এসো আরও কাছে এসো, দূরে দাঁড়িয়ে কেন?
— না মানে, আজ —
— আজ কি?
— আজ থাক।
গলার স্বর কেমন মিনমিনিয়ে ওঠে। ঢোক গিলে নিতে হয়। মাথা নীচু করে পিছু ফিরতেই সে হাত টেনে ধরে। চোখে জ্বলন্ত আগুন। সমস্ত কিছু পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে চায়।
সম্মোহনে নিজের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এক দুর্দান্ত নেশাচ্ছন্নতায় সমস্ত শরীর অবশ হয়ে যায়।
ও চোখে নেশা আছে। ওই শরীরের মোহে পৃথিবীর সমস্ত হিংস্র জন্তুও পোষ্য হয়ে যেতে পারে। ওই হাত একবার স্পর্শ করলে চিরকালের মতো বাঁধনহীন বেড়ি পরা হয়ে যায়। তখন মুক্তির জন্যে প্রাণ ছটফট করে।
ঘরের জানলাগুলি বন্ধই ছিল। দরজাতেও ছিটকিনি লেগে গেলো। একটা সাপ যেন নাগিনবীণের সুরে টলতে টলতে খোলস ছেড়ে দিল। তার লকলকে জিভ আরও লোভাতুর হয়ে ওঠে। একটা নিস্তেজ শরীরের মাথা থেকে পা
জাদুকাঠি ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে জাগ্রত করার তপস্যায় মগ্ন।
— আমাকে আর মনে ধরছে না বুঝি। ঠোঁটে ঠোঁট রেখে কথাগুলি আছড়ে পড়ে।
– উফ আজও সেভিং করোনি! কাল কতবার বলেছি তোমায় যে সেভিং করে আসবে, মনে ছিল না?
নিরুত্তর।
—- টোটনের বাবা বাড়ি আসছে দুদিন পর। তখন কিন্তু তোমায় একজন ভালো মাস্টারমশাইয়ের অভিনয় করতে হবে। কষ্ট হবে নাতো সোনা তোমার আমায় না পেলে?
কথাগুলো কেমন বিষাক্ত তীরের মতো কানে বিধছিল। চোখ বন্ধ করে রাখতে হয় যাতে অন্তত বিষধরকে না দেখতে হয়। কষ্ট হবে কেন, এতো সহজ মুক্তির উপায়। কিছুতেই যে নাগপাশ থেকে মুক্ত হওয়া যাচ্ছিল না যাকে প্রতিটি মূহুর্ত দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করে।
নিস্তেজ শরীর খুশিতে সতেজ হয়ে ওঠে। মুক্তপ্রাণ সকল শিকলের বাঁধন চূর্ণ করতে উগ্রমূর্তির রূপ নেয়। খুশির তেজে হাতের কাছে পাওয়া দুটি নরম তুলতুলে মাংসপিন্ড বৃন্ত থেকে ছিন্ন করার উদগ্র বাসনা জাগে। — আঃ আস্তে, কি করছ কি? ক্ষেপে গেছো নাকি?
আবারো নিরুত্তর। শুধু এক গোঁ ধরে নাগিনীর নগ্ন শরীর খুবলে খুবলে খাওয়া, বিষ উদগারণের প্রয়াস। নগ্নতায় সৌন্দর্য বলে কিছু থাকে না। অনুন্মুক্ত নারীশরীরে রাতে খোলা আকাশের নীচে ঘাসের উপর শুয়ে থাকার অনুভব পাওয়া যায়। সেই আকাশের গভীরে ডুবে যেতে ইচ্ছে করে। আর তা সম্পূর্ণ উন্মুক্ত হলেই চোখে দূরবীণ লেগে যায়। তখন রাতের আকাশে চাঁদের খুবসুরতি নয় বরং তার প্রকান্ড গহ্বরগুলিই চোখে পড়ে।
তবু শরীরে আগুন জ্বলে। তা নেভেও। কিছু ছাই ফেলে রেখে বাথরুমে চলে যেতে হয়। আয়নাতে নিজের কালশিরে পড়া শুকনো মুখটা দেখে চমকে যেতে হয়।
আর সেই চমকেই ঘুম ভেঙে যায় শ্যামলের। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে বিছানায়। গলাটা শুকিয়ে গেছে। বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস পড়ে। ইস্ প্যান্টটা ভিজে গেছে। দিনের বেলায় বীর্যপাত হলে শরীরে কেমন ম্যাজম্যাজে আর ক্লান্তিভাব চলে আসে। একবার স্নান করে নিতে হবে।
ঘড়িতে বিকেল পাঁচটা। শ্যামল উঠে পড়ল।
