……
। দুই।
প্রাচীন ভারতে বিবাহ
……তথাকথিত কলিপূর্বযুগে কন্যার বিবাহ সমগ্র পরিবারের সহিতই সাধিত হতাে। ঋগ্বেদে এবং অথর্ববেদে এমন কয়েকটি স্তোত্র আছে যা থেকে পরিষ্কার বােঝা যায় যে, যদিও বধূকে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাই বিবাহ করত, তা হলেও তার কনিষ্ঠ সহােদরগণেরও তার উপর যৌনমিলন বা রমনের অধিকার থাকতাে। এই দুই গ্রন্থেই স্বামীর কনিষ্ঠভ্রাতাকে “দেবৃ” বা “দেবর’ বলা হয়েছে। এই শব্দদ্বয় থেকেও তা সূচিত হয়। কেননা দেবর মানে দ্বিবর বা দ্বিতীয় বর।
ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের এক স্তোত্র থেকে বােঝা যায় যে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মৃত্যুর পর তার বিধবা দেবরের সঙ্গেই স্ত্রীরূপে বাস করতাে। সেখানে বিধবাকে বলা হচ্ছে, “তুমি উঠে পর, যে দেৰ্ব তােমার হাত ধরছে তুমি তারই স্ত্রী হয়ে তার সঙ্গে বসবাস কর।” অথর্ববেদের এক স্তোত্রেও (১০৩১-২) অনুরূপ কথা ধ্বনিত হয়েছে।
ভাবীর সঙ্গে দেবরের যে যৌন ঘনিষ্ঠতা থাকতাে । ঋগ্বেদের বিবাহ সম্পর্কিত স্তোত্রও ইঙ্গিত করে। উক্ত স্তোত্রে দেবতাগণের নিকট প্রার্থনা করা হচ্ছে যে, তারা যেন নববধূকে দেবৃর প্রিয়া ও অনুরাগের পাত্রী করে তোলন। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের অপর এক স্থানেও বর্ণিত রয়েছে যে, বিধবা ভাবী দেবকে তার দাম্পত্য শয্যায় নিয়ে যাচ্ছেন।
একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারা যাবে যে ঋগ্বেদের যুগে ভাবীর সঙ্গে দেবরের যৌন সম্পর্ক ছিল কেন। আর্যরা যখন এদেশে আসেন তখন তারা তাদের সঙ্গে খুব কমসংখ্যক মেয়েছেলে নিয়ে এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে মেয়েছেলের অভাব বিশেষভাবেই ছিল। এদেশে আসবার পর তাঁরা এদেশের অধিবাসীদের খুব ঘৃণার চক্ষে দেখতেন। রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য, গােড়ারদিকে তারা এদেশের অধিবাসীদের সঙ্গে কোনরূপ বিবাহ সম্পর্ক স্থাপন করেন নি। পরবর্তীকালে অবশ্য তারা এদেশের মেয়ে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু অন্তবর্তীকালে তাঁদের মধ্যে বিবাহযােগ্যা মেয়ের অভাবের দরুন মাত্র জ্যেষ্ঠভ্রাতাই বিবাহ করতেন আর অন্য ভ্রাতারা ভাবীর সঙ্গেই যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতেন।
ভাবীর উপর দেবরের এই যৌন অধিকার যে পরবর্তীকালের নিয়ােগপ্রথা থেকে স্বতন্ত্র সে বিষয় কোন সন্দেহ নেই। বৈদিক যুগে দেবরের যে যৌন অধিকার থাকতাে তা সাধারণ রমণের অধিকার। আর পরবর্তীকালের নিয়ােগপ্রথা ছিল মাত্র সন্তান উৎপাদনের অধিকার। সন্তান উৎপন্ন হবার পর এ অধিকার আর থাকত না।……..
