…..অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে অতি প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে অন্তত বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সমগ্র বাংলার সাংস্কৃতিক জগতে সবচেয়ে দৃশ্যমান, সক্রিয়, সাবলিল, শিক্ষিত, সচল এবং বিশেষত শাস্ত্রীয় সংগীতে ও নৃত্যে পটিয়সী অধিকাংশ নারীই ছিলেন বাইজি, বীরঙ্গণা অথবা মন্দিরের দেবদাসী কি সেবাদাসী। অর্থাৎ তারা অধিকাংশ-ই অন্তপুরের নারী ছিলেন না। বাগানবাড়ি, পতিতালয়, বাইজিবাড়ি, মন্দির কিংবা বাজারে কি বন্দরে তাঁদের কর্মতৎপরতা। বঙ্গ সংস্কৃতির কোনো কোনো ক্ষেত্রে (শাস্ত্রীয় সংগীত ও নৃত্য এবং অভিনয়ে) এই বাইজি-স্বৈরিণীরা বঙ্গে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন।…..
…..রাষ্ট্রের বাইজি-
বারবনিতারা তাঁদের পেশাটিকে একটি শিল্পে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এইসব গুনাবলী এবং শিল্পকলার সাথে এই আবার ব্যবসা ধরে রাখার স্বার্থে কিছু বিশেষ পদ্ধতি রপ্ত করতে হতো। যেমন, দাঁড়াবার বিশেষ মোহন ভংগী, আয়ত্বে আনা, কথার আবেশে বশ করার কামকলাপারদর্শী হয়ে ওঠা ইত্যাদি। আসলে সাথে সাথে কামের ষোলো আচারও কটাক্ষ শিল্পচর্চার দক্ষতা অর্জন, হতো। অর্থাৎ কোনো নারী যখন অনন্য বা অসাধারণ কোনো গুণে ভাস্মর হয়ে উঠতেন, পিতামাতা থেকে সমাজপতিরা মনে করতেন সাধারণ ঘরসংসার করা বা একজনের মনোরঞ্জনে জীবন কাটানো সেই নারীর জন্যে চূড়ান্ত এক অপচয়। তার বিশেষ গুণাবলি আরো অনেকের মধ্যে সমাদৃত হবে, সমাজে অনেক বেশি মানুষের মনোরঞ্জন করতে তারা সক্ষম হবে, তাদের খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে, সেই সঙ্গে হবে অর্থের সমাগম, প্রত্যাশা এটাই । অথবা কোনো এক দেবতা ও তার পূজারীর কাছে সমর্পিত হবার ভাগ্য নিয়েই এই বিশেষ কলায় পারদর্শী হয়ে উঠেছেন বলে সেইসব নারীদের পিতামাতা নিজেরা সঙ্গে করে কন্যাকে নিয়ে এসে দেবালয়ে এনে রেখে যেতেন, যেখানে নেচে, গেয়ে এবং অতিথিদের সেবা আর আপ্যায়ন করেই জীবন কাটতো তাদের।
প্রাচীন ভারতের গণিকারা পরিচিত হতেন বিভিন্ন নামে এবং তাঁদের মধ্যে শ্রেণিভাগ ছিল। সাধারণত ৬ ভাগে বিভক্ত ছিলেন তাঁরা-
১. রাজবেশ্যা (রাজার অনুগৃহিতা গণিকারা)
২. নাগরীবেশ্যা (নগরবাসিনী গণিকা)
৩. গুপ্তবেশ্যা (সদ্বংশীয় নারী যে গোপনে অভিসার করে)
৪) দেববেশ্যা (মন্দিরের দেবদাসী)
৫. ব্রহ্ম বেশ্যা বা তীর্থতা (যারা তীর্থস্থানে থাকেন)
৬. সাধারণ গণিকা ।
তখনকার দিনেও, আজকের মতো-ই, পতিতাবৃত্তির প্রধান ও মৌলিক কারণ ছিল অর্থনৈতিক । এটি নারীর জীবিকানির্বাহের একটি উপায় বলে সমাজ মেনে নিতো। ফলে পতিতা বৃত্তি নিন্দনীয় বা ঘৃন্য কোনো পেশা বলে বিবেচিত হতো না তখন।…..
