তিতাসের পূর্বাঞ্চলটা এই সময়ে ইটখােলাগুলাের ইটপােড়ার গন্ধে প্রায় আচ্ছন্ন। আগে এ জায়গাগুলােতে গরুর বাথান এবং শহরের দুধের কারবারিদের গাইগরু পােষার একচ্ছত্র অধিকার ছিল। আগে লােকেরা এ চরের রাখালদের বলতাে খলার মানুষ। এখন ক্রমাগত তা সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। খলাগুলাে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ইট পােড়াবার বিশাল চুল্লি এবং চিমনিতে ছেয়ে গেছে। তবে বাথানের রাখালরা একেবারে উচ্ছেদ হয়ে যায়নি। তারা উত্তরে-দক্ষিণে বাথানগুলাে সরিয়ে এনেছে। নতুন ইটের গাদা যদিও মাইল মাইল ছড়িয়ে আছে কিন্তু বাথানগুলােও স্বাভাবিক নিয়মে তাদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে চাইছে। আগেও এসব অঞ্চল ছিল আইন-কানুনহীন। এখনাে তেমনি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর অর্থাৎ জেলা সদরের পুলিশ পারতপক্ষে নদী পেরিয়ে এ পাড়ে আসে না। সবাই জানে ওটা হলাে অপরাধী, চোর, ডাকাত, রাখাল এবং আত্মগােপনকারী দৃষ্কৃতিকারীদের এলাকা। আইন হলাে শহর বা সদরের জন্য। গরু বা গরুর রাখালদের শহরের মানুষ কোন অবস্থাতেই মানুষ বলে অস্বীকার করে না।
সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে গরুগুলাে বাথানে ঢুকিয়ে কামাল ও কালা তাদের নিজেদের বাসস্থান একটা তর্জার চালার নিচে এসে তাদের নারকেল খােলের হুকায় তামাক সাজাল। হুকাটায় টান দিতে দিতে কালা মুখ তুলল কামালের দিকে, হারামজাদা তাে এখনাে ফিরল না, উস্তাদ। আমি কি চুলা জ্বালিয়ে ভাতটা ফুটিয়ে নেব? আজ আমার রাধার কথা ছিল না। কিন্তু ওই হারামজাদা তােরাব যদি আজকেও একটা মাগিকে যােগাড় করে নিয়ে আসতে না পারে তবে আমি তার মুখে গরম ফ্যান ঢেলে দেব।
কামাল এ কথার কোন জবাব না দিয়ে হাত বাড়িয়ে ডাবাটা একরকম কালার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে টানতে লাগল। অনেকক্ষণ পর্যন্ত টেনে কালার হাতে হুকোটা ফিরিয়ে দিতে দিতে বলল, আয় ঘাটের দিকে যাই। আমার মনে হয় আজ তােরাব একটা বুড়ি হলেও যােগাড় করে আনবে। কতদিন মাইয়া লােকের গন্ধ খুঁকি না। আমি ততা ওকে বলে দিয়েছি দত্তখলার ঋষিপাড়া থেকে যে করেই হােক ভুলিয়ে ভালিয়ে একটা মাগিকে যােগাড় করে নিয়ে আসবে। আমাদের আবার চামার-কুমার দিয়ে! বেটি মানুষ হলেই হয়। হাত দিয়ে তলাটা দেখলে গাইয়ের মতাে ভেজা লাগলেই হলাে। কি কস, কালা?….
কালার মুখে একটা অমায়িক হাসি ফুটে উঠল। দুমড়ানাে রেখাবহুল চেহারার মধ্যে একটু রােদের ঝিলিকের মতাে মনে হলাে। আপনি যা কন না উস্তাদ! ষাড়েরও শুনলে পানি এসে যায়।
কামাল ও কালা উঠে দাঁড়াল। তারা ছাউনিটার বাইরে এসে তিতাসের আঘাটার দিকে হাঁটা শুরু করল যেন দুটি বিশালাকার দৈত্য সন্ধ্যার নিমজ্জমান সূর্যের বিপরীত দিক থেকে চলেছে অমৃতের সন্ধ্যানে। ইটপােড়ার গন্ধটা এখন তীব্র হয়ে বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে। একদিকে সূর্য ডুবে যাচ্ছে। অন্যদিকে আকাশে ফুটে উঠেছে অসংখ্য তারার জোনাকি। সব নদীরই একটা গাত্রগন্ধ আছে। পদ্মার মেঘনার ব্রহ্মপুত্রের। তিতাসেরও একটা নিজস্ব জলীয় গন্ধে চরের মানুষ অভ্যস্ত। গন্ধটা মাখনা, শালুক, পানিফল, কলমি ঝােপ ও পানকৌড়ির গায়ের মেছাে গন্ধের মতাে এক ধরনের সংমিশ্রিত সৌরভ যেন বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে সন্ধ্যায়। এর সাথে মিশ্রিত হয় বাথানের যাঁড়ের গায়ের গন্ধ, গাইয়ের শরীরের গন্ধ, গােবরের গন্ধ। এ সময়টাকে অতীতে তিতাসপাড়ের রাখালেরা বলত গােধূলিবেলা। বিস্তীর্ণ চরের বেড়ে ওঠা ঘাস খাইয়ে গাভী ও ষাঁড়গুলাে নির্দিষ্ট বাথানে ফিরিয়ে আনার সময়। আজ আর এ অবস্থা কই? এখন গােধূলি শব্দটা নিশ্চয় রাখালদেরও হাসির উদ্রেক করে। কারণ চিমনির ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন পুরাে এলাকাটা হয়ে গেছে শুধু পােড়ার গন্ধে নিমজ্জমান। ইটপােড়ার গন্ধের মধ্যে একটা দগ্ধতার জ্বালা আছে। যা অনভ্যস্ত লােকের নাকে গেলে মনে হয় নাসারন্ধ্রে জ্বালা ধরে গেছে। এ সময়ের এখন একটা নামকরণ হওয়া উচিত। গােধূলিবেলা শব্দটা এখন শুধু বৃদ্ধ রাখালদের কল্পনায় আছে। বাস্তবে তাে দগ্ধ মাটির গন্ধ ছাড়া এখানে আর কোন গন্ধের আভাস মাত্র নেই। কালা ও কামাল হাঁটতে হাঁটতে নদীর ঘাটে চলে এলাে। প্রকৃতপক্ষে এখানে কোন ঘাট নেই। কেউ এসে কোসা নাও নদীর পাড়ে টেনে তুলে খলার দিকে রওনা হয়। ঘাট নেই বলেই রাখালরা বলে আঘাটা। তিতাসের এদিকের পাড় তেমন উঁচু নয়। বলা যায়, নদীর প্রায় সমান্তরাল। জোয়ার এলে তিতাসের পানি চরের ওপর বেশ খানিকটা উঠে আসে। আবার নেমেও যায় যথারীতি। কামাল নদীর একটু উঁচু ডাঙায় এসে বসে পড়ল। হাতের ইশারায় কালাকে বলল, এখানেই বইসা যা বেটা। কালাও তার পাশে বসে পড়ল। রাইত হইয়া গেল উস্তাদ। হারামজাদা তােরাইব্যা এখনাে ফিরল না? ও যদি শহরে গিয়া থাকে তাহলে আইতে তাে একটু দেরি অইব জানি। কিন্তু সুরুজ ডুইবা গেছে কত আগে। শালার দেখা নাই। ভাতও রানলাম না। একটু পরেই তাে পেটে জ্বালা ধইরা যাইব। হায়রে কালা, শালা আমার। এখুনি যদি তােরাইব্যা একটা মাগি লইয়া ফিরে তইলে তাের পেটের জ্বালার চেয়ে চেটের জ্বালা লাফ দিয়া উঠব। ঠিক কইছি না? এই কথায় কালা শব্দ করে এক ধরনের অদ্ভুত হাসি হাসল। লুব্ধ, ক্ষুধার্ত, অপেক্ষায় অসহিষ্ণু রাখালের হাসি। অই দেখ, আইতাছে। তােরাইব্যা আইতাছে। সাথে লইয়া আইছেরে। তাের মাসিমারে লইয়া আইছে ।
একথায় কালা উত্তেজনায় দাড়িয়ে গেল। রাসি না উস্তাদ। তােরাইব্যা হের মারেই লইয়া আইতাছে । মাইয়া মানুষ না পাইলে কী করববা বেচারা। ঠিক দেইখ ওর মারে লইয়া আইছে। এ সময় উস্তাদ আপনার একটা বিড়ি দরকার। আমার কাছে একটা আছে না। দিমু জ্বালাইয়া? দে বেটা! কোমরের ভাঁজ থেকে লুকানাে বিড়ি ও দেশলাই নিয়ে কালা দ্রুত কাঁপা হাতে ধরিয়ে একটা দম মারল। তারপর এগিয়ে দিল কামালের দিকে। নেন উস্তাদ। সাগরেদের হাত থেকে বিড়িটা নিয়ে উপর্যুপরি টান দিতে লাগল কামাল । ততক্ষণে তােরাবের কোসা নাওটা ছায়া মূর্তির মতাে একটা মানুষকে নিয়ে ঘাটে এসে লেগেছে। ছায়া মূর্তিটা সবার আগে চরের ওপর লাফ দিয়ে নামল। তােরাব বৈঠা নৌকার আড়কাঠের উপর তেরচা করে সাজিয়ে রেখে নেমে এল চরে। ততক্ষণে তার। দুই স্যাঙাত দ্রুত নেমে এসেছে তােরাবকে সাহায্যের জন্য। এক টানে কোসা নৌকাকে তারা একেবারে পাড়ের ওপর তুলে আনল।
কোথেকে পাইলিরে তােরাব? কথা বলে উঠল কামাল। গলায় খুশির আওয়াজ। দখলার ঋষিপাড়া থেকে। জবাব দিল তােরাব । তার কণ্ঠস্বরে কৃতিত্বের গাম্ভীর্য । আমরা তাে ভাবতেছিলাম তুই একটা বুড়ি ধইরা লইয়া আইবি। এ তাে দেখি ভর যুবতী! কততে ঠিক করলি? ও কিন্তুক শুধু রানবাে। গাই গরু টানাটানি করতে পারব না। মাসে একশ টেহা দিতে অইব, খাওয়া খােরাক ছাড়া। কালা বলল, এত টেহা কোত্থেকে দিবিরে তােরাব। তাইলে তাে শহরে গিয়া ডাকাতি করতে অইব। দশটা বাথানের দুধ চুরি করতে অইব। এই শালা, বেঁকিয়ে উঠল তােরাব, আমরা তাে চোরই। আমরা সব সাউধ নাকি! তুই ভাবস গরুর রাখালদের মানুষ মানুষ মনে করে! ওর জন্য সব করবি। কী আনছি ভালাে কইরা দেখছস? চরাঞ্চলের সেরা মাগিটা লইয়া আইছি। হির চাহিদা নাই? শুধু খাইব, পিনব আর তােমার সাথে হুইব। ভারি মজায় আছ হারামজাদা। হির লাইগ্যা সারা দুনিয়া লুট করুম, চুরি করুম, ডাহাতি করুম, গলা কাইট্যা ফালামু বুঝলি? এবার থামত তােরাব। কামাল এগিয়ে এসে দুজনের মাঝে দাঁড়াল। এদের ঝগড়ার ছায়ামূর্তিটি আবার কোসা নৌকার আড়কাঠের ওপর গিয়ে বসে পড়ে খিলখিল করে হেসে ফেলল। তােরাব সেদিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী নাম গাে তােমার? আমার নাম জিগান? আমার নাম মইষা ঋষি। ওই দত্তখলায় বাড়ি। বিয়া শাদি অইছিল? প্রশ্ন করল কামাল।
