মধ্যাহ্ন – হুমায়ূন আহমেদ

›› উপন্যাসের অংশ বিশেষ  

১.

……….ডােবার চারদিকেই ঘন জঙ্গল। আব্রু রক্ষার আলাদা ব্যবস্থার প্রয়ােজন নেই । জুলেখা গােসল করতে ঘাটে গেল। পানিতে নামল সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে। গায়ে কোনাে কাপড় ছাড়া পানিতে ভেসে থাকার অন্যরকম আনন্দ। কেউ তাে আর দেখছে না।

জুলেখা অতি রূপবতীদের একজন। আজ তাকে আরাে সুন্দর লাগছে। শঙ্কর মতাে শাদা গা থেকে আলাে ঠিকরে আসছে। খাড়া নাক আজ অনেক তীক্ষ্ণ লাগছে। বড় বড় চোখ। ছায়াদায়িনী দীর্ঘ পল্লব যেন আরাে গাঢ় হয়েছে। পান না খেয়েও ঠোট লাল।…………

…….হাট থেকে সুলেমান ফেরে সন্ধ্যায় । সেদিন কোনাে কারণে বা ইচ্ছা করেই সে হাটে না গিয়ে দুপুরের দিকে বাড়ি ফিরল। বসত বাড়ির সদর দরজা দিয়ে সাড়াশব্দ করে না ঢুকে ঢুকল বাড়ির পেছন দিয়ে। চুপি চুপি ঘাটলার কাছে এসে থমকে দাঁড়াল। কী দেখছে সে! জুলেখা সাঁতার কাটছে। চোখ বন্ধ করে চিৎ সঁতার দিচ্ছে। তার নগ্ন শরীরের পুরােটাই পানির উপর ভাসছে। গুনগুন শব্দও আসছে । গান করছে না-কি! সুলেমান চাপা গর্জন করল— এই বান্দি! তুই করস কী ?

মুহুর্তের মধ্যে জুলেখা পানিতে ডুব দিল। মানবী জলকন্যা না, দীর্ঘ সময় সে জলে ডুবে থাকতে পারে না। জুলেখাকে ভেসে উঠতে হলাে। সে অতি দ্রুত গায়ে কাপড় জড়াল। আতঙ্কে অস্থির হয়ে সে তাকাল সুলেমানের দিকে।

সুলেমান বলল, কারে শরীর দেখানাের জন্যে নেংটা হইছস ? জুলেখা বলল, কাউরে দেখানাের জন্যে না।………

…….সুলেমান ফিরল বিছুটি পাতার বড় একটা ঝাড় হাতে নিয়ে। তার মুখভঙ্গি শান্ত। রাগের প্রথম ঝড় পার হয়েছে। প্রথম ঝড়ের পর দ্বিতীয় ঝড় আসতে কিছু সময় নেয়। সুলেমান কুপি জ্বালিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, নেংটা হইতে তাের মজা লাগে। এখন নেংটা হ।

জুলেখা বলল, না। সুলেমান বলল, কোনাে কথা না। যা করতে বললাম করবি। শাড়ি খােল। আবার বলে না! এক্ষণ খুলবি। তাের নেংটা হওনের স্বাদ জন্মের মতাে মিটায়ে দিব। শাড়ি খােল।

জুলেখা শাড়ি খুলল। সুলেমান বিছুটি পাতার বাড়ি শুরু করল। দু’হাতে মুখ ঢেকে জুলেখা পশুর মতাে গােঙাতে শুরু করল। তার শরীর ফুলে গেল সঙ্গে সঙ্গে। জায়গায় জায়গায় কেটে রক্ত বের হচ্ছে। ফর্সা শরীর হয়েছে ঘন লাল। সুলেমান বিছুটি পাতার ঝাড় ফেলে দিয়ে বলল, শাস্তি শেষ, এখন শাড়ি পর।

জুলেখা পশুর মতাে গােঙাতে গােঙাতে বলল, শাড়ি পরব না। এই বাড়িতে আমি যতদিন থাকব নেংটা থাকব।

সুলেমান বলল, কী বললি?

জুলেখা বলল, কী বলেছি আপনি শুনেছেন। আমি বাকি জীবন এই বাড়িতে নেংটা ঘুরাফেরা করব।…….

সুলেমান ছেলেকে নিয়ে রাত ন’টার দিকে ফিরল। দরজায় খিল দেয়া। অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কানাের পর খিল খুলল। জুলেখা কাপড় পরে নি। সে সম্পূর্ণ নগ্ন। এক হাতে কেরােসিনের কুপি নিয়ে সে স্বাভাবিকভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। যেন কিছুই হয় নি।  সুলেমান স্ত্রীর হাত থেকে কুপি নিয়ে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিল। এমন দৃশ্য ছেলের দেখা ঠিক না। জহির কাঁদতে শুরু করল।

সুলেমান চাপা গলায় বলল, তুই নেংটা থাকবি ?……

……..শরীরের এই অবস্থায় তাঁর মনে হলাে, অতি রূপবতী এক নগ্ন তরুণী উঠানের কাঠাল গাছের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। শয়তান তাকে ধাক্কা দেখাতে শুরু করেছে। মৃত্যুর সময় তিনি যাতে আল্লাহখােদার নাম নিতে না পারেন শয়তান সেই ব্যবস্থা করেছে। পরীর মতাে এক মেয়ের রূপ ধরে এসেছে।

মাওলানা ইদরিস বললেন, হে আল্লাহপাক, তুমি আমাকে শয়তানের ধোকা থেকে রক্ষা কর । তিনি আয়াতুল কুরসি পাঠ শুরু করলেন। তাঁর দৃষ্টি কাঁঠাল গাছের দিকে। মেয়েটা এখনাে আছে। মাওলানা ভীত গলায় বললেন, তুই কে ?

