বর্ষা আকাশের ঋতুর সময়, যেমনটা ঠাকুর ভাবতেন।
যোনি দিয়ে বেড়িয়ে আসে পুরোনো আবেগ,
নতুন আবেগ জন্মে আবার পুরোনো হয়ে যায়, বর্ষা আরও গভীর হয়….
আকাশ কি জানে ওর আবেগ মাপা হয় সেন্টিমিটার আর মিলিমিটারে?
মোটা চামড়ার জলীয়বাষ্প ঠেলে এবং উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রাম-মফঃস্বল ভেঙে, রাধিকাপুর এক্সপ্রেস রাত শেষে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে ক্লান্ত হয়ে হাঁপাচ্ছে। একরাশ দুশ্চিন্তা আর স্যাঁতস্যাঁতে ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে প্ল্যাটফর্মে মাথা নিচু করে বসে পড়ল বিপ্রতীপ। নিজের ঘামের গন্ধেই গুলিয়ে উঠছে শরীর। খুলির মধ্যে বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজছে, এই বুঝি মুণ্ডুটা খসে পড়বে। তা সত্ত্বেও পুরো ঘটনাটা মাথায় একবার কষে নিতে চাইছে সে। মন আর মস্তিষ্কের মধ্যে চলছে তাত্ত্বিক মল্লযুদ্ধ।
কানে ভেসে আসা এক্সপ্রেসের শেষ ভোঁ-ডাকটা, ছোট মাসি আর চুটকির কান্নার মতো শোনাচ্ছে – অবসাদ ভোলাতে সাম্যবাদী মন ভেবেছে শ্রমিকের কান্না। আসলে খুব
ছোটবেলাতেই মনের বিস্তর জমি লিখে দিয়েছিল দুখু মিয়াঁর নামে। তাতে অবশ্য বেশ লাভই হয়েছে ওর। বন্ধুমহলে বিপ্লবী স্বভাবের সুখ্যাতি এবং সমৃদ্ধি প্রাপ্তি তারই ফলশ্রুতি। তবে পিছনে যে কেউ ওর নিন্দে বা মশকরা করত না এমনটা নয়। দশম শ্রেণীতে একদিন ইংরেজির মাস্টারমশাই নীলকণ্ঠবাবু পড়া বুঝিয়ে দেবার অছিলায় যখন দেবস্মিতার চুল-পিঠ ঘুরে বুকের কাছাকাছি নিজের কুৎসিত দুর্গন্ধময় হাতের থাবা বসিয়েছে, ক্লাসের কেউ কিন্তু টু-শব্দটুকু করে নি। কেউ কেউ দেখেও না দেখার ভান করছে, কেউ নিস্পলক দৃষ্টিতে নীল হাতের গতিপথ মেপেছে, আবার কেউ সবটা দেখে বেঞ্চে মুখ রেখে হেসেছে। হয়ত নীলকণ্ঠের হাত দিয়ে এরাও নিজেদের বিষ ঢেলে দিতে চেয়েছে দেবস্মিতার শরীরে। হয়ত ভেবেছে, দশম শ্রেণীর কোনও মেয়ের এমন ঘন বুক থাকতে নেই, নইলে মেয়ের আব্রু বাঁচে না। বিপ্র কিন্তু স্থির থাকতে পারে নি। জ্যামিতির বাক্স থেকে কম্পাস বের করে সজোরে বার কয়েক বসিয়ে দিয়েছে নীলকণ্ঠের কালো লোমশ হাতের উপর। ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এসেছে রক্ত। দেবস্মিতা একভাবে দেখে চলেছে বিপ্লকে, চোখের পাতারা ভাষা হারালে যেমন হয়। বিপ্র তখনও নিস্তেজ হয় নি, খান দুয়েক কাঁচা খিস্তি দিয়ে নীলকণ্ঠকে মাটিতে ফেলে বেধড়ক কেলিয়ে গেছে। শেষে প্রাণে বাঁচতে বিপ্লর বুকে জোরালো একটা লাথি মেরে কমন রুমের দিকে দৌড়ে পালিয়েছে নীলকণ্ঠ। বেকায়দায় লাথি খেয়ে বিপ্লর তখন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, দেবস্মিতা নিজের জলের বোতল থেকে জল খাইয়ে বুকে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সৌম্য, অভি, রাকেশ, তন্ময়রাও বিপ্লর পাশে এসে বসেছে ইতিমধ্যেই। বিপ্র সব স্পর্শদের অগ্রাহ্য করে কেবল দেবস্মিতার স্পর্শ অনুভব করছে। যাকে মনে মনে এক বছর ধরে চেয়েছে, ভালবেসেছে সঙ্গোপনে, তার স্পর্শে পরম স্বস্তি অনুভব করছে এখন। না, ঠিক কামনা করেনি, অন্তত শরীরের কামনা তো করেইনি বিপ্র, সঙ্গ প্রত্যাশা করেছে শুধু। কামনা বাসা বাঁধতে এখনও বছর তিনেক বাকি। আসলে গাঁ-মফঃস্বলের নবম-দশম শ্রেণীর ছেলেদের মন সরলরৈখিক, মনের মানুষের সঙ্গ প্রাপ্তিকেই প্রেম ভাবে। ওদের কাছে শাহরুখ আজও সেরা, রণবীর-শাহিদরা জায়গা পায়নি এখনও। এই বাড়ন্ত বয়সে বড় জোর কোনও মেয়েকে “আমি তোমাকে ভালোবাসি” লিখে চিরকুট ছুঁড়েছে। পরে অবশ্য নিজেদের এই স্পর্ধায় লজ্জিত হয়ে এক সপ্তাহ স্কুল কামাই করতে বাধ্য হয়েছে। বিপ্র এমন স্পর্ধা কখনও দেখায়নি, এসব ওর পছন্দ নয়। ওর বিশ্বাস, ভালোবাসা যদি ব্যক্ত করতেই হয়
