ডেকামেরন – গিয়ােভানি বােকাসিও

›› অনুবাদ  ›› সম্পুর্ণ গল্প  ›› ১৮+  

    উৎস  : -পরকীয়া প্রেম – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়  সম্পাদিত

গিয়ােভানি বােকাসিও যদি কখনো ডেকামেরন না লিখতেন তবুও ইউরোপীয় সাহিত্যের ইতিহাসে তার স্থান সবার উপরে থাকতো, তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর এগিয়া ডি ম্যাগনো ফিয়াসেটা’ উপন্যাসে। এই উপন্যাসটি প্রথম আধুনিক মনোবিদ্যাগত উপন্যাস হিসাবে আজও চিহ্নিত হয়ে আছে। নারী পুরুষের প্রেম নিবেদনের ক্ষেত্রে মধ্যযুগীয় লেখার সঙ্গে কোনো মতেই আপােস করতে চাননি তিনি। বরং বলা যেতে পারে, অতি আধুনিকতার ছাপ তাঁর প্রেমাস্পদের কাছে সম্পূর্ণ উজাড় করে দিয়েছেন। বোকাসিওর গল্পের নায়িকারা যে রক্ত-মাংসের মানুষ। এই কথাটা মনের মধ্যে গেঁথে রেখে তিনি কথায় কথায় নায়কের শয্যাপাশ্বে তাদের শুইয়েছেন, কামনায় অধীর করে তুলেছেন, নায়ক-নায়িকার দৈহিক তৃপ্তি না মেটা পর্যন্ত বোকাসিওর কলম থামে নিএটা তার পক্ষে দুঃসাহসিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা বললে অত্যুক্তি হবে না।

দ্বিতীয় রজনীর এটি সপ্তমকাহিনী। বোকাসিওর প্রতিটি গল্পই পড়তে কিংবা শুনতে গিয়ে পাঠক-পাঠিকাদের কখনোই মনে হয়নি যে, এসব গল্প কাল্পনিক। মনে হয় এ যেন তাদেরই জীবনের সুখ-দুঃখের কাহিনী। তার গল্প শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও যেন ফুরোতে চায় না, প্রতিটি গল্পের রেশ থেকে যায় পাঠকপাঠিকাদের মনে। ডেকামেরন গল্পগুলির স্বার্থকতা এখানেই। তাঁর প্রতিটি গল্প যেন নতুন ও চিরন্তন। এই গল্পটিও তার ব্যতিক্রম নয়!

ব্যাবিলনে সালামের মেয়ের ভাগ্য বড় নিষ্ঠুর, নিমর্ম। বিয়ের জন্য চার বছরে সে বিভিন্ন দেশের ন’জন লোকের সংস্পর্শে আসে, কিন্তু তার দুর্ভাগ্য প্রতিবারেই ব্যর্থ মন নিয়ে তাকে তার বাপের বাড়িতে ফিরে যেতে হয়। তবে তার একমাত্র সান্তনা হল, এখনো সে তার সতীত্ব অক্ষুন্ন রাখতে পেরেছে, আজও সে কুমারী। এবার সালাম তাকে আলগারভের রাজার ঘরণী হওয়ার জন্য পাঠালেন।

এমিলিয়ার মুখ থেকে মাতোনা বেরিটোলার দঃখের কাহিনী শুনতে শুনতে যুবতীরা তাদের চোখের জল আর সামলাতে পারেনি। তাদের বুকটা বারবার হাহাকার করে উঠেছিল, এত দুঃখ-কষ্ট কেউ সহ্য করতে পারে? এমিলিয়া যেন দরদ দিয়ে দুঃখের কাহিনী শুনিয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত সেই ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর কাহিনী শেষ হতেই রাণীর ইচ্ছে হল এবার প্যানফিলো তার কাহিনী বলতে শুরু করুক। রাণীর কাছ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া মাত্র বাধ্য ছেলের মতন সে তখন বলতে শুরু করল।

এখানে উপস্থিত আমরা সবাই জানি, আমাদের কোল্টা ভালো, আমাদের বেঁচে থাকার স্বার্থকতা কি আমাদের প্রয়োজন, সেটা ঠিক করা সহজ ব্যাপার নয়। আমরা অনেকেই মনে করে থাকি, আমরা বড় অভাবে আছি, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদের প্রচুর অর্থ সম্পত্তি পাইয়ে দেন আর যখন ঈশ্বর আমাদের কারোর ওপর সদয় হন, তারা যখন প্রচুর অর্থের পাহাড়ের শীর্ষে উঠে যান তখন হয়ত দেখা যাবে তাদের সেই সুখ-সম্পদের সঙ্গে সঙ্গে শত্রুও তৈরি হয়ে গেছে। একদিন তারা হয়ত সুখী হয়ে যায়। তখন সেই সুখের সর্বোচ্চ শিখর থেকে চরম দুঃখের অতল গভীরে তাদের তলিয়ে যেতে হয়। ধনী হওয়ার আগে তাদের এই চরম সর্বনাশের স্বপ্নই কখনো দেখেনি তারা। কোনো রাজা যেমন অপরের রাজ্য জয় করতে গিয়ে তার কাছের এবং প্রিয়জনদের নির্বিচারে হত্যা করার সময় একবারও খেয়াল করেন না, যে রাজ্য জয়ের সুখের মােহে তিনি সেই কাজ করতে যাচ্ছেন, সেই সুখ কখনই তঁার যে হাতছাড়া হতে পারে একদিন, সেই ভয়টা যে চিরদিনই থেকে যেতে পারে তার জীবনে সেটা তিনি একবারও ভাববার প্রয়োজন মনে করেন না। আসলে তাদের বোঝার ক্ষমতা থাকে না, পাওনার অতিরিক্ত আকাঙ্খ তাদের মৃত্যু এবং চরম দুর্দশার কারণ হয়ে উঠতে পারে একদিন।

মানুষের আশা-আকাঙ্খর বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে আমি শুধু বলব পৃথিবীতে এমন কোনো মানুষ নেই যে জোর গলায় বলতে পারে, ভাগ্য বিপর্যয়ের হাত থেকে সে কখনোই রেহাই পেতে পারে। তাই বলছি, ঈশ্বরের দান হিসেবে আমরা যেটুকু পেয়েছি তাতেই যদি সন্তুষ্ট থাকতে পারি, তাহলে আমরা আমাদের ভাগ্যবিপর্যয়কে অনায়াসে এড়িয়ে যেতে পারি। তবু মানুষ তাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু চেয়ে কিংবা কামনা করে তাদের অজান্তে যে পাপ করে বসে তার ফল তাদের ভুগতে তো হবেই এই ধরে আমি উপস্থিত মহিলাদের উল্লেখ করেই বলছি তোমাদের মধ্যে হয়ত এমন কেউ আছে, যে কিনা প্রকৃতির দান হিসাবে যে রূপ সৌন্দর্য পেয়েছে তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে আরো সুন্দরী আরো রূপসী হওয়ার চেষ্টা করবে যাতে করে পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। কিন্তু কোনো জ্ঞানী-গুণী লোক একে সমর্থন করবেন না। তার কারণ তার পরিণাম ভালো হতে পারে না। এই কাহিনীতে আমি এমন একজন পরমাসুন্দরী সিরিয় মেরে কথা শোনাবো, যে তার রূপের দেমাকে চার চারটে বছর ন’জন পুরুষের সংস্পর্শে এলেও কারোর স্ত্রী হয়ে ঘর বাঁধতে পারেনি।

অনেক, অনেক দিন আগে ব্যাবিলনে সুলতান বেকিদারের রাজত্বকালে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু ঘটা অসম্ভব ব্যাপার ছিল। তার অনেকগুলো ছেলেমেয়ের মধ্যে মেয়ে আলাটিয়েল, তখনকার সময়ে পৃথিবীর সেরা সুন্দরী ছিল বললে বোধহয় এতটুকু বাড়িয়ে বলা হবে না। এক সময়ে আরবের যাযাবররা হঠাৎ তার রাজ্যে হানা দেয়। তখন আল্যারভের রাজা সময়মত এগিয়ে এসে সেই আক্রমণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। এবং তার পুরস্কারস্বরূপ তিনি তখন সুলতানের কাছ থেকে তার সেই সুন্দরী কন্যাকে তার স্ত্রী হিসেবে পাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। সুলতান সঙ্গে সঙ্গে তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন এবং একদিন তিনি তার সুন্দরী কন্যাকে জাহাজে তুলে দিলেন মহাআনন্দে আল্যারভ-এর উদ্দেশ্যে। আলাটিয়েলের সঙ্গে দিলেন পর যৌতুক এবং লোকলস্কর ও চাকর চাকরানি।

