দাম্পত্যের পরে – স্বাতী গুহ

›› সম্পুর্ণ গল্প  

বেশ কয়েক মাস পর সুবোধ হঠাৎ-ই ঢুকে পড়েছিল সাহানার ঘরে। ঠিক যে গতিতে ভেজানো দরজায় ঘাড়ের তেরছা চাপে পর্দার ফাঁক দিয়ে শরীরটাকে গলাবার মতো সামান্য জায়গা করে নিয়েছিল, তার দশগুণ বেশি গতিতে ছিটকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিল সে। সাহানার তীব্র চাপ তার ঠোঁটে, ঘাড়ে, পিঠে হঠাৎই এমনভাবে সেঁটে গিয়েছিল যে, সেই হতভম্ব ভাবটা কাটাতেই কেটে গিয়েছিল কয়েক সেকেন্ড। চূড়ান্ত বিরক্তির বিষ উগরে দিতে দিতে বলে ফেলেছিল— এনাফ্! ইজ এনাফ্!
ঠিক তার কয়েকশোগুণ হাই পিচে বলে উঠেছিল সাহানা- হোয়াট ইজ এনাফ্?
আধখোলা দরজাটাকে ঠেসে পুরো বন্ধ করে দিয়েছিল সুবোধ। এই ফ্লোরে তখন কিছু না হোক তিনজন কাজের লোক। ডাস্টিং-ক্লিলিং-কুকিং ইত্যাদি কাজের। সুবোধের এই ফ্লোরে সাহানার ঘরে এই সময়ে আসাটা অভ্যাসের বাইরের ব্যাপার। তাই যেন সে নিজের আক্রান্ত শরীরটাকে কিছুটা সহজ করে নিতে নিতে ওয়ারড্রোবে হেলান দিয়ে দাঁড় করায়। সাহানার দিকে সোজা তাকিয়ে বলে ফেলে— আমি অনেকবার বলেছি তোমাকে। ডোন্ট এক্সপেক্ট দিইজ ফ্রম মি এনি মোর।
যেন হাইকোর্টের এজলাসে বিচারপতি তার চূড়ান্ত রায় শোনাচ্ছেন বিবাদী পক্ষকে। তেমনই স্থিতধী আজ সুবোধের গলার স্বর। যেন এরপর এজন্মে আর কোনও দিন এই রায়ের নড়চড় হওয়ার নয়। কিন্তু সাহানা এই বন্ধ দরজার এপারে তার সমস্ত আভিজাত্যের পোশাক খুলে ফেলেছে একটানে। ইচ্ছে করলেই সে যেন খাবার দিতে আসা মানুষটির ওপর ঝাপিয়ে পড়তে পাড়ে বন্দী বাঘিনির মতো। সুবোধের সমস্ত দূরত্বকে নির্লজ্জের মতো ফর্দাফাই করে টেনে নিয়ে আসে তাকে একেবারে বিছানায়, আধখানা এলিয়ে পড়া তার শরীরের ওপর। সুবোধের দুই অনিচ্ছুক হাতকে প্রাণপণ চেপে ধরে সে তার শক্ত হয়ে ওঠা লালচে-বাদামি স্তনবৃন্দের ওপর। দেয়ালের গায়ে স্নান সেরে ঘরে ফেরা রমনীর বিরাট ফ্রেসকো। রবি বর্মার বিশেষ ঠমক। প্রতিটি স্ট্রোকে স্পষ্ট হয়ে ওঠা শরীরী খাঁজ। এখনও সুবোধের চোখ সেখানেই আটকে থাকে। নিজেকে সাহানার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে খেলনা পুতুলের মতো মনে হয় তার। কিন্তু কী করবে সে? কী করে বোঝাবে সে এই প্রকৃত মহিলাটিকে-
আই কান্ট ডু দ্যাট।
হোয়াই?- সাহানার চিৎকার তাদের জানালা দরজা ভেদ করে ততক্ষণে রাস্তা পার হয়ে ওপারের পার্ক লাফিয়ে পেরিয়ে সমুদ্রের নোনা জলে গিয়ে মিশেছে নিশ্চিত। আরও অনেক নুন খসে পড়ে তাই সাহানার আধশোয়া অর্ধনগ্ন শরীরের ভাঁজ-খাঁজ থেকে। কিন্তু সুবোধ যেন সিমলাই-এর ব্রহ্মচর্যে আছে। তেমনই শীতল, উদাসীন আর দূরত্ব তার চোখে। কিন্তু ভয়ঙ্কর এক অস্বীকার পেয়ে বসে সাহানাকে। গম্ভীর আর কাটা কাটা শব্দে সেও যেন আজ বলে ফেলে অনেকদিনের জমিয়ে রাখা কথাগুলো-
