আপনি এত সুন্দর, এ-ত সুন্দর যে, চোখ ফেরাতে পারি না; শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে, সুযোগ থাকলে সারা দিনরাত শুধু তাকিয়েই থাকতাম। আর কিছু না, শুধুই তাকিয়ে থাকা, শুধু দু’চোখ ভরে ওই মাধুর্যভরা রূপ দেখে নেয়া টেলিফোনের ওপার থেকে ভেসে আসা শব্দগুলো রূপার সময়জ্ঞান ভুলিয়ে দেয়। ওপাশে কথার স্রোত থামে না, কিন্তু তার কানে যেন ভেসে আসে পুরনো দিনের গান- সেই একইরকম শব্দগুচ্ছ, একইরকম বাক্যবিন্যাস, একই বাচনভঙ্গি! একসময় প্রায় দেড় যুগ আগে- এইসব কথা নিয়মিতই শুনতে পেতো সে। তারপর দীর্ঘ এক বিরতির পর আবার নতুন করে, অন্য আরেকজনের কাছ থেকে! কিন্তু এতটা সময় পেরিয়ে গেছে, তখনকার যুবকেরা এখন প্রৌঢ়, আর এখনকার যুবকরা তখন কিশোর ছিলো, তবু স্তুতির এই শব্দবিন্যাস কি একই রকম রয়ে গেছে? তার বিস্ময় বোধ হলো। বিস্ময়টা শুধু ভাষা ব্যবহারের এই ধরন-ধারণ দেখেই নয়, বরং শব্দ ও বাক্যগুলো যে তার জন্য প্রয়োগ হচ্ছে- সেটা দেখেও। সে তো ভেবেছিল, তার জীবন থেকে অনেক আগেই ওই পর্ব ধুয়ে-মুছে গেছে; এতদিন পর আবার কেন এই যন্ত্রণা এসে হাজির হলো তার জীবনে? যন্ত্রণা? হ্যাঁ, যন্ত্রণাই তো! এ এক চক্র, যা থেকে বেরুনো কঠিন। রূপা বেরিয়ে এসেছে, নিজেকে স্থির করে এনেছে, মন দিয়েছে সংসারে অনেকদিন আগেই নতুন করে আর এই চক্রে পড়তে চায় না সে! কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, কথাগুলো শুনতে ভালো লাগছে তার! কেন লাগছে? সে কি তবে অবচেতন মনে এখনও এসব শোনার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে? তার যৌবনে, আরো নির্দিষ্ট করে বললে, যৌবনের একেবারে শুরু থেকেই সে কেবল এইরকম স্তুতিতে ভুলে গিয়ে একাধিক পুরুষের শয্যাসঙ্গী হয়েছে। তখন বয়সটা ছিলো আবেগের, আর তার ছিলো তীব্র পুরুষসঙ্গ- আকাঙ্ক্ষা। পুরুষরা সেটা সহজেই বুঝে যেত। কিংবা কে জানে, পুরুষদের স্বভাবই হয়তো এইভাবে ভুলিয়ে ভালিয়ে মেয়েদেরকে বিছানায় নেয়া, তারপর রূপ-রস-গন্ধ পান করে একসময় কেটে পড়া। অন্তত তার জীবনে তেমনটিই ঘটেছিল। রূপা নিজের কাছে সরলভাবেই স্বীকার করে শরীরী আকর্ষণ, শরীরের তৃষ্ণা তার ভেতরেও প্রবলভাবেই ছিল। সম্পর্কগুলোকে । উপভোগও করেছে সবসময়। কিন্তু এ-ও ঠিক, ভাঙার জন্য সে সম্পর্ক গড়তো না। প্রতিটি সম্পর্কে জড়ানোর আগে সে প্রেমে পড়তো, পুরুষটিকে নিয়ে সুদূরপ্রসারী স্বপ্ন দেখতো, ঘর-সংসার, জীবন-যাপন ইত্যাদি; কিন্তু সে বুঝতে পারতো না যে, তার কাঙ্ক্ষিত পুরুষটি মোটেই তেমনটি ভাবছে না- তার কাছে কেবলই গুরুত্ব পাচ্ছে রূপার শরীর, ভরা যৌবনবতী শরীর। এরকম ঘটনা একবার ঘটলেই তো মানুষ সাবধান হয়ে যায়, অথচ সে বারবার জড়িয়ে