বেশ কয়েকদিন পরে জাহাজটা আলেকজান্দ্রিয়া কন্দর ছেড়ে যাওয়ার পর একদিন তারা যখন সারদিনিয়ার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, যাত্রাপথ যখন তাদের প্রায় শেষ হয়ে আসছিল হঠাৎ সমুদ্রে প্রচণ্ড বড় এবং তুফান উঠতে দেখা গেল। এত তীব্র এবং ভয়ঙ্কর সেই ঝড় যে, জাহাজের নাবিকেরা এক রকম ধরেই নিল, তাদের বাঁচার আয়ু শেষ হয়ে আসছে, তারা গভীর সমুদ্রের নিচে তলিয়ে যাবে একদিন। তবে তাদের সাহস এবং ধৈর্য ধরার ক্ষমতা ছিল অনেক। দুদিন ধরে সমুদ্রের নিচে পাহাড়ে ধাক্কা খেতে খেতে কোনোরকমে বেঁচে রইল নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে। যাই হোক, তৃতীয় দিন আবার সমুদ্রে প্রচণ্ড ঝড় এবং তুফান উঠতেই তাদের জাহাজ এবার প্রায় ডুবে যাওয়ার অবস্থা হল। সেখান থেকে ম্যাজোরকা খুব দুরে না হলেও আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢাকা থাকার দরুন তারা বুঝতে পারছিল না তারা তখন ঠিক কোথায় ছিল।

সবাই তখন ডুবন্ত জাহাজ থেকে নেমে একটা বড় নৌকা নিরাপদ আশ্রয় নেওয়ার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠল। জাহাজের সব যাত্রী সেই নৌকায় জায়গা পেল । কিছু লোক রয়ে গেল জাহাজে।

ইতিমধ্যে সমুদ্রের প্রচণ্ড ঝড় সেই জাহাজটাকে ম্যাজোরকা দ্বীপের কাছে টেনে নিয়ে এল। জাহাজটা তখন প্রায় জলে ভর্তি হয়ে গেছে। সেই সময় জাহাজের যাত্রী বলতে সেই মহিলা এবং তার পরিচারিকা। তাদের অবস্থা তখন মৃত জাননায়ারের মতন, তাদের চোখে-মুখে গভীর আতঙ্কের ছাপ। প্রচণ্ড ঝড়ের দাপটে জাহাজটা সমুদ্র তীরের বালিতে গেঁথে গিয়েছিল, নড়বার ক্ষমতা ছিল না তার। সারাটা রাত যাত্রীদের জাহাজেই কাটল।। পরদিন ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ের দাপট কমে গেল। ভদ্রমহিলা প্রায় অর্ধমৃত অবস্থায় কোনোরকমে উঠে দাঁড়িয়ে একের পর এক পরিচারিকাদের নাম ধরে ডাকতে শুরু করলেন। কিন্তু তখন তাদের সাড়া দেওয়ার কেউ ছিল না।

তাদের কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে এবং ধারে কাছে কাউকে দেখতে পেয়ে দারুণ ভয় পেল। কোনো অঘটন ঘটল না তো? তখন সে জাহাজের চারিদিক ঘুরে দেখতে গিয়ে দেখল, সবাই প্রায় মৃতের মত। খুব কম মানুষের দেহে প্রাণের স্পন্দন লক্ষ করা গেল। ভদ্রমহিলা এবার সত্যি সত্যি দারুণ ভয় পেলেন। জাহাজের চারিদিকে জল থৈ থৈ, তিনি যে কোথায় এসে পড়েছেন, কোনো ধারণা নেই সে ব্যাপারে। যে ক’জন তখনো জীবিত ছিল তাদের তিনি জাগিয়ে তুললেন। তারাও জানে না জাহাজের মানুষগুলোর কি হাল হয়েছে, তারা কোথায় তা তারা জানে না। তিন দিন ধরে পেটে একটুও খাবার পড়েনি। একটা নিশ্চিত মৃত্যুর সম্ভাবনা অনুমান করে নিয়ে তারা সবাই তখন যেন ভায়ে চিৎকার করে উঠল। দুপুর পর্যন্ত ধারে কাছে কাউকে দেখতে না পেয়ে হতাশায় ভেঙে পড়ল আসন্ন মৃত্যুর কথা চিন্তা করে। তারপর দুপুর প্রায় শেষ হয়ে আসছিল সেই সময় পেরিকোন দ্য ভিসালগে নামে এক ভালোমানুষ এথেন্স থেকে ফেরার সময় সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন ঘোড়ায় চড়ে, সঙ্গে ছিল অনেক লোক লস্কর। সমুদ্রতীরে সেই জাহাজটা দেখে তিনি ধরে নিলেন, কিছু একটা নিশ্চয়ই ঘটে থাকবে সেখানে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার এক বিশ্বস্ত পরিচারককে বললেন সেই জাহাজের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে দেখার জন্যে। চাকরটি তখন জাহাজে উঠে সেই যুবতী মহিলা এবং তার পরিচারিকাদের দেখতে পেয়ে অবাক হল, তারা তখনো কি করে বেঁচে আছে আশ্চর্য! কিন্তু চাকরটা ওদের ভাষা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ। তখন তারা আকারে ইঙ্গিতে চাকরটাকে পথের দূরাবস্থার কথা বোঝাতে চাইল। চাকর ফিরে এসে মেয়েটির সম্পর্কে খবর দিলে পেরিকোন সঙ্গে সঙ্গে তাকে সেই ডুবন্ত জাহাজ থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এলেন তাঁর প্রাসাদে, সেই সঙ্গে জাহাজের সমস্ত মূল্যবান সম্পদও সংগ্রহ করে নিয়ে এলেন। মেয়েটির সৌন্দর্য এবং মূল্যবান পোষাক দেখে পেরিকেন বুঝতে পারলেন সম্রান্ত বংশের মেয়ে সে। তার রূপে মুগ্ধ হয়ে তিনি তখন মনে মনে ঠিক করে ফেললেন তাকে বিয়ে করবেন। আর বিয়ে যদি একান্তই সম্ভব না হয়, তাহলে তিনি তাকে তার মিস্ট্রেস হিসেবে রেখে দেবেন।

