রাঁড় কাহিনি
….ত্রৈলােক্য অত কিছু বােঝে না। তারাদিদির অন্ধকার ঘরে পিদিমের বিবর্ণ আলােয় দেহতত্ত্বের কথা শুনতে শুনতে তার কর্ণমূল লজ্জায় আরক্ত হয়ে আসে, আবার ভালােও লাগে কেমন যেন, শরীরে ঝিমঝিম ধরে, কেমন এক সুখানুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে মন। রাত গভীর হলে একান্ত অনিচ্ছায় নিজের বাড়ি গিয়ে ঘুমনাের সময়ও মানসচক্ষে ভাসতে থাকে সেই সব রতিদৃশ্য।….
…..পঞ্চাশ বছরের শীর্ণ ক্লিষ্ট স্বামী পেয়ে তারাদিদির কাছে আহরণ করা শিক্ষা ব্যর্থ তাে হলই, রাগে দুঃখে ত্রৈলােক্য অস্থির হয়ে উঠল। বিয়ের আয়ােজন মিটে যেতেই তার মনে হতে লাগলাে, তার এই দুর্দশার জন্য দায়ী আর কেউ নয়, তার নিজের বাপ-মা। কুলীন কুলীন করে গোঁড়ামির জন্য বলি হতে হয়েছে তাকে।
বিয়ের পরে ত্রৈলােক্যর স্বামী অবশ্য বেশি সময় অপচয় করলেন না, বিবাহ বাবদ যৌতুক ও দেনা পাওনা আগেই বুঝে নিয়েছিলেন, বিয়ের পরের কিছুদিন শ্বশুরালয়ে অবস্থান করে আরও কিছু উপঢৌকন সঞ্চয় করে তিনি তেরাে বছরের স্ত্রীকে পিত্রালয়ে রেখে রওনা দিলেন। গােটা বছরটা তাঁকে নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে কিছুদিন করে থেকে স্ত্রীদের স্বামীসেবা করার সুযােগ দিতে হয়, এক জায়গায় থাকার অবকাশ কোথায়?….
…..তারা দিদি বলল, ‘মন খারাপ করিস না লাে। সবাই তাে আর জোয়ান মদ্দ সােয়ামি পায়না বল। তাই বলে কি এই যৌবন বইয়ে দিবি নাকি? না দেওয়াটা কোন বুদ্দিমানের কাজ!
‘মানে!’ ত্রৈলােক্য কুল খাচ্ছিল, খেতে খেতে তারাদিদির কথা শুনে কিছুই বুঝতে পারেনা, হাঁ করে তাকিয়ে থাকে, ‘সােয়ামি না থাকলে কার সাথে পিরিত করব গা? তুমি কি যে মাঝেমধ্যে হেঁয়ালি করাে, কিছুই বুজি না বাপু!’
‘নিজের সাথে করবি।’ তারাদিদি অপাঙ্গে তাকায় ত্রৈলােক্যের দিকে।
সেই দৃষ্টির মধ্যে এমন কিছু নিহিত থাকে, তা দেখে ত্রৈলােক্যর শরীর যেন ঝিমঝিম করে ওঠে। কোনােমতে সে বলতে পারে, সে কি করে গা!’
‘কোনাে সােয়ামি যদি নিজের মাগকে সুখ দিতে না পারে, তখন ইস্তিরি নিজেই নিজেকে সুখ দিতে পারে বুজলি? ওতে কোন অধম্ম হয় না-কো!’ তারাদিদি পান চিবােতে চিবােতে বলে।
তারপর ধীরেসুস্থে ত্রৈলােক্যকে সে শেখায় কি করে শুধুমাত্র স্পর্শ দিয়ে নিজের শরীরকে পৌঁছে দেওয়া যায় মৈথুনের চূড়ান্তে।
অবগাহন করা যায় সুখের সাগরে। একা। লাগে না কোনাে পুরুষ। ত্রৈলােক্য প্রথমে সেই সুখ উপলব্ধি করে হতভম্ব হয়ে যায়, তারপর অপরাধবােধ মেশানাে এক মিশ্র অনুভূতি গ্রাস করে ওকে। নিষিদ্ধ মাদকের আকর্ষণের মতােই নেশাতুর হয়ে সে রােজ ছুটে যায় তারাদিদির ঘরে, পান করতে চায় যৌবনের সুখ-সুধা, যতটা পারা যায়।…..