আমি তোমার স্ত্রী। আমার সঙ্গে শোয়াটাও তোমার কাজ। তোমার শরীরের ওপর আমার অধিকার আছে। সেটা তুমি অস্বীকার করতে পারোও না। ইউ মাস্ট স্যাটিসফাই মাই নিডস্। অ্যান্ড ইটস্ অ্যা লেজিটিমেট ডিমাণ্ড ।
সাহানার সঙ্গে আজ যে বেশ কয়েক দান পাশা খেলতে হবে এই সকাল সকাল, তা ভেবেই এই একুশ ডিগ্রি টেম্পারেচারের ঘরেও কপালে দানা দানা ঘামের বিন্দুর টের পায় সুবোধ। কিন্তু নিজেকে আরও একটু গুছিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে সে নতুন করে। কিউরেটর সুবোধের মনের স্ট্যাগে কত যে স্মৃতিকথা! এক একটা ছোটও জিনিসকে ঘিরে কত যে গল্প। মনে পড়তেই কেমন যেন নরম হয়ে ওঠে ওর চোখ। গলায় অভিভাবকের মডুলেশন এসে পড়ে সামান্য কিছুটা
সাহানা, লিসন টু মি কেয়ারফুলি! আমি সত্যিই পারি না। এটা তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে। আর যত তাড়াতাড়ি এটা মেনে নেবে তত আমাদের দুজনের জন্যই ভালো।
কী মেনে নেবো? ওই পুরোনো কথাই তো?
তোমার পুরনো মনে হলেও আমার কিছু করার নেই।
কিন্তু আমার কথা ভেবে দেখেছো কখনও ? হোয়ার আই ইউল গো? আই স্টিল লাভ ইউ। মোর ওভার স্টিল আই হ্যাড় হাঙ্গার ফর সেক্স!
আমি যে কিছুতেই তোমার সঙ্গে অ্যারাউজড্ হই না। আই ফিল টোটাল লস্ট। শুধু মনের ব্যাপার নয় এটা। আমার শরীরটা কোনও ভাবেই আর সাড়া দেয় না তোমার কাছে এলে!
আমি তা হলে কী করব? গেট ইট ফ্রম্ আদার ওয়াইজ?
গো, গেট ইট।
শব্দকটি সুবোধের ঠোটের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসার তোড়ে কেমন একটা ঝনঝন বেজে ওঠে। ঠাণ্ডা ঘরের সমস্ত শক্ত বিষ যেন টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যেতে থাকে এই নারী-পুরুষ দুটির শরীরের দূরত্বের মাঝখানে দিয়ে। সাহানা উঠে বসে কনুইয়ের কাছে নেমে আসা ব্রায়ের ওয়াইন কালারের স্ট্র্যাপ টেনে তুলে দেয় তার দুধে-আলতা রঙের কাঁধে। ওয়ার পাড় বেস ঠিক করে নেয় নিমেষে। বিছানার ওপর পড়ে থাকা হাউসকোটের মধ্যে সেঁধিয়ে যেতে যেতে সুবোধের দিকে ঘৃণা আর প্রতিবাদের একটা ঝাপটা যেন দিয়ে ফেলে সে কিছু না ভেবেই।
সুবোধ ধীরে ধীরে এসে বসে ড্রেসিং টেবল-এর সামনে পেতে রাখা গদি মোড়া স্টুলে। আবার বলে ফেলা কথাগুলোই নতুন করে বলতে হবে বলেই যেন কিছুটা ক্লান্ত সে। কয়েকমাস আগে উটিতে বেড়াতে গিয়ে, তার আগে কোভালামে, তার আগে লিমায়, মাচুপিচু পাহাড়ের ট্রিপ সেরে নেমে এসে, আরও কত বার ঠিক মনে করতে পারে না এই মুহূর্তে, কতবার সে সাহানাকে বলেছে—
আমি তোমার জন্য সব করতে পারি। কিন্তু ডোন্ট আসক মি টু স্লিপ…
