বশিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্র – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

›› পৌরাণিক কাহিনী  

……শৌনকের লেখা সেই বৃহদ্দেবতা গ্রন্থে দেখতে পাচ্ছি— মিত্র ও বরুণ এই দুই আদিত্য দেবতা যজ্ঞ করতে বসেছেন— এমন সময়ে সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। স্বর্গসুন্দরী অপ্সরা ঊর্বশী। স্বাভাবিক ভাবেই যজ্ঞক্রিয়া থেকে মন সরে গেল মিত্র ও বরুণের এবং তাঁদের চোখ পড়ল ঊর্বশীর শরীরে— তয়োরাদিত্যয়োঃ সত্রে দৃষ্টাপ্সরসমুরশীম্। শ্লোকের মধ্যে অবশ্য যজ্ঞ-শব্দটা উচ্চারণ না করে ‘সত্র’ বলা হয়েছে। সত্র মানে যজ্ঞই বটে, তবে বিশেষার্থে বারো দিনে সমাপনীয় দ্বাদশাহ যজ্ঞাগুলির নাম হল সত্র। যাই হোক, সেই সত্রকালে উর্বশীর মতো স্খলিতবসনা এক সুন্দরীতমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার ফলেই তাঁদের তেজস্খলিত হল এবং সেই স্খলিত তেজ খানিকটা গিয়ে পড়ল সোমযাগের জন্য আনা ‘বসতীবরী’র জলে, অন্যাংশ জল কুম্ভ-সন্নিহিত ভূমিতে— রেতঃ চস্কন্দ তৎকুত্তে নাপতাসতীবরে।
জলকুম্ভে পতিত তেজ থেকে জন্মালেন অগস্ত্য মুনি, আর ভূমিতে স্খলিত দেব-তেজ থেকে জন্মালেন বশিষ্ঠ — স্থলে বশিষ্ঠস্ত মুনিঃ সম্ভূত ঋষিসত্তমঃ। বৃহদ্দেবতার এই অতিসংক্ষিপ্ত বিবরণ, যা প্রায় তথ্য-নিবেদনের মতো পরিবেশিত হয়েছে সংবাদের আকারে, এই তথ্য-নিবেদন রসান্বিত হয়েছে পুরাণকারদের বিবরণীতে। আর এটাও ঠিক যে, যজ্ঞকর্মের ধর্মস্থলে যদি উর্বশীর মতো নাগরিকা রমণী এসে উপস্থিত হন, তাহলে দেবতার চক্ষুও যে ইন্দ্রিয়ের বিষয়টুকু মন দিয়েই উপভোগ করবে, সেটা বলাই বাহুল্য।
যাই হোক, মৎস্য পুরাণে এরপর সেই ঘটনাটা ঘটছে, যা বৃহদ্দেবতায় সূত্রাকারে বর্ণিত হয়েছে। ব্রহ্মার কথামতো বশিষ্ঠের জীবসত্তা মিত্রাবরুণের তেজোবীর্যে আহিত হওয়া মাত্রেই আমরা মিত্রাবরুণের সামনে স্বর্গসুন্দরী ঊর্বশীকে আগমন করতে দেখছি। মিত্রাবরুণের তপস্যা এবং তপস্যার স্থান নিয়ে রামায়ণের বিবরণের সঙ্গে মৎস্য পুরাণের তফাত থাকলেও ঊর্বশী যে তাঁর সখীদের নিয়ে মিত্রাবরুণের সামনাসামনি ঘোরা-ফেরা করছিলেন, সে বিষয়ে সব পুরাণই একমত। বিশেষত ঊর্বশীর গমক-ধমকও তো অপরিবর্তিত। ফুটাস্ফুট ব্যঞ্জনায় তাঁর দেহ-ব্যঞ্জন বসন, তার মধ্যে আবার নুয়ে-নুয়ে যাওয়া বনতল থেকে তাঁর ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাওয়া ফুলদল— ঊর্বশী পুষ্প-চয়ন করছেন— ঊর্বশী তু বরারোহা কুর্বতী কুসুমোচ্চয়ম্। আমরা জানি, এ কোনও পূজার পুষ্প নয়, ঊর্বশীর এই চলাও কোনও তপোভূমির পরিক্রমা নয়— বস্তুত এই চলা-ফেরার অবান্তর ফল যা হওয়ার ছিল, তাই হল। মিত্রাবরুণ যে মৃগচর্মের আসনে বসেছিলেন, সেখানেই তাঁদের তেজঃস্খলন ঘটল। তাঁরা অবশ্য সেই তেজ ধারণ করার চেষ্টা করলেন জলকুম্ভ বা কলসের মধ্যে, যাতে তাঁদের দৈব তেজ ব্যর্থ না হয়— চক্রতুঃ কলসে শুক্রং তোয়পূর্ণে মনোরমে।…..