বিয়া শাদি? এ তাে প্রতি রাইতেই হয়। আবার খিলখিল হাসির শব্দ। তােরাব কামালের দিকে ফিরে বলল, আগে নাওটা কুইল্যা নিয়া চল ছাউনির দিকে যাই। ও তাে আমাদের সাথে থাকবার লাইগ্যাই আইছে। দেখতে পারবা, হুঙতে পারবা। এখন নাওটা সবাই মিল্লা কান্ধে তােল। মইষা নাওয়েই বইয়া থাক। তােরাব এ কথা বলামাত্রই যেন তিনটি দৈত্য একটানে কোসা নৌকাটিকে মাথায়, পিঠে ও কাঁধে তুলে নিয়ে হন হন করে ছুটতে লাগল। এ সময় বেশ আবছা অন্ধকার নেমে এসেছে। আকাশে যদিও সবগুলাে তারা একসাথে ঝিলিক দিয়ে জ্বলছে কিন্তু মাটিপােড়ার গন্ধটা এখন মনে হয় একটু থিতিয়ে পড়েছে। তার ফলে এখন তিতাসের বাতাস উপচে পড়ছে চরে। পােড়া ইটের গন্ধের বদলে পানির গন্ধ, শালুক পাতার গন্ধ এবং শাপলার গন্ধ বয়ে যেতে লাগল চরভূমির ওপর দিয়ে। যদিও চাঁদের আলাে নেই বলা যায়, অন্ধকারেই বিরাজমান। কিন্তু তার মধ্যে সবকিছুই দেখা যাচ্ছে। স্পষ্ট নয়। অস্পষ্ট। তবু বৃক্ষহীন চরের এদিক ওদিক একটা দুইটা আঁশশ্যাওড়া গাছের অস্তিত্ব বােঝা যায়। মনে হচ্ছে তিনটি বিশালকায় দৈত্য একটি নৌকার উপর এক যুবতীকে নিয়ে যেন যুদ্ধে জয় করে আনা মানবীকে নিয়ে তাদের ছাউনিতে ফিরছে। তাদের। শরীরের আনন্দ ঘামের গন্ধ হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে। বাথানের ষাঁড়ের গন্ধের সাথে এই মাংসের অর্থাৎ পুরুষের গন্ধের কোন বৈপরিত্য নেই। ঠিক এ সময় আকাশে অষ্টমীর এক চিলতে চাঁদ একটা মাল বােঝাই নৌকার মতাে মেঘ সাঁতরে বেরিয়ে এলাে। হাঁটতে হাঁটতে নাওটা কাঁদে নিয়ে তিন পশুর রাখাল ছাউনির সামনে এসে দাঁড়াল। নাম মইষা, এইটাই আমাদের ঘরবাড়ি। দেখ নামতে পারবি কি না মাগি? তােরাবের কথায় জায়গা হারামজাদারা? একটা তর্জার বেড়া বাঁশ দিয়া আসমানে তুইল্যা রাখছস। এটা ছাউনি? মইষার কথায় তিন দৈত্য পাশাপাশি দাঁড়িয়ে গেল। কামাল বলল, আমরা তাে গরুর রাকখাল, আমরা তাে এমনি থাকি। ঝড় বিষ্টি আমাদের ওপর দিয়ে যায়। আমরা ভিজি, পুড়ি। নিজেরা খামচা খামচি করি। কিন্তু আমরা সুখে। থাকি। পলাই না। তবে তােমারে আমরা ভিজতে দিমু না। রােদে জ্বলতে দিমু না। তােমার গতর থেইক্যা ঘাম বাইরতে দিমু না, জিব্যা দিয়া চাইটা দিমু। আমরা তােমার মাথার ওপর ছাউনি হইয়া থাকুম, বালিশ হইয়া খাকুম, পা টিপ্যা দিমু। তুমি আমাদের ফালাইয়া চইলা যাইবা না। আমরা তােমার লাইগা ডাকাতি করুম, মানুষ মারুম, লুট করুম-কামালের দীপ্ত কথায় একই সাথে তার রাখালসুভল পৌরুষ ও যৌনকাতর ভিক্ষুকের আর্তস্বর বেরিয়ে এলাে। এ কথায় মইষা হাসিমিশ্রিত গলায় বলে উঠল, কৃষ্ণ, কৃষ্ণ! বলতে বলতে সে নৌকা থেকে নেমে পড়ল মাটিতে। তােরাব তার হাত ধরে বলল, আয় ভেতরে। আগে একটু বসে একটা বিড়ি খা । আজ আমি নিজে রান্দুম। তর রানতে অইব না। আসলে তুই রানবি না। আমরাই রান্দুম। তুই শুধু থাকবি আর কিছু না। আমরা তর খেদমত করুম। দেখ তরে ওই বাউন বাইড়া শহরে একশ জন টানাটানি করে, ছিড়াছিড়ি করে না। আমরা মাত্র তিনজন। আমরা তরে আদর করুম, যত্ন করুম, তুই আমাদের তিনজনরে একসাথে খুশি রাখবি। তর কোন কাজ নাই। আমরা বঁড় আর গাই চরামু আর তর ওপর চড়ম । তােরাবের কথায় কোন শ্লেষ বা ঘৃণার শব্দ নেই। যেন সে মইষার ভজনা করছে। এবার মইষা ছাউনিটার ভেতরে গিয়ে একটা আড় বাঁশের ঠেস লাগিয়ে বসে পড়ল । কালা একটা বিড়ি ধরিয়ে তার কাছে নিয়ে গেলে সে কালার হাতটা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলল, আমি বিড়ি খাই না। ওই তােরাব মিয়ার কাছে সিগ্রেট আছে, সিগ্রেট আন। এ কথা তােরাবের কানে যেতেই সে লুঙ্গির খুঁট থেকে এক প্যাকেট স্টার সিগারেট ও দেশলাই কোন মহার্ঘ বস্তুর মতাে বের করে মইষার দিকে এগিয়ে দিল। এটা তর। এখান থেকে কাউকে ভাগ দিবি না। আমরা বিড়ি হুক্কা খাই। এটা তর লাইগ্য’। মইষা প্যাকেটটা নিয়ে ধীরে সুস্থে একটা সিগ্রেট ধরাল। খুব মনােযােগ দিয়ে তাকে ঘিয়ে বসে থাকা তিনটি পুরুষ দৈত্যকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল মইষা। কিংবা বলা যায় দেখতে নয় বুঝতে লাগল। কারণ এখানে কোন আলাে নেই। চাদের আলাে ছাউনির ভেতর পৌছে না। আচ্ছা তইলে তরা তিনজন। দ্রৌপদীর নাকি পাঁচজন ছিল। আমার ভাইগ্যে তিনজন? ভগবান জানে তরা কেমন হবি। আমি থাকুম। তয় খুব ভুখ লাগছে, রান আমার লাইগ্যা। পােড়া মরিচ দিয়াই খাইতে পারুম। তােমার পােড়া মরিচ দিয়া খাইতে অইব না। দুধ আছে, দুধের সর আছে। আমরা বাথানের রাখাল না। দুধের চেয়ে বড় খাইদ্য দুনিয়াতে কী আছে, কও? আমরা তােমার শরীর চাটুম আর এর ক্ষয়ক্ষতি দেখুম না। বিনীত কণ্ঠে বলল কামাল। এ কথায় মইষার খুব ভালাে লাগল। সে বলল, ঠিক আছে। খিদা লাগছে ভাত রান। আমি কতক্ষণ এই বাঁশটায় ঠেস দিয়া ঘুমাই। মইষার কথায় তিনটি দৈত্যই এক সাথে লাফিয়ে উঠল। সবাই ছুটল মাটির চুলার দিকে। কয়েকটি ইট দিয়ে এখানে রান্নার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে! কালা চাল ধুয়ে নিয়ে এল একটা মাটির হাঁড়িতে পানি দিয়ে ভাত বসিয়ে দিল। অন্য দুজন কামাল ও তােরাব লাকড়ি কেটে ফালাফালা করে চুলায় দিতে লাগল। যেন মহােৎসবের আগে তিন দানব সন্তান ক্ষুন্নিবৃত্তির আয়ােজন করছে। কথায় আছে না আগে পেটের জ্বালা। রাখালরা বলে আগে পেটের জ্বালা তারপর চেটের জ্বালা।
॥ দুই॥
মইষা সত্যি সত্যি আড়বাঁশে ঠেস দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। দুটি পা ঘড়ির কাঁটার মতাে ছড়িয়ে দিয়ে নিশ্চিত নিদ্রা। যেন কিছুই আসে যায় না তার। সে জানে তাকে এই তিন দানব প্রকৃতপক্ষে তাদের ভােগের তৃপ্তির জন্য এ চরে নিয়ে এসেছে। তবে তাদের ব্যবহারটা যে এতটা বিনয়ী হবে এবং ভজনাকারীর মতাে তােষামােদের মতাে গলে পড়বে এতটা মইষা আন্দাজ করতে পারেনি। এখন সে নিশ্চিত হয়ে নাকে মৃদু শব্দ তুলে ঘুমাচ্ছে। তার দুটি সুপুষ্ট স্তন উঁচু হয়ে ওঠানামা করছে। গলা দিয়েও শ্বাসপ্রশ্বাসের একটা অদ্ভুত শব্দ চুলার পাড়ে বসে তিন দানব শুনতে পাচ্ছে। কালা বলল, ওস্তাদ মাগিটা কালা না ফরসা বুঝতে পারলাম না। তােরাইব্যা এমন একটা সময়ে আইসা আঘাটায় ভিড়ল মুখটা কেমন হিডাও দেখলাম না। তবে বেশ জোয়ান আছে। এইটা বােঝা যায়। আইজ রাতে খাওয়ার পরেই ওরে লইয়া আমরা তিনজন চরের যেখানে সবচে বেশি নতুন ঘাস আছে সেখানে নিয়া শুয়ামাে। কী কও? আমারে লাথি মাইরা ফালাই দিও না ওস্তাদ। আমি গায়ে গতরে তােমাদের সাথে পারুম না। কিন্তু আমার ভাগটা আমারে খাইতে দিও। কামাল গম্ভীর গলায় একটু হাসির চেষ্টা করল। তরে তাে হারামজাদা না পারলে ওই মাগিটাই কী যেন নাম মইষা না ভইষা লাথি মাইরা ফালাই দিব। এ কথায় তােরাব হেসে বলল, শালা কালার বাচ্চা তুই অত বড় মইষের মতাে মইষার সাথি কী করবি রে বেটা! লাথি তর খাইতেই অইব। তারপর তিনজনই এক সাথে হেসে উঠল। তিন দানবের অট্টহাস্যে আড়বাঁশে ঠেস দেয়া মইষা ঋষির ঘুম চটে গেল। সে আড়বাঁশের ঠেস দেয়া অবস্থা থেকে পিঠ সিদা করে বসে পড়ল। কই গেলিরে রাখাইল্যারা? ভাত রানতে এত দেরি লাগে? কালা সেখান থেকেই জবাব দিল, হইয়া গেছে বইন, একটু সবুর কর। কালার বইন শব্দ শুনে বাকি দুই রাখাল ফিস ফিসিয়ে হাসল। তর আবার বইন অইল কেমনে? শালা তর মা! বইন অইলে আমরা তর বইনজামাই হমু! শ্লেষ মিশিয়ে হাসল তােরাব। কামাল বলল, নে শালা কালার বাচ্চা আমারে সেলাম কর। আমি তর বইনজামাই। রাখাল তিনজনের কথাবার্তা বেশ স্পষ্টভাবেই মইষার কানে আসছিল। সে একটা সিগ্রেট ধরিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর সােজা গিয়ে হাজির হলাে চুলার পাশে এবং নিজেই ভাতের পাতিলে রাখা বাঁশির ধজি দিয়ে সিদ্ধ হওয়া ভাত তুলে নিয়ে বাঁ হাতে টিপে দেখল। হইছে, পাতিল উল্টাইয়া ফ্যান ছাড়াইয়া আন। হয়ে গেছে সব। আমি গিয়া ওইখানে বসি। তরা সানকি লইয়া ওই জায়গায় চইলা আয় ।
পাতিল থেকে মুখটা তুলে মইষা সােজা হয়ে দাঁড়াবা মাত্র কালা একটা জ্বলন্ত শিখাযুক্ত লাকড়ির টুকরা চুলা থেকে নিয়ে মইষার সামনে ধরল। তােমার চেহারাটা কেমন দেখি বইন। দেখ! আমি দুর্গার মতাে। যদিও আমার নাম মইষা। বলেই কাচভাঙার মতাে খিলখিলিয়ে হাসল মইষা। সবাই মইষাকে ঘিরে সানকির ওপর গরম সাদা ভাত ও দুধের সর নিয়ে নুন মাখিয়ে খেতে শুরু করেছে। মইষা লােকমার পর লােকমা খাচ্ছে একটি উপােসী ভিখিরির মতাে। আর ফাকে ফাকে হাসছে। এই বেজন্মারা তােদেও খানা বহুত মজার। এই খাইয়াইতাে শরীরে এত তেল । দেখতে এককটা ষাঁড়ের মতাে। তাে খাওয়া হয়ে গেলে কে আমারে লইয়া চরে ঘুরব ক দেহি? তিনজনই লােলুপ দৃষ্টিতে মইষার দিকে তাকাল। কামাল ও তােরাবের দিক থেকে মুখ সরিয়ে নিয়ে মইষা হাসল। এই তর নাম কিরে? কালাকে জিজ্ঞেস করল মইষা। কালীচরণ! তুই বেটা আবার কালীচরণ হইলি কেমনে! হিন্দু নাকি।। তা তাে জানি না। বাথানের মালিকের বাড়িতে আমার মা কাম করত। আমি হইয়া গেছি। কে জানে আমার বাপ হিন্দু না মুসলমান আছিল। ততক্ষণে খাওয়া সাঙ্গ হয়েছে। কালা প্রত্যেকের সানকি তুলে নিয়ে পেছনে চলে গেল। মইষা ফস্ করে একটা সিগ্রেট ধরিয়ে আড়বাঁশে ঠেস দিয়ে দুই ঠ্যাং ছড়িয়ে দিল। কামাল ও তােরাবের কোলের কাছে মইষার দুই বিছানাে উরু। তারা লুব্ধ দৃষ্টিতে মইষার উরতের দিকে লালা ঝরানাে দৃষ্টি মেলে চুপ করে আছে।
