রাধা।
বেশ নাম, বারবার উচ্চারণ করতে ভালো লাগে, ডাকতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু রাধা শব্দের অর্থ কী? কেমন মেয়ে এই রাধা ? ‘ধা’ মানে ধাবমান। যে মেয়ের অভিসারসরণি অন্তহীন। আর ‘রা’ অর্থাৎ পাওয়ার জন্য। কী পাওয়ার জন্য রাধা অনন্তসরণির যাত্রী!
প্ৰেম ।
প্রেমের জন্য চলছেন রাধা। ঝড় জল বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে তিনি গামিনী। তিনি ভিজছেন। বৃষ্টিই তাঁকে পথ দেখাচ্ছে, তাঁর শরীরে রোপণ করছে অলৌকিক উর্বরতা। বৃষ্টিভেজা রাধার শরীরে উর্বরতার অভিজ্ঞান ফুটে উঠছে এইভাবে-
আধ আঁচর খসি আধ বদন হাসি
আধহি নয়নতরঙ্গ।
আধ উরজ হেরি আধ আঁচড় ভরি
তবধরি দধে অনঙ্গ। (বিদ্যাপতি)
ভিজে রাধার আদ্দেক বুক থেকে খসে গেছে আঁচল। দেখা যাচ্ছে আদ্দেক স্তন। সেই আর্দ্র স্তন যেন সোনার কৌটো (কনয় কটোরা)। সোনার কৌটোটির উপর লেপ্টে আছে সিঞ্চিত ‘কাঁচুয়া’ বা ‘কঞ্চুক’ যেখানে ফাঁস মেরেছেন স্বয়ং কামদেব (ফাঁস পসারল কাম)। রাধা কিন্তু ভিজে পোশাকে প্রায় অনাবৃত হয়ে পড়েও লজ্জা পাচ্ছেন না, যেন এমন লোভনীয়ভাবে সিক্ত থাকাই তাঁর ধর্ম। বিশেষ করে বিদ্যাপতিতে রাধা জলযৌনতার পূর্ণ প্রতীক। তাঁর ‘চিকুর গলয়ে জলধারা’, তাঁর চুল থেকে ক্রমাগত ঝরছে জল (কেশ নিঙাড়িতে বহ জলধারা) কিংবা তাঁর ভেজা শাড়ি আটকে আছে পিছল স্তনবৃত্তে (সজল চীর রহ পয়োধর সীমা)। সিক্তবসনা রাধার বুক দুটি যেন সোনার বেল। রাধা চলছেন রজনী অভিসারে। আর ওই বেল দুটি ভিজে যাচ্ছে, বৃষ্টিতে নয়, হিমে (কনক বেলে জনু পড়ি গেও হীনা)।
শুধু বিদ্যাপতি কেন, চণ্ডীদাসের রাধাও ‘গলিতবসনা’। তাঁর ভিজে পোশাক ‘রসনাহীন’ অর্থাৎ মেখলাবন্ধনমুক্ত। চণ্ডীদাসের রাধার একটি বড় আকর্ষণ হল তাঁর সেলোফেনস্বচ্ছতা। আকাশে যখন মেঘ নেই, ভুবনে নেই বৃষ্টি, তখনও ভিজে রাধার দেহ। তাঁর ত্বকের বিশেষ চরিত্রহেতু এই আর্দ্রতা। রাধার শরীর ঠিক শরীর নয়, যেন ‘সরোবর’— এ বর্ণনা চণ্ডীদাসের। নারীশরীরের এমত দ্রবণ বিশ্বসাহিত্যে বিরল : লাবণ্য জল তোর সিহলি কুন্তল/বদন কমল শোভে অলক ভযল।
রাধার শরীর সরোবরে মুখটি যেন ভাসমান পদ্ম। রাধার ভিজে গাল নেশাধরানো মহুয়াফুল। সুন্দরী রাধা লো, তুমি সরোবরময়ী, লিখলেন চণ্ডীদাস।