ইতিমধ্যে জাহাজ ভ্রমণের ক্লান্তি কাটিয়ে উঠতেই মেয়েটি আরো বেশী রূপবতী এবং সুন্দরী হয়ে উঠল। পেরিকোনও কম সুপুরুষ নন। তিনি তখন মেয়েটির সঙ্গে ভাব জমাবার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু মেয়েটি তার হাবভাবে বুঝিয়ে দিল তার ইচ্ছা পূরণ করতে অপারগ সে। ওদিকে পেরিকোনের কামনা ক্রমশ বেড়েই যেতে থাকল। মেয়েটি তখনো জানে না, যে কোথায় এসে উঠেছে, কাদের সঙ্গে বসবাস করছে। তবে সে বুঝতে পারল, লোকগুলোর আচার ব্যবহার দেখে মনে হয় তারা খ্রিস্টান। পেরিকোনের মনের ভাব তখন তার পুরোপুরি জানা হয়ে গেছে। যে রকম ব্যবহার তিনি করছেন তাতে মনে হয় সে পছন্দ করুক বা না করুক, একদিন না একদিন তাকে তার ইচ্ছের শিকার হতেই হবে। তবুও, যেন সে কিছুই বুঝতে পারেনি এমনি ভাব দেখিয়ে অন্ধের মত চোখ ফিরিয়ে থাকার চেষ্টা করল পেরিকোনের দিক থেকে। মেয়েটি তার তিন জীবিত পরিচারিকাকে নির্দেশ দিয়ে বলল, যতক্ষণ না তারা সেখান থেকে তাদের মুক্তির আশ্বাস পাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ যেন তাদের পরিচয় প্রকাশ না করে পেরিকোনের কাছে। তাছাড়া তারা যেন সেখানকার কোনো পুরুষের প্রলোভনে নিজেদের দেহ বিকিয়ে দেয়। যত দিন যায় পেরিকোন যেন ততই অধৈর্য হয়ে উঠতে থাকে মেয়েটির সঙ্গ লাভের জন্যে। কিন্তু প্রতিবারেই মেয়েটি তাকে দৃঢ়তার সঙ্গে ফিরিয়ে দেয়। ক্রমে তার কামনার আগুন বেড়েই চলে। বার বার মেয়েটি তাকে ফিরিয়ে দিলে পেরিকোন তখন ভাবলেন, ভালো কথায় কাজ হবে না, হয়ত এবার তাকে বলপ্রয়োগ করতে হবে। তবে তিনি খোজ নিয়ে জেনে নিয়েছিলেন, মেয়েটির মদে আসক্তি আছে, অথচ মদ খাওয়া মেয়েটির ধর্মবিরুদ্ধ। পেরিকোন ভাবলেন মদের লোভ দেখিয়ে হয়ত তাকে জয় করা যেতে পারে। তাই তিনি একদিন সন্ধ্যায় এক বিরাট ভোজসভার আয়োজন করলেন, সেই সভায় মেয়েটি উপস্থিত ছিল। পেরিকেন তার চাকরকে বলে রেখেছিলেন মেয়েটিকে দামি মদ পরিবেশন করার জন্যে। চাকর তাঁর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করল। মদের নেশায় বিভোর হয়ে মেয়েটি অতিরিক্ত মদ গিলল। মেয়েটি তখন তার সব বিপর্যয়, সব দুঃখ দুর্দশার কথা ভুলে গিয়ে মেতে উঠল তাদের সঙ্গে। মেয়েটি দেখল, বেশ কিছু মেয়ে ম্যাজোরকার ঢঙে নাচছে, তখন সে নিজেও আলেকজান্দ্রার ফ্যাসানে নাচতে শুরু করে দিল।

সেই দৃশ্য দেখে পেরিকোনের মনে আশা জাগল, খুব শিগগীরই তার ইচ্ছাপূরণ হতে পারে। মেয়েটি গ্লাসের পর গ্লাস মদ গিলে যায়। তখন তার নিজস্ব সত্ত্বা বলতে কিছু ছিল না, তখন যেন সে একটা কলের পুতুল, দম দিলেই চলবে। সব শেষে অতিথিরা যে যার বাড়ি চলে গেলে পেরিকোন মেয়েটিকে যন্ত্রচালিতের মতন দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে নিয়ে গেল। মেয়েটির তখন হুঁশ বলতে কিছু ছিল না। পেরিকোনকে সে তার ব্যক্তিগত পরিচারক ভেবে নিজের ঘরের মধ্যে ঢুকে তার সামনেই সে তার পোষাক এক এক করে খুলে ফেলল, এবং বিছানায় শুয়ে পড়ল। পেরিকোন সময় নষ্ট না করে সঙ্গে সঙ্গে সেও মেয়েটিকে অনুসরণ করলেন নিজেকে নির্বস্ত্র করে। তার ঘরের আলো নিভিয়ে মেয়েটির নগ্ন দেহের পাশে শুয়ে পড়লেন তিনি এবং দু’হাত দিয়ে তিনি তাকে জড়িয়ে ধরলেন, মেয়েটি কোনো বাধা দিল না, কলের পুতুলের মত নিজেকে সে সঁপে দিল পেরিকোনের হাতে। পেরিকোন তার নগ্ন দেহ যথেচ্ছ ভাবে ব্যবহার করতে শুরু করে দিলেন। পুরুষ স্পর্শ যে নারীর কাছে এত প্রিয় হতে পারে আগে কোনও ধারণা ছিল না মেয়েটির। একটু একটু করে তখন তার মদের নেশাটা কেটে গিয়ে হুশ ফিরে আসছিল। পেরিকোনের হাতের মুঠোয় তখন তার স্তনযুগল, ঠোটে ঠোট। পেরিকেন তার দেহের ওপর নিজের শরীর বিছিয়ে দিতেই মেয়েটি আবেগে চোখ বুজল। পেরিকেন তার ঠোটে ঘন ঘন চুমু খেতে খেতে মেয়েটির দেহে প্রবেশ করল এক সময়। পেরিকোন আচমকা তার দেহে প্রবেশ করার কারনে প্রথমে একটু ব্যথা পেলেও এক অদ্ভুত আনন্দানুভূতি তার সারা দেহে রন রন করে অনুরণিত হয়ে উঠতে থাকল। থর থর করে কেঁপে উঠল তার সারা দেহ। সেই রোমাঞ্চকর সুখে গা ভাসিয়ে দিতে গিয়ে মেয়েটির তখন দারুণ অনুশোচনা হল, আগে কেন সে পেরিকোনেরর আহ্বানে সাড়া দেয়নি, কেন সে এই অপূর্ব সুখ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে রাখত এতদিন। মেয়েটির তৃপ্তি তখন এতই তীব্র হয়ে উঠেছিল যে, এবার সে নিজেই সেই সুখের জানান দিতে পেরিকোনের প্রেম প্রেম খেলার সাথী হয়ে উঠল। একবার সুখ পেয়ে দেহের ক্ষুধা আরো বেড়ে গেল। তারপর সে নিজের থেকেই আহ্বান করল পেরিকোনকে। সেই রাতে দেহে ক্লান্তি না আসা পর্যন্ত বার বার পেরিকোনের সঙ্গে দৈহিক মিলনে প্রবৃত্ত হল বিভিন্ন কায়দায়। পেরিকোনও তাকে তৃপ্তি দিতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করলেন না। তারপর থেকে পেরিকেনের আর কোনও ক্ষোভ রইল না। মেয়েটিকে তিনি তাঁর স্ত্রী হিসেবে না পেলেও খুশি মত যখন যেভাবে পারছেন তিনি তার দেহ উপভোগ করতে থাকলেন স্বামী-স্ত্রীর মতন। কিন্তু তার সেই সুখের দিন বেশী সময় স্থায়ী হল না। পেরিকোনের এক পঁচিশ বছরের যুবক ভাই ছিল, তরতরে তাজা এবং সুপুরুষ, যেন সদ্য প্রস্ফুটিত একটি গোলাপতার নাম ছিল মারাটো। মেয়েটিকে দেখা মাত্র তার যৌনচেতনা প্রচণ্ড ভাবে জেগে উঠল। মনে মনে মেয়েটিকে সে ভীষণ ভাবে কামনা করল। মেয়েটিও তাকে দেখে হাবভাবে বুঝিয়ে দিল সেও তাকে কামনা করে। তখন তারা দেখল, তাদের সামনে একমাত্র বাধা পেরিকেন, যাঁর কড়া নজর পড়ে আছে তার ওপর। মারাটো বুঝতে পারল, যে ভাবেই হোক পেরিকোনের হাত থেকে মেয়েটিকে মুক্ত করতে না পারলে তারা তাদের সুখের লক্ষে পৌছতে পারবে না। সে তখন এক মারাত্মক খেলায় মেতে উঠল।

সেই বন্দরে দুটি জোনোসী যুবক একটা জাহাজ নোঙর করল। পেলেপোনিজে ব্যবসায়ীদের জন্যে মালপত্র বোঝাই করে নিয়ে যাচ্ছিল জাহাজটা। অনুকূল বাতাস আবার বইতে শুরু করলেই জাহাজটা সমুদ্রে ভাসবে। মারাটো সেই জাহাজের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার নিজের এবং মেয়েটির জন্যে দুটি আসনের ব্যবস্থা করে রাখল। পরদিন রাত্রে তারা সেই জাহাজে উঠবে, সেখান থেকে পালাবার সব ব্যবস্থাই তো পাকা হল। কিন্তু যে মেয়েটিকে নিয়ে সে পালাতে চায় সেই মেয়েটিকে তার বড় ভাই-এর খপ্পর থেকে কি করে উদ্ধার করা যায়? সঙ্গে সঙ্গে মারাটোর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল, ঠিক করল পেরিকোনের বাড়ি থেকে মেয়েটিকে চুরি করে নিয়ে আসবে।

