মায়াজাল – স্বরুপা রায়

›› সম্পুর্ণ গল্প  

রাস্তার স্ট্রিট-ল্যাম্পের আলো ম্রিয়মাণ হবার পর তিমিরময় জঙ্গল। বাইক থামিয়ে আমি রা মোবাইলে আরেকবার ঠিকানাটা চেক করলাম। নাহ! ভুল হচ্ছে না। আমি ঠিক জায়গাতেই এসেছি। আশে-পাশে বাড়িঘর নেই, থাকলেও হয় লোডশেডিং নইলে বাড়িতে আলো জ্বালা বারণ। অতিথি আপ্যায়নের মতন একটা শেয়াল আমার সামনে দিয়ে দৌড়ে রাস্তা পার হলো। ঝিঁঝিঁপোকার ডাক নিস্তব্ধতার মাত্রা বাড়িয়ে তুলছে কয়েকগুণ। জনমানবশূন্য এরকম একটা জায়গায় কারোও বাস করার কথা নয়।
আমি বাইক থেকে নেমে হোয়াটস্যাপে রাজেশদার পাঠানো নম্বরটায় ফোন করতেই যাব, এমন সময় আমার ফোনটা ভয়ানক শব্দে বেজে উঠল। রিংটোনে লাগানো গানটা আমার খুব প্রিয়। কিন্তু বরে শাপ হয়ে এখন এই গান আমার হৃদকম্পন বাড়িয়ে তুলেছে ক্রমাগত। স্ক্রিনে ফুটে উঠেছে ক্লায়েন্টের নম্বর। রিসিভ করে বললাম, “হ্যালো ম্যাডাম, আমি সৃজন বলছিলাম। আপনার বাড়িটা…”
ফোনের ওপাশ থেকে একটা মধুর নারী কণ্ঠ ভেসে এল, “তুমি এসে গেছ?”
উল্ফ এই কণ্ঠের মাদকতা মড়াকেও দাঁড় করিয়ে দেবে।
“না ম্যাডাম। আসলে আপনার বাড়িটা ঠিক খুঁজে পাচ্ছি না। রাজেশদা যে ঠিকানাটা পাঠিয়েছে, সেখানে এসে আমি দাঁড়িয়ে আছি। চারিদিকে তো শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল।”
“গুগল ম্যাপ ধরে রাজেশের ঠিকানায় যদি ঠিকমতো পৌঁছে গিয়ে থাকো, তাহলে
হাতে বাঁপাশে দেখতে পাবে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটা পাঁচ-ছয় হাত চওড়া রাস্তা ভেতরের দিকে চলে গিয়েছে। রাস্তা থেকে কিছুই দেখতে পাবে না। কিন্তু ওই রাস্তা ধরে কিছু দূর আসতেই তুমি আমার বাড়ি পেয়ে যাবে।”
আমি বাঁপাশে তাকালাম। একটু এদিক ওদিক তাকাতে কয়েক পা আগে সেই রাস্তা চোখে পড়ল। আমি ফোনে বললাম, “রাস্তা পেয়ে গেছি ম্যাডাম। আসছি।”
“ঠিক আছে। নিচের গেট খোলাই আছে। সোজা উপরে চলে এসো।”
“আচ্ছা।” বলে আমি ফোনটা কেটে প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে বাইকে আবার উঠে বসলাম। বাইকে স্টার্ট দিয়ে জঙ্গলের ভেতরের সেই রাস্তায় ঢুকলাম। মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি শুরু হয়েছে। এরকম নিরিবিলি, জনমানবশূন্য জায়গায় একজন মহিলা একা একা কীভাবে থাকতে পারে, এটা আমার মাথাতে কিছুতেই ঢুকছে না। একটা ভয়ও মনের মধ্যে দানা বাঁধতে শুরু করেছে। আদৌ কি এই বাড়িতে কোনো মহিলা আছে কিনা বা এই মহিলা আসলে রক্তমাংসের মানুষ কিনা। দিদার কাছে ছোটবেলায় পিশাচী বা চুরেলের গল্প অনেক শুনেছি। আমি এসবে বিশ্বাস না করলেও আজ মনের মধ্যে এই ভাবনাগুলো জাঁকিয়ে বসছে। পড়াশোনার সঙ্গে পার্টটাইম কাজ করার শখ আজ প্রথমদিনই ঘুচে না যায়!
