প্রথম চুম্বন হয় পুণ্য, প্রথম চুম্বন হয় পাপ। প্রতিটি চুম্বনই প্রথম চুম্বন অথচ গভীরে ও প্রকৃত কিন্তু প্রথম নয়। সুরাসুরে ভাসমান ও টলমল আমার মাথার ভেতরে রমণীর ঠোট যেন এক রক্তিম নৌকা-উলটো দিক থেকে দেখছি-পানিতে তার নিখুঁত প্রতিবিম্ব রচিত হয়ে একজোড়া হয়ে আছে। সন্ধ্যে থেকে আমরা বসে আছি বাংলাের বারান্দায়। বড়া সাব কা বাংলা। বান্টি এখানে বড় সাহেব-ম্যানেজার। বই, সুরা এবং একাকিত্ব তার প্রিয় এবং একমাত্র সঙ্গী। সন্ধ্যা থেকে আমরা সুরা পান করছি। বান্টি বলে, আজ বাগানে কিছু চুরি হবে।
অমাবস্যার রাত আজ কিন্তু বান্টির কণ্ঠে চুরির জন্যে কোনাে উদ্বেগ লক্ষ্য করি না, যেনবা সে স্বগতােক্তি করেছে। মাথার ভেতর থেকে আমি রমণীর ঠোট মুছে ফেলতে পারি না। বান্টি ফরাসি সেই কবিতার পংক্তিগুলাে আবৃত্তি করছিল, তােমাকে দেখলেই আমার মনে পড়ে যায় জাতীয় পতাকার কথা। তােমার চোখের নীল, দাঁতের শাদা, ঠোটের লাল। ফরাসি পতাকায় আছে ঐ তিনটে রঙ। আমি গেলাশে চুমুক দেই। একেক সময় একেকটা ছবি হঠাৎ পেয়ে বসে। এখন ঠোটের ছবি। গেলাশে তরল সােনার মতাে সুরা। গেলাশে ছোঁয়ানাে আমার এই ঠোট যেন চুম্বন করছে। কতকাল আমি চুম্বনরহিত, কতকাল আমি অচুম্বিত। আমাদের সমুখে একটি রাত তার গাঢ় অন্ধকার নিয়ে পায়ে পায়ে নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে। আমি পরিস্কার শুনতে পাচ্ছি কোনাে মানুষ কিম্বা প্রাণী নয়, রাতের পায়ের শব্দ। রাতের পায়ের শব্দ শুনতে হলে সিলেটে আসতে হবে, আসতে হবে চা বাগানে। একদিন হঠাৎ এমনি এক ভ্রমণে খুঁজে পাই বান্টিকে। তারপর থেকে মাঝেমাঝেই আমি তার কাছে আসি । আমি বিয়ে করেছিলাম, এক বছরের মাথায় কাকলী আমাকে ছেড়ে চলে যায়। ও, না, না-সে জগত ছেড়ে চলে যায় না, সে আমাকে ছেড়ে অন্য কারাে কাছে চলে যায়। আর আমি আবিষ্কার করি, বান্টি এখনাে বিয়েই করেনি। সন্ধে থেকে বান্টি কবিতা আবৃত্তি করছিল। অসাধারণ তার স্মৃতি। ইংরেজি কবিতা, অন্য ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনূদিত কবিতা, এমন কি রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত ইংরেজি অনুবাদে বান্টির কণ্ঠে-কারণ, সে বাংলা কখনাে পড়েনি। ইহা হয় আমার জীবনের এক ট্রাজেডি যে, আমি বাঙালি কিন্তু আমার পিতা আমাকে বাংলা শিখাইল না। ইংরেজি পড়েছে ইংরেজের কাছে নয়, তাই নির্ভুল ইংরেজি বলতে পারলেও তার উচ্চারণ ইংরেজের মতাে নয়।
কলকাতা থেকে সাতচল্লিশ সালে যখন এসেছিল, ঢাকায় আমরা তাকে পাই ক্লাস নাইনে, সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে সে বিশেষ ব্যবস্থায় ইংরেজিতেই সব বিষয়ে পড়তে এবং পরীক্ষা দিত। আজ সন্ধ্যা থেকে বান্টি আবৃত্তি করছে প্রেমের কবিতা, দেহস্পর্শের কবিতা, চুম্বনের কবিতা। আমি এখন অনেকগুলাে দরােজা দেখতে পাচ্ছি এই অন্ধকারের ভেতরে এবং যে কোনাে দরােজাই খুলছি-আমি স্তম্ভিত এবং ঈষৎ ভীত হয়ে দেখতে পাচ্ছি চুম্বনরত একেকটি যুগলকে। রদ্যা-র ভাস্কর্যের মতাে তারা একে অপরকে দৃশ্যত লঘু কিন্তু রক্তের ভেতরে কঠিন করতলে ছুঁয়ে আছে। আমি এগিয়ে যাই আরেকটি দরােজা খুলি। আরেকটি যুগলকে দেখতে পাই। রদ্যা। চুম্বন ফরাসি পতাকা। লাল, নীল, শাদা-নীল, শাদা, লাল। লাল নৌকোর নিখুঁত প্রতিবিম্ব। বান্টি আমার গেলাশ ভরতে ভরতে বলে, তুমি জানাে, মােকাম্মেল, আমি তােমাকে। সত্য বলিতেছি, ইহা তুমি সত্য বলিয়া জানিও, আমার জননী আমাকে কখনাে চুম্বন করেন নাই। কি বলিতেছ? সাধারণত আমি বাংলা ছাড়া অন্য ভাষা বান্টির সঙ্গে ব্যবহার করি না, সেই ইস্কুল জীবন থেকেই করিনি, বান্টি কিন্তু কখনাে ইংরেজি কখনাে বাংলায় কথা বলে, কখনােবা দুটোই এক বাক্যে, এক নিঃশ্বাসে মিশিয়ে- আমি এতটাই অবাক হই বান্টির এ কথা শুনে যে ইংরেজিতে বিস্ময় আমার মুখ থেকে এক আশ্চর্য স্বাভাবিকতা নিয়ে নির্গত হয়। ইহা সত্য? আমার সন্দেহ হয়, বান্টির নেশা ধরেছে। এত তাড়াতাড়ি? অসম্ভব বলেই মনে হয়। মাছের মতাে পান করতে পারে সে। সেই বান্টি এত সহজে মাতাল হয়ে যাবে? এ কেমন করে বিশ্বাস করবাে যে মা চুমাে খায়নি তার ছেলেকে? বান্টি আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসতে থাকে। হ্যা, সত্যি, আমার মা কখনাে চুমাে খায়নি আমাকে। বেয়ারা কিছু আলুভাজা এনে নিঃশব্দে আমাদের সমুখে রেখে যায়। বান্টি গেলাশ হাতে উঠে দাঁড়ায়, বারান্দার শেষ প্রান্ত পর্যন্ত হেঁটে যায়, কি দ্যাখে, চুমুক দেয় হেলােশে, দেখতেই থাকে, তারপর ফিরে আসে, এসে আর সে সােফায় বসে না, আমার সমুখে দুপা ছড়িয়ে সে দাঁড়িয়ে তাকে, দূরে ঝােলানাে পেট্রোম্যাকসের আলাে, সে আলােয় তার একটা বিশাল ছায়া ওদিকের শাদা চুনকাম করা দেয়ালে গিয়ে পড়ে। আমি কামরার পর কামরায় দেখতে পাই চুম্বনরত যুগলদের। লাল ঠোট, কালাে ঠোট, পুরু ঠোট। ঘড়ির কাঁটার ভেতরে ছােট বড় হাত দুটি যেন পুরুষ ও রমণীর হাত, ক্রমাগত তারা এক অপরকে সন্ধান করে চলেছে, মাঝে মাঝেই তারা এক হতে পারছে কিন্তু মাত্র এক মিনিটের জন্যে, আবার তারা সরে যাচ্ছে, দূরে যাচ্ছে একে অপরের কাছ থেকে। বিরহের তুলনায় মিলন কি এমনই সংক্ষিপ্ত । আমার মা কখনাে আমাকে চুমাে খায়নি। গেলাশ টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে বান্টি এক টুকরাে আলুভাজা মুখে দেয়। বলে, আজ বাগানে চুরি হবেই জানি। অমাবস্যার অন্ধকারের চা পাতা চুরি করবে ওরা। কুলিরা। আমি কিছু বলব না। আমি জানি কত গরিব ওরা।
বান্টি এতক্ষণ কথা বলছিল বাংলার ঢালু জমিনের দিকে মুখ করে, চা বাগানের দিকে তাকিয়ে, এবার আমার দিকে ফিরে বল, হ্যা, আমি জানি তুমি বিশ্বাস করছ না আমার মা কখনাে আমাকে চুমাে খায়নি। না, বান্টির পা টলছে না, আমি লক্ষ্য করি। সে মাতাল নয়। বলি, কেউ বিশ্বাস করবে, মা ছেলেকে চুমাে খায়নি? আর তুমি জানবেইবা কি করে যে খায়নি? সদ্যজাত শিশুর কি স্মৃতি থাকে? হয়ত বড় হয়ে তুমি আর দ্যাখােনি যে মা তােমাকে চুমাে খাচ্ছেন। খস করে একটা শব্দ হয়। সঙ্গে সঙ্গে বান্টি চাপাস্বরে বলে, নড়িও না। আমি শীতল হয়ে যাই। বিস্ফারিত চোখে লক্ষ্য করি, বান্টি শর্টসের পকেট থেকে রিভলবার বের করে আমার দিকে তাক করছে। দুবার ফায়ার করে সে। লম্বা সােফায় যে প্রান্তে আমি বসেছিলাম তার অপর দিকে খবরের কাগজের ওপর। একটি সাপ গুলতে ছিন্নভিন্ন হয়ে চাবুকের মতাে আছড়াচ্ছে। আমি অবিশ্বাস নিয়ে ওপরের দিকে তাকাই। বান্টি বলে, ছাদের ঐ চালের ভেতরে সাপের বাসা আছে। চেষ্টা করেও কিছু হয়নি। ভাগ্যিস তােমার গায়ের ওপর পড়েনি। বান্টি বেয়ারাকে ডাকে জায়গাটা পরিষ্কার করবার জন্যে এবং আমার দিকে ফিরে বলে, তুমি নির্বোধ নও। কেন বুঝিতে পারিতেছ না, যে, পুত্রকে জননী যে চুম্বন করে নাই, তাহা মােটেই রহস্যময় কিছু নহে। কি যে বলাে তুমি। মায়ের চুমমা আমি পাইনি কারণ আমার মা আমাকে জন্ম দেবার দুমিনিটের মধ্যে মারা যান। আমি হতভম্ব হয়ে বসে থাকি। আজ বিফ রােস্ট হয়েছে। টেবিলে মােম জ্বেলে দিয়েছে বেয়ারা। কোমল আলােয়। ডিশগুলাে অপার্থিব বলে বােধ হচ্ছে। বান্টি বলে, আমি খেতে পছন্দ করি। খুব বেশি খাব না, যতটুকু খাব সুন্দর করে খাব। খাও। বান্টির মা যে নেই-তার সঙ্গে স্কুলে একসঙ্গে পড়েও এই তথ্যটি কি করে। আমাদের অজানা থেকে গেছে আমি জানি না। আমার ঈষৎ লজ্জা হয় ।
আমি খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করি। বুঝে পাই না, বান্টির সঙ্গে কিভাবে আবার কথা শুরু করবাে। খাও। চমকার রান্না হয়েছে। আমি এক টুকরাে মাংস মুখে নিয়ে বলি । এই জঙ্গলের ভেতরে এ রকম রােস্ট-ভাবাই যায় না। বাজে বােকো না। এ রােস্ট হলাে? মনে হয়, বাঘের মাংস সেদ্ধ করে রেখেছে। উপায় নেই, এই তােমায় খেতে হবে। বান্টি, একটা কথা। আমার মনে হয় কথাটা জিগ্যেস করলে তুমি মনে কিছু করবে না।-এতদিন বিয়ে করােনি কেন? হা হা করে হেসে ওঠে বান্টি। এই কথা জিগ্যেস করতে তােমার এত উতস্তত: বিয়ে কিরিনি, মেয়ে পাইনি, তাই। মেয়ে পাওনি, তুমি, আমাকে বিশ্বাস করতে হবে? কি এক অজ্ঞাত কারণে বান্টি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যায়। আমি কি তার আহত কোনাে নাড়ি ছুঁয়ে ফেলেছি আকস্মাৎ? বরং তুমি আমাকে জিগ্যেস করতে পারতে, নারী আমার জীবনে আসিয়াছিল কিনা? তুমি প্রশ্ন করিতে পারিতে-আমার শয্যা কি রমণীমুক্ত? তুমি জানিতে চাহিতে পারিতে, আমার যৌন জীবন কিরূপ। আমি চুপ করে থাকি। আমি জানি, সন্ধ্যায় সুরা বান্টির ওপর চমৎকার কাজ করেছে, সে মাতাল নয় কিন্তু তার কথার দরােজা এবার খুলে যাবে। সে কথা বলে। তােমাদের অনেকের ধারণা, আমরা চা বাগানে কাজ করি, আমরা কুলি মেয়েদের সঙ্গে শুই? নয়? তােমাদের ধারণা, কুলি মেয়েদের সহজে পাওয়া যায়। নয়? তুমি কি মনে করাে, যে, আমি একটি পুরুষ, আমি কুলি রমণীকে ব্যবহার করি নাই? আমার শয্যায় তাহারা আসে নাই, না মৃদু মৃদু হাস্য করিও না। উত্তর দাও। আমাকে দেখিয়ে, আমার সহিত এই কয়েকদিন অতিবাহিত করিয়া, কি ধারণা হইয়াছে? আমরা বারান্দায় ফিরে আসি। রােজ রাতে খাবার শেষে বারান্দায় বসে আমরা চা খাই। বান্টি রাত দশটার ভেতরেই শুতে চলে যায়। ভাের সাড়ে পাঁচটায় উঠে তাকে কাজে যেতে হয়। বাগানের চা বাজারের চায়ের চেয়ে গাঢ় এবং ঈষৎ কষায়ও পিচ্ছল। চুপ করে আছ যে, বান্টি আমাকে খোঁচা দেয়। আমি বান্টির দিকে ফিরে তাকাই। না, খোচা নয় । বান্টিকে আমি ছেলেবেলা থেকে চিনি-অত্যন্ত কোমল হৃদয় মানুষ, এতটাই যে আমি আর দ্বিতীয় এমন কাউকে দেখেছি বলে বলতে পারব না। আমি বলি, চুপ করে আছি কেন? তুমি কি কথার কি উত্তর দিলে? আমি কেবল জিজ্ঞেস করেছিলাম, বিয়ে করােনি কেন?