…..গণিকা ও দাসী যখন ভোগের অযোগ্য হবে তখন তারা কাজ করবে রান্নাঘরে। ‘তার মানে কৌটিল্য গণিকাদের পেশা থেকে অবসর নেবার পরে তাঁদের পুনর্বাসনের দায়িত্বও রাষ্ট্রকেই গ্রহণ করার পরামর্শ দিয়েছেন, কেননা তখনকার দিনে রাষ্ট্র ইচ্ছে করলে নারীকে গণিকায় পরিণত করতে পারতো। আম্রপালিকে তো অপরিসীম সুন্দর হবার কারণে রাষ্ট্রীয় আদেশের বলে বারবনিতা হতে হয়েছিল। যুক্তিটা ছিল এই রকম। আম্রপালি এতো বেশি সুন্দর ও আকর্ষনীয় যে সে কেবল একজন পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হতে পারেন না- হওয়া উচিত নয়। সেটি হবে দারুণ অপচয়। শুধু তাই নয়, তাঁর মতো দেহবল্লভীর অধিকারী এক মেয়ে রাষ্ট্রের কোনো এক বিশেষ পুরুষের স্ত্রী হলে অন্য পুরুষদের মধ্যে তাঁর জন্যে রীতিমতো যুদ্ধ বেঁধে যাবে। ফলে আম্রপালিকে রাষ্ট্র নিযুক্ত করে নগরবধূ হিসেবে। এখানে আম্রপালির নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা-মতামতের কোনো মূল্য নেই। রাষ্ট্রের আদেশে বারবনিতা হয়ে আম্রপালি বহু ক্ষমতাধর পুরুষের সঙ্গে দৈহিক মিলনে মিলিত হয়েছেন— এমন কি দেশের শত্রু ভীনদেশের রাজাও আম্রপালির প্রেমে উন্মত্ত হয়ে তাঁর ঘরে আসতে ও থাকতে শুরু করেন।…..
…..ঢেমনি
ঢেমনি হচ্ছে উপপত্নী বা রক্ষিতা স্ত্রী। ঢাকায় এবং বিশেষত কলকাতার বাবু কলোচারে সৌখিন ঋণী এবং বিলাসী পুরুষদের মধ্যে এই রকমের ঢেমনি বা উপপত্নী রাখার চল ছিল। কেউ কেউ বিষয়টিকে এক ধরনের আভিজাত্যের প্রতীক বলে বিবেচনা করতেও কুণ্ঠাবোধ করতেন না। উপপত্নী আর রক্ষিতা কথা দুটোর মধ্যেই গভীর সমাজচিত্র রয়েছে। ‘উপ’ মানেই মূলের অসমকক্ষ। অর্থাৎ তিনি স্ত্রীর মতো তাকে মর্যাদা ও অন্যান্যসবের সমান উত্তরাধিকারী নন । তাকে সাধারণ ভাড়াবাড়িতে বা স্বামী প্রবরের অন্যবাড়িতে মূল স্ত্রী হতে দূরে রাখা হতো ।
মূলত তার সাথে স্বামীর দৈহিক সম্ভোগেরই সম্পর্ক। বারবনিতার মতো তার ভরণপোষণ ইত্যাদির জন্য অন্য মুখাপেক্ষি হওয়া লাগতো না। উপপত্নী হিসাবে এইসবের সরবরাহ পেতেন। রক্ষিতা হওয়ার মধ্যে স্বামীর সদয় প্রযত্ন পাবার বিষয়টি স্পষ্ট। মানে তার নির্ভরতার নির্ভয়তা থাকতো । এই স্বামীর ওর সে আমলে একাধিক রক্ষিতা রাখারও চল ছিল। তো এই ঢেমনি কথাটি বাইজি আলোচনায় এইজন্য প্রাসঙ্গিক যে, কোনো কোনো বাইজি তাদের গ্রাহকদের সাথে প্রণয় সম্পর্কে অভিসারিকা হয়ে উঠতেন পরিণতিতে তারা বাইজি পেশা ছেড়ে তার উপপত্নী বা রক্ষিতার জীবন বেঁচে নিতেন। আর এমনও হতে ঐ বাইজি এককভাবে কেবল তার রক্ষকপতির মনরঞ্জনার্থে প্রয়োজন মতো নাচ-গান করতেন। আবার এর অন্যথাও হতো। অর্থাৎ উপপত্নী রক্ষিতা এবং বাইজি।
বডিস