পড়তো, জটিল এক কারণে। বিষয়টি শুধু শরীরী আকর্ষণের জন্য ঘটেনি, সবার সঙ্গে সে জড়াতোও না, জড়াতো কেবল সেলিব্রেটিদের সঙ্গে, তাদের সঙ্গেই সম্পর্ক গড়ে তুলতো, কারণ, তার ছিলো দুর্দমনীয় তারকাপ্রীতি। অবশ্য সম্পর্ক গড়ার ব্যাপারটা যেহেতু একতরফা নয়, দায়টাও তাই তার একার নয়। সে হয়তো সাহস করে কেবল তার মুগ্ধতার কথাটুকু জানাতো কাউকে, আর তারপরই ওই নক্ষত্রগণ নানা কথায় নানা ঢঙে তাকে ভুলিয়ে-পটিয়ে বিছানায় নিয়ে যেত। সে আকাঙ্ক্ষা করতো প্রেমের, দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কের যৌথ জীবন-যাপনের, আর তারকারা ভালোবাসতো শয্যা । শরীর। তারকাদের প্রতি কেন এমন তীব্র মোহ ছিলো রূপার বোঝা কঠিন। তার নিজের কমতি ছিলো না কিছুরই; ছিলো রূপ, গুণ ও নয়নাভিরাম যৌবন। গান গাইতে পারতো সে, কিছুদিন নাচও শিখেছিল, মঞ্চে অখ্যাত নাট্যদলে ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগও ঘটেছিল— কিন্তু কোনোভাবেই স্টার হয়ে উঠতে পারেনি রূপা। যে সময়ের গল্প এটা, তখন তারকা হয়ে ওঠা এত সহজ ছিলো না। এত বেশি টেলিভিশন চ্যানেল ছিলো না; ইচ্ছে করলেই একটু ধরাধরি করে, দু- একজন লুচ্চা ধরনের পরিচালক-প্রযোজকের সঙ্গে রঙঢঙ করে কোনোরকম যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করা এবং টেলিভিশনের কল্যাণে নিজেকে দেশজুড়ে পরিচিত করে তোলার তেমন কোনো সুযোগ ছিলো না তখন। একটা মাত্র টিভি চ্যানেল, তা-ও সরকার নিয়ন্ত্রিত, সেখানে আবার বাঘা বাঘা সব প্রযোজকরা নাটক পরিচালনা করতেন, অডিশনে পাশ করে সেইসব প্রযোজকদের চোখে পড়া ছিলো নিতান্তই ভাগ্যের ব্যাপার। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে, এমনকি একটা-দুটো নাটকে অভিনয় করেও কেউ-কেউ তারকা হয়ে যেত। রূপার ভাগ্যে সেটা জোটেনি। হয়তো সেজন্যই, অর্থাৎ, নিজে তারকা হতে পেরে, তারকাদের প্রতি এক তীব্র মোহ কাজ করতো তার ইচ্ছে হতো তাদের জীবন- সঙ্গী হওয়ার, কিন্তু কেউই তাকে ওই পর্যন্ত নিয়ে যায়নি। অভিনেতা, সঙ্গীতশিল্পী, চলচ্চিত্র পরিচালক, সাংবাদিক ও সম্পাদক- সব ধরনের তারকাদের সঙ্গেই তার সম্পর্ক হয়েছে, তবে সেটা কেবলই বিছানার, এর বাইরে আর কিছু ভাবতে চায়নি কেউ। যদিও সম্পর্কগুলো উপভোগ্য ছিল খুব, কারণ, তখন নক্ষত্রগণ থাকতেন প্রেমময় কথায় ভরপুর, মিষ্টি-মধুর কথার ফুলঝুরি সে উপহার পেয়েছে সে সবার কাছ থেকেই, শরীরী সম্পর্কগুলোকেও তারা ভরে দিতেন কানায় কানায় পূর্ণ করে। তবু একের পর এক মন- ভাঙা অভিজ্ঞতা অর্জন করতে করতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। কারণ, সম্পর্ক ভাঙার সময় ওই নক্ষত্ররাই হয়ে উঠতেন অতিমাত্রায় নিষ্ঠুর; প্রায় ব্যবহৃত