নিজেও ভাবতে থাকে সে। কীভাবে হল এমন। সাহানার সঙ্গে আলাপের পর থেকে বিয়ে পর্যন্ত তো কখনও এমন হয়নি তার। বরং এমবিবিএস-এর সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট সাহানার ইনটেলিজেন্স আর ইউট খুব টানত ওকে। সুবোধের ‘ডেরা’-টা তখন অনেক ছোটো ছিল। ডিসপ্লে আর অফিসের টেরিটরিকে আলাদা করত একটা রাজস্থানী মিনিয়েচার এয়ার্কের স্যাম্পল ডিভাইডার। বেসটা কাঠের ছিল। কাচের খোলা দরজা ঠেলে কাস্টমারের ভিতরে ঢোকার শব্দটা যাতে ডিভাইডারের ওপারে থেকেও পাওয়া যায়, তাই দরজার পুরোনো লিভারটাকে তেল দিয়ে স্মুদ করে রাখত কলেজ ফেরত কিংবা মাঝখানেও সাহানা ডেরা-য় চলে এলে প্রায়ই শরীর আদায় করে নিত তারা। কথা বলার জন্য তো রাস্তা-কাফে-রেস্তোরাঁ কত কী ছিল। কাস্টমার এসে পড়ায় বিপত্তিও ঘটেছে বেশ কয়েকবার। কোনও রকমে সামাল দিয়ে কাজ হাসিল করতে হয়েছে। সেই সব দিনের কথা সুবোধ অনেকবার ভেবেছে একা একা বসে। যদি ফেরা যায়। একবারও। সাহানার আউটফিট ও প্ল্যান করত ও সে সময়। কী ভয়ঙ্কর উত্তেজনা ছিল তার অন্তবাসও বাছাই করে দিত নিজে। গ্রিক ভাস্কর্যের মতো সাহানার শরীর। বেশি কম বলে কিছু নেই! এখনও তাই। যে কোনও পুরুষের বাকরোধ করে দেওয়ার ক্ষমতা আছে ওর ক্লিভেজের, নাভির কিংবা শরীরের নিচের তিনকোণা ঢলের। কিন্তু সুবোধ কিভাবে যেন হারিয়ে ফেলেছে ওর সেই পুরোনো স্বাদ। একঘেয়ে বলে? বিবাহিত পাওয়া যায় বলে? এই সব প্রশ্নগুলোকে ও বহুদিন ধরে নানাভাবে সল্ভ করতে চেয়েছে ও।
‘ডেরা’ এখন খুব বড়। পৃথিবীর প্রায় সব দেশ ঘুরে সংগ্রহ করে সুবোধ ডেরা-র ডিসপ্লে। অফিস উইথ অ্যান্টি-চেম্বার সাজানো পড়ে থাকে প্রায়ই। সাহানা হাসপাতাল ফেরত এলেও কথা হয় বাইরে বসেই। তারপর হয়ত কোথাও মিটিং, খেতে যাওয়া, শপিং, নয়ত এমনি এমনি ড্রাইভ-র যাওয়া। এ হাসপাতাল, পেশেন্ট, কলিগ, নিউজিল্যান্ডের পুরোনো সভ্যতার টুকরো-টাকরা কালেক্ট করার স্কিম— কত কী আলোচনা করে ওরা। কিন্তু বাড়ি ফিরে এলেই যেন অদ্ভুত দুটো মানুষ দুটো তলায় ভাগ হয়ে যায়। সেভেনথ ফ্লোরে সাহানার সাম্রাজ্য আর টপ মোস্ট ফ্লোরটা টেরাস সহ সুবোধের ওয়ার হাউস কাম লিভিং রুম। মাঝেমাঝে সাহানার সঙ্গে ডিনার করে সুবোধ নীচের ফ্লোরে। কখনও সাহানা উঠে আসে। ছাদের বাগান চেয়ারে বসে রাতের খাবার খায় একসঙ্গে। টুকটাকি সংসারি কথাবার্তাও সেরে নেয় দুজনে প্রয়োজন হলেই। অসুস্থ হলে অবশ্য একে অন্যের সেবাযত্ন আজও করে ওরা আন্তরিকভাবেই। গত মাসেও চার-পাঁচ দিন সাহানার ভাইরাল ফিভারের সময় সুবোধ ডেরা-তে যায়নি রোজ। বাড়ি থেকে ফোনে ইন্সট্রাকশন দিয়েছে কল্পনা আর সুজিতকে। ওরাও গত দশ বছর ধরে সুবোধের সঙ্গে থেকে ব্যবসার ঘাত-ঘোঁতগুলো বুঝে ফেলেছে সব। মালিকের ভালবাসার জায়গাগুলোও চিনে নিয়েছে ওরা ভালোভাবেই। তাই সুবোধ এখন আর তেমন ইনসিকিওরড ফিল করে না নিজের অনুপস্থিতিতেও। ডেরা-ইজ্জ নাও আ বিগ নেইম। তা । তা বম্বে শহরে শুধু নয়, দেশে, দেশের বহিরেও অনেকের জানা। ন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল সব প্রাইম ম্যাগেই ডেরা-র অ্যাড কিংবা নিউজ থাকে নিয়মিত। কিন্তু সাহানার কাছে এসে পড়লেই কেমন যেন অন্য খুব । অন্য একটা [ মানুষ হয়ে ওঠে সে। এমনকি সাহানার কপালেও একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করে না ওর আজকাল। জন্মদিন, ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি- এই সবদিনগুলোর থেকে পালাতে চায় ও। আর সাহানা যেন অপেক্ষা করে থাকে- এইদিনগুলোর জন্যই। যদি কোনওভাবে কাছে পেয়ে যাওয়া যায় ওকে। দেখো, তোমাকে শেটল ডাউন করার জন্য অনেক সময় দিয়েছি। আমি রক্ত মাংসে । রক্ত মাংসের একটা মানুষ। ভাল খাওয়া, ভাল জামাকাপড় পড়া, বেড়াতে যাওয়া, গিফট পাওয়া, গিফ্‌ট দেওয়া আর প্রপার্টির মালিক হওয়া—এসব হলেই আমার চলে, এমন যদি তুমি ভেবে থাকো, তবে খুব বড় একটা মিস-আন্ডারস্ট্যান্ডিং হচ্ছে আমাদের মধ্যে। সাহানার গলা থেকে সেই মরিয়া ভাবটা কখন যেন ঝরে গেছে। কাউন্সেলরের রাক্তিত্ব যেন অ্যাড হয়েছে তাতে। সকাল সকাল বেডরুমের এই আলুথালু ব্যাপারগুলো যে নেহাতই ছেলেমানুষি নয়, তা যেন আজ বুঝিয়ে ছাড়বে। ছাড়বে সে সুবোধকে। আমি জানি তুমি অন্য কোনও মেয়ের সঙ্গে ইনভলভড তোমাকে আমি বাধা দিইনি। এমনকী অশান্তিও করিনি।
সুবোধ নিঃশ্বাসের ছেড়ে নেওয়া সাজিয়ে ফর্ক আর নাইফ দিয়ে আস্তে আস্তে চিরে ফেলতে থাকে। সাহানার শরীরটা আবার যেন তীক্ষ্ণ হয়ে উঠতে চায়। হাউসকোটের নটাকে কোমরের কাছে বাঁধতে বাঁধতে হঠাৎ-ই আবার এক ঝটকায় খুলে ফেলে সুবোধের সামনে দাঁড়ায় সে। বলে—
আই নো আমার থেকেও ভালো কোনও শরীর তুমি কারও কাছে পাবে না। এই ব্যাপারে আমি কনফিডেন্ট! আমারও এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই! — সুবোধ যেন একপিস হাওয়ার ওমলেট আঙুলে আঁটা ফর্ক থেকে জিভের ডগায় পুশ করে দিতে দিতে বলে ফেলে আজ।
তা হলে তুমি আমায় টার্ন ডাউন করো কেন? হোয়াই? —সাহানার অধৈর্য শব্দরা সাপের মতো বিষ ঢেলে দিতে থাকে ওর মাথার কোষে কোষে। পেডিকিওর করা ফুল ওয়াক্সড্ ওর পা দুটো সামান্য কেঁপে ওঠে বোধ হয় একবার। সুবোধ তাকিয়ে থাকে সোজা ওর বিকিনি লাইনে। তবু একবারও ইচ্ছে করে না উঠে গিয়ে হাত রাখে ডিজাইনার প্যান্টির লেসের ওপর কিংবা তারও ভেতরে। কিন্তু একটা সময় তো ছিল, সুবোধ অস্থির হয়ে যেত সাহানাকে শুধু ছুঁয়ে দেখার জন্যই। ডানহাতের আঙুলে রিং পড়া ছেড়ে দিয়েছিল সে সাহানার ব্যথা লেগে যেত বলে! আর আজ, এখন কিছুই ইচ্ছে করে না তার। টেরাসের কাঠগোলাপ গাছের নীচে দাঁড় করিয়ে রাখা মেয়েটির মার্বেল মূর্তি সংগ্রহ করেছিল সে রত্নাগিরির রাজবাড়ি থেকে। কিছুটা ড্যামেজডও মূর্তিটা। কিন্তু এখনও ফুলমুন রাতে যখন তেরছা আলো এসে পড়ে ওই পাথরের নারীর শরীরে, তখন সুবোধ আশ্চর্য প্যাশনেট একটা টান টের পায়। সামান্য ভেঙে যাওয়া সেই মূর্তির স্তনের ওপর হাত রাখে ও সিগারেট ঠোঁটে চেপে। বিছানায় সে রাতে ফান্টাসাইজ করে ওই পাথরপ্রতিমাকেই। প্রথম প্রথম নিজের এই অস্বস্তিটার সঙ্গে তার