॥ নয়॥
বিবাহ-বহির্ভূত যৌন সংসর্গ
জগতের অধিকাংশ সমাজেই স্বামী বিবাহ দ্বারা স্ত্রীর সঙ্গে যৌন মিলনের একাধিপত্য পায়। কিন্তু এমন অনেক সমাজ আছে যেখানে সামাজিকভাবে এই অধিকার অপরকে সমর্পণ করা হয়। যৌন মিলনের জন্য নিজের স্ত্রীকে অপরের হাতে সমর্পণ করবার পিছনে যে যুক্তি আছে সেটা হচ্ছে এই যে, যেহেতু স্বামীই হচ্ছে স্ত্রীর একমাত্র অধিকারী সেইহেতু তার ক্ষমতা আছে সেই অধিকার সাময়িকভাবে অপরকে সমর্পণ করবার। অনেক সমাজে এই অধিকার বিশেষভাবে সমর্পিত হয় অতিথির কাছে। যৌন মিলনের অধিকার সমর্পণ করে আতিথেয়তা পালন করা প্রাচীনকালে বহু সমাজে প্রচলিত ছিল। বর্তমানকালেও অনেক সমাজে এ রীতি আছে। ………মানুষ অপরিচিত আগন্তুককে সৃষ্টির প্রারম্ভ থেকেই ভয় করে এসেছে। সেজন্য এরূপ আগন্তুককে অতিথিরূপে যখন গ্রহণ করা হয় তখন তার সন্তোষবিধানের জন্য অতিথিসেবক সবসময় প্রস্তুত থাকে সাময়িকভাবে তার কাছে নিজের স্ত্রী বা মেয়েকে পর্যন্ত সমর্পণ করতে। যৌন আতিথেয়তা প্রাচীন ভারতেও প্রচলিত ছিল। মহাভারতেও এর উল্লেখ আছে। বিশেষ করে অনুশাসন পর্বে সুদর্শন ও ওঘাবতীর কাহিনী এ সম্বন্ধে বিশেষ আলােকপাত করে।
সুদর্শন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ ছিলেন। তিনি গৃহস্থাশ্রম পালন করেই মৃত্যুকে জয় করবেন সঙ্কল্প করেছিলেন। স্ত্রী ওঘাবতীকে অতিথি সৎকারের কাজে নিয়ােজিত করে তিনি তাকে আদেশ দেন যে, প্রয়ােজন হলে ওঘাবতী যেন নির্বিচারে নিজেকেও অতিথির কাছে সমর্পণ করে। কেননা অতিথি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি আর কেউ নেই। একদিন তাঁর আদেশের সততা পরীক্ষা করবার জন্য তাঁর অনুপস্থিতকালে যমরাজ স্বয়ং ব্রাহ্মণের বেশে সেখানে উপস্থিত হয়ে ওঘাবতীর সঙ্গে সঙ্গম প্রার্থনা করলেন। ওঘাবতী প্রথমে কৌশল করে এটা এড়াবার চেষ্টা করেন কিন্তু ব্রাহ্মণবেশী ধর্মকে নাছােড়বান্দা দেখে অগত্যা তার সঙ্গে যৌনমিলনে প্রবৃত্ত হন। এই সময় সুদর্শন ঘরে ফিরে এসে স্ত্রীকে সামনে দেখতে না পেয়ে তাকে বারবার ডাকতে থাকেন। কিন্তু কোন উত্তর পেলেন না। কেননা ওঘবতী তখন ব্রাহ্মণের সঙ্গে যৌনমিলনে নিযুক্ত থাকায় নিজেকে অশুচি জ্ঞান করে স্বামীর আহ্বানে সাড়া দেন না। এমন সময় অতিথি ব্রাহ্মণ ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে সুদর্শনকে বলেন যে ওঘাবতী তার কামনা পূর্ণ করেছে।
ওঘাবতীর অতিথিপরায়ণতা দেখে সুদর্শন অত্যন্ত প্রীত হন। ধর্ম তখন আত্মপ্রকাশ করে বলেন, “সুদর্শন, তুমি তােমার সততার জন্য এখন থেকে মৃত্যুকে জয় করলে।”…….. মহাভারতে আরও উল্লিখিত আছে যে সন্তসুজাত অর্জুনকে বলেছিলেন যে বন্ধুত্বের যড়গুণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বন্ধুর নিকট নিজ পুত্র ও স্ত্রীকে সমর্পণ করা। কৃষ্ণও বন্ধুর কাছে পুত্র এবং স্ত্রীকে সমর্পণ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কর্ণও বলেছিলেন যে যদি কেউ তাকে দেখিয়ে দেয় যে অর্জুন কোথায় আছে তাহলে তিনি তাকে তাঁর স্ত্রী ও পুত্রকে সমর্পণ করবেন। মহাভারতের পরবর্তীকালে অবশ্য এ প্রথা ভারতে বিলুপ্ত হয়েছিল।