টয়লেট পেপারের মতো সম্পর্কিত মানুষটিকেও ছুঁড়ে ফেলে দিতে এতটুকু দ্বিধা করতেন না তারা। এইরকম এক ক্লান্তিকর-বিমর্ষ সময়ে এক বন্ধুর মাধ্যমে তার পরিচয় ঘটে দেশের এক খ্যাতিমান লেখকের সঙ্গে। খ্যাতিমান বলাটা কি ভুল হলো? রূপার সঙ্গে পরিচয় ঘটার সময়ে তার খ্যাতি পড়তির দিকে, লেখালেখিতে দীর্ঘদিনের বিরতি তাকে খানিকটা লোকচক্ষুর আড়ালে নিয়ে গেছে বা তিনি নিজেই আড়ালে থাকতে চাইছেন। সহযাত্রী লেখকদের সঙ্গে আড্ডাবাজি, বন্ধুদের সঙ্গ, এবং লেখালেখি সব ছেড়ে তিনি ততোদিনে পুরোমাত্রায় চাকরিজীবী, একটি নামজাদা প্রতিষ্ঠানে উঁচুপদে অধিষ্ঠিত সেই হিসেবে তিনিও তারকা, বড়োমাপের তারকাই, এক নামেই তাঁকে সকলে চেনে। কিন্তু মুশকিল হলো বয়স নিয়ে। লেখক সাহেব তখন মধ্য চল্লিশে, আর রূপার বয়স পঁচিশ ছাড়ায়নি। প্রায় কুড়ি বছরের ব্যবধান। বিবাহিত তিনি, সন্তানের জনকও, তবে তার অনিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে গেছেন! সেই জীবনে যেমন ধুন্ধুমার আড্ডাবাজি ছিল, তেমনি ছিল আরো হাজারটা বদগুণ। জুয়ার নেশা, মদ্যপান আর নারীলোলুপতা। এ-সবকিছুতে সময় দিয়ে তাঁর বাদবাকি সময়টা কাটতো লেখার ঘোরে। স্ত্রী শেষেরটি মানতে রাজি থাকলেও আগেরগুলোর মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি সইতে পারেননি। স্ত্রী তাঁকে ছেড়ে যাওয়ার পরই লেখক সাহেবের বোধোদয় ঘটে। বিয়ে-বিচ্ছেদের নোটিশ পেয়ে তিনি এমন এক বিমূঢ় অনুভূতির মুখোমুখি হন যে, সবকিছুকেই তুচ্ছ-অকিঞ্চিৎকর-অর্থহীন মনে হতে থাকে। আর এর প্রধান কারণ— স্ত্রী চলে গেছেন একা, তাদের শিশু সন্তানটিকে রেখে গেছেন তারই জিম্মায়। এই শিশুটিকে নিয়ে তিনি কী করবেন, ভেবেই পাচ্ছিলেন না! উপায়ন্তর না দেখে এক এক করে তিনি সব ছেড়ে দেন- আড্ডাবাজি, বন্ধুসঙ্গ, নারীলিপ্সা, মদ্যপান ও জুয়াখেলা। এসবকিছুর সঙ্গে ঝরে পড়ে তার লেখালেখির ঘোরও। এরপর দীর্ঘদিন তিনি আর লেখেননি। কিন্তু তাতে কার কী যায় আসে? মাঠ কখনো খালি থাকে না, দখল হয়ে যায়। তাঁর তুলনায় বয়সে নবীনরা তাঁর জায়গা দখল করে নেয়। যিনি হতে পারতেন দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক, যার লেখায় ছিল জনপ্রিয় হওয়ার সকল উপাদান এবং একইসঙ্গে জীবনের গূঢ়তর রহস্য অনুসন্ধানের চেষ্টা, তিনিই চলে গেলেন বিস্মৃতির অতলে। জনপ্রিয়তা পেলেন অন্য লেখকরা। এরকম একটি সংকটময় মুহূর্তে রূপা হাজির হয় তাঁর জীবনে, আর তাঁর প্রেমিকসত্ত্বা বহুদিন পর আবার জেগে ওঠে এই অপরূপার সান্নিধ্যে। কথার ফুলঝুরি ফোটে তাঁর কণ্ঠেও, আর রূপার মনে হয় আগের প্রেমগুলোর মতো এটারও একই পরিণতি হতে চলেছে! কিন্তু এবার রূপার বোঝাপড়ায় একটু ভুল ছিল, কারণ হারানোর আশংকা রূপার চেয়ে লেখক সাহেবের ভেতরেই বেশি ছিল। আর তাই তিনি অতিদ্রুত বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসেন। রূপা বয়স নিয়ে একটু দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগলেও রাজি হয়ে যায়! তার আসলে আর ভেসে বেড়াতে ভাল লাগছিল না! মানুষকে এক জায়গায় নোঙর ফেলতেই হয়- এমনকি ভুল ঘাটে হলেও সারাজীবন ধরে কারো পক্ষেই ভেসে বেড়ানো সম্ভব হয় না। আর তাছাড়া গত কয়েক বছরেই সে সঞ্চয় করে ফেলেছিল কয়েক জীবনের অভিজ্ঞতা, এত অভিজ্ঞতার ভারে হয়ে উঠেছিল ক্লান্ত, বিমর্ষ, দিকচিহ্নহীন নাবিক। সে তাই নোঙরটা লেখকের ঘাটেই ফেলতে রাজি হয়ে যায়! এবং সে সুখী হয়! পোড় খেয়ে লেখকও ততোদিনে অনেক স্থির ও দায়িত্বশীল, রূপাও তা-ই। বিয়ের পর প্রথমেই রূপা তার লেখক স্বামীকে ফিরিয়ে আনে তাঁর লেখালেখির জগতে। প্রায় সারাক্ষণ লেগে থেকে সে লেখককে লেখার টেবিলে বসায় এবং দীর্ঘদিনের অনভ্যস্ততায় একটু সময় লাগলেও লেখক আবার ফিরে আসেন তাঁর ঘোরলাগা সাহিত্য রচনায়। সেসব দেড়- দশক আগের কথা। তারপর কতোকিছু বদলে গেছে! রূপা নিজে মা হয়েছে, বয়স বেড়েছে, যৌবনের তীব্র উন্মাদনাময় শরীরী আকাঙ্ক্ষাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পেরেছে। যদিও কাজটি কঠিন কিন্তু লেখক সাহেবও তো বুড়ো হচ্ছেন, তিনি আর কতটুকুই সক্ষম এই তীব্র আকাঙ্ক্ষা মেটাতে? রূপা তাই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করাটাকেই সঠিক পন্থা বলে মনে করেছে। না, শরীর নিয়ে তার এমন কোনো ছুঁৎমার্গ ছিলো না কখনো। শরীরকে এমন কোনো মহার্ঘ্য বস্তু বলেও মনে হতো না তার যে, সবার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে হবে; আবার এমন তুচ্ছও মনে করতো না যে, সবার কাছেই সহজলভ্য করে তুলবে। সে বহুজনের শয্যাসঙ্গী হয়েছে বটে, তবু নিজেকে তার কখনো বহুগামী মনে হয়নি। কারণ, কখনোই একসঙ্গে একাধিক সম্পর্কে জড়ায়নি সে; বরং একটি সম্পর্কের মৃত্যুর পরই কেবল আরেকটি সম্পর্ক খুঁজে ফিরেছে। আগেরগুলো বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়নি, এটা যেহেতু গড়িয়েছে, সে তাই- অতৃপ্তি থাকা সত্ত্বেও আর কোনো সম্পর্কে জড়াবার ভাবনাকে মনে আসন গেড়ে বসতে দেয়নি। কিন্তু এই এতদিন পর এটা কি হচ্ছে? এই তরুণ, এই সময়ের এক সম্ভাবনাময় লেখক, কেন তাকে আবার সেই ফাঁদে ফেলতে চাইছে? তরুণটির সঙ্গে পরিচয়টি হলো স্বামীর সূত্রেই, নিজের বাসায়। অনুজ লেখক হিসেবে সে তার অগ্রজ লেখকের সাক্ষাৎকার নিতে এসেছিল। তার কাজের ধরনটি একটু ভিন্ন। কয়েকটি গৎবাঁধা প্রশ্ন করেই সে থেমে যায়নি বোঝাই যায়, প্রচুর প্রস্তুতি নিয়েই সে ইন্টারভিউ করতে এসেছে এবং সেটি একদিনে শেষও হয় না। লেখক সাহেব এই সৃজনশীল তরুণ লেখকের সঙ্গে কথা বলে গভীর আনন্দ পান, নিজের অর্গল খুলে অপকটে সব কথা বলতে থাকেন এবং রূপাকে ডেকে উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে পরিচয় করিয়ে দেন। তরুণটি সহজ ভঙ্গিতে রূপার সঙ্গেও প্রচুর কথা বলে, অনেক কিছু জানতে চায় এবং তার মুগ্ধ দৃষ্টি রূপার চোখ এড়ায় না। পরপর তিন-চারদিনের যাওয়া-আসাতেই, তাদের দুজনের সঙ্গেই, তরুণটির একটা চমৎকার সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং ইন্টারভিউ পর্ব শেষ হলেও তার জন্য এই বাসার দরজা তাই অবারিতই থেকে যায়। লেখক সাহেবের সঙ্গে গল্প করার ছলে প্রায় নিয়ম করেই আসতে থাকে তরুণটি, কিন্তু তার চোখ যে সদাসর্বদা রূপাকেই খুঁজে বেড়ায় সেটা বুঝে নিতে রূপার এতটুকু কষ্ট হয় না। একদিন সরল ভঙ্গিতে তরুণটি তার সেলফোন নম্বরটি চেয়ে নেয়, রূপাও দিতে দ্বিধাবোধ করে না আর তারপরই শুরু হয় তরুণটির প্রেমময় কথামালা। কথা তো নয় যেন কবিতার ঘোর, সঙ্গীতের অপূর্ব সুরমূর্ছনা! রূপা শুনতে চায় না এসব, আবার ফেরাতেও পারে না। নিজেকে বরং কথার সৌন্দর্যে তার মন ক্রমশ কোমল আচ্ছন্নতায় ছেঁয়ে যেতে থাকে; এই সর্বনাশা ফাঁদ থেকে নিজেকে ফেরানোর তীব্র ইচ্ছেটিও যেন আকুলতায় ভরে ওঠে। তরুণের স্তুতির জবাবে সে বলে- বলো না, এভাবে বলো না। অনেক তো হয়েছে, আর কিছু না-ই বা হোক । নতুন কিছুর যন্ত্রণা সইতে পারবো না। জানোই তো সব। অনেক পথ ঘুরে আমি অবশেষে এই বুড়োর কাছেই থিতু হয়েছি। কেউ যা পারেনি, বুড়োটা তা পেরেছে। আমাকে স্থিরতা দিয়েছে, ঘর দিয়েছে, সন্তান ও সংসার দিয়েছে। এইসব নিয়ে বেশ আছি। বুঝতেও পারিনি, কখন এতটা সময় চলে গেছে। পনের বছর মন্ত্রমুগ্ধের মতো কেটে গেছে। এখন বেলা পড়ে আসছে। এখন আর এসব কথা বলো না। আর ডেকো না আমাকে। ডাকলে এখনও যে আমার বুক কাঁপে! কেন বলবো না?- তরুণটি জেদী ভঙ্গিতে বলে- আমি আমার ভালোলাগার কথাটুকুও বলতে পারবো না? আমি তো আপনার কাছে কিছু চাইনি। শুধু তাকিয়ে থাকতে চেয়েছি। এটুকুও পারবো না? বলো না, অমনভাবে বলো না। আমি বলবোই। বলবো- আপনার জন্য আমার মন কেমন করে। বলবো সারাক্ষণ ধরে আপনাকে আমার দেখতে ইচ্ছে করে, কারণ এত সুন্দর এত আকর্ষণীয় মানুষ আমি আর কখনো দেখিনি। বলবো…বলো না বলো না…’না, না’ বললেও রূপা টের পায় কথাগুলো শুনতে তার ভালো লাগছে, বুকের ভেতর প্রথম যৌবনের কাঁপন টের পাওয়া যাচ্ছে! মনে হচ্ছে- এখনও ফুরিয়ে যাইনি আমি, এখনও কারো না কারো কাছে আমি কাঙ্ক্ষিত রমণীই রয়ে গেছি। তার আনন্দ বোধ হয় সঙ্গে বিস্ময়ও। তরুণটি বয়সে অন্তত তার বছর দশেকের ছোট। সে কেন তবে তার মতো