নিজের বোঝাপড়া হচ্ছিল না কিছুতেই। তাই সাহানার পরামর্শে কতরকম ডাক্তারের কাছেও ঘুরে এসেছে সে। স্ত্রীর পরিচিত ডাক্তারদের কাছে শুরুতে নিজের কথা বলতে ভাল লাগেনি তার। কিন্তু পরে ধীরে ধীরে সে বলতে পেরেছে তার এই অনুভূতির কথা। কিছুতেই সে আর সাহানার শরীরের কোনও আগ্রহ বোধ করে না আর। ইরেকশন তো দূরের কথা, চুমু খাওয়ার মতো সাধারণ ব্যাপারও টানে না ওকে। সাহানা জেদ করে দেখেছে, কান্নাকাটি করে দেখা। করে দেখেছে, রাগ-ঝগড়াঝাটি সব পর্ব শেষ। তবু মাঝে মাঝে সাহানার অটুট শরীর গ্রীষ্মের ফুটিফাটা মাঠের মতো দজ্জাল হয়ে ওঠে। সমস্ত শক্তি দিয়ে সুবোধকে ভরে ফেলতে চায় সে তার গভীর খাদে। যোনি পার হয়ে অর্ন্তযোনি, যোনিমূল…. আরও আরও গভীরে। [ কোথাও ৷ যে ভয়ঙ্কর আগুনে খিদে তার, তাতে যেন পিষে ফেলতে চায় সে সুবোধের সমস্ত অনীহাকে কিন্তু শিথিল সুবোধ আরও তীব্র প্রত্যাখানে ফেলে চলে যায় তাকে। যেন ‘আমি পারছি না’— বলে সুবোধ যদি দোষ স্বীকার করে নিত তার, তবে যেন কিছুটা শান্ত হতে পারত সে। কিন্তু সুবোধ অত্যন্ত ব্যক্তিত্বের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় যেতে চায়। যেন এমনটা হতেই পারে। মানুষের এমন ঘটেই থাকে। দার্শনিকের মতো মানুষের নিজস্ব প্যারামিটারে জীবনকে দেখার স্বাভাবিকতাটুকু আদায় করে নিতে চায় সুবোধ। আর এটাই সবচেয়ে বেশি হার্ট করে সাহানাকে। নিজেকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতেও কসুর করেনি সে। লম্বা চুল, মাঝারি চুল, ছোট চুল, স্ট্রেটনিং পার্মিং, কালার স্কিম চেঞ্জ, স্পেশাল আউটফিট ডিজাইনিং, ফ্রেঞ্চ ম্যানিকিওর, পেডিকিওর, স্পা ভিজিট কিছুই ছাড়েনি সে। হাসপাতালের ডিউটির বাকি সময়টা নিজেকে গ্রুমড রাখতেই ব্যস্ত থাকে সে। পলিটিক্স, কালচারের ঘাতঘোঁত সবই তার বিচরণের ক্ষেত্র। রান্না-খাওয়া আর ইন্টেরিয়রকে নিয়ে মাথা ঘামাতেও তার আপত্তি নেই। হসপিট্যালিটি- বিমুখ সে। তবে কেন কিউরেটর সুবোধ তার জীবনের সবচেয়ে মোক্ষম সংগ্রহটিকে এমন আলগোছে ফেলে রাখে ? কিছুতেই এ প্রশ্নের উত্তর সে খুঁজে পায় না। কোনও ডাক্তার বা কাউন্সেলরও তাকে তেমন আস্থা জোগাতে পারিনি আজও। স্বামী শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে গেলে যেন তবু স্ত্রী হিসেবে মাফ করে দিতে পারত সে সুবোধকে। কিন্তু শুধু তার কাছে এলে ফ্রিজিডিটি— একথা মেনে নিতে পারে না সাহানা— কোনও ও যুক্তিতেই। সুবোধও যেন নিজেকে বোঝে না কোন ঝোঁকেও আজকাল ইনা ভাবের কাছে উপস্থিত হয় ঘুরে ফিরে। ইনার সঙ্গে আলাপ তাও বেশ কয়েক বছর হল। জে জে-র এই কড়া স্বভাব আর চড়া মেজাজের মেয়েটিকে সে প্রথম দেখেছিল কালাঘোড়া ফেস্টিভ্যালে। শিল্পীদের সঙ্গে, , আর্টিজানদের সঙ্গে রাত জাগত সে সেই টিন এজ । ই টিন এজ থেকেই। নিজে কোনও দিনও একটাও ছবি আঁকেনি সুবোধ। কিন্তু ফাইন আর্টস