজানুলম্বিত বাহুর অধিকারী হয়েছে নিশ্চয়। স্নেহ নিম্নগামী মা। একদিন কন্যাকে আশ্রয় করে যে স্নেহ ফুরিত হত তা এখন দৌহিত্রের ওপর বর্ষিত হচ্ছে। একী মা, তুই কাঁদছিস?
হাহাকার করে কেঁদে উঠল দেবযানী।
আবার উচ্ছ্বসিত আবেগে কেঁদে উঠল দেবযানী। কী অঘটন ঘটেছে তার, আমার চিন্তু এই মুহূর্তে অস্থির হয়ে উঠেছে যযাতির জন্য।
সঙ্গে সঙ্গে অশ্ব খুরধ্বনি শােনা গেল। আশ্রম প্রাঙ্গণে অশ্ব থেকে অবতরণ করলেন রাজা
এই তাে যযাতি এসে পড়েছে। এত বিলম্ব তােমার ? অবশ্য দ্রুতগামী অশ্ববাহিত রথে
মহারাজ যযাতি ঋষি শুক্রাচার্যকে প্রণাম নিবেদন করে নত মস্তকে দাঁড়িয়ে রইলেন। অঙ্গনে দাঁড়ালে কেন বৎস, কুটির অভ্যন্তরে এসাে। আজ মার্কণ্ডের তাপ বড়ই প্রবল। আমি অপরাধী মহাত্মন, আপনার কাছে বিচারপ্রার্থী হয়ে এসেছি। কী সে অপরাধ যযাতি। আপনার কন্যা দেবযানীকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করুন।
শুক্রাচার্য কন্যার দিকে ফিরে বললেন, রহস্যের আবরণ আমার আঁখির সম্মুখে না রেখে সত্য যা তাকে প্রকাশ করাে।
দেবযানী আকুল ক্রন্দনে ভেঙে পড়ে বলল, বাবা, শর্মিষ্ঠা আজ আমার সপত্নী। শুধু তাই নয়, সে পুরু নামে এক পরম সুন্দর পুত্রকে গর্ভে ধারণ করেছে।
বাক্যহীন রাজা যযাতি দাঁড়িয়ে রইলেন নতমস্তকে। উঃ, আমার বুকের অস্তিগুলাে যেন চূর্ণ হয়ে গেল মা। বাবা, মহারাজ অন্যায় আচরণ করেও অনুতপ্ত নন। তার অভিমত, শর্মিষ্ঠার প্রতি আমরা সুবিচার করিনি। তার জীবনকে আমরা ব্যর্থ করে দিয়েছি। | শুক্রাচার্য বললেন, সে ব্যর্থ জীবনকে তুমি পূর্ণ করে দিয়েছ, তাই না কামমােহিত রাজা। যৌবনকে যে নরাধম সংযত করতে জানে না, যৌবনের আঘাতেই তাকে একদিন ধবংস পেতে হয়। তুমি শুধু সত্য গােপন করে গর্হিত কাজই করােনি, তুমি বিবাহের কালে যে প্রতিশ্রুতি আমাকে দিয়েছিলে তাকেও ভঙ্গ করেছ। তুমি শুক্রাচার্যের প্রসন্ন মূর্তি দেখেছ, তার রুদ্ররূপ দেখেনি। মিথ্যাচারী, কামার্তের বিরুদ্ধে সে যে কত নির্মম হতে পারে আজ তার পরিচয় তুমি পাবে পাপিষ্ঠ।
মক্তক আরও নত হল রাজা যযাতির। শুক্রাচার্যের আঁখিতে অগ্নি জ্বলে উঠল। তিনি বলতে লাগলেন, যে অগ্নির সম্মুখে দাঁড়িয়ে তুমি দেবযানীকে একমাত্র পত্নী বলে অঙ্গীকার করেও যৌবনের তাড়নায় সত্যভ্রষ্ট হয়েছ, সেই অগ্নি তােমার যৌবনকে ধ্বংস করুক। শিথিল জরা গ্রাস করুক তােমার সর্বাঙ্গ।
দেখতে দেখতে সুর্যাসের মতাে জরারূপ রাহু গ্রাস করতে লাগল ব্লাজা যযাতির যৌবনদীপ্তি। বিরল হয়ে শুভ্রবর্ণ ধারণ করল কেশগুচ্ছ। স্বলিত হল দস্তপংক্তি। বিবর্ণ আর লােল হয়ে গেল গাত্রচর্ম। ক্ষীণ হয়ে গেল দৃষ্টি। কম্পিত হতে লাগল যযাতির কলেবর। | আর্ত হাহাকার বেরিয়ে এল ঘষতির কষ্ঠ থেকে, প্রভু, রাজ্যতৃষ্ণা, দেহতৃষ্ণা, সম্পদতৃষ্ণা এখনও আমার অন্তরকে অধিকার করে আছে, আপনি আমাকে জরা থেকে মুক্তি দিন। না হলে মৃত্যু দিন প্রভু, আমি সানন্দে বরণ করব।
শুক্রাচার্যের নয়নের দীপ্ত-অগ্নি সহসা স্তিমিত হতে হতে নির্বাপিত হল। প্রশমিত হল ক্রোধ। ধীর কণ্ঠে বললেন, তপস্যাসিদ্ধ পুরুষের বাক্য ব্যর্থ হবার নয়। তবে কেউ যদি স্বেচ্ছায় তােমার জরা গ্রহণ করে তার যৌবন দান করে তবে তুমি পুনরায় পূর্বাবস্থা ফিরে পাবে। আবার দেবযানী দুই করে আঁখি আবৃত করে অস্ফুটে উচ্চারণ করতে লাগল, উঃ কী পরিণতি।
দানবরাজ বৃষপর্বার কাননভূমি থেকে জলপানের পর বেরিয়ে এলেন জরাগ্রস্ত রাজা যযাতি। অতি কষ্টে অশ্বারােহণ করে ফিরে এলেন নিজ রাজ্যে।
যযাতির পরিণতি দেখে স্তম্ভিত হল প্রজাকুল। কিন্তু মহাশক্তিধর শুক্রাচার্যের বিরুদ্ধে একটি বাক্যও উচ্চারণ করার সাহস পেল না কেউ।
প্রতিদিন জরাগ্রস্ত রাজা ছদ্মবেশে নগর পরিক্রমা করতে লাগলেন। কোনও ইচ্ছুক ব্যক্তির কাছ থেকে ক্রয় করতে হবে যৌবন।
একদিন বৃক্ষতলে এক অন্ধ যুবককে ভিক্ষা করতে দেখে রাজা এগিয়ে গেলেন তার পাশে। বললেন, তােমার প্রাণ-ধারণের উপায় কী যুবক?
রাজা ভাবলেন, যেহেতু জন্মান্ধ সেই হেতু দেহের যৌবন সৌন্দর্য ও দীপ্তি সম্বন্ধে তার সুস্পষ্ট কোনও ধারণা নেই। রাজা তাই বললেন, তােমার ভরণপােষণের সমস্ত ব্যবস্থাই রাজবাড়ি থেকে হতে পারবে, এমনকী প্রাসাদের একটি প্রকোষ্ঠও তােমার জন্য নির্দিষ্ট থাকবে,
তুমি তােমার এই যৌবন দান করবে এক জরাগ্রস্তুকে আর গ্রহণ করবে তার জরা।
তুমি বৃদ্ধ হয়ে বেঁচে থাকবে।
বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হলে অন্ধ ধীরে ধীরে বলল, মহাশয়, অপরাধ নেবেন না। প্রায় একযুগ আগে এই বৃক্ষতলে এসে দাঁড়িয়েছিল দুটি তরুণী। তাদের কথার স্বরে আমি তাদের বয়স অনুমান করেছিলাম। তারা পরস্পরের ভেতর অনুচ্চে কথার আদান প্রদান করছিল। আমি অন্ধ হলে কী হবে শ্রবণশক্তি আমার অতিশয় তী। তাদের কথা থেকে জানতে পারলাম তারা আমার রূপ দেখে মুগ্ধ হয়েছে। আমার অন্ধত্বের জন্য তারা আক্ষেপ করছিল। চলে যাবার সময় তারা আমার ভিক্ষাপাত্রে দুটি মুদ্রা ফেলে দিয়ে যায়। মহাশয়, আমি নারিসের শত নির্যাতনেও সে দুটি মুদ্রা ব্যয় করিনি। যারা আমাকে সুন্দর বলেছিল তারা যদি আবার কোনওদিন এ পথে আসে তাই এই পথের ধারের বৃক্ষতল পরিত্যাগ করে আমি ভিক্ষাবৃপ্তির জন্য আর কোথাও যাই না। মহাশয়, যুদ্ধ করুণা পেতে পারে, ভালবাসা নয়।
অন্ধ তার শতছিন্ন পােশাকের ভিতর থেকে দুটি মুদ্রা বের করে রাজা যযাতির চোখের অন্যদিন পথের মাঝে কোলাহল শুনে ছদ্মবেশী রাজা যযাতি থমকে দাঁড়ালেন। তিনি অশ্লীল গালাগাল করছে। মহারাজ যযাতি এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করে জানতে পারলেন, যুবকটি পানাসক্ত। পতিতালয়ে যাবার অভ্যাসও তার প্রবল। সে যখন সুরাপান আরম্ভ করে তখন তাই তাকে বাগে পেয়ে প্রহার করা হচ্ছে।
মহারাজ যযাতি ভাবলেন, এই সুযোেগ। তিনি প্রহার বন্ধ করতে বলে যুবকটির সমস্ত ঋণ ধীরে ধীরে জরাগ্রস্ত রাজা যুবকের হাত ধরে এসে দাড়ালেন এক নির্জন স্থানে। বললেন, আমি যা জিজ্ঞেস করব তার সত্য উত্তর দিতে হবে। বলুন মহান। আপনি আমার প্রাণদাতা, আপনার কাছে যথার্থ উত্তরই দেব। তােমার গৃহে কে আছেন? আমার স্ত্রী আর শ্ব-মাতা। তাঁদের কাছে তােমার কীরূপ সমাদর? পানাসক্ত বলে আমাকে প্রথমে ধিক্কার দিত, এখন আর বহুকাল যাবৎ গৃহে প্রবেশ করতে
মহারাজ বললেন, তােমার পানভােজনের সকল ব্যবস্থাই আমি করে দিতে পারি। যুবক এবার কোনও বাধা না শুনে মহারাজ যযাতির পদধূলি গ্রহণ করল। যতি বললেন, এর জন্য তােমাকে একটি শর্ত পালন করতে হবে।
তােমার ওই যৌবন একটি মানুষকে দান করতে হবে। তা হলে আমি বেঁচে থাকব কী করে? বেঁচে থাকবে, তবে জরা গ্রহণ করে।
যুবকটি হেসে উঠল। শেষে বলল, আশ্চর্য কথা শােনালেন মহাশয়। যদি দেহখানা জরাতেই পঙ্গু হল, তা হলে সুরাপান করব কী করে। তা ছাড়া লােলঙ্গী রয়েছে, সে তাে, না মহাশয়, নগরে সে সুন্দরী শ্রেষ্ঠা যুবতি বারাঙ্গনা। নামেই শুধু লােলাগী।
তােমাকে বিহীন জেনেও সে ভালবাসে? ভালবাসে মানে, সে ভালবাসার তুলনা হয় না। নিজের স্ত্রীর কাছ থেকে কখনও পাইনি এত ভালবাসা। স্ত্রী তাে স্বামীর সঙ্গে স্বার্থে বাঁধা। এই দেখুন না বিত্ত নেই বলে গৃহ থেকে বিতাড়িত করেছে। কিন্তু লােলাঙ্গী কখনও আমাকে ভৎসনা করে না, বিতাড়ন তাে দূরের কথা। সে আমাকে বিনামূল্যে এখনও উৎকৃষ্ট সুরা পরিবেশন করে।
তােমার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন ঘটতে দেখছি। এর কারণ কী? মহাশয়, সত্য বলি, আমাকে দেখে ও আনন্দ পায়। ও বলে, আমার দেহ নাকি নবীন মেঘের মতাে নব যৌবনের সুধারসে ভরা। নিশা তৃতীয় প্রহরের আগে সমস্ত অতিথিকে তার ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে যেতে হয়। তারপর সে স্নান করে নববস্ত্র পরিধান করে। আমি গৃহমধ্যে প্রবেশ করলে লােলাজী প্রদীপ হক্তে আমাকে প্রদক্ষিণ করে। এরপর আসন পেতে আমার রাজা শেষবারের মতাে বহির্গত হলেন যৌবনের অন্বেষণে। বহুক্ষণ নগরে পরিভ্রমণ করে এমন কোনও যুবকের সন্ধান পেলেন না যার কাছে যৌবন প্রার্থনা করা যায়।
বিস্তীর্ণ প্রান্তর। তীব্র তাপ প্রবাহের পর কদিন ধরে শুরু হয়েছে বর্ষণ। দীর্ণ দগ্ধ খেতের দীর্ঘশ্বাস ঘুচে গিয়ে এখন শাস্তিরস পানে স্নিগ্ধ হয়েছে কৃষিভূমি। স্থানে স্থানে কৃষকের হলকর্ষণের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। কিন্তু মধ্যাহ্ন কাল উপস্থিত হওয়ায় সম্ভবত কৃষকেরা কর্ম পরিত্যাগ করে স্নানাহারের জন্য চলে গেছে। একটি ক্ষুদ্র প্রান্তর অতিক্রম করে এসে মহারাজ যযাতি দেখতে পেলেন, কয়েকটি আবৃক্ষ কুঞ্জ রচনা করে দাঁড়িয়ে আছে। বৃক্ষগুলি রৌদ্রতপ্ত ধরিত্রীর বুকে বিছিয়ে রেখেছে ছায়ার আঁচল। ক্লান্ত শ্রান্ত যাতি উপস্থিত হলেন সেখানে। মনে মনে অভিপ্রায়, কিছুক্ষণ বিশ্রাম গ্রহণ
পাশে এসে চমকিত হলেন। বিলুপ্তপ্রায় আশাটি তার আবার বলবতী হয়ে উঠল। তিনি দেখলেন, বৃক্ষের ছায়ায় এক যুবক বসে প্রান্তরের শেষ সীমার দিকে তাকিয়ে আছে। রাজা যযাতি তার পাশে এসে দাঁড়ালেন। তার দেহ পথশ্রমে ক্লান্ত ও নুজ্জ হয়ে পড়েছিল।
একটি সন্ত্ৰাস্ত বৃদ্ধকে পাশে এসে দাঁড়াতে দেখে কৃষক যুবকটি উঠে দাঁড়াল। হাত জোড় করে বলল, কী উদ্দেশ্যে আপনার এখানে আগমন? ইচ্ছা হলে এই তৃণভূমিতে বসে আপনি রাজা যযাতির সত্যিই বিশ্রামের প্রয়ােজন ছিল, তিনি অতি ভদ্র কৃষক যুবকটির হাত ধরে তৃণাচ্ছাদিত ভূমিতে বসে পড়লেন।
কিছু সময় পরে শান্তি দূর হলে মহারাজ বললেন, অদুরেই হল-বলীবর্ণ দেখে অনুমান তােমার প্রাপ্য শস্য থেকে সংসারযাত্রা নির্বিঘ্নে সমাধা হয়?