তরা দুই জন না। আগে আমারে কান্দে লইয়া চরে ঘুরব ওই হারামজাদা। হের আহাতাহা বেশি। আজ রাইতটা ওই কালীচরণের। তরা সবুর মাইন্যা থাকবি। পরের রাত, এর পরের রাত তরা দুই জনের। খাবলা খাবলি করবানা রাখাইল্যা বেডারা। আমি তাে তরারে দিবার লাইগ্যাই আইছি। কত খাইবি! বলতে বলতে মইষা উঠে দাঁড়াল। কোমর থেকে পঁাচ দেয়া শাড়িটা খুলে আড়বাঁশের ওপর রাখল। ছায়ান্ধকারে হা করে তাকিয়ে রইল কামাল ও তােরাব? মনে হলাে বিশাল দুটি স্তন ব্লাউজের একটা মাত্র বােতামে বাঁধ মানছে না। দুদিক থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসছে। সবই আবছা ছায়ার মতাে দুই রাখালের চোখে পড়ছে। তারা যেন মন্ত্রমুগ্ধেও মতাে মইষার ধমকে টোলের ছাত্র হয়ে চুপচাপ বসে থাকল। এই সময়ে কালা এসে হাসি মুখে দাঁড়িয়েছে। সেও অবাক। মুহূর্তের মধ্যে তার হাসিটা উবে গেল। তার সামনে শুধু একটা ব্লাউজ পরে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মইষা ঋষি। এই হারামজাদা! আমারে কান্দে লইয়া বাইর। ঘাড়টা নােয়া।
নিজেই এগিয়ে এসে তার দুই কাঁধে দুই রান ছড়িয়ে মইষা বলল, ওঠ, তােল আমারে। আজ তরে লইয়া যামু যমুনায়। কালা একটা সহজ বােঝার মতাে মইষাকে কাঁধে তুলে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর মইষার ইশারায় চলতে লাগল ঘাস ভর্তি চাদনি রাতে উথলে পড়া নদীর বাতাসের মধ্যে। মধ্যচরের দিকে। পেছন থেকে তােরাব ও কামাল দৃশ্যটা দেখে ছাউনিতে এসে দাঁড়াল। আকাশে তখন চাঁদের মুখটা নীলের তস্তুরীতে সিদ্ধকরা আধখানা ডিমের মতাে। দেখাচ্ছে। যেন আকাশে কেউ একটি অপূর্ণ সােনার ডিম গড়িয়ে দিয়ে মেঘের ভেতর লুকিয়ে পড়েছে। একদিকে সপ্তর্ষি তারার প্রশ্ন চাঁদের উদরে ঝিলমিল করতে লাগল। ঘালা কালার ভাইগ্যটা দেখছস, তােরাব? দেখতাছি। কিন্তু আফসােস হে তাে এই মহিষানি মইষার তেল মজাইতে পারব না। ওই বেটা সারাজীবন গাইয়ের লাথি খাইয়া সামনের দাঁত ফালাই দিছে। আইজ দেখিস ওর বুকে লাথি মরবে মাগিটা। তুইত জানস না কামাল এই মইষানিরে আত করতে আমার কত কষ্ট করতে হইছে। ঋষিপাড়ার বেডারা বুঝতে পারলে আমারে কাইট্যা ফালাইত। জানস না দত্তখলার ঋষিরা কুবাইয়া বাউনবাইড়ার কত খেতঅলারে তিতাসের কূলে মাড়িচাপা দিয়া রাখছে। আমি আনলাম কারণ একশ ট্যাহা সােজা কথা না। মাসে একশ ট্যাহা দিমু কইতেই মইষানি ওইঠ্যা খাড়াইয়া গেল গা। আর এখন কী না একটা বাছুরের কান্দে ওইটা চরে রওয়ানা দিছে। ঠিক আছে। সান্ত্বনা দিয়ে হাসল কামাল। কাল রাইতে তর পালা। আইচ্ছা কইরা রস মিটাইয়া দিবি। নাম রাখছে আবার মইষা ঋষি। কাল ষাড়ের গুঁতা খাইলেই মাগি বুবং বাথানের রাকখালরা দুধের সর খাইয়া কেমন পাথর হইয়া গেছে। হাঁটতে হাঁটতে ঘাড়ে একটা নগ্ন দানবীকে নিয়ে যেন চলছে কালীচরণ। সে মজাই পাচ্ছে কারণ মইষা মাঝে মধ্যেই তার কান টেনে বলছিল, এই আরাে জোরে হাঁট। এখন এতদূও চলে এসেছে সম্ভবত এখান থেকে তাদের থাকার ছাউনিটা এই চাদের আলােতে আর দেখা যাচ্ছে না। আর কত চলুম? এর পরে তাে চর শেষ, নদী শুরু। আমারে লইয়া কি নদীতে ডুববা নাকি? মইষাকে উদ্দেশ্য করে আপন মনে কথাগুলাে বলল কালীচরণ। সে রীতিমত ঘামছিল। মইষা তার বাহনের ক্লান্তি ও ঘর্মাক্ত অবস্থাটা আন্দাজ করতে পেরে বলল, থাম হারামজাদা! নামা আমারে। এ কথায় কালীচরণ সােজা বসে পড়ল এবং ঘাড়ের বােঝাটার টাল রাখতে না পেরে গড়িয়ে পড়ল চরের ঘাসে।
মা গাে! হারামজাদা আমারে ঘাসের উপর হুতা দিছে। জিরাইয়া ল বেডা। আর আমি হুইয়া একটা সিগারেট খাই আর চান্দের মুখ দেখি। বলেই খিলখিল করে হাসতে লাগল মইষা ঋষি। সে দুপা ছড়িয়ে নগ্ন হয়ে শুয়ে আছে। তার এক বােতামঅলা ব্লাউজের ভেতর থেকে উইয়ের ঢিবির মতাে বেরিয়ে এসেছে দুটি স্তন। যেন কালাে মাটির বড় দুটি মুছি।
কিন্তু কালীচরণ তার ঘর্মাক্ত শরীর নিয়েই হামাগুড়ি দিয়ে মইষার পাশে এসে বসল এবং তার তলপেটে এবং নাভীতে হাত ঘসতে লাগল। ওই হারামজাদা! উঠবি তাে উইঠা পড়। মইষা ঋষি তার পা দুটি ইষৎ ভাঁজ করল । চাঁদের আলাে চরভূমিতে এখন এক অদ্ভুত চোরাই দুধের ভাড় যেন উবুড় করে দিয়েছে। উঠ হারামজাদা। আর হাত ঘসবি না। এবার কোন কথা না বলে কালীচরণ মইষার উপর শুয়ে পড়ল। ঠিক সে সময়েই এক খণ্ড মেঘ এসে চাঁদকে আড়াল করে দিয়েছে। চরভূমিতে উঠে এসেছে দুধের বদলে তিতাসের মাখনাগন্ধি কালাে পানির আবরণ।
॥ তিন॥
সকালবেলা ছাপড়াটা সুনসান। রাখালেরা তিনজনই গাই গরু নিয়ে চারণভূমিতে চলে গেছে। যাওয়ার সময় তােরাব মইষার কোমরে একটা লাথি মেরে তাকে জাগিয়ে দিয়ে বলে গেছে, এই মাগি ওঠ, আমরা আমাদের আদি কামে চললাম। তুই উইঠ্যা রান্দাবাড়া কর। ছাউনিতে হাগ, হুটকি যা আছে রাইন্দা রাখবি। তর সাথে যে চুক্তি কইরা আনছি হেই কাম কর। গত রাইত তাে কালার কান্দে চড়লি। আইজ রাইতে কামাইল্যার কান্দে চড়িস। কিন্তু তার আসল কাম হইল ভাত রান্দা। একশ টেহা নিবি আর পা ছড়াইয়া হুইয়া থাকবি মাগি। আমি কিন্তু তর গাওরামি দেখতাছি। আমি তােরাব আলী মনে রাখিস-এই কথা বলে মইষার পাছায় আরাে একটা লাথি মেরে তােরাব তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে ষড় খেদাবার হুঁই ছুঁই শব্দ করতে করতে চারণভূমির দিকে ছুটতে লাগল। মইষা একবার পটলচেরা চোখ মেলে রাখালদের চলে যাওয়া দেখল। হারামজাদা রাখালের বাইচ্চারা। আমারে ঘাটাইলে তােরাইব্যার কপালে জিল্লতি আছে। বলতে বলতে মইষা পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ল। তােরাব অবশ্য ইঙ্গিত দিয়ে গেলে তারা দুপুরে একজন করে খেতে ফিরে যাবে। ঘুমন্ত মইষাকেই সাবধান করে গেছে যেন সে দিনের বেলায় কাউকে ছাপড়ার ধরে রাখবার চেষ্টা না করে। খাইতে আইলে খাওয়াই বিদায় করবি কাউকে বইতে দিবি না। দুজন খাইয়া গেলে আমি আমু। এই বলে দিয়ে সাবধান করে গেছে তােরাব। সব কথা মইষার কানে যায়নি। সে। পাশ দিয়ে পাছায় লাথি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। এখনাে বাইরে ঠিক মতাে আলাে ফোটেনি। মইষা জানে না রাখালরা শেষ রাতে উঠে গাইগুলাে ধুইয়ে খলার ভাঁড়ে দুধ রেখে চলে গেছে। সকাল হলে আঘাটা থেকে মানুষ এসে ওই দুধ বাজারে নিয়ে যাবে। রাখালেরা যে এত করিৎকর্মা লােক তা মইষা এক রাতেই ঠাহর করতে পারেনি। চারণভূমির মাঝখানে প্রায় পঁচিশ-ছাব্বিশটি ষাঁড় গরুকে তােরাব পাজন হাতে ঠেলে এনে জড়াে করেছে। মুখে অদ্ভুত হিস হিস ও রে রে শব্দ। গাভীগুলাে দেখছে কামাল। আর বাছুর সামলাচ্ছে কালা। কালার শাসন থেকে বাছুরগুলাে ছুটে গিয়ে গাইয়ের উরে মুখ লাগিয়ে টানছে। তবে তেমন কোন বিশঙ্খলা নেই এদের মধ্যে। প্রায় শতাধিক গাই গরু ও বাছুর। এর মধ্যে কোন বিশৃঙ্খলার মধ্যেই অবাধ্যতা এবং ছােটাছুটি বেশি। তােরাব দক্ষ রাখালের মতাে বাথানের সবগুলাে গরুর ওপরই খবরদারি রাখছে। সূর্য ওঠার সাথে সাথে মইষা আড়মােড়া ভেঙে বিছানাে চাটাইয়ের ওপর উঠে বসল। দেখল চারদিকে কোন জনপ্রাণীর সাড়া নেই। একবার বাইরে এসে দাঁড়িয়ে বুঝল তার গায়ে কোন আব্রু নেই। সে দৌড়ে ছাউনির নিচে ঢুকল। যে সায়াটা কাল সে পরে এখানে এসেছিল সেটা টেনে নিয়ে অদ্ভুত কায়দায় ছতর ঢাকল। তারপর সােজা হাঁটা দিল নদীর দিকে। হাঁটতে হাঁটতে আঘাটায় পৌছে নদীর পানিসীমায় নেমে এসে দাঁড়াল। একবার নদীর দিকে তাকিয়ে দেখল, না এপারের দিকে কোন কলের নৌকা ফটফটিয়ে যাচ্ছে না। নদীর পশ্চিম পাড়ের তীর ঘেঁসে নাওয়ের চলাচল থাকলেও সেখান থেকে কেউ এ পাড়ের মানুষকে নজর করতে পারবে না। সুযোগ বুঝে মইষা সায়াটা খুলে সােজা নেমে গেল পানির মধ্যে। তিতাসের ভেতর ডুব দিয়ে কতক্ষণ ঝিম ধরে থাকল। কিছুক্ষণ পর হউ মাছের মতাে শব্দ করে মাথা তুলল ঢেউয়ের ওপর। মুখে বলে উঠল, কৃষ্ণ, কৃষ্ণ! এবং পূর্বদিকে ফিরে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে অদৃশ্যকে প্রণাম করল। কিছুক্ষণ পানির ভেতর থেকে ভেজা ব্লাউজসহ নিম্নদেশ সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় মইষা তীরে উঠে এল। দ্রুত হাতে সায়াটা কোমরে তুলল। তারপর হাঁটা দিল ছাউনির দিকে। সূর্য এখন ঠিক মধ্যগগণে। তীব্র রােদে দগ্ধ হচ্ছে চরভূমি। ইটখােলার চিমনির ধোয়া এখন বেশ কালাে ও গনগনে মাটিপােড়ার গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। মইষা ভাতের ডেগ উল্টে দিয়ে রান্নার চুলার উপরে শিকেয় রাখা সিদল পুঁটকি ও মরিচের গুঁড়াে স্বভাবসুলভ অনুসন্ধানেই বের করতে পারল । সে একটা সানকিতে শুটকি ও মরিচের গুঁড়াে মিশিয়ে ভর্তা তৈরি করল। দেখল যে ছাউনির এদিকটার প্রতিটা বাঁশ বেয়ে গজে উঠেছে পুঁইপাতা। সে পুঁই শাকগুলাের ডাটা কেটে রসুন দিয়ে ভেজে অন্য একটা সানকিতে রাখল। তারপর রেখে যাওয়া একটা মাঝারি কিসিমের টোপায় দেখল প্রায় সের পাঁচেক দুধ। একটা বড় মাটির হাঁড়িতেই দুধটা ঢেলে নিয়ে মইষা চুলােয় বসিয়ে দিল। এখন আর লাকড়ি ঠেলার প্রয়ােজন নেই। কারণ লাল অঙ্গারে চুলােটা গনগন করছে।