নগ্ন মেয়ে কাঠাল গাছের আড়ালে চলে গেল। মাওলানা বললেন, ইবলিশ দূর হ। তােকে আল্লাহর দোহাই লাগে তুই দূর হ। দূর হ কইলাম । 

মেয়েটা দূর হলাে না। কাঠাল গাছের আড়াল থেকে বের হয়ে এলাে। মাওলানা জ্ঞান হারালেন।…….

………জুলেখা রঙিলা বাড়িতে ভর্তি হয়ে নতুন নাম নিয়েছে চান বিবি। নতুন নাম নেয়াই দস্তুর। অতীত পেছনে ফেলে আসতে হবে। যা গেছে তা গেছে। অতীত নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। এও এক ধরনের সংসার। প্রতিরাতে স্বামী বদলের সংসার। এটাই মন্দ কী?……

………মুসলমান সমাজে স্ত্রীকে তালাক দেয়া এবং স্ত্রীর বাপ-ভাইয়ের কাছে চলে যাওয়া অতি স্বাভাবিক ঘটনা। এক স্ত্রী চলে যাবে অন্য স্ত্রী আসবে। স্ত্রী একা আসবে না, সঙ্গে দাসী নিয়ে আসবে। স্ত্রীর গর্ভে যেমন সন্তান হবে, দাসীর গর্ভেও হবে। স্ত্রীর গর্ভের সন্তানরা সম্পত্তির ভাগ পাবে। বান্দির গর্ভের সন্তানরা পাবে না। তারা কামলা খাটবে। তাদের বিয়েশাদি হবে তাদের মতােই বান্দি বংশের লােকজনদের সঙ্গে। সহজ হিসাব।……..

…….হরিচরণ বললেন, ডােম কন্যাদের সঙ্গে যৌন কর্মে বর্ণহিন্দুর সমস্যা নাই। এতে তাদের জাত যায় না, কিন্তু এরা বর্ণহিন্দুর বাড়িতে এসে ঘর ঝাট দিলে জাত যায়— এটা কেমন কথা?…….

২.

………

গাত্রবর্ণ কী ?
নীল।
তার বুকের সাইজ কী ? বাঙালি মেয়েদের মতাে, না-কি বুকও মুখের মতাে ছােট ?
খিয়াল নাই।

খিয়াল নাই মানে ? বুক দেখাে নাই ? লজ্জা পেয়েছিলা? মৎস্যকন্যা উদাম গায়ে পানিতে ঘুরে। সে তাে শাড়ি দিয়া শরীর ঢাকে না। তারে নগ্ন দেখাই স্বাভাবিক।
সুলতান মিয়া বলল, আমি যখন দেখেছি তখন উড়না দিয়া তার বুক ঢাকা ছিল।

উড়না দিয়া বুক ঢাকার প্রয়ােজন পড়ল কেন?

সুলতান মিয়া বলল, অনেক ছােট ছােট পুলাপান ছিল, এইজন্যে ঢাকা হয়েছিল। মাতব্বররা ঢাকতে বললেন।

শশাংক পাল বিস্মিত গলায় বললেন, দশ হাজার টাকা দাম ? তুই কস কী ? দশ হাজার টাকায় একজোড়া জীবন্ত মৎস্যকন্যা পাওয়া যায়। তাদের সঙ্গে যৌনকর্ম করা যায়।

সুলতান নির্বিকার গলায় বলল, পাওয়া গেলে খরিদ করেন। যৌনকর্ম করতে চাইলে করেন। আপনার বড় পুসকুনি আছে। পুসকুনিতে ছাড়েন।…………

………ধনু শেখ হুঙ্কার দিলেন। অনেক আগে তােমারে ন্যাংটা হইতে বলছি। হও নাই। এখন হও। ন্যাংটা অবস্থায় বােতল আনবা । লজ্জা ভাঙা দরকার।
শরিফা থরথর করে কাঁপছে। গা থেকে শাড়ি খােলার চেষ্টা করছে। শাড়ি খুলছে না, আরাে যেন পেঁচিয়ে যাচ্ছে।…….

…… ড্যান্স মাস্টারের কাছ থাইকা নাচ শিখার পর তুমি আমার সামনে ন্যাংটা নাচ নাচবা। স্বামীর সামনে ন্যাংটা নাচে অসুবিধা নাই। স্বামী যদি সুখী হয় তার জন্যে আলাদা সােয়াব। বুঝেছ ?………

……..মালেকাইন বলল, তের বছরের একটা মেয়ে নতুন এসেছে। ডানাকাটা পরী কেউ দেখে নাই, এই মেয়ে ডানাকাটা পরী ।মেয়ের নাম কী ? ………

………মাঝির কথা শেষ হবার আগেই পেছন দিকের পর্দা সরিয়ে একজন ঢুকে শরিফার মুখ চেপে ধরল। ভারী গলায় বলল, একজন আস, ঠ্যাং চাইপা ধর। ঠ্যাং দিয়া লাথি দিতে পারে। আরেকজন খিক খিক করে হাসতে হাসতে বলল, আমি বুনি’ চাইপা ধরব। ঠ্যাং ধরব কোন কামে। হি হি হি।।

সারারাত রঙতামাশা করে তারা অচেতন শরিফাকে ফেলে গেল পরিত্যক্ত এক বিষ্ণুমন্দিরে। সেখান থেকে তার স্থান হলাে রঙিলা নটিবাড়িতে।………..

Leave a Reply