‘মেয়ে পাইনি।’ ‘মেয়ে পাওনি?’ আমি আমার বিস্ময় আবার প্রকাশ করি। বান্টি বলে, মেয়ে পাইনি, কথাটা ব্যাখ্যা করা দরকার। তােমার কি স্মরণ রহিয়াছে, আমার পিতা পুলিশের বড় কর্মকর্তা ছিলেন? হ্যা, আমার মনে আছে। উনি তাে রিটায়ার করেছেন বােধহয় এতদিনে? বান্টি একটু চুপ করে থেকে বলে, তিনি দেহত্যাগ করিয়াছেন। তাঁহার স্রষ্টার নিকটে ফিরিয়া গিয়াছেন। বান্টি একটু হেসে ইংরেজিতেই বলে চলে, আশাকরি, সৃষ্টিকর্তা তাঁহাকে ক্ষমা করিবেন। এই ক্ষমা শব্দটি আমার চেতনা সুরা-বিহ্বল অবস্থায় বারবার রণিত হতে থাকে। ‘ক্ষমা?’ আমি চায়ের কাপ ঠেলে দিয়ে বলি, ক্ষমার কথা বলিতেছে এমনভাবে যেন তিনি ক্ষমা পাইবার উপযুক্ত নহেন। বান্টি বলে, পরিষ্কার বাংলায়, ‘তুমি ভুলে যাচ্ছ, আমার বাবা ছিলেন পুলিশের লােক। তুমি ভুলে গেছ, উনিশশ বাষট্টির কথা। সেই উনিশশ বাষট্টিতে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ঢাকায় প্রথম আন্দোলন হয়েছিল, মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েছিল। নবাবপুর দিয়ে বিরাট মিছিল আসছিল। তুমি কি সব ভুলে গেছ? সত্যি কথা বলতে কি, আমার কিছুই মনে পড়ে না। আইয়ুব খান মনে পড়ে, বাঙালিদের মিছিল মিটিংয়ের কথা মনে পড়ে কিন্তু বিশেষ কোনাে বছর কি বিশেষ কোনাে মিছিলের কথা মনে পড়ে না। বান্টি বলে চলে, সােফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে, বারান্দায় অশান্ত পায়চারি করতে করতে, সেই মিছিল বাধা পায় মুকুল সিনেমার কাছে। পুলিশ বাধা দেয়। আমার বাবার হুকুমে সেই মিছিলের ওপর গুল চলে। সরকারি হিসেবে বলে দুজন মারা গেছে। আমি সেইদিনই বাবাকে বলতে শুনেছি, ড্রইং রুমেতিনি সরকারি কর্মকর্তাদের বলিতেছে যে, সত্য এই হয় যে যে মােট আঠারাে ব্যক্তি আমাদের গুলােতে নিহত হইয়াছে। এই তথ্য যেন প্রকাশ না পায়। আমাদের সর্বোত চেষ্টা করিতে হইবে সত্য যেন চাপা থাকে, হ্যা লাশগুলাে কি আমরা লুকাইতে পারিয়াছি? বান্টি আমার সমুখে এসে বলে। বলে চলে, পাশের ঘর থেকে আমি সবই স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম। আমি যেন আমার বাবা নয়, অন্য কারাে কথা শুনছি। তাঁর অতিথিরা, সরকারের সেই অফিসারেরা আমার বাবাকে বলে, সমস্ত লাশ গােপন করা হয়ে গেছে। তুমি বিশ্বাস করিতে পারাে? যেন শিশুরা আলাপ করিতেছে তাহাদের খেলা বিষয়ে। যেন যাহা লইয়া আলাপ হইতেছে তাহা মানুষের পবিত্র দেহ নহে, শিশুর খেলায় ব্যবহৃত কতিপয় বল কিম্বা ব্যাট-লুকাইয়া রাখা হইয়াছে। আমি ঠিক বুঝে পাই না, বান্টির বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজে না পাওয়ার সঙ্গে এই ঘটনার যােগ কোথায়? বান্টি কি নেশার ঘােরে বক্তব্যের পারম্পর্য হারিয়ে ফেলেছে?
তুমি কি জানাে, কেন আমি চা বাগানে চাকরি নিয়েছি। জানাে? জানাে না। তবে জানাে, এই আমার আত্মহত্যা। বাবার মুখে সেদিন রাতে ঐ কথা শােনার পর আমার জন্মের ওপর ঘৃণা হয়। আহ, আমার মা। মায়ের চুম্বন হইতে আমি বঞ্চিত। হইবই বা না কেন? আমার মতাে হতভাগ্য, যাহার পিতা স্বদেশবাসীকে খুন করিল এবং লাশ গােপন করিল? যাহার পিতা এমনই এক ব্যক্তি যে পুত্রকে তাহার মাটির ভাষা না শিখাইয়া বিদেশের একটি ভাষা শিখাইল। হায়, এই হতভাগ্যের মতাে আর কে আছে?-এইরূপ আমার চিন্তা হইতে লাগিল। আমার পড়াশােনা খারাপ হইতে লাগিল। তুমি তাে স্মরণ করিতে পারিবে-শিক্ষকেরা আশা করিতেন আমি প্রথম শ্রেণী পাইব কিন্তু পরীক্ষার ফল যখন বাহির হইল, আমি দ্বিতীয় শ্রেণীর শেষ দিকে, নয়? মনে পড়ে আমি সেই রাত হইতেই ভাবিতে থাকি, মানুষের সভ্য সমাজ যদি এই হয় যে, মানুষের ন্যায্য অধিকার চাইবার অধিকারটুকু নেই এবং চাইতে গেছে তার ওপরে গুল চালানাে হয় এবং সেই গুলতে মানুষ মারা গেলে তার লাশ গােপন করা হয়-হঁ্যা, সেই মরা মানুষটির কি স্ত্রী পুত্র সন্তান ছিল না? আমি তাে আত্মহত্যা করতে পারি না। এ জীবন আমি চাই নি, এ জীবন শেষ করবার অধিকারও আমার নেই। আমি স্থির করি, আমি সভ্য সমাজ থেকে বেরিয়ে যাব। আমি চা বাগানে কাজ নেই। এই জঙ্গল, এই অসভ্য কুলি, এরাই আমার নিকট বর্তমানে বাস্তবের অধিক বাস্তব এবং তােমরা যে সমাজ ও শহরে বাস করাে, উহা আমার নিকট এক নিষিদ্ধ, দুর্বোধ্য এলাকা ভিন্ন আর কিছু নহে।। বান্টি । এসাে না, আমরা আর একটু পান করি । সুরা? না, রাতে খাবার পর আমি আর পান করি না। তুমি মনে করছ, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে এসব বলতে, সুরা পান করলে সেরে যাবে মনে ভাবছ তাে? না বন্ধু, ইহা হয় আমার হৃদয়ের এক চিরস্থায়ী পরিস্থিতি। তুমি বলছিলে, বিয়ে করিনি কেন? আমি কাকে বিয়ে করব? আমার মতাে বিকট বিদীর্ণ এক ব্যক্তিকে কে গ্রহণ করবে? যে জীবনের ভেতর আমি পতিত সেই জীবন আমি কাকে টেনে আনব? কি অধিকার আমার আছে আমারই সঙ্গে আমার দুর্ভাগ্য তাকে আমি ভাগ করে নিতে বলিব?-তাও একদিন দুদিনের জন্যে নয়, সারাজীবনের জন্যে?-আমি এখন শুতে যাচ্ছি। শুভরাত্রি। তােমার দ্রিা উত্তম হউক। বান্টি দ্রুত তার ঘরে চলে যায়। দুদিকে দুটি শােবার ঘর, মাঝখানে করিডর-সােজা চলে গেছে পেছনের বারান্দায়। ডান দিকের ঘরে বান্টি শােয়, বাঁদিকের ঘর অতিথিদের জন্যে। অতিথিদের এই ঘরে বইয়ের একটা শেলফ আছে, বহুদিন আগের কিছু ইংরেজি উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনি আর শিকারের গল্প-সেই ব্রিটিশ আমল থেকে এ ঘরেই অতিথিদের জন্য রয়ে গেছে। আমি একটা বই তুলে নিই। আজ রাতে আমার ঘুম আসবে না। যে বই আমার হাতে উঠে আসে-আফ্রিকার এক নারী প্রধান সমাজের কাহিনি।
আজ রাতে নারীর অভাব আমি বড় বােধ করে উঠি। কাকলী, আমার বৌ-না, সে আমাকে ছেড়ে চলে গেলে, সে অন্য কারাে, তাকে আর আমার বৌ বলার অধিকার নেই-জাহান্নামে যাও, কাকলী ছিল অতীব দক্ষ ও নিপুণ এক মহিলা, হ্যা শয্যায় তাহার প্রতিভা ছিল যে কোনাে প্রধান কবির তুল্য। কাকলী, কেন তুমি আমাকে ছেড়ে গেলে? কাকলী, তুমি যে আমাকে প্রথম চুমাে দিয়েছিলে, সেটা কি ছিল তােমার প্রথম চুমম? আমাদের দুজনের প্রথম চুম্বন তাে বটেই কিন্তু তােমার কি প্রথম? কিন্তু আমার সে চুমাে প্রথম চুমাে ছিল না। বান্টি আজ সন্ধ্যে বেলায় বলছিল, তার মা তাকে চুমাে দেয়নি কারণ বান্টিকে জন্ম দেবার পরপরই তার মৃত্যু হয়। আমরা আজ বিকেলে একটা মজার তর্ক করছিলাম-মানুষ কেন এতখানি জোর দেয় প্রথমের ওপর? নারীর বেলায়? পুরুষ কেন চায় তার চুম্বনই হবে প্রথম চুম্বন। তার শয়নই হবে নারীটির জন্যে প্রথম শয়ন? কি আছে এই প্রথমের গভীরে? আমার পাশের বাড়িতে বদলি হয়ে এসেছিল নতুন এক পশু ডাক্তার। তার মেয়ের নাম ছিল সন্ধ্যা। এত চঞ্চল মেয়ে আমি খুব কম দেখেছি। সারাক্ষণ এই ঘরে, এই বাইরে, এই গাছে উঠছে, এই সাঁতার কাটছে। ক্লাস নাইনে পড়ত। বুক দুটো বড় হয়ে উঠছিল তার, তাকাতে আমার লজ্জা করত কিন্তু চোখ বারেবারে চলে যেত। আমি পড়তাম এইটে। সন্ধ্যাকে তার মা ফ্রক পরিয়ে রাখতেন। আমার বাবাকে শুনেছি এক রাতে অন্ধকারে আমার মাকে আদর করতে করতে বলছেন, সন্ধ্যারে দ্যাখাে না, তার বাপমায়ে অখনতরি নাবালিকা কইরা রাখতে চায়। আরে পানি পরলে, অখনি তার প্যাট হইব । সেই কথাগুলাে আমার শােনার কথা না, উচিত না-কিন্তু আমরা সবাই, বাবা মা ভাই বােন এক ঘরে টানা বিছানায় শুতাম, না শুনে উপায় কি? তারপর থেকে আমার ভীষণ লজ্জা করত সন্ধ্যার দিকে তাকাতে। আমার এক ক্লাস ওপরে পড়ত বলে বড় উঁটি দেখাত সে আমার ওপর। ছুটির এক সুনসান দুপুরবেলা। আমের সময়। বাতাসে কাঁচামিঠে আমের ঘ্রাণ। হু হু করা বাতাস। সোঁ সোঁ করে ধুলাের ঘূর্ণি। হঠাৎ হঠাৎ। বাইরের ঘরে আমি বিছানায় উপুড় হয়ে অংক করছি। হঠাৎ দেখি আমার সমুখে একজোড়া পা-মেয়েদের পা-হাঁটু পর্যন্ত খােলা-দুলছে। চোখ তুলে দেখি-সন্ধ্যা। কাঁচা একটা আমে দাঁত দিয়ে আমার। দিকে তাকিয়ে আছে ঘন কি একটা চোখে যে আমি বুঝে উঠতে পারি না। আমার হঠাৎ প্রস্রাব পায়। খপ করে আমার হাত ধরে ফ্যালে সে। এই কোথায় পালাচ্ছিস।
সন্ধ্যা যে কখন এসে আমার ঘরে ঢুকেছে, ঢুকে টেবিলে পা ঝুলিয়ে বসে আছে, আমি । টেরও পাইনি। অংক করায় আমি এতই ডুবে ছিলাম। আমার খাতাটা কেড়ে নেয় সন্ধ্যা। বােস এখানে। অংক করছিলি? অংক? খাতা খানিক দেখে ঠোট উলটে বলে, ভুল করেছিস। গােল্লা পাবি। আমি চমকে খাতাটা নিই। দ্রুত তাকিয়ে দিখে। ইস, তাই তাে, অংকটা ভুল হয়ে গেছে। আমার লজ্জা হয়। একে সন্ধ্যার ঐ বুক, তার ওপরে ভুল অংক-আমাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। একটু পরে আমি আবার উঠে দাঁড়াই। আমার ভীষণ প্রস্রাব পেয়েছে। ধমক দেয় সন্ধ্যা। অংক ভুল করে পালানাে হচ্ছে? সন্ধ্যাকে আমি কি করে বলি যে, আমার ফেটে যাচ্ছে। যদি বাইরে না যাই তাে এক্ষুণি প্যান্টে হয়ে যাবে। সন্ধ্যা টেবিলের ঐ উচ্চতা থেকে আমার কাঁধে পা রেখে বিছানার ওপর চাপ দিয়ে বসিয়ে দিতে দিতে বলে, আগে অংক ঠিক কর, তারপর ছুটি।