দুধটা বসিয়ে দিয়ে মইষা ফিরে এল ছাউনির ভেতর। এসে আড়াশে ঠেস দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে থাকল। সে জানে তােরাবের কথা অনুযায়ী রাখালরা একজন একজন করে খেয়ে দেয়ে যাবে। তােরাব তাকে একশ টাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে। একশ টাকা অনেক টাকা। মইষার ঘর্মাক্ত মুখে আনন্দের বিচ্ছুরণের মতাে একটু হাসি দেখা দিল। সে আবার আড়বাঁশে ঠেস দিয়ে দুপা ছড়িয়ে ঘুমােবার চেষ্টা করল। ঠিক এ সময় কখন যে কামাল এসে মইষার পাশে দাঁড়িয়ে লােলুপ দৃষ্টিতে তাকে দেখছে সে বুঝতে পারেনি। কিন্তু রাখালদের শরীরের গন্ধটা এতই তীব্র গাে চেনার গন্ধের মতাে যে মইষার চোখ আপনা থেকেই খুলে গেল। দেখে দৈত্যের মতাে ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে লােলুপ দৃষ্টিতে কামাল তাকে দেখছে। শুয়ােরের বাচ্চা! বেজন্মা। খেঁকিয়ে উঠল মইষা। গালি দেস ক্যান? মাইয়া লােক দেইখা তর আফসােস যায় না। আজ রাত আমারে কান্দে লইয়া ঘাসের খেতে লুটোপুটি খাইবি। পরান সবুর মানে না? এখন তাে রাক্ষসের মতাে গিলতে আইছত। এখন আমার দিকে নজর দেস ক্যান। বলতে বলতে মইষা তার একটি পা বসে পড়া কামালের বুকের ওপর রাখল। নে চুমা দে। জগদ্ধাত্রীর পা! কামাল সত্যি সত্যি পা টা সরিয়ে এনে পায়ের তলায় সজোরে একটা চুম্বন করল।
এই বেজন্মা তর আসল ঠিকানা কিরে? এই চরের আইল থেইক্যাত পয়দা হস নাই । বাড়ি কই তর? হগাে বইন। তুই একটা কথা ঠিক কইছস। এই চরের ঘাস থেইক্যা আমি বার অইছি। বেজন্মা ঠিকই। ওই ইটখােলা এখন যেখানে সেখানে একটা অনেক বড় বাথান ছিল। ওই বাথানের রাকখাল সর্দারের নাম ছিল জামাল উদ্দিন। আমি তারে বাপ ডাকতাম। হুনছি ওই রাকখাল সর্দার একদিন ভােরবেলা গরু লইয়া বাইরবার সময় দেখে যে বাথানের গেইটে একটা আউজ ঘরের আবুইদ্যা চিল্লাইতাছে। শিশুডার চাইরপাশে ধােড়া কাওয়া ঠোকরাইতেছে। জামাল উদ্দিন দৌড়াইয়া আতের পাজন দিয়া ধােড়া কাওয়া তাড়াইয়া দেখে মাইনষের বাইচ্চা। ওই বাউনবাইড়া শহর থেইক্যা কেউ পুটলাটা এখানে রাইখ্যা গেছে। এইত আমি। কে জানে আমার মা কেডা? কে জানে আমার বাপ কেডা? আমার ধর্ম কী হিন্দু না মুসলমান না কেরেস্টান। কে জানে বইন! ওই জামালউদ্দিন আমারে ফালাছে। নাম রাখছে কামাল উদ্দিন। তাে আমার জন্ম আসলে এই চরের ঘাস থেইক্যা। ঘাসের মতাে আমি বেজন্মা । পূর্ণ দৃষ্টিতে মইষা এবার কামালের দিকে তাকাল। মনে হলাে তার সেই ছেনালিপনা চেহারাটা যেন কাদার মতাে ঘেমে উঠেছে। যা ভাত খা গিয়া। হিদল আছে, হাগ আছে আর আছে দুধের সর । পেট ভইরা খাইয়া অসুর হইয়া বাঁইচ্যা থাক। আজ রাইত তরে লইয়া পাড়ি দিমু। আমি ডরাই তােরাইব্যারে। আমিও। তােরাইব্যা পাজনের খইরকা দিয়া গুঁতা মেরে আইবার সম কইছে বইবি না। খাড়াইয়া খাইবি। দৌড়াইয়া আইবি। এ কথায় মইষা উঠে দাঁড়াল। আয় আমি তরে বাইড়া খাওয়ামু। কইতে কইতে মইষা গায়ে শাড়ি জড়িয়ে মাথায় ঘােমটা তুলে দিল। চুলার পাশে গিয়ে কাঠের পিঁড়িটা ঠেলে দিয়ে বলল, বয়। তারপর সানকিতে গরম ভাত ঝাল সিদলের ঢেলা ও শাক তুলে দিল। একটা মাটির মগ থেকে পানি ঢেলে হাত ছিটকা দিল কামাল। তারপর সত্যিই যেন দানবের মতাে খেতে লাগল। তার হাপুস হুপুস খাওয়া, শাক মিশ্রিত নলা তােলার দৃশ্য অবাক বিস্ময়ে দেখতে লাগল মইষা। রান্দা কেমন অইছে? অমৃত! আমি অসুররে অমৃত ভক্ষণ করাইতাছি। হা কৃষ্ণ! বলেই খিলখিল করে হেসে ফেলল মইষা। ডাবাটা কিন্তু আমি একটা টান দিয়া যামু বইন। আয় আমি সাইজা দেই।
খুব তাড়াতাড়ি করন লাগব। তােরাইব্যা মারব আমারে । তােরাইব্যা মানুষ না বইন পাষণ্ড। এই বাথানের বড় ষাঁড়টার মতাে। খালি গুতাইবার চায়। বড় মারে। তুই সাবধান। হের আতে খইড়কা পাজন আছে। মইষা খিলখিল করে হাসতে আকাশের দিকে মুখ তুলে বলল, কৃষ্ণ, কৃষ্ণ! ডাবাটায় কয়েকটা দম মেরে কামাল ছাউনির বাইরে গিয়ে দৌড় শুরু করল । মইষা এতবড় দানবরূপী অসুরের ভীতি-বিহ্বল ছােটা দেখে বিস্মিত হলাে। যে তােরাবের ভয়ে কামাল দৌড়াচ্ছে সেই তােরাবকে সে একটামাত্র লাথিতে কম্ম কাবার করে দিতে পারে। কিন্তু এ কী ধরনের আনুগত্য? তােরাবের খড়কে পাজনের পুঁতাের ভয়ে এই দানব শিশুটি চারণভূমিতে ফিরে যাচ্ছে ভাবতেই মইষা আপন মনে বলে উঠল, রাখ তােরাইবা, আমি জানি তর ক্ষমতা কত। আমি তর ভেতরটা, জুরের জায়গাটা মুচড়াইয়া ভাঙুম। এই বাথানের সবগুলাে ষাঁড়কে আমার বশ করতে অইব। সবার বুকের ওপর তুইলা দিমু আমার ঠ্যাং। তােরাইব্যা হারামজাদা তরে দিয়া আমার পায়ের পাতা চাটামু। আমি মইষা ঋষি মনে রাখিস। আড়বাঁশের ওপর ঠেস দিয়ে বসল মইষা আগের মতােই দুই পা ছড়িয়ে দিয়ে। এর মধ্যেই সে কামাইল্যার পোটলা, সানকি ইত্যাদি ধুয়ে পরিস্কার করে সাজিয়ে রেখে এসেছে। হয় এখন কালীচরণ কিংবা তােরাইব্যা ডাকাইত কেউ একজন আসবে। আড়াশে মাথা লাগিয়ে চোখ বন্ধ করতেই মইষা স্বপ্নের ঘােরের মধ্যে পড়ে গেল।
তিতাস নদীটা যেন হঠাৎ একটি অতিকায় অজগর হয়ে মইষার দিকে হা করে এগিয়ে আসছে। সাপটা মইষার কোমর পর্যন্ত গিলে ফেলেছে। মইষা সাপের মুখ গহ্বর থেকে | চিৎকার করে বলছে বাঁচাও, বাঁচাও! এ সময় তার পাশ থেকে কালীচরণ হেসে বলল, তােমারে বাঁচাইবার কর্ম আমার না। তাড়াতাড়ি উড। চাইট্যা খাইয়া একখুনি দৌড়াইতে অইব। না অইলে তােরাইব্যা মাইরা ফেলব। মইষা ত্ৰামযুক্ত স্বপ্নের ঘাের থেকে উঠে সােজা দাঁড়িয়ে গেল। ও মাগাে মা! আর একটু অইলেই গিল্যা ফেলছিল। ও মা। এ আবার কোন কথা কয়। তরে আবার গিলব কেডা! কালীচরণের বিস্ময়। ওই তিতাস অজগরনি! উইঠা আইসা আমারে গিলতে লাগছিল। তুই বেডা কালার বাচ্চা একটু আগে আইলে তাে আমি দুঃস্বপ্ন দেখতাম না। তয় তুই আওয়াতে আমার সবটা হাপের পেড়ে যায় নাই। যা বেড়া তােরাইব্যার গােলাম, খা গিয়া। সব ঠিক কইরা রাইখা আইছি। গিল আর মনে মনে আমার ভজনা কর। আমি জগদ্ধাত্রী। আমি তর মা । তােরাইব্যার গােলামি থেইক্যা আমি তরে, কামাইল্যারে ছুড়াইয়া আনুম। ও তরার কান্দে জুয়াল তুইল্যা ঘুরাইতাছে। আমি এই জুয়াল ছাড়ামু। সব্বনাশ! এই কথা মুখে আইন না। এই কথা টের পাইলে তােরাব তােমার দুই ঠ্যাং ধইরা ছিড়া ফেলাইব। তুমি তাে জান না তােরাইব্যা মানুষ মাইরা এই চরে খাদাইয়া। ফেলে। তােরাইব্যার ডরে ওই ইটখােলার মানুষরা পর্যন্ত বাবা বাবা করে! আর তুমি দত্তখলার চামারনি তােরাইব্যারে নুয়াইবার স্বপ্ন দেখতাছ। তুমি বুঝ না তােরাইব্যা তােমার দিকে একবারও চায় নাই। হেই জানে হে কী চায়। তােমারে আনছে রান্দনের লাইগ্যা। হেই কামই করতে থাক। মাসে একশ টেহা মুখের কথা না। তোরাইব্য, ভগবানই জানে যে একশ টেহা কোথেইকা বাইর করব। আইজকাল দুধ চুরি কইরা বেচন যায় না। খলার মালিক লাইঠ্যাল লইয়া আইসা হাজির হয়। একশ টেহা সোজা। কথা না। কামাইল্যা ও কালাকে বিদায় করার পর মইষা এগিয়ে গিয়ে চুলার আশপাশটা ঝাড় দিয়ে পরিষ্কার করল। তার মুখে একটাই শব্দ তােরাইব্যা হারামজাদা আমার দিকে একবারও চাইলি না। তুই হারামজাদা রাইতে ছাউনিত না থাইক্যা ওই গাই আর ষাঁড়গুলাের সাথে বাথানের ভিতরে বাঁশের মাচানে ঘুমাস। হারামজাদা ডেহা আর দামড়ি গাইয়ের সাথে থাকতে থাকতে তর আর মাইনষের মায়ার প্রতি চোখ নাই । হারামজাদা কানা মইষা ঋষির গতরের দিকে চাইয়া কত বেডা, বামনবাইড়ার মতাে ঠিকাদার, মাঝির পুতেরা আমার ফাইল, আমার ঠ্যাংয়ে উবুড় হইয়া পড়ে। আর তুই হারামজাদা তােরাইব্যা তর ভিতরে কী আছে আমি দেখুম। এই কথা ভাবতে ভাবতে মইষা চুলার আশপাশের জায়গাটা সাফ করে একটা ধাড়ির ভাঙা এনে চুলার পাড়ে রাখল। মনে হলাে যে, তারও খিদে পেয়েছে। অথচ তােরাইব্যা এখনও খেতে আসেনি। মইষা ভাবাটা খুলে বের করে এতে তামাক সেজে, চুলা থেকে একটা আংড়া কল্কে ঠেসে ভরে টানতে শুরু করল। এই অবেলায় হুক্কা জ্বালাইছস চামারনি। তর ভুখ, খিদা লাগে না? মইষা ঘাড় ফিরিয়ে দেখে তােরাব দাঁড়িয়ে আছে। খুব মধুর হাসি হেসে মইষা হুকাটা তােরাবের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, মায়া লােকের ভুখ, হুদা ভাতের লাইগ্যা, তুই ভাবাে ওস্তাদ? লও হুক্কা ধর। তােমার ভাত বাড়ুম। মইষার কোমল ব্যবহারে একটু মৃদু হাসল তােরাব। হুকাটা তার হাত থেকে নিয়ে সজোরে একটা টান দিয়ে নামিয়ে রাখল। একটু সবুর কর মইষানি। আমি গামছাড়া ফিন্দা একটা ডুব দিয়া আই আঘাটা থেইক্যা। হুনলাম তর রান্দা নাকি কামাইল্যা আর কালার খুব ভাল্লাগছে। আমারও ভাল্লাগছে। এর আগেতাে চামারনির হাতে রান্দা খাইনি। দারুণ মজা। এ কথায় মনে হলাে মইষা যেন মুহূর্তে গলে পানি হয়ে গেল। একটু আগেও তােরাইব্যার আতাজুড়ি বের করে দেখবার যে বাসনা ছিল, তা মনে হলাে ওই দৈত্যের মতাে কালাে পুরুষটা ভেতর থেকে তার প্রশংসা এবং গুণের কথা ফোঁটা ফোঁটা করে চুইয়ে পড়ার কারণে মইষা ভিজে গেছে। তার ভেতরটা তােরাবের জন্য মুহূর্তেই বদলে গেল ।