মারাটো তার কয়েকজন বিশ্বস্ত সঙ্গীদের সঙ্গে কথা বলে রাখল এ ব্যাপারে, তারা তাকে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিল। রাত গভীর হলে পেরিকেন এবং মেয়েটি গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে পড়লে তারা তার ঘরে ঢুকে পেরিকোনকে হত্যা করে মেয়েটিকে ঘিরে ফেলল। মেয়েটি ঘুম থেকে জেগে উঠে সেই ভয়ঙ্কর বীভৎস দৃশ্য দেখে চিৎকার করে উঠতেই তারা তাকে হত্যা করার ভয় দেখায়। মেয়েটি প্রাণের ভয়ে চুপ করে গেল। তখন তারা পেরিকোনের মূল্যবান সম্পদ ও নগদ অর্থ যা পারল সংগ্রহ করে মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে সমদ্রতীরের দিকে রওনা হয়ে গেল। রাত তখন গভীর নিশুতি, কাক পক্ষীও কেউ টের পেল না তাদের সেই দুঃসাহসিক অভিযানের কথা। সমুদ্রতীরে অপেক্ষা করছিল মারাটো। মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে সে তখন সেই জাহাজে উঠে পড়ল এবং তার সঙ্গীরা যে যার পথের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল সেখান থেকে।

একটু পরেই অনুকূল বাতাস বইতে দেখে জাহাজের নাবিকরা বন্দর থেকে নোঙর তুলে দিয়ে জাহাজটা জলে ভাসিয়ে দিল। মেয়েটি দ্বিতীয়বার বিপর্যয়ের মুখােমুখি হয়ে নিজের অদৃষ্টের কথা ভাবছিল তখন। তবে মারাটোর মিষ্টি মিষ্টি কথায় মেয়েটি কিছুক্ষণের মধ্যেই ভুলে গেল পেরিকোনের কথা। তার মন থেকে পেরিকোনের স্মৃতি মুছে ফেলে মারাটোর কাছে নিজেকে সঁপে দিল। রাতের অন্ধকারে জাহাজ তখন ভেসে চলেছে সমুদ্রে। আর ওদিকে একটা কেবিনে মারাটো এবং মেয়েটি সুখের সাগরে গা ভাসিয়ে দিল। বাকী রাতটুকু তারা প্রেম প্রেম খেলা খেলল, কম করেও তিনবার তারা চরম সুখের স্বাদ পেয়ে নিজেদের ধন্য মনে করল, তাদের জীবন সার্থক বলে ধরে নিল। কিন্তু এবারেও বোধহয় ভাগ্যদেবী অলক্ষ্যে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হাসলেন। মারাটোর সঙ্গে তার একটা নিবিড় ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠার আগেই এক বিপর্যয়ের মহড়া দিচ্ছিল জাহাজের যুবক মালিক দু’জন। মেয়েটিকে রাতের অন্ধকারে দেখা মাত্র তাদের রক্ত গরম হয়ে উঠেছিল। মনে মনে তারা ঠিক করে ফেলেছিল যে ভাবেই হোক মেয়েটিকে তাদের শয্যা সঙ্গিনী করতে হবে।

“বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি না করে বলতে চাই, প্যানফিলো এখানে একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন, আমরা জেনেছি মেয়েটির সারা অঙ্গে রূপ আর যৌবন যেন উপচে পড়ছিল। তাকে স্বর্গের অপ্সরা বললে এতটুকু বুঝি বাড়িয়ে বলা হয় না। তার সেই চোখ ধাঁধানো রূপ দেখে যুবক দুটি প্রচণ্ড উত্তেজনায় তখন ভাবছিল কি করে মেয়েটির মন জয় করা যায়, তাকে তাদের কামলালসার চরিতার্থ করাতে রাজি করানো যায়। সেই সঙ্গে তারা এও ঠিক করল, তাদের মনের কথা মারাটোকে জানতে দেবে না।

যুবক দুটি পরস্পরের মনের কথা জানতে পেরে নিজেদের মধ্যে একটা আপোষ রফা করে নিল আগে ভাগে। প্রথমে মেয়েটিকে জয় করতে হবে, তারপর ঠিক করা হবে কে প্রথম তাকে উপভোগ করবে। কিন্তু তাদের অপেক্ষা করতে হল। কারণ মারাটো তখন মেয়েটির ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে রেখেছিল। কিন্তু একদিন তাদের সামনে সেই সুবর্ণ সুযোগটা এসে গেল। মারাটো দাঁড়িয়েছিল ডেকের ওপর, সামনেই রেলিং। তারা তখন নিঃশব্দে তার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল, তাদের উদ্দেশ্যের কথা সে জানতেও পারল না। তারপর অতর্কিতে পিছন থেকে তারা তাকে সজোরে ধাক্কা দিতেই মারাটোর ভারী দেহটা জলের ওপর আছড়ে পড়ল এবং গভীর সমুদ্রে তলিয়ে যেতে দেখা গেল তার দেহটা। দুর্ঘটনাস্থল থেকে এক মাইল পাড়ি দেওয়ার পর মেয়েটি জানতে পারল মারাটো আর বেঁচে নেই। জাহাজের দু’জন মালিকের হাতে ভাগ্যকে সঁপে দেওয়া ছাড়া অন্য কোনও উপায় সে আর দেখতে পেল না।

জাহাজের মালিক দুই ভাই তখন মেয়েটির দূরাবস্থা দেখে তাকে সাহায্য করার জন্যে হাত বাড়িয়ে দিল। তাঁর সঙ্গে ভালো ভালো কথা বলে তার মন গলানোর চেষ্টা করল। মেয়েটি তখন মারাটোকে হারিয়ে যত না দুঃখ পেয়েছিল তার বেশী দুঃখ পেল দুই ভাইকে একই সঙ্গে তার দেহের ওপর লোলুপ দৃষ্টি ফেলতে দেখে। একটি নারী, দুটি পুরুষ, একটা অশুভ চিন্তা তখন তাকে গ্রাস করছিল। সেই আশঙ্কা যে মিথ্যে নয় একটু পরেই তার প্রমাণ পাওয়া গেল। দুই ভাই তখন আলোচনায় বসল, কে প্রথম মেয়েটিকে তার শয্যাসঙ্গিনী করবে। প্রথমে ভালো কথায় তারা এ ওকে বোঝবার চেষ্টা করল, কিন্তু কেউ যখন কারোর কথায় রাজি হতে পারল না, তখন তারা উত্তেজিত হয়ে এ ওকে গালিগালাজ করতে করতে শেষে ছুরি হাতে দ্বন্দ্বযুদ্ধে নেমে পড়ল। ছুরির আঘাতে দু’জনের দেহই তখন দারুণ ক্ষত-বিক্ষত। একজনের আঘাত এতই গুরুতর ছিল যে, ঘটনাস্থলেই সে মারা গেল। অন্য ভাইটা মারাত্মক ভাবে আহত হয়ে লুটিয়ে পড়ল ডেকের উপর।