আমার বাইরে যেতে হবে। আমি মরিয়া হয়ে বলি।। আগে অংক। বলেই কচাৎ করে কাঁচা আমের গা থেকে এতখানি মাংস খুবলে নেয় সন্ধ্যা। আমার শরীরের ভেতর আশ্চর্য একটা ঝিনঝিন রব বহে যায়। আমি পুতুলের মতাে দাঁড়িয়ে থাকি। সন্ধ্যার কি দয়া হয়, সে হঠাৎ তার রণরংগিনী মূর্তি ছেড়ে মায়াবতী হয়ে ওঠে। বলে, অংকটা যদি ঠিক করতে পারিস, আমি তােকে একটা চুমাে দেব। আমার কান ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে। এতদিন পরে এখনাে স্পষ্ট মনে আছে, এর পরের ছবি-আমি প্রস্রাব ভুলে গিয়েছি, আমি বিছানার ওপর উপুড় হয়ে অংক করে চলেছি, অংক কিছুতেই মিলছে না, বারবার রবার দিয়ে অংকের ভুল ধাপগুলাে মুছে ফেলছি, আবার পেনসিল চিবােতে চিবােতে অংকের সূত্রটা ভাবছি, সন্ধ্যা টেবিলে বসে পা দোলাচ্ছে তাে দোলাচ্ছে, আম খাচ্ছে কচ কচ করে, আমার অংকটা হঠাৎ মিলে যায়। সন্ধ্যা আমার দিকে স্থির তাকিয়ে থাকে। তার পা দোলানি থেমে গেছে। হাতের আম হাতে রয়ে গেছে। আমাকে দেখছে। আমাকে সে দেখছে। আমি কেবল তার বুক ছাড়া আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না-চোখ বারবার চলে যাচ্ছে। আমরা নিশ্চল ও স্তব্ধ দুজনে। হঠাৎ সন্ধ্যা লাফ দিয়ে টেবিল থেকে নেমে, আমার ওপর ছোঁ মারবার ভঙ্গিতে শরীরটা পেছনে রেখে মুখ বাড়িয়ে দেয় এবং আমার ঠোটে কুট করে কামড় বসিয়ে দেয়। তারপরে জড়িয়ে ধরে সে আমাকে, আদর করে ঠোটে নিজের ঠোট শুকনাে ঘষে দিতে দিতে বলে, একটা করে অংক রাইট করে দেখাবি, একটা করে চুমাে পাবি। আমি টের পাই আমার প্যান্টের সমুখটা ভিজে যাচ্ছে। যদিও ছাড়তে ইচ্ছে করছিল না সন্ধ্যাকে, শুধু ঐ ভেজা পাছে টের পেয়ে যায়, আমি তাকে ছেড়ে দৌড়ে বেরিয়ে যাই।
সেই আমার জীবনের প্রথম চুমাে-মায়ের নয়, খালার নয়, বড় বােনের নয়, এমন কারাে যে আমার কেউ নয়-কেউ নয় আবার সব কিছু। সেবার গরমের ছুটিতে, আমের সেই মৌসুমে, বাতাসের সেই ঘূর্ণি চড়াও দুপুরে আমি একশ আটাশখানা অংক রাইট করেছিলাম। আর কাউকে চুমাে খেয়ে মজা নেই, তােকে যত মজা। কি যে ঈর্ষায় আমি জ্বলে উঠেছিলাম-সন্ধ্যা তবে আরাে অনেককে চুমাে দেয়? কাকলী যখন আমাকে প্রথম চুমাে দেয়-না, সন্ধ্যার মতাে সে আমাকে চুমাে দেয় না, আমিই তার কাছ থেকে আদায় করে নিই-এক রাতের বেলায়, কাকলীদেরই বাড়িতে বারান্দায়, খুব দ্রুত কিন্তু এতটা দ্রুত নয় যে চুমাের স্বাদ পেতে না পেতেই দুজনে বিযুক্ত-আমি তাকে জিজ্ঞেস করি-বােধহয় অবচেতন মনে সন্ধ্যা এসে হানা দিয়ে থাকবে-আর কেউ তােমাকে চুমাে খেয়েছে এর আগে? যাহ। বলে কাকলী আমার বুকে ঢলে পরেছিল-সে ঢলে পড়েছিল সে যে তার নিজের বাড়িতে এবং যে কোনাে মুহূর্তে যে কেউ এসে পড়তে পারে সব ভুলে গিয়ে। আমি তাকে জড়িয়ে ধরে কানের লতি কামড়ে বলি, কেউ না? এত সুন্দর মেয়েটিকে আর কেউ চুমাে দেয়নি? কাকলী যখন আমাকে তালাক দিয়ে চলে যায়-হঁ্যা, কাকলীই আমাকে দেয় কারণ আমি নাকি তার উপযুক্ত নই, আমাকে বিয়ে করে সে ভুল করেছিল, আরাে অনেক কথা-তখন সে আমাকে বলেছিল, আমার মনে পড়ছে, তুমিই আমার প্রথম কিনা বারবার জিজ্ঞেস করেছিলে। না, তুমি প্রথম নাও। তুমি যে কত নম্বর তাও আমার মনে নেই, হিসেবে নেই। আমি বিয়ের রাতে অভিনয় করেছিলাম, তুমি আমার প্রথম পুরুষ। আমি ব্যথা পাবার অভিনয় করেছিলাম। তােমার আগে আমি তিনজন চারজনের সঙ্গে শুয়েছি। আমার এখনাে বিশ্বাস, এ সবই কাকলী বানিয়ে আমাকে বলে। সে বানিয়ে এসব বলে, আমাকে আঘাত করবার জন্য আর বলে এই জন্যে যে-আমি যদি ক্ষেপে উঠি তাহলে তার চলে যাওয়াটা তার পক্ষে সহজভাবে নেয়া সম্ভব হয়। সে তখন নিজেকে বলতে পারে, আমি একটা খারাপ লােকের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছি, এতে আমার। দোষ কোথায়? আসলে, কাকলী আমাকে ছেড়ে যায় কারণ সে ভালােবাসত- ভালাে খাবার, বেড়ানাে, মােটরগাড়ি, অলংকার এবং অর্থ। আমার এ সব দেবার মতাে সঙ্গতি নেই। আমার বন্ধুটির ছিল, তার নাম বলব না- তার নাম আমাকে দংশন করে, আমাকে ছােট করে, আমাকে খুন করে, এখনাে; আমার সেই বন্ধুটির সঙ্গে কাকলী একদিন চলে যায়।
কিন্তু এই প্রথম-প্রথম-এত জরুরি কেন? কাকলীকে দেয়া আমার চুমােটি তাে প্রথম | চুমাে ছিল না। সন্ধ্যার জন্যে একশ আটাশখানা অংক, যে কটা অংক বইয়ে ছিল, সব।
আমি রাইট করেছিলাম। এমনকি, শেষদিকে, সন্ধ্যা আমাকে প্যান্টের ওপর দিয়ে নিচেও স্পর্শ করত, আমি ভিজে যেতাম, প্রথম দিনের সেই প্রস্রাবে ভিজে যাওয়া নয়। আমি কি সেদিক থেকেও কাকলীর জীবনে প্রথমত পুরুষ নই? তাহলে কাকলীর ওপর আমার কেন এই দাবি, যে, আমিই প্রথম এবং কেন আমি বিশ্বাস করতে চাই না যে, কাকলী যাবার সময় সত্যি কথা বলে গেছে? আজ রাতে, অমাবস্যার এই রাতে, চা বাগানের গরিব কুলিরা যখন চায়ের পাতা চুরি করবে, বান্টি তার বিরাট কোল বালিশ আঁকড়ে-সেদিন তার কোল বালিশেল বপু দেখে আমি হেসে খুন, বুড়াে খােকা নাকি যে বড় কোল বালিশ চাই? ঘুমিয়ে আছে, তার নাক ডাকার প্রচণ্ড শব্দ এ ঘর থেকেই পাওয়া যায়, কাকলীর জন্যে মন কেমন করে ওঠে। আহ আমরা সভ্যতা তখনাে ছাড়তে পারি না, যখন অমাবস্যা এবং এক একটি ঘরে আমরা। মন কেমন করে?-না শরীর কেমন করে? কাকলী?-কাকলীর জন্যে? না, যে কোনাে নারীর জন্যে? আমি জানি, আমি নিজের কাছেই নিজেকে গােপন করতে চাইছি। আমি জানি, যে কোনাে একটি নারী, যে কোনাে একটি বিপরীত লিঙ্গধারী দেহের জন্যে আমার শরীর এখন কেবলি মােচড়াচ্ছে এবং আমাকে ঘুম থেকে ছুড়ে মারছে-তবু, আমি কাকলীর আবরণের সব ঢেকে রাখতে চাইছি। এমনকি, কাকলীর জন্যে আমার চোখের পানি পড়ছে। আমি কাঁদছি। কাকলীর ঠোট কি অপরূপ লাল ছিল-সন্ধ্যার আকাশের মতাে লাল।
আহ! আবার সন্ধ্যার নাম এসে গেল। আমি উঠে গিয়ে খাবার ঘরে যাই এবং গেলাশে সুরা ঢেলে নিই, বারান্দায় বসতে চাই কিন্তু সন্ধ্যার সেই সাপের কথা মনে পড়ে যায়। আহ আবার সন্ধ্যা! সন্ধ্যা আমার পেছন ছাড়বে না। আমি শােবার ঘরে রাখা আরামচেয়ারে বসে গেলাশের সােনালি আমার গলায় ঢেলে দেই। দূরে চৌকিদার ঢং ঢং করে ঘণ্টা পিটিয়ে রাত দুটো জানায়। চারদিকে খসখস শব্দ। আবার এক স্তব্ধতা, যার তুল্য শব্দহীনতা আমি খুব কম জেনেছি। নারীহীন জীবন বােধহয় এমনই শব্দহীন হয়। এতদিন পরে আমি আমার পরিস্থিতির একটি বাস্তব তুলনা খুঁজে পাই। কাকলী, আমি তােমার প্রথম নই। আমি প্রায় চিৎকার করে উঠি, যেন কাকলী ঘরের ভেতরেই আছে-কাকলী, তুমি জানাে, বেশ্যাও তােমার চেয়ে আমাকে বেশি আনন্দ দেয়। হ্যা, আমি বেশ্যাগমন করি। স্বামীর বন্ধুর সঙ্গে শয্যা যাবার চেয়ে বেশ্যার বিছানা আমার কাছে জননীর বিছানার মতাে নিশ্চিন্ত এক শয্যা। কাল রাতে তােমার ভালাে ঘুম হয়নি? বান্টি জননীর মতাে মমতা নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে।
ভাের সাড়ে পাঁচটায় ঘন্টির সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গিয়েছিল, যেমন সে প্রতি ভােরে যায়, গণতিতে দাঁড়ায় কিন্তু বান্টি মনে করে সে বড় ম্যানেজার হলেও এটা তারই দায়িত। একে কুলিদের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের সম্পর্ক মানবিক এবং উত্তম থাকে। বান্টি রােজ গণতি থেকে ফিরে গরম পানিতে গােসল করে, আমাকে ডাক দেয় এবং বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে আমার অপেক্ষা করে। তারপর আমরা একসঙ্গে নাশতা করি। বান্টি এরপর সাড়ে নটা দশটার আগে আর বেরােয় না, কাজেই এই সময়টা আমরা আমাদের স্কুলের, কলেজের, বিশ্ববিদ্যালয়ের গল্প করি, বন্ধুদের কথা চলে আসে, কত মজার কথা, হাসির কথা বােকামির কথা, প্রেমের কথা এবং কত হারিয়ে যাবার কথা, কখনাে দু-একটি মৃত্যুর কথা। রােজ ভােরে বান্টি যখন গণতিতে বেরিয়ে যায়, আমি বিছানায় শুয়ে টের পাই। আজ সে এসে আমাকে না ডাকা পর্যন্ত টের পাইনি। তাড়াতাড়ি গােসল সেরে বারান্দায় এসে যখন বসি, আমি বুঝতে পারি আমাকে রাতজাগা দেখাচ্ছে, আমার চোখের ভেতর করকর করছে। দেখলাম, বােতল বের করা। আবার টেনেছিলে বুঝি? আমি চায়ে চুমুক দিতে দিতে নীরবে শুধু সায় দেই। ইহা ভালাে কথা নয়। তুমি আসিয়াছ ছুটি উপভােগ করিতে। রাত্রে দ্রিা না হইলে আমি ভালাে বােধ করিব না। আমি নিঃশব্দে একটু হাসি। বান্টির জন্যে আমার খুব মায়া করে ওঠে মনটা। মায়ের চুম্বন সে পায়নি। দিনের আলাে। বান্টি আমার সমুখে। আমি সমস্ত কিছু নতুন প্রেক্ষিতে স্থাপিত বলে অনুভব করে উঠি। আমাকে বলিও, তােমার আরামের জন্যে কি প্রয়ােজন। আমি চেষ্টা করিব যাহাতে তােমার এখানে অবস্থান সুখপ্রদ হয়। আমি নারী দেহের জন্যে এখন এই অসামান্য রােদ জাড়ানাে সকাল বেলায় কোনাে ক্ষুধা বােধ করি না। বস্তুপক্ষে, নারী আমার কাছে বৃক্ষ, বাড়ি, বাতাস ওসবের মতােই এ বিশ্বের চলবার জন্যে অন্যতম উপকরণ বলে মনে হয়।
