নৈশভিশার – গিয়ােভানি বােকাসিও

›› অনুবাদ  ›› সম্পুর্ণ গল্প  ›› ১৮+  

অনুবাদঃ অবনী সাহা
উৎসঃ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ আদি-রসের গল্প
সম্পাদনাঃ সুকান্ত সেনগুপ্ত

বেশী দিনের কথা নয়। উপত্যকায় একটি সাচ্চা লােক বাস করতাে। পথ চলতি লােকদের খাদ্য-পানীয় যুগিয়ে সে সৎভাবে পয়সা রােজগার করতাে। লােকটি গরীব। তার কুটিরটিও ছােট। কিন্তু তবু বিপদে আপদে পড়লে রাতের মতাে লােকেদের থাকার জায়গা দিতাে। তবে তারা তার পরিচিত হওয়া চাই। এই লােকটির বউটি পরমাসুন্দরী। দুটো মাত্র সন্তানের জননী। বড় মেয়েটি যেমন সুন্দরী তেমনিই আকর্ষণীয়। বয়স পনেরাে কি ষোল। আর কোলেরটির বয়স বছর পরেনি। মায়ের দুধ খায় এখনও।

কন্যাটি ফ্লোরেন্সের এক সুন্দর ছােকরার দৃষ্টি কেড়েছে। সে ছােকরাটি মেয়েটির প্রেমে হাবুডুবু খাচেছ। কন্যাটিরও সেই দশা। সে প্রেমের স্বীকৃতি দিতেও দুজনে প্রস্তুত, কিন্তু হলে কি হবে পিনুসিও (ছােকরাটির নাম তাই বটে) মেয়েটি বা নিজেকে ধরা দিয়ে, বকুনি খেতে চায় না।

অবশেষে, প্রেমের স্রোত যখন বাঁধ মানে না, পিনুসিও যখন মেয়েটির সঙ্গলাভের জন্য লালায়িত, ভাবলে যা ঘটে ঘটুক, যে ভাবেই হােক একটা রাত মেয়েটির বাপের ঘরে থাকার ব্যবস্থা করতেই হবে। আর তাহলে মেয়েটির সঙ্গসুখ সে পেতে পারবে। আর যেই নাকি এই চিন্তা তার মাথায় ঢুকলাে, সঙ্গে সঙ্গে তা কাজে পরিণত করার জন্য তৎপর হলাে সে।

একদিন বিকেলে, সে আর তার বিশ্বাসী সঙ্গী অ্যান্ডিয়ানাে যে নাকি মেয়েটির সঙ্গে ভাব ভালবাসার কথা জানতাে, এক জোড়া ঘােড়া ভাড়া করলাে। তাতে থলেতে মাল চাপালাে (মাল বলতে সম্ভবত খড় দিয়ে ভর্তি থলে) যেন ফ্লোরেন্সের থেকে আসচে এমন ভান করে মাগনান উপত্যকায় এসে হাজির হলাে। আর তা এমন সময় যে সময়ে রাত নেমেছে। এসে কড়া নাড়লাে দুজনে। আর যেহেতু পিনুসিও এবং অ্যান্ডিয়ানাে দুজনেই পরিচিত, কাজেই দরজা খুলে বাইরে এলাে বাড়ীওয়ালা। পিনুসির বললাে, রাতের মতাে আমাদের একটু আশ্রয় দিতে হবে। আমরা আঁধার নামার আগেই ফ্লোরেন্সে পোঁছবো আশা করেছিলাম, কিন্তু দেখছেনই তাে, আমরা এ পর্যন্ত আসতেই রাত হয়ে গেলাে। এখন সহরে ঢোকার পক্ষে খুব দেরী হয়ে গেছে।

গৃহকর্তা বললেন, প্রিয় পিনুসিও, তুমি তাে জানই, আমি তােমাদের রাজসিক থাকার ব্যবস্থা করতে পারবাে না। কিন্তু কি আসে যায়, রাত যখন হয়েছেই, আর তােমাদের যখন কোথাও থাকার জায়গা নেই, আমি খুশী মনে যতটা পারি তােমাদের থাকার ব্যবস্থা করবাে।