তবে তার বহিঃপ্রকাশ হোক কবিতায়, গানে। যে প্রেমে কাব্য প্রশ্রয় পায়না, সঙ্গীত অর্থহীন, সে আবার কীসের প্রেম? কীসের সম্পর্ক? বিগত এক বছরে দেবস্মিতাকে ঘিরে সঙ্গোপনে সৃষ্টি করেছে দশটি কবিতা। এইবার বুঝি সেই কবিতাদের আত্মপ্রকাশের সময় ঘনিয়ে এসেছে। দেবস্মিতার মনে যে সামান্য হলেও প্রেমাঙ্কুর জন্ম নিয়েছে, তার আভাস বিপ্ৰ স্পর্শেই বুঝেছে। কিন্তু, এই রোম্যান্টিক বাতায়ন হেড স্যারের অকস্মাৎ আগমনে সম্পূর্ণ উবে গেল। ক্লাসে ঢুকেই তিনি বিপ্লকে কান ধরে বের করলেন। তারপর সপাটে দুটো থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন ওর গালে, যে গাল খানিক আগেও প্রেমের উষ্ণ স্পর্শ উপভোগ করছিল। এমন সময় বিপ্র যা চেয়েছিল ঠিক তাই ঘটল। দেবস্মিতা কাঁদতে কাঁদতে পুরো বিষয়টা হেড স্যারকে বুঝিয়ে বলল। বিপ্লর সমর্থনে দাঁড়াল অভি, সৌম্য, তন্ময়, স্কুল মনিটার দ্বাদশ শ্রেণীর আনোয়ারদা, সঙ্গে পলাশদা, প্রণয়দা, অভিষেকদা নীলকণ্ঠ বাবুর ভেজা বেড়াল প্রতিমূর্তির আড়ালে যে ভয়ানক নারীখেকো কেউটের বিষ দাঁত লুকিয়ে রয়েছে, এক নিমেষেই তা প্রমাণ সমেত উন্মোচিত হল। প্রমাণ হিসেবে বেরিয়ে এল কিছু সেক্স-চ্যাট। দ্বাদশ শ্রেণীর মধুপর্ণাদিকে একাধিকবার কুপ্রস্তাব দিয়ে জ্বালিয়ে মেরেছে বিষধরটা। এতদিন সবাই চুপ করেই সহ্য করেছে, কিন্তু আজ সব সীমা ভেঙেছে। প্রায় পুরো স্কুল বিপ্লর পক্ষে দাঁড়িয়ে। ওদিকে শিক্ষকদের একটি মহল বিপ্রর বহিষ্কারের দাবীতে অনড়। তাতেও অবশ্য বিশেষ সুবিধে হয়নি নীলকন্ঠের। বরং স্থানীয় পত্র-পত্রিকার সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তরে নীলকণ্ঠকেই অনির্দিষ্টকালের জন্য সাসপেন্ড করা হয়। পরো ঘটনায় প্রাপ্তি কেবল বিপ্লর। দেবস্মিতার সঙ্গে বন্ধুত্ব আরও ঘন হবার এই তো অবকাশ! ক্লাসে বা টিউশনে এরপর থেকে যখনই দেবস্মিতার আগমন হয়েছে, কিছু ছেলের আড়াল থেকে “বিপু… বিপু…” বলে সমস্বরে চাপা চিৎকার বেড়েছে। দেবস্মিতাও বিপ্লর নাম শুনলেই ঠোঁটের কোণেও হত একটা হাল্কা লাজুক হাসির আভা বিকিরণ- বিচ্ছুরণ। এই ভাবেই বেশ চলছিল, অবশেষে প্রতীক্ষার অবসান ঘটাল বিপু নিজেই। দ্বাদশ শ্রেণীতে বায়োলজির টিউশন থেকে ফেরার পথে বিপ্র দেবস্মিতার হাত ধরে একটি ছোট্ট স্বরচিত কবিতা পড়ে শোনাল,
অস্পৃশ্য
ভালোবাসার কথা হলে
কেন ঠোঁটেৱাই এগিয়ে আসে বারবার?
বিচ্ছেদে জিভেরা থুতু ছেটায়,
চুমুর নেপথ্যে হাসুক না জিরান্ত… কান্নায় জেদেরা সম্প্রীতি আঁকে মন দিয়ে,
ভয় হয়!
প্রতীক্ষায় ঠোঁটেরা হিমালয় তুলে দিলে,
আমি চাইলেও আর তোর ঠোট ছুঁতে পারব না।
স্কুলে বিপ্লর প্রেমময় কন্ঠের তারিফ অনেকেই করেছে, ওর কলমের প্রশংসাও করেছে সব্বাই। তবে, এই বিশেষ মুহূর্তে পাঠ শেষে বড় উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে বিপ্রকে। মনের মানুষের প্রতিক্রিয়ার প্রত্যাশায় ওর শরীর ঘেমে উঠেছে। দেবস্মিতা বিপ্রর বাঁ গালে পরপর দু’বার চুমু বসিয়ে, জড়িয়ে ধরে বলল, “আমায় খুব ভালবাসবি? বেশি কিছু চাই না, আমি চাই তুই আমি এই ভাবেই একসঙ্গে শেষ দিন অবধি… কী রে থাকবি তো??”