মেয়েটি তখন অত্যন্ত বিপন্না। জাহাজে তখন এমন কোনও ভালো লোক তার চোখে পড়ল না যে কিনা তার বিপদে তাকে সাহায্য করতে পারে। তার আরো আশঙ্কা, এবার বুঝি জাহাজের অন্য লোকগুলো তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, তার রূপসী দেহটা ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। কারণ, দুই ভাই যখন কে আগে তাকে দেহ উপভোগ করবে, সামান্য এই সমস্যাটার কোনো সমাধান করার আগেই একজনকে খুন হতে হল, আর একজন মারাত্মকভাবে আহত হল, তখন অতগুলো লোক কি সমঝােতায় যে আসতে পারে, সেটা এখন আর তার অজানা থাকার কথা নয়। আর সেই ভয়েই মেয়েটি তখন আরো বেশী কুঁকড়ে গেল। যাইহোক আহত যুবকটির প্রতি তার কেমন যেন মায়া হল এবং ওদিকে ক্লারেঞ্চয় নোঙর করাতে তখনকার মত তার বিপদ বুঝি কেটে গেল। তখন সে আহত যুবকটিকে সঙ্গে নিয়ে জাহাজ থেকে নেমে একটা হোটেলে গিয়ে উঠল। পরে সেই হোটেল থেকেই মেয়েটির দেহ-সৌন্দর্যের খবরটা ছড়িয়ে পড়ল সারা শহরে। সেই সময়ে ক্লারেঞ্জায় মােরিয়ার রাজকুমার উপস্থিত ছিল। তার কানেও খবরটা পৌঁছতে সে তখন মেয়েটির ভুবন ভোলানো রূপ দেখা মাত্র সে তার প্রেমে পড়ে গেল, তার মনে হল ওর মত সুন্দরী মেয়ে সে বুঝিএর আগে কখনো দেখেনি। মেয়েদের রূপ না তো অভিশাপ।

মেয়েটার পূর্ব পরিচয় পেয়ে রাজকুমারের মনে হল, কেনই বা সে তাকে পাবে না। রূপে-গুণে অর্থ-যশে সেই বা কি এমন কমতি আছে? আহত যুবকের আত্মীয় বন্ধুরাও তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে কসুর করল না। রাজকুমারের মনের কথা বুঝতে পেরে তারা তখন মেয়েটিকে চুরি করে নিয়ে গিয়ে রাজকুমারের হাতে তুলে দিল। মেয়েটিকে পেয়ে রাজকুমার উৎফুল্ল, এবং মেয়েটিও কম খুশি হল না। তার নতুন পুরুষকে সঙ্গী হিসেবে পেয়ে। মেয়েটি তখন ভাবল, এবার বোধহয় তার বিপদ কাটল। ওদিকে রাজকুমার তার রূপে মুগ্ধ হয়ে ভাবল, মেয়েটির চালচলন দেখে মনে হয় সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে সে। তখন মেয়েটির প্রতি তার ভালোবাসা দ্বিগুণ বেড়ে গেল। রক্ষিতা হিসাবে নয়, তাকে সে নিজের স্ত্রীর মর্যাদা দিতে কসুর করল না। মেয়েটি তার বর্তমান রূপ এবং ঐশ্বর্যের বহর দেখে নিজেকে অত্যন্ত ভাগ্যবতী বলে মনে করল। আগের জীবনে সে যে দুঃখ যন্ত্রণা পেয়েছিল সে সবের তুলনায় রাজকুমারের জীবনে এসে সে অনেক বেশী সুখী, নিজেকে অনেক নিরাপদে বলে মনে করল। একটা সুখের মুখ দেখতে পেয়ে তারপর থেকে তার রূপ যেন আরো বেশী খুলে গেল। তার সেই নতুন রূপের কথা সারা প্রাচ্য সাম্রাজ্যে আগুনের দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়তে দেখা গেল। সবার মুখেই সেই একই কথা ; আহা কি রূপ মেয়েটির। এথেন্স-এর ডিউক ছিল রাজকুমারের আত্মীয় এবং বন্ধু। তার একদিন ইচ্ছে হল মেয়েটিকে নিজের চোখে একবার দেখে। ডিউকও ছিল দেখতে-শুনতে সুপুরুষ, বয়স অল্প। বলিষ্ঠ যুবক রাজকুমারের সঙ্গে প্রথামত দেখা করার অছিলা করে একদিন সে ক্লায়েঞ্চয় এল।

কথায় কথায় ডিউক জিজ্ঞেস করল, রাজকুমার শুনেছি তোমার প্রাসাদের নতুন অতিথিটি নাকি খুব সুন্দরী।

‘সুন্দরী কি বলছ হে? পরমাসুন্দরী সে। অতুলনীয়া। রাজকুমার মেয়েটির রূপের প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে বলল, ‘বিশ্বাস না হয়, নিজের চোখেই পরখ করে দেখতে পারো।

এরপর রাজকুমার তাকে মেয়েটির ঘরে নিয়ে গেল। মেয়েটি তাদের সাদর অভ্যর্থনা করে তার শয়নকক্ষে বসাল। মেয়েটি বসেছিল দুই বন্ধুর ঠিক মাঝখানে। তবে তাদের ভাষা ঠিক মত বুঝতে না পারায় তাদের আলোচনায় রস সে গ্রহণ করতে পারছিল না। ডিউক ঘন ঘন মেয়েটির দিকে তাকাচ্ছিল। সে বিশ্বাস করতে পারছিল না, মেয়েটি এই পৃথিবীর মানবী না কি স্বর্গের কোনো দেবী। একই অঙ্গে এত রূপ? নিজের চোখে না দেখলে বোধহয় সে বিশ্বাস করতে পারত না। তার রূপে আগুনের ঝলক ছিল, এত তীব্র সেই ঝলক যে, কোনো পুরুষ সেই আগুনে জ্বলে পুড়ে মরতে পারে। তবু সেই আগুনের স্পর্শ পেতে চায় পুরুষ। বিচিত্র নারী, তার চেয়েও বিচিত্র বোধহয় তাদের রূপ আর যৌবন। মেয়েটির প্রতি একটা প্রচণ্ড আকর্ষণ অনুভব করল ডিউক। তার মনে হল, পৃথিবীতে রাজকুমারের মত খুশী বোধহয় আর কেউ নেই এমন এক সুন্দরী মেয়ে যার শয্যা সঙ্গিনী, তার থেকে বেশী সুখী আর কেই বা হতে পারে? ডিউকের মধ্যে তখন অনেক চিন্তা। কি করে রাজকুমারের সেই সুখের সাম্রাজ্যে হানা দেওয়া যায়, কি করে মেয়েটিকে তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া যায়। তবে সে এ কথাও ভাবল, যে কোনো মূল্যে মেয়েটিকে পেতেই হবে, তার পরিণাম যত ভয়াবহই হোক না কেন। অতঃপর ডিউক একদিন তার বদ মতলবের একটা বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্যে রাজকুমারের বিশ্বস্ত চাকরকে টাকা দিয়ে হাত করল। তার সঙ্গে চুক্তি হল, গভীর রাতে রাজকুমারের প্রাসাদের দরজা খুলে দেবে। তখন ডিউক এবং তার এক সঙ্গীকে সঙ্গে নিয়ে রাজকুমারের শয়ন কক্ষে প্রবেশ করে মেয়েটিকে অপহরণ করে নিয়ে যাবে।

| সেদিন রাতে ঘোড়ায় চড়ে ডিউক তার সঙ্গীকে নিয়ে রাজকুমারের প্রাসাদের সামনে এসে দাঁড়াল। তারা দু’জনেই অস্ত্রে সুসজ্জিত। যথারীতি চাকর সিউরিয়াসি তাদের পথ দেখিয়ে নিঃশব্দে রাজকুমারের শয়নকক্ষে নিয়ে এল। প্রচণ্ড গরম সেদিন। চারিদিকে অন্ধকার থিকৃথিক করছিল। মাঝে মাঝে সমুদ্রের গর্জন ভেসে আসছিল। মেয়েটি তখন বিছানায় গভীর নিদ্রায় মগ্ন এবং প্রায় অর্ধনগ্ন অবস্থায় ঘুমােচ্ছিল। এবং রাজকুমার সমুদ্রে হাওয়া খাওয়ার জন্যে জানালার সামনে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় দাঁড়িয়েছিল। দেখে মনে হয় খানিক আগে মেয়েটির সঙ্গে যৌন খেলায় মেতে উঠে থাকবে সে। ডিউক তার সঙ্গীকে ইশারায় ইঙ্গিত করল, আগেই সে বলে রেখেছিল কি তাকে করতে হবে। রাজকুমার তাদের উপস্থিতি একেবারেই টের পায়নি। সেই সুযোগে ডিউকের অনুচর পা টিপে এগিয়ে গিয়ে পিছন থেকে রাজকুমারের পিঠের ওপর তার হাতের ধারালো তলোয়ারটা আমূল বিঁধিয়ে দিল। মাত্র একবারই অস্ফুটে চিৎকার করে উঠেছিল রাজকুমার, পরক্ষণেই তার রক্তাক্ত শরীরটা মেঝের ওপর পড়ে যেতেই ডিউক তার মৃতদেহটা দুহাত দিয়ে তুলে নিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল। বারান্দা সংলগ্ন রাজকুমারের প্রাসাদের প্রাচীর। ডিউক তার দেহটা প্রাচীর টপকে বাইরে জঙ্গলের মধ্যে ফেলে দিল। কেউ জানতেও পারল না।