কত হবে? তিনটে, সাড়ে তিন। বান্টি একবার আমাকে দেখে নেয়, চোখে চোখ পড়তেই সে চোখ ফিরিয়ে রােদেজ্বলা বাগানেরা ফুলগাছগুলাের দিকে তাকায়। আমি জানি, সে কিছু একটা বলতে চায় কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না বলবে কিনা। আমি জানি, এখন না বললেও সন্ধ্যেবেলা সুরার গেলাশ হাতে আমরা যখন এই বারান্দাতেই বসব, সে বলবে।
বান্টি বলে, কাল রাতে আমি বলেছিলাম না চুরি হবে । দুজন ধরা পড়েছে চা পাতাসহ। অফিস ঘরে তারা কয়েদ হয়ে আছে। কি হবে ওদের? বান্টি হেসে বলে তুমি জানাে, কুলিরা যে বেতন পায়, তা দিয়ে সপ্তাহের তিনদিনেরও খাবার হয় না। বাকি চারদিন তারা চায়ের মােটা পাতা, যে পাতা জ্বাল দিয়ে নুন দিয়ে খায়, খিদেটা মরে যায় সেই কষ গরম পানিতে, আবার খিদে পায়, আবার ঐ খায় । পাতা চুরি করে বিক্রি করে কেউ কেউ, সেটা খিদের জ্বালায় নয়, মদ খাবার জন্যে। দেখলে অবাক হয়ে যাবে, সপ্তাহের বেতন পাবার দিন, কুলিদের বেতন ছিনিয়ে নেবার জন্যে মেলা বসে যায় অফিস ঘরের সামনে, বাইরে সড়কের ওপর । নানা রকম সৌখিন জিনিস, চুরি, মালা, নাকের ফুল, জামা, শাড়ি-এই সব তাে আছেই, আছে জুয়াখেলা, তারপর চোলাই। বেতনের অর্ধেক ঐতে দিয়ে মাঝরাতে যখন বাড়ি ফেরে তখন প্রায় ফতুর। তাহলে কি বলতে চাও, হিসেব করে যদি খরচ করে, মদ যদি না খায় তাহলে যে বেতন কুলিরা পায় তা দিয়ে সাতদিন তারা ভালােভাবে চলতে পারবে? খুব ক্রুদ্ধ গলায় বান্টি বলে, না, নহে। আমরা যে শ্রমমূল্য দেই তাহা মােটেই যথেষ্ট নহে। আমরা কুলিদিগকে মানবেতর বলিয়া মনে করি। আমরা তাহাদিগকে যে বেতন দেই তাহার অধিক আমরা আমাদের জুতা পালিশ করিতে ব্যয় করিয়া থাকি। বান্টি বাথরুমে চলে যায়। আমার পক্ষে জানবার কথা নয়, বাথরুমে সে কাঁদে। সে যখন ফিরে আসে তখন তার চোখ লাল দেখায় এবং আমার এমন মনে হয়-সে কাঁদছিল। কেন? কুলিদের জন্যে? আমি ঈষৎ বিস্ময় অনুভব করি। বান্টির চোখ লাল দেখালেও তার মুখে সরল হাসি খেলা করে । বান্টি বলে, জানাে আমার প্রথম যে বাগানে চাকরি হয়, সহকারি ম্যাসেজার আমি, এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়। কাল আমরা চুমাে নিয়ে কথা বলছিলাম না? চুমাে বলতে আমরা তাে প্রথমেই বুঝি নারী পুরুষের চুমাে, কামগন্ধী চুম্বন ভিন্ন অন্যপ্রকার চুম্বর আমাদের চিন্তায় আসিতেই পারে না, নহে? অথচ কতপ্রকার চুম্বর রহিয়াছে। মাতা শিশুকে চুম্বন করিতেছে। পিতা সন্তানকে চুম্বন করিতেছে। কোনাে কোনাে দেশে চুম্বন হয় স্বাগত করিবার একটি ভঙ্গিম, যেমন আরবদিগের ভিতরে। সুরা পান করিবে? বান্টির কথায় চমকে উঠি। যে কদিন হলাে এসেছি, বান্টিকে দিনের বেলা দূরে থাক, সকালবেলা সুরাপান করতে দেখিনি। বুঝতে দেরি হয় না, তার ভেতরে কোথায় ভাঙচুর হচ্ছে। কার জন্যে, কিসের জন্যে এই ভাঙচুর? আমি কোনাে কুলি রমণী সংক্রান্ত রসালাে কাহিনির জন্যে প্রস্তুত হয়ে তার দিকে তাকাই এবং বলি, হ্যা, আপত্তি নেই।
বান্টি বেয়ারাকে সুরার জন্যে আদেশ করে। লক্ষ্য করি, বেয়ারাও অবাক হয়েছে এই সকালবেলায় সুরার আদেশ শুনে। সে ইতস্তত করে-ঠিক শুনেছে কিনা। কিন্তু তার তেমন সাহস নেই বলে, কৌশল অবলম্বন করে, জানতে চায়। বাদাম দেবে কিনা। যদি উত্তর হয় হ্যা তাহলে নিশ্চিত যে, সাহেব সুরাই চেয়েছেন। বান্টি বেয়ারাকে আদরভরা গলায় বলে, বুরবাক, হুইস্কি কা সাথ জো কুছ চলতা হ্যায় লাও না? সুরা আসে কিন্তু অনেকক্ষণ স্পর্শ করে না বান্টি। বলে চলে, আমার সেই প্রথম বাগানের একটা আউট গার্ডেন ছিল, মানে দূরে ছােট একটা বাগান ছিল, নতুন গড়ে তােলা হচ্ছিল। সেখানে কুলিদের ভেতরে বিদ্রোহ দেখা দেয়। সে লম্বা ব্যাপারটা একটু বেশি দূর গড়িয়ে যায়। আমার আগে যে সহকারি ম্যানেজার গিয়েছিল কুলিদের সঙ্গে কথা বলতে, তার গায়ে হাত পড়ে। এখন তুমি তাে জানাে, ম্যানেজারের গায়ে হাত পড়ার অর্থ। মালিক পক্ষ যেমন মরিয়া হয়ে ওঠে, কুলিরাও ভাবে মরেছি যখন তখন আর রাখঢাক করে লাভ কি? তারা আউট গার্ডেন থেকে মালিকপক্ষের সব লােককে তাড়িয়ে, বাংলা জ্বালিয়ে, পথ কেটে দিয়ে বিদ্রোহ ঘােষণা করে বসে। দুজন কুলি এদিক থেকে পাঠানাে হয়েছিল, বেশ মাতবর বেশ পুরনাে কুলি-তারা দায়ের জখম নিয়ে ফিরে আসে। তখন পুলিশের সাহায্য নিতে হয়। সে বিস্তারিত বিবরণে গিয়ে লাভ নেই, মােকাম্মেল, তুমি খামােখা বাের হবে। সংক্ষেপে ইহাই হইল যে, আমি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রেরিত হইলাম আউট গার্ডেনে। আমার তখন নবীন বয়স। আমি নিজেকে অ্যালেকজান্ডার মনে করিতেছি সেই গার্ডেনে পা রাখিয়া। নতমুখে কুলিসকল আমাকে দেখিয়া সরিয়া যাইতেছে। আমি দিল্লিশ্বরের ন্যায় ঘােষণা করিলাম-তােমাদের সকল অপরাধ ক্ষমা করা হইল, তােমরা অতঃপর মন দিয়া কাজ করিতে থাক। যদি কাহারাে এ বাগান ভালাে না লাগে তবে সে চলিয়া যাইতে পারে, তাহার বিরুদ্ধে কানাে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে না-মােকাম্মেল, তুমি হয়ত জানেন না, চা বাগানে অলিখিত দাসব্যবস্থা আজো আছে। কোনাে কুলি পালিয়ে গেলে বা বাগান ছেড়ে চলে গেলে, সেই আমেরিকায় তুলাক্ষেতের নিগ্রোদের মতাে, তাদের ধরে আনা হয়, কোনাে বাগান তাদের কাজ দেবে না। তারা শুধু পলাতক হয়ে এক বাগানের পর আরেক বাগান ঘুরে ফিরবে রাতের আঁধারে, দিনে বেরুতে পারবে না। তাই আমি যখন বললাম, যার ইচ্ছে সে বাগান ছেড়ে চলে যেতে পারে, কেউ সে সুযােগ গ্রহণ করল না। সকলেই আমার বশ্যতা স্বীকার করল ।
আমাদের হেডক্লার্কবাবু আমার কানে কানে বললেন, সবাইকে মাফ করেছেন, ভালাে কথা। তবে, নষ্টামির মূলে যে আছে তাকে বাগান থেকে বের করে না দিলে আবার গােলমাল হবে, আবার উৎপাত হবে। আমি তখন সেই ব্যক্তিটিকে বহিষ্কারের আদেশ দেই। আমি পাহাড়ের একটি ঢালে দাঁড়াইয়াছিলাম, আমি দেখতি পাইলাম সেই ব্যক্তিটিকে, আমি বিস্মিত হইলাম কারণ তাহার চেহারা বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিবার মতাে মােটেই ভয়ঙ্কর নহে বরং তাহার শীর্ণ দেহ দেখিয়া হাসপাতালের রুগি সাব্যস্ত করাই যে কাহারো পক্ষে স্বাভাবিক, সে নীরবে পথের উপর আসিয়া দাঁড়াইল, তাহার বগলে ছােট একটি পুটুলি, সে একবার দূরে সমবেত কুলিদের প্রতি দৃষ্টিপাত করিল, একবার আমাকে ও বাবুটিকে দেখিয়া লইল, তাহার পর অগ্রসর হইতে লাগিল। বাগান সে ছাড়িয়া যাইতেছে কিনা নিশ্চিত হইবার জন্যে আমি ও হেডক্লার্ক বাবু পাহাড় বাহিয়া হাঁটিতে লাগিলাম। অচিরে বাগানের সীমানায় আসিয়া পড়িলাম। তখন দেখিলাম, কুলিটি দাঁড়াইয়া পড়িল। একবার মনে হইল, সে যাইতে চাহে না। মনে হইল, সে আমার নিকটে ছুটিয়া আসিয়া ধুলায় গড়াগড়ি দিবে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করিবে, এখানেই থাকিয়া যাইবার অনুমতি ভিক্ষা করিবে । আমি স্থির করিয়া রাখিলাম, সে যদি সত্য সত্যই ক্ষমা চাহে, ক্ষমা করিয়া দেব। কিন্তু না। সে এক অদ্ভুত কাণ্ড করিয়া বসিল। সে নত হইল। সে নত হইয়া মাটিতে মস্তক ঠেকাইল । মােকাম্মেল, সে মাটিকে চুম্বন করিল। তাহার পর দৃষ্টিসীমার বাহিরে সে চলিয়া গেল ।