আধঘন্টা পরে স্নান সেরে গলা দিয়ে একটা টিশার্ট গলিয়ে শ্যামল বেরিয়ে পড়ল। টোটনরা থাকে সিদ্ধেশ্বরীতলায় মহুয়া কমপ্লেক্সের সেকেন্ড ফ্লোরে। তাকেই প্রতি সন্ধ্যায় টিউশন পড়াতে যেতে হয়। পড়ানো তো ছাই, কিছুক্ষণ আগে দেখা দিবাস্বপ্নটাই প্রতি সন্ধ্যায় সত্যি হয়ে ওঠে। প্রথম প্রথম ভালো লাগলেও এখন এসবে তাঁর গা গুলিয়ে ওঠে। একটা অপরাধবোধ প্রতিনিয়ত তাঁর বিবেককে নাড়া দিয়ে যায়। তবু এ নেশা থেকে কিছুতেই সে মুক্ত হতে পারে না। চুর্ণির ওপারে রানাঘাটের সিদ্ধেশ্বরীতলা। ওপারে যাওয়ার জন্যে দুটি ব্রীজ আছে। বড়ো ব্রীজ আর ছোট ব্রীজ। বড়ো ব্রীজ জাতীয় সড়কের সাথে যুক্ত আর পায়ে চলা মানুষের জন্যে ঝুলন্ত ছোটব্রীজ।
ব্রীজের উপর থেকে আজ চূর্ণির জল বড়ো ঘোলাটে মনে হল। শ্যামলের মনে পড়ে সেদিনের কথা যেদিন পাড়ে পাড়ে সাইকেল চালিয়ে সঙ্গম দেখতে গিয়েছিল।
চূর্ণি গঙ্গা ভাগিরথীর উপনদী। মানে রানাঘাট থেকে কিছুটা দূরে গোঁসাইচর গ্রামের কাছে দুটি নদী মিলিত হয়েছে। চূর্ণির জল কুচকুচে কালো আর গঙ্গার হলদে সঙ্গম যেন ঘোলাটে। রাধাকৃষ্ণের যুগলমিলন। শ্যামল স্বগতোক্তি করে উঠেছিল, আহা দেখিলাম! জন্মজন্মান্তরেও কি ভুলিব না।
পাশ থেকে একটি মেয়ে মুচকি হেসে ওঠে।
শ্যামল অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। মন্তব্যটি যে মেয়েটির প্রতি করেনি সেকথা কিভাবে বোঝাবে।
ব্ৰীজ পার পালচৌধুরি স্কুলের পাশ দিয়ে যেতে যেতে শ্যামল চেয়ে দেখল তাঁরই বয়সি দুটি ছেলেমেয়ে একসাথে হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে।
কী সহজ সরল সাবলীল। বিকেলের কনে দেখা আলোয় দুজনের এই পাশাপাশি পথ চলা — সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে সাতরাজার ধন যেন ওরাই আয়ত্ত করেছে। শ্যামলের বুকের বাঁদিকে চিনচিনে ব্যথা শুরু হল। অনেক সময় বৃহৎ পাওয়ার চেয়ে ক্ষুদ্র চাওয়ার মাঝেই মানুষের জীবনীশক্তি অমৃতসুধার আস্বাদ লাভ করে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। কলিংবেলে হাত দিতে গিয়ে একমূহুর্ত থমকে দাঁড়াল শ্যামল। ভিতরে তো সেই একই গদি বিছানা, নীল বাতি, উত্তপ্ত শ্বাসের উত্থান পতন, এক বুভুক্ষু নারীর কামনার আবেদন, শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে হিসহিস। শ্যামলের মনে হল সে দিনদিন ক্ষয় হতে হতে এক দূষিত বর্জ্য পদার্থে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। শ্যামল ঘুরে দাঁড়াল।
তখনি দরজা খুলে গেল। পরিচিত নারীকণ্ঠ বলে উঠল,
‘এসো, বাইরে দাঁড়িয়ে কেন? ভিতরে এসো, তোমার অপেক্ষাতেই তো ছিলাম।’
শ্যামলের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। না, ওদিকে আর দেখবে না। চোখে জাদু নিশি ডাক আছে। ধীরে ধীরে এক একটি অস্থির পদক্ষেপ ফেলে সিঁড়ি বেয়ে সে নীচে নামতে লাগল। ওপ্রান্ত থেকে কেমন হতচকিত কণ্ঠধ্বনি ভেসে এলো, শ্যামল কোথায় যাচ্ছো? কি হল তোমার? শ্যামলের বুকটা আবার ধড়াস করে উঠল। না তবু ফিরবে না সে। জোরে আরও জোরে পা ফেলে সে রাস্তায় এসে উঠল। একটা লম্বা শ্বাস নিল। আহ বাতাসটা বড়ো বিশুদ্ধ মনে হচ্ছে। শ্যামলের বুক থেকে যেন দশমণ ওজনের একটা পাথরের বোঝা নেমে গেল। বড্ড হালকা লাগছে। যেমনটা নগরদোলায় চড়লে উপর থেকে নীচে নামার সময় মনে হয়।