প্রভু, আমরা চিরদিনই অভাবগ্রস্ত। খাদ্যের সংস্থান হলে বস্ত্রের সমস্যা দেখা দেয়, আবার পরিধেয় সংগ্রহ করতে গেলে খাদ্যে টান পড়ে।
আচ্ছা, যুবক, তােমাকে কেউ যদি বহু অর্থ একসঙ্গে দান করে তা হলে তুমি কী করবে? গরিবকে পরিহাস করছেন প্রভু? না বৎস, যথার্থই বলছি। এখন বলাে, তুমি কী করবে?
অভাবে পড়ে কিছুকাল আগে একটি বলীবর্দকে সামান্য বিত্তের বিনিময়ে প্রতিবেশীর কাছে বন্ধক রেখেছি। বিত্ত সংগ্রহ করতে পারলেই বলীবর্দটিকে আমি মুক্ত করে নিয়ে আসতে পারি।
না প্রভু, কথাটি ঠিক তা নয়। ওই বলীবর্পটি একসময় কৃষিকর্মে খুবই পরিশ্রম করেছে কিন্তু পেয়ে আসছিল। আমি বুঝেসুঝে তাকে লঘু কাজে নিযুক্ত করতাম। কিন্তু আমার প্রতিবেশীটি ওই বৃদ্ধ বলীবর্দটিকে দিয়ে সাধ্যের অতিরিক্ত কাজ করিয়ে নিচ্ছে। সে এখন মৃতপ্রায়। আমার সঙ্গে পথে দেখা হলে সেই বলীবর্দটির চোখ বেয়ে জল পড়ে। আমি তার কষ্ট দেখে স্থির থাকতে পারি না প্রভু। আমার চোখ দিয়েও জল গড়িয়ে পড়ে। মনে হয়, কী কুকর্মই না আমি করেছি। অভাবের দায়ে এ যে পিতামাতাকে বিক্রয় করে দেওয়ার মতাে হল।
বৃদ্ধ জীবের প্রতি তােমার দয়া দেখে মনে হয় তুমি বৃদ্ধ মানুষকেও ভালবাসাে? আমার বহু বৃদ্ধ পিতামহ সম্প্রতি গতায়ু হয়েছে। আমার পিতৃদেব আগেই কালগ্রাসে
তােমার সেবায় তােমার বৃদ্ধ পিতামহ নিশ্চয়ই সুখে ছিলেন। তিনি আমাকে প্রায়ই আশীর্বাদ করনে। তবে প্রভু, বৃদ্ধ অবস্থায় কেউ সুখী নয়।
কেন এ কথা বলছ যুবক? যদি বৃদ্ধ তােমার মতাে ভক্তিভাজনের কাছ থেকে সেবা পায়? যদি তার বিত্তের অভাব না থাকে? তবে কি সে ব্যক্তি অসুখী? | প্রভু, আপনি মহাজ্ঞানী, আপনাকে কী বােঝাব! বিত্তের বিনিময়ে কি সত্যিকারের সুখ কেনা যায়। আপনার মনের মধ্যেই সুখের জন্ম, আবার অসুখেরও উৎপত্তি মন থেকে। যে কথা বলছিলাম, বৃদ্ধ মানুষের সুখ কই? সংসারে সকলেই তাকে পরিত্যাগ করে। যে সেবা সে পায়, সেটা ভালবাসার টানে যতখানি তার চেয়ে অনেক বেশি কর্তব্যের টানে। বড় মানুষের অনেক বিত্ত থাকে। তিনি বৃদ্ধ হলে অনেকেই তার সেবা করতে এগিয়ে আসে। সেখানে ভক্তি তা ছাড়া বৃদ্ধের কত দুঃখ। সকলেই তার সঙ্গ এড়িয়ে চলতে চায়। বৃদ্ধ অবস্থায় বেশি কথা। বলার কিংবা উপদেশ দেবার ইচ্ছা প্রবল হয়। অবশ্য তার একটা কারণও থাকে। দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতার একটা দাম আছে। তাই বৃদ্ধেরা বয়ঃকনিষ্ঠদের সংসারজীবনে চলার উপদেশ দিতে চায়। কিন্তু আশ্চর্য, খুব কম লােকই বৃদ্ধের কাছে বসে তার উপদেশ গ্রহণ করে।
একটুখানি থেমে বহুদর্শী কৃষক যুবকটি আবার তার কথা শুরু করে। দেখুন বার্ধক্যে।
মানুষের লােভ প্রবল হয় কিন্তু সে তুলনায় তার পরিপাক ক্ষমতা থাকে না, তাই দেহের বলে সে প্রাচুর্যের কোনও মূল্য থাকে না। বৃদ্ধ ছয়টি ঋতু উপভােগ করতে পারে না। মনে উপভােগের বাসনা থাকলেও দেহ অশক্ত হয়। প্রকৃতির ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বৃন্ধেরা বিষয় হয়ে পড়লেন মহারাজ যযাতি। তিনি বেশ বুঝতে পারলেন, এ যুবক কখনও যৌবনে জরা গ্রহণ করবে না। তিনি উত্থানের আগে বললেন, বৃদ্ধের সম্বন্ধে তুমি এত কথা জানলে কী
প্রভু, আমার জ্ঞানী পিতামহ এসকল কথা আমাকে বলে গেছেন। আমি নিষ্ঠাবান শ্রোতার
আচ্ছা যুবক আর একটি প্রশ্ন জানতে বড় কৌতুহল হচ্ছে। তুমি যৌবনকে কী দৃষ্টিতে
যৌবন ক্ষণস্থায়ী কিন্তু তার প্রভাব অসীম। যৌবন দেহে এলে মানুষের মনে হয় পৃথিবীতে এমন কোনও কাজ নেই যা সে করতে পারবে না। আর যৌবনের সঙ্গে সঙ্গে আসে ভালবাসা।
বিস্ময়ে চমকে উঠে দাঁড়ালেন যযাতি। যুবক কি তাকে চিনতে পেরেছে নাকি। না, যুবকের ভাবে তা মনে হল না। তিনি উঠে দাঁড়াতেই যুবকটি তাঁকে নত হয়ে নমস্কার করল। | মহারাজ যযাতি যুবকের হাতে ছােট্ট একটি রত্নের থলি ধরিয়ে দিয়ে বললেন, প্রথমে তুমি তােমার ওই বৃদ্ধ বলীবর্ণটিকে উদ্ধার করবে। সে যতকাল জীবিত থাকবে ততকাল তাকে তােমার সেই নবৃদ্ধ পিতামহের মতাে যত্নে প্রতিপালন করবে। তারপর বাকি অর্থ ব্যবহার
প্রভু, আমি বিত্তহীন। বিত্তহীনকে বিত্ত দিলে তার চরিত্রের স্থিতি থাকে না। আপনি অযাচিতভাবে আমাকে যে দান দিতে চাইছে তা ফিরিয়ে দিয়ে আপনার অসম্মান করতে চাই । তবে আপনি এ ধনের সবটুকু দিয়ে ওই বলীবর্দটির মুক্তি ও প্রতিপালন বাবদ যা রাজা যযাতি নির্লোভ যুবকের কথা রক্ষা করে তাঁর বিবেচনা মতাে ধন দান করলেন।
মহারাজ যযাতি সেই থেকে প্রাসাদে নিজেকে বন্দি করে রাখলেন, যৌবন ক্রয়ের জন্য প্রাসাদের বাইরে আর বেরােলেন না।
একদিন প্রাসাদের শীর্ষে আরােহণ করে চতুর্দিকের দৃশ্য অবলােকন করছিলেন রাজা যযাতি। হঠাৎ তার দৃষ্টি পড়ল, তঁারই প্রিয় অশটির ওপর আরোহণ করে দেবযানীর গর্ভজাত পুত্র যদু রাজ উদ্যানে ভন্ন নিক্ষেপের কৌশল অভ্যেস করছে।
মহারাজ যযাতি ইঙ্গিতে যদুকে অশ্ব থেকে অবতরণ করতে বললেন। যদু অবতরণ করলে মহারাজ ‘তাকে সপ্তপর্ণী বৃক্ষের তলায় বাঁধানাে বেদিতে এনে বসালেন। নিজে তার পাশে বসে বললেন, যদু, তুমি আমার প্রথম সন্তান, তােমার ওপর দাবি আমার সবচেয়ে বেশি। একটি অনুরােধ তােমাকে আমি জানাতে চাই পুত্র।
কী এমন অনুরােধ পিতা? তােমার জননীর অভিযােগ শুনে তােমার মাতামহ ঋষি শুক্রাচার্য আমাকে অভিশাপ দেন, যার ফলে আমি আজ অকালে জরাগ্রস্ত। কেউ যদি আমার এ জরা গ্রহণ করে তার যৌবন আমাকে দান করে তা হলে আমি পুনঃযৌবন লাভ করতে পারি। তুমি কি পুত্র তােমার ওই যেীবন আমাকে দান করতে পারাে?
অসম্ভব একটি কথা আপনি উচ্চারণ করলেন পিতা। কেউ কি কোনও কিছুর বিনিময়েও তার যৌবনকে ত্যাগ করতে পারে? | যদু, আমি কিছুকাল জরাগ্রস্ত হয়ে রাজ্য থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছিলাম, যার ফলে রাজ্যের দমন করতে পারছি না। তাই তােমার কাছে যৌন দানের জন্য অনুরােধ জানাচ্ছিলাম।
পিতা, আপনার আর উদ্বিগ্ন হবার কোনও কারণ নেই। মাতামহ আমার কাছে গােপন সংবাদ পাঠিয়ে বলেছেন, রাজ্য শাসনের জন্য এখন থেকে প্রস্তুত হও।
মহারাজ যযাতি অনুত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, তাই বুঝি আমার অশ্বে আরােহণ করার সময় আমার অনুমতি নেবার প্রয়ােজন বােধ করােনি?
মহারাজ যযাতি বললেন, উত্তম, এখন তুমি এখান থেকে চলে গিয়ে আমাকে একটু নিরিবিলিতে থাকতে দাও।
যদু পিতার আদেশ অমান্য করার সাহস পেল না, কিন্তু যাবার সময় দৃপ্ত পদক্ষেপে উদ্যান রাজপ্রাসাদের এক প্রান্তে শর্মিষ্ঠা এবং তার সন্তান পুরুর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ঘটনাটি সবার গোচরে আসার পর পুর বনপ্রদেশে মাতাপত্রকে নির্বাসিত রাখার আর কোনও সার্থকতা ছিল না। তাই স্বয়ং রাজা যযাতি তাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন
যদুর কাছে যৌবন প্রার্থনা করে প্রত্যাখ্যাত হবার পর রাজ্য চললেন কনিষ্ঠ পুত্র পুরুর পিতা অপুরে প্রবেশ করে পুরুর সামনে এসে দাঁড়াতেই পুরু তাকে আমি লুষ্ঠিত হয়ে প্রণাম করল। জরাগ্রস্ত যযাতি এইমাত্র যদুর কাছে আহত হয়ে এসেছিলেন, তিনি পুরুর আচরণে অভিভূত হয়ে তাকে গভীরভাবে আলিঙ্গন করলেন। রাজা উপবেশন করলে পুরু তার চরণতলে আসন গ্রহণ করল।
রাজা যযাতির দিকে তাকিয়ে পুরু একসময় বলল, পিতা আমার অপরাধ নেবেন না, আজ আপনাকে বড় বেশি চিন্তাক্লিষ্ট আর বিষয় দেখাচ্ছে।
জরাগ্রস্ত হবার পর আপনি কি দেহে অসুস্থতা অনুভব করছেন?