ব্যাপারটা বুঝেছিল দাদা সুধাকরের কাছে। রং, স্ট্রোক, লাইন, স্কেচ – এই সব সুধাকর নিজে শিখতে শিখতে ছোট ভাইটিকে শেখাতে শুরু করেছিল সুবোধ স্কুলে থাকতেই। শিল্পীদের নানারকম হ্যাজার্ডস্ আর ভেকগুলোকেও চিনতে শিখেছিল সে সময়ই। ইনাকে দো দেখে প্রথমেই বুঝতে পেরেছিল ওর পেইন্টিং কিছুটা হাটকে তাই পাশে বসে সিগারেটের মোড়কে চরসে দু’একটা টান দিয়েই নিজের কার্ড দিয়েছিল সে ইনাকে। ইলা সিগারেটের আগুনে ফুঁকে ফুঁকে একটা ডিজাইন তৈরি করেছিল সেদিন। কিন্তু, ধ ততদিনে শিখে। শিখে ফেলেছে কোন দেবতাকে কী দিয়ে সন্তুষ্ট করলে ‘ডেরা’-র লাভ। ঘাঘড়ার ওপর লং টপ আর ক্যাজুয়াল অ্যাকসেসারি আর মাথার অ্যাকসেসারি আর মাথার রঙিন ফেট্টিতে একেবারে আলাদা লুকের ইনার কাঁধ থেকে কোমরে আড়াআড়ি করে রাখা রাজস্থানী পাউচে আর একটা কার্ড লগিয়ে দিয়েছিল সে কথার ফাঁকেই। তারপর ছ’মাস। নিজে ইনার একটা খোঁজাও নেয়নি। ইচ্ছে করলে নেওয়াই যেত। কিন্তু একদিন দুপুরে ইনা নিজের ডেরা-য় এসে দিয়ে গিয়েছিল তার চারটে পেইন্টিং। সেদিন ওর পোশাকের রং আর গন্ধ থেকে সুবোধ বুঝতে পেরেছিল এখুনি কিছু টাকার দরকার বলেই ইনা ডেরায় এসেছে ছবি নিয়ে। সুবোধ ফিফটি পার্সেন্ট অ্যাডভান্স দিয়ে ওর ঠিকানা চেয়েছিল বাকিটা পৌঁছে দেবে বলে। একটা ফোন নম্বর শুধু এলোমেলো কাঁপা হাতে ডায়েরিতে লিখে রেখে টাকাগুলোকে পাউচে ভরতে ভরতে বেরিয়ে গিয়েছিল ইনা সেদিন। বহুবার সেই ফোন নম্বরে ট্রাই করে কারও সঙ্গেই কথা বলে উঠতে পারেনি সুবোধ। অথচ থেকে ঠিকানা জোগাড় করে যেখানে এসে পৌঁছেছিল বেশ বড় একটা অ্যামাউন্ট ইনার পাওনা হয়েছে। জে. জে. সেখানে যে কোলিরা ছাড়া ইনার মতো সুন্দরী আর্টিস্ট থাকতে পারে তা ভাবাই যায় না। কিন্তু দরজায় বাইরেই ইনার কাজ চোখে পড়ে, ভুল হওয়ার উপায় নেই। একটা মাঝারি পিতলের ঘণ্টা রঙিন সুতোর বিনুনিতে বেঁধে ঝোলানো। ঘণ্টাটি নেড়ে পাক্কা তিন মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর ন-ওয়াড়ি শাড়ি পড়া এক মহিলা দরজাটা সামান্য ফাঁক করে জিজ্ঞাসা করেছিল— তুঝা নাও কায় ?
সুবোধ— বলে ফেলার পর এক সেকেন্ডের মধ্যে ডাক এসেছিল ভিতর থেকে প্লিজ কাম ইন্‌!
এক মনে একটি বাচ্চা মেয়ের পোর্ট্রেট করে চলেছিল ইনা। তার দিকে একবারও ঘুরে তাকায়ওনি। শর্টস আর ফতুয়ার অজস্র রঙ সেঁটেছিল এমন ভাবে যে ইনাকেই যেন একটা সাবজেক্ট মনে হয়েছিল সুবোধের। যেন ইজেল আর ক্যানভাস পেলে সেই এঁকে ফেলতে পারত ওই পেইন্টারের ক্যানডিড ছবি। কাজ শেষ করে বাচ্চা মেয়েটিকে যত্ন করে খাইয়েছিল ভাত, উসল আর বাদামের চাটনি। আই—মানে ল্যান্ডলেডি আর বাচ্চাটাকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে সোজা এসে সুবোধের চোখে চোখ রেখে বলেছিল-ঢাকা দিতে? হ্যাঁ। আপনাকে ফোনে কিছুতেই না পেয়ে আসতেই হল। আমি শিওর ছিলাম।
কী ব্যাপারে?
