বিশ্বামিত্র ও মেনকা – (রামায়নী প্রেমকথা) – সুধাংশরঞ্জন ঘোষ

›› পৌরাণিক কাহিনী  ›› সম্পুর্ণ গল্প  

আগে এইখানে এই পুষ্কর হৃদের বুকে ছােট ছােট ঢেউয়ের শিরাগুলি প্রায়ই ফুলে ফুলে উঠত। চারিপাশের তৃণগুচ্ছে ও কল্পতরু শাখার পাতায় পাতায় কাপন লেগে থাকত সব সময়। মাথার উপরে অনেক দূরে শ্যামালতার পরিপক্ক ফলের মতাে তাম্রাভ আকাশের কোলে স্বর্ণাভ আলাে দোল খেত। এখানকার বাতাস চঞ্চল শিশুর মতাে অশান্ত স্পন্দনে নিয়ত ছুটে বেড়াত।

কিন্তু আজ মহাতেজা মহামুনি বিশ্বামিত্রের তপােপ্রভাবে একেবারে নিশ্ৰুপ হয়ে গেছে সব। যেদিন হতে এই পুষ্কর হৃদের তীরে তপস্যা করতে এসেছে বিশ্বামিত্র, সেদিন হতে চারিদিকের সমস্ত বস্তুও যেন ধ্যাননিমীলিত হয়ে পড়েছে তার সঙ্গে সঙ্গে। এক অবিচল অটল স্তব্ধতায় প্রস্তরীভূত হয়ে উঠেছে যেন এখনকার জল স্থল অন্তরীক্ষ।

আজ এখানে জলের বুকে কোনাে ঢেউ নেই, বাতাসে হিল্লোলিত চঞ্চলতা নেই, বৃক্ষলতা বা তৃণগুল্মের মধ্যে কোনাে দোলা নেই, আলাের মধ্যে কোনাে কম্পন নেই। | তপস্যারত বিশ্বামিত্রকে দেখে ভীতিবিহ্বল হয়ে উঠেছে শ্বাসরুদ্ধ পৃথিবী। নিশ্চল ও নিস্পন্দ হয়ে উঠেছে সমস্ত জীবন ও জড়প্রকৃতি।

তপস্যারত বিশ্বামিত্রকে দেখলে সত্যিই ভয় হয়। তার মস্তকে জটাজাল কালসর্পাকৃত চূড়ার মতাে উন্নত করে আবদ্ধ ; কর্ণদ্বয় দ্বিগুণীকৃত রুদ্রাক্ষের মালায় অবতংসযুক্ত। পরিধানে কৃষ্ণবর্ণ মৃগচর্ম। সমুখস্থ প্রজ্জ্বলিত হােমাগ্নিশিখায় তার গৌরকান্তি জ্যোতিষ্মন।। 

তিনি বীরাসনে স্থির হয়ে বসে আছেন। তার শরীরের উর্ধ্বভাগ নিশ্চল। সরল ও সমুন্নত স্কন্ধদ্বয় সন্নতভাবে অবস্থিত। করযুগল ক্রোড়দেশে উত্তানভাবে সন্নিবেশিত।

এই হােমাগ্নিশিখার অতিপ্ৰখর প্রভাবে ভীত হয়ে উঠেছে সমগ্র ভূলােক ও দ্যুলােক। সমস্ত জলদেবতা বনদেবতারা ভয়ে কোথায় লুকিয়ে পড়েছেন।বনপ্রদেশে ফুলের পাপড়িগুলি ভালাে করে আর ফোটে না, ভয়ে ভ্রমর ভ্রঞ্জন করে না, মৃগশিশু আর খেলা করে না। | কঠোর তপস্যার দ্বারা একে একে দেবলােক ও ব্রহ্মলােক অধিকার করবেন বিশ্বামিত্র, এই সংবাদে সুদূর স্বর্গলােকও ভীত ও ত্রস্ত হয়ে পড়েছে।

ভয়ে বিবর্ণ হয়ে উঠেছে যেন আতান্ত্র আকাশ। কম্পিত হয়ে উঠেছে স্বর্গের সিংহাসন। চিন্তিত হয়ে পড়েছেন দেবতারা। বিষাদের এক ঘন ছায়া নেমে এসেছে চির আনন্দময় স্বর্গের সংগীত সভায়। তাই আজকাল প্রায়ই তাল কেটে যায় অপ্সরাদের নৃত্যের ছন্দে।

সেদিন সন্ধ্যার কিছু পূর্বে একবার যােগবিরত হলেন বিশ্বামিত্র। সূর্য অস্ত যাবার সঙ্গে সঙ্গে এই সময় প্রতিদিন তিনি বীরাসন ত্যাগ করে পাদাগ্রভাগে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে পবিত্র স্বর্গগঙ্গাসলিলের অঞ্জলি দ্বারা অর্থ দান করে শুদ্ধ মনে গায়ত্রীর উপাংশু জপ করেন। তারপর উপযুক্ত সন্ধ্যাবন্দনার পর নামগান করতে থাকেন। সেদিন কিন্তু আর গায়ত্রী জপ করা হলাে না বিশ্বামিত্রের। বীরাসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াতেই কিসের একটা মধুর শব্দে চোখ মেলে উপরের দিকে চাইলেন। দেখলেন সূর্যাস্তকালে চারিদিকের শােভা বড় মনােরম। দূর দিকচক্রবালে মেঘের ঋজুকুটিল প্রান্তভাগগুলি রক্ত, পীত,কপিশ প্রভৃতি নানা রঙে রঞ্জিত হয়ে উঠেছে। অস্তগামী সূর্যের লােহিত আভায় মনে হচ্ছে যেন উজ্জ্বল কাঞ্চনদ্রবে সিক্ত হয়ে উঠেছে নবপল্লবশােভিত তরুবীথিকা। | কিন্তু এই সব সন্দর দশ্যের উপর একবার দষ্টিপাত করবার সময় বা প্রবৃত্তি নেই বিশ্বামিত্রের। সমস্ত ইন্দ্রিয়ের রগুলিকে এমনভাবে রুদ্ধ করে দিয়েছেন তিনি, যাতে বাইরের জগতের কোনাে শব্দ বা দৃশ্যের কোনাে উদ্দীপন কোনরূপ চেতনার সৃষ্টি করতে না পারে তার মধ্যে।