দেহ সমল রক্ষা করে চলে, কিন্তু অকালে জরাগ্রস্ত হয়ে পড়লে দেহের সঙ্গে মনের মিলন ঘটে না। আর তখনই শুরু হয় মানসিক যন্ত্রণা।
পুরু শান্ত কণ্ঠে বলল, পিতা, আপনার জরাক্রান্ত দেহের কথা ভেবে জননী প্রায় প্রতি মুহূর্তে আমি জানি পুরু। শর্মিষ্ঠার অন্তর আমার দুঃখে দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। কোথায় তােমার জননী। ডাকো তাঁকে। আজ আমার এ শােকের তিনিই একমাত্র সান্ত্বনা।
কিন্তু পুত্র, আমি তাঁর জন্য বিশেষ চিন্তিত হয়ে পড়লাম। এদিকে শুক্রাচার্যের আশ্রমে গেছে দেবযানী। বহুবর্ষ পরে বৃষপর্বার রাজ্যে দু’জনে মুখােমুখি হলে কোনও সংঘর্ষ আবার আপনি চিন্তিত হবেন না পিতা। অন্যায় কোনও সংঘটনে লিপ্ত হয়ে পড়বেন না আমার শর্মিষ্ঠার চরিত্র আমার অজানা নয় পুত্র। তবে শর্মিষ্ঠা স্পষ্টবাদিনী, এখানেই আমার পুরু এবার প্রান্তরে এসে জিজ্ঞেস করল, আপনাকে কি অনন্তকাল এই ধরাধামে জরাগ্রস্ত হয়ে থাকতে হবে পিতা?
জানি না, বিধাতাপুরুষের কী অভিপ্রায়। যদি আমার দেহের অবসান হত তা হলে আমি মুক্তি পেতাম পুরু। কিন্তু দেহ আছে, আকাকা আছে, শক্তি নেই, এ যে অসহনীয় পুত্র।
আমি মাতৃমুখে শুনেছি, কেউ যদি আপনার জরা গ্রহণ করে তা হলে আপনি ফিরে পাবেন
হাসলেন রাজা যযাতি। বড় করুণ, বড় বেদনার্ত সে হাসি। বললেন, শুক্রাচার্য অতি অসম্ভব। যদি কেউ তার যৌবন দান করে জরা গ্রহণ করে তবেই কেবল আমি আমার স্বরূপ ফিরে পেতে পারব। কিন্তু পুরু, পৃথিবীতে এমন কাঙাল কি কেউ আছে যে সমস্ত সাম্রাজ্যের বিনিময়েও তার যৌন বিক্রয় করতে পারে? নেই, কেউ নেই। আমি সামান্য ভিক্ষাজীবী ব্যর্থ হয়েছি। এখন ভাগ্যকে মেনে নিয়ে শেষ পরিণতির দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমার আর
রাজা যযাতির শেষ বাক্যটি বহির্গত হল একটি গভীর দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে। আর সেই পুরু! আমি কাঙালের মতাে পথে প্রান্তরে যৌবন ভিক্ষা করে বেড়িয়েছি। কিন্তু পৃথিবীর দরিদ্রতম ভিখারি হলেও আমি তােমার কাছ থেকে যৌন ভিক্ষা করতে পারব না পুত্র।
পিতা, আপনাকে সেবা করার সুযােগ দিয়ে আমাকে ধন্য হতে দিন। যে দেহ একদিন আপনার কাছ থেকে আমি পেয়েছি সেই দেহ আপনার সেবায় সমর্পিত হােক। জ্ঞানীরা বলেন, পুত্রের মধ্যে পিতা নিজের প্রতিবিম্ব দেখেন, নিজেকে রক্ষা করেন। আমি বিশ্বকে বলে যেতে চাই, পুত্র আপন স্বরূপকে যথার্থ করে দেখতে পায় পিতার লীলার মধ্য দিয়ে। আপনি আমাকে এ সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত করবেন না পিতা।
পুরু, আমার পুত্র, তােমার এই ত্যাগ সারা বিশ্বে অদ্বিতীয় হয়ে থাকবে। দাতা জগতে অনেক পাওয়া যায় কিন্তু আপন যৌবন দান করে স্বেচ্ছায় জরা গ্রহণ করার মতাে দাতা বিশ্বে কেবল একটি মিনতি পিতা, আমাকে সামান্য কিছু সময় বাইরে যেতে দিন। ফিরে এসে সানন্দে যেীবন দান করে আমি আপনার জরা গ্রহণ করব।
সেই পরিত্যক্ত কাননভূমিতে পুরু দ্রুতগামী অশ্বারােহণে উপস্থিত হল। উদ্যালরক্ষক বাইরে থেকে রুদ্ধ। কোথায় গেল নবাসীরা।
অশ্বের মুখ ফিরিয়ে নিল পুরু রাজপুরীর দিকে। পিতা প্রাসাদে অপেক্ষা করে আছেন তার পুরু একবার তাদের পরিত্যক্ত কুটিরটি দেখার জন্য অরণ্য মধ্যে প্রবেশ করল। আ,, পলাশ, শিমুল বৃক্ষগুলি তখন শেষ সুর্যের সােনায় স্নান করছিল। প্রথম বসন্তের মঞ্জরী থেকে মধু লুণ্ঠন করে নিয়ে যাচ্ছিল মধুকরের দল।
ওই তাে তাদের কুটির। অশ্ব থেকে অবতরণ করে পুরু ধীরে ধীরে অগ্রসর হল। কুটির প্রাঙ্গণে পা দিয়েই তার মনে হল, এ যেন পরিত্যক্ত কোনও গৃহের অঙ্গন নয়। কুটিরবাসীরা সযত্নে পরিচ্ছন্ন করে রেখেছে তাদের পরিবেশ।
গৃহদ্বার উন্মুক্ত ছিল। পুরুর মনে হল, গৃহবাসীরা গৃহত্যাগ করে চলে গেলে দ্বার উন্মুক্ত থাকা অসম্ভব নয়। পুরু শৈশব, কৈশাের, যৌবনের বহু স্মৃতি বিজড়িত গৃহের মধ্যে প্রবেশ
আশ্চর্য, অগিগৃহ থেকে বেরিয়ে আসছে সুতি, হাতে তার জননী শর্মিষ্ঠার ব্যবহৃত পঞ্চ প্রদীপখানি। প্রজ্বলিত প্রদীপ নিয়ে পুরুর সামনে বিস্মিত শ্রুতি স্তব্ধ হয়ে মাড়াল। ক্ষণকাল মাত্র। পর মুহূর্তে হাসিতে মুখখানি উদ্ভাসিত করে ক্ষতি বেরিয়ে গেল দেবগৃহের দিকে।
বেশ কিছু সময় পরে যখন ফিরে এল পূজা সাঙ্গ করে তখন পুরু নেমে এসে দাঁড়িয়েছে গৃহ প্রাঙ্গণে। অসুর্যের রক্ত আভা তার ললাট আর মুখমণ্ডল প্লাবিত করে গড়িয়ে পড়ছে।
শ্রুতি করজোড়ে নমস্কার করে বলল, কী মনে করে রাজকুমার ?
তােমার কাছে এসেছি শ্রুতি। কিন্তু এই পরিত্যক্ত গৃহে কেন? তােমাদের উদ্যান-গৃহ দেখলাম বাইরে থেকে অর্গলবদ্ধ।
মা-বাবা গেছে মাতুলগৃহে। গঙ্গাদর্শন ও স্নান করে ফিরকেন পক্ষকাল পরে। তাই দু’খানি এ তাে পরিত্যক্ত গৃহ শ্রুতি। এর পরিমার্জনের প্রয়ােজন কী? এখানে আমি দেবতার প্রতিষ্ঠা করেছি কুমার। ও গৃহটি আমার আবাসভূমি, এ কুটির আমার তুমি তােমার সখা পুরুকে আজও মনে রেখেছ তি? কোনও কথা না বলে শুতি আনত করল তার মুখখানি।
পুরু শ্রুতির মুখ দুই করে তুলে ধরতেই শ্রুতির আয়ত চোখ থেকে অজস্র অশ্রুর ফুল ঝরে পড়তে লাগল পুরুর অঞ্জলিপুটে।
পুরু বলল, বিরহের অশ্রুতে স্নান করে প্রেম পবিত্র হয় শ্রুতি। আমাদের দীর্ঘ অদর্শন শ্রুতি অশ্রু বস্ত্রাঞ্চলে মুছে নিয়ে বলল, আমি জানি, রাজকুমার পুরু আমার স্বপ্নের ধন।
পুরু বলল, আজ আমি আমার জীবনের এক পবিত্র কর্তব্য সম্পাদনের জন্য প্রথতে হয়েছি শ্রুতি, আর তাই সে বিষয়ে তােমার অনুমতি নিতে এসেছি।
আমার অনুমতি! সামান্য মালিনীর কাছে রাজার কুমার নেবে অনুমতি। এখনও তােমার অভিমান গেল না তি?
বিশ্বাস করাে কুমার, এ আমার অন্তরের কথা। শাল্মলী তরুর শিরে যে চাদ ওঠে আমি প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে তার দিকে চেয়ে চেয়ে দেখি। সে আমার ভালবাসার তন্ত্ৰীগুলােতে আঘাত হেনে আর্য সব রাগিনী তােলে। কিন্তু আমি জানি, সে আমার স্পর্শের অতীত। ভালবাসলেই কি ভালবাসার ধনকে পাওয়া যায় কুমার ? তােমার আমার অনেক ব্যবধান, তাই বলছিলাম, আমার অনুমতির কিছু কি প্রয়ােজন হবে তোমার?