জবাবে “নিশ্চয়ই” বলে আলতো করে দেবস্মিতার ঠোঁটে চুমু রাখল বিপ্র। এই প্রথম কোনও মেয়ের এতটা কাছাকাছি এসেছে বিপু – এই প্রথম কোনও মেয়ের মুখের গন্ধ, ঘামের গন্ধ, লালার স্বাদ সবটা নি মেখে নিচ্ছে। মানুষ বুঝি এই মুহূর্তগুলোর গুলোর জন্যই ভালোবাসে। দেবস্মিতারও পাগল হতে ইচ্ছে করছিল। তাই অজান্তেই বিপ্লর ঠোঁটে লঘু কামড় বসিয়ে দিয়েছে। হরমোনের জৈবিক সম্মোহন কাটতেই আবার বিকে করল, “আচ্ছা, তুই তো ভালো রেজাল্ট করে কলকাতায় চলে যাবি। আমি তোর মতো পড়াশোনায় ভালো নই, বাবা-মাও আমাকে কলকাতা যেতে দেবে না। তুই ভুলে যাবি না তো?” বিপ্র আরও শক্ত করে দেবস্মিতাকে জড়িয়ে ধরে, “তোর থেকে আমাকে কেউ কোনোদিন আলাদা করতে পারবে না। শুধু নিজের খেয়ালটুকু রাখ। চারদিকে নীলকন্ঠের মতো শয়তানরা বিষদাঁত বের করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর কেনই বা উল্টোপাল্টা ভাবছিস? তুই আমি দু’জনই ভালো নম্বর নিয়ে একসঙ্গে কলকাতা যাব। আমি বিশ্বাস করি, আমরা পারবই।”
নীলকন্ঠের নাম শুনতেই দেবস্মিতা নিজের বুকের দিকে একবার তাকাল। এই দু’বছরে ওর বুক আরও ঘন হয়েছে, মাঝে মধ্যেই ওর ইচ্ছে হয় নাজেলীর মতো নিজের স্তন দুটো উপড়ে ফেলতে, কিন্তু পারে না। ও জানে, ঠিক যেমন একজন নারী পুরুষের মন শরীর সবটা ভালোবাসে, পুরুষও তাই। হতে পারে পুরুষের মনে শরীরের কদর বেশি, তবে বিপ্লর মতো পুরুষরা নারীর মনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়। ও জানে বাড়ন্ত বয়সে বেড়ে চলা নারীর মন থেকে শুরু করে শরীরের ভাঁজ, সবটা জুড়েই পুরুষের প্রেম। বিপ্লকে দেবস্মিতা আদর করে নাম দিয়েছে ‘রাজ’, বিপ্রও মনের মানুষকে ‘সোনামণি’ বলে ডাকে। দেবস্মিতা নামটাও বড্ড প্রিয়, কিন্তু বাড়ির ডাকনাম ‘রিম্পা’ – এই নাম যেন ঠিক ওর ধরে না।
তখনও মোবাইলের এত স্বাভাবিক প্রচলন শুরু হয় নি। আদরের গল্পগুলো চিঠিতে লিপিবদ্ধ করে রাখে ওরা। পরের টিউশনে আবেগের বিনিময় হয় সেই চিঠি মারফৎ। কিন্তু যে আশঙ্কা দেবস্মিতার মনে সেই সন্ধেবেলায় দানা বেঁধেছিল, তা সত্যিই হল শেষমেশ। নিয়তির অমোঘ নিয়মে, বিপু চলে এল কোলকাতায়, ভর্তি হল স্কটিশ চার্জ কলেজে, রসায়ন বিভাগে। এতে অবশ্য প্রারম্ভিক আনন্দ পেয়েছিল দু’জনই, কিন্তু এই লম্বা দূরত্বের প্রেম ওদের দু’জনের কাছে ক্রমশই দুর্বিসহ হয়ে উঠল। একদিকে যেমন পড়াশোনার চাপ বেড়ে চলেছে বিপ্রর, অন্যদিকে স্বল্প নম্বরে পাড়া গাঁয়ের কলেজেও ঠাই না পেয়ে দেবস্মিতার মনে বাড়ছে অবসাদের শাসন। অগত্যা বাবার আদেশে বি.সি.এ । পড়তে ভর্তি হল বাড়ির কাছেই একটি বেসরকারি সংস্থায়। বছর যেতে না যেতেই বিপ্লর সাফল্য আকাশ ছুঁয়েছে, রসায়নে প্রথম বর্ষে দারুণ ফল, আর দেবস্মিতার স্বপ্নের পাহাড় ধ্বসে -একটু করে। । কি আর জানতো ওই বেসরকারি সংস্থাটি ভুয়ো! শিক্ষার টাকা আত্মসাৎ করার ফাঁদ! এই নিয়ে বাবার সঙ্গে কতই না সন্ধান করে অহরহ যখন পড়ছে একটু-এ আড়ালে ছারা বছর যেতে সাধারণ মানুষের টাকা আত্মসাৎ করার মুহূর্তের ঝগড়া, কতই । অভিমান ওর। মানুষের মন এমনই মানুষ চরম নিঃসঙ্গ বোধ করে, ব্যর্থতা এসে তার পারদ চড়ায়, ঠিক এই সময়গুলোতে নিজের সব থেকে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে নিজের মন। নিজে তো মরেই, মানুষটাকে ও খেতে শুরু করে হায়নার মতো। তার মানে এই নয় যে বিগত একবছরে ওদের দু’জনের দেখা হয় নি। হয়েছিল তো… বার চারেক… ওই ঘণ্টা খানেক সময় ধরে ওদের স্পর্শ বিনিময়ের খেলা। সর্বসাকুল্যে চারটে ঘণ্টা, এক বছরে কেবল এই চারটে ঘণ্টা ওরা মুখোমুখি সময় কাটিয়েছে। বিপ্লর