কাজেই দুই ছােকরাই ঘােড়া থেকে নামলাে। যখন দেখলাে তাদের ঘােড়া দুটো ভালভাবেই আস্তাবলে ঢুকেছে, তারা নিজেরাও ঘরে ঢুকলাে। তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা ছিলাে ভালােই। বাড়ীওয়ালার সঙ্গেই তারা নৈশভােজন সারলাে। এবার শােবার পালা। একটি মাত্র ছোট ঘর। তার মধ্যে তিনটি ছােট ছোট শােবার ব্যবস্থা। ফলে স্থান এত সংকীর্ণ যে ঘরে চলাফেরা করা মুস্কিল। দুটো বিছানা একদিকের দেওয়ালের দিকে। তৃতীয়টি তার উল্টো দিকে। তৃতীয় শয্যাটিই অপেক্ষাকৃত আরামদায়ক বলে গৃহকর্তা অতিথিদের সেটায় শুতে অনুরােধ করলাে। তারা ঘুমলে (আসলে মােটেই তারা ঘুমােইনি কিন্তু) মেয়েকে অন্য একটি শয্যায় শুতে দিয়ে নিজে তার বউকে নিয়ে অন্য আর একটিতে শুয়ে পড়লাে। বউয়ের পাশে বাচ্চার ছোট্ট খাটটা।।

মনে মনে এসবের ছক মাথায় নিয়ে পিনুসিও অপেক্ষা করতে লাগলাে যতক্ষণ সে না নিশ্চিত হলাে যে প্রত্যেকেই ঘুমিয়ে পড়েছে। তারপর চুপিসারে বিছানা ছেড়ে তার প্রেমিকার বিছানার দিকে এগিয়ে যেয়ে তারপাশে শুয়ে পড়লাে। মেয়েটি আগেই এই অভিসন্ধি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলো। ফলে চরম আশ্লেষে দুহাত দিয়ে তাকে টেনে নিলো নিজের দিকে। তারপর তারা এতদিন ধরে যে সুখের জন্য প্রতীক্ষা করছিলাে, তা শুরু করলাে।

এদিকে পিনুসি ও মেয়েটি যখন ঐ কাজে লিপ্ত, একটা বেড়াল কোথাও কি যেন ফেলে দিয়ে বসেছে। শব্দ পেয়ে গিন্নি চমকে উঠলাে। কী ঘটেছে দেখায় জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠে বসলাে। তারপর যেদিক থেকে শব্দটা আসছিলাে অন্ধকারে সেই দিকে হাতড়াতে হাতড়াতে এগিয়ে গেলাে।

এর মধ্যে আবার আরেক কাণ্ড। অ্যান্ডিয়ানাে উঠে বসেছে। না, ওজন্য নয়। বাইরে যাবে বলে। অন্ধকারে দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই ঠেকলাে বাচ্চার খাটটি। তা সরিয়ে সে বাইরে গেলাে। কিন্তু ফেরার সময় ছােট খাটটি সরিয়ে রেখে আসতে ভুলে গেলাে।

এদিকে মহিলাটি বেড়ালের খোঁজে বেরিয়ে যখন নিশ্চিন্ত হলাে না, তেমন কিছু পড়ে যায় নি, তখন তার নিজের বিছানার দিকে ফিরতে লাগলাে। বাতি জালাবার ঝামেলায় গেলনা সে। অন্ধকারের মধ্যেই সতর্কভাবে এগুতে লাগলো যে বিছানায় তার স্বামী শুয়ে আছে। কিন্তু বাচ্চার দোলনার খাটটির নাগাল পেয়ে নিজের মনেই বললাে, আমি কী বােকা, আমি কিনা ভুল করে আমাদের রাতের অতিথিদের বিছানার দিকে যাচ্ছিলাম।

সুতরাং সে আরও একটু এগিয়ে গেলো। খাটটাও হাতে ঠেকলাে। নিশ্চিন্ত হয়ে সে অ্যান্ডিয়ানাের পাশে যেয়ে শুয়ে পড়লাে। ভাবলো স্বামীই শুয়ে আছে।