আচ্ছা শ্রুতি, অনুমতির কথা থাক, আমি শুভকাজে তোমার প্রসন্ন মনের শুভেচ্ছা চাই। আমার শুভ প্রার্থনা তােমার সকল কাজে নিত্যদিন রয়েছে কুমার। তবু বলাে, আজ তুমি কী শুভ কাজের অনুষ্ঠান করতে চলেহ। | আজ আমি এক পবিত্র যজের অনুষ্ঠান করতে চলেছি শ্রুতি, যেখানে আমি হােতার আসনে গড়িয়ে আহুতি দেব আমার এ চোখের দৃষ্টি, মনের কামনা, দেহের বীর্য। আর সেই যজ্ঞাগ্নি থেকে জন্ম নেবে আর এক যুবা পুরুষ, যে পাবে আমার প্রদত্ত আহুতির সকল বৈভব।
আমাকে সহজ করে বলাে কুমার, আমি এ প্রহেলিকা ভেদ করতে পারছি না। মহারাজ যযাতিকে এ অরণ্যে তুমি বদ্বার অশ্বারােহণে আসতে দেখেছ শ্রুতি। হাঁ কুমার। আমি আশৈশব সেই অপূর্ব কাক্তিমান পুরুষসিংহকে এই অরণ্যে তােমাদের গৃহে তার সেই প্রদীপ্ত বীর্যবান দেহের কোনও পরিণতির কথা কি তুমি শুনতে পেয়েছ। পিতা লােকমুখ থেকে আমাদের মহারাজের ভয়াবহ পরিণতির কথা শুনে এসেছিলেন।
মুক্তির পথও বলে দিয়েছেন।
আমরা শুধু মহারাজের জরাগ্রস্ত হবার কথাই শুনেছি, তার থেকে মুক্তির যে পথ আছে সে সে এক অদ্ভুত পথ শ্রুতি। যদি কেউ তার যৌবন দান করে মহারাজের জরা স্বেচ্ছায় গ্রহণ। করে তা হলেই কেবল মহারাজ পুর্বাবস্থা ফিরে পেতে পারেন।
আশ্চর্য এই শ্রুতি, একজন ভিক্ষাজীবীও পৃথিবীর সম্রাটের সমস্ত সম্পদের বিনিময়ে তার যৌন দিয়ে জরা গ্রহণ করতে চায় না।
সম্পদ নিয়ে সে হতভাগ্য কী করবে, যদি সম্পদ ভােগের ক্ষমতা না থাকে। জরাগ্রস্ত মানুষের কোনও কিছু ভােগের ক্ষমতাই থাকে না।
কুমার, সে যদি ত্যাগের পথে যায় ? তার প্রাপ্ত ধন যদি সে ধনহীনদের মধ্যে বিলিয়ে দেয় তা হলে কি তার ভােগের বাসনা তৃপ্ত হয় না? | ত্যাগের ভেতর যে সবচেয়ে বড় ভােগ লুকিয়ে রয়েছে তার খবর তােমার মতাে ক’জন জানে শুতি। সবকিছু বিলিয়ে দিয়ে সবার মুখে হাসি ফোটাতে পারলে দাতা পায় সমবেত হৃদয়ের আনন্দের লােগ। সেখানেই তার চরম তৃপ্তি।
একটুখানি থেমে আবার বলল পুরু, আমি সেই ত্যাগের ব্রতই সাধন করতে চলেছি শ্রুতি। তােমার সঙ্গে আশ্চর্য মিল হয়ে গেল আমার মনের। আমি আমার যৌবন উৎসর্গ করছি পিতার ভােগের জন্য। শুধু পিতার ভােগ নয়, আমারও ভােগ ত্যাগের তৃপ্তি আর আনন্দ-ভােগ।
শ্রুতি বলল, কুমার, সার্থক তােমার জীবন। আমিও গর্বিত এ জন্যে যে, পৃথিবীর অদ্বিতীয় এক পুরুষ আমার মতাে সামান্যকে তার ভালবাসা দান করেছে।
শ্রুতিকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে পুরু বলল, তুমি কী পেলে আমি জানি না তবে আমি তােমার কাছে যা পেলাম তার তুলনা নেই। তােমাকে ভালবেসে আজ আমি সত্যিই খুন হলাম। আমার ব্রত উদযাপনে আর কোনও বাধা নেই শুতি।
অপার আনন্দ আর পরিতৃপ্তির ছবি ফুটে উঠল তির চোখে মুখে। সে আলিঙ্গনে আবদ্ধ থেকে বলল, কুমার, শুধু একটি প্রশ্নের উত্তর দাও, এ জরা থেকে কোনওদিন কি তােমার মুক্তি
আমি তাে সর্বত্যাগী হতে চেয়েছি শ্রুতি, মুক্তি পেতে চাইনি। তবু তােমার জিজ্ঞাসার উত্তর দিচ্ছি। যদি পিতা কোনওদিন জরা গ্রহণ করে আমাকে তার যৌবন দান করেন তা হলেই
মুহূর্তে। শ্রুতি দেখল, তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এক জ্যোতির্ময় পুরুষ, পার্থিব চাওয়া পাওয়ার কোনও চিহ্ন নেই তার অবয়বে। সে স্পষ্ট শুনতে পেল, দিব্য পুরুষ উচ্চারণ করছে,
আমি অনন্ত যৌবনের অধীশ্বর। এ যৌবনকে জরা বিকৃত করতে পারে না, ভােগ নিঃশেষ করতে পারে না, আর মহাকাল হরণ করতে পারে না। যে ত্যাগী অন্তরে চির আনন্দময় সেই কেবল পায় এই অনন্ত যৌবনের অধিকার।
শ্রুতি লুষ্ঠিত হয়ে সেই পুরুষােত্তমের চরণে তার প্রণাম নিবেদন করল। রাতের অন্ধকারে প্রাসাদের নিভৃত এক প্রকোষ্ঠে দাড়িয়ে রয়েছেন জরাগ্রস্ত যযাতি। তার পদতলে ধ্যানমগ্ন পুরু। পুস্পার্ঘ্য নিবেদন করা হয়েছে। এখন ধ্যানে পুরু পিতৃপুরুষকে স্মরণ
স্বর্গ থেকে মর্তলােক পর্যন্ত প্রসারিত এক আলাের সােপান। সেই সােপানের সর্বোচ্চ আসনে দাড়িয়ে আছেন মানব-পিতা মনু। জ্ঞান ও কর্মের দীপ্তিতে উদ্ভাসিত অবয়ব। তার নিম্ন সােপানে দণ্ডায়মান অত্যাশ্চর্য এক মুক্তি। মনুর পুত্র ইলা। একদিকে তার পুরুষের শৌর্য, অন্যদিকে নারীর কমনীয়তা। তঁার নিম্নের আসনে ইলার পুত্র পুরুরবা। ত্রয়ােদশ দ্বীপের অধীশ্বর, বিপ্র-বিদ্বেষী, উর্বশীর প্রণয়ভিক্ষু। পুরুরবার মুক্তিতে অদ্ভুত স্বাতন্ত্র্যের সুস্পষ্ট এক চিহ্ন। পুরুরবার পদনিম্নে দণ্ডায়মান হয় পুত্রের অন্যতম আয়ু। তার পদতলে ধর্মপরায়ণ
আলাের সােপানের নিম্নে প্রসারিত মৃন্ময়ভূমি। সেখানে দণ্ডায়মান জরাগ্রস্ত ম্লানবর্ণ যযাতি।
পুরু প্রার্থনা করে চলেছে, হে আমার পূর্বপুরুষগণ, তােমাদের দেহ থেকে প্রবাহিত যে আলােকধারা অধস্তন পুরুষকে স্পর্শ করে চলেছে, তার থেকে বঞ্চিত কোরাে না আমার জন্মদাতা পিতা যযাতিকে। আলােকিত হােক তার সর্বত। জরা থেকে হােক তার মুক্তি। আমি স্বেচ্ছায় সমর্পণ করছি আমার যৌবন। সম্পূর্ণ কামনামুক্ত হয়ে আমি আমার যৌবন তাঁকে
সকল অভিশাপের উর্ধ্বে তার স্বাভাবিক জীবন ধারণ করুন।
সহসা পুরুর ধ্যাননেত্রে উদ্ভাসিত হল প্রসন্ন প্রভাতের কোমল এক দ্যুতি। মুছে গেছে পূর্বের সে ছবি। সেখানে ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে একটি মূর্তি। যযাতি! যৌবনের দীপ্তিতে দীপ্তিমান
প্রাসাদ প্রকোষ্ঠের বাতায়ন পথে ততক্ষণে এসে পড়েছে উলােকের আলাে। প্রস্রবণের মতাে ছড়িয়ে পড়েছে তা পাষাণনির্মিত গৃহতলে। পলিত কেশ, জরাজীর্ণ, ক্ষীণ দৃষ্টি এক বৃদ্ধ বসে রয়েছে পাষাণ ভিত্তির ওপর যুক্ত করে আর তার সামনে দাঁড়িয়ে ভাস্বর মুর্তি পরম
হাঁ দেবযানী, মহর্ষির এই পবিত্র আশ্রমে মনে হল তােমাদের সঙ্গে একবার দেখা করে যাই। এসাে, এই পাষাণ বেদিকায় উপবেশন করা যাক।
তিনি প্রভাতে ঋষিকুলের এক বিচারসভায় পৌরােহিত্য করতে গিয়েছেন। দিনাবসানের এ কথা কেন শর্মিষ্ঠা ? পিতৃগৃহে আমি বিশ্রামেই রয়েছি। ক্লান্তির কোনও কারণ নেই। তা হলে দেবযানী এই পাষাণ বেদিকায় উপবেশন না করে আমরা কি আশ্ৰম তরুর ছায়ায় তােমার যা অভিরুচি তাই হবে। তুমি এখন এ আশ্রমের অতিথি। তা ছাড়া আমিও আর সে কথা এখন থাক। আমি অবাক হয়ে দেখছি দেবযানী, মহর্ষির তপােবন অবিকল, সেই বাবা সারাক্ষণই প্রায় আশ্রমের পরিচর্যায় ব্যস্ত থাকেন।
ওই দেখাে দেবযানী, সপ্তপর্ণীর তলদেশ ঘিরে সেই নিবিড় মাধবীলতায় আচ্ছাদিত কুঞ্জভূমি। একদিন ওই তরুতলে তুমি আর বৃহস্পতি সূত কচ বসে ছিলে। খুব মগ্ন হয়েই আলাপন চলছিল তােমাদের। সহসা কুকু-কুহ ফানি শুনে তুমি আর কচ চমকিত হয়ে তাকিয়েছিলে চতুর্দিকে। তারপর আমার কলহাস্যে তুমি আবিষ্কার করেছিলে সেই পাখিটিকে।
সত্যি শর্মিষ্ঠা, সেদিন তুমি অবিকল পাখির ডাক ডেকেছিলে। কচ্চ পর্যন্ত তােমার কীতি মনে হয় কালই ঘটনাটা ঘটেছে শর্মিষ্ঠা। আচ্ছা দেবযানী, অশােক তরুবীথিতে বাঁধা তােমার সেই প্রিয় দোলনাটি নিশ্চয় এখন আর আমার এখানে আসার পরে বাবাই সেটিকে কুটির থেকে নিয়ে গিয়ে অশােক শাখায় বেঁধে।
মনে পড়ে তােমার, এই দোলনা নিয়ে কী লুকোচুরি খেলা খেলতে হয়েছিল আমাদের। মহর্ষিকে সেদিন দুর থেকে আসতে দেখে আমি করতালি দিতেই তােমরা দু’জন দোলনা থেকে করেছিল কচ। তুমি আমাকে হাতছানি দিয়ে পাশে ডেকে নিয়েছিলে। তারপর কচের পরিবর্তে আমরা দু’জনই সেদিন দুলেছিলাম দোলনায়। মহর্ষি আমাদের পাশ দিয়ে যেতে যেতে বাবা বলেছিলেন, দোলনাটি কাষ্ঠখণ্ড আর তন্তু রঙ্কু দিয়ে তৈরি। ওটি ভেঙে অথবা ছিড়ে গেলে আবার তৈরি সম্ভব। কিন্তু দুই কন্যার অস্থি চুর্ণ হয়ে গেলে তা আর জোড়া লাগানাে অসাধারণ স্মৃতিশক্তি তােমার দেবযানী।
কচের কথা এখনও তােমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। তুমি যেমন আমার মুখােমুখি দাঁড়িয়ে আছ শর্মিষ্ঠা, ঠিক কচও আমার স্মৃতিতে তেমনই শখিনী নদীতে একদিন তুমি ছল করে জল আনতে গেলে আর আমি আশ্ৰম কুটিরে মহর্ষিকে নানা প্রসঙ্গের আলােচনায় অন্যমনস্ক করে রাখলাম।
বাতাস হু হু করে বয়ে এসে আশ্রম তরুর ডালপতি কাপিয়ে দিয়েছিল। আমার মনটাও অমনি হু-হু করে উঠল। কচ গেছে শঙ্খিনী নদীর ওপারে গােধন নিয়ে, তাকে দেখার জন্যে সেই আমি তােমাকে পরামর্শ দিলাম কলস নিয়ে নদীতে জল আনতে যাবার। সঙ্গে সঙ্গে তােমার পরামর্শ মেনে নিয়ে আমি চলে গেলাম নদীতে।
দু-চার ফোটা বৃষ্টিও নামল তখন হঠাৎ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন মহর্ষি। তােমাদের খোঁজ করতে লাগলেন। আমি বললাম, উদ্বিগ্ন হবেন না, আমি এখুনি ওকে ডেকে আনি।
আমরা তখন নদীর ধারে শিংশপা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে গভীর আলাপে মত্ত ছিলাম, তুমি ছুটে গেলে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে আশ্রমের দিকে দ্রুত পা চালালাম। আমি কচকে বারণ করলাম সঙ্গ নিতে। বনের মাঝখানে আচ্ছাদিত সাধন বেদিকায় ঝড়বৃষ্টি না থেমে যাওয়া পর্যন্ত ধেনু নিয়ে অপেক্ষা করতে বললাম। ও সুবােধ বালকের মতাে সেদিন তােমার নির্দেশ মেনে মনে আছে দেবযানী, দানবেরা যখন শত্রুপক্ষের লােক আর সঞ্জীবনী বিদ্যার শিক্ষার্থী বলে কচকে কয়েকবার হত্যা করল, তখন আমিই তােমাকে তার মৃতদেহের সন্ধান বলে দিয়ে গিয়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে তুমি মহর্ষিকে সেখানে নিয়ে গিয়ে সঞ্জীবনী বিদ্যা প্রভাবে তার দেহে সে কথা আমি ভুলিনি শর্মিষ্ঠা। আরও ভুলতে পারিনি সেদিনের কথা, যেদিন কচ সঞ্জীবনী দেবযানী, বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, বসাে এই শিল-বেদিকায়। শর্মিষ্ঠা আর দেবযানী পাশাপাশি উপবেশন করল। কিছুক্ষণ কাটল নীরবতায়। সহসা শর্মিষ্ঠা প্রশ্ন করল, দেবযানী, মহারাজ বৃষপর্বার কন্যা কোনওদিন কোনও উপকার
একথা কেন শর্মিষ্ঠা, আমি কি কোনওদিন তা অস্বীকার করেছি। তবে কেন তুমি মহারাজ যযাতির ওপর প্রতিশােধ নিতে গেলে? আমাকে তুমি সামান্য কারণে দসিত্বে নিযুক্ত করলে, আমি কোনও প্রতিবাদ সেদিন করিনি, কিন্তু মহারাজ যযাতি তােমার কাছে কী অপরাধ করেছিলেন দেবযানী? | মহারাজ আমাকে শ্রীরূপে গ্রহণ করে গােপনে তােমার প্রতি আসক্ত হয়েছিলেন। আমার ওপর তাঁর গভীর প্রেম প্রদর্শন একটা প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়। তিনি তােমার প্রতি তার প্রেমের কথা তিলমাত্র আমাকে জানতে দেননি। স্বামী যদি স্ত্রীর কাছে তার সব কথা এমন করে গােন করে রাখে তা হলে স্বামী-স্ত্রীর ভেতর পবিত্র কোনও বন্ধনই থাকে না।
সত্য দেবযানী, তােমার এ কথাগুলি প্রতিটি দম্পতির ক্ষেত্রে মিলনের প্রথম শর্ত হিসেবে মেনে নেওয়া উচিত। স্বামী-স্ত্রী, যারা বিধাতার নিয়মে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ, দেহে মনে যারা সর্বোত্তম মিলনের অধিকারী, তাদের ভেতর পারস্পরিক প্রতারণা থাকবে কেন?