চল্লিশ-ছোঁয়া নারীর প্রেমে বুঁদ হয়ে আছে? কিংবা যদি প্রেম না-ও হয় এটা, যদি কেবল শরীরের আকর্ষণই হয়ে থাকে, সেটাই বা কেন? তার কি সেই তীব্র যৌবন আর আছে, সেই কানায় কানায় ভরা শরীর? কী দেখে ছেলেটি এমন পাগল হলো? এরকম অবশ্য হয় কারো কারো ক্ষেত্রে, জানে সে- বয়সে বড়ো নারীদের প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধ করে কোনো কোনো যুবক। ঈদিপাস কমপ্লেক্সে! কেন যে এই আকর্ষণের নাম ঈদিপাস কমপ্লেক্স, কে জানে! ঈদিপাস তো নিয়তিতাড়িত, নিজের অজান্তেই সে সম্পর্কিত হয়েছিল তারই জন্মদাত্রীর সঙ্গে। এটা তো সেরকম কিছু নয়! জেনেশুনে একজন বয়স্ক নারীর প্রেমে পড়ছে একজন তরুণ। কেন পড়ছে? সে ভেবে পায় না। মুখে সে ‘না, না’ বলতে থাকে, কিন্তু তরুণটির বিরামহীন স্তুতিগাথা তার ভেতরটাকে তছনছ করে ফেলে। টের পায়, সে প্রেমে পড়েছে, তবে এই প্রেমটি আগের কোনো প্রেমের মতোই নয়। অন্য সবগুলোতে তার নিজের অনেক কিছু চাওয়ার ছিল, কিন্তু এই তরুণের কাছে তার কিছু চাওয়ার নেই, বরং হয়তো কিছু দেয়ার আছে। তারপর একদিন, ততদিনে লেখক সাহেবেরে অনুপস্থিতির সুযোগে তরুণের যাওয়া-আসা প্রায় নিয়মে পরিণত হয়েছে, যুবকটি তার হাত ধরে কাছে টানে। রূপা বাধা দিতে চেয়েও পারে না, বরং কী এক অমোঘ আকর্ষণে যুবকের বুকে আশ্রয় নেয় সে। যুবকটি যখন তার ঠোঁট-চিবুক-গাল-কপাল চুম্বনে জর্জরিত করে ক্রমশ নিচের দিকে নামতে থাকে, সরিয়ে দেয় বুকের আঁচল, হাতে তুলে নেয় স্তন, ঠোঁট ছোঁয়ায় বুকে, তারপর আরো নিচে ক্রমশ গভীর থেকে গভীরে, তখন তার চোখে অবিরল জলের ধারা নামে, ‘না, না’ বলতে বলতেই সে তীব্রভাবে জড়িয়ে রাখে তরুণটিকে নিজের শরীরের সঙ্গে, তারপর গভীর আবেশ আবেগে যুবককে নিজের ভেতরে প্রবেশের সুযোগ করে দেয়।
অনেকদিন পর তার শরীরের এই জেগে ওঠা তাকে বিমূঢ় করে দেয়, সে অনুভব করে ওঠে- আবারও এক অপ্রতিরোধ্য জটিল প্রেম তার মনকে ছেয়ে ফেলেছে, সে তাই তার শরীরটিকেই উপহার হিসেবে উপস্থাপন করেছে তার তরুণতম প্রেমিকের কাছে। আর রাত গভীর হলে, বুড়ো লেখক যখন গিয়ে বসেছেন তাঁর অসমাপ্ত লেখার ডাকে, মিউজিক সিস্টেমে একটানা বেজে চলেছে তাঁর প্রিয় গান, রবীন্দ্রনাথের প্রেম এসেছিল নিঃশব্দচরণে, তাই স্বপ্ন মনে হলো তার, দিই নি তাহারে আসন- তখন, লেখার টেবিলে বসা ঘোরগ্রস্ত লোকটিকে দেখতে দেখতে আর গানটি শুনতে শুনতে রূপার ঠোঁটে মৃদু-রহস্যময় হাসি ফুটে ওঠে না, তার প্রেম নিঃশব্দচরণে আসেনি, এসেছে সশব্দে সচকিত করে, আর সে-ও তার শরীরটিকেই দিয়েছে আসন পেতে বসবার জন্য; কোনো অনুতাপ নেই তার, নেই কোনো বেদনাবোধ বরং এক মধুর আবেশে তার অনুভূতিটি যেন রবীন্দ্রনাথকেও হার মানিয়ে দিচ্ছে এই মুহূর্তে।