হঁা এই রাখাইল্যাটা একটা পুরুষ বটে। লম্বায় প্রায় ছয় ফুট হবে। আড়াশ থেকে একটা গামছা কাধে নিয়ে তােরাব নদীর দিকে চলে গেলে মইষাও তার শাড়ি, ব্রাউজ ও সায়া শরীর ঢাকার এই সামান্য পিন্দন যতটা সম্ভব ঠিকঠাক করে পরে নিল। খােপার চুল খুলে একটা এলােবেনি পিঠের উপর ছড়িয়ে দিলো। মইষা মনে মনে ভাবল এই লােকটা তার গতরে কেমন যেন ঘাম ঝরিয়ে দিয়েছে। চরের উন্মুক্ত বাতাসে চুলার পাশে বসে মইষা ঘামতে লাগল। একটু পরেই ভেজা শরীর ও মাথা মুছতে মুছতে ছাউনিতে এসে ঢুকল তােরাব। আড়চোখে সে একবার মইষাকে দেখল । তার হাতে গরম ভাতের সানকির উপর পুঁইশাকের ডাটাভর্তি উষ্ণ শাকের আয়োজন। তার পাশে সিঁদলের ভর্তা। নুন। একটা সানকিতে গরম দুধ প্রায় সেরখানিক। চামড়ার মতাে সর। যে কোন ক্ষুধার্ত পুরুষের কাছে সত্যিই অমৃত! তোরাব সােজা এসে বসে পড়ল। সদ্যস্নাত পুরুষের শরীর থেকে যেন একটা স্নিগ্ধ শক্তির বিচ্ছুরণ ঘটে। তােরাবের শরীর থেকেও তেমনি তার প্রবল শারীরিক শক্তির আভাস ঠিকরে বেরুচ্ছে। পেশীগুলো এখন তিতাসের ঠান্ডা পানিতে স্নিগ্ধ ও উত্তেজনাহীন। মইষা কোন কথা না বলে তার দিকে সবকিছু বাড়িয়ে দিয়ে হাঁটু ভাঁজ করে বসে পড়ল। তােরাব একবার মইষার দিকে তাকিয়ে বলল, তুই খাবি না? আমি তাে তােমারে বিদায় কইরা ঘাটে যামু। তােরাব কোন জবাব না দিয়ে ক্রমাগত খেতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে দুই সানকি ভাত-ব্যঞ্জন ও দুধ সাবাড় করে অত্যন্ত পরিতৃপ্তির সাথে হাসল। তুই কোথেইক্যা আইলি? বড়ই মজা! তর লাইগ্যা চুরি কইরা দুধ বেচার একটা ব্যবস্থা করছি। ওই ইটখলা থেইক্যা রাইত থাকতে একটা বেডি আইয়া বাথানের দুধ লইয়া যায়। বুঝলি? তর লাইগ্যা করলাম। বাথানের মানুষ এই ধরনের অন্যায্য কাজ করে । তর লাইগ্যা করলাম চামারনি। তবে একশ টেহাই দিমু। জবান লড়চড় হইবাে । তুই যে মাসে একশ টেহা লইবি রাখবি কই? এই দুই চোরা কামাইল্যা আর কালীচরণের মাইঝে লুকাইবি কই? লুকাইতে হইবাে না। তুমি আমারে যে গাঁও থেইকা লইয়াইছ সেই গাঁওয়ে আমার একটা বইন আছে উষা ঋষি। আমার ছােড। বাউনবাইড়ার বাজারে পানি তুলে। মাস ফুরাইলে ঠিক আইয়া হাজির হইব। আমি তারে কইয়া আইছি। তাইলে উডি। এই সময় মাঠের সব গাই গরুর তিয়াস লাগে। গরুর পাল লইয়া তিতাসে নামতে অইবাে। ষাঁড়গুলােরে ধােয়াইতে অইবাে। তারপর হাইজা পর্যন্ত ঘাস খাওয়াইব ওই কামাইল্যা আর কাইল্যা। আর আমি তখন ওই একটা শ্যাওড়া গাছের নিচে একটু জিরাইয়া লমু। আমি মানুষ খারাপ না বুঝলি চামারনি। অদ্ভুত এক ধরনের হাসি হেসে কথাগুলাে বলল তােরাব। আমি তাে তােমার দুই সাগরেদের ঠিকানা জানছি। ঘাড়ে চড়ছি, নিচে হুইছি কিন্তু তােমারেই বুঝলাম না। মন চায় না? এই প্রশ্নে হু হু করে হেসে উঠল তােরাব।
আমারে গলাইতে চাস? হুন আমি বেজন্মা না। আমার মা আমারে লইয়া বিধবা হইছিল। দুইটা গাই পালত। দুধ বেইচ্যা আমারে পাঠশালায় ভর্তি করছিল। আমি লেখাপড়া কিছু জানি। নাম লিখতে পারি, পড়তে পারি। বুঝলে মাগি । আমি গরু না । তুইত আমারে ষাড় ভাবছস। আমি গরু না, মানুষ। আদম। তবে কপালডা ভাইঙ্গা গেছে। এই যে বাথান দেখছস এর মালিক আমার মারে হাঙ্গার লােভ দেখাইয়া ওই দুইটা গাইসহ তার নিজের গােয়ালে লইয়া গেল। আমার মারে অবশ্য কাবিন কইরাই নিছল। মানুষটা একেবারে খারাপ ছিল না। আমারেও আদর করত। কিন্তু আমার কপাল ভাইঙ্গা গেল আমার মা বাচল না। এক বছরের মাথাতেই কলেরায় মইরা গেল। তয় ওই বাথানের মালিক আরব আলী আমারে কইল, দেখ তর মারে আমি বিয়া করছিলাম, আমার বউ ছিল আমি দুইটা গাইয়ের লােভে নিকা করি নাই। তরে আমি আমার নিজের পােলার মতাে আদর করছি। তর বয়স কত অইব বার-তেরাে। তুই যদি ইচ্ছা করস ওই দুইটা গাইসহ আরও দুইটা গাই বেশি দিয়া আমি বিদায় করতে চাই। আর যদি থাকতে চাস আমার সাথে তইলে তুই বাথানে চইলা যা। ওই নিলইক্ষার চরে আমার বাথান আছে, দেড়শ গাই গরু আছে। হিয়ানে গিয়া সর্দারি কর। যাবি? আমি কইলাম যামু। তারপর থেইকা এইখানে আছি। গরু-বাছুর তাে আমি পালতে পারি । এই একশ দেড়শ গাই গরু আমার কাছে কিছু না। আমি একটা আস্ত ষাঁড় কান্দে লইয়া ঘুরতে পারি। কিন্তু বিপদ অইছে দুই হারামজাদারে লইয়া। দুইটাই বেজন্মা, বাপ-মার ঠিক নাই। চোর, ডাকাইত, বদমাইশ। তবে আনছি এই দুইডারে দেখভাল করতে। আর নাইলেত এই দুইডা গাইয়ের উপরে গিয়া উঠব। তুই যদি এই দুইটারে সামাল দিতে পারস তাইলে বুঝবি এই নিলইক্ষার চরের রাজত্ব তর। নে এইবার ঘাডে গিয়া দুইডা ডুব দিয়া আয়। আমি গেলামগা। খাড়াও। ডাবাটা একটা টান দিয়া যাও । বলতে বলতে মইষা কল্কিতে তামাক সেজে একটা অঙ্গার চুলা থেকে তুলে বুড়াে আঙুল দিয়ে চাপ দিলাে। তারপর ডাবাটা এগিয়ে দিলাে তােরাবের দিকে। তােরাব মুগ্ধ হয়ে মইষাকে এই প্রথম ভালাে করে দেখল। তুই বড় ভালাে মায়া। সব মায়াই ভালা। কোন মায়ার ভেতরটা তুমি দেখছ? টানাে, আমি উঠলাম। আঘাড়ায় গিয়া ডুব দিমু আর পাশে যে কলমির ঝাড় সেইখানে থেইক্যা কলমি হাগ তুলুম। রাইতে কলমি হাগ খাইবা। বলে পাছায় একটু দুলুনি বাঁকিয়ে মইষা উঠে দাঁড়াল। তারপর কোন দিকে না তাকিয়ে সােজা হাঁটতে লাগল নদীর ঘাটের দিকে। তােরাব ভাবল, আহা চামার হউক, মেথর হউক মায়াড়ার একটা মাত্র শাড়ি। গতরে পেঁচাইবার আর তাে কিছু নাই। নাহ্, তর জন্য চুরি করতে অইব চামারনি। ডাকা ডালতে অইব।
মইষা আঘাটায় গিয়ে নদীর দিকে তাদিয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর সােজা ঝাপিয়ে পড়ল নদীতে। সাঁতরে চলে এল কলমির দামের কাছে। এখানে নদীতে থৈ নেই। মইষা কলমির দাম আঁকড়ে ধরে পানির ভেতর পা ঠেলে অদ্ভুতভাবে ভেসে থাকল। এক হাতে কলমির কচি ডগা ভাঙতে গিয়ে দেখল ভাঙছে না মচকে যাচ্ছে। মইষা দাঁত দিয়ে কলমিডগা ছিড়ে কিছুক্ষণের মধ্যে স্তুপ করে ফেলল । মইষার নাড়াচাড়ায় কলমির দাম থেকে উড়ে পালাল কয়েকটা ডাহুকি। এ সময় ইঞ্জিনচালিত একটা নৌকা কোথেকে যেন মাঝ নদী ছেড়ে কলমির দামের কাছ দিয়ে এগিয়ে এল। মইষা দেখল মাঝিটা তার দিকে লােভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নাওটা খুব কাছে এসে পড়েছে। কী দেখ মাঝি? ল্যাংটা মেয়েলােক দেখ? মাঝিটা এই প্রশ্নে হকচকিয়ে গেল। এখন ইঞ্জিনটা বন্ধ করে দিয়ে সে মইষাকে অবাক বিস্ময়ে দেখছে। এই বেডি তুমি এই নিলইক্ষ্যার চরে থাক? তােমার হেই দিয়া কাম কী? আমার ঠিকানা জানতে চাও, হাঙ্গার প্রস্তাব দিবা? এই বেডি এমন কইরা কথা কও কেরে? কমুনা, তুমি আমার দিকে হা কইরা তাকাইয়া আছ। দেখ না আমার আব্রু নাই? ভালা চাওতাে চইলা যাও। আমার নাওয়ে উঠবা? তােমারে ঘুরাইয়া আনি। দেখ হারামজাদা! মায়া মানুষের বুঝিন দেখস নাই আগে? হা কইরা আছস। খাবি? মইষা তার ডান স্তনটি উঁচু করে দেখাল। লােকটা এ কথায় আবার ইঞ্জিন চালু করল। আমি ইচ্ছা করলে বেডি তরে জোর কইরা ধইরা লইয়া যাইতে পারি। জানস আমি কে? হারামজাদা তুই জানস আমি কে? আমি মইষা ঋষি। এই চরের রাকখাল সর্দার তােরাইব্যার ভাত রান্দি। এই কথা শুনেই মাঝিটা নির্বাক হয়ে গেল। সে দ্রুত নাওয়ের মুখ ঘুরিয়ে বিপরীত দিকে ধাওয়া করে পালিয়ে গেল। কলমির শাক নিয়ে মইষা ধীরে সুস্থে আঘাটার উঁচু পাড়ে রাখা একটা তক্তার উপর উঠে দাঁড়াল। তারপর ধীরে সুস্থে শাড়ির আঁচল চিপে পানি ঝরিয়ে আঁচলের বাড়িতে চুল ঝাড়তে লাগল। সূর্য তখন পশ্চিমে একটু ঢলে পড়েছে। মইষা ছাউনিতে ঢুকবার আগে শাড়িটা খুলে সম্পূর্ণ ন্যাংটো হয়ে গেল। তারপর শাড়ি ও ব্লাউজ ছাউনির তরজার উপর বিছিয়ে দিয়ে চুলার পাশে রাখা ভাত ও ব্যঞ্জন একত্র করে ক্ষুধার্ত ছাগির মতাে খেতে শুরু করল। খাওয়া শেষ হলে সােজা এসে আড়াশের উপর ভিজা চুল মেলে দিয়ে বালিশহীন বিছানায় কাত হয়ে ঘুমুতে লাগল।