শ্যামল রাস্তার মাঝ বরাবর হাঁটছিল। পিছন থেকে একটি স্কুটি বারবার হর্ন দিচ্ছিল।
ওর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। হঠাৎই স্কুটিটি পিছন থেকে জোরে ধাক্কা মারে। শ্যামল হুবড়ে গিয়ে পড়ে রাস্তার পাশের পানের দোকানের উপর। কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে। স্কুটিশুদ্ধ চালকও রাস্তার ভাঙা অংশে জমে থাকা কাদাজলের উপর ধপাস করে পড়ে। লোকজন রে রে করে ছুটে আসে উদ্ধারের জন্যে। শ্যামল চুপটি করে ভিড়ের ভিতর থেকে উফ দোকানের দরজায় কপালটা জোরে ঠুকে গেছে। ফলে লাল হয়ে আছে। সন্ধে হয়ে আসছে।
চারিদিক কেমন ধোঁয়াসাচ্ছন্ন মনে হচ্ছে। সিদ্ধেশ্বরীতলার প্রাচীন কালীমন্দিরে সন্ধ্যারতি শুরু হয়েছে। কাঁসর ঘন্টার আওয়াজ এই লোকজন যাচ্ছে। বড়ো অসহ্য বোধ শোনা ভিড়ভাট্টায় হচ্ছে। চলতে চলতে শ্যামল বড়ো ব্রীজের উপর
এসে পৌঁছাল। খুব একটা এখানটায় লোকজন থাকে না। জাতীয় সড়ক বেয়ে গাড়িগুলি হুসহুস করে বেড়িয়ে শ্যামল নীচের দিকে যাচ্ছে।
তাকাল। চূর্ণির জল কচুরিপানাতে ভরে গেছে। একটি মাছধরা নৌকা কচুরিপানার ভিড় কাটিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে
চলেছে। পাড়ের ইটভাটার চিমনি চূর্ণির থেকে কালো ধোঁয়া ধীরে ধীরে বাতাসে মিশে যাচ্ছে।
শ্যামলের মোবাইল ফোন বেজে উঠল। একটা আননোন নম্বর।
ফোনটা রিসিভ করতে গিয়েই শ্যামলের হাতটা কেঁপে উঠল। আর তখনি হাত ফস্কে ফোনটা উপর থেকে চূর্ণির জলে
পড়ে গেল। ব্রীজটা কেমন অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে। ভূমিকম্প হচ্ছে বোধ হয়। শ্যামল একমূহুর্ত উপর থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর সম্বিৎ ফিরলেই ব্রীজের থেকে প্রাণপণে ছুটতে লাগল।
কিছুদূর গিয়ে ব্রীজটা অতিক্রম করে রাস্তায় উঠেই হোঁচট খেয়ে শ্যামল রাস্তায় মুখ ঘেঁষে পড়ল।
চারিদিকটা কেমন কাঁপছে। শ্যামলের কষ বেয়ে রক্ত গড়াতে লাগল। একবার ওঠার চেষ্টা করতেই তাঁর মাথাটা টলে উঠল।
সে মড়ার মতন চুপ করে পড়ে রইল। তাঁর মনে হল পৃথিবীতে নেমে এসেছে। সমস্তকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে এই আলোড়ণে।
রাতে বাড়ি ফিরলে শ্যামলকে জড়িয়ে ধরে ওঁর মা ডুকরে কেঁদে উঠল। ওঁর চোখেমুখে হাত বোলাতে লাগল।
অনেকদিন এভাবে মায়ের আদর পাইনি। তবু তাঁর আজ মায়ের এত উদ্বিগ্নতার কারণ খুব জানতে ইচ্ছা করল। —কি হয়েছে মা কাঁদছ কেন?
— খবরটা শুনেই তোর বাবাকে পাঠিয়েছি ওখানে। কান্নাভেজা গলায় বলল শ্যামলের মা।
-কিসের খবর? কোথায়?
— তুই যেখানে পড়াতে গিয়েছিলি, সিদ্ধেশ্বরীতলায়
— কিন্তু কেন? আমি তো আজ পড়াতে যাইনি যাসনি? দুগ্গা দুগ্গা ভগবান তোকে রক্ষা করেছেন। শ্যামলের মা হাতজোড় করে কপালে ঠেকালেন।
-কেন মা, কি হয়েছে বলো তো?
— আজকের সিদ্ধেশ্বরীতলার মহুয়া কমপ্লেক্স ভূমিকম্পে একদম ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। বোধ হয় কেউ আর বেঁচে নেই।
শ্যামলের মুখ দিয়ে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ল। আজ অনেকদিন পর মাকে জড়িয়ে ধরে।