……রথ মন্দির প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে বিবিধ বাদ্যযন্ত্র একসঙ্গে বেজে উঠল। পুরনারীরা উলু ও শঙ্খধ্বনি দিল। যুবরাজ ভদ্র এবং মন্ত্রীবর সুবীর দুজনে দশরথকে সাদরে অভ্যর্থনা করল। জনতা জয়ধ্বনি দিল। সকলের সঙ্গে দশরথ মন্দিরে প্রবেশ করল। অমনি সুগন্ধী পুষ্প বলয়ে সজ্জিতা একদল নৃত্য পটীয়সী যৌবনবতী দেবদাসী মরালীর মতাে ভেসে ভেসে এল নাটমঞ্চে। প্রস্ফুটিত ফুলের মতাে সজীব এই সুযৌবনা দেবদাসীরা তাদের যৌবনপুষ্ট দেহের লীলায়িত বিন্যাসে বিচিত্রমুদ্রা বচনা করে নাচতে লাগল। নাচছিল পাগলের মতাে। সমুদ্রে ঢেউয়ের মতাে দুলছিল তাদের দেহ। বিদ্যুতে রেখার মতাে তাদের আঁখিকোণে কটাক্ষ মুর্মুহু ঝলক দিচ্ছিল। রঙিন কাঁচুলির আড়ালে দুটি বক্ষ গােলক উত্তেজনায় অধৈর্য হয়ে ঘন ঘন কাঁপছিল। ললনারা চক্রকারে পাক দিতে দিতে উল্কার মতাে ছুটে গেল দেব বিগ্রহের দিকে। নাটমঞ্চ থেকে দেখা যাচ্ছিল কাঞ্চনময় মঞ্চে রক্ষিত হর পার্বতীর অনুপম যুগল শিলামুর্তি। নর্তকীরা সকলে একসঙ্গে হরপার্বতীর পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়ল। শ্বেতপাথরের বেদীর উপর মাথা রেখে তারা আকুল হয়ে নিজেকে নিবেদন করল!…..
…..দশরথের চোখের তারায় তখনও অনাস্বাদিতপূর্ব সুখানুভূতির আবেশ। মৃদগতি মরালীর মতাে সামনে এসে দাঁড়াল কেকয় রাজকন্যা কৈকেয়ী। কৈকেয়ী গৌরবর্ণা। প্রতিমার মতাে নিখুত মুখ। ছােট কপাল তার চমৎকার। থােকায় থােকায় নেমে আসা চুল কোমর পর্যন্ত। পাহাড়ের গা বেয়ে গড়িয়ে পড়া ঝর্নার মতাে অবিন্যস্ত তার কেশদাম। মসৃণ ত্বক, চোখা নাক, খাসা চোখ। নীলকান্ত মণির মতাে চোখের তারা দুটি। পল্লবঘন চোখ দুটি সরােবরের মতাে স্থির, শান্ত। অগাধ ও গভীর। কি গভীর অনুভূতি মাখানাে চাহনি। ঘুম ঘুম আবেশে বিভাের। বর্তুলকার চিবুক, বিম্বফল সদৃশ ঠোট, মুক্তার মতাে ঝকঝকে দাঁত, ঝিনুকের মতাে কান, মরালের মতাে গ্রীবা, শঙ্খের মতাে পয়ােধর। যাকিছু রমণীয় এবং সুন্দর ঈশ্বর যেন উজাড় করে দিয়ে অনুপমা করে গড়েছেন তাকে!
দশরথ স্তব্ধ। চোখের পলক পড়ে না তার। চোখ দুটো খাদ্যোতের মতাে জ্বলে। কৈকেয়ীর উদগ্র যৌবন যেন মরীচিকার মতাে জুল জুল করে জুলছিল। তৃষ্ণার্ত পথিকের মতাে আকণ্ঠ তৃষ্ণা নিয়ে লুব্ধ দৃষ্টিতে দশরথ তার দিকে চেয়েছিল।
কৈকেয়ীর বর্ণাঢ্য পােশাক আর ঝকমকে অলঙ্কার শােভিত তনু বহুমূল্যের রত্নখচিত হাল্কা নীল শাড়ির সঙ্গে মানিয়ে গেছে চমৎকার। নীবিবন্ধ থেকে পা পর্যন্ত কাপড়ের কুঁচি উরুর দুইদিকে সমান ভাবে পাটে পাটে থাকে থাকে নিচ পর্যন্ত নেমে গেছে। কোমরের উর্বভাগে চুমকির কাচুলি ছাড়া আর কোন আবরণ নেই। বিমুগ্ধ পুরুষের দৃষ্টি থেকে কমনীয় উধ্বাঙ্গকে ঢেকে রাখার কোন সামাজিক অনুশাসন উপজাতি সমাজে নেই। রাজকন্যা হলেও উপজাতি সমাজের রীতি তাকেও মানতে হয়। অলঙ্কার প্রিয় উপজাতি রমণীর মতাে কৈকেয়ীও তার তন্বী সুঠাম অবয়ব সাজিয়ে তুলেছে বিবিধ স্বর্ণালঙ্কারে। ঝিনুকের মতাে দুটি কানে মুক্তোর ঝুমকো, চন্দ্রশােভার মতাে ললাটে টায়রা, বল্লরীর মতাে ভুজদ্বয়ে কঙ্কন, বলয়, পদ্মনালের মতাে কণ্ঠে হারের লহর। মেঘবরন কুন্তলে থােকা থােকা সুগন্ধী পুষ্পগুচ্ছর সঙ্গে সােনার কাটা আর চিরুনী। সব অলঙ্কারে সােনার উপর জড়ােয়া কাজ। চুনির পাশে পান্না, পীতাভ পােখরাজ আর হীরে, মােতি জহরৎ মিশে রঙের ইন্দ্রধনু সৃষ্টি করেছে। ফুল্লপয়ােধরের পীতবর্ণ রেশমীর কাচুলিতে মরকতের গায়ে সােনা আর পদ্মরাগ মণি জুল জুল করে জ্বলছে। রূপ নয় রূপের আগুন। সে আগুনে পুরুষের মন পােড়ে, দেহ জ্বলে।…..
…..মনের ভেতর ডুব দিয়ে কি যেন ভাবছিল তন্ময় হয়ে। তার এই আকস্মিক আশ্চর্য পরিবর্তন অশ্বপতিকে অবাক করল। নাটমঞ্চে রূপধন্যা সুযৌবনা, দেবদাসীদের দেখা থেকেই মহামান্য অতিথির চোখের চাহনি বদল হতে দেখেছেন তিনি। কিন্তু দশরথের চিত্তবিনােদনের জন্য এরকম হাজার রমণী অযযাধ্যায় প্রতিদিন তার সেবায় নিযুক্ত। ললনাপ্রিয় দশরথের নিজস্ব প্রমােদকক্ষে এরকম আকর্ষণীয় রূপরম্যা, লাস্যময়ী তরুণীর অভাব নেই। অনাবরণ দেহের অপরিসীম সৌন্দর্যে ভরপুর যৌবন চিহ্নগুলি উন্মুক্ত করে রাজার সম্মুখে নৃত্য করে তারা। সে নৃত্য আরাে উত্তেজক, আরাে চিত্তবিভ্রমকারী। প্রমােণ গৃহের ঝাড় বাতির আলােয় তাদের অনাবৃত আশ্চর্য যৌবনশ্রী অগ্নিশিখার মতাে জুলে। কামনালালসা লেলিহান শিখার মতাে লকলক করে তাদের সর্বাঙ্গে। উষ্ণ জলের স্রোতের মতাে তরলিত কামনা মােমের মতাে গলে গলে পড়ে রক্তে। সুতরাং এ উত্তেজনা, আনন্দ, রােমাঞ্চ দশরথের কাছে নতুন কিছু নয়। এসবে তার মন অভিভূত হলেও হৃদয় বিকল হওয়ার কথা নয়। এসব একঘেয়ে আনন্দ উপভােগের মধ্যে কোন চমৎকারিত্ব নেই। তাহলে দশরথ অন্যমনস্ক কেন? কি হয়েছে তার?……