ওদিকে ডিউকের শেখানো মত তার সঙ্গী তখন রাজকুমারের ভৃত্য সিউরিসির গলায় ফাঁস লাগিয়ে তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে খুন করে ফেলেছিল। তার মৃতদেহটাও প্রাসাদের বাইরে ফেলে এল তারা। তারপর ডিউক তার সঙ্গীকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলে রাজকুমারের শয়নকক্ষে ঢুকল তার শেষ কাজটা সারার জন্যে। মেয়েটি তখন অঘোরে ঘুমােচ্ছিল। পোষাকে ঢাকা যে মেয়ের এত সৌন্দর্য না জানি নিরাবরণ দেহে তাকে আরো কত না সুন্দরী দেখাতে পারে। সেটা দেখার জন্যে ডিউক নিঃশব্দে বিছানায় তার পাশে বসে এক এক করে তার দেহ থেকে সমস্ত পোশাক খুলে ফেলল। তার চোখের সামনে মেয়েটির নগ্ন দেহ ভেসে উঠল। ফোটা পদ্মের মতো স্তনযুগল। সুউচ্চ স্তন জোড়ার মাঝে মসৃণ উপত্যকা অনেক নিচ পর্যন্ত নেমে এসেছে, নাভি পেরিয়ে সেই তল গিয়ে মিশেছে দুটি উরুর সন্ধিক্ষণে যেখানে মেয়েটির দেহের সমস্ত উত্তাপে ঘনীভূত। সেই উত্তাপের স্পর্শ পাওয়ার জন্যে ডিউক দারুণ উত্তেজিত হয়ে উঠল। প্রথমে মেয়েটির ঠোটে চুমু খেল। তার ঠোট জোড়া মেয়েটির বুক হয়ে পরিক্রমা শেষ করল নাভির নিচে। তার ভেতরের পশুটা তখন গর্জে উঠছিল পোষাকের আড়াল থেকে। তাকে শান্ত করতে ডিউক তখন পোক মুক্ত হয়ে নিজের দেহটা আলতো করে বিছিয়ে দিল মেয়েটির নগ্ন দেহের ওপর। মেয়েটি তখন আধা ঘুম চোখে একবার তাকিয়েই আবার চোখ বুজল। ঘরের আলোগুলো ডিউক আগেই নিভিয়ে দিয়েছিল। মেয়েটির ঠোটে কামনার হাসি ফুটে উঠল। সে তখন ডিউককে তার মনের মানুষ রাজকুমার ভেবে তার দৃঢ় আলিঙ্গনে সাড়া দিতে বিন্দুমাত্র আপত্তি করল না। আর ডিউক সেই সুযোগে মনের আনন্দে মেয়েটির দেহ উপভোগ করে চলল। এক সময় তাদের দু’জনের দেহটা থরথর করে কেঁপে উঠল। ঠিক সেই মুহূর্তে দুজনের দেহে একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে গেল। মেয়েটি দু’হাত দিয়ে ডিউকের মাথা নামিয়ে নিজের সিক্ত ঠোটের ওপর তার ঠোট জোড়া চেপে ধরল। ডিউক তার মুখের ভেতরে জিভটা চুষতে শুরু করে দিল। এক সময় চুম্বন বিষাদ ঠেকতেই তারা এ ওর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। ডিউক উঠে গিয়ে ঘরের আলো জ্বালাতেই মেয়েটি রাজকুমারের বদলে ডিউককে দেখেই চমকে উঠল। তুমি? তুমিই তাহলে এতক্ষণ আমার সঙ্গে, কথাটা অসমাপ্ত রেখে ডিউকের দিকে তাকাল মেয়েটি। কোনো রাগ নয়, বিদ্বেষ নয়, বরং মনে মনে মেয়েটি তার প্রশংসাই করল, কারণ রাজকুমারের থেকেও আজ বেশী সুখ পেয়েছে সে ডিউকের কাছ থেকে। ডিউক তার দেহ মন দুই ভরিয়ে দিয়েছিল কানায় কানায়। রাজকুমারের মৃত্যুর খবর না জানলেও এখন তাকে ছেড়ে দিয়ে ডিউকের সঙ্গে পালিয়ে যেতে তার মনের ভাবটা মুখে প্রকাশ করল না। মেয়েদের স্বভাব জাত ধর্ম বুক ফাটল তবু তার মুখ ফুটল না। ডিউক ভাবল মেয়েটি বোধহয় নারাজ তার সঙ্গে যেতে। তাই সে তাকে ভয় দেখাল হত্যা করার হুমকি দিয়ে। তার নির্দেশে তার সঙ্গী তখন মেয়েটিকে কোলে তুলে নিয়ে রাজকুমারের প্রাসাদের বাইরে চলে এল। ডিউক তার নিজের ঘোড়ায় মেয়েটিকে তুলে নিয়ে এবার ছুটে চলল। তাকে অনুসরণ করল তার সঙ্গী আর একটা ঘোড়ায় চড়ে। অদূরে ডিউকের অনুচররা অপেক্ষা করছিল তার জন্যে। ডিউকের নির্দেশে তখন তারা এসেন্সের দিকে রওনা হল। ডিউক ছিল বিবাহিত তবে তাই বলে বেচারী এই মেয়েটিকে সে অবহেলা করবে তা নয়। শহরের এক প্রান্তে এক নির্জন জায়গায় তার বাগানবাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুলল সে মেয়েটিকে। সেখানে সে মেয়েটিকে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সব রকম ব্যবস্থা করে দিতে একটুও কার্পণ্য করল না।

পরদিন সকালে রাজকুমারের ঘুম ভাঙতে না দেখে তার অনুচররা ভাবল, মেয়েটির সঙ্গে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকার দরুণ তার ঘুম ভাঙতে দেরী হচ্ছে হয়ত। কিন্তু অনেক বেলা পর্যন্ত যখন তার ঘুম ভাঙল না তখন তারা তাঁর শয়ন কক্ষের সামনে গিয়ে হাজির হল। ঘরের দরজা খােলা ছিল। সেই খােলা দরজা পথ দিয়ে তারা দেখল ঘর ফাকা। তখন তারা ভাবল, রাজকুমার হয়ত মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে সমুদ্র তীরে বেড়াতে গেছে। তখন তারা রাজকুমারের খোঁজে সমুদ্রতীরের দিকে যেতে গিয়ে এক এক করে তারা রাজকুমার এবং তার ভৃত্য সিউরিয়াসির মৃতদেহ আবিষ্কার করল। একটা গভীর শোকের ছায়া নেমে এল রাজপ্রাসাদে।। কে, কে হত্যাকারী হতে পারে? রাজকুমার সমাধিস্থ দেওয়ার পর চলল অন্বেষণ। দেখা গেল এথেন্সের ডিউক নিঃশব্দে পালিয়ে গেছে সেখান থেকে। তখন তাদের সব সন্দেহ গিয়ে পড়ল তার ওপর। এথেন্সে লোক পাঠিয়ে তারা খোঁজ পেল হ্যা, ডিউক সেই মেয়েটিকে তার রাজ্যে নিয়ে গেছে। তারা তখন রাজকুমারের ছােট ভাইকে রাজকুমারের আসনে বসিয়ে তাকে অনুরোধ করল, ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে। নবাগত রাজকুমার তখন তার প্রতিবেশী। রাজ্যের মিত্র এবং আত্মীয় বন্ধুদের কাছে খবর পাঠাল, কে কি ভাবে তাকে সাহায্য করতে পারে জানানোর জন্যে। তাদের কাছ থেকে আশ্বাস পেয়ে রাজকুমার তখন এথেন্সের ডিউকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল।