মিনিট তিনেকের মধ্যে জঙ্গলে ঘেরা কাঁচা রাস্তা পেরিয়ে আমি একটা খালি জায়গায় পৌঁছলাম। সামনেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে দোতলা একটা বাড়ি। দেখতে বেশ পুরোনো। আমার বাইকের হেডলাইটের আলোতে বোঝা যাচ্ছে যে, বাড়িটার গায়ের রং ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। চারপাশে জঙ্গলে ঘেরা।
বাড়ির বাইরে বাইক দাঁড় করিয়ে আমি নামলাম। বাইকটা ভালো করে লক করে বাড়িটার দিকে এগিয়ে গেলাম। প্রথমেই একটা বড় লোহার গেট। ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। আমি ভেতরে ঢুকে আবার গেটটা আটকে এগিয়ে গেলাম। সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়ালাম। সিঁড়িতে একটা হাল্কা হলুদ আলো জ্বলছে। এই আলোতে পরিবেশটা কেমন মায়াবী হয়ে উঠেছে। ধীরে ধীরে উপরে উঠে এলাম।
দোতলায় পৌঁছাতেই একটা সুন্দর গন্ধ আমার নাকে এসে ঠেকল। একবার চোখ বন্ধ করে, লম্বা শ্বাস নিয়ে সেই গন্ধ উপভোগ করলাম। জীবনে প্রথম এরকম একটা কাজ করতে এসে একদিকে যেরকম ভয় লাগছে, তেমনি অন্যদিকে বেশ উত্তেজনাও হচ্ছে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে না গেলে অবশ্য আমি এই কাজ কখনোই করতাম না। বাবার পাঠানো টাকায় শুধুই পড়াশোনা হয়, শখ পূরণ হয় না। আর এই বয়সে যদি নিজের শখগুলো পূরণ করতে না পারি, তাহলে আর কবে করব!
আমি একবার ঢোঁক গিলে আওয়াজ দিলাম, “ম্যাডাম… আমি এসে গেছি।”
ঘরের ভেতর থেকে ভেসে এল সেই নারী কণ্ঠ, “ভেতরে এসো।” এই কণ্ঠ ফোনের চেয়ে সামনাসামনি তো আরোও অপূর্ব।
আমি জুতো খুলে ঘরের ভেতরে ঢুকলাম। সিঁড়ির মতোই একটা হলুদ আলো জ্বলছে এই ঘরেও। ঘরের মাঝখানে একটা ছোট সোফা। সোফার সামনে একটা টেবিল। ঘরের এক কোণে একটা গ্রামোফোন রাখা। সাজানোর জন্য নাকি আজও সেটা ব্যবহার করা হয়, তা বুঝতে পারলাম না।
ঘরের এক দেওয়ালে একটা পোর্ট্রেট। ছবিতে দেখা যাচ্ছে একজন বৃদ্ধা। যার চুলগুলো উসকোখুসকো, মুখে বলি রেখার জটিল নক্সা, চোখের নিচে কেউ যেন বীভৎস ভাবে কালি লেপটে দিয়েছে। চোখের মণি দুটো নীল রঙয়ের, দেখে মনে হচ্ছে কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে এখনি।
“তুমি বোসো। আমি আসছি।” কোথা থেকে যে কথাটা ভেসে এসে আমার কানে ঢুকল, বুঝতে পারলাম না। কিন্তু এতে আমার সম্বিৎ ফিরল। নাহলে আমি যেন ওই ছবিটার মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আমি সোফায় বসলাম।
পরিবেশটা মোটেই আমার সুবিধের লাগছে না। যে মহিলার ডাকে এসেছি, তার এখনো কোনো পাত্তা নেই। উপরে জঙ্গলের মধ্যিখানে বাড়ি, বাড়ির ভেতরের আবহাওয়াও যথেষ্ট ভয়ংকর এবং রহস্যজনক। মনে মনে ভাবলাম, “আমাকে এখানে খুন করে ফেললেও জানতে পারবে না কেউ। রাজেশদাকে একবার জানিয়ে রাখা দরকার যে, আমি এসে গেছি। ওই একজনই তো জানে আমার আসার কথা।”
আমি রাজেশদাকে হোয়াটস্যাপে একটা মেসেজ করলাম, “আমি পৌঁছে গেছি ক্লায়েন্টের বাড়িতে।”
কিন্তু মেসেজের পাশে টিক চিহ্ন দেখায় না, ফোনে নেটওয়ার্ক নেই।
ফিরে এল আবার সেই মোহময়ী কণ্ঠ, “গান শুনবে?”