সন্ধ্যা হইয়া আসিয়াছে, তাহাকে অনতিকাল পরে আর ভালাে করিয়া দেখা গেল না। আমি তাঁবুতে ফিরিয়া আসিলাম। তােমার হয়ত স্মরণ হইবে, বিদ্রোহীরা বাংলাে জ্বালাইয়া দিয়াছিল তাই আমাকে তাঁবু আনিতে হইয়াছিল। তাঁবুতে যখন শয়ন করিতে যাই, গভীর রাত, আহার আগে মােরগ পােড়া দ্বারা ডিনার সারিয়া প্রায় আধ বােতল হুইস্কি গলায় ঢালিয়াছি, বিছানায় শয়ন করিতেই, মাটির ঘ্রাণ নাকে আসিয়া লাগিল। মাটি। সেই মাটি। যে-মাটি কুলিটি চুম্বন করিয়াছিল। আমার একবার লােভ হইল-দেখিই না, মাটি চুম্বন করিতে কেমন লাগে। আমি বিছানার নিচে পাতা ক্যাম্বিস সরাইয়া মাটি উন্মুক্ত করিলাম, নত হইলাম, ঠোট দিয়া মাটি স্পর্শ করিলাম, আমি কিছুই অনুভব করিতে পারিলাম না। অথচ কি বলিব তােমাকে, সেই কুলি যখন মাটি চুম্বন করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিল, তাহার চক্ষুদ্বয় দিয়া অঞ অবিরল ধারায় নির্গত হইতেছিল। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, বান্টির চোখ দিয়ে এখন পানি পড়ছে-সম্ভবত সে নিজেও জানে না, পানি মােছার চেষ্টা করে না, সুরায় প্রথম চুমুক দেয়। সকালে সুরা পানের অভ্যেস নেই বলে, এতক্ষণ সমুখে গেলাশ পড়েই ছিল, এখন এক ছােট চুমুকের পর মুখ বিকৃত করে গেলাশটা সরিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ায়। বলে, মাটি যদি জননী হয়, এই প্রথম আমি কাউকে চুমাে দেই । মাটি যদি প্রেয়সী হয়, তাে সেই আমার প্রথম চুম্বন। সত্য এই যে, কাব্য পড়িয়া থাক, আমি কাহাকেও চুম্বন করি নাই, আমাকেও কেহ চুম্বন করে নাই। বিকেলে বান্টি আমাকে ফ্যাকটরিতে নিয়ে যায়। দূর থেকেই চমৎকার ঘ্রাণ আসছিল বাতাসে ভেসে-সবুজ ঘ্রাণ, পাতার পিষ্ট পত্রালীর ঘাণ। পুরােদমে মেশিনে কাজ চলছে। ফ্যাকটরির বাইরে কুলি নারী ও পুরুষেরা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে চা পাতা জমা দিচ্ছে টুকরি উজাড় করে। একটি মেয়েকে আমার চোখে পড়ে।
শ্রেষ্ঠ মনােদৈহিক গল্প ও ৪৩
বান্টি।
বান্টি প্রশ্নবােধকে চোখে আমার দিকে তাকায় এবং আমার চোখ অনুসরণ করে অচিরে বুঝতে পারে আমি কি দেখছি এবং কি বলতে চাইছি। আমি শুধু বলতে চেয়েছিলাম, মেয়েটি তাে খুব সুন্দর দেখতে। বান্টি কি আশংকা করে জানি না, সে আমাকে দ্রুত সেখানে থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়। এবং যেতে যেতে বলে, ইহাদের সাক্ষাতে ইহাদের বিষয়ে কোনাে মন্তব্য করিও না। ততক্ষণ আমরা তাদের শ্রুতি সীমার বাইরে বলে গেছি। আমি বলি, মেয়েটি অপূর্ব। বান্টি কেমন অস্বস্তি বােধ করে। আমি জিগ্যেস করি, ওর নাম কি? এতদূরেও সাবধানতা অবলম্বন করে থাকে বান্টি, নামটা সে ইংরেজি বানান করে বলে, টি-এ-আর-এ। তারা? বান্টি সঙ্গে সঙ্গে চাপা গলায় আমাকে শাসন করে ইংরেজিতে, বলিয়াছি না, ইহাদের সমুখে মুখ খুলিবে না। আমি অপ্রস্তুত বােধ করি। বান্টি ফ্যাকটরির ভেতরে যেতে যেতে আমাকে বলে, তুমি বাংলায় ফিরিয়া যাও। আমি আসিতেছি।। অবাক হই। কথা ছিল, বান্টির সঙ্গে ফ্যাকটরির কাজ দেখব কিভাবে চায়ের সবুজ পাতা বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে আমাদের চেনা চা পাতায় পরিণত হয়। বান্টি এখন আমাকে এক তরফা বিদায় করে দেয়। আমি ঠিক বুঝে উঠি না, আমার শুধু অস্পষ্টভাবে মনে হয়, কোনাে কিছু তাকে হঠাৎ বিচলিত করে ফেলেছে। আমি বাংলােয় ফিরে যাই। না। আমি ফিরে আসি কুলিদের দাঁড়িয়ে থাকা লাইনের কাছে। আমি সেই মেয়েটি-যার নাম তারা, তাকে সন্ধান করি। বেশ কয়েকটি নার-যুবতী, প্রৌঢ়া, কিশােরীও দু-একজন। সকলেরই পরনে শত ময়লা শাড়ি, গায়ের রঙ কালাে, মুখে হাতে, পায়ে ধুলাের ঘন প্রলেপ, হঠাৎ একজন থেকে আরেকজনকে আলাদা করা যায় না। আমি প্রথমবার পুরাে লাইন হেঁটে গিয়েও আমার সেই মেয়েটিকে খুঁজে পাই না। চলে গেছে? আমি ঈষৎ বঞ্চিত বােধ করি। আমি আবার হেঁটে আসি লাইন ধরে ।। তারা । ঐ তাে তারা সেই মেয়েটি। আমি তার সমুখে এসে স্থির হই। ছিপছিপে শরীর, আঁটো করে জড়ানাে শাড়ি, ভােরের প্রথম আকাশের মতাে গায়ের রঙ-কালাের ভেতরে চাপা একটা ফর্সা আলাে যেন কোথায়।
ঠোট। তার ঠোট আমার চোখে পড়ে। আমি তৎক্ষণাৎ শরীরের ভেতরে মেয়েটির জন্যে বাসনা অনুভব করি। পাতলা ঠোট, জামের মতাে রঙ, সে ঠোটে ধুলাের আভাস; আমার শরীরের ভেতরে ক্ষুধা বােধ হয়। আমি একটু পিছিয়ে দাঁড়াই এবং তাকে সরাসরি দেখতে থাকি। শহরে হলে এতেঠ সরাসরি দেখতাম না, অরণ্যে ভেতরে, চা বাগানে, কুলি এক যুবতীকে দেখে চোখ ফিরিয়ে নিতে হবে? অরণ্যের পরােক্ষ, আড় বা। বাঁকা বলে কিছু নেই, সকলেই সরল, প্রত্যক্ষ ও স্পষ্ট। আমি একটা জায়গায় পাছা ঠেকিয়ে মেয়েটির রূপ গ্রহণ করতে থাকি। যতই তাকে দেখি ততই আমার রক্তে আগুন তীব্র হয়ে ওঠে। মেয়েটি, তারা নাম বলেছিল বান্টি-তারা আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে চোখ ফিরিয়ে নেয়। এই চোখ ফিরিয়ে নেয়া এমন নয় যে, শহরে যেমন লজ্জায় ফিরিয়ে | নেয়, সে চোখ ফিরিয়ে নেয় এবং তার ভেতরে কথাটি যেন এই যে-তুমি আমাকে যত ইচ্ছে দেখে যাও যতক্ষণ না তােমার আশা মেটে, আমি কিন্তু তােমাকে যতদূর দেখার দেখে নিয়েছি। মেয়েটির পালা যখন আসে, উপুড় হয়ে টুকরি উজাড় করে দেয়। ঐ যে একটু নত হয়, উত্তোলিত হয় তার পেছনটা, সমুখে ঈষৎ ঝুঁকে পড়ে তার স্তন-আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। আমি শুনেছি, চা বাগানে কুলি মেয়েদের শয্যায় পাওয়া যায়। আজ রাতে একে আমার চাই। মেয়েটি পাতা নামিয়ে লাইন ছেড়ে দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। আমি বাংলাের দিকে ফিরে যেতে যেতে শেষ একবার পেছন ফিরে তাকাই। দেখতে পাই । মেয়েটি আমার দিকে স্থির তাকিয়ে আছে। আমি যে দেখে ফেললাম, তাতে সে মােটেই বিচলিত বা অপ্রস্তুত নয়। আমার ধারণা হয়, মেয়েটি বুঝতে পেরেছে, আমি তাকে পছন্দ করেছি। আমার বিশ্বাস, আমি লােক লাগালে আজ রাতে তাকে পাবাে। লােক লাগালে মানে, বান্টিকে বলতে হবে। বান্টি তাে আমাকে বলেইছে-এখানে আমার অবসর সুখপ্রদ করবার জন্যে যা চাই তাকে যেন বলি, সে সাধ্যমতাে করবে। বান্টি ফ্যাক্টরি থেকে ফিরে আসে। আমার হাতে গেলাশ দেখে বলে, কি, আমার জন্যে অপেক্ষা না করেই? হা। তেষ্টা পেয়েছিল। তােমার গেলাশ এনে রেখেছি। এই যে। বান্টিকে আমি সুরা ঢেলে দেই।
সে সােফায় বসে সমুখে পা লম্বা করে দিয়ে আহ জাতীয় এক ক্লান্তিহর ধ্বনি করে গেলাশ তুলে নেয়। আমি দেরি করি না। বলি, তােমার তারাটি দেখতে বেশ। আমার তারা? এই বিশ্বে কি হয় তােমার কথার অর্থ? আমি যে বাংলা বাগভঙ্গি অনুসারে তােমার তারা বলেছি, বান্টি তা বুঝতে পারেনি এবং তােমার কথাটি আক্ষরিকভাবে নিয়েছে দেখে আমার ভীষণ হাসি পায়। কিন্তু হাসাটা উচিত হবে না। বাংলা ভালাে জানে না, বাংলায় মনের সবটা সে প্রকাশ করতে পারে না-এ নিয়ে তার দুঃখ একটা আছে। আমি লম্বা একটু চুমুক দিয়ে গেলাশ নামিয়ে রেখে বলি, আমি তােমার চরিত্রের প্রতি কোনাে কটাক্ষ করছি না, বন্ধু আমি বলছি না যে, তােমার তারা মানে তােমারই তারা। বলছি, তােমার এই বাগানে যত মেয়ে দেখলাম তার মধ্যে তারা মেয়েটির চেহারা খুব
বান্টি গভীর মুখে সুরাপান করে চলে। কবিতা শুনবে? আমি বলি। গত সন্ধ্যেয় বান্টি আবৃত্তি করছিল, ভাবলাম আজ আমি করি-ওর মনটা ভালাে হবে। তবে, মনটা যে হঠাৎ ওর এভাবে বিগড়ে গেল কেন, আমি এখন অবধি বুঝতে পারিনি। বান্টি আরাে খানিকটা সুরা ঢেলে নেয় নিজের গেলাশে। আমি জীবনানন্দ দাশ থেকে আবৃত্তি করতে থাকি-বনলতা সেন। আবৃত্তি করতে করতেই আমি অনুভব করি, এর একটি বর্ণও বান্টির ভেতর যাচ্ছে।
-যাচ্ছে না সে ভালাে বাংলা জানে না বলে নয়, সে অন্যমনস্ক বলে। আমি কবিতাটি মাঝপথেই শেষ করে দেই। বলি আর মনে পড়ছে না। বান্টি আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসে মাত্র। সে হাসিটিও অন্যমনস্ক। সন্ধ্যে দ্রুত নামে। পাহাড়ি অঞ্চলে সন্ধ্যে যেন শ্বাপাদের মতাে ঘাড়ের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে।
বেয়ারা অনেক আগেই পেট্রোম্যাকস জ্বেলে দিয়ে গেছে। হঠাৎ সেই সাপের কথা মনে পড়ে যায়। আমি সভয়ে ওপরে তাকাই। বান্টি বলে, সাপের ভয় করছে? ভেতরে বসবে? আমরা এসে বান্টির ঘরে বসি। বান্টি তার বিছানায় বসে, আমি সারা ঘরে যে একটিমাত্র সােফা আছে, তাতে। তার বিছানার পাশে বইয়ের শেলফ-অধিকাংশ বই ইতিহাসের, ভারতীয় ইতিহাসের ওপর বই, বিশেষ করে ব্রিটিশ শাসনকালের। তুমি তাে পলিটিক্যাল সায়েন্স পড়েছ। হা। বান্টি যােগ করে, ইতিহাসে আমার নেশা ধরে অনেক পরে। বলছি না, বাবার ঐ গুলাে চালানাে, আইয়ুব খান, তারপর থেকেই ইতিহাস আমাকে টানে। পড়তে পড়তে পেছনের দিকে যাচ্ছি। নেহেরুর আত্মজীবনী দিয়ে শুরু করেছি, তারপর পেছুত পেছত এখন ওয়ারেন হেস্টিংসের মামলার বিবরণ পড়ছি। কবিতাতেও তােমার ইন্টারেস্ট কম নয়।