কাছে এ-সবই চরম প্রাপ্তির মুহূর্ত। আসলে হোস্টেলের সদাচঞ্চল প্রাণবন্ত মুহুর্তে ও ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি সোনামণির একাকীত্ব। তাই তো যখনই দু’জন কাছাকাছি এসেছে, বিপ্র বন্য-প্রেমে নিজেকে পুলক জুগিয়েছে, আদর মাখিয়ে দিয়েছে দেবস্মিতাকে। উনিশ বছর বয়সের হরমোন মনের নৈতিক হিসেব-নিকেশ মানতে চায় না। বিপ্র কামনার তাড়নায় তাই দেশে ফিরলেই জাপটে ধরেছে দেবস্মিতার নরম শরীর। কিন্তু মফঃস্বলে এমন গোপন জায়গার যে বড্ড অভাব, ফলত এই নিভৃতযাপন কখনই ঘণ্টার সীমা পেরোয়নি।
বিপ্লর কামুক চাহিদার পাশাপাশি মননের আরেকটি পরিচয় আছে। ছোট থেকেই জ্ঞানপিপাসু অনুসন্ধিৎসু ছেলে বিপ্র। ও যদিও বলে মগজের খিদে। খুব ছোটবেলা থেকেই নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করা স্বভাব। এই তো সেবার যখন দুজনে রেস্তোরাঁয় চিকেন দোপেয়াজা খাচ্ছে, মনের মধ্যে অজস্র প্রশ্নের দংশন। বইপত্র ঘেঁটে ছেলে ঠিক উদ্ধার করেছে এই নামকরণের হেতু। মুঘল সম্রাট আকবরের সভায় নবরত্নের নবম । নবম রত্ন ছিলেন আকবরের খানসামা মোল্লা দোপেয়াজা। যিনি হঠাৎ একদিন ভুলবশত চিকেনের থেকে পেঁয়াজের আধিক্যে রেঁধে ফেললেন এই বিশেষ পদ। সেই সঙ্গে আনুষঙ্গিক উপকরণের সামান্য তফাতে স্বাদেও বেশ আলাদা এবং সুস্বাদু। সেই থেকেই তো মধ্য প্রাচ্যে ও ভারতবর্ষে এই পদের প্রচলন। এই ভাবেই কত অজানাকে জেনে নিয়েছে, হোস্টেল জীবনে এই মগজের খিদে যেন গুণোত্তরে বেড়ে চলেছে। দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময়, হঠাৎ যখন ওষ্ঠযুগল ধূম্রস্বাদ পেল, বিপ্র ঠিক তথ্য নথি ঘেঁটে বের করেছে প্রথম ভারতীয় স্বদেশী সিগারেট ‘কালী সিগারেটের’ ইতিবৃত্ত। গর্বে পাগল ছেলে ‘কালী সিগারেটের’ জন্য সারা কোলকাতা চষে বেড়িয়ে শেষে ফেলু মিত্তিরের চারমিনারেই খুঁজে নিয়েছে আত্মসুখ। বিপ্লর এই অনুসন্ধিৎসু স্বভাবের জন্য সে একাধিকবার সিনিয়র-দের র্যাগিং-এর শিকারও হয়েছে। তৃতীয় বর্ষের ডগিদা তো একরাতে বিপ্লকে দিয়ে মুচলেকা লিখিয়ে নিয়েছে, “আমি যদি একুশ বছর বয়স অবধি জনপ্রিয় হতে না পারি তবে আত্মহত্যা করব…”।
পরবর্তীতে বিপ্লর বাবা কলকাতা এলে, তাঁর হাতে পড়ে এই মুচলেকা। পুরোটা পড়ে ভদ্রলোক ছেলেকে বুঝিয়ে বলেছিলেন, “এত প্রেসার নিস না। এই তো সবে শুরু…”। তারপর ছেলের মুখ থেকে বিস্তারিত বর্ণনা শুনে বলেছিলেন, “তোর হোস্টেলে থাকতে কষ্ট হলে, অন্য কোথায় ভাড়া নিয়ে নে।” কিন্তু ততদিনে সব স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে।
দাদাদের সঙ্গে হৃদ্যতা, বন্ধুদের সঙ্গে সখ্যতা। সব বেশ চলছে। ছেলের কথার স্বস্তি পেয়েছিলেন ভদ্রলোক। প্রশান্তির প্রশস্ত হাসি দিয়ে ছেলেকে আশীর্বাদ করেছিলেন। আর হয়েও ছিল তাই। খুব শিগগিরই দৈবিক উপায়ে সুযোগ এসেছে সমদর্শীদার হাত ধরে।
তার একের পর প্রবন্ধ, কবিতা প্রকাশ পেয়ে চলেছে নানা পত্র-পত্রিকায়। কিন্তু শুধুমাত্র একটা বদভ্যাসে নিজেকে আসক্ত করেছে নিজে থেকেই। ধূমপান বা মদ্যপান না, ওসবে ও খুব একটা আমল দেয় না। বিপ্ল আসক্ত হয়েছিল অন্য একটি বিষয়ে। স্কুলজীবনে যে বস্তুর কথা বন্ধুদের মুখে শুনেছে বহুবার, কিন্তু চাক্ষুস করতে
কিনা তাতেই আসক্ত না।
সাহস হয়নি, এমনকি বিষয়টির নাম উচ্চারণেও নাক সিঁটকে সরে গিয়েছে, অবশেষে কিনা তাতেই আসক্ত হল বেচারা ব্লু ফিল্ম, যাকে সভ্য বাঙালি ‘নীল ছবি’ বলতে অভ্যস্ত। দেশ-বিদেশের রূপসীদের সেখানে অবারিত আনাগোনা, স্বপ্নের স্বর্গপুরী। রাতের অন্ধকার যৌনতা হয়ে শিহরণ জাগায় ওর শরীরে। কখন যে নীল নায়িকারা ফ্যান্টাসির দুনিয়া থেকে বাস্তব হয়ে ওঠে, সে বুঝতে পারে না। এই আসক্তির নেপথ্যে ছিল পানুদা।