অ্যান্ডিয়ানাে জেগেই ছিলাে। ব্যাপারটা বুঝতে তার দেরী হলো না। কাজেই অভ্যর্থনাটা খুব আন্তরিকই হলাে। কোন শব্দ না করে সে ঘন চুম্বন ও আলিঙ্গনে তাকে তৃপ্তি ও আনন্দ দান করতে লাগলো। এদিকে ঘটনা দাঁড়ালাে পিনুসিও তার এতদিনের সাধ মিটিয়ে উঠে দাঁড়ালাে। কে জানে যদি প্রেমিকার বাহুবন্ধনে সে ঘুমিয়ে পড়ে। সুতরাং নিজের বিছানার দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে চললাে সে। কিন্তু শয্যার কাছে যেতেই দোলনা খাটটা ঠেকলো। ভাবলো, তবে তো এটা কর্তার খাট। কাজেই সে এগিয়ে যেয়ে যে বিছানা পেলাে সেটায় শুয়ে পড়লাে। আসলে শুলাে সে কর্তার পাশে। আর তাকে অ্যাড্রিয়ানাে ভেবে, অনুচ্চ কণ্ঠে বলতে লাগলো, আমি তােমাকে শপথ করে বলিনি, নিকোলোসা মতাে এমন সুস্বাদু বস্তু আর কোথাও নেই। ঈশ্বরের নামে বলছি। কোন লােক কোন মেয়েকে ভােগ করে এমন আনন্দ পায়নি যা নাকি আমি তার সঙ্গে পেলাম এতক্ষণ ধরে। তােমাকে নিশ্চিত বলতে পারি কমপক্ষে ছ’বার আমি সে স্বাদ পেয়েছি।

সত্যি বলতে কি, পিনুসিওর কথায় কর্তার খুশী হবার কথা নয়। প্রথমে সে ভাবলাে, ছোকরা কী করছিলাে তার বিছানায়। তারপর রাগ সামলাতে না পেরে বলে উঠলাে এই পিনুসিও, এ কোন ধরণের শয়তানী হে? আমার সঙ্গে চালাকী খেলবে ভাবিনি। দাড়াও, তােমাকে আমি উচিত জবাব দেবাে।

এখন হয়েছে কি, পিনুসিও বুদ্ধিমান ছোকরা নয় মােটেই। নিজের ভুল বুঝতে পেরে কোথায় সে তার ভুল শুধরাবে, তার বদলে সে বলে উঠলাে, আমাকে ফেরৎ জবাব দেবে ? কিভাবে? তুমি আমার কি করতে পারবাে?

অন্যদিকে গৃহকর্তার স্ত্রী, যে নাকি ভেবেছে স্বামীর সঙ্গেই শুয়ে আছে, অ্যান্ডিয়ানােকে বললো, হায় ভগবান, দ্যাখাে আমাদের অতিথিরা দুজনে কেমন তর্ক জুড়েছে।

অ্যান্ডিয়ানাে হেসে উত্তর দিলাে, করতে দাও। জাহান্নামে যাক। দুজনে কালরাতে বেশ টেনেছে।

মহিলাটি কিন্তু এতক্ষণে তার স্বামীর  ক্রব্ধ কণ্ঠ ধরতে পেরেছে। অ্যাড্রিয়ানাের গলা শুনে সে তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারলাে কার বিছানায় শুয়ে আছে। কিছু বুদ্ধি সুদ্ধি রাখে মহিলাটি, আর একটিও কথা না বলে সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়লাে সে। ছেলের দোলনা খাটটি সরিয়ে বড় মেয়ের খাটের পাশে রাখলো। তারপর অন্ধকারেই বড় মেয়ের পাশে যেয়ে শুয়ে পড়লাে। তারপর, যেন স্বামীর চেচামেচিতেই ঘুম ভাঙলাে এই ভাণ করে, স্বামীকে ডেকে বললো, কী হয়েছে? পিনুসিওর সঙ্গে ঝগড়া করছাে কেন? তার স্বামী উত্তর করলাে। শুনছো, না, ও বলছে, রাতে ও নিকোলোসার সঙ্গে কী করেছে ?