বান্টি হাসে। ইংরেজিতে বলে ইহা হয় আমার স্বপ্ন যে আমি কবিতা লিখিব। আমি যদি কবিতা লিখি কেবল ভালােবাসার কবিতা লিখিব । কেবল ভালােবাসার কবিতা কেন? বান্টি চুপ করে থাকে। বান্টি আমাকে ঠিক করে বলাে তাে, কাউকে তুমি ভালােবেসেছ? এমন কোনো মেয়ের জন্যে তােমার মন পড়ে আছে বান্টি, যাকে তুমি ঢাকায় ফেলে এসেছ, এই স্বেচ্ছা নির্বাসনে পড়ে আছ? না ঢাকায় তেমন কেউ নেই। আমি বলেছি, আমার এ হতভাগ্য জীবনে কাউকে আমি ডেকে আনব না। সেটা হবে পাপ। হতভাগ্য জীবন বলছ কেন, বান্টি, আমার শুনে ভালাে লাগে না। পা তুলে বসাে। কথাটা আমি ঠিক ধরতে পারি না। বান্টি বলে, ঘরের মধ্যেও সাপ আসে। গতবার বাথরুমে কমােডের পেছনের নল জড়িয়ে একটা সাপ শুয়ে ছিল। আমি ব্যাকুল হয়ে বলি, তােমার তাে কোনাে বিকার দেখছি না, বান্টি? কেন তুমি এখানে পড়ে আছ? ইচ্ছে করলেই কত ভালাে কাজ তুমি ঢাকায় পেতে পারাে। এখানে এই জঙ্গল, এই সাপখােপ, এই জংলি অসভ্যদের মধ্যে তুমি পড়ে আছ কি করতে? বান্টি ধীর শান্ত গলায় বলে, আমি এখানে স্বচ্ছন্দ বােধ করি, আমি বােধ করি যেন আমি জননীর নিকটেই রহিয়াছি। জানাে তাে প্রকৃতি হয় জননী? বান্টি উঠে দাঁড়ায়, ঘরের ভেতর একটু পায়চারি করে এসে আবার বসে। বলে, ঢাকায় আমি বেমানান। আমি বাঙালি, বাংলা জানি না, বাংলার প্রতি আমার শ্রদ্ধা যাতে না জন্মায় তার প্রাণান্ত চেষ্টা আমার পিতা করিয়াছেন, তিনি সবই করিয়েছেন, কেবল আমার গায়ের রং ফর্সা করিয়া দিতে পারেন নাই। আমার পিতামাতার স্থলে ইংরেজ যােগাড় করিতে পারেন নাই অথচ চাহিয়াছেন-আমি ইংরাজ হই। আমি সুস্থ জীবন হইতে বঞ্চিত এবং ইহারা, এই চা বাগানের কুলিরা, ইহারাও দুই তিন চার পুরুষ পূর্বে তাহাদের জন্মভূমি, তাহাদের পূর্বপুরুষদের ভূমি হইতে উৎপাটিতে এবং এখানে আনীত, ইহারাও সুস্থ এবং স্বাভাবিক জীবন হইতে বঞ্চিত, অবিকল আমারই ন্যায়। তাই আমি এখানেই স্বচ্ছন্দ বােধ করি। এখন ইহাই হয় আমার আপন-নিবাস। বান্টি। বলাে । আমি দুঃখিত।
কাহার জন্যে? আমার জন্যে দুঃখ করিও না । আমি তােমাকে বন্ধু মনে করি। বন্ধু মনে করিয়াই অন্তর প্রকাশ করিয়াছি তােমার সাক্ষাতে। নহিলে, কেহই আমাকে দেখিয়া অসুখী বলিবে না। না, মােকাম্মেল, আমি ভালো আছি। আমাকে করুণা করিও না । চলাে, ডিনার প্রস্তুত। খাবার টেবিলে বসতে না বসতেই বান্টি বলে, জানাে তাে উত্তম ডিনার উত্তম নিদ্রা আনিয়া দেয়। কাল রাতে তােমার ঘুম হয়নি, আজ পেট ভরে খাও, ঘুম হবে। বেয়ারার সাক্ষাতে কথাটা বাংলায় বলি না; বেয়ারা অত্যন্ত নিপুণ হাতে আমাদের প্লেটে নানারকম সেদ্ধ সজি তুলে দিচ্ছে। বলি কিন্তু নিদ্রা আমার আসিবে না। কাল নিঃসঙ্গ বােধ করিয়াছিলাম। বান্টি নীরবে ভ্র তুলে আমার দিকে তাকায়। আমি আমার কথায় সংকেত যতটা পুরে দেয়া সম্ভব দিয়ে বলে, নারী আমাকে আকর্ষণ করে। বিবাহ জীবনেও অপর নারীর স্বাদ লইতে ইতস্তত করি নাই। আমি নারী মাংস ক্রয় করিয়াছি, শয্যায় লইয়া গিয়াছি। বান্টি, তুমি সাত্তিক মানুষ, তুমি জীবন লইয়া অধিক চিন্তা করাে, আমি জানি এই জীবন চিরস্থায়ী নহে এবং আমার প্রধান অনন্দবিন্দু নারীদেহ। বান্টি আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হাতের ইশারায় বেয়ারাকে ঘর থেকে চলে যেতে বলে। বেয়ারা আমাদের শ্রুতির বাইরে গেলে বান্টি বলে, বিশুদ্ধ বাংলায়, আজ রাতে তােমার। একটি মাসি চাই? আমি জানি, বান্টি বাংলা ভালাে জানে না বলেই শয্যা-রমণীর বদলে ঐ স্থূল শব্দটি ব্যবহার করেছে, নইলে তার মতাে রুচিবান মানুষ এমন উচ্চারণ করে, এ অসম্ভব। মাথা নেড়ে সায় দেই। হ্যা, আমি বিছানায় একা যেতে চাই না। তুমি বােধ হয়, চা বাগান সম্পর্কে কিছু উপন্যাস পড়েছ আর গল্পটল্প বেশি শুনেছ, যে, এখানে মেয়ে পাওয়া যায়। যায় না, তা বলব না। যায়। যদি এই তােমার কথা ছিল তাে আমাকে বিকেলে বললেই পারতে। আমি তােমাকে পাশের বাগানে মি. জাকারিয়ার বাংলায় পাঠিয়ে দিতাম। মি, জাকারিয়া? তিনি কে? আমার প্রতিবেশী বাগানের ম্যানেজার। তিনি হয়ত তােমার জন্যে একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারতেন। অর্থাৎ তুমি নিজেই দায়িত্বটা নিতে চাইছ না। বেশতাে, তুমি শুতে যাও, আমি বেয়ারার সঙ্গে কথা বলে দেখি, তারাকে পাওয়া যায় কিনা? কে? প্রায় চিৎকার করে ওঠে বান্টি। তারা। এই তারা। ভারি চমৎকার দেখতে। দেখে ভালাে মনে হয়।
বান্টি ধীর হতে ন্যাপকিন দিয়ে মুখ মােছে, উঠে দাড়ায়, আমার যেন মনে হয় সে নিজেই এবার তারার বিষয়ে বেয়ারার সঙ্গে কথা বলবে এবং আমার জন্যে ব্যবস্থা করবে। আমি বলি, বলাে, আমি টাকা ভালাে দেবাে। ঢাকায় ওরকম একটা মালের জন্যে পাঁচশ পর্যন্ত যেতাম। এখানে আশা করি, তার কমেই হয়ে যাবে। বান্টি চেয়ার ঠেলে আমার পাশে এসে দাঁড়ায়, তারপর চাপাস্বরে উচ্চারণ করে, স্তব্ধ হও। ইশ্বরের দোহাই স্তব্ধ হও। তারার নাম তুমি উচ্চারণ করিও না। দ্রুত সে নিজের ঘরে চলে যায়। সাধারণত আমরা কেউই দরােজা ভেতর থেকে লাগাই না। আজ শব্দ পাই, বান্টি দরােজার খিল তুলে দিচ্ছে। পরদিন নাশতার টেবিলে বান্টির সঙ্গে আমার দেখা হয় না। বেয়ারার কাছে শুনতে পাই, একটা জরুরি কাজে সাহেব শ্রীমঙ্গল গিয়েছেন, ফিরতে রাত হবে, কিম্বা আজ নাও ফিরতে পারেন। আমি এতটা নির্বোধ নই যে বুঝাতে পারব না। আমি নিশ্চিত হয়ে যাই যে, তারা আসলে বান্টির রক্ষিতা এবং তাই তারাকে আমি আমার শয্যায় পেতে চেয়ে তার অধিকারের ভেতরে হাত দিয়ে ফেলেছি। সেবার বান্টির কাছে বিদায় আর নেয়া হয় না। আমি বিকেলেই ঢাকার ট্রেন ধরে ফিরে আসি। তারা আমাকে কিছুদিন হানা দেয়, আমার শরীরকে দগ্ধ করে, আমাকে নারীদেহ কিনতে ঠেলে পাঠায়। বান্টির জন্যে আমার ঈর্ষা হয়-কি সুখে সে আছে অমন ডবকা একটি মেয়ে নিয়ে এবং কি নিশ্চিন্ত সে-লােকভয় নেই, গর্ভ হলে দুঃশ্চিন্তা নেই, টাকা খরচ নেই এবং যখন খুশি তখন। তারার কথা যখন প্রায় ভুলেই গেছি, একদিন শেরাটনের সমুখে দাঁড়িয়ে আছি, পেছন থেকে এক নারীকণ্ঠে আমার নাম উচ্চারিত হয়। ঘুরে তাকে দেখার আগেই আমি জানি এ কণ্ঠ আমার অপরিচিত। সত্যিই সে অপরিচিত। না, তাকে আমি আগে কখনাে দেখিনি। আমার সমবয়সী এবং মেয়েদের বয়সের হিসেবে যেমন যায় অর্থাৎ সে যুবতী আর নয়। সে আমার কাছে আসে এবং এবার আমার ডাক নাম ধরে ডাকে। আমি অবাক হয়ে যাই। এ নামে সে জানল কি করে? আমাকে চিনতে পারছ না? আমি মাথা নাড়ি-না; কিন্তু তীব্র চোখে তাকিয়ে থাকি। চিনতে পারি না। মাথা পেছনে ঠেলে ভদ্র মহিলা হেসে ওঠে নিঃশব্দে এবং ভঙ্গিটি আমার অকস্মাৎ বড় চেনা মনে হয়। তুমি সন্ধ্যা? হ্যা, আমি সন্ধ্যা। তবে এখন আর সন্ধ্যা নয়, মাঝরাত বলতে পারাে।
পুরুষ হলে আমি তার কাঁধ ধরে দুপাক নেচে নিতাম; নিতান্ত নারী বলে হাে হাে করে খ্যাপার মতাে শুধু হাসি আর কেবলি বলতে থাকি, আ, কতকাল পরে, কতকালে পরে । তুমি যে তুমি আমার সমুখে, কি আশ্চর্য। সন্ধ্যা নিজেকে মাঝরাত বলে একাধিক বার অর্থাৎ নিজেকে সে বিগতযৌবন বলতে চায় কিন্তু ভাবে ভঙ্গিতেই বােঝা যায়, সে নিজেই এতে বিশ্বাস করে না। এ শুধু শ্রোতার মন। পরীক্ষা করে দেখা, যে, শ্রোতাটি বিশ্বাস করছে কিনা। আমি এ জাতীয় মানুষদের চমৎকার জানি। আমি যদি বলি যে, হ্যা সত্যিই তােমার বয়স হয়ে গেছে বা কথাটা হাবেভাবেও বুঝিয়ে দেই, তাহলে তক্ষুণি সে বরফের মতাে শীতল হয়ে যাবে, আমাকে বিদায় দেবে এবং আবার সে হারিয়ে যাবে জীবন থেকে হয়ত অনেক দিনের জন্যে, কিম্বা চিরদিনের মতােই। সন্ধ্যাকে বলি, চলাে, কোথায় বসে চা-টা খাই। সন্ধ্যা এমন একটা চোখভঙ্গি করে, যেন আমি তার গােপন প্রেমিক। বলে, কেন, আমার বাড়ি যেতে ভয় করে?-না, আমাকে তােমার বাড়ি নিতে ভয়? আমার বাড়িতে তাে কেউ নেই। সন্ধ্যা, সেই সন্ধ্যা, আমার জীবনের প্রথম একশ আটাশখানা চুমাে যার কাছ থেকে পাওয়া, সেই সন্ধ্যা, আহ সন্ধ্যা, ঘড়ির কাঁটার মতাে দূরে গিয়েও আবার যে আমার কাছে সরে এসেছে-এক হবে কি?-আমার বুকের ভেতরটা কেমন দুরুদুরু করে ওঠে-সন্ধ্যার দিকে জীবনের এত বছর পরে এবং এত রমণীর পরে আমি তাকাই-পরীক্ষা করি নীরবে, কেমন শয্যাসঙ্গী সে হবে-প্রথম চুম্বন হয় পাপ, প্রথম চুম্বন হয় পুণ্য-আ, সন্ধ্যা, তুমি সন্ধ্যা, সন্ধ্যা চোখ গােল করে বলে, বাড়িতে কেউ নেই মানে? নেই। বিয়ে করােনি? বৌ? করেছিলাম। মিথ্যে করে বলি, কাকলী মারা গেছে। সহানুভূতিতে চুকচুক করে ওঠে সন্ধ্যা। তােমার বাসা কোথায়, মােকাম্মেল? আমার ভালাে নাম ধরেই ডাকে সে এবার। শােক জানাবার পর মানুষ বােধ হয় একটু কেতাদুরস্ত হয়ে পরে কিছুক্ষণের জন্যে। ঠিকানা শুনে সন্ধ্যা বলে, তাহলে তাে আমার বাসার চেয়ে তােমারটাই কাছে। চলাে, তােমার ওখানেই যাই। চায়ের পানি বসিয়ে বলি, তােমার নিশ্চয়ই বিয়ে হয়েছে, ছেলেমেয়ে স্বামী নিয়ে দিব্যি জমিয়ে আছ।