……রামায়ণের বিবরণ একটু অন্যরকম। তাতে ঊর্বশীকে নিয়ে দুই যমজ দেবতা মিত্র ও বরুণের একটা ঝগড়ার মতোই হয়ে গেল। রামায়ণে দেখা যাচ্ছে, ঊর্বশী বরুণালয় সাগরে এসে সখীদের সঙ্গে জলক্রীড়া করছিলেন। সাগর তো বরুণ- দেবতারই ঘর-বাড়ি এবং সেখানে মিত্র-দেবও আছেন। যাই হোক, জলক্রীড়ার কালে সিক্তবসনা ঊর্বশীকে দেখে বরুণ এতটাই উত্তেজিত হলেন যে, তিনি ঊর্বশীকেই প্রার্থনা করে বসলেন, বরুণো বরয়ামাস মৈথুনায়ান্সরোবরাম্। বরুণের এমন স্পষ্ট আকুতি শুনে ঊর্বশী সবিনয়ে বললেন, দেবতাদের রাজা, আমার আজকে কিছু সমস্যা আছে। আপনারই অন্যতর, মিত্রদেব আগেই আমার কাছে এই প্রার্থনা করে। রেখেছেন, মিত্রেণাহং বৃতা সাক্ষাৎ পূর্বমেব সুরেশ্বর।
কথাটা শুনে বরুণ বললেন, তোমাকে দেখার পর থেকে আমার যে চরম অবস্থা তৈরি হয়েছে, তাতে এখন তুমি মিলনে অস্বীকৃত হলেও আমি আমার তেজ ধারণ করতে পারব না। এই দেবনির্মিত জলকুম্ভে আমি এই তেজোবীর্য মোচন করছি এবং ভাবছি তোমার সঙ্গেই এই মিলন সম্পূর্ণ হল— কুম্ভে’স্মিন্ দেব নির্মিতে। এবমুৎসৃজ্য সুশ্রোণি ত্বয্যহং বরবর্ণিনি। বরুণের কথা শুনে ঊর্বশী বললেন, তবে তাই হোক। কেননা আমার হৃদয় তোমার কাছেই পড়ে আছে, আমার এই শরীরটা আজ মিত্রদেবের অধিকারে থাকলেও আমার হৃদয়-ভাব তোমার জন্যই উৎসুক হয়ে আছে— ভাবশ্চাপ্যধিকং তুভ্যং দেহো মিত্রস্য তু প্রভো। উর্বশীর এই কথা শোনার পরেই বরুণদেবের তেজোবীর্য স্খলিত হল সেই জলকুম্ভের মধ্যে।
ওদিকে ঊর্বশীর হৃদয়-ভাব অন্যত্র আহিত দেখে মিত্রদেব ঊর্বশীকে দারুণ এক অভিশাপ দিলেন বটে, কিন্তু ঊর্বশীকে দেখে তাঁরও ধৈর্য যে পূর্বেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তার প্রমাণ ওই রামায়ণেই আছে। তিনি বরুণের প্রস্তাবনার আগেই ঊর্বশীর শরীরের অধিকার প্রার্থনা করেছিলেন বটে, কিন্তু সিক্তবসনা এই অনুপমা রমণীকে দেখে মিত্রদেবেরও যে পূর্বেই তেজ স্খলিত হয়েছিল এবং তা নিক্ষিপ্ত হয়েছিল সেই কুম্ভ-কুণ্ডে, সেটা প্রমাণ হয় রামায়ণ থেকেই— তদ্ধি তেজস্ত মিত্রস্য ঊর্বশ্যা পূর্বমাহিতম্। আরও একটা প্রমাণ হল, সেই কুম্ভ-গর্ভ থেকে প্রথমে জন্মেছিলেন অগস্ত্য মুনি এবং তারপর জন্মালেন মহামুনি বশিষ্ঠ।…..