আমি সেই কথাই বলতে চাই শর্মিষ্ঠা। কিন্তু দেবযানী, আমরা সকলেই সম্মুখের মানুষটির সমালােচনা করি নিজের মনের স্বারটি বন্ধ রেখে। তখন আমরা প্রতিপক্ষের সমালােচনায় এতই অন্ধ যে নিজের দিকে তাকাবার অবসরই পাই না। সত্য নয় দেবযানী?
মহারাজের সমালােচনা করতে গিয়ে কোনওদিন তাকিয়েছ নিজের অন্তরের দিকে, নিজের অতীতের দিকে ? কোনওদিন তুমি মহারাজের কাছে প্রকাশ করেছ, কচ নামে দেবগুরু বৃহস্পতির পুত্রের কথা? তােমার পিতার শিষ্যত্ব নিয়ে শিক্ষা করতে এসেছিল মৃতসঞ্জীবনী
একথা মহারাজকে আমি বিশ্রালাপের সময় জানিয়েছি শর্মিষ্ঠা। কিন্তু তুমি ঋষিকন্যা, আজ অগ্নির মতাে পবিত্র সত্যকে আশ্রয় করে বলাে, কচের সঙ্গে তােমারি গােপনে প্রণয় সম্পর্কের কথা রাজার কাছে ব্যক্ত করেছ?
বলাে, বলাে দেবযানী, নীরবে মাথা নত করে বসে রইলে নে? এ তােমার ব্যতিয়ার নয়? রাজা যদি তার গােপন প্রণয় বাক্ত না করে স্ত্রীর কাছে প্রতারক হন, তা হলে সেই একই প্রতারণার দায়ে কি তােমাকে অভিযুক্ত করা যায় না লেবানী? | পিতার কাছে বিবাহকালে মহারাজ প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভঙ্গ করেছিলেন, তাই পিতাই তার অপরাধ নিয়াে না দেবযানী, একটি প্রশ্ন ব্রা আমি তোমাকে করতে চাই। যদি কোনও ব্যক্তি তার আপন জনের জীবন-মরণের চাবিকাঠিটি প্রতিপক্ষের হাতে তুলে দেয় তা হলে কী মহারাজ বৃষপর্বই সে কথা বলতে পারবেন। তােমার সহজ বুদ্ধি আর বিবেচনায় কী বলে দেবযানী? শাক্তি তার প্রাপ্য কিনা?
তা হলে বিচার করাে তােমার পিতা মহর্ষি শুক্রাচার্যের। তিনি দানবের গুরু দানবের স্বজন। দেব দানবের যুদ্ধে তিনি মৃত দানবদের সঞ্জীবিত করে দানবকুলের পরম শ্রদ্ধার আসনে বসেছিলেন। তিনি শেষ পর্যন্ত সেই গুপ্ত সঞ্জীবনী বিদ্যা বিলিয়ে দিলেন শত্রুপক্ষের প্রেরিত কিন্তু তিনি এমন প্রতিশ্রুতি কাউকেই দেননি যে, দানব ছাড়া কোনও ব্যক্তিকে শিষ্যত্বে বরণ
এ প্রতিশ্রুতি উচ্চারণ করে কাউকে দিতে হয় না দেবযানী। এ প্রতিশ্রুতি অলিখিতই থাকে। যে কাজ তিনি করেছেন তা তার অজ্ঞাতসারে হলেও স্বজন পরাবের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমার পিতা তাে বলেননি যে তিনি দানবকুলকে আর যুদ্ধে সঞ্জীবিত করবেন না। যুদ্ধের নিস্পত্তি হয় জয় পরাজয়ে। দেব দানবের যুদ্ধ চলে আসছে আবহমান কাল থেকে। কখনও দানবের জয়, কখনও দেবতার।
কিন্তু সঞ্জীবনী বিদ্যার অধিকারী তােমার পিতা মহর্ষিদেব দানবপক্ষ অবলম্বন করার পরে দানবরা সৈন্যক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে অনেক বেশি বলশালী হয়ে ওঠে। আজ তােমার পিতাই শত্রুপক্ষকে সে বিদ্যা দান করে দানবকুলের পরাভবের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছেন। | সে তার ব্যক্তিগত অভিরুচি শর্মিষ্ঠা। তিনি সবার পূজনীয়, সবার শুরু। তার সমালােচনার অধিকার অন্য কারু নেই।
আছে বই কী দেবযানী। তিনি নিঃস্বার্থভাবে দানবদের উপকার যদি করতেন তা হলে তিনি থাকতেন সমালােচনার উর্ধ্বে। কিন্তু তিনি যে আশ্রমে রয়েছেন তা দানবরাজ বৃষপর্বারই অধিকারভুক্ত। তা ছাড়া তার ভরণপােষণ যাগযন্ত্রের সমস্ত ব্যবস্থাই করা হয়ে থাকে রাজকোষ কুদ্ধ দেবযানী বলল, একবার আমার পিতার ভরণপােষণের প্রশ্ন তুলে তুমি শাস্তি পেয়েছিলে, মনে নেই শর্মিষ্ঠা ? | আজ সে অতীতকে ভুলে যাও দেবযানী। সে আর ফিরে আসবে না। আমি পিতার অধীন নই, তােমার তাে নয়ই। সুতরাং অনাবৃত করে দেখাবার অধিকার আমার কাছে আছে। আর তােমার পিতার অভিশাপের ভয় দেখিয়াে না আমাকে। আমি যেখানে নিজের বিবেকের কাছে মুক্ত, যেখানে সত্যই আমার আশ্রয়, সেখানে সব অভিশাপই ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাবে। দেব দ্বিজ ঋষি কারুরই কাছ থেকে কোনও শঙ্কা আমার নেই। | তুমি দানবের ঘরে জন্মেছ তাই ঔদ্ধত্য তােমার ভূষণ। ব্রাহ্মণ, আর ঋষিকুলের প্রতি কীরূপ আচরণ করতে হয় তা শেখােনি! কেবল যুদ্ধ করলে শক্তিমান হওয়া যায় কিন্তু উচ্চ চিন্তা, উচ্চ হৃদয়ের অধিকারী হতে হলে ঋষির মতাে সাধনা করাই চাই শর্মিষ্ঠা। তুমি দানবকন্যা,
শােননা দেবযানী, ঋষিত্বের বড়াই আর কোরাে না। তােমার পিতা অন্ধ, তাই সত্যাসত্যের বিচার না করে, কেবলমাত্র তােমার কথার ওপর নির্ভর করে আমার গুরুতর শাস্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু আমার পিতা দানব হয়েও আপন কন্যার শাস্তি বিধানে ইতস্তুত করেননি। তােমার বিবাহের পর আমার পিতা তােমাকে উপযুক্ত উপঢৌকন দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন মহারাজ যযাতির রাজ্যে। সঙ্গে সাধারণ এক শিবিকায় দাসী করে পাঠিয়ে দিলেন তার প্রাণের কন্যা শর্মিষ্ঠাকে। বুকখানা পাষাণ হয়ে গেলেও একবিন্দু অশ্রু নির্গত হয়নি তার চোখ থেকে। আর অন্যদিকে ঋষি শুক্রাচার্য কন্যাকে পাঠালেন পতিগৃহে। তঁার কি একবারও মনে হল না, আর একটি কন্যা সমস্ত আনন্দের আয়ােজনের মাঝখানে একবুক বেদনা নিয়ে সম্পূর্ণ অপরিচিত রাজগুহের অন্ধকার কোণে নির্বাসিতার জীবনযাপন করতে চলেছে। ধরে নাও আমি তােমাকে মৃত্যুর ফাঁদেই ফেলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দেবযানী, তখন আমাদের বয়সই বা কত! অপরিণত বুদ্ধির দুটি কন্যা যদি পরস্পর বিবাদ করতে গিয়ে কোনও অঘটনই ঘটিয়ে থাকে, তাহলে বিচক্ষণ ঋষি কী করে সেই ঘটনায় গুরুত্ব আরােপ করলেন! আমার পিতার প্রতি সামান্য কৃতজ্ঞতাবােধও যদি তার থাকত তা হলে তিনি তার অপ্রাপ্তবয়স্কা কন্যার ওপর এত অবিচার করতেন না। ব্রাহ্মণের ঔদার্যের আর মিথ্যা বড়াই কোরাে না দেবযানী। আমার পিতা বৃষপর্বাকে দেখে যেন তোমার মহর্ষি পিতা লােক ব্যবহার শিক্ষা করেন।
একটু থেমে শর্মিষ্ঠা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি এসকল কথা মহর্ষিকেই শােনাতে এসেছিলাম, কিন্তু আমার দুর্ভাগা তার পরিবর্তে তােমাকেই শােনাতে হল।
দেবযানী ক্রুদ্ধ, স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। দৃপ্ত পদবিক্ষেপে আশ্রম পরিত্যাগ করে চলে গেল
সারথী নেমে গিয়ে সন্ধান নিয়ে এসে জানাল, আশ্চর্য খবর মহারানি। মহারাজ নাকি জরামুক্ত হয়ে অশ্বারােহণে কিছু পূর্বে এই পথ অতিক্রম করে গেছেন। প্রজারা তাই উল্লাসধ্বনি করে চলেছে?
সঙ্গে সঙ্গে শর্মিষ্ঠা কন্ঠের হার খুলে সারথীকে দিয়ে বলল, এ শুভসংবাদের পুরস্কার তােমার প্রিয়তমা পত্নীর হাতে তুলে দিয়ে। দ্রুত রথ চালিয়ে চলাে প্রাসাদে। | প্রাসাদরীর কাছে শুভসংবাদটি দ্বিতীয়বার শ্রবণ করে আনন্দে আবেগে চোখে জল এসে গেল শর্মিষ্ঠার। মহারাজকে দেখবার জন্য অধীর হয়ে উঠল প্রাণ। কিন্তু জানা গেল মহারাজ সূর্যাস্তের সমারােহ পশ্চিম দিগন্তে। রানি শর্মিষ্ঠা প্রবেশ করল প্রাসাদ অভ্যন্তরে আপন নিকেতনে। প্রাসাদ প্রকোষ্ঠে সন্ধ্যাদীপ প্রজ্জ্বলিত হয়েছে। অদূরে দেবাদিবের মন্দিরে শুরু শর্মিষ্ঠা নিজের প্রকোষ্ঠ ত্যাগ করে প্রবেশ করল পুত্র পুরুর কক্ষে। সে কক্ষে তখনও সন্ধ্যাদীপ জ্বলেনি। অন্ধকারের ভেতর থেকে শর্মিষ্ঠা শুনতে পেল, কে যেন শাস-প্রশ্বাস গ্রহণ এমন বিকৃত ভগ্ন কণ্ঠস্বরে কথা বলছ কেন পুরু? গুহে দীপ জ্বালাবার আদেশ দাওনি কেন আজ থেকে এই প্রকোষ্ঠে পুরু থাকবে অন্ধকারের জীব হয়ে। সমস্ত জগৎ থেকে সে স্বেচ্ছায় নিজেকে সরিয়ে নিয়ে যাপন করবে নির্বাসিতের জীবন।
হয়েছে তােমার, আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না বাবা।
আমি পিতাকে যৌবন দান করে জরা গ্রহণ করেছি মা!
শর্মিষ্ঠার আর্ত চিৎকারে প্রাসাদ প্রকোষ্ঠ দীৰ্ণবিদীর্ণ হতে লাগল।
পুরু কাতর জননীর কণ্ঠ বেষ্টন করে বলল, আমি পবিত্র ব্রত গ্রহণ করেছি মা। অন্তরে আমার কোনও আক্ষেপই নেই। অতৃপ্ত পিতাকে যদি আমার যৌবন দান করে কিছুমাত্র তৃপ্তি দিতে পারি তা হলে ইহলােক পরলােক আমার আলােকিত হবে মা।
| দু’চোখ ভাসিয়ে প্লাবনের ধারা নামছে তখন রানি শর্মিষ্ঠার। ভগ্ন কণ্ঠে শর্মিষ্ঠা বলল, তােমার ওই জরাগ্রস্ত মুখ আমি কেমন করে দেখব পুরু। প্রভাত সূর্যের মতাে যে মুখের দীপ্তি, সেই মুখ আজ রাহুগ্রস্ত। জননী হয়ে, আমি কী করে আর ওই মুখের দিকে তাকাব পুত্র। | মা, তাই তাে আমি রয়েছি অন্ধকারে চতুর্দিক কুদ্ধ করে। পৃথিবীর মানুষের অকারণ ঔৎসুক্যের মুখােমুখি আমি হতে চাই না। পিতাকে অনুরােধ জানিয়েছি, তিনি যেন আমার কাছ থেকে তার যৌবনপ্রাপ্তির কথা সর্বসাধারণে না প্রকাশ করেন। পুত্রের কাছ থেকে পিতা নিয়েছে যৌবন, এ যে মা প্রতিটি মানুষের মুখে সমালােচনার বন্ধু হয়ে উঠবে। প্রথমে শুঞ্জন, তারপর তা রূপ নেবে প্রকাশ্য সমালােচনার। কেউ বিশ্বাস করবে না মা পিতৃঋণের সামান্যতম অংশ শােধ করবার জন্য পুরু স্বেচ্ছায় বরণ করে নিয়েছে তার পিতার জরা।
যেখানে পুত্র আমার জরাগ্রস্ত হয়ে লােগ সুখে বঞ্চিত!