কথাটা আমার পেছন থেকে এল। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম, একজন নারী গ্রামোফোনটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে তার একটা লাল শিফনের শাড়ি। লম্বা, খোলা চুল কোমর ছাড়িয়ে গেছে। পেছন ফিরে থাকায় আর কিছু দেখতে পারলাম না।
আমার কাছে উত্তর না পেয়ে সে আবার জিজ্ঞাসা করল “গান শুনবে?”
আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, “আপনার যা ইচ্ছে।
একটা মৃদু সুর বেজে উঠল। আলো-আঁধারের এই পরিবেশে এরকম একটা সুর কানে আসতেই আমার সারা শরীরের লোম যেন নিজে থেকেই খাঁড়া হয়ে গেল।
অবশেষে আমার সামনে এসে দাঁড়াল আমার প্রথম ক্লায়েন্ট। এত সুন্দরী নারী আমি জীবনেও দেখিনি। যেরকম গায়ের রং, সেরকম মুখের গঠন। অদ্ভুতভাবে ছবিটার মতো চোখের মণি নীল। কিন্তু এক্ষেত্রে চোখ দুটোই যথেষ্ট একজন পুরুষকে উন্মাদ করে তোলার জন্য। আমি তো নিজের চোখ সরাতেই পারছি না।
“কী দেখছ?” প্রশ্নে আমার সম্বিৎ ফিরল।
আমি ঈষৎ হেসে বললাম, “আপনাকেই দেখছিলাম। আসলে রাজেশদা বলেছিল যে, সব ক্লায়েন্টের বয়সই মোটামুটি তিরিশের উপরে হয়। কিন্তু আপনাকে দেখে তো…”
“তিরিশ মনে হচ্ছে না। তাই তো?”
“একদম তাই।”
আমার একটা হাত ধরে সে সোফায় গা এলিয়ে বসে জিজ্ঞাসা করল “তাহলে কত
মনে হচ্ছে?”
আমিও তার পাশে বসে উত্তর দিলাম, “একুশ অথবা বাইশ।”
এটা শুনে সে হো হো করে হেসে উঠল। নিঝুম, মায়াবী পরিবেশে তার হাসির শব্দটা
চারদিকে থেকে আমাকে যেন জাপটে ধরল।
“তোমার নামটা যেন কী?” “সৃজন।”
“আমার নাম কামিনী। তোমার কী এটা প্রথমবার?” তার প্রশ্নে আমি “হ্যাঁ” বললাম
ঘাড় নেড়ে।
“বয়স কত?”
“উনিশ।”
“এই কাজের প্রতি ইচ্ছা জাগল কবে?”
“পার্ট টাইমের জন্য ভালো কাজের খোঁজ না পাওয়ায় এক বন্ধুর মাধ্যমে রাজেশদার
সঙ্গে পরিচয়।”
“বেশ। প্রেম নিশ্চয়ই করো না?”
“নাহ!”