হ্যাঁ, হোস্টেলে সবাই তাকে ওই নামেই ডাকে। ভালো নাম বলার প্রয়োজন নেই এই গল্পে। পানুদার সংগ্রহে তখন কয়েক টি.বি নীল রমণীদের গোপন কার্যকলাপ। শুধু একটি সিগারেটের বিনিময়ে বিলিয়ে দেয় রাতের সুখ। যৌবনের বারুদে মিশিয়ে দেয় সাদা বীর্যের আঁশটে গন্ধ। খবরের কাগজে হলদে হয় কোটি কোটি মৃত শুক্রাণুর দল। হয়ত বিপুর এই আসক্তি দেবস্মিতার রাতের চাহিদাদের দূরে সরিয়ে ছিল কিছুটা। শরীরের খিদের চেয়ে ভয়ানক খিদে আর নেই পৃথিবীতে!
হোস্টেলের এক নবীনবরণ অনুষ্ঠানে সুদীর্ঘ পঁচিশ মিনিটের একটা বিস্তর বক্তব্য রেখেছিল বিপ্ল, যার বিষয়বস্তুর সার – এই নীল ছবিই বিশ্বের কোটি কোটি নারী-পুরুষের দৈহিক খিদে মিটিয়ে সাম্যাবস্থা কায়েম রেখেছে। ওর বক্তব্যে সেদিন বারংবার উঠে এসেছে নীল ছবির উপকারিতার গল্প। ওর মনে হয়, পৃথিবী জুড়ে ক্রমবর্ধমান নারীবিদ্বেষ, ধর্ষণ, বধূ নির্যাতন, যৌনদাসবৃত্তি সবের সমাধান হতে পারে এই নীল ছবি। কথাটা সম্পূর্ণ যৌক্তিক নয় জেনেও সবাই করতালি দিয়ে বক্তাকে সম্ভাষণ জানিয়েছিল সেদিন। ফলত হোস্টেলে ক্রমশ বেড়ে চলল নীল ছবির আসক্তি। আবার এ কথাও সত্যি যে হোস্টেলের অধিকাংশ ছেলেরাই প্রকাশ্য রাস্তায় কোনও মেয়েকে টোন-টিটকারি করে না। আড়ালে কুমন্তব্য করে কিনা সেটা বিপ্লর জানা নেই। মেয়েদের ও সম্ভ্রম দৃষ্টিতেই দেখে, ওর কাছে ভালোবাসার মানুষ ধ্রুব সত্যের মতোই চিরন্তন। দেবস্মিতার প্রতি ওর প্রেম ভালোবাসা কোনোদিন মিথ্যে ছিল না। এমন কত মুহূর্ত এসেছে যখন ফোনে ফোনে ওরা একে ওপরকে ভার্চুয়ালি আদর করেছে, গভীর চুমুতে ভরিয়ে দিয়েছে, ভার্চুয়াল শীৎকারে গম- গম করেছে রাতের অন্ধকার ঘর।
কিন্তু তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময়, এক নীল নায়িকার প্রেমে পড়ে বিপ্লব।
প্রেমই বলা যায়। দেবস্মিতার সঙ্গে মনোমালিন্য হলে একান্তে সেই নীল নায়িকার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিয়েছে মনের রাগ অভিমান আবেগ অনুভূতি সবটাই। যার সঙ্গ প্রাপ্তিতে মনে । মনের আনন্দ, যাকে মনের সাদা কালো দিকগুলো উজাড় করে দেওয়া যায়, সেই তো হয়ে ওঠে মনের মানুষ। তাই এই নীল নায়িকার বিষয়েও ওর বেড়েই চলে। ভালো নাম সারাহ জো কামুন। জন্ম ১৯৯৩ সালের ১০ ই ফেব্রুয়ারি লেবাননের বৈরুতে। ২০০০ সালে সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন। শৈশব ও কৈশোরের পড়াশোনা নর্থওয়েস্ট হাই স্কুলে। এরপর টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে সাফল্যের সঙ্গে স্নাতক, ২০১৪ সালে অক্টোবরে পর্নোগ্রাফিতে অভিনয় জার্নির সূত্রপাত এবং মাত্র দু’মাসের মধ্যেই পর্নহাবের সবচেয়ে জনপ্রিয় নীল তারকা হয়ে ওঠা। তার এই । জনপ্রিয়তা মধ্যপ্রাচ্যে চরম বিতর্কের সৃষ্টি করে। বিশেষ করে একটি ভিডিওকে কেন্দ্র করে যেখানে তিনি হিজাব পড়ে যৌনকর্ম লিপ্ত। ধর্মীয় সহিষ্ণুতায় আঘাত হানলে রক্ষণশীল সংকীর্ণ মনের ক্ষোভ তো সহ্য করতেই হবে। কিন্তু বিপ্লর কাছে এই বিষয়টি প্রতিবাদের একটি ভাষা। রক্ষণশীল ইসলামিক পরিবারের একটি সাধারণ মেয়ের স্বাধীনচেতা মনের দাবী। সত্যিই তো, সমাজ বা কোনও পুরুষের অধিকার ফলানোর ক্ষেত্র নারীর শরীর বা পোশাক নয়। “দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই নীল নায়িকা বলেন, “The controversial scene was satirical and should be taken as such. Besides Hollywood films depicted Muslims in a far more negative light than any pornographer could.”