বডিস হচ্ছে কাঁচুলি বা ব্রেসিয়ার । নারীর বক্ষবন্ধনী হিসাবে ব্যবহার করা হয়। তাদের উর্ধ্বাঙ্গের অন্তর্বাস। বডিস ইংরেজ শব্দ । ব্রিটিশ ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন আমলে প্রচুর ইংরেজি শব্দের প্রচল ঘটে ভারত উপমহাদেশে। সে আমলে এই শব্দটি প্রয়োগ ছিল। এখন তার স্থানটি দখল করে আছে ব্রেসিয়ার’। বাইজিদের বডিস ব্যবহার ছিল নানা কারণে অন্য রকম নাচের সুবিধার্থে তাদের শরীরকে আটোসাঁটো রাখা দরকার ছিল। নিজেকে আকর্ষণীয় এবং নৃত্যের লাস্যকে দৃষ্টিগোচর করতে তারা এক ধরনের ব্রেসিয়ার ব্যবহার করতেন যা অনেকটা খুব খাটো ব্লাউজের মতো। তাতে পয়োঃধর দুটিকে দেখানো এবং ওপরের দিকে ভরাট স্তনের ব্যথা স্পষ্ট। যাকে অনেকটা সেভ অ্যাপেইলিং বলা যেতে পারে। নাচে তাদের ঝাকানাক ধরনের বুকের কাজও দেখাতে হতো। ফলে তাদেরকে মোটা বড় বক্ষবন্ধনী পরিধান করতে হতো, যাকে বড় ব্লাউজের মতো লাগতো। ঐ ধরনের কিছুটা ব্রীড়াহীন ব্রেসিয়ার সমাজের সাধারণ নারীরা পরতেন না।
লাস্যময়ী
খুবসুন্দরী, কামোদ্দীপক, পূর্ণযৌবনা বিস্তৃত নিতম্বীনি, ভরাটবক্ষা, আকর্ষণীয় দেহী নারীকে সাধারণত ‘লাস্যময়ী বলা হয় । সে আমলে বাইজিদেরকেও এই অবিধায় বিশেষায়িত করা হতো। কিন্তু ‘লাস্য’ বিষয়টি দেহসংশ্লিষ্ট নারীর শরীরনির্ভর হলেও তা ঠিক নারীরদেহই নয়। বরং লাস্য হলো এক প্রকারের নাচভঙ্গি এবং লালাসমৃদ্ধ দেহভঙ্গি যা অবশ্যই নারীর জন্য প্রযোজ্য। যা বিশেষ করে পুরুষদের মনোহরী। এককথায় ভরাযৌবন নারীর উত্তেজক নৃত্যভঙ্গিই হচ্ছে লাস্য। দেহ নয় বরং দেহভঙ্গি।….
…..শিল্পী পরিতোষ সেন ও কিন্তু ভূলে যাননি সিক্ত বসনে বাইজিদের ঘরে ফেরার দৃশ্যর বর্ণনা দিতে:
‘আমাদের পাড়ায় বারবনিতারা প্রতিদিন সকালে স্নান করতে বুড়িগঙ্গা যায়। তাদের স্নানে যাবার পথটি আমাদের বাসার সামনে দিয়ে। ফেরার পথে ভেজা কাপড়ে কালী মন্দিরে প্রণাম করে আমাদের গলির মুখে আবার দেখা হয় । সকাল বেলার এই মনোরম দৃশ্যটি আমাদের পাড়ার পুরুষদের চোখকে বেশ তৃপ্তি দিত। তাদের মন মেঝাজ খোশ রাখে। দিনটি ভালো কাটে ।
সদ্য স্নাত তরুণীদের প্রথম সারির মাঝখানে ১৬-১৭ বছরের একটি মেয়ের আকর্ষণীয় বর্ণনা দিয়েছিলেন পরিতোষ সেন। অবিকল লিচুর মত গোল। থুতুনিটি ঈষৎ তীক্ষ্ণ, ঠোঁট দুটি যেন প্রতিটি রসালো দুটি কমলার কোয়া। তার নাকের ছোট্ট নিঃশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে ফুলে ফুলে উঠছিল। গোটা যেন মুর্শিদাবাদী রেশম দিয়ে মোড়ান। এমনই মসৃন আর চকচকে তার পোচে যে রঙের ত্বক। পাকা পাতিলেবুর গায়ে হাল্কা মিশ্রন হয় ঠিক তেমনই তার গায়ের ” তার নীল কালো চোখ দুটি যেন স্তম্ভিত মেঘ মুখের অর্ধেকটাই জুড়ে আছে।