“এর আগে কখনো কোনো নারীর সঙ্গে…”
“না, একেবারেই না।”
গালে নিজের ডান হাতের তর্জনী
কামিনী আমার দিকে একটু এগিয়ে এসে আমার বুলিয়ে বলল, “তাহলে তো আজকের রাতটা খুব স্পেশাল হবে।”
আমার সারা শরীরে একটা হিম স্রোত বয়ে গেল। প্রথম কোনো নারীর এত কাছাকাছি
এসেছি আমি। কামিনীর শরীর থেকে আসছে একটা মনাভিরাম গন্ধ যা ক্রমাগত আমাকে নেশাগ্রস্ত করে তুলছে। এমন অপরূপ নারীর শরীর কখনো সম্ভোগ করার সুযোগ আসবে, এটা ভেবেই আদি-রিপুর নদীতে প্রবল জোয়ার এল।
আমি সাহস করে আমার সামনে বসা সম্মোহিত নারী কামিনীর অনাবৃত কোমরে হাত রাখতেই সে বাধা দিয়ে বলল, “একটু বোসো। দুজনের জন্য ড্রিংক্স নিয়ে আসছি। সুরার নেশায় শরীর আরোও বেশি উপভোগ করা যায়।
সে উঠে ভেতরে চলে গেল। আমার আর সহ্য হচ্ছে না। আর কতক্ষণ অপেক্ষা করতে
হবে জানি না। আমার শরীর প্রচণ্ড পরিমাণে কামাতুর হয়ে উঠেছে। এরকম অনুভূতি
আমার আর কখনো হয়নি।
প্রথমদিকে আমার মনের মধ্যে চলতে থাকা সমস্ত দোলাচল এখন শেষ হয়ে গেছে। এই নারী, যে সে নারী নয়। একজন পুরুষকে আকৃষ্ট করার সমস্ত গুণাবলী আছে।
একজন অতৃপ্ত বিবাহিতা নারীকে সাময়িক সুখ দিয়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে এসে যে এরকম একজন নারীর কাছে এসে দাঁড়াতে পারব, স্বপ্নেও ভাবিনি।
প্রায় মিনিট দশেক সময় লাগল কামিনীর ফিরে আসতে। এই ‘মাত্র দশ মিনিট’ যেন আমার জীবনের সবথেকে লম্বা দশ মিনিট ছিল।
কামিনী আমার হাতে একটা হুইস্কির গ্লাস ধরিয়ে, নিজের গ্লাস নিয়ে আবার বসল
আমার মুখোমুখি। ওর ঠোঁটের কোণায় এখন যে হাসি লেগে আছে, আমি জানি এই হাসি সাধারণ হাসি নয়। আমাকে আরোও বেশি নিজের কাছে আকৃষ্ট করার চেষ্টা। আর সেই চেষ্টায় ও যথেষ্ট সফল ও ।
আমি আমার গ্লাসের হুইস্কি শেষ করে, টেবিলে গ্লাসটা রেখে কামিনীকে জিজ্ঞাসা
করলাম, “এই জায়গায় একা থাকতে ভয় লাগে না?”
“ভয় বলে কিছু নেই আমার ।”
“বেশ। তা তোমারও কি প্রথমবার ?”
কামিনী নিজের গ্লাসটা টেবিলে রেখে আমার মুখের কাছে নিজের মুখটা নিয়ে এসে
জিজ্ঞাসা করল “প্রথমবার নাহলে বুঝি আমার প্রতি আকর্ষণটা কমে যাবে? প্রশ্নটা শুনে আমি অস্বস্তিতে পড়লাম, “না, সেরকম কিছু নয়…” আমি পুরো কথা
শেষ করার আগেই কামিনী ওর বাঁ হাত আমার ডান থাইয়ের উপরে রাখল, ডান হাত
আমার ঠোঁটের উপরে রেখে বলল, “শ…”
আমার শরীরের ভেতরে তৈরি হওয়া অনুভূতিগুলো যেন নিজে থেকেই আমার