তা আছি। এতদিন বিলেতে ছিলাম। কর্তার হঠাৎ শখ হয়েছে দেশে বাড়ি বানাবেন। তাই এসেছি। মােহাম্মদপুরে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়েছি, বাড়ি হচ্ছে উত্তরায়। কর্তা কি করেন? রেস্টুরেন্ট আছে ম্যানচেস্টারে।। চায়ের পেয়ালা দুহাতে জড়িয়ে-শীতের দেশে কাপ দুহাতে জড়িয়ে ধরলে ওম হয়-বলে, ছেলেমেয়েরা সঙ্গে এসেছিল, ওরা আছে, কর্তা ফেরত গেছে। এখন সব চাপ। আমার ওপর। ইট, বালি, চুন, মিস্ত্রি, হিসেব, উরে বাপরে বাপ। আমি রসিকতানা করে পারি না। বলি, অংকটা তাে তুমি ভালােই জানতে। শুনে কিছুক্ষণ ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে সন্ধ্যা। তাকে কি সাধারণ, ঘামে ভেজা, প্রায় মােটা, বােকা-বােকা এক মহিলা বলে আমার হঠাৎ মনে হয়। ঐ রসিকতাটি করবার জন্যে ঈষৎ অনুতাপও হয় আমার।। সন্ধ্যা হঠাৎ আগের ব্যোমভােলাভাব ছেড়ে হেসে ওঠে-শব্দের একটা হিল্লোল বয়ে যায়। আমি এই বয়সে বাচ্চা মেয়ের মতাে হেসে উঠতে কাউকে দেখিনি। নাকি, বাচ্চা বয়সের স্মৃতি মানুষকে বাচ্চা করে দেয়? সন্ধ্যা চোখ পাকিয়ে কপট ধমক দেয়, চোপ, তারপরেই আবার খানিক হাসে। বলে, মনে আছে? আছে বৈকি। উহ অনেকগুলাে চুমাে তুমি আদায় করেছিলে। আচ্ছা, তুমি কিন্তু ঐ বয়সে কত তঁাদোড় ছিলে না। বাবারে বাবা। আমি তাে অবাক। এতদিন পরে সব দোষের দোষী হলাম আমি গাে? চায়ের পেয়ালা সরিয়ে সন্ধ্যা বলে, তােমার ফ্ল্যাটটা দেখি, ভালাে করে। আমাকে তাে এদিকে রােজই একবার আসতে হয়, আসব তােমার এখানে। থাকে মােহাম্মদপুরে, বাড়ি হচ্ছে উত্তরায়, আমার এদিকে অর্থাৎ শান্তিনগরে কেন তাকে রােজ আসতে হয়, আমার বােধগম্য হয় না। কিন্তু রােজই প্রায় একবার করে সন্ধ্যা আমার ফ্ল্যাটে আসতে থাকে। যাবার সময় টেলিফোন নম্বর নিয়ে গিয়েছিল তাই ফোন করেই আসে, এমন হয় না যে এতদূর এসে তাকে ফিরে যেতে হচ্ছে। তবু প্রতিবারই ফ্ল্যাটে পা দিয়েই সে বলবে, বাবা, তােমাকে ধরাই মুশকিল। এর মধ্যে একবার উত্তরায় গিয়ে তার বাড়ি দেখে আসি। বিশাল এক বাড়ি তৈরি হচ্ছে। জিগ্যেস করি, ভাড়ার জন্যে বানাচ্ছ মনে হয়।
এবার দেশে ফিরে আসব। দেশেই থাকব। তারপর তােমার মতাে পুরনোের দেখা যখন পেয়েছি। সন্ধ্যা এমন একটা ভঙ্গি করে, যেন আমার সঙ্গে তার গােপন সম্পর্ক সেই ছেলেবেলা থেকে এখনাে চলেছে। প্রথম প্রথম সন্ধ্যা এসে আমার বাড়িতে সােফায় বসত, একদিন শরীরটা ভালাে লাগছে না বলে বিছানায় শুয়ে পড়ে। শুয়েই আবার অজগরের মতাে পাক দিয়ে উঠে বলে, মাইন্ড করলে না তাে?
না। তুমি আরাম করাে। আমি ঘুরে আসছি। খপ করে আমার হাত ধরে ফ্যালে সন্ধ্যা। উঁহু সেটি হচ্ছে না। আমাকে ফেলে তুমি কোথায় যাবে? বােসাে এইখানে। আমি বাইরের ঘরে সােফায় লম্বা হয়ে বসি। শােবার ঘরে বিছানায় এখন সন্ধ্যা সময় খুব ধীরে বয়ে চলে দরােজা জানালা ভেদ করে, দেয়ালকে স্বচ্ছ করে-ঘড়ির কাঁটা দুটো যেন পুরুষ ও রমণীর দুটি হাত; হঠাৎ আমার খেয়াল হয়, কতদিন পরে আমার ঘরে এমন একজন নারী যে টাকায় কেনা নয়। আমি সােজা হয়ে আসি। আমার কেমন কৌতূহলাে হয়-সন্ধ্যাকে একবার দেখবার জন্যে। একশ আটাশখানা চুমাে আমাকে চারদিকে থেকে হেঁকে ধরে। সন্ধ্যা ঘুমিয়ে আছে। ইস এভাবে ঘুমােয় কেউ? দুপা ছড়িয়ে-যেন একেবারে তৈরি। আমি বহুদিন কোনাে গৃহস্থ রমণীকে এভাবে পা ছড়াতে দেখিনি। সন্ধ্যার ঐ বােকা বােকা চেহারাটাও এখন মনে হয় একতাল কোমল মাংস যেখানে দাঁত বসে যাবে এবং সেই দাঁত একটি চিত্র রচনা করবে, সে চিত্র কেবল নর ও নারী মিলেই রচনা করতে পারে। কখন যে সন্ধ্যা কাছে এসে দাঁড়িয়েছি, আমি নিজেই বলতে পারব না। আমি আবিষ্কার করি, বিছানার পাশে আমি, একদৃষ্টে তাকিয়ে আছি এমন এক মহিলার দিকে যাকে আমি একদা চিনতাম এবং আমার জীবনের প্রথম চুম্বন যার কাছ থেকে পেয়েছিলাম। সন্ধ্যা আমার হাত ধরে টান দেয়। তবে কি সে ঘুমােয়নি? সবটাই ভান? একটি শব্দ সে উচ্চারণ করে না, আমাকে টানে, শত কাছে টানে। আমি সম্মােহিতের মতাে তার বুকের ওপর পড়ে যাই। তখন সে ফিসফিস করে বলে, অংক রাইট হয়েছে? বলেই সে আমাকে চুমাে খায়, ঠিক সেই আগের মততা, নিজেই সে খায়-সেই ছেলেবেলায় আমার যখন বেশ অভ্যেস ও সাহস হয়ে গিয়েছিল, আমি নিজে চুমাে খেয়ে চাইতাম, আমাকে ঠেলে সরিয়ে দিত-এখনাে, এই এত বছর পরেও সে, সন্ধ্যা, আমাকে চুমাে খেতে দেয় না, নিজেই চুমাে খেয়ে চলে-যেন সে পুরুষ আর আমি তার নারী । হঠাৎ আমাকে সে ছেড়ে দেয়। যেন কিছুই হয়নি আমাদের ভেতরে, সে বলে, আরেক কাপ চা করাে তাে। আমি চায়ের পানি চাপাই । আমার কেমন সন্দেহ হতে থাকে, হয়ত, চা খেয়েই সন্ধ্যা আমাকে বিছানায় টেনে নিয়ে যাবে।
সন্ধ্যা চা নিঃশেষে শেষ করে, খুব গভীর চোখে আমাকে অনেকক্ষণ দেখে নিয়ে বলে, আসি। কাল পরশু আবার দেখা হবে। যাবার আগে আমার কাঁধে একটা হাত ক্ষণেকের জন্যে সে রাখে । আর কখনাে সে আসে না। অনেকদিন পরে উত্তরায় গিয়ে খোজ করি। সেখানে ভাড়াটে বসেছে। না, বাড়িওয়ালারা বিলেতেই আছেন। না, তাঁরা শিগগির দেশে ফিরছেন না। আমার পাপ বােধ হয়। হ্যা, আমি নষ্ট, নারীমাংসলােলুপ আমারই হয় পাপবােধ। এই পাপের হাত থেকে বাঁচবার জন্যেই সমাজ বােধহয় বেশ্যা শ্রেণী একদা তৈরি করেছিল। সন্ধ্যার কাছে আমার জীবনের প্রথম চুম্বন-কুমার চুম্বন এবং পরকীয় চুম্বন-এই দুটি চুম্বন আসে। প্রথম চুম্বন হয় পুণ্য, প্রথম চুম্বন হয় পাপ। পরদিনই বান্টির জন্যে মনটা কেমন করে ওঠে। বান্টির সঙ্গেই তাে চুম্বন নিয়ে এক সন্ধ্যেবেলা কত কথা। সে কোন জীবনের কথা। সে কত আগের কথা। বান্টিকে আমি চিঠি লিখি। জবাব আসে না। কিছুদিন পরে আবার চিঠি দেই। এবার চিঠি ফেরত আসে। প্রাপক এখানে থাকে না। আমার বড় ক্রোধ হয়। চা বাগানের ম্যানেজার একজন, বদলি হয়ে গেলে তার চিঠি কি এভাবে প্রেরকের কাছে ফিরে আসবে? নতুন ম্যানেজার পারেন না চিঠি প্রাপকের নতুন ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতে? আমি একদিন বান্টির কোম্পানির ঢাকা অফিসে যােগাযােগ করি এবং সেখানে দুটি সংবাদ শুনে হতবাক হয়ে যাই। প্রথম সংবাদ-বান্টি চাকরি ছেড়ে দিয়েছে এবং কোথায় আছে কেউ জানে না। দ্বিতীয় সংবাদ-বান্টি এক কুলি রমণীকে বিয়ে করেছে। বান্টি বিয়ে করেছে এক কুলি রমণীকে? আমি ওদের ঢাকার বাড়ি চিনতাম-সে অনেক আগের কথা-সেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পর আর ধানমন্ডির সে বাড়িতে যাইনি; খুঁজে খুঁজে বাড়িটি বের করি। বুড়াে এক মালী এসে সমুখে দাঁড়ায়। বান্টির বাবা বাড়িতে কাজের লােকজনদের সঙ্গে উর্দু বলতেন। জানি না কেন? হয়ত বান্টিরা কলকাতার উর্দুভাষী বাঙালি অথবা অবাঙালি কাজের মানুষ ওরা রাখত অথবা বান্টির বাবা বহু মানুষের মতাে বিশ্বাস করত উর্দুই পাকিস্তনিদের একমাত্র ভাষা হওয়া উচিত। আমি উর্দুতেই জিগ্যেস করি, ‘ইয়ে বান্টি সাব কা মাকান হ্যায়? মালী বাংলায় উত্তর দেয়। হ, বান্টি সাবে এইখানে থাকে। আপনে কই থিকা? উনি আছেন? অখন বাড়ি নাই। বাইরে গেছুন। আমি একটা চিরকুট লিখে চলে আসি। প্রিয় বান্টি, আমি আসিয়াছিলাম। তুমি ঢাকায় আছ, আমাকে জানাও নাই, ইহাতে বড় দুঃখিত হইয়াছি। তুমি কি বন্ধুদের ভুলিয়া গিয়াছ? , আমি ভুলি নাই। বান্টি আমার ফ্ল্যাটে এসে উপস্থিত। ঐ চিরকুটে ঠিকানা দিয়ে এসেছিলাম। আশা করিনি বান্টি চিরকুট পাবার সঙ্গে সঙ্গে এসে হাজির হবে। তার চেহারায় অযত্নের ছাপ। মনে হয় কতকাল মুখে সাবান মাখেনি। গাল ভেঙে গেছে। পিঠ নুয়ে পড়েছে। মাত্র তাে দুটি বছর, এর ভেতরে একটা মানুষ এভাবে বুড়িয়ে যেতে পারে আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। কি খাবে? হুইস্কি? বান্টি হেসে বলে-তার হাসিতে আগের সেই নির্মলতা অটুট রয়েছে-না, ধন্যবাদ, হুইস্কি ছেড়ে দিয়েছি। তারা মরে যাবার পর থেকে ছেড়ে দিয়েছি। তারা? আমি অবাক হয়ে জিগ্যেস করি, তারা কে? একটি মেয়ের নাম। আমি তাকে বিয়ে করেছিলাম। আমি লক্ষ্য না করে পারি না, বান্টি ক্রিয়াপদের অতীতরূপ ব্যবহার করছে। তার মানে কি? বান্টি বলে, সে প্রাণত্যাগ করিয়াছে। শেষ দিকে দধি ব্যতীত আর কিছুই সে খাইতে পারিত না। তােমার কি স্মরণ আছে, আমি বলিয়াছিলাম-কুলিরা সপ্তহের তিনচারদিন কেবল কাঁচা চা পাতা সেদ্ধ পানি পান করিয়া ক্ষুধা নিবারণ করে। মনে নাই? হ্যা, আমার মনে পড়ে যায়। এবং আমার মনে পড়ে যায় তারার কথা। তারা সেই মেয়েটি, যে মেয়েটিকে আমি লাইনে দেখেছিলাম। তারাকে আমি আমার শয্যায় চেয়েছিলাম এবং বান্টি আমাকে তিরস্কার করেছিল, পরদিন তাকে বিদায় জানাবার সুযােগ পর্যন্ত আমি পাইনি চলে আসবার সময়-সবই আমার মনে পড়ে দ্রুত চলচ্চিত্রের মতাে। আমি বলি, বান্টি, আমার সব মনে আছে। বান্টি চকিতে চোখ তুলে বলে, সব? তারপর চোখ নামিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে উচ্চারণ করে, তারাকেও।