বিশ্বামিত্রের কাছে সমস্ত সৌন্দর্য হচ্ছে মায়া। হিরন্ময় পাত্রের দ্বারা আচ্ছন্ন থাকেন যেমন সবিতৃদেব, তেমনি সৌন্দর্যের মায়া দ্বারা আবৃত থাকে সত্যের রূপ। সৌন্দর্যে বিমােহিত হয়ে পড়লে সত্যকে লাভ করতে পারা যাবেনা কখননা। তাই কখনাে কোনাে সুন্দর বস্তু মন ভােলাতে পারে না মহাযােগী বিশ্বামিত্রের। | আবার সেই শব্দটা কানে এসে বাজল। চকিত হয়ে উঠলেন বিশ্বামিত্র। শব্দটা এতক্ষণে স্পষ্ট হয়ে উঠল তার কাছে। তিনি স্পষ্ট শুনতে পেলেন, ছলবিলাসিনী কোন্ এক নিপুণা নটীর সুমধুর নুপুরশিঞ্জায় ছন্দিত হয়ে উঠছে যেন এক অপরূপ নৃত্যকলা। তার অলক্তলাঞ্ছিত চরণের নূপুরশিঞ্জামুখরিত পদাঘাতে আকাশ বাতাসকে আলােড়িত করে জলের বুকে ঢেউ জাগিয়ে সমস্ত জড়বস্তুকে স্পন্দিত করে তারই দিকে এগিয়ে আসছে সেই নটী। কিন্তু কোথায় সেই নটী?

সচকিত হয়ে যেদিকেই তাকান বিশ্বামিত্র, তার মনে হয় ঠিক তার বিপরীত দিকে লুকিয়ে সে যেন ছলনা করছে তার সঙ্গে। আর হাসছে। নৃত্যের তালে তালে উঠছে মদস্রাবী হাসির কলরােল।

বিশ্বামিত্রে মনে হলাে, বিশ্বচরাচরের যে সব বস্তু এতক্ষণ স্থাণুর মতাে অটল স্তব্ধতায় জমাট বেঁধে ছিল, এখন তারা সব সচল হয়ে নাচতে ও হাসতে শুরু করে দিয়েছে সহসা। এখন তার মনে হলাে, এ জগতের সব কিছু গতিশীল ও নৃত্যশীল। | যে সব অণুপরমাণু দিয়ে এই বিশ্বের বস্তুনিচয় গঠিত, এক উজ্জ্বল মত্ততায় স্বলিত হয়ে পড়ছে তারা সহসা। | একবার তার মনে হলাে, তার রােষবিস্ফারিত লােচনবহ্নি দিয়ে মুহূর্তে ভস্মীভূত করে দেবেন সেই কামিনীকে। তার উদ্ধত উন্মত্ত স্পর্ধার সমুচিত শাস্তি দেবেন এমনি নির্মমভাবে।

কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলেন বিশ্বামিত্র। মুহূর্তে সংবরণ করে নিলেন সমস্ত ক্রোধােচ্ছাস। ভাবলেন ক্রুদ্ধ হয়ে কোনাে বস্তুকে অভিশাপ দিলে বিনষ্ট হবে তার তপস্যার ফল।

এমন সময় সহসা এক নৃত্যপটীয়সী সুন্দরী রমণী করজোড়ে এসে দাঁড়াল তার সামনে।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও চেয়ে দেখলেন বিশ্বামিত্র, স্বর্গের অপ্সরার মতাে তার বেশভূষা। মদির তার কটাক্ষ। মদোন্মত্ত তার হাসি। পদ্মগন্ধবিনিন্দিত তার দেহসৌরভ। তার অনিন্দ্যসুন্দর রূপের অত্যুজ্জ্বল বিভায় সমাগত সন্ধ্যার ছায়ান্ধকারে আচ্ছন্ন দশদিক সমুদ্ভাসিত।

কে তুমি অপরিণামদর্শিনী নারী, আমার তপস্যায় বিঘ্ন সাধন করতে এসেছ?

কণ্ঠে কিছু তিক্ততা ও কঠোরতা মিশিয়ে গম্ভীরভাবে জিজ্ঞাসা করলেন বিশ্বামিত্র। কিন্তু একবার কি ভেবে দেখেছ, তােমার এই হীন কর্মের কী ভীষণ পরিণাম? মনে রেখাে, প্রতিফলনের কথা বিবেচনা না করেই যে কর্মে প্রবৃত্ত হয়, সে পশুর অধম। 

বিশ্বামিত্রের দুস্প্রেক্ষ্য ভ্রুভঙ্গ পানে বঙ্কিম কটাক্ষপাত করে কী একবার দেখে নিল সেই উদ্ধতমদা কামিনী। তারপর পর্যাপ্ত কুসুমস্তবকের ভারে নম্রীভূত লতার মতাে আপন পীনােন্নত স্তনদ্বয়ের ভারে অবনত দেহসম্ভারকে নত করে তাকে প্রণাম করে বলল, আমি আমার কর্মের প্রতিফল জেনেই স্বেচ্ছায় এখানে এসেছি মুনিবর।

বিশ্বামিত্র তেমনি গম্ভীরভাবে বললেন, কে তুমি, আগে তােমার পরিচয় দাও, তুমি দেবকন্যা না গন্ধর্বকন্যা। 