চোখটাকে বন্ধ করে দিলো। আমি কামিনীর প্রতিটা নিশ্বাস অনুভব করতে পারছি। ধীরে ধীরে ও আমার আরোও কাছে আসছে। কয়েক মুহূর্ত বাদেই, একটা নরম তুলতুলে ছোঁয়া অনুভব করতে পারলাম আমার ঠোঁটের আগায়। বুঝলাম, ফুলের জোড়া পাপড়ির মতো কামিনীর ঠোট আমার ঠোঁট ছুঁয়েছে।
আমি অনুভব করতে পারছি, কামিনী নিজের নগ্ন শরীর নিয়ে আমার উপরে উঠে
এসেছে। আমার শরীরের প্রতিটা অংশে নিজের নরম ঠোঁট বুলিয়ে দিচ্ছে। আমার দেহ-মন ওকে জড়িয়ে ধরার জন্য ছটফট করছে। কিন্তু আমার সারা শরীর যেন অসাড় হয়ে গেছে। হাত, পা, কিছুই নাড়াতে পারছি না। চোখ দুটোও কেমন যেন ভারী ভারী লাগছে, খুলতে পারছি না। অনেক কষ্টে জোর করেই চোখ খুললাম। আমার দুই হাত, দুই পা আর কোমরের কাছে একটা চাপ অনুভব করছি। চারিদিকে অন্ধকার। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। আমি চোখ খুলে রাখতে পারছি না। বারবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কানে এসে ঠেকছে কামিনীর মায়াবী কণ্ঠ, বিড়বিড় করে কিছু একটা যেন বলতে চাইছে, সে ভাষা অস্পষ্ট। আমার বন্ধ চোখে তাপ অনুভব করতে পারলাম। শরীরের নয়, আগুনের তাপ। চোখ খুলতেই আমি যে দৃশ্য দেখতে পেলাম, তা কল্পনাতীত।
আগুনের শিখা ঘরের সিলিং ছুঁয়ে যাচ্ছে। কামিনী যজ্ঞের আগুনে ঘি ঢালছে আর অনবরত মন্ত্র উচ্চারণ করে চলেছে। আর সামনে … সামনে এক বিশাল মূর্তি। এরকম অদ্ভুতদর্শন মূর্তি আমি চাক্ষুষ দেখিনি।
চারটে শীর্ণকায় হাত, অনাবৃত উন্নত স্তন, নিম্নাঙ্গে কাপড় জড়ানো। চার হাতে যথাক্রমে, গোলাপ ফুল, খড়গ, করোটি এবং বাটি। যজ্ঞের আগুনের আলোতে এতটুকুই দৃশ্যমান, বাকি অন্ধকারে অস্পষ্ট।
আমার ভয় করতে লাগল। ভীষণ ভয়ে আর্তনাদ করে উঠলাম, “কামিনী কী করছ এসব তুমি? এই যজ্ঞ, মূর্তি, কী এসব?” কামিনী নিরুত্তর। নিজের মন্ত্র পড়ায় ব্যস্ত।
আমি হুইস্কি খাওয়ার পর চোখ বন্ধ করেছিলাম। কামিনী আমাকে আদর করছিল।
তারপর… মনে পড়ছে না। তারমানে, ওই হুইস্কিতেই ও এমন কিছু মিশিয়ে ছিল যেটায় আমি অজ্ঞান হয়ে যাই।
“দ্যাখো কামিনী, রাজেশদা কিন্তু জানে যে তুমি আমাকে এখানে ডেকেছ। আমার সঙ্গে তুমি আজ কিছু করলে কিন্তু রাজেশদা তোমাকে ছেড়ে দেবে না। পুলিশ নিয়ে এখানে আসলেই কিন্তু তুমি ফেঁসে যাবে ।”
আমার দেওয়া হুমকি এইবার কামিনীর কানে ঢুকল। সে মন্ত্র পড়া থামিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর আমার দিকে ঘুরল। উফ! এই নারী সেই নারী নয় যাকে দেখে আমি উন্মাদের মতো আকৃষ্ট হয়েছিলাম। কিন্তু এই নারীও আমার পরিচিত। হ্যাঁ, এই রূপ আমি কামিনীর বসার ঘরে পোর্ট্রেট’এ দেখেছি। তাহলে এ কামিনী নয়? কামিনী গেল কোথায়?