ওদিকে ডিউক যুদ্ধের খবর পেয়ে সেও তখন নবাগতা রাজকুমারের সঙ্গে মােকাবিলা করার জন্যে তৈরি হতে থাকল। বহু প্রতিবেশী সাম্রাজ্যের শক্তিশালী সম্রাট এবং রাজারা তাদের সৈন্যসামন্ত সঙ্গে নিয়ে তার পাশে এসে দাঁড়াল। তাদের মধ্যে কনস্ট্যান্টিনেপলের সম্রাটের ছেলে কনট্যান্ট এবং ভাই ম্যানুয়েলও এলো তাদের বিরাট এক সৈন্যবাহিনী সঙ্গে নিয়ে। কনট্যান্ট এবং ম্যানুয়েলকে দারুণ খাতির যত্ন করল। তাদের সব থেকে বেশী উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাল ডিউক পত্নী ড্যাচিস, কারণ কনস্টান্টির বোন ছিল সে।

যুদ্ধ যখন ঘনিয়ে আসছিল, ড্যাচিস একদিন তার ভাই কনস্ট্যান্ট এবং ম্যানুয়েলকে নিজের ঘরে ডেকে পাঠাল। সবাই জানাল, সেটা ভাইবোনের সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎকার। কিন্তু ড্যাচিসের আসল উদ্দেশ্য ভায়েদের কাছে তার দুঃখের গোপন কাহিনী খুলে বলা। কান্নায় ভেঙে পড়ে সে তখন তাদের বলল, এই যুদ্ধের মূলে একজন সুন্দরী মহিলা যাকে ডিউক চুরি করে এনেছে। এই মহিলা শুধু এথেন্স-এর অশান্তির কারণ নয় ড্যাচিসের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। তার জন্যেই ডিউক আজকাল তাকে অবহেলা করতে শুরু করেছে। তার প্রতি আগের মতন তেমন নজর আর দেয় না সে। সারাক্ষণ সে সেই মেয়েটির কাছে পড়ে থাকে। ড্যাচিস তার দুঃখের কাহিনী বলে ভায়েদের অনুরোধ করল তাদের জীবন থেকে এই মেয়েটিকে অপসরণ করার জন্যে।

দুই ভাই তখন তাদের বোনকে আশ্বাস দিয়ে বলল, তারা তাদের সাধ্যমত ব্যবস্থা করবে। বোনের কাছ থেকে তারা জেনে নিয়েছিল সেই সুন্দরী রমণী কোথায় থাকে। তারপর একদিন তারা কথায় কথায় ডিউকের কাছে সেই মেয়েটির প্রসঙ্গ তুলে অনুরোধ করল তার সঙ্গে তাদের পরিচয় করিতে দেওয়ার জন্যে। ডিউক তাদের অনুরোধ রাখতে গিয়ে তার জীবনে বিপর্যয় ডেকে এনেছিল।

ড্যাচিসের দুই ভাই-এর সামনে ডিউক একদিন এক বিরাট ভোজ সভার আয়োজন করল বাগান বাড়িতে। সেখানে সেই সুন্দরী মেয়েটির সঙ্গে কনস্ট্যান্টের আলাপ হল। প্রথম দর্শনেই প্রেম এতই তীব্র মনে হল তার কাছে যে সেই মুহূর্তে সে তার মন থেকে আসন্ন যুদ্ধের কথা মুছে ফেলে মনে মনে ডিউকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ফেলল। যে ভাবেই হোক ডিউকের হাত থেকে মেয়েটিকে উদ্ধার করতে হবে। তার সঙ্গে আলাপ জমাতে হবে, বোনের স্বার্থ নয় তার | নিজের স্বার্থে নিজের দৈহিক ক্ষুধা মেটানোর জন্যে। অবশ্য মেয়েটির প্রতি তার সেই তীব্র আকর্ষণ বোধের কথা সে কারোর কাছেই প্রকাশ করল না। কনস্ট্যান্টের সারা দেহ মন তখন আচ্ছন্ন মেয়েটির কামনায়। এই সময় রাজকুমার এথেন্সের সীমান্তে প্রায় পৌঁছে গিয়েছিল তার সৈন্য-সামন্তদের সঙ্গে নিয়ে। খবর পেয়ে ডিউক তার সৈন্যদের নিয়ে এগিয়ে গেল। যুদ্ধে তার মন কিছুতেই বসতে চাইছিল না। কয়েকদিন পরেই অসুখের ভান করে সে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে এল এথেন্স শহরে। ডিউক তখন অনুপস্থিত সেখানে। এই সুযোগ। মেয়েটিকে ইলোপ করার সুযোগটা সে হাতছাড়া করতে চাইল না। ম্যানুয়েলকে

তার কাজ বুঝিয়ে দিয়ে আসে সে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে আসার আগে।

এথেন্স-এ ফিরে সে প্রথমে তার বোন ড্যাচিসের সঙ্গে দেখা করল। তাকে সে বোঝাল, তার ভালোর জন্যেই সে তার স্বামী ডিউকের প্রেমিকাকে ইলোপ করে নিয়ে যেতে চায় সেখান থেকে। বোনের কাছে সে তার মনের গোপন ইচ্ছার কথা প্রকাশ করল না। ড্যাচিস তখন তাকে বলল তোমার সব কাজেই আমার পূর্ণ সমর্থন আছে। তবে দেখ, ডিউক যেন ঘূণাক্ষরেও জানতে না পারে, এ ব্যাপারে আমার মত আছে।’

তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো বোন কাক পক্ষীও জানতে পারবে না।” এই বলে তারপর সে প্রথমেই একটা দ্রুতগামী স্পীড বোটের ব্যবস্থা করল অত্যন্ত গোপনে। ডিউকের বাগানবাড়িটা ছিল সমুদ্রের ধারেই। কনস্ট্যান্ট তার কিছু অনুচরদের স্পীড বোটটা পাহারা দিতে বলে বাকী লোকদের সঙ্গে নিয়ে মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতে গেল। ডিউকের সম্বন্ধী বলে খাতির করলেও অনুচররা তার ওপর নজর রাখতে ভুললো না। মেয়েটির এক পরিচারিকা মারফৎ সে খবর পাঠাল ডিউকের কাছ থেকে একটা গোপন বার্তা সে বহন করে নিয়ে এসেছে। স্বাভাবিক কৌতুহলবশত মেয়েটি কাছে আসতেই তার অনুচররা মেয়েটিকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলল। কনস্ট্যান্ট তাদের দিকে তলোয়ার উচিয়ে হুমকি দেয় ; মৃত্যু যদি না চাও তো এক পাও আর নড়বে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক। যতক্ষণ না আমার স্পীড বোটটা তোমাদের দৃষ্টির আড়াল হয়ে না যায়। ডিউকের রক্ষিতাকে হরণ করার উদ্দেশ্য আমার নয় তবে সে আমার বোনের যে ক্ষতি করেছে সেটা পূরণ করার জন্যেই আমি একে নিয়ে যাচ্ছি বুঝলে?