…..তারাদিদির ভাইটিও তেমনই, অপরিচিত স্ত্রীলােককে দেখেও কোনাে সংকোচ নেই, কেমন হাসিহাসি মুখে ত্রৈলােক্যর আপাদমস্তক দেখতে দেখতে বলে উঠল, “এই তােমার সেই বােন? কী নাম গাে তােমার?
তারাদিদির নির্জন কুঁড়েঘরে তপ্ত দুপুরে ত্রৈলােক্য নির্লজ্জতার বহর দেখে মরে যায় আর কি! এমনভাবে যে কোনাে পুরুষ সােজাসুজি কথা বলতে পারে, তা তার বিশ্বাস হয় না।
তারাদিদি বলে, ওর নাম ত্রৈলােক্যতারিণী। ভারি ভালাে মেয়ে। কপাল যদিও মন্দ, এই বয়সেই সােয়ামিকে খুইয়েচে রে গৌর! ওর এটু ভালােবাসা দরকার।”
ত্রৈলােক্যর বৈধব্য সংবাদ শুনে গৌর নামক লােকটির পুলক যেন আরও বেড়ে যায়। সে পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ায় ত্রৈলােক্যর সামনে। এত কাছে যে তার নিশ্বাসের ওম এসে লাগে ত্রৈলােক্যর মুখে-চোখে। তারপর একসময় হাত দিয়ে খুলে দেয় ত্রৈলােক্যর মুখের আড়ালকে। আড়ষ্টতায় ত্রৈলােক্য কেঁপে ওঠে।
হাজার সংকোচের মাঝেও সেই অনুভূতিকে নতুন করে আবিষ্কার করে ত্রৈলােক্য, বােঝে এমন অভিজ্ঞতা তার আগে কখনাে হয়নি। স্বমেহনের সুখও যেন এর কাছে তুচ্ছ!
সেদিন একটু পরেই গৌর চলে যায়। ত্রৈলােক্য ম্লানমুখে দাওয়ায় বসেছিল। তারাদিদি প্রথমে কিছু বলেনি, বােধ হয় ত্রৈলােক্যকে গুছিয়ে নিতে সময় দিচ্ছিল।……
…..তারপর একসময় কাজ করতে করতে বলে ওঠে, “আমাদের বােষ্টুমিদের কি নিয়ম জানিস ত্রৈলােক্য? সােয়ামী মরে গেলেও বােষ্টুমিরা অন্য পুরুষের কাছে আশ্রয় নিতে পারে। এতে কোনাে অধম্ম হয় না কো, বরং একালে পরমসুখ পাওয়া যায়, আর পরকালে সগগলাভ! বুজলি কিছু? তাের এত নজ্জার কি আছে? আমার গৌর কি খারাপ ছেলে নাকি?
কিন্তু এখন সেই আগল আর রইল না। তারা বৈষ্ণবীর নির্জন ঘরে খুব শিগগিরই গ্রীষ্মের এক তপ্ত দুপুরে শরীরের সমস্ত ঘাম গৌর মাখিয়ে দিল ত্রৈলােক্যর দেহে। ত্রৈলােক্য অবশেষে তার কৌমার্য হারাল।……
…..ত্রৈলােক্য অবশ্য এসবের কিছু টের পেল না। একদিন সন্ধ্যের সময় সে গৌরের সঙ্গে তারা বৈষ্ণবীর নির্জন গৃহে রতিক্রিয়ায় ব্যস্ত, ত্রৈলােক্যর মা ও তাঁর কিছু প্রতিবেশিনী সখী আকস্মিক হুড়কো খুলে ঢুকে পড়লেন।
‘ও মাগাে, একী অনাছিষ্টি কাণ্ড গাে! ভর সন্দেবেলা গেরস্থ ঘরের বেধবা …ছি ছি ছি!’ মুহূর্তে মহিলাদের আর্তনাদে সারা পাড়া মুখরিত হয়ে উঠল।
ত্রৈলােক্য নিজের বিস্রস্ত বেশবাস ঠিক করার আগেই গৌর লাফ দিয়ে উঠে অন্ধকারের মধ্যে পালিয়ে গেল।…..