আরে, ও এক কড়ি মিধ্যে কথা বলছে। মহিলাটি উত্তর দিলো। ও নিক্কোলােসার ধারে কাছে ছিলাে না। আমি নিজেই তাে সারাক্ষণ নিকেকালােসার পাশে শুয়ে। এক চিমটি ঘুম আসেনি আমার। তুমি একটা বােকা তাই ওর কথায় গুরুত্ব দিচ্ছাে। তােমরা পুরুষেরা সন্ধ্যায় এতাে মদ গেলাে যে সারারাত সপ্ন দেখো আর ঘুমের মধ্যে সারা ঘুরে ঘুরে বেড়াও। কল্পনা কর যে সব অলৌকিক কর্মই তােমরা করে ফেলেছো। হাজার গুণ ভাগ্য যে তােমরা উল্টে পড়ে পা ভাঙো না। তা পিনুসিও ওখানে কী কাণ্ড করছে । সে তার নিজের বিছানায় নেই কেন ?

দেখুন, কী কায়দায় মহিলাটি নিজের এবং মেয়ের ইজ্জৎ বাঁচালাে।

অ্যাড্রিয়ানােও তার পক্ষে সাক্ষ্য দিতে যেয়ে বললাে, আমি তােমাকে আর কতবার বলবাে পিনুসিও যে রাত দুপুর হেটে বেড়িও না! একদিন দেখাে কী বিপদে পড়বে, এই তোমার ঘুমের মধ্যে হেটে চলার জন্যে আর ঐ যে তুমি যা উভট কাণ্ড করছেো বলে স্বপ্ন দেখাে।

তার স্ত্রীর কথায় অ্যাড্রিয়ানােকে সায় দিতে শুনে, গৃহকর্তা ভাবতে লাগলেন, হ্যা ঠিকই, পিনুসিও স্বপ্নই দেখছিলাে। তার কাঁধ ঝাঁকি দিয়ে কর্তা বললাে, এই পিনুসিও জেগে ওঠো! তােমার বিছানায় ফিরে যাও।

সব যখন ঠিক ঠাক, তখন পিনুসিও আবার ঘুমিয়ে পড়ার ভান করতেই গৃহকর্তা হাে হাে করে হেসে ওঠলাে।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত, অনেক ঝাকুনি খেয়ে সে জেগে ওঠার ভাণ করলাে। তারপর অ্যাড্রিয়ানােকে উদ্দেশ্য করে বললাে, আমাকে জাগালে কেন? সকাল হয়েছে ?

উত্তর দিলাে অ্যান্ডিয়ানাে , আজ্ঞে হ্যা। এখানে চলে এসাে।  পিনসিও তার ভণিতা বজায় রাখলাে। দেহে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হওয়ার প্রতিটি চিহ্ন ফুটিয়ে তুললাে। অবশেষে গৃহকর্তার পাশ থেকে উঠে, নিজেদের বিছানায় ফিরে এলাে। পরদিন ভােরে যখন তারা শয্যা ত্যাগ করলাে তখন পিনুসিও ও তার স্বপ্নের কথা নিয়ে কর্তার কী হাসাহাসি।

সেই আনন্দ উল্লাসের মধ্যে দুটি তরুণ ঘােড়ায় জিন পরালাে, মাল চাপালাে, তারপর পরস্পরের স্বাস্থ্য পান করে, পুনরায় ঘােড়ায় চড়ে ফ্লোরেন্সের দিকে রওনা দিলাে। রাতের কাণ্ড কারখানার জন্য কম আনন্দ হয়নি তাদের।

তখন থেকে পিনুসিও তার ফিয়াসীর সঙ্গ মেলার জন্য অন্য উপায় বাৎলাত লাগলো। আর কন্যাটি মাকে নিশ্চিত করলাে এই বলে, যে সে রাতে পিনুসিও নির্ঘাৎ সপ্ন দেখছিলাে।

ফলে মহিলাটি, যে নাকি অ্যাড্রিয়ানাের সুখ আলিঙ্গনের প্রতিটি স্মৃতি মনে রেখেছে, সেই শুধু দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে থাকলাে, যাক সেই শুধু সে রাতে জেগেছিলাে তাহলে।

Leave a Reply