হলে বিচলিত হয়ে উঠবে আমার চিত্ত। তুমি স্থির হও না। আশীর্বাদ করাে, যেন তােমার পুত্র অবিচলিত চিত্তে তার ব্রত উদযাপন করতে পারে।
একটু নীরব থেকে পুরু বলল, জীবনের প্রসারিত শাখায় দুটি পাখির বাস। একটি দেহ অন্যটি আত্মা। দেহ ভােগ করে ফল আর নির্লোভ, নিস্পৃহ আত্মা তাই দর্শন করে। আমি ভেজা না হয়ে দ্রষ্টা হতে চাই না।
পুত্র, তুমি আজ আমাকে শুধু কালের যাত্রাতেই অতিক্রম করে যাওনি, জ্ঞানেও অতিক্রম করে গেছ।
হেসে উঠল পুরু। বড় প্রসন্ন সে হাসি। বলল, জননীকে কি মহাকাল সীমা দিতে পারে মা। জননী মুর্তিতে নারী কালের অতীত। প্রতিটি পুরুষ জননীর দৃষ্টিতে শিশু। আর সন্তান কি কখনও জ্ঞানের বিচারে জননীকে অতিক্রম করতে পারে মা। সস্তানের সকল আচরণ, চরিত্র, প্রজ্ঞা যে আশৈশব জননীর নখদর্পণে। সন্তানের সকল ক্রিয়া, সকল মহিমার স্রষ্টা তিনি। | অন্ধকারে জরা-পীড়িত পুত্রকে আদরে চুম্বনে পূর্ণ করে দিয়ে শর্মিষ্ঠা পুরুর প্রকোষ্ঠ থেকে নিষ্ক্রান্ত হল। পুরু একাকী বসে অন্ধকারের বুকে প্রার্থনা করতে লাগল। হে রাত্রি, আশ্চর্য তােমার মহিমা। সমস্ত দৃশ্যমান জগতের পৃথক পৃথক অস্তিত্বকে তুমি অবলুপ্ত করে দাও। তুমিই প্রমাণ করাে সৃষ্টিতে যত বৈচিত্র্যই থাক, তার মূল উৎস এক। কে পিতা, কে জননী,
যৌবন, জরা সেখানে একাকার। কেবল স্রোতের বুকে তরঙ্গের উত্থানপতন মাত্র। শৈশব তরঙ্গটি স্রোতের আন্দোলনে সৃষ্টি হয়ে ক্রমে শফীত হয়ে উঠল যৌবনের গরিমায়। তারপর জরাগ্রস্ত হয়ে বিলীন হয়ে গেল ওই স্রোতের বক্ষে। একই জলস্রোত, একই কালস্রোত। কেবল আলােকে বিভ্রান্তি। রূপের ভেতর পড়ে অরূপ রতন হয়ে যাচ্ছে অচেনা।
হে রাত্রি, তুমি তোমার অন্ধকারের স্পর্শে আমার উপলব্ধির দ্বার উন্মুক্ত করে দাও।
চিনতে পারছ না আমাকে মহারানি শর্মিষ্ঠা ? বিশ্বাস করাে, আজ আমার সন্তানের সঙ্গে তুমি অভিন্ন হয়ে গেছ।
কিন্তু মহারাজ সমস্ত যৌবন-শক্তি আমার পুত্রের। তুমি একই শয্যায় শয়ন করে আর আমাকে স্পর্শ কোরাে না। চেয়াে না আমার দিকে কামনার দৃষ্টিতে। আজ থেকে এ প্রাসাদে আমি শুধু জননী। কামনা বাসনার সমস্ত বহ্নিশিখা আজ থেকে নির্বাপিত।
তুমি আমার অগ্নিসাক্ষী রেখে গ্রহণ করা বিবাহিতা পত্নী নও?
স্বাভাবিক দেহধর্মে ফিরে আসতে পারে সেদিন যে অবস্থাতেই থাকো, শর্মিষ্ঠা জীবিত থাকলে প্রভাতে রাজকার্যে বসে নতুন উদ্দীপনায় উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলেন মহারাজ যযাতি। সভাসদেরা অবাক হয়ে দেখল, মহারাজ যযাতি তার শাসনকালের মধ্যে আজই সর্বাধিক প্রদীপ্ত হয়ে সৈন্যাধ্যক্ষকে আহ্বান করে যযাতি বললেন, পক্ষকালের মধ্যে বাহিনী প্রস্তুত করুন। সীমান্তের দুবৃত্তদের আমি স্বয়ং গিয়ে শান্তি বিধান করে আসব।
সৈন্যাধ্যক্ষ সবিনয়ে বললেন, মহাশয় আপনি যখন যুদ্ধযাত্রা মনস্থ করেছেন তখন কেবলমাত্র সীমান্তবাসীদের শাসন না করে উত্তরাভিমুখে আরও কিছুদূর অগ্রসর হয়ে চলুন।
সৈন্যদের মধ্যে যে তেজোহীনতার আবির্ভাব ঘটে তা চলাচল ও যুদ্ধক্রিয়ার ফলে বিদূরিত হবে। দ্বিতীয়ত, কতকগুলি যুদ্ধ জয়ের ফলে চতুর্দিকস্থ নরপতি ও শত্রুকুলের মধ্যে শ্রদ্ধা ও সন্ত্রাসের সৃষ্টি হবে। আর সর্বশেষ ফল, রাজকোষের শ্রীবৃদ্ধি।
মহারাজ যযাতি বললেন, এ পরামর্শ আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে অতীব সুচিন্তিত ও যুক্তিযুক্ত। সভাসদগণ, আপনাদের এ বিষয়ে বিরুদ্ধ কোনও মন্তব্য থাকলে প্রকাশ করতে যুদ্ধ অপেক্ষা শান্তিই কাম্য হওয়া উচিত। যুদ্ধে শরীর নাশক উত্তেজনা, লােকক্ষয় জয়পরাজয়ের অনিশ্চয়তা থাকে। কিন্তু শান্তির মাঝে থাকে সংগঠনের স্পৃহা। কৃষিকর্ম, গােধন বৃদ্ধি প্রভৃতি প্রজার মঙ্গল প্রদায়ক কর্মশুলি সম্পাদিত হয়।
মহারাজ যযাতি বললেন, আপনার পরামর্শ সর্বকালে সকল মানুষের গ্রহণযােগ্য। কিন্তু যদি বিশ্বের সকল নৃপতি পরস্পরের সঙ্গে সম্ভাব রক্ষা করে নিজ নিজ দেশ শাসন করতেন তা হলে লােঞ্চয়কারী যুদ্ধের কোনও প্রশ্নই উঠত না। মনুষ্যচরিত্র বিচিত্র। এই মুহূর্তে যে বন্ধু পরমুহুর্তে সে শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উঠতে পারে। আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, কিছুকাল আমার জরাগ্রস্তুতার সুযোেগ নিয়ে সীমান্তের কিরাত সম্প্রদায় উপদ্রব শুরু করে দিয়েছে। তাই মনুষ্য
থেকে শক্তিমান না ভাবে তা হলে তাকে চতুর্দিক থেকে নিত্য উত্ত্যক্ত করতে থাকবে, যার ফলে দেশের মঙ্গল কর্মে আত্মনিয়ােগ করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না।
একটু থেমে রাজা বললেন, সৈন্যাধক্ষেরা যেমন আমার একদিকের শক্তি, অন্যদিকের আপনারা। আমি যুদ্ধযাত্রা করলেও জানি রাজ্যের উন্নতি বিধায়ক কর্মগুলি আপনারা সুষ্ঠুভাবে বৃদ্ধ আমাত্য বললেন, আপনি নিশ্চিন্তে যুদ্ধযাত্রা করুন মহারাজ, আমরা সমবেতভাবে সকল অমাত্য সাধ্যমতাে প্রজাকুলের প্রিয়কর্ম সম্পাদন করব।
সুসজ্জিত তােরণ অতিক্রম করে চলল মহারাজ যযাতির চতুরঙ্গ সৈন্যবাহিনী। অশ্ববাহিত রথশীর্ষে উদ্ভডীন সূর্য-লাঞ্ছিত পতাকা শ্রেণি বায়ুভরে আন্দোলিত হয়ে যেন পূর্বাহেই বিজয় ঘােষণা করছে। মহারাজের জয়ধ্বনিতে মুখরিত রাজপথ। হস্তীবাহিনীর বৃংহণ, অশ্ববাহিনীর হ্রেষা, রথচক্রের ঘর্ঘর, পদাতিকের কোলাহল, ভেরী পটহ মৃদঙ্গ শিঙা শঙ্খের সম্মিলিত নিনাদ যুদ্ধযাত্রাকে মহা সমারােহপূর্ণ করে তুলল। চতুরঙ্গ সেনার গমনে গগনমার্গে যে ধুলি উথিত সুসজ্জিত গজপৃষ্ঠে আরােহণ করে চলেছেন মহারাজা যযাতি। সূর্যালােকে প্রজ্জ্বলিত হচ্ছে
মহারাজ যযাতি প্রথমে গঙ্গা যমুনার মধ্যবর্তী ক্ষেত্র থেকে সৈন্য পরিচালনা করে নিয়ে গেলেন উত্তরাভিমুখে। তার রাজ্য সীমার প্রান্তে অস্তগিরিতে অবস্থিত কিরাত রাজ্য। এই উপত অঞ্চল শাসনই মহারাজ যযাতির প্রথম লক্ষ্য। কিরাতরা মহা ধনুর্ধর জাতি। তারা সহজে পরাভব স্বীকার করতে চাইল না। পর্বতের আড়াল আয় বৃক্ষশীর্ষ থেকে নিক্ষেপ করতে রাজা যযাতি সৈন্যদের আদেশ দিলেন অরণ্যে অগ্নি সংযােগের। রাজাদেশ মুহূর্তে প্রতিপালিত হল। শীতের শেষে বৃক্ষতলে সুপীকৃত শুষ্ক পত্রে অগ্নিসংযোেগমাত্র তা মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ল অরণ্যের অভ্যন্তরে। বৃক্ষে বৃক্ষে জ্বলে উঠল অনল। সহস্র সহস্র পক্ষী পাখার শব্দে বাতাস বিদীর্ণ করে আকাশপথে উড়ে চলল। সারারাত্রি রহস্যময় আলাে অন্ধকারের চিত্র ফুটে উঠল অস্তুগিরির অরণ্যে অরণ্যে। স্কন্ধ্যাবারে বিশ্রামরত সৈন্যরা শুনতে পেল প্রাণভয়ে প্রভাতে রাজসমীপে কিরতিবাহিনী এসে ভূমিতে ধনুঃশর নিক্ষেপ করে আত্মসমর্পণ করল। কিরাতরাজ করজোড়ে বললেন, সম্রাট, আমি আপনার অনুগত দাস। এখন থেকে আপনার আজ্ঞাবাহী হয়ে থাকব। কৃপা করে আর অরণ্যে অগ্নি সংযােগ করবেন না। আমরা ব্যাধ জাতি। মুগ আর পক্ষীই আমাদের সম্পদ। অরণ্য দন্ধ হলে আমাদের রাজ্য ছেড়ি পশুপক্ষীরা পলায়ন করবে। আমরা শবর জাতি সামান্য উপটৌকন এনেছি, গ্রহণ করে কৃতার্থ করুন।
মহারাজ যযাতি শবর নায়ককে বন্ধু বলে আলিঙ্গন করে অভয়দান করলেন। শবররাজ দুর্গম পার্বত্য পথযাত্রায় সম্রাটকে পথপ্রদর্শকের জন্য দিলেন কয়েকজন দক্ষ ও মহারাজ যযাতি তাদের সহযােগিতায় বহির্গিরি ও উপগিরির অধিকাংশ স্থান আপনার অধিকারভুক্ত করলেন। বিপুল উদ্যম ও বাহুবলে তিনি অরণ্য প্রদেশের অধিবাসীদের পরাভূত ব্ৰহ্মপুরায় বহু ক্ষত্রিয় নৃপতি সমবেত হয়ে মহারাজ যযাতির সৈন্যবাহিনীকে আক্রমণ করল। মহারাজ অকুতােভয়ে সমবেত রাজন্যবর্গের সম্মুখীন হয়ে তার বিক্রম প্রকাশ করলেন।