যে তুমি আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে। লেটস্ সেলিব্রেট।
কম দামি মদের ঝাঁঝাল গন্ধে ভরে গিয়েছিল সেই ছোট্ট ঘরটা দশ মিনিটেই। কিন্তু সুবোধ কিছুতেই এড়াতে পারছিল না ইনার চোখের গভীর ইশারাকে। কয়েকদিনের মেয়ে মানুষের গায়ের গন্ধ যে সে সহ্য করতে পারে তা জানতই না সে সেই দুপুরটার আগে। কোলিওয়ারার শুকনো মাছের গন্ধ, বাদামের চাটনির ঝাঁক, সিগারেটের পাফ আর রঙের কাঁচা গন্ধ মিলেমিশে যেন একটা বুনো পরিবেশ তৈরি করেছিল ওই হলুদ টিমটিমে আলোর খোলিতে— এসবই কি যৌন জীবনকে ডিক্লাসড্ করে ফেলেছিল একেবারে? সাহানার সৌন্দর্যের পরিমিতি, এটিকেটে রপ্ত ব্যবহারিক জীবন, সো কলড্ সেক্স ওরিয়েন্টশন সব যেন কোথাও পাত্তা পায় না এই রাস্টিক ইনার সঙ্গে। ব্রাশের স্ট্রোকের মতোই সহজ সাবলীলবাবে সাকিং-ফাকিং তবে সুবোধের জাতীয় শব্দ বাইরে বেরোয় ইনার দক্ষ ঠোঁট থেকে। সাহানার সঙ্গে যেন সে এতদিন লাভমেকিং করেছে মাত্র। কিন্তু ‘হ্যাভিং সেক্স’-এর ইন্টারপ্রিটেশনটা বোঝাই হতো না এই মেয়ের সঙ্গে দেখা না হলে। ছবি, রঙ, ব্রাশ, ক্যানভাস সব কিছুকেই ইনা অ্যানালিসিস করে তীব্র যৌন অনুষঙ্গে। ছবি এঁকে চলে দিনের পর দিন ঘরের খিল তুলে দিয়ে। আবার ঘুরে বেড়ায় রাস্তায় রাস্তায় একা একা। সুবোধের সঙ্গে কীভাবে যেন একটা বেশ কয়েকদিন বলতে পারে—
বোঝাপড়া তৈরি হয় ওর। ইচ্ছে হলে ডেকে পাঠায় ওকে। কাজ না করতে পারলে দ্বিধাহীন গলায় আই নিড় আ গুড়লে। আবার কোলি সিরিজ পুরোটাই জাহাঙ্গির আর্ট গ্যালারি থেকে কেকের মতো বিক্রি হয়ে গেলে বা অ্যাপ্রিশিয়েটেড হলেও সুবোধকে ডেরা থেকে তুলে নিয়ে যেতে যেতে বলতে পারে-
নাউ, আই ডিসার্ভ আ ট্রিমেন্ডাস লে। সুবোধ ভাবতে পারে না ঠিক কোনখান থেকে শুরু করা যাবে। ইনা চূড়ান্ত দ্রুততায় তাকে নিয়ে যেতে পারে শরীরের সমস্ত পয়েন্টগুলোতে। ঘোর লেগে যায় ওর। ঝড় থেমে গেলে আশ্চর্য এক প্রশান্তি টের পায় ওরা শরীরে। রোলা কোস্টার রাইডের থেকে নেমে আসার পর কি এমন অনুভূতি হয় শরীরের? সুবোধ জানতে চায় ইনার কাছে। ইনা ওদের ক্লাসের ফিজিওলজি স্টাডির কথা শোনায়। আরও আশ্চর্য লাগে সুবোধের। তার স্ত্রী তো ডাক্তার। মানুষের শরীরের গঠনের যাবতীয় কারুকার্য ওর তো আরও ভিতর থেকে জানা। তবে কেন এতদিন সে সুবোধকে আবিষ্কার করতে পারেনি শরীরের এমন করে! নাকি ইনা বাইরে থেকে শিখেছে কিন্তু জানার জন্য কাজে লাগিয়েছে ওর ক্রিয়েটিভ মনটাকে। তাই সাহানার তুলনায় মোটেই তেমন সুন্দরী না হয়েও শরীরের মধ্য থেকে আনন্দকে খুঁজে পেতে পারঙ্গম সে। কিন্তু সে তো মিথ্যে।
সাহানাতেই অভ্যস্ত ছিল অনেকগুলো বছর! তবে, সে সব না মিথ্যে নয়। সাহানা সত্যি। আজ এভাবে সাহানার তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকাও সত্যি। কিন্তু ওর সবকিছু এত বেশি ভালো, এমন নিখুঁত যে তাকে কেমন যেন দূরের মনে মানুষ বলে মনে হয় তার এখন।
আই নো ইউ হ্যাভ আ গুড বডি। বাট অল ইউ হ্যাভ আর হেভেনলি !