এই নীল নায়িকার সমর্থনে জনৈক ব্রিটিশ-লেবানন লেখক নাসরি আতাল্লাহ বলেছিলেন, “The moral indignation is wrong for two reasons, First and foremost, as a woman, she is free to do as she pleases with her body. As a sentient human being with agency, who lives halfway across the world, she is in charge of her own life and owes absolutely nothing to the country where she happened to be born. Women-rights in Lebanon are a long way from being taken seriously if a Lebanese- American porn star that no longer resides there can cause such an at I once boasted to people as being the most Westernized nation in the Middle East, I now see as devastatingly archaic and uproar. What oppressed,”
এই সাহসিনী নীল নায়িকা-ই নেট দুনিয়ায় আজ মিয়াঁ খালিফা নামে পরিচিতা, যার নামের মধ্যেও প্রতিবাদ খুঁজে পেয়েছে বিপ্র। যে মেয়ে নিজেকে ‘খালিফা’ সম্বোধনের মতো দুঃসাহস দেখাতে পারে, তার প্রতি প্রেম আসাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই ঔদ্ধত্য সইবে কেনও, তাই তো মুসলিম সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী আই.এস.আই.এস ফতোয়া জারি করেছে, দিয়েছে মুণ্ডচ্ছেদের হুমকি। মিয়াঁ এখন পর্ন ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন। ইন্ডাস্ট্রি ছাড়ার পর জীবন সংগ্রামের আসল রূপ চিনেছেন তিনি।
মিয়াঁর এই প্রত্যাবর্তনই বিপুকে আকৃষ্ট করেছে বারংবার। তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় তার জনপ্রিয়তা আজও তুঙ্গে। জনপ্রিয়তার লড়াই হলে ইনি আজও বিশ্বের প্রথম দশজন মহিলার মধ্যে নাম লেখাবেন। এমন নির্ভীক মানবীর শরীর নয়, মনকে সম্মান করে বিপ্র।
ভারতে কৃষি বিলের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষকদের এই আন্দোলনকেও সমর্থন জুগিয়েছেন। তালিবানদের অতর্কিতে আফগানিস্তান অধিগ্রহণ নিয়েও শওয়াল তুলে একাধিক টুইট বিডেনের পদক্ষেপকে কাপুরুষো ইত্যাদি ইত্যাদি।
বিপ্র কিন্তু মিয়াঁর প্রতি এই আকর্ষণের অধ্যায়টি দেবস্মিতার কাছে কখনই লুকিয়ে রাখেনি। হয়ত এরই জন্য আরও বেশি কোণঠাসা মনে হত। আরও একা হয়ে পড়ত দেবস্মিতা। ছেলের মানসিক ভারসাম্যের খানিকটা যে লোপ পেয়েছিল, এ কথাটাও সম্পূর্ণ অসত্য নয়। মিয়াঁর প্রেমে পড়ার পর থেকেই ছেলের অদ্ভুত সব আবদার। এই যেমন, মিয়াঁ আর দেবস্মিতার বুকের মাপ মিলিয়ে নেওয়া, চোখের চাহনি, হাসি, বাচন ভঙ্গিমা সব কিছুই মাপতে থাকা তুলনার তুলাযন্ত্রে। কোনও নারী-ই এ হিসেব মেনে নিতে চাইবে না।
যখন তার শরীরের প্রত্যেকটি লোমকূপ অবধি তুলনার কাঠগড়ায়। অসহ্য হয়ে উঠতে লাগল এই ভালোবাসা। মোহ আর প্রেমের দ্বন্দ্বে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল দেবস্মিতার। হাতে যখন মুঠোফোন আর একলা নারীর মন তখন সামান্য পিছলে গেলেই চরম সর্বনাশ। সবই ভবিতব্য। দেবস্মিতার জীবনে শুরু হল একাধিক পুরুষের আনাগোনা। সবাই ভার্চুয়াল সঙ্গী। পুরুষ প্রণয়ীদের মধ্যে অধিকাংশই বিবাহিত। ওই যাকে বলে মিড- লাইফ-ক্রাইসিস। বিপ্লর পড়াশোনা, লেখা-লিখি, নাম-যশের অন্তরালে নিঃসঙ্গ দেবস্মিতাও মেতে উঠল যৌনতার এক ভয়ংকর খেলায়। যে পুরুষদের সঙ্গে ওর প্রণয়ের বার্তালাপ তারা সবাই ওর শরীর কামনা করেছে শুধু, যেমনটা নীলকণ্ঠ কামনা করেছিল। আর নাই বা কেনও, এমন সুশ্রী চাবুক শরীরের বঙ্গনারী সব পুরুষের স্বপ্ন। বিপ্রর প্রতি ঘৃণায়, যৌন তৃষ্ণায় একদিন দেবস্মিতা ঝাঁপিয়ে পড়ে ভিডিও সেক্স চ্যাটের মতো এক হিংস্র হাঙ্গরের মুখে। অন্যদিকে, সৌভাগ্যক্রমে মিয়াঁর সঙ্গে বিপ্লর বার দু-এক কথাও হয় টুইটারে। দিশেহারা, আত্মমগ্ন, কিছুটা পাগল ছেলে তাই কোনোদিনই বুঝতে পারেনি আগামী সময়ে কী নেমে আসতে চলেছে ওর জীবনে। বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি।