…..সেই রাতের পর তিনমাস কেটে গেছে। এই তিনমাসে পৃথিবীর সব কিছু যতই এক থাকুক, সূর্য একই নিয়মে উদিত হােক, অস্ত যাক, ত্রৈলােক্যর জীবনে আমূল পরিবর্তন এসেছে।
সে বহুগামিনী হয়েছে, সুরাপান শিখেছে, ধূমপানে অভ্যস্ত হয়েছে। বাড়ির আর পাঁচজন স্ত্রীলােকের ভাবভঙ্গি, আদবকায়দা, চালচলন অনুকরণ করে ছলা কলা প্রয়ােগে সে হয়ে উঠেছে বিশেষ পারদর্শিনী। ইদানীং তার ঘরে পুরুষের ভিড় লেগেই থাকে, প্রথম দিনের স্বপ্নের মতাে পয়সা ফেলে সে আদেশ করে ভৃত্যকে।
গৌরের ভূমিকা ত্রৈলােক্যর জীবনে খুব দ্রুত বদলে চলেছিল। এখানে সে ত্রৈলােক্যকে যখন নিয়ে এসেছিল, তখন ত্রৈলােক্যর চোখে সে ছিল প্রেমিক, ক্রমে সে হয়ে উঠল ত্রৈলােক্যর খদ্দের ধরার দালাল।
ত্রৈলােক্য ইদানীং ওকেও ওর সেই চাকরের মতােই ফাইফরমাশ খাটায়, গালিগালাজ করে আর মাসান্তে গুঁজে দেয় কিছু পয়সা। নিজের এমন অধঃপতনে গৌরের অবশ তেমন কোনাে অভিযােগ নেই। সে নিছকই সােনাগাজির খেপ খাটা দালাল ছিল, উঠতি এক রূপােপজীবিনীর ছায়ার তলায় থাকলে তাে ভালােই, নিরাপত্তা অনেক বেশি।
দিনে দিনে ত্রৈলােক্যর রূপযৌবন, সর্বোপরি তার ছলাকলার খ্যাতি এমনভাবে ছড়িয়ে পড়তে লাগল সােনাগাজিতে, অনেক পুরুষই শুধুমাত্র ত্রৈলােক্য রাঁড়ের সঙ্গলাভের আশায় হানা দিতে লাগলেন ওই বাড়িতে। ফলত ত্রৈলােক্যর সারা অঙ্গ সােনা ও বহুমূল্য অলংকারে ভরে যেতে লাগল, সঞ্চয় উপচে পড়তে লাগল।
ত্রৈলােক্য নিজে আমূল বদলে গিয়েছে এই কয়েক বছরে। তার মেজাজ এখন সবসময়েই সপ্তমে চড়ে থাকে, পান থেকে চুনটুকু খসলে বাড়ির কড়িবরগাগুলাে পর্যন্ত ভয়ে কেঁপে ওঠে। সবাই তাকে তােষামােদ করে চলে।
পরিবর্তন এসেছে তার চেহারাতেও। গ্রামের গুল্মলতার মতাে জড়সড় কিশােরীটি সে আর নেই, তার চেহারায় এখন সৌন্দর্যের সঙ্গে এসেছে পরিণত মেদ। লজ্জা, আড়ষ্টতা এইসবও তার চরিত্র থেকে এখন উধাও হয়ে গিয়েছে।
পায়ের ওপর পা তুলে মুখে একখিলি পান খুঁজে সে এখন অবলীলায় গায় প্রবােধ সরকারের লেখা অশ্লীল গান,
“আয় কে তােরা নিবি আমার সাধের আনারস
নয় পাকানাে নয় ডাঁসানাে, রস পড়ে টস টস
আমার এই আনারসে—
কত ছােড়ার মন বসে
ফিরি করি দেশ বিদেশে
লােকে করে যশ!”………