তার শুভ্রবিহসিত মুখমণ্ডল বিষাদে মলিন হয়ে উঠল সহসা। মুহূর্তে কোথায় যেন বিলীন হয়ে গেল তার বিলােল কটাক্ষ। শান্তকণ্ঠে কামিনী উত্তর করল, আমি স্বর্গের অপ্সরা মেনকা।

বজ্রের মতাে গর্জন করে উঠলেন বিশ্বামিত্র, আমি তপস্বী, তুমি অপ্সরা। আমার সকাশে কি হেতু তােমার আগমন? সত্য পরিচয় দাও। সত্যকে গােপন করবার চেষ্টা করাে না, কারণ আমি ধ্যানস্থ হলেই তােমার গৃঢ়তম অভিলাষ ও গােপনতম এষণাও জেনে নিতে পারব। 

নতজানু হয়ে করুণ কষ্ঠে মেনকা বললেন, না প্রভু, আমি বিন্দুমাত্র কোনাে কিছু গােপন করব না আপনার কাছে। তাতে আমার পক্ষে যে শাস্তি সমুচিত বলে বিবেচনা করবেন আপনি, তাই বিধান করবেন আমার উপর। স্থির হয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন বিশ্বামিত্র।

মেনকা বললেন, আপনার তপস্যার কঠোরতায় ও একাগ্রতায় শঙ্কিত হয়ে দেবগণ আপনার তপস্যায় বিঘ্ন ঘটাবার জন্যই আমায় পাঠিয়েছেন এখানে।

তারপর কিছুক্ষণ ধরে নীরবে চিন্তা করলেন বিশ্বামিত্র। বললেন, তা আমি আগেই বুঝতে পেরেছি। কিন্তু তুমি ঘটনাক্রমে আমার যোগবিরতির সময় এসে পড়েছ। অন্যথায় আমি যদি ধ্যানস্থ থাকতাম, তাহলে কেমন করে তুমি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে আমার?

তেমনি নতজানু অবস্থায় শান্তকণ্ঠে মেনকা বললেন, আমার ধৃষ্টতা মাপ করবেন প্রভু। আমি আমার নৃত্যগীতাদি দ্বারাই আপনার ধ্যানভঙ্গ করতাম।

তাচ্ছিল্যভরে হেসে উঠলেন বিশ্বামিত্র, তুমি ভুল করছ অপ্সরি, তুমি জান না, কী কঠোর তপস্যায় আমি ব্রতী হয়েছি। আমার কৃচ্ছসাধন সম্পর্কে তােমার কোনাে জ্ঞান নেই। যে পাতা গাছ হতে আপনা হতে ঝরে পড়ে সেই স্বতস্ফুত বৃক্ষপত্রের সামান্য রসটুকু পান করে জীবন ধারণ করি আমি।

বিশ্বামিত্রের মুখপানে আশ্চর্য হয়ে একদৃষ্টে চেয়ে ছিলেন মেনকা। শত আত্মনিগ্রহ ও কৃচ্ছসাধনেও কিছুমাত্র কমেনি তার দেহের অনলপ্রভ বিভূতি। বরং তা আরও বেড়ে গেছে। তপােশুদ্ধ সেই বিভূতির কাছে নিজের রূপেশ্বর্যকে ম্লান বলে মনে হলাে মেনকার।

বিশ্বামিত্র বললেন, আমার সমাধিস্থ ভাব বড় নিবিড় আর নিচ্ছিদ্র। সেখানে কোনােমতে প্রবেশ করতে পারত না তােমার নৃত্যগীতের কোনাে ধ্বনি। আমার রুদ্ধ ইন্দ্রিয়দ্বারে ব্যাহত ও ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসত তােমার সমস্ত তরল প্রয়াস।

মেনকা বললেন, আমি স্বীকার করছি আপনার ঐশী শক্তি। কিন্তু দেব, সবিশেষ বিনয়ের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি আমার উম্মাদনা শক্তিও বড় প্রবল। আমার যে নৃত্যের ছন্দে চঞ্চল হয়ে ওঠে স্বর্গের দেবসভা সেই নৃত্যের ছন্দে নৃত্যচঞ্চল হয়ে উঠত এই মর্ত্যলােকের প্রতিটি ধূলিকণা। আমার নৃত্যশীল চরণের নূপুর-নিকণে বিশ্বচরাচরের স্থাবর জঙ্গম প্রতিটি বস্তুও দোলায়িত হয়ে উঠত এক মধুর ছন্দোমত্ততায়। এইভাবে আপনার আসন উঠত টলে এবং আপনার ধ্যানভঙ্গ হত তার ফলে।

সহসা রােষস্ফুরিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন বিশ্বামিত্র, তারপর ?
মেনকা উত্তর করলেন, তারপর আপনি ক্রুদ্ধ হয়ে অভিশাপ দিতেন আমায়।
কিন্তু কেন? এবার রােষ নয়, এক নিবিড় বিস্ময়বিমুগ্ধতা ফুটে উঠল বিশ্বামিত্রের কণ্ঠে।

কেন তুমি স্বর্গেরনন্দনকানন ছেড়ে শাপদগ্ধ হয়ে মর্ত্যের ধূলিকণার সঙ্গে মিশে যেতে এসেছিলে অপ্সরি! যে দেবতাদের তুমি তােমার নৃত্যগীত দ্বারা যুগ যুগ ধরে প্রীত করে এসেছ সেই দেবতারা কেন তােমায় এই নির্মম নিষ্ঠুর আদেশ দান করলেন এবং কেনই বা তুমি নত মস্তকে অপ্রতিবাদে মেনে নিলে এই ভয়ঙ্কর আদেশ?