কিছু দূরে গিয়ে তারা অপেক্ষা করে, স্পীড বোটে উঠে যাত্রা শুরু করল। কয়েকদিন পরে তারা চিরসে গিয়ে পৌছাল। জায়গাটা নিরাপদ মনে করে কনস্ট্যান্ট সেখানে থেকে গেল কিছুদিন। মেয়েটিকে চুরি করে আনার খবরটা সেখান থেকে বাবার কানে গিয়ে পৌঁছবে না অন্তত, ভাবল সে। কয়েকদিন ধরে মেয়েটি তার দুর্ভাগ্যের কথা ভেঙে কাটিয়ে দিল। তারপর একদিন সে কনস্ট্যান্টের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারল না। আগের মত সে তার ভাগ্যকে মেনে নেয় নতুন ভাবে কনস্ট্যান্টের সঙ্গে আনন্দে মেতে উঠল। ডিউকের কথা ভুলেই গেল সে একদিন। কিন্তু মেয়েটির নতুন জীবন, ঘর সংসার বেশীদিন স্থায়ী হল না আগের মতন। ভাগ্যদেবী আবার তার ওপর অপ্রসন্ন হলেন। , আবার সে হাত বদল হল, অন্য এক পুরুষের উপভোগের সামগ্রী হল সে। তারপর একে একে আরো অনেক পুরুষের হাত বদল হতে হল তাকে। তার দেহ নিয়ে অনেক পুরুষই ছিনিমিনি খেলল তারপর। সুন্দরী হওয়ার অভিশাপ যে কি, মেয়েটি বাস্তবে সেটা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করল। বারবার সেই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি না করে মেয়েটির ভাগ্যবিড়ম্বিত জীবনের একেবারে শেষ অধ্যায়ে আমি আপনাদের নিয়ে যাচ্ছি। এই বলে প্যানফিলল আবার বলতে শুরু করল। সাইপ্রাসের সতদানার প্রথমে তাকে বোনের মতো গ্রহণ করল তার দুঃখের কাহিনী শুনে। কিন্তু জাহাজে পাড়ি দিতে গিয়ে তার কেবিনে মেয়েটিকে একদিন নিভৃতে পেয়ে তার রূপ আর যৌবন দেখে ভাইবোনের সম্পর্ক আর টেনে নিয়ে যেতে পারল না। তার সব ধৈর্য ভেঙে রেণু রেণু হয়ে ভেঙে পড়ল। আর মেয়েটিও বহুদিন পুরুষ সঙ্গ না পেয়ে হাঁফিয়ে উঠেছিল। বলতে গেলে একরকম। স্বেচ্ছায় সে তার কাছে ধরা দিয়ে ফেলল। তারপর একদিন সাইপ্রাসের বন্দর প্যাফোসে নামল স্বামী-স্ত্রী হিসেবে।

একদিন প্যাফোসে অ্যান্টিগোনা নামে এক বয়স্ক লোক এল। মেয়েটির বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল সে একদিন। তখন সাইপ্রাসের সেই সতদানার বাড়িতে ছিল না। ব্যবসার কাজে আরমিনিয়ায় গিয়েছিল সে তখন। মেয়েটিকে জানালার সামনে দেখতে পেয়ে অ্যান্টিগোনা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার মনে হল, কোথায় যেন সে দেখেছে মেয়েটিকে। ঠিক ওর মতন সুন্দরী মেয়ে, তার মুখটা মনে আছে, কিন্তু পরিচয়টা ঠিক খেয়াল করতে পারছিল না সে। মেয়েটিও তাকে দেখে ভাবছিল, আলেকজান্দ্রিয়ায় লোকটাকে দেখে থাকবে সে, বাবার কাছে লোকটা এসেছিল কোনো একটা কাজে। লোকটাকে দেখে কেন জানি তার মনে হল সে বোধহয় তার বাড়ি ফেরার পরামর্শ দিতে পারে; লোকটার সাহায্যে তার দুঃখের অবসান হতে পারে। মেয়েটি তার একজন পরিচারিকাকে পাঠিয়ে লোকটিকে ডেকে পাঠাল, লোকটি তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল আপনাকে ফেমাষ্টার অ্যান্টিগোনা বলে মনে করলে আমি কি ভুল করব?

“না”, অ্যান্টিগোনা চটজলদি উত্তর দিল, “বিন্দুমাত্র নয়। আমিও ভাবছিলাম, তোমাকে কোথায় যেন দেখেছি। কিন্তু এখন তোমার নামটা খেয়াল করতে পারছি না। কি তোমার পরিচয় বল তো?”  মেয়েটি এবার নিশ্চিত হল, এই মানুষটিকেই সে খুঁজছিল। তার দু’চোখের কোল বেয়ে অশ্রুর বাদল নামল। দুহাত দিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরে মেয়েটি এবার ডুকরে কেঁদে উঠল। অ্যান্টিগোনোর বুক থেকে অশ্রুসিক্ত মুখ তুলে এক সময় মেয়েটি তাকে জিজ্ঞেস করল, আপনি আমাকে কখনো আলেকজান্দ্রিয়ায় দেখেন নি।? | অ্যান্টিগোনা এবার তাকে চিনতে পারলসুলতানের মেয়ে আলটিয়েল সে। কিন্তু আলেকজান্দ্রিয়ার সবাই জানে সুলতানের সুন্দরী কন্যা সমুদ্রে জাহাজডুবি হয়ে মারা গেছে। অ্যান্টিগোনা তাকে খবর দিল, “মিশরের সমস্ত লোক জানে, তুমি সমুদ্রে ডুবে মারা গেছ। বহু বছর তোমার কোনো খবর না পেয়ে তাদের সেই ধারণাটা আরো বদ্ধমূল হয়ে গেছে।”

“তাদের ধারণা ঠিকই। কিন্তু তারা তো জানে না, কি ভয়ঙ্কর দুর্বিষহ জীবন আমাকে কাটাতে হয়েছে।

তুমি যদি কিছু মনে না কর, এই দীর্ঘ কয়েক বছর তুমি কিভাবে কাটালে বলবে?’ অ্যান্টিগোনা জিজ্ঞেস করল।

অ্যান্টিগোনা’, আলটিয়েল উত্তরে বলল, আপনাকে দেখেই কেন জানি না আমার মনে হয়েছিল, আমি যেন আমার নিজের বাবাকে দেখছি। অনেকদিন থেকে আমি আমার প্রিয়জনকে খুঁজছিলাম, যাকে আমার জীবনের দুঃখের কাহিনী বলা যেতে পারে, যা আমি এর আগে কাউকে বলিনি, মানে বলতে পারি নি। হ্যা, আপনাকেই সে সব কথা বলা যায়। সব শোনার পর যদি মনে করেন, আমি আবার আগের জীবনে ফিরে যেতে পারব। আর যদি মনে করেন, তা সম্ভব নয়, তাহলে আপনাকে অনুরোধ করছি, কাউকে বলবেন না, আমার সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল, আমার সম্পর্কে কোন কথা আপনি শুনেছেন।”

মেয়েটি তার দুঃখের কাহিনী এক এক করে সব বলে গেল, কোনো কিছুই বাদ দিল না। কিন্তু অ্যান্টিগোনা ভাবল, এ কাহিনী শুনলে, সুলতান কিংবা আলগারভ-এর রাজা তাকে তার স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে পারে না। তাই অ্যান্টিগোমা তখন মেয়েটিকে পরামর্শ দিল, সে যেন তার জীবনের তিক্ত ঘটনার কথা গোপন রেখে সৎ জীবনযাপনের গল্প ফেঁদে বসে। এরপর অ্যান্টিগোনা আলেকজান্দ্রিয়ায় ফিরে গিয়ে সুলতানের সঙ্গে দেখা করে তার মেয়ের বেঁচে থাকার খবর দিতেই তিনি আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে তখুনি লোক লস্কর পাঠালেন মেয়েকে দেশে ফিরিয়ে আনার। আলাটিয়েলের দুঃখের জীবন তখন শেষ হয়ে এসেছিল। সুলতান তখন আলগারভ-এর রাজার কাছে চিঠি লিখে তার মেয়ের সাময়িক বিপর্যয়ের কথা জানিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কি তখনো তার মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি আছেন? আলগারভ-এর রাজা-খুশি হয়ে সঙ্গে সঙ্গে লোক লস্কর পাঠিয়ে আলটিয়েলকে তার দেশে আনতে পাঠালেন। মেয়েটি অতঃপর আটজন পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হওয়ার পর কুমারী মেয়ে হিসেবেই তার সত্যিকারের স্বামীর ঘর করতে আলাগারভ-এ চলল। বহু বছর ধরে মেয়েটি সুখে দিন কাটাল আলগারভ-এর রাজার রানি হয়ে। এর থেকেই বোঝা যায়, চাদের কলঙ্ক আছে, কিন্তু তাই বলে চাদ তো তার সৌন্দর্য হারায়নি?”

Leave a Reply