অ্যান্ড নাউ ইউ লাইক দ্য হেল !
ইচ্ছে ভেবে নাও।
আই ডোনচ ওয়াল্ট টু…
ইভন, আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু ডিসকাস… কিন্তু একটা জিনিস বলি। তুমি এতটাই ভালো যে তোমাকে আমার মানুষ বলে মনে হয় না।
তোমার কী মনে হয়? আমি দেবী, পবিত্র কিছু? হয়তো! আমার রক্তমাংসের নারী চাই। এতটা কথা বলে ফেলতে পেরে সুবোধেরও কিছুটা হালকা বলে-
লাগে যেন আজ। কপালের ঘামও শুকিয়ে এসেছে ততক্ষণে। শান্ত পরিচিত গলায় তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। লেটস্ গো আউট ফর আ ড্রাইভ। ল্যাচে হাত রেখে আরও একবার বলে নেয়- স্নান করো। আধ ঘণ্টার মধ্যে রেডি হয়ে নাও। তোমাকে
আজ দারুণ একটা জায়গায় নিয়ে যাব। এত বছর বম্বেতে থেকেও কখনও তুমি যাওনি ওখানে আমি শিওর! কোলিওয়াড়া? — দাঁতে দাঁত চেপে বলে সাহানা।
নো। ইটস্ আ সারপ্রাইজ! বলেই দরজা ঠেলে বেরিয়ে যায় সুবোধ ঘণ্টাখানেক পর দুজন যখন একসঙ্গে বাড়ি থেকে বেরোয় তখন পৃথিবীতে কারও প্রায় সাধ্যনেই যে বুঝে ফেলে এদের দুজনের সম্পর্কের সমীকরণটা কেমন! ! দামি | হোটেলে লাঞ্চ টার্ট করতে করতে সাহানার দিকে আজ সেরে গাড়ি এমনভাবে তাকায় সুবোধ, এক কোটি সম্ভাবনার কথা ভেবে থাকে সাহানা। ভয়-ভালোলাগা সব একসঙ্গে ধুকপুক রোমকূপে! কিন্তু শহর ছেড়ে বড় রাস্তা ছেড়ে করে ওঠে সাহানার ওডিকোলন স্নিগ্ধ শরীরের প্রতিটি কালন ডানা ছেড়ে গাড়ি ক্রমশ ঢুকে পড়তে থাকে বেশ সরু গলিতে। সমুদ্রের গন্ধ তীব্র হতে থাকে আরও। সাহানার মনে হয় নতুন কোনও বিচ্‌ বা দেখাবে আজ তাকে সুবোধ। হঠাৎ সাহানার চোখে পড়ে সার সার কাপড় শুকোনোর বাঁশ আর দড়ির কারসাজি। সাদা, লাল, কালো, হলুদ… কত যে রঙ সেই সব মেলে দেওয়া কাপড়ের! চোখে কেমন ধাঁধাঁ লেগে যায় ওর। গাড়ি শেষ পর্যন্ত যেখানে এসে স্টার্ট বন্ধ করে সেখানে সার সার কাপড় ভেজানো আর কাঁচার চৌবাচ্চা। সুবোধ তার দিকে তাকালেই সাহানা বলে ওঠে— ধোবি ঘাট? কোনও দিনও আসিনি।
কিরণ রাও-এর ছবিতে দেখেছি।
সুবোধকে আর কোনও কথা বলতে দেয় না সাহানা। গাড়ি থেকে নেমে একা একা কিছুটা হেঁটে আসে ও। ফেরার পথে একটাও কথা হয় না আর ওদের। লিফটের থেকে সেভেনথ ফ্লোরে নেমে যাওয়ার সময় লিচের বাটনটা আঙুলে চেপে রেখে দরজাটা খুলে দেয় সাহানা। সুবোধের চোখে চোখ রেখে বলে, ‘একদিন আমিও খুঁজে পাব আমার রক্তমাংসের মানুষটাকে। বন্ধু হিসেবে তুমি আমায় পথ দেখিও।’