সূর্য ডােবার একটু পরে ষাড়ের হাম্বা রব, নিশ্বাস, মানুষের হাঁকডাক ও তােরাবের কুৎসিত গালিগালাজের মধ্যে মইষা উঠে একটা গামছা দিয়ে ছতর ঢাকল । সহসা বাইরে গিয়ে শুকনাে শাড়ি ও সায়াটা এনে পরার ইচ্ছা থাকলেও বাইরে তােরাবের গলা শুনে সে গামছাটা কোমরে পেঁচিয়ে বুকের উপর টেনে ধরল । এ অবস্থায় মইষা চলে গেল ছাউনির বিপরীত দিকে। ভাবল বাথানে গরুগুলাে ঠিক মতাে ঢুকানাে পর্যন্ত সে এখান থেকে নড়বে না। কিন্তু গাই গরুর পানি খাওয়ার জায়গা এটা। এখানে অনেকগুলাে গামলা রাখা আছে। মইষা অবশ্য একটা গামলার আড়ালেই বসে পড়ল। এ সময় দুটি দামড়ি ও কয়েকটা বাছুর নিয়ে কালাকে আসতে দেখে মইষা গামলাটার পেছনে গুটিশুটি হয়ে বসে পড়ল। কালা দূর থেকে মইষার মাথা লক্ষ্য করে হাসল। ওই খানে লুকাইয়া আছ কেন? আমি লেংটা! তুই ছাউনির উপর থেইকা আমার শাড়িটা আইনা দে। বাছুরগুলাে ততক্ষণে গামলায় মুখ নামিয়ে দিয়েছে। কালা দ্রুত দৌড়ে ছাউনির চালা থেকে মইষার শাড়িটা নিয়ে এল। দেও। হাত বাড়াল মইষা। বাছুরগুলাের আড়ালে ছতর লুকিয়ে। কালীচরণ শাড়িটা এগিয়ে দিতে দিতে হাসল। তুমি তাে কথায় কথায় কৃষ্ণ কৃষ্ণ জপ কর। আজ দেখ তােমার সেই রাধা মাধবের। মতাে তােমারে শাড়ি আগাইয়া দিলাম। ওরে আমার ননী চোরারে! শাড়ি জড়িয়ে মইষা গামলা ও বাছুরের আড়াল থেকে সােজা হয়ে দাঁড়াল। এই সময় একটা পাজন হাতে কামাল এসে বলল, রাইতের রান্দায় আমি তােমারে যােগান দিমু। আমাদের তােরাব মিয়ার হুকুম। ছাউনিতে আলু আছে। আলু ভর্তা ঘি দিয়া ভাল্লাগব । কিন্তু আমাদের ঘি নাই। জ্বাল দিতে পারি না। তয় সর দিয়া মাখাইয়া খামু। এই বেডা খালি খাম খাম করে। আইজ তাে আমার পালা। কামাল গলার সুর নামিয়ে তার পালার কথা উচ্চারণ করলেই মইষা খিলখিল করে হেসে ফেলল। সবারই পালা আছে, তােরাইব্যার নাই? কামাল বলল, হেই দিকে হাত বাড়াইও না। আইজ পূর্ণিমার চান উঠব আসমানে। আমারে কান্দে লইয়া চরের শেষ মাথা পর্যন্ত যাইতে অইব।
এই কথা বেশি কইও না। জানি না তােরাইব্যার মতাে মানুষরে তুই কী দিয়া ভুলাইছস। আইজ গরু চরাইবার সময় তােরাব সর্দার তাের কথা কইল । বলল, মায়াডা বড় ভালা। কীরে কালা কয় নাই? এ কথায় দপ করে নিভে গেল মইষা ঋষির গলা। তােরাব সর্দার আমারে ভালা কইছে? এই লােকটা ত একটা পাথর। হায় রাধামাধব। ওই পাষাণডারে গলাইয়া দাও। মনে মনে প্রার্থনা করল মইষা ঋষি। কিন্তু মুখে বলল, কৃষ্ণ, কৃষ্ণ! হাত জোড় করে আকাশের দিকে নমস্কার করল। কামাল আতঙ্কিত গলায় বলল, সর্বনাশ! আইজ তরে লইয়া চাদনির চরে যাইতে সর্দার বাধা দিলে আমি মইরা যামু। তােরাব ততক্ষণে প্রায় পঁচিশটা ষাঁড়কে বাথানের বেড়ার ভেতর নির্দিষ্ট জায়গায় বেঁধে রেখে এল। কচুরিপানার ঝুড়ি এনে ষাঁড়গুলাের সামনে রেখে তাকিয়ে দেখল কামাল ও কালীচরণ অন্যান্য বাছুর ও গাই গরুকে তাদের জায়গা মতাে পৌছে দিয়ে পানি ও কটা শুকনাে বনের ঝুড়ি সাজিয়ে দিচ্ছে। গেইটের কাছে দুধের কয়েকটা কাইরা পড়ে আছে। এই কাইরাগুলাে শেষ রাতে এসে দুধে ভর্তি করে তােরাব ও শহর থেকে আসা বাথানের মালিকের লােকজন। এরা নিশাচরের মতাে আসে নিশচারের মতােই চলে যায়। বাথানের অন্য মানুষের সাথে বাথানের মালিকের লােকেরা কথা বলে না। কথা বলে শুধু সর্দার তােরাবের সাথে। তােরাবকে তারা টাকাপয়সা দুধ লেনদেনের খাতা সই করে ফিরিয়ে দেয়। বাথানের দেশনের ব্যাপারে তােরবই সর্বেসর্বা, স্বাধীন। তােরাবের বিরুদ্ধে বাথান, খলা ও ইটখলায় কারাে কোন নালিশ নেই। সবাই বলে লােকটা গোঁয়ার হলেও তার মধ্যে ইনসাফ আছে। সন্ধ্যায় বাথানের কাজ শেষ হলে কালীচরণ ও কামাল এসে রান্নার কাজে মইষাকে এটা সেটা এগিয়ে দিতে লাগল। কিন্তু মইষার দৃষ্টি বাথানের দিকে। তােরাব এখনও বাথানের গেইট পেরিয়ে ছাউনির দিকে আসেনি। কামাল এর মধ্যে মইষাকে প্রলুব্ধ করার জন্য কয়েকবার চেষ্টা করেছে। তার মুখেও ওই একই কথা। বুঝলা মইষা বিবি? আইজ আমার পালা। ওইরে হারামজাদা! তাের পেটের জ্বালার চেয়ে চেটের জ্বালা বেশি। এখন যদি তর মনিব আইয়া আমারে চুলে ধইরা টাইন্যা লইয়া যায় ময়দানে তখন তুই কী করবি? তােমার মুখে শুধু আকথা। আমার মনিবের ইনসাফ আছে। তরে আমরা সবাই ভাগ কইরা খামু। এর লাইগ্যাইতাে তরে আনছি। আগে কালা তরে ঘটছে। আইজ রাইত আমার ।এর মইধ্যে কে বাগড়া দিব? কামালের এই প্রতিক্রিয়ার সাথে সাথেই দানবের ছায়ার মতাে একটি বৃহৎ ছায়া এসে দাঁড়াল তিনজনের পেছনে।
দে, খাওন বাইড়া দে। আইজ শইলডা বড় ম্যাজ ম্যাজ করতাছে। খাইয়া গিয়া হুইয়া পড়ি। আর তুই কামাইল্যার কান্দে উইঠা যেইখানে যাইতে চাস যাইস। আমি কামাইল্যার লালা ঝরানাে বন্ধ করতে চাই। এর পরে পাজন দিয়া বাইড়ামু। ভাতের বদলে ঘাস খাওয়ামু। গাইগুলাে দুধ কম দিতাছে খাওনের অভাবে। কামাইল্যার তো নজর তর দিকে। এই কালা হারামজাদা, কামাইল্যা এই চামারনিরে লইয়া যেখানে খুশি যাক। তুই পিছে পিছে যাইবি না। বলতে বলতে তােরাব কামাল ও কালীচরণ দুজনকে দুদিকে সরিয়ে দিয়ে মাঝে বসে পড়ল। মইষা ধোঁয়া উড়া গরম ভাত এগিয়ে দিলাে প্রথম তােরাবকে। তারপর ব্যঞ্জন, শুটকি, কলমি শাক ইত্যাদি পাতের পারপাশে সাজিয়ে দিলাে। দিয়ে হেসে বলল, খাও সর্দার। সর্দার শব্দটি এমন মিষ্টি করে উচ্চারণ করল যে তােরাব আচমকা মইষার মুখের দিকে তাকাল। আমারে একটু খাতির যত্ন বেশি করতাছ মনে হয়? ওমা কয় কী? তুমি নিলইক্ষ্যার চরের রাজা। আমরা সেলাম করি। তােরাবের গলা থেকে খাদ্য মিশ্রিত একটা অসাধারণ হাসির শব্দ বেরিয়ে এল। দেখ ঋষির মায়া, আমি মাইনষের কদর করি। মানুষের ভুল, চুরি, বদমাইশি আমার দেখার বিষয় না। আমি দেখি আমার বঁড়গুলাের গতর ঠিক আছে কিনা। গাইগুলাের উর ভরা আছে কিনা। অবলা জীব ডাক উঠলেও কইতে পারে না। আমি ষাঁড় লাগাই। গাইয়ের পেডের ভিতরে বাছুর পয়দা হয়। আমি বাইর করি। আমি দুধ দুয়াই, মাছি তাড়াই। কে গুনার কাজ করতাছে আর কে পুণ্য করতাছে হেইডা আমার দেখার বিষয় না। আজ তর ডাক উঠছে তুই কামাইল্যারে লইয়া যা। আমি দরজা ধইরা খাড়ামু না। মাইনষের পাপ-পুণ্যের বিচার করবার আমি কে? তবে আমার রাজ্যে জুলুম অইতে দেই না। বলতে বলতে বড় বড় গ্রাস তুলে খাওয়া শেষ করল তােরাব সর্দার। ততক্ষণে তােরাবের কথায় মইষার হাত কেঁপে যাচ্ছিল। কালীচরণ ও কামালের দিকে সানকি ঠেলে দিলেও নুন পানি দিতে ভুলে গিয়ে সে তােরাবের বিশাল বুকের দিকে তাকিয়ে থাকল। কালীচরণ খেতে খেতে বলল, নুন দে। তােরাব মইষার অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকা দেখে হাসল। আগাে দস্তখােলার মায়া, আগে নিমকহারাইমার নুন, পানি দাও। আমারে কী দেখবা? আমি ত আসলে একটা গরুর রাখাল। বলেই তােরাব ওঠে বাথানের গেইটের দিকে রওয়ানা হলাে। সবাই জানে সারারাত আজ তােরাব সর্দার ছাউনির বেড়ার ভেতর থেকে আর বের হয়ে আসবে না।
আকাশে অপূর্ণ কিন্তু বিশাল একটা ডিমের মতাে চাঁদ উঠেছে। মইষা চুলার পাড়ে নিজের লােকমা তুলছে। বাঁধভাঙা জোছনার ভার মনে হচ্ছে এই ক্ষুদ্র ছাউনিটা সইতে পারছে না। কারণ চন্দ্রালােকের প্রতিফলনে ছাউনির ভেতরটাও এক ধরনের দুধ মেশানাে পানির স্বচ্ছতার মতাে হয়ে উঠেছে। একদিক থেকে অন্যদিক পর্যন্ত সবই দেখা যায়। কিন্তু কোন কিছু স্পষ্ট বােঝা যায় না। আজ বাতাসও বইছে জোরে। নদীর বাতাস। মনে হয় তিতাসের বাতাস একে ইটখলার মাটি পােড়ার গন্ধের সঙ্গে মিশে একটা দগ্ধ গ্রহের গন্ধের মতাে হয়ে উঠেছে। ছাউনির বাইরে বসে ডাবা টানছিল কামাল ও কালীচরণ। গেলে বাইরইয়া যাও। কাম সাইরা তাড়াতাড়ি আইয়। এই মইষা গাইটার রসে গতর ভিজাইয়া বিলের ঘাসের উপর ঘুমাইয়া যাইয় না। কালার গলা থেকে কাম লালসা মিশ্রিত এই উপরােধটুকু শুনতে কামালের ভালােই লাগল। সে ডাবাটা কালার হাত থেকে টেনে নিতে নিতে বলল, তর এত তাগাদা কীয়ে? গেলেত তরে ছাউনির খুড়ার সাথে বাইন্ধা রাইখা যাইতে অইব। নাইলে লে লে করতে করতে তুই গিয়া চরে হাজির হইবি। তুইত একটা আসল হারামজাদা কালীচরণ। তর পালাত শেষ অইছে। আইজ যদি ছাউনির বাইরে পা দেস তইলে আমি তর পুটকি দিয়া পাজন ভইরা ঘাসের জঙ্গলে কাকতাড়ুয়া বানাইয়া রাখুম। বুঝলি? ডাবার গড় গড় শব্দের সাথে কথাগুলাে জড়িয়ে গিয়ে কামালের গলা থেকে নির্গত হলাে। কালা কামালের কাছ থেকে ডাবা হাত বদল করতে গিয়ে সত্যিই ভীত হয়ে হাসার চেষ্টা করল। আমি ত আসলে ভাবছিলাম দূরে বইয়া তােমরার কাণ্ড দেখুম। আমি কিছু করুম না। এই খানে ত ভাগ চাওয়ার কিছু নাই। আমি দেখলে তােমার শরম লাগব? দেখ কালা তরে আমি শেষ বারের মতাে কইতাছি, তুই আইজ ছাউনির মইধ্যে চুপচাপ হুইয়া থাক। বেশি বেসর বেসর করিসনা। আমি তরে বাইন্ধ্যা ফালাইয়া যাইতে চাই না। তর জিব্বাডায় এত লালা ঝরে কেন? খাস নাই, চুষছ নাই? না পুষাইলে মাটির ডেলা চাট গিয়া। নাইলে বাথানে গিয়া দামড়ির চোনা খা গিয়া। মনে রাখিস আইজ আমার পালার রাইত। আমার কোন আহাতাহা নাই। এ সময় দুজনের পেছন থেকে মইষা এসে ধপ করে সামনে বসে পড়ল। কৃষ্ণ, কৃষ্ণ! ও রাধা মাধব। একটু টানি। বহুত ভাত ভাইছি আইজ। আমারে কান্ধে লইয়া দৌড়াইলে কামাইল্যার কাম সারা। বলেই খিলখিল করে হেসে কাত হয়ে পড়ল মইষা ঋষি। তইলে অখন আমি ভিতরে যাই গা। বলল, কালা।