…..দশরথ চুপি চুপি তার শয্যা থেকে উঠল। পায়ে পায়ে কৌশল্যার কক্ষের সামনে দাঁড়াল। বন্ধ দরজায় হাত দিতে খুলে গেল। পা টিপে টিপে কক্ষে ঢুকল। কৌশল্যার পালঙ্কের উপর বসল। নিদ্রিত কৌশল্যাকে অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। পরিধানের স্বচ্ছ পাতলা বসন নিদ্রার মধ্যে এলােমেলাে ও বিস্ত হয়েছিল। আর তার আড়ালে অবারিত হয়েছিল বক্ষবাসের আবরণমুক্ত কোমল, নরম সুডৌল মসৃণ দুটি স্তনভাণ্ড, গুরুনিতম্বে অস্পষ্ট ছায়াভাস এবং কটিতলেব উলংগ জঙ্ঘা। খর যৌবনবতী সেই অনিবৰ্চনীয় অনাবৃত সৌন্দর্যেব দিকে লুব্ধ দৃষ্টি কামনায় আবিল হয়ে উঠল। আর গলা মােমের মত তরল স্রোত তার মেরুদণ্ড দিয়ে বইতে লাগল। নিদারুণ উত্তেজনায় দেহমন তার বিবশ হয়ে গেল। রাত্রির সেই মধ্যযামের নিথর নিস্তব্ধতার ভেতর চুপ করে বসে থাকতে থাকতে তার সারা অঙ্গে লাগল কামনার জোয়ার। নদীতটের মত পড়ে থাকা শরীরটা উপর ঢেউর মত ঝাপিয়ে পড়ে দলাই মালাই করতে ইচ্ছে হল। নদী হয়ে তার দেহে মিশে যেতে ইচ্ছে করল। কিন্তু পারল না দশরথ।
তুষারাবৃত পাহাড়ের মতাে হিমশীতল আর কঠিন তার দেহ। কেবল আঙ্গুলগুলাে লব্ধ আর মত্ত হয়ে উঠল। পরম আদরে তার বুকে আলতাে করে হাত বােলাল।
নিদ্রিত কৌশল্যার স্নায়ুতে তরঙ্গায়িত হয়ে গেল তার শিহরন। অমনি কৌশল্যা চমকাল। চোখ খুলল! ধড়ফড় করে উঠে বসল ফেননিৰ কোমল শয্যায়। সদ্য ঘুমভাঙা দুই চোখে তখনও একটা আতঙ্ক, উদ্বেগ জড়িয়ে ছিল। বিভ্রান্ত বিস্ময়ে ভুরু, কোঁচকাল। এক অব্যক্ত বিরক্তি, ক্রোধ, ঘৃণা, বিতৃষ্ণা দশরথকে দেখেই যেন থমকে গেল। অবাক চোখ অবান্তর করে সে দশরথের দিকে তাকাল। ঠোটে তার ধরা পড়ে যাওয়ার গ্লানিকর লজ্জার আভাস। তার সমগ্র অভিব্যক্তিতে একটি ভীরু অপরাধবােধের আর্তি যেন মার্জনা চাইছিল। কিন্তু তাতেই চল্লিশ বছরের দশরথকে এত সুন্দর লাগছিল যে তাতে ত্রিশ বছরের কৌশল্যার রক্ত থরথরিয়ে উঠল। মুহূর্তে কৌশল্যাকে অন্যরকম লাগল। প্রগাঢ় প্রেমানুভূতির তীব্রতায় জ্বল জ্বল করছিল বয়স্ক দুটি চোখ। দশরথের বুকের খুব নিকটে দাঁড়িয়ে কৌশল্যার বিস্ময়মাথিত স্বর ধ্বনিত হল : তুমি! এত রাতে!….