রাধার সর্বাঙ্গ সিক্ত। এমন কোনো অঙ্গ নেই যা ভেজেনি। স্তন থেকে নাভি, কোমর থেকে নিতম্ব, সব কিছুই কাকভেজা। পদ্মের ভেজা পাপড়ির মতো রাধার ঠোঁট। রাধার দাঁত ভিজে শ্বেতপদ্ম। রাধার অধর সদ্যফোটা ভিজে বাঁধুলি ফুল (ফুটিল বন্ধুলী ফুল বেকত আধর)। রাধার বাহু সিক্ত মৃণাল। তাঁর করতল ভেজা রক্তপদ্ম। দুটি স্তন যেন শরীরসরোবরে সাঁতারু হাঁস। নাড়ির কাছে লোমগুলি স্যাঁতসেতে শৈবাল। ভিজে কোমরের তিনটি ভাঁজ সরোবরে নামার তিনটি সোনার সিঁড়ি। নধর পাছাটি সরোবর ঘাটের পিছল শিলা। আর জঘন (নিতম্বের সম্মুখভাগ) যেন সোনার তৈরি ভিজে তক্তা।
রাধা তাঁর শরীরের সর্বত্র তরল। সংস্কৃতে ‘তরল’ শব্দটি ‘চপল’ অর্থেও ব্যবহৃত হয়। তাই রাধার ‘তারল্য’ তাঁর চাপল্যেরও প্রতীক। তাঁর সারা শরীর একই সঙ্গে তরল ও চপল। তাঁর গভীর নাভিতে দুলছে নাগকেশর ফুল। জঙ্ঘায় ফুটছে স্বর্ণকেতকী। আর তাঁর তেলতেলে ভিজে কাপড় যেন তিসির তৈরি। যেমন জলেতেলে মিশ খায় না, তেমনি মিশতে পারে না রাধার শাড়ি ও শরীর।
শরীর। তাঁর চঞ্চল শরীর থেকে ক্রমাগত খসে পড়ে ভিজে শাড়ি। রাধা ভিজে শরীর কৃষ্ণের দিকে ফিরিয়ে বাহু তোলেন। কৃষ্ণ বলেন, ছি ছি রাধা আমাকে লোভ দেখাচ্ছ কেন? রাধা হেসে বলেন, আমি তো বাহু তুলেছি ভিজে চুল বাঁধার জন্য।
ভেজার ইচ্ছায় রাধার নানা ছলচাতুরি। বিচিত্র দুষ্টুমি। একদিন টাপুরটুপুর বৃষ্টির মধ্যে রাধাকে নৌকোতে তুললেন কৃষ্ণ। নৌকো ধীরে ধীরে মাঝ যমুনায়। হঠাৎ রাধা কৃষ্ণকে বললেন, কানাই, তোমার এই নৌকোটাকে তুমি ডুবিয়ে দাও।
তুমি যে যমুনার জলে একাকার হয়ে ভিজে যাবে রাধা! বললেন কৃষ্ণ।
আমাকে ওইভাবে ভিজতে দেবে কেন? আমাকে কোলে নিয়ে তুমি যমুনা পার হবে কৃষ্ণ । বললেন রাধা।
কৃষ্ণ রাধার কথায় ডোবালেন নৌকো, পার হলেন যমুনা রাধাকে কোলে করে, এ বোল সুণিআঁ কাহ্নাঞিঁ মনের হরিষে/নাও ডুবিয়িলা রাধা কোলে করি ভাসে (চণ্ডীদাস)। কৃষ্ণের কোলে রাধা তখন ভিজছেন ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে। বৈষ্ণবপদাবলির রাধা সারাক্ষণ ভিজছেন, বৃষ্টিতে কিংবা যমুনার জলে কিংবা কৃষ্ণবিরহে চোখের জলে। তাঁর সপসপে শাড়ির স্খলিত স্বচ্ছতা লেপ্টে আছে স্তনবৃত্তে। এবং ওইভাবেই রাধা হাঁটছেন তার নিরন্তর অভিসারের তিমির বৃষ্টির মধ্যে। আমাদের মনে পড়ে যৌনতার রোম্যান জলদেবী ভিনাস কিংবা বাসনাকামনার সিক্ত দেবী আফ্রেদাইতিকে (Aphrodite- তে ‘O’-এর উচ্চারণ ‘এ’-র মতো)।