হয়ে আসমর্পণের পথ গ্রহণ করল। | মহারাজ যযাতি তাদের সঙ্গে সখ্যস্থাপন করে বললেন, আপনারা আমার সমতল আপনাদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের সেতুবন্ধন হােক। | যৌবন শক্তিতে উজ্জীবিত মহাপরাক্রমশালী সম্রাট অতঃপর কিম্পূরুষবর্ষের উদ্দেশে যাত্রা করলেন। সমতলভূমি থেকে পর্বতারােহণের সময়ে তিনি নিম্নে রেখে এসেছিলেন তার গজবাহিনী। অশ্বারােহণে তিনি পর্বতসংকুল রাজ্যগুলি অতিক্রম করছিলেন। এখন কিশুরুষবর্ষে প্রবেশের মুখে তিনি সীমান্ত রাজ্যগুলির কাছ থেকে উপঢৌকন স্বরূপ লাভ সুনিশ্চিত। অতি দুর্গম বিঘ্ন-সংকুল পথে আরােহীসহ এদের যাত্রা নির্বিঘ্ন। | দুর্জয় সাহস ও অদম্য মনােবল নিয়ে মহারাজ যযাতি অগ্রসর হতে লাগলেন। পার্বত্য ঝঞ্জা ও শৈত্য প্রবাহে ক্ষতিগ্রস্ত হল তার স্কন্ধাবার। তিনি হিমানী সম্প্রপাতে কতির সৈন্যদের পর্বত সমতলে প্রত্যাবর্তনের আদেশ দিলেন। স্বয়ং মহারাজ একদল অতি দক্ষ অশ্বরােহী নিয়ে প্রতিরােধ করতে এগিয়ে এল না। প্রত্যুগমন করে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাজপুরী থেকে প্রেরিত সুললিত সংগীতে আপ্যায়িত করে রাজপুরীর দিকে নিয়ে চলল।
পর্বত খােদিত করে নির্মিত হয়েছে আশ্চর্য প্রাসাদ। প্রাসাদের সােপানরাজি বিধৌত হচ্ছে পর্বতশীর্য থেকে নিরন্তর প্রবাহিত সুশীতল জলধারায়। প্রাসাদের স্বর্ণচুড়া সূর্যালােকে ঝলমল করে উঠছে। ঠিক প্রাসাদের পশ্চাৎপটে নীলাকাশের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ধৌলাধার পর্বতের তুষারশূল। প্রাসাদের দুই ধারে সবুজ নিবিড় অরণ্য পাহাড়ের কোল বেয়ে নেমে গেছে প্রাসাদ-নিম্নে অশ্ব থেকে অবতরণ করলেন মহারাজ যযাতি। সঙ্গে সঙ্গে অশ্বারােহী অনুচরবাহিনী। কিম্পূরুষবর্ষের রাজা সূক্ষ্ম বস্ত্রখণ্ড ও চমরীপুচ্ছের চামর দান করে মহারাজ যাতিকে সমাদরে নিয়ে গেলেন প্রাসাদে। তার প্রাসাদের লােকেরা মহারাজের অশ্বারােহীদের পরিচর্যায় নিযুক্ত রইল।
সপ্ত দিবস স্বপ্নের মতাে কেটে গেল মহারাজ যযাতির। এমন সুধাকণ্ঠ কিন্নরীদের সংগীত তিনি তার সাম্রাজ্যের কোথাও কোনও গায়িকার কণ্ঠে শ্রবণ করেনি। | কিশুরুষবর্যের রাজা সখা বলে সম্ভাষণ করেছেন মহারাজ যযাতিকে। প্রতিদিন সম্রাটের মনােরঞ্জনের জন্য বসেছে নৃত্যগীতের আসর। তঁার এবং তার অনুচরদের তুষ্টির জন্য পরিবেশন করা হয়েছে নানা ধরনের ভোজ্যবস্তু।
অভিভূত রাজা যযাতি এক সন্ধ্যায় সংগীতের আসরে কিশুরুষবর্ষের রাজাকে বললেন, সখা, আপনার আতিথ্যে আমরা পরম পরিতৃপ্তি লাভ করেছি। আমাকে এবার স্বরাজ্যে ফেরার আপনি এ রাজ্যের অধীশকের হৃদয় জয় করে নিয়েছেন। আপনি আমার সখা। আপনাকে কেবল একটি শর্তে ফিরে যেতে দিতে পারি। সে শর্তটি হল, আপনার অন্তরের ক্ষুদ্র একটি কোণে যদি এই সুদূরের বন্ধুটিকে স্থান দেন।
মহারাজ য্যাতি নিবিড় আলিঙ্গনে বেঁধে ফেললেন কিম্পূরুষবর্ষের উদার হৃদয় রাজাকে।
যে প্রভাতে যাত্রার দিন স্থির হয়েছে তার পূর্বরাত্রে দুই সখা বসে বসে কিন্নরীদের সংগীত শ্রবণ করছিলেন, এমন সময় কিম্পূরুষবর্ষের রাজা বললেন, এ কী সংগীত শ্রবণ করছেন বন্ধু, এর চেয়ে সহস্রগুণ উৎকৃষ্ট সংগীত এই কিম্পূরুষবর্ষেই শােনা যায়।
হ্যা সী! তবে সে সংগীত ভাগ্যবান ব্যতীত কেউ শুনতে পায় না।
অপরাধ না নিলে কৃতার্থ হব সখা, আমার প্রাসাদে সে সংগীত অনুষ্ঠানের যদি কোনও সুযােগ থাকত তা হলে নিশ্চয়ই আপনাকে তা শােনাতাম।
কৌতুহলী যযাতি বললেন, কোথায় অনুষ্ঠিত হয় সে সংগীত? কিশুরুষবর্যের সীমায় সুউচ্চ পর্বতরাজির কোলে এক অতি সুদৃশ্য অরণ্যভূমি আছে। সেই অরণ্যের অভ্যন্তরে লােকচক্ষুর অন্তরালে রয়েছে এক সরােবর। দিবালােকে সেই স্বচ্ছ সুনীল সরােবরে প্রতিবিম্বিত তুষার শৃঙ্গগুলি। নিশীথে, পূর্ণ চন্দ্রের আলােকে সে সরসীর শােভা হয়ে নেমে আসে অলৌকিক রূপলাবণ্য দ্যুতি সম্পন্ন এক অঙ্গরা। সেই অঙ্গরা ওই সরােবরের জলে অঙ্গ ডুবিয়ে স্নান ক।ে সারারাত্রি পূর্ণিমার চন্দ্র প্রত্যক্ষ করে তার স্নানলীলা।
ওই অঙ্গরা সরােবরে নেমেই শুরু করে তার সংগীত। পূর্বাকাশে শুকতারা উদয়ের পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত তার কণ্ঠের সেই অলৌকিক সংগীত শােনা যায়। তারপর সেই অঙ্গরা সমস্ত নিশীথ প্রকৃতির বুকে বিরহ ছড়িয়ে দিয়ে প্রভাতের পূর্বে অস্তুহিত হয়।
আছে, আর সেই পথ ধরে কিম্পূরুষবর্ষের অধিবাসীরা বসন্ত পুর্ণিমার রাত্রে ওই অঙ্গরার গান শুনতে যাত্রা করে?
করতে পারে না। আবার বসন্ত পূর্ণিমার ঠিক সন্ধ্যালয়ে সেই সবােবর তীরের অরণ্যভূমিতে পেীছােনাে চাই। এমন লগ্নে দুর্গম পথযাত্রীকে সেখানে পৌছোতে হবে যখন পূর্ণ চন্দ্রটি প্রকাশ ভাগ্যে ঘটে না। কেবলমাত্র সেই ব্যক্তিই দর্শন করবার অধিকার পায় স্নানলীলারত অঙ্গরাকে।
মহারাজ যযাতি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করেন, সে পথের নিশানা আপনার জানা আছে, একমাত্র পথ চলে গেছে পাহাড় পর্বত অতিক্রম করে, কনকনান্ত বিদীর্ণ করে। যে পথ দিয়ে আপনি কিম্পুরুষবর্ষে প্রবেশ করেছিলেন, সেই পথে এগিয়ে আসার সময়ে উর্ধ্বলােক থেকে গর্জনশীল একটি জলধারাকে নেমে আসতে দেখেছিলেন। ওই জলধারার দক্ষিণ পার্শ্ব দিয়ে সেই পথ চলে গেছে। সহস্র সহস্র বর্ষ ধরে মেষচারকেরা ওই পথ দিয়ে তাদের মেষপাল নিয়ে চলতে চলতে সুস্পষ্ট একটি পথরেখার সৃষ্টি করেছে। ওই পথ সেই সরােবরতীরস্থ অরণ্যভূমি খুঁয়ে বেঁকে চলে গেছে পূর্বাচলের দিকে।
পরদিন কিম্পূরুষবর্ষের রাজা সানেত্রে বিদায় দিলেন বন্ধু যযাতি ও তার অনুচরদের। মহারাজ যযাতি অতি উৎকৃষ্ট মেষলােম ও পালক নির্মিত একখানি গরম পরিধেয় লাভ করলেন বন্ধুর কাছ থেকে। শৈত্য যত প্রবলই হােক তা প্রবেশ করতে পারে না এই পােশাকধারীর দেহের অভ্যন্তরে।
অশ্বারােহীদের নিয়ে রাজা যযাতি দুই দিবস অতিক্রম করার পর উপস্থিত হলেন সেই রাজা যযাতি একাকী বিচরণ করতে করতে সেই পথের সন্ধান পেলেন। তার সহসা মনে হল কে যেন তাকে আকর্ষণ করছে ওই পথের দিকে। অপ্রতিরােধ্য সেই আকর্ষণ। তিনি ওই সেই দৈব নির্দিষ্ট ব্যক্তি আঁর ভাগ্যে এই সরােবরের অলৌকিক ঘটনাবলী দর্শনের সুযােগ রয়েছে। কাল গণনা করে দেখলেন তিন দিবস পরেই রােমাঞ্চকর সেই বসন্ত পুর্ণিমা। অনুচর অশ্বারােহীদের নিকটে আহ্বান করলেন মহারাজ যযাতি। বললেন, এইখানে তােমাদের সঙ্গে আমার বিচ্ছেদ ঘটল। তােমরা রাজ্যে ফিরে যাও। অমাত্যদের বলাে, আমি যতকাল না ফিরি পরামর্শের প্রয়ােজন হলে তারা যেন পুরুর মতামত গ্রহণ করেন। কোনওক্রমেই যদুকে যেন তারা রাজকার্যে প্রবেশের সুযােগ না দেন।
বিস্মিত অনুচরেরা মহারাজের আদেশ শিরােধার্য করে একসময় স্বদেশাভিমুখে প্রস্থান ঠিক তৃতীয় দিবসের সন্ধ্যালগ্নে রাজা যযাতি অশ্বারােহণে এসে পেীছােলেন সেই শৈলঘেরা অরণ্যভূমির সরােবর তীরে। সবিস্ময়ে দেখতে পেলেন পর্বতের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে মহারাজ যযাতি অশ্ব থেকে অবতরণ করে অশ্বটিকে বেঁধে রাখলেন অরণ্য বৃক্ষের সেখানে আত্মগােপন করে উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন।
রুদ্ধশ্বাস কয়েকটি নিমেষ অতিক্রান্ত হবার পর রাজা যযাতি দেখলেন নীলকান্ত মণির মতাে নীল সরােবরের জল কাপিয়ে একটা বাতাস বয়ে গেল। জলের মধ্যে ভাসমান তুষারখণ্ডগুলি পরস্পরের সঙ্গে সংঘাতে আশ্চর্য সুন্দর এক ধ্বনির সৃষ্টি করল। অরণ্য বৃক্ষের পত্রে বীণার ধ্বনির মতাে শ্রুতিসুখকর ধ্বনি বেজে বেজে ফিরতে লাগল। রাজা যযাতির মনে হল, তিনি যেন গন্ধর্বসভা প্রত্যক্ষ করছেন। সুরমন্ত্রীরা শুরু করেছে যবাদন। এইমাত্র গীতশিল্পী প্রবেশ করে আরম্ভ করবে তার অলৌকিক সংগীত।
রাজা যযাতির বক্ষস্পন্দনকে ক্ষণকালের জন্য স্তব্ধ করে দিয়ে সরােবর তীরে আবির্ভূত হল সেই অঙ্গরা। অবর্ণনীয় অঙ্গ সুষমা তার। জ্যোৎস্নার থেকে একখণ্ড বস্ত্র নিয়ে জড়িয়েছে নৃত্য ভঙ্গীমায় দুই হস্ত প্রসারিত করে বস্ত্রখানি বাতাসে উড়িয়ে অপরূপা অঙ্গরা একবার প্রদক্ষিণ করে নিল সমস্ত সরােবর। তারপর পালকের মতাে নরম পরিধেয়খানি মহারাজ যক্তির সম্মুখস্থ বৃক্ষশাখায় লীলাভরে পরিত্যাগ করে নগ্ন দেহবল্লরী আন্দোলিত করতে করতে নেমে গেল সেই স্বচ্ছ শীতল সলিলে।
সেই বিন্দুগুলি জলে পতনের সঙ্গে সঙ্গে মঞ্জরী নিক্কণের মতাে শব্দিত হতে লাগল।
শুরু হল সংগীত। চরাচর অন্ধ। সে সংগীতের সুর পুষ্প পরাগের মতাে বাতাসে ভাসতে ভাসতে ছড়িয়ে পড়তে লাগল সান্ধ্য প্রকৃতির বুকে।