আমি মাথা নাড়ি হা-সূচক। অনেকক্ষণ আমরা চুপ করে বসে থাকি। হঠাৎ বান্টি বলে, আমাকে যেতে হয়। না, মােকাম্মেল, কাহিনি কিছু নেই যে তােমাকে বলব। না খেয়ে খেয়ে তারার পেটে আসলার হয়ে গিয়েছিল। আমার সঙ্গে বিয়ের পর, আমি অন্য বাগানে নিজেই বদলি নিয়ে চলে যাই, যে-বাগানে তারা কাজ করেছে, পাতা তুলেছে, সেখানে তাকে নিয়ে স্ত্রী হিসেবে ঘর করা যেত না, রক্ষিতা করে রাখলে সবাই মেনে নিত-তাে যাক সে কথা, আমার নতুন বাগানে বাংলােয় সে আর আমি সুখে সংসার করছিলাম। আমি বড় সুখি ছিলাম, না, না, আমার বলা কর্তব্য আমরা উভয় বড় সুখি রহিয়াছিলাম। কিন্তু ঐ যে বলিয়াছি, উহারা চা পাতা সেদ্ধ করিয়া সপ্তাহের তিন চারদিন ক্ষুধা নিবারণ করিত, উহার ফলেই তারার পেটে আমাদের খাবার সহ্য হয় না। আমরা যে মাছ, যে মাংস, যে ডিমকে বড় স্বাভাবিক বলিয়া গ্রহণ করি, উহা এবং ঐ সমস্ত তারার নিকট বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে। আমি চিকিৎসক নহি। আমি বলিতে পারিব না। এমনও হইতে পারে, তারা পেটে পূর্ব হইতেই আলসার সৃষ্টি হইয়াছিখল। আবার এমনও হইতে পারে-সভ্যতা তাহার সহ্য হয় নাই, সভ্য মানুষের আহার্য তাহারর নিকট অমৃত হইবার বদলে বিষ হইয়ালি। সে কেবল কিছুটা দধি গ্রহণ করিতে পারিত। একরাত্রে রক্ত বমন করিয়া সে প্রাণত্যাগ করে। আমি চাকুরিতে ইস্তফা দিয়া ঢাকা
আসি।
ঢাকা? আমি এই উচ্চারণের ভেতর এই কথাটা পুরে দিতে চাই যে, তুমি তাে অরণ্যকে গ্রহণ করেছিলে ঢাকা তথা সভ্যতাকে বর্জন করে, সেই তুমি ফিরে এলে ঢাকায়? বান্টি এখন শুধু বুড়িয়ে গেছে তাইই নয়, তার গ্রহণ শক্তিও ধীর হয়ে গেছে-কথার ব্যঞ্জনা বুঝতে তার এখন বিলম্ব হয়। সে আমার দিকে হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। সুরাপান না করাে, চা কফি? চা? বান্টি ম্লান হাসে। চায়ে উল্লেখ মাত্রে তার হয়ত একটি জগত দুলে ওঠে। বলে, না। আজ নহে অপর কোনােদিন। আমি তারাকে ভালােবাসিয়া ফেলি, এখন মনে হয় তারা আমার নিকট আরণ্যের চেয়েও প্রিয় হইয়া গিয়াছিল। তারাই ছিল আমার অরণ্য। ঢাকায় আসিয়াছি। আমাদের যৌবনের সেই ঢাকা আর নাই। ঢাকাও এখন একটি অরণ্য। অন্যপ্রকার কিন্তু অরণ্য। বান্টি আবার এসেছিল। পরদিন ভােরবেলায়। দরােজায় বেল শুনে বিরক্তই হয়েছিলাম। কে এলাে এই অসময়ে? খুলে দেখি-বান্টি। সারারাত আমি ঘুমােতে পারিনি। বান্টি সােফায় বসে চোরের মতাে আমার দিকে চেয়ে নিচুস্বরে উচ্চারণ করে। কেন?
আমার বড় কষ্ট হয় বান্টির লাল চোখ দেখে। নিশ্চয়ই তারার কথা ভেবে ঘুম হয়নি। তার। কেঁদেছে? বান্টির পক্ষে অসম্ভব নয়। সে বলে, কিছু মনে করাে না, তােমার নামের শেষ অংশ ভুলে গেছি, তাই টেলিফোন এনকোয়ারিতে যে জিগ্যেস করব নম্বর, তাও পারিনি। নইলে রাতেই একটা কোন হয়ত করতাম। বান্টি আমার দিকে এমন চোখে চেয়ে থাকে যেন সে অপেক্ষা করছে তিরস্কৃত হবার জন্যে-তিরস্কার এ কারণে যে, কেন আমাকে রাতে ফোন করে সে বিরক্ত করতে চেয়েছিল? আমার স্কুলের বন্ধু, আমার বাইশ বছরের বন্ধু, তার জন্যে আমার ভেতরটা ভেঙে যায়। তার কাঁধে হাত রেখে বলি, আমারই উচিত ছিল তােমার ফোন নম্বর নেয়া, আমার ফোন তােমাকে দেয়া। আমারই ভুল হয়ে গেছে। খুব জরুরি কথা ছিল? নাহ্, না জরুরি কিছু না। বান্টি চোখ নামিয়ে নেয়। তার চোখে এক ধরনের দীপ্তি খেলা করে জলের নিচে মাছের মতাে। আমি অপেক্ষা করি। কেবল বুঝে পাই না, কি সে বলবার জন্যে সারারাত ঘুমহীন হয়ে ছিল এবং আমাকে বলবার জন্যে। বান্টি হঠাৎ মুখ তুলে বলে, তােমার মনে আছে, আমরা একবার চুম্বনের বিষয়ে কথা কহিতেছিলাম? স্মরণ হয়? হ্যা, হয়। প্রথম চুম্বনের কথা। বান্টি, তুমি জাননা, আমি তােমার সঙ্গে সেই শেষ দেখার পর এমন প্রথম চুম্বনও লাভ করিয়াছি যাহা পাপ ভিন্ন আর কিছুই নহে। কথাটা বলতে বলতেই আমি লক্ষ্য না করে পারি না, আমার কথা বান্টির কানে কিছুই যায়নি; বস্তুত সে আমার কাহিনিতে আদৌ আগ্রহী নয়। এই উপলব্ধি আমাকে আরাে করুণ করে তােলে বান্টির জন্যে।
বান্টি যেন এক দীর্ঘ পথ হেঁটে এসে বলে, তারাকে বিয়ে করে, পয়লা রাতে, বাসর যাকে বলে, বাসরই তাে?-শ্রমিকেরা বড় আনন্দ করিয়াছিল আমাদের বিবাহে, আমার বিবাহ উহাদের প্রথা অনুসারেই হয়, না আমি তাহাকে ধর্মান্তরিত করি নাই, উহাদের আদিবাসী আচার অনুষ্ঠান অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালিত হইয়াছিল। হঁ্যা, বাসর, সেই প্রথম রাত, আমার জীবনের প্রথম চুম্বনের জন্যে যখন আমি মুখ নত করিয়া আনি-না, মােকাম্মেল, লজ্জা করিও না, ইহা বড় পবিত্র আমার নিকটে এবং পুণ্য কথার মতাে আমি সর্বত্র আবৃত্তি করিতে পারি এই কথা যে, আমার প্রিয়তমাকে আমি যখন চুম্বনের নিমিত্তে আকর্ষণ করি তখন সে মুখ ফিরাইয়া লয়। ঘরের ভিতরে একটি হারিকেন ছিল, তাহার লাল আলােয় আকাশচ্যুত পরীটির মতাে তারাকে মনে হইতেছিল। সে আমাকে চুম্বন করিতে দিল না অর্থাৎ তাহার মুখ সে ফিরাইয়া লইল, তারপর আমার হস্ত ধারণ করিয়া আমাকে সে শয্যায় শােয়াইল-এবং স্বয়ং…।
বান্টি বাক্য শেষ করল না, মাথা দুহাতের ভেতর নিয়ে নীরবে অশ্রুপাত করল কিছুক্ষণ। তারপর রুমাল দিয়ে মুখ মুছে, চোখ ঘষে হেসে উঠল। নীরব সে হাসি।। আমিও হাসি। বান্টি বলে, আমি একটি গর্দভ। তােমার মতাে বন্ধুর নিকটেও ইতস্তত করিতেছি। অথচ বলিয়াছি তাে, এ কাহিনি পবিত্র কথা আমার নিকট এবং জনে জনে বলিয়া বেড়াইবার মতাে। তারা আমাকে ধীরে বিছানায় রাখিয়া পদপ্রান্তে দাঁড়াইল, আমার দিকে অপলক চাহিয়া রইল কিছুক্ষণ, তারপর ধীরে, অতিধীরে সে নত হইল, সে নত হইতে লাগিল-বান্টি যেন চোখের সমুখে আবার সব দেখছে এমনি চোখে বলে যেতে থাকে, তাহার পর তারা তাহার মুখ আমার দুই পায়ের ফাঁকে রাখিয়া কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলাে। আমি কি করিব বুঝিতে না পারিয়া স্থির পড়িয়া আছি। হঠাৎ অনুভব করিলাম একজোড়া ঠোট। হ্যা, তারা আমার পদচুম্বন করিতেছে। কিছুক্ষণ দৃশ্যটি যেন সে মনের মধ্যে দেখে নেয়, বারবার দ্যাখে। আমি চুপ করে থাকি। আমার মনের মধ্যে গ্লানি হয়, একদিন তারাকে আমি আমার শয্যায় চেয়েছিলাম এবং একদিন আমি ভেবেছিলাম তারা হয় বান্টির রক্ষিতা। বান্টি বলে, প্রিয় বন্ধু, তুমি কি বিশ্বাস করিবে, তারাকে আমি কখনাে ওষ্ঠে চুম্বন করিতে পারি নাই। যখনি চাহিয়াছি, সে বলিয়াছে-আহ! সে কিভাবে, কত কোমলতা লইয়া এই কথা উচ্চারণ করিত, মােকাম্মেল, আমি তােমাকে বলিয়া বুঝাইতে পারিব না-সে বলিত, পতি, আমি তােমার সমকক্ষ নহি, আমার ওষ্ঠ কেবল তােমার চরণযুগলের জন্যে ।
অনেকক্ষণ পরেও যখন বান্টি আর নতুন উচ্চারণ করে না, আমি বলি, বান্টি, আমার মনে হয়, এখন থেকে আমাদের নিয়মিত দেখা হােক। পুরনাে বন্ধুত্ব ছাড়া আর কি আছে বলাে এখন আমাদের? বান্টি আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। আমার হাত তার হাতের ভেতরে নিয়ে ছােট একটা চাপড় দেয়, দিয়ে বলে, হঁ্যা, সত্য। তারপর দ্রুত সে রুমাল বের করে চোখের উদ্ধত অশ্রু সামলে নেয়। আমি দীর্ঘনিশ্বাস চেপে রাখতে গিয়েও ব্যর্থ হই। আমার মনে পড়ে যায় সেই কথা, বান্টি বলেছিল-আমাকে করুণা করিও না। আমার কানের কাছে মুকুল সিনেমার সমুখে আইয়ুব খানের পুলিশের গুলির শব্দ হয় এবং একের পর এক লাশ পড়ে যেতে থাকে। জানাে, মােকাম্মেল, পৃথিবীর প্রতি, সংসারের প্রতি, আমার পিতার প্রতি সমস্ত ক্রোধ আমার ধৌত হইয়া যায় তারার প্রেম স্পর্শে। তারা যখন মৃত্যুশয্যায়, ডাক্তার বলিয়া গিয়াছেন-এখন শুধু মিনিটের অপেক্ষা, আমি তারার ঘর হইতে সকলকে বাহির করিয়া দেই। আমরা যখন একা যখন সম্ভবত মৃত্যুর দূর ভিন্ন আর সে কামরায় কেহ অপেক্ষা করিয়া নাই, আমি তারাকে নাম ধরিয়া ডাক দেই, সে চক্ষু মেলিয়া চাহে। আমি তাহার মুখ দুই হাতে একবার বুলাইয়া পদপ্রান্তে আসিয়া বসি। বলি, তারা তুমি চলিলে, আমি রহিলাম, আমার চুম্বন লইয়া তুমি যাইবে এবং এই চুম্বন স্বর্গে তােমাকে স্মরণ করাইবে আমার কথা।-মােকাম্মেল, তারা এই কথা শুনিয়া ম্লান হাসিল, যেন প্রথমবার চাদ দেখা দিয়াই কোথায় হারাইয়া গেল। সে চক্ষু মুদিল, আমি ঠিক তাহারই অনুরূপ, সেই বাসর রাত্রে সে যেমন দিয়াছিল, আমি তাহার দুই চরণে আমার চুম্বন রাখিলাম। আমার প্রথম চুম্বন।