‘Aphros’অর্থাৎ সমুদ্রের ফেনা যা তৈরি করেছে – দেবীর ত্বক । সেই ফেনা যা লোভ দেখায়, যার বর্ণচ্ছটা ডাকে, যা ধরেও কাছে রাখা যায় না। রাধার ভিজে সেক্সাবেদনেও আছে এই আদিম ‘aphros!’ কৃষ্ণ এই ফেনা ধরতে চেয়েছেন। ব্যর্থ হয়েছেন। কেঁদেছেন আষাঢ়ের আকাশের মতো। আর শ্রীযুক্ত আয়ান ঘোষ, কৃষ্ণের মামা, রাধার স্বামী– তিনি তো সারাজীবন রাধা ভেবে ঘর করেছিলেন ছায়ারাধার সঙ্গে। আসল রাধা তো তাঁর ফেনিল শরীর নিয়ে অভিসারে উধাও! হঠাৎ আমার মন চলে যাচ্ছে কালিদাসে। ‘কুমারসম্ভব’ কাব্যে উমার দেহ ‘ত্রিস্রোতা’ গঙ্গা। খোঁপা বাঁধার আগে তাঁর কেশপাশের ভিজেভাব কাটানো হয় ধূপের ধোঁয়ায়। উমার ত্বকে তারল্যের কারণটিরও উল্লেখ করেছেন কালিদাস : লোথ্ররেণুর মলম। উমার নাভির তারল্যের উপর কালিদাস সযত্নে বিছিয়ে দিয়েছেন স্বচ্ছ কৌশেয় (রেশম) বস্ত্র। সদ্যস্নাতা উমার শরীর ‘মেঘবর্ষণের পর প্রফুল্ল কাশফুল।’ কেন উমার শরীর এমন স্নিগ্ধ আর সিক্ত? কালিদাসের উত্তর, তিনি মাখেন ‘কানেয়’ নামের সুগন্ধী– সেই কৃষ্ণচন্দন আজকের পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে। কালিদাসের ‘মেঘদূত’ কাব্যে বিরহিনীর ভুরু যেন ক্ষীণকায়া নদী। আর কালিদাসের শকুন্তলার জ্বর হলে তার কিশোরী স্তনে লাগানো হয় ভিজে পদ্মপাতা। কালিদাস থেকে বৈষ্ণবপদাবলি, নারী শুধু ভিজছে– বৃষ্টিতে-নদীতে-অশ্রুতে-অঙ্গরাগে। বারিকন্যা রাধাকে আমার কখনো কখনো উর্বরতার গ্রিক দেবতা ডায়োনিসাস-এর দূর সম্পর্কের আত্মীয়া বলে মনে হয়। প্রাচীন গ্রিসে ডায়োনিসাস-এর মন্দিরে (যে দেবতার নাম Bacchus) নগ্ন নারীপুরুষের ধারানৃত্যের কথা আমরা জানি। সেই যৌনমত্ততা কীভাবে পরিণত হয়েছিল Bacchanalia উৎসবে, হয়ে উঠেছিল রোম্যান অবক্ষয়ের অঙ্গ, সে-কথাও জানি আমরা। রাধার বৃষ্টিস্নাত অভিসারের মধ্যে, তাঁর তিমির শরীরবিলাসের মধ্যে রোম্যান ব্যাকানালিয়া-র পূর্বাভাস পাই আমি। আমার ভাবতে ভালো লাগে অন্য কোনো যুগে, অন্য কোনো সময়ে, রাধা পূজারিণী ছিলেন ডায়োনিসাস-এর মন্দিরে, নেচেছিলেন ‘ব্যাকাস’- উৎসবের ধারানৃত্য, তাঁর সিক্ত শরীরে চমকে উঠেছিল প্রাচীন ভারতের যৌন-ইশারার অব্যর্থ মুদ্রাগুলি : সূচি, চন্দ্রকলা, শিখর, পদ্মকোশ, মৃগশীর্ষ, ভ্রমর, চতুর, নাগপাশ। ভিজে মেয়ের গল্প তাই অনেক মেয়ের কাহিনি নয়। যুগে যুগে একটি মেয়েই তো ভিজছে। আর সে ভিজছে বলেই পৃথিবী আজও উর্বর, পৃথিবীর অন্য নাম ‘উর্বী’। এ মেয়ে সর্বক্ষণ ভিজছে, রতিসুখে, বৃষ্টিতে, শৃঙ্গাররসে। তার স্তনের উপর হারটিও ‘লিকুইড’ : কুচকলসিপরে তরলিতহারা। তার হারের উপর ঝরে পড়ছে রতিসুখের ঘাম। এই মেয়েই জয়দেবের সিক্ত ললিতলবঙ্গলতা। চণ্ডীদাসের গুরুনিতম্ব সরোবরময়ী। বিদ্যাপতির বদনে-বসনে-স্তনে ভিজে অভিসারিকা।