রাজা যযাতির মনে হল কোনও স্বর্গীয় বিহঙ্গ সেধে চলেছে তার সুমিষ্ট স্বর। অতিপূর্ব সেই সংগীত একেবারে হৃদয়ের গভীরে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে। মােহাচ্ছন্ন রাজা সারারাত্রি ব্যাপী শুনলেন সেই অপ্সরার অলৌকিক সংগীত। দেখলেন অদৃষ্টপূর্ব দেহধারিণীর সানলীলা। যখন শুকতারা উদিত হল পূর্বাশায় তখন সহসা থেমে গেল সেই অবর্ণনীয় হৃদয় জল থেকে উঠে দাঁড়াল সেই অপরূপা। একটা শুত্র রাজহংসী যেন উঠে এল স্নান সাঙ্গ থেকে আকর্ষণ করে নিয়ে আবার গুহার অভ্যস্তরে প্রবেশ করলেন।
ললিত পদবিক্ষেপে বৃক্ষের কাছে এসে দাঁড়াল সেই অঙ্গরা। বিস্ময়ে স্তম্ভিত। কোথায় গেল তার সেই বস্ত্রখণ্ড, যাকে স্পর্শ করলে তার দেহ পালকের মত হালকা হয়ে যায় আর সে সঙ্গে সঙ্গে উঠে চলে যেতে পারে দেবলােকে। এ পদক্ষেপে চতুর্দিকে পরিভ্রমণ করে সে তার বস্ত্র অলরা সহসা আকাশের দিকে তাকাল। শুকতারাটি যেন সজল চোখে চেয়ে আছে তার দিকে। সে যে আর থাকতে পারবে না আকাশে। দিগন্তে দেখা দিয়েছে সেই ব্যাধ যে এখুনি শুরু করবে সুবর্ণ শর হেনে তার প্রভাতি মৃগয়া। | সুর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে বিগত হয়ে যাবে অপরার যথেচ্ছ ভ্রমণের মহিমা। দুই করে আঁখি আবৃত করে নতজানু হয়ে বসে পড়ল সেই অপ্সরা। রাজা যযাতি এগিয়ে গেলেন তার কাছে। বখানি জড়িয়ে দিলেন তার অনুদেহ ঘিরে। বললেন, ক্ষমা করাে দেবী, আমিই সেই তস্কর যে তােমার বস্ত্রখানি অপহরণ করেছিল। | চমকে উঠে দাঁড়াল অঙ্গরা। আকাশে তখন শুরু হয়ে গেছে আলাের প্লাবন। রাজা যযাতির আজ আমার জীবনে। একটি বছরের মতাে রুদ্ধ হয়ে গেল আমার জন্যে স্বর্গের দ্বার। আবার যখন ফিরে আসবে বসন্ত পূর্ণিমার এই রাত্রি কেবল তখনই আমি পাব মুক্তি, তার আগে নয়। | হে দেবী, সেই একটি বছর এই মর্তলােকে তােক তােমার অবস্থান। আমি যযাতি, এই মর্তরাজ যযাতির সঙ্গে স্বৰ্গনটী ঘৃতাচী সেই সরােবর তীরের অরণ্যে অতিবাহিত করল একটি বছর। যযাতি শােনাল অলরা ঘৃতাচীকে তার পূর্বপুরুষ পুরুরবা আর স্বৰ্গনটী উর্বশীর মিলনের কাহিনী। কামমােহিত, প্রেমমােহিত যযাতি আর ঘৃতাচী। নৃত্যে, সংগীতে, কলহাস্যে সে অরণ্য যেন এক নব ইন্দ্রলােক। নির্জন নীল সরােবর-সলিলে উভয়ের স্নানলীলা; অশ্বারােহণে উভয়ের পরিভ্রমণ; পর্বতগুহায় নিবিড় আলিঙ্গনে নিশিযাপন; দুটি হৃদয়কে বেঁধে | একটি বছর পরে ফিরে এল সেই বসন্ত পূর্ণিমা। সারা নিশি চলল মানলীলা আর অলৌকিক ভগ্ন হৃদয় রাজা যযাতি আপন হাতে তুলে দিল অঙ্গরা ঘৃতাচীর স্বর্গলােক যাত্রার অবলম্বন সেই বস্ত্রখানি। ঘৃতাচী স্থির দৃষ্টিতে তাকাল যযাতির দিকে। ইন্দ্রের মতাে বীর্যবান দেহ, কিন্তু আঁখিতে স্থির হয়ে আছে ব্যথার সজল ঘন মেঘ। স্বর্গের দেবতা কি কোনদিন ঘৃতাচীকে দিতে পারবে এমনি এক ব্যথা ভরা হৃদয়ের উপহার?
সূর্য উঠল, শুকতারা অদৃশ্য হল, কিন্তু সে অরণ্যভূমি ছেড়ে, রাজা যযাতির আকর্ষণ ছিন্ন করে স্বর্গে ফেরা হল না আর অলরা ঘৃতাচীর।
এমনি করে মহাকাল পরিক্রমায় যৌবনের লীলারঙ্গে প্রমত্ত প্রেমিক যুগলের কেটে গেল দুরের বিস্মৃত জীবন তাকে বারবার ব্যাকুল হাতছানি দিয়ে ডাকছে। উভয়ের নিশীথ ঘৃতাচী অবাক হয়ে দেখল, মহারাজ যযাতির মনে কোথায় যেন হয়ে যাচ্ছে বারবার তালভঙ্গ।
গান থেমে গেল। মহারাজ সচকিত হয়ে উঠলেন।
মহারাজ আর এই মর্তলােকে ঘৃতাচীর সংগীত কোনদিনও শােনা যাবে না। অপরাধ নিয়াে না ঘৃতাচী, আমি সত্যিই অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। আমি বুঝেছি মহারাজ, পূর্ব কোনও স্মৃতির বেদনায় মথিত হচ্ছে, তােমার হৃদয়। তােমার অনুমান মিথ্যা নয় ঘৃতাচী। আমার মন আজ বারে বারে স্মৃতি ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে। তােমাকে জানাতে পারিনি এতকাল, আমি এক অভিশপ্ত মানুষ। ঋষি শুক্রাচার্য আমার যৌবন আমাকে দান করে আমার জরা গ্রহণ করে তা হলে আমি আবার পুর্বাবস্থা ফিরে পাব। আমার তরুণ পুত্র পুরু আমাকে তার যৌবনদান করে ভয়ংকর জরা গ্রহণ করেছে ঘৃতাচী। তাকে আমি ফিরিয়ে দিতে চাই তার যৌবন। | শুব্ধ বিস্মিত ঘৃতাচী উঠে দাঁড়াল। কাতর কণ্ঠে বলল, মহারাজ, ফিরে যাও, ফিরে যাও নিজ আছে তাকে ফিরিয়ে দাও তার যৌবন। না হলে আমাদের এই সুদীর্ঘ যৌবন-বিহার ব্যর্থ হয়ে দুটি হৃদয়ের দীর্ঘশ্বাস জলে, স্থলে, অরণ্যে, নভলােকে পরিব্যাপ্ত হয়ে গেল।
পূর্বাশায় শুকতার প্রতীক্ষাকাতর চোখ মেলে তাকিয়ে আছে। অরণ্যভূমির আড়ালে অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে চন্দ্র। মহারাজ যাতি অশ্বপৃষ্ঠে আরােহণ করে তাকিয়ে রইলেন নভলােকের দিকে। ফিরে চলেছে অনন্ত যৌবনা ঘৃতাচী। একটি শ্বেত হংসের মতাে দুটি শ্বেতপক্ষ মেলে দিয়ে ভেসে যাচ্ছে সে গন্ধর্বলােক পার হয়ে চির আনন্দলােকের দিকে। দৃষ্টির আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে উর্ধ্বলােক থেকে রাজা যযাতির ললাটে ঝরে পড়ল মুক্তাবিন্দুর মতাে দুটি নিটোল অশ্রুবিন্দু।
কে? মহারাজ? জুরাভারে আমি অন্ধ, পঙ্গু। লুষ্ঠিত হয়ে আপনাকে প্রণাম নিবেদন করতে তােমার যৌবন ফিরিয়ে নিয়ে আমাকে মুক্তি দাও পুত্র। প্ৰলিত হচ্ছে আমার দেহ যৌবনের প্রদীপ্ত অগ্নিতে। নিত্য কামনায় ঘৃতাহুতিতে সে অগ্নি অনির্বাণ। সম্পন, রাজ্য, দেহ সব কিছু আহুতি দিয়েছি এই অগ্নিতে। কিন্তু ক্ষুধা মেটেনি। আকাক্ষা চির অতৃপ্ত থেকে গেছে। যৌবনে নিবৃত্তির শান্তি নেই পুত্র, আছে শুধু প্রবৃত্তির দাহ। কারা দাও, মৃত্যু দাও, দূর হােক
মহারাজ যযাতি ঋষি শুক্রাচার্যকে স্মরণ করে অন্ধকার গৃহমধ্যে উপবেশন করলেন। হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করলেন জরাগ্রস্ত পুত্রকে। সঙ্গে সঙ্গে এক অগ্নি থেকে প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠল আর এক অগ্নি। মহারাজ যযাতির দেহু নির্বাপিত সমিধের মতাে কৃষ্ণবর্ণ, গলিত ও জীর্ণ হয়ে গেল। পিতার চরণে প্রণাম নিবেদন করে উঠে দাঁড়াল তরুণ সূর্যের মতাে প্রদীপ্ত কুমার পুরু।
তখন শেষ সূর্যের রক্ত রশ্মি বসন্তের পুষ্পিত কনভূমিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। শ্বেত অন্যে আরােহণ করে কুমার পুরু প্রবেশ করল অরণ্যলােকে। কয়েকটি চিত্রিত হরিণ-হরিণী ব্যস্ত ছিল সরোবরে জলপানে, তারা অশ্বখুরধ্বনি শুনে মুখে তুলে চেয়ে রইল।
পুরু দ্রুত অশ্য চালনা করে এসে দাঁড়াল উদ্যানরক্ষক দেবলের কুটিরের সম্মুখে। কেউ কোথাও নেই। কেবলমাত্র কয়েকটি মৃত্তিকার ভূপের ওপর শুষ্ক পত্র বিকীর্ণ হয়ে আছে। | রুদ্ধ একটা দীর্ঘশ্বাস বুক ঠেলে বেরিয়ে এল পুরু। সে রাজপ্রাসাদের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে সরােবরে কমলের মতাে ফুটে উঠতে দেখেছে, কোথায় তার সেই মানস প্রতিমা শ্রুতি। সুদীর্থ জরার বেদনায় সে যে একমাত্র তারই স্মৃতিকে অবলম্বন করে লাভ করেছে পরম শান্তি।
পুরুর আকুল আহ্বানের পথ বেয়ে কোনও উত্তরই ধ্বনিত হল না বনভূমির কোনও প্রান্ত একটা অবরুদ্ধ হাহাকার অন্তরের নিভৃত কোণে কোণে ঘুরে ঘুরে বাজতে লাগল। পুরু অশ্বের মুখ রাজধানীর দিকে ফিরিয়ে নিল। ভগ্ন হৃদয়ে অতিক্রম করতে লাগল জনশূন্য সহসা অশ্বের বলগা আকর্ষণ করল পুরু। ওই তাে এক অথর্ব বৃদ্ধা বসে আছে পথের ধারে পুষ্পিত শাল্মলী বৃক্ষের তলায়। পাশে রক্ষিত জলের কলস।
পুরু অশ্ব থেকে অবতরণ করে বৃদ্ধার দিকে অগ্রসর হল। উচ্চকণ্ঠে বলল, আচ্ছা বলতে পারাে, উদ্যানরক্ষক দেবল এখন কোথায় ?
বিস্মিত বৃদ্ধাটি চোখের ওপর হাত রেখে দৃষ্টি প্রসারিত করে আগন্তুককে দেখবার চেষ্টা করল। কিন্তু সুস্পষ্ট কোনও ছবি ফুটে উঠল না তার চোখে।
দেবল মৃত। আচ্ছা বৃদ্ধা, তুমি বলতে পারাে দেবলের কন্যা শ্রুতি কোথায় ? হাতছানি দিয়ে পুরুকে আরও কাছে ডাকল বৃদ্ধা। তাকে দেখবার চেষ্টা করে এবারও ব্যর্থ কুমার। দেখাে তাে দেখি এ বৃদ্ধার ভেতর সেই চঞ্চল তরুণী শ্রুতির কোনও চিহ্ন খুঁজে পাও | নতজানু হয়ে বৃদ্ধার কাছে বসল পুরু। আনন্দে উদ্ভাসিত, অশ্রুতে প্লাবিত সুতির মুখখানা অনন্ত যৌবন তুলে ধরে আছে জরার মুখখানি। বলছে, আমার কাছে আছে সেই সঞ্জীবনী। সুধা যার স্পর্শে জরা পূর্ণ হয়ে উঠে অমিত প্রাণের লাবণ্যে। আমিই তাে শীতের রিক্ত শাখায় শাখায় যৌন বসন্তের পুষ্পিত প্লাবন এনে দিই।