নিয়তি খেলা দেখাতে শুরু করলেন।
দেবস্মিতা জড়িয়ে পড়ল একাধিক স্ক্যান্ডালে, যাকে সস্তা ভাষায় বলে কেচ্ছা! বিভিন্ন সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে ওই বিবাহিত পুরুষদের স্ত্রী-রা তখন হন্যে হয়ে খুঁজে চলেছে দেবস্মিতার সবকটা অ্যাকাউন্ট। একাকীত্ব আর ব্যর্থতা একসঙ্গে কামড়ে খেয়েছে মেয়ের মন। তার হাজার-হাজার ছবি-ভিডিও তখন ভাইরাল বিভিন্ন পর্নোগ্রাফিক সাইটে। বিপুর কাছেও যখন সেইসব লিঙ্ক এসেছে, সে নিজেকে সামলাতে পারেনি। চার দেওয়ালের মধ্যে খুব করে কেঁদেছে, চিৎকারে গমগম করে উঠেছে ওর চার দেওয়ালের ঘর। বিপ্লৱ বেশ বুঝতে পেরেছে, চোখের জল আর চিৎকারের ওজন শীৎকারের চেয়ে অনেক বেশি। বারবার বেছে নিতে চেয়েছে আত্মহত্যার পথ। কিন্তু পারেনি। দেবস্মিতার কান্না “আমাকে বাঁচা প্লিজ” বলে আর্তনাদ মৃত্যুর পথ বেছে নিতে দেয়নি বিপ্লকে। দেবস্মিতার হয়ে থানা, পুলিশ, সোশ্যাল-মিডিয়া সব একা হাতে সামলেছে ছেলেটা। টানা দু’বছর কতই না মারণ ঝড় এসেছে ওদের জীবনে। বিপ্র কিন্তু দেবস্মিতাকে দোষ দেয়নি। সব দোষ নিজের কাঁধে নিয়ে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছে। না, একবারও যাচাই করতে চায়নি মনের মানুষের সতীত্ব। বরং আরও ভালবাসতে চেয়েছে দেবস্মিতাকে, আরও আগলে রাখতে চেয়েছে। বিপ্র জানে, এই পরিস্থিতিতে একটা মেয়ের মন কতটা অবসাদে ডুবে যায়। এই অবসাদ থেকে বেরোতে সময় পেরিয়ে গেল দুটো বছর। এখন সব স্বাভাবিক। হঠাৎ করেই একদিন খবর এল বিপ্লর ছোট মেসো সুইসাইড করেছেন। খবর পেয়েই কোলকাতা থেকে সেই রাতে জেনারেল বগিতে চেপে দেশের বাড়িতে ফিরল বিপ্র।
রমেন্দ্রপল্লীর লাল সাদা বাড়িটার কাছে যেতেই বিপু শুনতে পেল, ধোঁয়ার মতো গলগল করে বেরিয়ে আসছে কান্নার শব্দ। এক সেকেন্ডের জন্যও বিরাম নেই সেই শব্দে। গেটের সামনে যেতেই কান্নারা চিৎকারের মতো শোনাল। বিপ্লর মনে হল যেন আগুনে পুড়ে মরছে দুটো মানুষ – ছোট মাসি আর চুটকি। চুটকির এখন ক্লাস নাইন। ভালো-খারাপ সব বুঝতে শিখেছে। বিপু বাড়িতে ঢুকতেই কাঁদতে-কাঁদতে, হাঁপাতে হাঁপাতে বিপ্লকে বলল, “বড়দাভাই, ওই মেয়েটাই সব শেষ… বাবাকে পাগল করে দিয়েছিল…. মাকে বাবা খুব মারত জানিস… মা অনেক বুঝিয়েছে। কিন্তু!! বড়দাভাই… বড়দাভাই… এখন দেখ কি হয়ে গেল আমাদের… মার কথা যদি…”। চুটকি কেঁদেই যাচ্ছে, কান্না থামছে না, থামবেই বা কী করে, মেয়ে যে বাপ-হারা হয়েছে। চুটকির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ছোট মাসির কাছে গিয়ে বসল বিপ্ৰ । ছোট মাসি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে পাগলের মতো কেঁদেই চলেছে, কিচ্ছু বলছে না। মন শক্ত করে মাসিকে জিগ্যেস করল, “মাসি মেয়েটা কে? কিছু জানো?” মাসি উত্তর দেয় না, বিপ্র মাসির কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে আবার জিগ্যেস করল, “মেয়েটা কে? কিছু জানো?” মাসির চোখে তখন রক্ত ফুটছে। এমন আগ্নেয় চোখ এর আগে কখনও দেখেনি বিপ্র। ছোট মাসি রুক্ষ গলায় বললেন, “ওই বেশ্যার নাম জানলে খুন করে দিতাম রে হুতুম! মাগীটা অনেকের মাথা খেয়েছে! কালনাগিনী! ডাইনি! দিনের পর দিন মাথা খেয়েছে গুর… ঠিকই হয়েছে, মরে গিয়ে নিজেও শান্তি পেল, আমাদেরও শেষ কয়েকটা মাস কম জ্বালিয়েছে নাকি!!”