বিশ্বামিত্রের মুখপানে একদৃষ্টে চেয়ে নীরবে বসে রইলেন মেনকা। তার কথার কোনাে উত্তর দিলেন না। 

তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। তবু আজ সায়ংকৃত্য সম্পন্ন বা সামগান করা হয়নি বিশ্বামিত্রের। প্রদীপ জ্বালা হয়নি সমাধি কুটিরে। শুধু থেকে থেকে অসংখ্য জোনাকির অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জ্বলছে সারা বনভূমি জুড়ে। মস্তকে অন্ধকারের এক একটি বিপুল জটাজাল নিয়ে ধ্যানমগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আছে যেন প্রশান্তগম্ভীর দুমদল। বিশ্বামিত্র আবার বললেন, আমার প্রশ্নে উত্তর দাও অপ্সরি

এতক্ষণে চমক ভাঙল মেনকার। মেনকা বললেন, স্বর্গে অপ্সরার জীবন আমার আর ভালাে লাগেনা মুনিবর। অনন্তকাল ধরে চটুল দেহৈশ্বর্য ও হীন বিলাসলাস্যের দ্বারা অসংখ্য দেবতাদের প্রীত করা আমি আর একেবারেই পছন্দ করি না। দিনের পর দিন কাউকে নৃত্যগীত, কাউকে হাস্যময় সংলাপ, কাউকে নিবিড় সঙ্গদানের মধ্য দিয়ে সন্তুষ্ট করে যাওয়াই হচ্ছে আমার কাজ। এ কাজ আর আমি চাই না। আমি চাই না স্বর্গের নন্দনকানন, তার চেয়ে মর্ত্য আমার কাছে ঢের ভালাে। আমি অমরত্ব চাই না ; মৃত্যু চাই। বিশেষ করে সে মৃত্যু যদি আসে আপনার মতাে একজন পুরুষশ্রেষ্ঠর কাছ থেকে।

মেনকার কথায় এবার আরও বিস্মিত হলেন বিশ্বামিত্র।

মেনকা বললেন, এতদিন স্বর্গে বহু দেবতা দেখেছি। আজ মর্তে একজন মানুষ দেখে ধন্য হলাম। বিস্ময়ে বাকস্ফুর্তি হলাে না বিশ্বামিত্রে মুখ থেকে।

মেনকা আবার বলতে লাগলেন, হে মানবশ্রেষ্ঠ, আপনি এমনি একজন বিরাট পুরুষ যিনি স্বর্গ মর্ত্যের সমস্ত ব্যবধানকে লুপ্ত করে দিতে চলেছেন ; আপন পুরুষকারের দ্বারা বিধিনির্দিষ্ট জন্মবিধানকে অস্বীকার করে ব্রাহ্মণত্ব লাভ করতে চলেছেন আপনি। হে ঋষিশ্রেষ্ঠ, আপনি এমনি একজন তপস্বী যার তপস্যার কঠোরতায় ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে সমস্ত দেবকুল।

বলতে বলতে যেন আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়লেন মেনকা আর তা শুনতে শুনতে স্তম্ভিত হয়ে পড়লেন বিশ্বামিত্র।

মেনকা বললেন, হে তাপস, আপনার পবিত্র অভিশাপবহ্নিতে দগ্ধ ও ভস্মীভূত হয়ে আপনার তপােভূমির ধুলিকণার সঙ্গে মিশে থাকাও পরম ভাগ্যের কথা। এতে যদি আমার মৃত্যু হয় তাহলে সে মৃত্যু আমার হবে মহৎ। কারণ সে মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে আমি পাব আমার এই অবাঞ্ছিত ও ধিকৃত জীবন থেকে চিরমুক্তি।

সহসা চমক ভাঙল বিশ্বমিত্রের। দেখলেন তার পদতলে আনত হয়ে তার কাছে শাস্তি ভিক্ষা করছে মেনকা। মেনকা বলছে, হয় আমায় শাস্তি দিন তা না হলে আবার যথাস্থানে ফিরে যাবার অনুমতি দিন। আচ্ছন্নের মতাে জিজ্ঞাসা করলেন বিশ্বমিত্র, কোথায়? মেনকা বললেন, স্বর্গ ছাড়া আর যাবার আমার জায়গা কোথায় প্রভু।

বিশ্বামিত্রের মুখে চোখে এক অদ্ভুত পরিবর্তন ফুটে উঠল। কিন্তু তা দেখা গেল না। শুধু তার গম্ভীর কণ্ঠ শােনা গেল, সেখানে তােমায় আর আমি যেতে দেব না। তােমার মােহিনী মূর্তি ও মধুর বাকভঙ্গিমার দ্বারা আমাকে কামচঞ্চল করে গিয়ে দেবতাদের তুমি প্রীত করবে, সে আমি কিছুতেই হতে দেব না। ধীরে ধীরে মেনকার একটি হাত ধরলেন বিশ্বামিত্র।

সহসা বিশ্বামিত্রের এই চিত্তবিকার দর্শনে চমকে উঠলেন মেনকা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠল সমগ্ৰ বনভমির অরণ্যসমাহিত অন্ধকার।

করুণ কণ্ঠে মেনকা বললেন, একি করলেন ঋষিবর, আমাকে স্পর্শ করে কেন আপনি আপনার এতদিনের কঠোর তপস্যার ফল বিনষ্ট করলেন?