আমার কাকতাড়ুয়াও হইবার দরকার নাই, পাজনের বাড়ি খাইবারও দরকার নাই। আইজ রাতটা ঘুমাইয়া কাটাই দেই। তয় কামাল মিয়ারে কইয়া রাখি আঘটায় দুধের নাও আইবার আগেই বাথানের দরজায় আইতে অইব।। উঠলাম। কালা উঠে সােজা ছাউনির ভেতরে একবারে শেষ মাথায় যেখানে তার জন্য একটা কথা বিছানাে ও পিঁড়ি পাতা আছে সেদিকে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর বুক থেকে ষাঁড়ের পাটা নামিয়ে ফেলল মইষা। একটানে ব্লাউজ খুলে পাশে রাখল। কি জোয়ান? আমারে কান্ধে লইয়া হাঁটবা? না এই খানেই কাম সারবা? মাইনষের কান্ধে উঠতে আমার ভাল্লাগে না। ওই মাগি তুইত ভাঙা কলসি। তরে কান্ধে লইলে, রস গড়াইব না? বলতে বলতে কামাল তার বিশাল দুই বাহু দিয়ে মইষাকে বুকের উপর টেনে আনল। এ সময় আকস্মাৎ বাথানের একটা ষাঁড় হাম্বার করে উঠলে পর পর বেশ কয়েকটা ষাঁড়ও ডেকে উঠল। কেন পশুগুলাে এমন রাতের প্রহরে প্রহরে এভাবে ডেকে উঠে। এর রহস্য কে বলবে? পাখি ডাকে, রাতা মােরগ ডাকে, কুত্তা ঘেউ ঘেউ করে। হয়তাে বা নদীর মাছও ডাকে। অর্থাৎ এই ডাক কেবল পুরুষদের গলা থেকে বেরুয়। মুরগি ডাকে না, পক্ষিণী ডাকে না, মৎসিনী ডাকে না। কেবল ডেকে ওঠে প্রজাতির কিংবা সৃষ্টির পুরুষেরা। নিগুঢ়, গভীর রাতে আদম জাতির পুরুষ যখন ওঙ্কার তােলে, তখন তারা হৃদয়ভাঙা কুই মেরে হু হু শব্দে স্রষ্টার নামে জিকির করে উঠে। এই জিকির ধ্বনিতে প্রকৃতির ভেতর শুরু হয় নিঃসরণ। নৈঃশব্দের ভাষায় যে প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে তা আর জড়কে জড় রাখে না। মনে হয় সবকিছুই প্রাণের গন্ধে ভরপুর। সবকিছুকেই মনে হয় সজীব এবং সপ্রাণ। এই শব্দ শােনার কান থাকতে হয়। চাঁদটা মেঘের আড়ালে সম্পূর্ণ ঢাকা পড়েছে। কালাে মেঘ চাঁদটাকে গিলে ফেলে যেন চরের উপর বাতাস ছেড়ে দিয়েছে। নিস্তব্ধতার মধ্যে চরভূমিটা যতদূর চোখ যায় ঝিমঝিম করতে লাগল। চর থেকে আগাছা গুল্মের একটা মিষ্টি গন্ধ উদ্ভিদের রসায়নের মতাে যেন আবহাওয়ার মধ্যে একটু একটু করে মিলে যাচ্ছে। রাত চারটা থেকেই শুরু হলাে ছায়া মূর্তিদের আনাগােনা। কোন হাঁকডাক নেই, গালমন্দ নেই। কেবল নিঃশব্দ চলাফেরা। আঘাটা থেকে উঠে এসেছে এইসব ছায়ামূর্তি। তারা। বাথানে ঢুকে ঘন্টাখানিকের মধ্যে তাদের কাজ গুছাতে লাগল। এখন আর চন্দ্রালােক বা প্রতিবিম্বের কোন খেলা নেই। কোনাে অন্ধকারে চেপে আছে ছাউনি এবং বাথানের পরিবেশটা । তােরাব ছায়ামূর্তিগুলাের সাথে কেবল ইশারায় ও ইঙ্গিতে নড়াচড়া করছে। চৰ্চন্ শব্দে দুধ দুয়াবার একটা অদ্ভুত শব্দ তরঙ্গের ছন্দ সৃষ্টি হয়েছে। কাঁচা দুধেরও একটা গন্ধ আছে। যা এখন গাই গরুর খলা ও ছাউনিকে একাকার করে দিয়েছে। এর মধ্যেই তােরা একবার গেইটের বাইরে এসে হাতড়ে হাতড়ে কামালের ছাতিতে হাত রাখল। এই উঠ বেজন্মা । দৌড়াইয়া ঘাটে গিয়া ডুব দিয়া। নাপাক শরীরে দুধ ধরন যাইব না।
ধড়মড়িয়ে উঠে বসল কামাল। একবার পাশে হাত দিয়ে দেখল বনুখের মাটির ঢেলার মতাে কঁকড়ে পড়ে আছে মইষা ঋষি। ততক্ষণে তােরাব আবার বাথানের ভেতরে গাই গরুর কাছে চলে গেছে। এখন দুয়ানাের শব্দটা আরও বিচিত্র ও তীব্র হয়ে উঠল । দুধ কমে এলে গাভীর উর থেকে সরু নালে দুধ নামাতে এ ধরনের শব্দ হয়। কামাল উঠেই অন্ধকারের মধ্যে আঘাটার দিকে দৌড় দিলাে এবং এখনাে কিছুই ফর্সা হয়নি। আন্দাজে ঢুকে গেল তিতাসের ভেতর। একটা সাঁতারের ভঙ্গি করে আবার ফিরে এল তীরে। ভেজা গা নিয়ে কামাল ছুটতে লাগল বাথানের দিকে। তােরাব নিজে ঠেলে তুলে দিয়েছে। একটু হেরফের হলেই খড়কেঅলা পাজনের বাড়ি খেতে হবে পাছায় । ফর্সা হবার আগেই দক্ষ হাতের দুয়ানাের পালা খতম। কাঁচা গরম দুধের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে। দুধের লােকরা কাইড়া নিয়ে আঘাটায় ফিরে গেলে তােরাব আবার তার নিজের জায়গায় গিয়ে শুয়ে পড়তে পড়তে বলল, এই কামাইল্যা হারামজাদা কাল বিয়ানে ষাঁড়গুলাে তুই ঠেইলা বাইর করবি। আর ওই হারামজাদারে গিয়া লাথি মার । কালা ঠেলব গাই বাছুর। আমি আরেকটু ঘুমাই। মাথাডা বড় ভার লাগতাছে। তােরাবের কথায় একটি মাত্র ভেজা গামছাটা কোমরে জড়ানাে অবস্থায় কামাল। স্বভাবসুলভ হাসি হেসে উঠল। তুমি ঘুমাও সর্দার। সকালে সুরুজ উঠলে উইঠ। তােমার চিন্তা কী? আমি আছি না। বলতে বলতে বাথান থেকে নির্গত হলাে কামাল। অন্ধকারে যেখানে মইষা চিৎ হয়ে শুয়েছিল সেখানে একবার তাকাল। ভালাে করে দেখা যায় না, কিন্তু কামাল জানে। চামারনিটা দিগম্বর হয়ে পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। তেজ ছিল মাগিটার। ফেরত দেওন জানে। ঘুমাক। কামাল এগিয়ে গিয়ে ছাউনির শেষপ্রান্তে কালীচরণের পাছায় একটা লাথি মারল। এই উঠ বেজন্ম। কালীচরণ একলাফে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। হেসে বলল, এইটা ত আসলে বেজন্মাদেরই চর। কেউ দেখে না, কেউ পুছে না। এর লাইগ্যা কয় নিলইক্ষ্যার চর। ইটখােলার লােকেরা কয় তােরাব রাজার চর। এই চরের মানুষগুলাে যেমন বেজন্মা, ঘাস, গরু, বাথান, বাউর কারােরইতাে জন্মের ঠিক নাই কামাল মিয়া। আমারে লাথি মারলে তােমার নিজের গতরের গন্ধ যাইব গা? যাও আবার গিয়া ডুব দিয়া আইয়। খবরদার! ছাউনির ওই বাঁশগুলাের পিছনে মায়া হুইয়া আছে। ওদিকে যাবি না। তুইত ছুছরা খালি জিব্বা দিয়া লেউন মারতে চাস খবরদার! জেতা পুইত্যালামু আমি তরে। তর জিব্বা কাইট্যা ফালাই দিমু। বাথানে গিয়া গাই ঠেল। আমি ষাঁড় বাইর করুম। একবার ডাবাটা টাইনা যাইতে দিবা না? এখনও ফর্সা অয় নাই। ঠিক আছে? জ্বালা গিয়া । আমি লুঙ্গিডা বদলাইয়া আই।
ঠিক এ সময় পূর্ব দিগন্তে একটা লালচে আলাের বিচ্ছুরণের মধ্যে দ্রুত উঠে এলো গনগনে সােনার থালের মতাে সূর্য। যেন আকাশের চোখের মতাে। কিছুক্ষণ পরেই কামালের বাথান খুলে দেয়া বাঁশের খাঁচা থেকে বেরিয়ে এলো খলার সবচেয়ে গজ উচু, ষণ্ডা ষাঁড়টি। যেন ম্রাটের মতাে তার পদক্ষেপ। শিংগুলো কালো রঙ মাখানাে। চোখের দৃষ্টি তীব্র। বাতাস শোকার এক ধরনের শব্দ তুলে বঁড়টি। বাথানের বাইরে পরিচ্ছন্ন আলাের মধ্যে এসে ঘাড় উঁচিয়ে দিনের প্রথম গন্ধটা নাক দিয়ে টানতে লাগল। তারপর একপা একপা করে সােজা গিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা মইষার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। একবার নাক নামিয়ে মইষার উন্মুক্ত নাভিমূল পুঁকতে লাগল। পশুটার কী হলাে কে জানে। হঠাৎ সে ঘাড় উঁচু-নিচু করে শিং বাঁকিয়ে বাতাসে লাফিয়ে উঠল। যেন পশুটার মগজে কোন ভঁস পােকা ঢুকে পড়েছে। দিগ্বিদিক লাফিয়ে ষাঁড়টা সােজা দৌড়াতে লাগল চরের দিকে। তার পেছনেই বেরিয়ে এল বাথানের বাছাই করা ষাঁড়গুলাে। সবগুলােই বেশ সতর্কভাবে পায়ে মচমচ শব্দ তুলে চরের দিকে যেতে লাগল। ষণ্ডদের চলার শব্দে মইষার ঘােরলাগা দ্রিার অবস্থাটা সম্ভবত কেটে গেল। সে ধড়মড় করে উঠে বসেই নিজের নগ্নতা উপলব্ধি করে দৌড়ে পালিয়ে গেল ছাউনির পেছনের গামলাগুলাের আড়ালে। তারপর চোরের মতাে পা টিপে টিপে ছাউনির ভেতরে এসে শাড়ি, ব্লাউজ ও সায়া তুলে নিল। শাড়ি ও ব্লাউজ কাঁধে রেখে শুধু সায়া পরে সে আঘাটার দিকে দৌড়ে যেতে লাগল। এ সময় দুধওয়ালারা চলে যাওয়াতে নদীর ঘাটটা সুনসান। এমন কি মাঝ নদীতে কোন ইঞ্জিনের নৌকাও চলছে না। মইষা শাড়িটা ভাঙা পাড়ের উপর রেখে সােজা পানিতে ডুব দিল। পানির নিচে মইষার রতিক্লান্ত দেহ জুড়িয়ে যাচ্ছে। ভেসে উঠতে ইচ্ছে করল না তার। ভাবল আমি যদি মাছ হতাম, আমি যদি এই নদীর হউ মাছনি হতাম তাহলে কতই না ভালাে হতাে। মানুষ পানিতে ডুবে থাকতে পারে না। নিশ্বাস নিতে তরঙ্গের উপর আসতেই হয়, ভাসতেই হয়। হউ মাছও ভাসে, সারাদিনে সূর্যাস্তের সময় কয়েকবার। ঢেউয়ের উপর মাথা তুলে মইষা ঋষি তার সাপের মতাে পেঁচানাে দুপাশের দুটি বেণী খুলতে লাগল । তাকে দেখে কলমির ঝোপ থেকে উড়ে গেল একটা পানকৌড়ি। এই নদীটাকেই না মইষার ঋষিকুল পানে, স্নানে, ঘ্রাণে উপাসনা করে এসেছে। আর এ নদীই মাঝে মধ্যে দুঃস্বপ্নের অজগরী হয়ে মইষাকে গিলে ফেলতে আসে।
মইষা বেণী খুলে পানিতে ভাসিয়ে নাড়ল। তারপর আরও একটা বৃহৎ ডুব দিয়ে করজোড়ে ঢেউয়ের ওপর ভেসে মৃদু শব্দে বলল, কৃষ্ণ, কৃষ্ণ! আজ বেশ দেরি করেই তােরাব বাথানের বিছানা ছেড়ে নিচে নেমে এল। কালা আর কামাল প্রতিদিনের মতাে চারণভূমির দূর দূর এলাকায় চলে গেছে। তােরাব বাইরে এসে দেখল প্রচুর কলমি শাকের বােঝা মাথায় নিয়ে শাকঝাড়া পানি নিংড়ে ফেলতে ফেলতে মইষা চামারনি আঘাটা থেকে ছাউনির সীমানায় এসে দাঁড়িয়েছে। সামনে তােরাবকে দেখে মইষা হাসল। আইজ মনে হয় সর্দারের নিয়ম ভাইঙ্গা গেল। হুনছি রাইত থাকতে তুমি সব কাজ সার। রাইত থাকতে গরু লইয়া চড়াইতে যাও। আইজ কী তােরাব রাজার শরীর ভালা না?