……রামায়ণে বর্ণিত এই অংশে একটু সমস্যা আছে। আসলে একই সময়ের একটু এদিক-ওদিকে জন্মালেও অগস্ত্য- মুনিকেই কিন্তু কুম্ভযোনি’ কিংবা ‘কুম্ভজন্মা’ বলে আখ্যাত করা হয়, বশিষ্ঠকে কিন্তু তাঁর অপর নাম হিসেবে ‘কুম্ভযোনি’ বলা হয় না। অথচ কুম্ভ কিন্তু একটা ব্যাপার। সেকালে এরকম ঘটনা ঘটত। মুনি-ঋষিরা অনেকেই প্রচুর ইন্দ্রিয় সংযম করতে করতে শুষ্ক-রুক্ষ হয়ে গেলেও স্বর্গসুন্দরী অপ্সরাদের ললিত বিভঙ্গ দেখে স্থির থাকতে পারতেন না। অপ্সরাদের স্বর্গের বারাঙ্গনা বলেছেন অমরসিংহ কোষকার। মুনি-ঋষিরা, যাঁরা সংসার জীবনে আসক্ত হতেন, তাঁদের অনেকেরই ক্ষণিক রতিমুক্তি ঘটেছে অপ্সরাদের সঙ্গরঙ্গে। এখানে অবশ্য অন্য প্রশ্ন ওঠে এবং সেটা সংগতিহীন অলৌকিকতার প্রশ্ন। নিতান্ত লৌকিক দৃষ্টিতে স্ত্রী-পুরুষের মিলন ব্যতীতই একটি পুত্রের আধান বৃদ্ধি ঘটছে, এটা স্বাভাবিক নয়। অতএব এটাই আমাদের বুঝতে হবে যে, অপ্সরা ঊর্বশীই এখানে গর্ভাধানের আধার। শব্দপ্রমাণে এটাও বোঝা দরকার যে, ‘কুম্ভ’, ‘ঘট’, ‘কলস’ ইত্যাদি শব্দ গণিকাদের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হয়েছে অনেক সময়েই যেমন কুম্ভদাসী মানেই বারাঙ্গনা, আর মহাকাব্য- পুরাণের এমন অভিসন্ধি অনেক সময়েই দেখেছি যে, স্বাভাবিক স্বামী-স্ত্রীর মিলন ভিন্ন অন্য অনামিকা রমণীর নামোচ্চারণ না করে যখনই সন্তানোপত্তি ঘটেছে তখনই ‘কলস’, ‘কুম্ভ’, ‘দ্রোণ’ ইত্যাদি শব্দের প্রয়োগ ঘটেছে। এইভাবে অগস্ত্য ঋষিকে কুম্ভজন্মা বলা হয়, এমনকী কলস- জন্মা বলেও তিনি খ্যাত। আমাদের ধারণা, এই কুম্ভ, কলস আসলে অপ্সরার গর্ভ। আর কুম্ভ-কলসে জল থাকে, স্ত্রী- গর্ভেও সন্তান ধারণের ক্ষেত্রে জলের ভূমিকা আছে। তাতেই মনে হয় অপ্সরা ঊর্বশীর গর্ভ থেকেই অগস্ত্যের জন্ম। কিন্তু বশিষ্ঠ বোধ হয় এমন কুম্ভজন্মা নন।……