মাসির কথা, আচরণ সব কেমন যেন উন্মাদের মতো মনে হল বিপ্রর। ওর অনুসন্ধিৎসু মনে প্রশ্ন জাগল, “তবে কি মাসিই রাগের মাথায় মেসোকে….??” মাসি তখনও বলে চলেছেন, “ঠিকই হয়েছে, মরে গিয়ে নিজেও শান্তি পেল, আমাদেরও… রোজ রাতে অশান্তি, এই দেখ না পরশুদিন আমার কপালে আয়নাটা ছুঁড়ে মারল…. দেখ হুতুম কীভাবে কেটেছে…..”
সত্যি কপালের একটা ছোট্ট জায়গা এখনও হাঁ হয়ে আছে। কিন্তু অমন শান্ত-ভদ্র ছোট মেসোর এমন ভীমরতি হল কীকরে? যে মানুষটা কোনোদিন মদ গাঁজা সিগারেট ছুঁয়েও দেখেনি, , তার এই পরিণতির কথা ভেবে অবাক হয়েছে বিপ্র। মাসির কথার উপর নিজের ছিল?”
প্রশ্নের ভর চাপিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা মেসোর কি কোন দেনা শোধের ব্যাপার “কীসের দেনা? কোনও ধার দেনার ব্যাপার না রে হুতুম। সাতে-পাঁচে না থাকা মানুষ… এ সবই ওই ডাইনিটার মগজধোলাই…
মাসির অসংলগ্ন কথা কেটে আবার নিজের প্রশ্ন বসিয়ে যাচাই করতে চাইল নিজের অনুমান, “কিন্তু মেয়েটার জন্য সুইসাইড করার দরকারটাই বা কী ছিল? অন্য কোনও মাসি ”
কারণ তো থাকতেই পারে, এসব নিয়ে ভেবে নিজের শরীর খারাপ করো না ছোট বিপ্লর কথাটা শেষ করার আগেই চুটকি একটা নীল রঙের ব্রা নিয়ে এসে ওর সামনে মাসি…
ধরে, “এটা ওই রাক্ষসীর ব্রা… বাবার অফিসের ব্যাগে ছিল…. আর কিছু বলবি বড়দাভাই…”
কি অদ্ভূত!! মেসোর অফিসের ব্যাগে ব্রা?? কেউ কি তাহলে আত্মহত্যার আড়ালে খুন লুকোনোর চেষ্টা করছে? মনের অনুমানেরা যেন দৃঢ় হতে চাইছে। বিপ্র হাতে নিয়ে ভালো করে দেখতে লাগল অন্তর্বাসটা। বক্ষবন্ধনীর ভেতরের দিকে চোখ পড়তেই ছুঁড়ে ফেলে দিল – যেন শরীরে কালকেউটের বিষ দৌড়ে যাচ্ছে আপাদমস্তক। অন্তর্বাসের ভেতরে লেখা ‘মিয়াঁ খালিফা 34B’, হাতের লেখাটা বিপ্লর! পরিষ্কার বুঝতে পারছে, বছর দুয়েক আগে, এক গভীর প্রণয়ের মুহূর্তে, দেবস্মিতার অন্তর্বাসে মার্কার দিয়ে লিখে দিয়েছিল ‘মিয়াঁ খালিফা 34B’। কিন্তু এ তো অসম্ভব!!… তাহলে কি… না আর ভাবতে পারছে না বিপ্র। আর কিছুই ভাবতে পারছে না। কথা না বাড়িয়ে অন্তর্বাসটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়তে চাইল, গন্তব্য দেবস্মিতার বাড়ি। হঠাৎ খেয়াল হল ওরা তো সপরিবারে ভুটান বেড়াতে গিয়েছে। ছোট মাসি জিজ্ঞেস করল, “কী-রে তোর হল টা কী? ওই ডাইনির ব্রা …”
ফেলে দে, অভিশাপ লাগবে রে হুতুম… ফেলে দে… পুলিশ এসে নিয়ে যাবে… ফেলে বিপ্লর মনে হাজার-হাজার প্রশ্ন, কিন্তু উত্তর মিলছে না, শুধুই প্রশ্ন। শরীর গুলিয়ে উঠছে ওর। বমিও করেছে কয়েকবার – অবসাদের চরম মুহূর্তে মন পুড়ে ছাই। কালবিলম্ব না করে সেদিনই কোলকাতায় ফিরবে মনস্থির করল। সন্ধ্যের ট্রেন রাধিকাপুর এক্সপ্রেসে চেপে, মোটা চামড়ার জলীয়বাষ্প ঠেলে উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রাম মফঃস্বল ভেঙে রাত শেষে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে ক্লান্ত হয়ে হাঁপাচ্ছে বিপ্র। একরাশ দুশ্চিন্তা আর স্যাঁতস্যাঁতে ঘাম শরীর নিয়ে প্ল্যাটফর্মে মাথা নিচু করে বসে রয়েছে। নিজের ঘামের গন্ধও আর সহ্য হচ্ছে না ওর। খুলির মধ্যে বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজছে, এই বুঝি মুণ্ডুটা খসে পড়বে। তা সত্ত্বেও পুরো ঘটনাটা মাথায় বারংবার কষে নিতে চাইছে। মন আর মস্তিকের মধ্যে চলছে তাত্ত্বিক অমীমাংসিত মল্ল যুদ্ধ।