ভালাই। তয় আইজ যাই নাই। ওই দুইটা গােলাইম্যারে গাই গরু সামলাইতে দিছি। আসছে মইষা বিবি তােমার সাথে একদিনও ভালা কইরা কথা অইল না। বুঝ তো, ওই হারামজাদার খাবলাখাবলিতে কোসা নাওয়ের কান্দে বসাইয়া তােমারে লইয়া আইছি। নাইলে ওই কুত্তার বাইচ্চারা আমারে একদিন পাজনের বাড়িতে খুন কইরা ফালাইত। তুমি তাে জান না মানুষের রূপ ধইরা দুইডা শয়তান আমার দুই বাজুতে চলাচল করে। কানাকানি করে। কী কমু আর। আইজ তােমার লাইগ্যা থাকলাম। এই প্রথম তােরাব সর্দার মইষাকে তুই থেকে তুমিতে সম্বােধন করল । গলাটা বেশ নামানাে, মায়া ভরা। মইষা তােরাবের গলা শুনেই বুঝল, একটা দেওয়ের ভেতর থেকে যেন মানুষের গলা বার অইতাছে। মইষা মাথা থেকে কলমিগুলাে সরিয়ে ফেলল। ভেজা বুক দুটো অর্ধসিক্ত শাড়িতেই আবৃত করে শরমিন্দা হয়ে হেসে বলল, টোপায় রাখা এক কলস কাঁচা দুধ জ্বাল দিয়া আনুম সর্দার? ছাউনির ভিতরে বইবা? তুমি চুলার পাড় যাও। আমার কাছে চায়ের পাতা লুকানাে আছে। মাঝে মাঝে খাই। আমি। দেকি আছে কি না। কাইল্যা চোরা পাতি পাতি কইরা খুঁজে কী না। ওই হারামজাদা যতক্ষণ এইখানে থাকে খালি খুঁজে। হুদা চা পাতা না, ও যে কী খুঁজে সেইটা ওর মা কালীই জানে। কইছি না দুইটাই হইল ইবলিসের পেশাবখাের। নেশা পাইলে আর ছাড়ে না। আমি দুধ চুরি কইরা হেরার লাইগ্যা তামুক যােগাই, মায়া মানুষ যােগাই, মরা গরুর চামড়া ছাড়াইয়া বেচি। কী করুম কও! মানুষ কয় নিলইক্ষ্যার চরে নাকি আইন কানুন নেই। কেমনে থাকব এইডাও জেলখানা। সাস্ত্রী সিপাই ছাড়া জেলখানা। উত্তর দিক থিক্যা আগাইয়া আইতাছে পােড়া ইট, ইটের চুল্লি আর গরুর ঘাসের জমি পিছাইয়া যাইতাছে। ইট সব খাইয়া ফেলব। ছােড অইয়া আইতাছে। কমতে কমতে একদিন পােড়া ইটই থাকব। মানুষ, গরু থাকব না। বুঝলা মইষা বিবি। সবুজ থাকব না, ঘাস গজাইব না। বলতে বলতে মইষার চেহারার দিকে উদাসীনভাবে দৃষ্টিপাত করে দাঁড়িয়ে রইল তােরাব সর্দার। মনে হয় তার দৃষ্টিতে কোন কিছুর প্রতিফলন নেই। এক দুর্বহ পরিণতির ছবি যেন সে মইষার চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছে। মইষা ভেজা আঁচলটা একটু টেনেটুনে প্রসারিত করে বুক ঘিরে মাথার উপর তুলল। আমি গিয়ে চুলায় ফুঁ দেই। তুমি আইয়। এ কথায় তােরাব আবার পেছন ফিরে বাথানের ভেতরে চলে গেল।
মইষা ভেজা সায়াটা মুচড়ে পানি নিংড়ে একটা বাঁশের উপর ঝুলিয়ে দিয়ে কলমি শাকের বােঝাটা বেড়ার এক পাশে সরিয়ে রেখে চুলার পাড়ে একটা ছিদ্রযুক্ত বাঁশের চোঙা নিয়ে চুলার ভেতরে ফু দিতে লাগল। একটা ফুতেই ছাইয়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল কাঠের জেতা আগুন। শাল কাঠের লাকড়ি ইটখলা থেকে সংগ্রহ করে আনে কামাল আর কালা। চুলাটা জ্বলে দিন রাত। এই চুলার আগুন ছাড়া খলার রাজত্বে আর কোন সভ্যতা নেই। থাকার দরকারও নেই। আগুন আছে আর তিতাসের পানি যতক্ষণ বহমান আছে ততক্ষণ এরা নিশ্চিন্ত। মইষা নানাভাবে চোঙ্গার ফু, কাঠের টুকরা ও নানা তুকতাক করে আগুনের শিখা বের করে আনল। ফট ফট শব্দ হচ্ছে চুলা থেকে। বাঁকা কাঠের গিট খােলার শব্দ। মইষা মাটির হাঁড়িতে দুধ চড়িয়ে দিল। এর মধ্যেই তার বুকের আঁচল আগুনের আঁচে শুকিয়ে গেছে। ঘামের বিন্দু দেখা দিয়েছে কপালে। মইষার গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের হলেও চেহারাটা তামাটে। এর উপর আগুনের আঁচ পড়ায় ঘামে, গন্ধে তাকে মনে হচ্ছে পােড়া ইটের মতাে। রক্তবর্ণা । এ সময় একটা ছােট মুখ বন্ধ ডিবা নিয়ে সেখানে হাজির হলাে তােরাব সর্দার। লও। এতে চায়ের গুঁড়া আছে। মইষা ডিবাটা হাতে নিল। তােরাব মুখ তুলে মইষার ঘর্মাক্ত লাল মুখের দিকে একবার দেখল। তুমি তাে খুব সুন্দর দেখতে! এ কথায় মইষা মুচকি হাসল। যাই হােক সর্দারের চোখ পড়েছে। চামারনির রূপ দেইখ্যা খুশি অইছে রাকখালের রাজা। তুমি খুব সুন্দর। অত তােয়াজ করতে অইব না। আমি তাে সব সময় উপাইস্যা মাইনষের ভুখ মিটাইবার জন্য বইয়াই থাকি। বলে খিলখিল করে হেসে উঠল মইষা । হাসতে হাসতে কাত হয়ে পড়ল এক দিকে। হাত বাড়িয়ে তােরাব মইষার একটি নগ্ন বাহু ধরে ফেলল। আমার সাথে বিয়া বইবা? ও মা কয় কী? আমি তাে চামারনি ঋষি, ছােড জাত। তুই আগুনের মতাে সুন্দর আর পানির মতাে ঠান্ডা । আমি তরে লইয়া খলা ছাইড়া পলামু ।
রাকবালি ছাইড়া মাঝি অইয়া বাঁচুম। আমার এক মুই আছে গােকনঘাটে। তার জামাই কলের নৌকা চালায়। তরে লইয়া হিয়ানে যামুগ। আমিও চামার, চামারের অধম, তুই রাজি অইয়া যা। মইষা আস্তে বলল, আমার হাতটা ছাড় সর্দার। তােমার আঙুল তাে লােয়ার মতাে শক্ত। একটু ছাড়। তােরাব হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলল, আমারে পছন্দ অয় না তর? এইখানে পছন্দ অপছন্দের কথা নাই সর্দার। আমি বহু মাইনষের ঘাঁটা ময়লা, কাদা, আগুন না যেমন তুমি দেখতাছ। আমার মতাে মাগিরে কেউ বিশ্বাস করে না। তুমিও করবা না! শখ মিট্যা গেলে আবার গতর থিক্যা পচা মাটির গন্ধ বাইরব। খাবলাইন্যা মাটির গন্ধ। কুলটা চামারনি কোনদিন বউ অয় না। নেও দুধের উপর বগলাইয়া সর উঠতাছে। হাতা দিয়ে তুইল্যা দেই ধাও। আমারেও খাও। বউ বানাইবার কথা কইয় না। আমি বউ অইবার খােয়াব দেখি না। বুঝলাম এইখান থিক্যা আমার ভাত উঠছে। আজ আমারে খাও। কাইল বিয়ানে আমি চইলা যামু। মইষার কথায়, প্রত্যাখ্যানে তােরাবের মনে হলাে তার বিশাল ছাতির উপর একটা মায়া মানুষ যেন জোরে লাথি মারছে। সে স্তম্ভিত ও দিশাহারা হয়ে মইষার মাটির হাতায় সর নিংড়ানাের কৌশলটা দেখতে লাগল। ধোঁয়াউড়া সরের হাতাটা মইষা এগিয়ে দিল তােরাবের দিকে। নেও সর্দার। ফু দাও, ঠান্ডা অইয়া যাইব। চামড়ার মতাে অইয়া যাইব। খাও আর আমারে দেখ । আমি চিৎ অইবার লাইগ্যা বইয়া থাকলাম। আবার খিলখিল হাসির শব্দ। গরম সরের ওপর ফু দিতে দিতে তােরাব সর্দার মন্ত্র উচ্চারণ করার মতাে কইল, তরে লইয়া ঘর বান্দুম, পলামু। এই খলা, এই ঘাসের চর, গরু বাছুর সব ফালাইয়া যামুগা। তুই রাজি অইয়া যা। মইষা বিবি, আমি তরে ভালােবাসি। মনে অয় তুমি আমারে রাইত পর্যন্ত থাকবার দিবা না। হুন সর্দার, আমি ছােড জাতের মায়া। চামার মেথরের সুন্দরী বুউঝিরে কেউ কয় না ভালােবাসি। খালি চিৎ কইরা ফালাইয়া রস ঝরাইয়া পলাইয়া যায়। এই আমি জীবনের পরথম হুনলাম কেউ আমারে বউ বানাইতে চায়। বলতে বলতে প্রথমে হাসি ও পরে হু হু করে কেঁদে মইষা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। হাতাটা আবার দুধের পাতিলে ঘুরিয়ে ডুবিয়ে দিল তােরাব সর্দার। তারপর মইষাকে মাটি থেকে বুকের ওপর তুলে নিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করতে লাগল। বিশ্বাস কর, তর থেইক্যা ভালা মায়া, খুবসুরত আওরত আমি আর দেখি নাই ।
এই কথায় মইষা দারুণ ফুপানি তুলে সর্দারের বুকের ওপর মাটির ঢেলার মতাে মিশে যেতে যেতে হাঁপাতে লাগল। আমারে ছাইড়া দেও সর্দার। আমি আর হাইনজা বেলার লাইগ্যা বইয়া থাকুম না। আমি চইলা যামু। আইজ পর্যন্ত আমারে কেউ কয় নাই কোন ভালবাসার কথা। এই কথাটাকু লইয়া যাইতে পারলে বুঝুম আমার ইষ্ট দেবতা রাধা মাধবের সারাজীবন জপ করা আমার বেৰ্থা যায় নাই। আমারে ছাইড়া দেও। আঘাটায় নিয়া আমারে একটা নাওয়ে তুইল্যা দেও। আমি দত্তখােলায় পানি দেই। তুমি তাে মায়া মানুষ বহুত পাইবা। কিন্তু আমার জন্য তুমি শেষ। খদার দোহাই এইটুকু লইয়া যাইবার সুযােগ আমারে দেও। সহসা বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতাে সর্দার মইষাকে বাহুর বন্ধন থেকে আলগা করে দিল। মইষা উঠে দাঁড়িয়েই আবার মাটিতে লুটিয়ে সর্দারকে প্রণাম করে বলল, আমি তইলে যাই। বলতে বলতে কোনদিকে না তাকিয়ে মইষা ছাউনির বাইরে চলে এল। হাঁটা শুরু করল আঘাটার দিকে। অনেক দূর চলে যাওয়ার পর তােরাব সর্দারও উঠে দাঁড়াল এবং এক পা এক পা করে আঘাটার দিকে হাঁটা দিল। তার চোখ থেকে উপচে বেরিয়ে এল এক জোড়া তিতাস নদী।