কোনাে উত্তর না দিয়ে নীরবে মেনকাকে আরও কাছে টেনে নিলেন বিশ্বামিত্র।

কোমলাঙ্গী মেনকার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলাে কেঁপে উঠল একবার। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময় বিমিশ্রিত এক বেদনার শিহরণে কুঞ্চিত হয়ে উঠল পুষ্কর হ্রদের শান্ত জলের বুক। বিশ্বামিত্র বললেন, তােমার কৃতকর্মের জন্য তােমাকে শাস্তি পেতে হবে অপ্সরা। মেনকার হাত ধরে তাকে কুটিরের মধ্যে নিয়ে গেলেন বিশ্বামিত্র।

মেনকা একবার ক্ষীণ প্রতিবাদ করবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু এখন আপনার সায়ংকৃত্য ও সামগান সারা হয়নি। বিশ্বামিত্র বললেন, তা না হােক।

অবশেষে সমস্ত চঞ্চলতা হারিয়ে স্তব্ধ হয়ে বিশ্বামিত্রের প্রশস্ত বুকের উপর নিথর নিস্পন্দের মতাে ঢলে পড়লেন মেনকা।

মেনকার মনের পরিচয় আগেই পেয়েছেন বিশ্বামিত্র। এবার সারারাত ধরে তাঁর অপরূপ দেহসৌন্দর্যের সুরভিত নির্যাস পান করতে লাগলেন তিনি। পান করতে করতে মত্ত হয়ে উঠলেন ভীষণভাবে।

বিশ্বামিত্রের সেই নির্লজ্জ মত্ততা দর্শনে লজ্জায় চক্ষুমুদ্রিত করল যেন দূর আকাশের নক্ষত্রদল। অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে রইল স্তব্ধ ও উচ্চকিত মদল।

সকাল হতে দুজনে বেরিয়ে এলেন কুটিরের মধ্য হতে। মেনকা একবার বললেন, এবার আমি যাই।

মেনকাকে নীরবে গাঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে তার ললাটে একটি চুম্বন করলেন বিশ্বামিত্র।

মন্ত্রমুগ্ধের মতাে বিশ্বামিত্রের মুখপানে চেয়ে রইলেন মেনকা। আর কোনাে কথা বলতে পারলেন না।

মেনকার কিন্তু সত্য সত্যই আর যাবার ইচ্ছা ছিল না। এই নির্জন বনস্থলীর মাঝে শান্ত সুখী এক আশ্ৰমজীবনের প্রতি কোথায় যেন একটা গুঢ় আকর্ষণ ছিল তার মনে।

বিশ্বামিত্র ও মেনকা দুজনেই দেখলেন, সমগ্র বিশ্বপ্রকৃতি সম্পূর্ণ এক নূতন রূপ ধারণ করেছে যেন। তারা দুজনেই অনুভব করলেন, তাদের সম্পূর্ণ নূতন জীবন সূচনা করছে যেন আজকের এই নবপ্রভাত।

মধুস্রাবী পক্ষিকুলকণ্ঠে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠেছে সমগ্রবনভূমি।চারিদিকে প্রস্ফুটিত পুন্নাগ কুসুমসৌরভে আমােদিত হয়ে উঠেছে বাতাস। দূরে মেরুপ্রদেশের যে সমুচ্চ শৃঙ্গ দেশগুলি তারকাসুর ভেঙে নিয়ে গিয়ে তার বিহারশৈল রচনা করেছে, আজ বহুদিন পর রঙীন সূর্যাশ্বগুলি বড় মনােরম ভঙ্গীতে বিচরণ করছে যেন সেখানে আবার। বহুদিন পর যেন অজস্র স্বর্ণমালা ফুটেছে শেতাজসুন্দর মন্দাকিনীর জলে।

নূতনভাবে বসবাস করার জন্য পরম আগ্রহে আর একটি পর্ণকুটির নির্মাণ করলেন বিশ্বামিত্র।

অপ্সরার বেশভূষা ত্যাগ করলেন মেনকা। তারপর ঋতুসত নানারকমের কুসুমভূষণ পরিধান করে গৃহকর্মে প্রবৃত্ত হলেন। এই সরল অনাড়ম্বর প্রসাধনে দ্বিগুণ বর্ধিত হলাে তার দেহসৌন্দর্য।

স্বহস্তরচিত কুসুমভূষণে সজ্জিত হয়ে মেনকা যখন নত হয়ে প্রণাম করতেন বিশ্বামিত্রকে তখন তার অলকদাম নিহিত গন্ধচুর্ণে কেমন যেন নেশা লাগত বিশ্বামিত্রের মনে। তিনি তখন সঙ্গে সঙ্গে তুলে ধরে বুকের কাছে টেনে নিতেন মেনকাকে। 

ইন্দ্রিয়ের যে সব দ্বারগুলি রুদ্ধ করে রেখেছিলেন এতদিন, এবার সেগুলি একেবারে উন্মুক্ত করে দিলেন বিশ্বামিত্র। দীর্ঘ অবদমনের পর আজ মেনকার দেহের মধ্য দিয়ে জগতের রূপ, রস, গন্ধ, বর্ণকে উপভােগ করবার জন্য উন্মুক্ত হয়ে উঠল তার সমস্ত ইন্দ্রিয়। আজ সারা জগতের সমস্ত রূপ, রস এসে যেন একত্রিত হয়েছে মেনকার দেহের মধ্যে।

প্রায়ই দুচোখ ভরে মেনকার দেহটাকে খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন বিশ্বামিত্র। তার সমস্ত অঙ্গ -প্রত্যঙ্গের উপর হাত বুলিয়ে কী যেন অনুভব করতে থাকেন।

কখনও তার দেহের আঘ্রাণ নেন। মঞ্জুভাষিণী মেনকার মধুর কণ্ঠ শােনবার জন্য সদাজাগ্রত ও উৎকর্ণ হয়ে থাকে তার কর্ণকুহর। মেনকার অধরােষ্ঠের উপর নিজের অধরােষ্ঠকে সংযুক্ত করে যখন নিবিড়ভাবে চুম্বন করেন বিশ্বামিত্র, তখন মনে হয় মেনকার দেহসৌন্দর্যের সমস্ত রসনির্যাসটুকুকে তিনি শুধু আস্বাদনই করছেন না, বদ্ধপরিকর হয়ে উঠেছেন তা নিঃশেষে পান করবার জন্য। 

জপতপ যে আজ কাল বিশ্বামিত্র একেবারে করেন না তা নয়। তবে দিনরাত্রির মধ্যে বেশির ভাগ সময়ই কেটে যায় মেনকাকে নিয়ে। 

একদিন দ্বিপ্রহরে যজ্ঞের জন্য কাষ্ঠ আহরণ করতে গিয়ে ফিরে এলেন বিশ্বামিত্র। আশ্রমের মধ্যে গৃহকর্মে নিরত ছিলেন তখন মেনকা। 

অকালে ফিরতে দেখে কাজ ফেলে ছুটে এলেন মেনকা। আকুল হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি অসুস্থ?