স্ত্রী বা কন্যাকে অপরের হাতে সমর্পণ করা সম্পর্কে মধ্যপ্রদেশের সাথিয়া উপজাতির মধ্যে এক বিচিত্র প্রথা প্রচলিত আছে। এদের মধ্যে কোন চুক্তির শর্ত হিসাবে বা ঋণের জামিনস্বরূপ উত্তমর্ণের কাছে নিজের স্ত্রী, কন্যা বা অপর কোন আত্মীয়াকে বন্ধক রাখা হয়। ঋণ পরিশােধ বা চুক্তির শর্ত প্রতিপালন না হওয়া পর্যন্ত ওই স্ত্রী বা কন্যা পাওনাদারের গৃহেই থাকে। | বন্ধকী অস্থাবর সম্পত্তি ভােগদখল করবার যেমন উত্তমর্ণের | অধিকার থাকে এক্ষেত্রে ওই স্ত্রী বা কন্যাকে ভােগ করবার সম্পূর্ণ অধিকারও পাওনাদারের থাকে। এই অবস্থায় পাওনাদারের গৃহে যদি ওই স্ত্রী বা কন্যা সন্তানবতী হয় তাহলে সে নিজ গৃহে পুনরায় ফিরে আসবার সময় ওই সন্তানকে পাওনাদারের গৃহে রেখে আসে। সাথিয়ারা এরূপভাবে স্ত্রী বা কন্যাকে বন্ধক রাখা মােটেই লজ্জাজনক বা নীতিবিগর্হিত ব্যাপার বলে মনে করে না।
ধর্মানুষ্ঠানের অঙ্গস্বরূপ পরস্ত্রীর সহিত যৌনমিলন তন্ত্রশাস্ত্রে অনুমােদিত আছে। তান্ত্রিসাধনার মূল কথা হচ্ছে প্রকৃতি ও পুরুষের মিলন। এই প্রকৃতি ও পুরুষের মিলনকে তন্ত্রশাস্ত্রে গুহ রূপ দেওয়া হয়েছে। …….এগুহিতায় বলা হয়েছে, সে ব্যক্তি পামরের সঙ্গে তাদের যৌনমিলন ঘটেছে এই আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে এই সকল হতভাগিনী নারীরা নিজ নিজ গৃহে ফিরে যেত।
দক্ষিণ ভারতের অপর একস্থানেও আবে দুবােয়া যে প্রথা দেখেছিলেন তার বিবরণও তিনি দিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, কোন কোন জনবিরল অঞ্চলে এমন অনেক মন্দির আছে যেখানে দেবতাদের প্রীতির জন্য অতি জঘন্য ধরণের লাম্পট্যের লীলা চলে। এসকল স্থানে বন্ধ্যা নারীরা সবরকম লজ্জাসরম বিসর্জন দিয়ে নির্বিচারে ও নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর লােকেদের সঙ্গে যৌনমিলনে প্রবৃত্ত হয়। প্রতি বৎসর জানুয়ারী মাসে এই সকল স্থানে উচ্ছলতীর এক উৎসব হয় এবং ওই উৎসবের সময় সকল শ্রেণীর নরনারী ( বিশেষ করে গ্রামের জঘন্য চরিত্রের লােক) ওই সব স্থানে সম্মিলিত হয়। বন্ধ্যা নারীরা এখানে দেবতার কাছে এসে মানত করে যে তারা যদি সন্তানবতী হতে পারে তাহলে দেবতার প্রীতির জন্য কোন বিশেষ সংখ্যক পুরুষের সঙ্গে সহবাস করে তবে বাড়ী ফিরে যাবে। এমন কি যেসব নারী বন্ধ্যা নয় তারাও দেবতার প্রতি তাদের ভক্তি প্রদর্শনের জন্য অতি নির্লজ্জভাবে অপরের সহিত যৌনমিলনে প্রবৃত্ত হত।
ধর্মের নামে আর এক রকমের গণিকাবৃত্তিও মন্দির সমূহে প্রচলিত ছিল। এ হচ্ছে দেবদাসী প্রথা। সেকালে দেবতার প্রীতির জন্য অনেকে নিজের মেয়েদের উৎসর্গ করত দেবতার কাছে। এরা মন্দিরে থাকতাে এবং এদের দেবদাসী বলা হতাে। এদের উত্তমরূপে নাচ-গান শেখান হতাে এবং তারা দেবতার সামনে নৃত্যগীত করতো। দেবদাসী যে হিন্দু-মন্দিরেই থাকতাে তা নয়, বৌদ্ধমন্দিরেও থাকত। কালক্রমে দেবদাসী প্রথা কদর্য গণিকাবৃত্তিতে পরিণত হয়েছিল। এখনও অনেক মন্দিরে দেবদাসী প্রথা জীবিত আছে।………..