“আপনি কে? কামিনী কোথায়?” আমি চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার গলা কাঁপছে।
উনি আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার মুখের কাছে বসে নিজের ডান হাতের তর্জনী আমার বাঁ গালে বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমাকে চিনতে পারছ না সুজন?” গলার স্বর এক্কেবারেই কামিনীর মতো। কিন্তু রূপ… রূপ যে একেবারেই বিপরীত। “আমি কামিনী।” কথা যেন ঘরটার মধ্যে বারবার বাজতে লাগল। তারমানে সেই পোর্ট্রেট’এর নারী আর কেউ নয়, কামিনী নিজেই। কিন্তু আমার সামনে এসে আগে যে দাঁড়িয়েছিল, তার সঙ্গে এই কামিনীর এত তফাৎ কীভাবে? আমার মাথায় সবকিছু কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। আমার মাথাটা ভনভন করে ঘুরছে। সঙ্গে একটা তীব্র যন্ত্রণা।
উঠে দাঁড়ালাম। কিন্তু অন্ধকার ঘরে যে কোথাও দরজা খুঁজে পাচ্ছি না। কামিনীর কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। মন্ত্রোচ্চারণে মশগুল। দেওয়াল হাতড়ে হাতড়ে … এই তো দরজা… কোনোমতে দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম। বাইরে থেকে হলুদ আলো এসে পড়ল আমার চোখে। আমি আর কোনোদিকে না তাকিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতন ছুটলাম। ছুটতে ছুটতে আমি বাড়িরে বাইরে এসে গেছি। কিন্তু চারিদিকে জঙ্গল। না দেখতে পাচ্ছি আমার বাইকটাকে। মনে হয় বাড়ির পেছন দিকে এসে পড়েছি।
দৌড় থামাইনি।
জঙ্গলের মধ্যে দিয়েই দৌড়তে থাকলাম অজানা, অনির্দিষ্ট পথে। গাছের ডালপালায় আমার নগ্ন শরীরে চিরে রক্ত ঝরছে। কিন্তু এখন সেসব দেখার সময় মায়াজাল থেকে বাঁচতেই হবে। কিন্তু আমি একা নই। কেউ অনুসরণ করছে আমায়।
কোনো পায়ের শব্দ নেই, কিন্তু সে আছে। কামিনীর সেই মোহময়ী গলা, এবার যেন মাথার ভেতর থেকেই ও বলে উঠল, “আমার চির যৌবনের রহস্য তোমাদের মতোই যুবকেরা। যাদের রক্তে আমার দেবী খুশি হয়ে আমাকে যৌবন উপহার দেন। তোমার আগেও অনেক যুবকই আমার মায়াজালে জড়িয়ে গেছে। তুমি একা নও সৃজন… তুমি একা নও।” এক বীভৎস হাসির শব্দ।
আর পারছি না দৌড়তে, বুকটা পাঁজরে এসে ধড়াস ধড়াস বাড়ি মারছে। কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়ালাম। হাঁপাতে-হাঁপাতে মুখ খুলে শ্বাস নিলাম। যেদিকে চোখ যায় ঘন কালো অন্ধকারময় জঙ্গল, তার ফাঁকে জ্যোৎস্নার আগমন। কিন্তু সারিবদ্ধ গাছের ডাল-পালার যেন পসার ঘটছে। ক্রমশ আশেপাশের আলোকে বুঝিয়ে দিয়ে একটা নিরেট অন্ধকারময় দেওয়াল তুলছে।
আকাশের চাঁদটাও নিভে গেল। ফিরে এল আবার সেই মন্ত্রোচ্চারণ। না….এ হতে পারে না। আমি ঐ ঘর ছেড়ে কোথাও যেতে পারিনি। সব কামিনীর মায়াজাল।
ওই নারীমূর্তি আমার খুব কাছে চলে এসেছে। ওটা কি স্থির নয়? সুডৌল বুকটাও যেন ওঠা-নামা করছে। শিকারের সামনে শিকারী পাথর হয়ে ওঁত পেতে আছে। কিছু একটা ঘটতে চলছে… ভাস্কর কিছু…
আমার সব জল্পনা-কল্পনার ইতি টানল কামিনী। ওর মন্ত্রপাঠ বোধহয় শেষ। সে উঠে দাঁড়াল। এক-লহমায় টেনে সরিয়ে দিলো মূর্তিটির কোমরে জড়ানো কাপড়টা। যজ্ঞের জ্বলন্ত আগুনে দেখলাম, নারীমূর্তি এসে আমার পায়ের ওপর বসল। তারপর সাপের মতন যোনি দিয়ে গেলা শুরু করল আমার পা দুটো, ক্রমশ আমার উরু, কোমর… আমার মুখের সামনে বুড়ো কামিনী এসে দাঁড়িয়েছে। একটু পরেই সে অষ্টাদশীর শরীরের অধিকারিণী হবে। ওর দুই হাতে খড়গ। নিশানা ঠিক আমার গলা বরাবর…..