বিশ্বামিত্র মেনকার মুখচুম্বন করে বললেন, না মেনকা, তােমায় ছেড়ে কোথাও গিয়ে আমি ক্ষণিকের জন্যও থাকতে পারছি না। যেখানেই যাচ্ছি সর্বত্রই শুধু তােমাকেই দেখছি। সর্বক্ষণ মনে পড়ছে শুধু তােমারি কথা।

কথাটা শুনে মেনকা কিন্তু তৃপ্ত হতে পারলেন না। শাস্তকণ্ঠে তিনি শুধু বললেন, মনকে একটু সংযত ও শক্ত করুন আর্য। অতখানি বিচলিত হওয়া শােভা পায় না আপনার পক্ষে।

বিশ্বামিত্র করুণকণ্ঠে বললেন, কিছুতেই তা পেরে উঠছিনা মেনকা। অন্তরীক্ষের নীলিমায় ও জলের স্বচ্ছতায় প্রতিফলিত দেখছি তােমার মুখ, অরণ্যের হাওয়ায় শুনছি তােমার শ্বাসপ্রশাস। পাখির গানে ধ্বনিত হচ্ছে তােমার কণ্ঠ। ফুলের গন্ধে পাচ্ছি তােমার দেহসৌরভ। শুধু তাই নয় মেনকা, আজকাল যজ্ঞাগ্নির কুশুলায়িত ধূমরাশির মধ্যে ভেসে ওঠে তােমার নৃত্যের ছন্দ। যজ্ঞকালে যখন উদাত্ত, অনুদাত্ত ও স্বরাত্ত এই ত্রিবিধ স্বরসংযােগে বেদবাক্যের ওঙ্কার ধ্বনি আরম্ভ করি, তখন সে ধ্বনিকে ছাপিয়ে ওঠে তােমার সঙ্গীতের ধ্বনি।

সহসা গম্ভীর হয়ে উঠলেন মেনকা। অসময়ের মেঘের মতাে বিষাদের কালাে ছায়া নেমে এলাে তার উজ্জ্বল মুখমণ্ডলে। শান্ত গম্ভীর কণ্ঠে তিনি বললেন, এইজন্যই কামিনীকাঞ্চনকে সাধনার ঘাের পরিপন্থী বলা হয় ঋষিবর। কিন্তু আপনি কেন একথা ভুলে যাচ্ছেন যে, গৃহের মধ্যে থেকেও অনেক তপস্বী সিদ্ধিলাভ করেছেন তাদের তপস্যায়। তাদের দাম্পত্য-সম্পর্ক বিশেষ সংযত হওয়ার জন্য তা কোনাে বিঘ্নই সৃষ্টি করতে পারেনি তাদের তপস্যায়। কিন্তু আমাকে নিয়ে ঘর বাঁধার পর থেকে আপনি যে একজন ঋষি বা তপস্বী একথা একেবারে ভুলে যেতে বসেছে।

একটু থেমে বিশ্বামিত্রের মুখপানে একবার বিশেষ অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে চাইলেন মেনকা। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, আপনার পােবন আজ একজন ভােগী বিলাসীর গৃহে পরিণত হয়েছে। আজকাল প্রায়ই পুষ্পরসনির্মিত মদ্যপানে গােলাপী নেশায় আঘূর্ণিত হয়ে থাকে আপনার নয়নযুগল। এক উগ্ৰ কামচেতনায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে আপনার মন-প্রাণ।

মেনকাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে হঠাৎ জোরে হেসে উঠলেন বিশ্বামিত্র। বললেন, তােমার এই মৃদু ভৎসনা আমার বড় মধুর লাগছে অপ্সরি !

মেনকা বিশ্বামিত্রের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে আবার বলতে লাগলেন, আমায় আপনি সত্যসত্যই ভালােবাসেন। আমার প্রতি আপনার এই প্রেমের জন্য আমি আপনার নিকট চিরকৃতজ্ঞ। কিন্তু এই প্রেমের জন্য আপনি সাধনার পথ হতে বিচ্যুতি হবেন, এ আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারব না। 

প্রেম মিথ্যা তা বলছিনা। কিন্তু প্রেমের থেকে আরও বড় সত্য আছে জীবনে। সেই বৃহত্তর সত্য লাভের পথে অন্তরায় হয়ে ওঠে যে প্রেম সে প্রেমে মঙ্গল নেই। কারাে পক্ষেই কখনাে শুভ হতে পারে না সে প্রেম।

কিঞ্চিৎ রুষ্ট হলেন যেন বিশ্বামিত্র। বললেন, আমায় যত পারাে ভসনা করা, কোনাে আপত্তি নেই। কিন্তু তুমি আমায় নীতি উপদেশ শােনাতে এসনা। কী জানাে তুমি প্রেম সম্পর্কে?