শাস্ত্রে বলা আছে বিহঙ্গের সৌন্দর্য্যের প্রতি আনুরাগ আছে বলিয়াই তো বিহঙ্গটি সুন্দর হয়েছে। ময়ুর ও সেই সৌন্দর্য্যের প্রতি অনুরাগী বলিয়াই তো ময়ুর সুন্দর হয়েছে। চম্পক আঙ্গুলী ও খঞ্জন নয়নের প্রতি পুরুষের আকর্ষন আছে বলিয়াই তো নারী জাতি চম্পক আঙ্গুলী ও খঞ্জন নয়নের অধিকারিনী হয়েছে’ । পরিতোষ সেন আরো বর্ণনা দিয়েছেন—
‘ভেজা কাপড়টি মেয়েটির গায়ে লেপ্টে থাকার কারণে তার শরীরের প্রতিটি অঙ্গ যেন একটি ফুলের বিভিন্ন পাপড়ির মতো আলাদা সত্ত্বা নিয়ে সরল বৃত্তটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এক একটি পাপড়ি যেন একেকটি ফুল। বাকী মেয়েকটির মতো তার কাঁধেও পেতলের কলসি ভরা বুড়িগঙ্গার জল । এই কলসি আর নিতম্ব দুইই মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। দুইই টলোমলো। এমনই সুন্দর সাবলীল আর বেপরোয়া ।…..
…..এ সময় প্রকৃত বাইজির অবর্তমানে এক শ্রেণীর নকল বাইজির উদ্ভব ঘটে। নৃত্যগীত নয়, রূপ যৌবনই ছিল তাদের মূল সম্পদ। পোশাকে-আশাকে ছিল আটসাট, শরীরের উপরের অংশ ছিল স্পষ্ট। নাচগানের মধ্যেই খরিদ্দাররা তাদের শরীর স্পর্শ করতে পারত ।
এরা অনেক খদ্দেরকে একান্তে সঙ্গও দিত। সাধারণ মানুষের কাছে এদের চাহিদা বেড়ে যায় এবং প্রকৃত বাইজিদের নৃত্যগীতভিত্তিক পরিচ্ছন্ন জীবন চাপা পড়ে যায়। শতকের গোড়ার দিকে জিন্দাবাহারের বাইজিপাড়াটি উঠে যায়। ওই শতকের চল্লিশ দশকে পাটুয়াটুলীর বাইজিপাড়াটি এক ”পতিতাপল্লীতে পরিণত হয়। …..
…..বাইজীদের উদ্ভব যেভাবেই হোক রাজবাদশাদের মনোরঞ্জনের জন্য বাইজিদের বিশেষ ভূমিকা আছে। বিলাসব্যসনে মত্ত থাকা রাজা বাদশারা এইসব পটু বাইজিদের নিয়ে রাজমহলে অধিক সম্মানীয় দিযে রাখতো। শুধুমাত্র নৃত্যগীতিতে মধুরঝঙ্কারে তুষ্ট হত না তারা। শারীরিক কামনাবাসনা ও দেহ সম্ভোগের বিষয়টিও অগ্রগণ্য ভূমিকা পেত। ফলে মধ্যযুগে রাজাবাদশার অন্তপুরে বাইজিদের দাপট ও প্রভাব ছিল উল্লেখ করার মতো । রাজার হিসেবে আমরা যাদের উল্লেখ পাই – বাইজিদের মধ্যে নেকেই এই রক্ষিতা হিসেবে থাকতো। আবার অনেকে কামনার বিষয়টি এড়িয়ে যেতো।…..
…..গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে আরও দেখা যাবে দেহপসারিণীর সঙ্গেও বাইজিদের যোগ আছে। কারণ যেহেতু রাজা বাদশার মনোরঞ্জনের জন্য বাইজিরা নীত হত। ফলে অনেক বাইজি রাজাদের টাকার বিনিময়ে ও কিংবা স্বর্ণালঙ্কার ও অন্য কোনো সম্মানীয়ের জন্য দেহদানের সঙ্গে কালক্রমে তারা দেহ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়তো। তবে বাইজিরা যেকারণেই রাজদরবারে নীত হোক না কেন তারা সম্মানের সাথেই রাজমহলে ঠাঁই পেত ।…..