….কৌশল্যার মুখে যেন ঝড়ের ঝাপ্টা লাগল। তার দৃষ্টি আচমকা আঘাতে বেদনাহত। হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল সে। কৌশল্যার আঁচল বুক থেকে খসে পড়ল। কাঁচুলিতে ফিতের ফাস ছিল না। মুক্ত বক্ষের মসৃণ চিক্কণ ত্বক দেখা যাচ্ছিল। কৌশল্যা আঁচল টেনে বুক ঢাকল না। খােলা বুকের উপর দশরথের দুই চোখ জুলছিল।
দশরথের কথায় কৌশল্যা চমকে উঠল। জিজ্ঞাসানিবিড় দৃষ্টি মেলে দশরথের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইল। দৃষ্টিতে নির্বাক জিজ্ঞাসা। সন্তানােৎপাদনের শক্তি দশরথ রাতারাতি পেল কোথা থেকে? ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকরা একবাক্যে বলেছে বয়ঃসন্ধিক্ষণ থেকে অতিরিক্ত রমণী সম্ভোগের ফলেই তার প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট হয়েছে। হৃত প্রজনন ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের কোন সম্ভাবনাই তার নেই। এই সংবাদ দশরথকে আরাে অসংযমী ও স্বেচ্ছাচারী করল। সন্তান বাসনায় শুদ্র, বৈশ্য, ক্ষত্রিয় অসংখ্য রমণীর পাণিগ্রহণ করল। রাজ-অন্তঃপুর দশরথের শত শত স্ত্রীতে পূর্ণ হল। তবু কোন মহিযী প্রত্যাশা পূরণ করতে পারল না। পুরুষত্বহীনতার লজ্জা, গ্লানি ও পরিতাপের কষ্ট এড়াতে সে নতুন মহিষীদের ছায়া মাড়াত না। তাদের কক্ষেও যেত না। কৌশল্যার কাছে আসতে কেবল লজ্জা ছিল না তার। অকপটে নিজের মনকে একমাত্র তার কাছেই উন্মুক্ত করতে পারত। আর তাতেই কৌশল্যার দশরথকে নিবিড় করে পাওয়ার সাধ মিটত। তাতে ফাক-ফাকি যাই থাকুক অন্যদের সঙ্গে নিজের অবস্থা তুলনা করে কৌশল্যা গর্ব অনুভব করত। নিজেকে তার ভাগ্যবতী মনে হত। বিজয়ীর গর্ব ও সুখে মন ভরে থাকত। কিন্তু সেই সুখ ও আনন্দ থেকে হঠাৎ বঞ্চিত হওয়ার অসহায় কষ্টকর অবস্থা কৌশল্যার বুকের ভেতর নারী মনের জটিল জিজ্ঞাসায় আর দ্বন্দ্বে আবর্তিত হতে লাগল। দশরথের দ্বিধাহীন স্বরের প্রতিটি শব্দেব মধ্যে এবং আমূল পােথিত রক্তের মধ্যে পুরুষের আকাঙ্ক্ষা এবং দাবির বলিষ্ঠ প্রার্থনা শুনল কৌশল্যা। সহসা চমক খেয়ে প্রশ্ন করল • তার মানে ? | দশরথের মুখে হাসি হাসি ভাব। মিষ্টি কৌতুকে কাপছিল ঠোট। বলল : তার মানে যা হয় তাই| তৎক্ষণাৎ একটা মুগ্ধ মুহূর্ত, তীক্ষ্ম বিদ্ধ সন্দেহের মধ্য দিয়ে, অনুরাগ বিরাগ, মান-অভিমান ভাসিয়ে দিয়ে শরীরী মত্ত আবেগের পূর্ণতায় উদ্ভাসিত হল চিত্ত। সুখানুভূতির আবেশে বিহুল হল শরীর। সত্তার শূন্যতা পূরণের জন্য শরীরের প্রতি কোষে যে এত উল্লাস ও যাতনা লুকিয়ে থাকে কৌশল্যা এত বয়সও জানতে পারেনি। হঠাৎ তাই বদলে গেল তার অভিব্যক্তি। চোখের চাহনিতে এখন তার সন্ধি স্থাপনের আর্তি। একমাত্র গর্ভস্থ সন্তান পরে দুটি উন্মুখ বিচ্ছিন্ন সত্তাকে এক করতে। কিন্তু দশরথের পুত্রোৎপাদনের ক্ষমতা কোথায় ? অক্ষম পুরুষাঙ্গ চাঙ্গা হবে কোন মন্ত্রবলে ?…..
….সরযূতীরে নবনির্মিত প্রাসা কৌশল্যা চলে গেলে দশরথ পায়ে পায়ে কৈকেয়ীর কক্ষে এল। স্বহস্তে কেশবিন্যাসে ব্যস্ত তখন সে। অসময়ে দশরথে অকস্মিক আগমন তাকে অবাক করল। দশরথের চোখ মুখে কেমন একটা উদ্ভ্রান্ত ভাব। বােবা দৃষ্টিতে অশান্ত-অস্থিরতা। কৈকেয়ীর উৎকণ্ঠা তীব্র হল। দশরথের চোখে চোখ রাখল। বিস্ময়ে ভুরু কোচকাল। বুকের কাপড় স্তনের ওপর টেনে দিতে দিতে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।…..