মেনকা আর কোনাে কথা বললেন না। স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। 

বিশ্বামিত্র বললেন, সে সত্য যত বড়ই হােক, প্রেমের সত্যকে না জানলে তা জানা যায় না। একদিক দিয়ে এই প্রেম সবচেয়ে বড় সত্য। বিশ্বসৃষ্টির সকল রহস্যের মূলে রয়েছে এই প্রেম।

কথাটা হয়ত ঠিক বুঝতে পারলেন না মেনকা। তাই অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন বিশ্বামিত্রের মুখপানে।

বিশ্বামিত্র বললেন, এই জগতে ও জীবনে মাত্র দুটো সত্য আছে-রাগ এবং দ্বেষ, আকর্ষণ এবং বিকর্ষণ। এই রাগ ও দ্বেষ হতেই উদ্ভব হয়েছে জীবন ও মৃত্যুর, প্রেম ও অপ্রেমের। এদের মধ্যে প্রেমই হচ্ছে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ গুণ। এই প্রেমবােধের তাড়নাতেই জগৎ সৃষ্টি করেছিলেন সৃষ্টিকর্তা। নিজের অভিন্ন পরমাত্মাকে বিভক্ত করেছিলেন নারী ও পুরুষে।

সহসা কথা থামিয়ে চারিদিকে চেয়ে কী একবার দেখে নিলেন বিশ্বামিত্র। দ্বিপ্রহর পার হয়ে কখন অপরাহু এসেছে, শান্ত ঘন হয়ে উঠেছে চঞ্চল ও ছিন্নভিন্ন বনছায়া,কথায় কথায় দুজনে এমনই মত্ত হয়ে উঠেছেন যে সেদিকে কেউ একবার ফিরেও তাকাননি। | বিশ্বামিত্র বললেন, শুধু মানুষের জীবনে নয়, সমগ্র জীবজগৎ ও প্রকৃতিজগতেও সব সময়ের জন্য চলেছে প্রেমের লীলা। এই প্রেমের নেশাতেই পরস্পরকে আকর্ষণ করে মহাশূন্যে ভাসছে গ্রহনক্ষত্রের দল। ঐ দেখ, প্রেমে আকুল হয়ে এক জায়গায় কখনাে স্থির হয়ে থাকতে পারছেনা বাতাস, ফেনিল নূপুর পরে নদী ছুটে চলেছে সমুদ্র-সঙ্গমাভিমুখে! প্রেমে মাতােয়ারা প্রতিটি বৃক্ষপত্র এক অপরূপ ছন্দভঙ্গিমায় নিয়ত নৃত্যশীল। আরও দেখ, নিবিড় প্ৰেমালিঙ্গনে আবদ্ধ হয়েই অণুপরমাণুগুলি গড়ে তুলেছে প্রতিটি বস্তুকে। অদম্য প্রেমের তাড়নাতেই ফুলের পরাগকেশর গর্ভকেশরে মিলিত হয়ে উৎপন্ন করে আশ্চর্য সুন্দর এক একটি কুসুমাবয়ব। 

বেশি দূরে যেতে হবে না, কোনাে এক মদচঞ্চল উতল মুহূর্তে গভীর প্রেমাবেশে তােমার পিতামাতা যদি মিলিত না হতেন তাহলে তােমার সষ্টি হত না মেনকা। প্রেমের অভাব ঘটলেই পরস্পর হতে ঋলিত ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সম্মিলিত অণু-পরমাণুর দল আর তার ফলে মৃত্যুমুখে পতিত হয় জীব; বিকৃতি প্রাপ্ত হয় বস্তু। মেনকাকে আবার আলিঙ্গন করে মৃদুভাবে একটি চুম্বন করলেন তার ওষ্ঠে। বিশ্বামিত্রের সব কথা বুঝতে পারলেন না মেনকা। কিন্তু তার দুরন্ত যুক্তি-গুলিকে খণ্ডন করবার মতাে কোনাে কথা খুঁজে পেলেন না। তাইনীরব হয়ে রইলেন বাধ্য হয়ে।

বিশ্বামিত্র বললেন, প্রেমের সহযােগেই সুন্দর হয়ে ওঠে এ জগতের সব বস্তু। আমি যদি তােমায় ভালােনা বাসতাম তাহলে তােমার এই সুন্দর দেহাবয়বকে অসুন্দর মনে হত আমার। হৃদয়ে যাদের প্রেম নেই তাদের কাছে ফুলের কোনাে সৌন্দর্য নেই, চন্দ্রালােকের মধ্যে কোন মাধুর্য নেই, সঙ্গীতের সুরের মধ্যে কোনাে মাদকতা নেই। প্রেম আছে বলেই মনে হয় মধুময় এই পৃথিবীর ধূলি। মধু ঝরে পড়ে জলে স্থলে অন্তরীক্ষে।

যেদিন প্রেম থাকবে না, সেদিন অচল হয়ে উঠবে এই বিশ্বসৃষ্টি। সেদিন একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কোনাে কিছুই বেঁচে থাকবে না। সেদিন স্বর্গমর্ত্যব্যাপী সৃষ্টিহীন এক মহাশূন্যতায় নির্গণ নিরাকার স্রষ্টা নিঃসঙ্গ বেদনায় কেঁদে কেঁদে ফিরবে।

এমনি করে বছরের পর বছর কেটে যেতে লাগল। তবু কিছুমাত্র পরিবর্তন হলাে না বিশ্বামিত্রের। বিন্দুমাত্র স্তিমিত হলাে না তার দুরন্ত প্রেমাবেগ।

একদিন মেনকা সহসা বুঝতে পারলেন, গর্ভসঞ্চার হয়েছে তার মধ্যে। এক অননুভূতপূর্ব আনন্দের শিহরণে সমস্ত দেহ মন দুলে উঠল মেনকার। তার ক্ষীণ কটির নিম্নভাগে নধরস্ফীত নাভিদেশের চারিদিকে বারবার হাত বুলিয়ে কী যেন অনুভব করে দেখতে লাগলেন মেনকা। তার এই দেহাবয়বের মধ্যে তারই কাছ থেকে তিল তিল রক্ত মাংস নিয়ে দিনে দিনে সকলের অলক্ষ্যে অগােচরে গড়ে উঠছে একটি দেহমন্দির আর সেই দেহমন্দিরের মধ্যে বিগ্রহের মতাে প্রতিষ্ঠিত হবে সম্পূর্ণ নূতন একটি জীবন যার মধ্যে এক অপরূপ সার্থকতা লাভ করবেন তিনি—একথা ভাবতে ভাবতে আত্মহারা হয়ে উঠলেন মেনকা। 

উল্লসিতাঙ্গী মেনকা সে আনন্দের বেগকে নিজের অন্তরে আর ধরে রাখতে পারলেন না। তাই ছুটে গিয়ে কথাটা বললেন বিশ্বামিত্রকে। 

কথাটা শুনে কিন্তু মােটেই খুশি হতে পারলেন না বিশ্বামিত্র। শােনার সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর হয়ে বসে ভাবতে লাগলেন। 

তার এই আকস্মিক ভাব পরিবর্তনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে রইলেন মেনকা।

যে সব কথা কোনদিন ভাবেননি বিশ্বামিত্র, আজ সেই সব কথা গভীরভাবে ভাবতে

লাগলেন। ভাবলেন, এতদিন অর্থাৎ এই দীর্ঘ দশটি বছর ধরে প্রেমের সত্যকে জানতে গিয়ে মেনকার প্রেম ও সৌন্দর্যে বিভাের হয়েছিলেন। এর উপর আবার যদি সন্তানম্নেহে জড়িয়ে পড়েন তাহলে সম্পূর্ণরূপে মৃত্যু ঘটবে তার ঋষিজীবনের।

আজ সহসা যেন চমক ভাঙল তার। তিনি বুঝতে পারলেন, কোনাে সত্যই চূড়ান্তভাবে মহৎনয়। কোনাে একটি সত্যকে জানার সঙ্গে সঙ্গে নূতনতর আর একটি সত্যের সন্ধানে সাধনা করাই জীবনের প্রকৃত ধর্ম। 

কাঁদতে কাদতে বিশ্বামিত্রের পায়ের উপর লটিয়ে পড়লেন মেনকা। করুণকণ্ঠে বললেন, কী, কথা বলুন, নীরব কেন? এত বড় আনন্দের দিনে কেন আপনি এমন বিষাদগম্ভীর হয়ে উঠলেন সহসা?

মেনকার দেহমনের মধ্য দিয়ে যে সত্যকে জানতে ও আস্বাদন করতে চেয়েছিলেন বিশ্বামিত্র, সে সত্যকে জানার সঙ্গে সঙ্গে মেনকার প্রয়ােজন ফুরিয়ে গেছে তার কাছে। 

কিছুক্ষণ পর বিশ্বামিত্র শান্তগম্ভীর কণ্ঠে বললেন, এবার তুমি যাও মেনকা। আমার প্রেমসাধনা শেষ হয়েছে এবার। এবার থেকে নূতনতর এক সাধনায় নিয়ােজিত করতে চাই নিজেকে।

মেনকা কাতরকণ্ঠে বললেন, তবে কি সব ভুল; তবে কি মিথ্যা স্তোকবাক্যে আমায় ভুলিয়ে রেখে নিজের হীন কাম প্রবৃত্তিকে চরিতার্থ করেছেন দিনের পর দিন?

বিশ্বামিত্র বললেন, বিচলিত হয়াে না মেনকা। কোনাে কিছুই মিথ্যা নয়। আমাদের অমর প্রেমের সাক্ষ্য দান করবে তােমার গর্ভস্থ সন্তান। আমার নামের সঙ্গে সঙ্গে চিরদিন যুক্ত হয়ে থাকবে তােমার নাম। তােমার অঙ্গরাজীবন অমরত্ব লাভ করবে আমার সঙ্গে। সাধনার দ্বারা ভবিষ্যতে দেবর্ষি বা ব্রহ্মর্ষি যত বড় ঋষিই হই না, আমার প্রেমিক সত্তাকে প্রমাণ করবে আমাদের এই সন্তান।

চোখের জল মুছে বিদায়ের জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠলেন মেনকা। তখন সূর্য সবেমাত্র অস্ত গেছে।

বহুদিন পর আবার একটি গােধূলি এলাে। বিরহবিধুর এক নিষ্ঠুরতায় ধূসর এক গােধূলি। এক অব্যক্ত বেদনায় রক্তরঙীন হয়ে উঠেছে মেঘের প্রান্তভাগগুলি। সাথীহারা শূন্যতার এক স্তব্ধ হাহাকারে আত্মলীন হয়ে উঠেছে আকাশ বাতাস। 

শেষবারের মতাে বিশ্বমিত্রকে প্রণাম করলেন মেনকা! দক্ষিণ হস্ত উত্তোলন করে নীরবে আশীর্বাদ করলেন বিশ্বামিত্র।

ধীরে ধীরে কোথায় বিলীন হয়ে গেলেন মেনকা। আজ তার চরণে কোনাে নৃত্যোচ্ছল চঞ্চলতা নেই। গতিভঙ্গির মধ্যে নেই কোনাে মাদকতা। নয়নে নেই কোনাে বঙ্কিম কটাক্ষের জটিলতা।

এদিকে তখন বিষাদগম্ভীর অন্ধকার নেমে এসেছে শান্ত নির্জন বনস্থলীতে আর পুষ্কর হ্রদের জলে। সেই অন্ধকারকে ভেদ করে যজ্ঞাগ্নি জ্বলে উঠল ঋষি বিশ্বামিত্রের।

ধীরে ধীরে এক নিবিড় ধ্যানে সমাধিস্থ হয়ে পড়লেন বিশ্বামিত্র।

Leave a Reply