আত্মতাড়িতেরা – আবদুল মান্নান সৈয়দ

›› সম্পুর্ণ গল্প  

১৯৬২ সালের ডিসেম্বর মাসের ঠাণ্ডা এক অণ্ডহীন সন্ধের বিরুদ্ধে ধনুকের মতাে ঘাড় বাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, মনে মনে, কেউ দেখলে ভাত পাগল, যদিও আসলে বিখ্যাত সে বাস্তবে; ফুটপাতে নামছে মুহূর্ত, দূরে-কাছে জ্বলে উঠেছে আলাে, উচাটন দোকানে দোকানে, সিনেমার উন্নত ফলকে, বিজ্ঞাপনে। সেই উপস্থিত আলােয় তাকে ফেলে চলে যাচ্ছে রিকশী-ক্ষমাহীন রিকশা, ট্যাক্সি, মােটর, এক মহিলার দ্রুতগামিনী নিতম্ব, বিভিন্ন মুখের মানুষেরা—তার মনে হলাে তারা ম্যাকস বিয়ারম-এর ছবি থেকে হড়হড় বেরিয়ে এসেছে;-প্রস্তরসম জগদ্দল মুখ, পাঁচ ফুটের ছােট্ট বেঁটে মােটা লােকটা ঘড়ির কাঁটার মতাে কম্পমান অগ্রসরমান দু’হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে, এই অনুভবহীন চলচ্চিত্রের সম্মুখে, এত লােকসাধারণ গাড়ি-ঘােড়া বিপদ-আপদ আলাে ছায়া চীৎকারের মধ্যে, বিবেক নামক আচ্ছা এক অপার শয়তানকে চিরকাল যে দমিয়ে রেখেছে ঔদাসীন্য ও অধিকতর পাপকর্ম নামক শাসনে, ছােট্ট একটি পােকার নির্দেশ দাড় করিয়ে রাখলে তাকে ছােট্ট একটি অচেতন পােকা, তার শিশ্ন, শীতে কুঁকড়েননা, আক্রমণের অভাবে এতটুকু। মানুষটা দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে সম্মুখের চলচ্চিত্র দেখছিল প্রখর চক্ষে, অর্থাৎ কিছুই অবলােকন করছিল না; তার মধ্য থেকে এই ঠাণ্ডা অবচেতন কী-জানি-কী সন্ধেয় ঠেলে উঠেছিল কাম; তার মনে পড়ে গিয়েছিল তুমুল এক মেয়ের কথা, আদি সান্দ্র পুরস্কার সেখানে পাওনা, আত্মীয়া সে—নিষিদ্ধ তার সঙ্গে সহবাস, এবং সেজন্যেই অধিকতর কাম্য, এই সহবাস তাকে পাপের সমান আনন্দ দান করবে। এই ভীষণসুন্দর শহরে যত মেয়েলােক আছে, সকলে যদি আজ রাত্রে সহবাসের দাওয়াত করে, আমি যাব প্রত্যাখ্যানে, ঐ মেয়েমানুষটির ন্যূনতম তদন্তে যদি নিযুক্ত হতে পারি। কিন্তু এই অণ্ডহীন সন্ধে আর আসন্ন রাত্রি খারাপ : আজ ভোরবেলা আমার। মন ছিল দেবশিশু-সম, এখন অবিশ্বাস্য পা ফেলেছে চোরা-নদীতে, সন্ধে আমার। শ, আবার বন্ধুও, বন্ধু মানেই তাে শক্র; সে আমার অযাচিত কাম জাগ্রত করেছে যা থেকে আমি এখন মুক্তি চাই না। না, আমি ভাবব না, আমি শরীরের উপর সমস্ত সদুত্তর ছেড়ে দেবাে, আলুলায়িত মনকে আমি সওয়ার করব শরীরের উপর, “আমি মনােহীন হবাে, আমি মনােহীন হবাে। আপন মনে মুণ্ডুহীন হাসল মানুষটা। তিরিশ বছর বয়স অবধি মনােময় শরীরময় সংযম অভ্যাস করেছে, দেহের লেলিহান রত্ন ঠাণ্ডা রেখেছে পরম অধ্যবসায়ে; অতঃপর এক আক্রমণভুক মহিলার সঙ্গে সহবাস ঘটে, স্বর্গের উদ্ভব, অতঃপর কেবলি ক্ষুধাপ্রবণ চীৎকার, ঝাঁপিয়ে পড়ল শনিতেপাওয়া পৃথিবীর মতাে, শরীরের জোড়া জোড়া অঙ্গ তার গভীর মজুরি খেটে গেল। ‘আমি এক শান্তিকাতর শিকারী, অবশ্য নিজেই নীতিপ্রাণ ঈশ্বরের শিকার, তত্রাচ সমস্ত ভুলে গিয়ে মন-হৃদয়-বিবেক, ইত্যাদি, মানুষের যতগুলি অদৃশ্য অহেতুভব শত্রু আছে তাদের দাবিয়ে আমি বাস্তবের ঋণ মিটিয়েছি, আমাকে আমি প্রবৃত্তচালিত শরীরের নিকটে এনেছি। আমি কুকুরে গিয়েছি : আমি মেয়েমানুষে গিয়েছি। কিন্তু এই ঈশ্বর সমেত মেয়েমানুষটি চারি বৎসর ধরে বাঁদরের মতাে নাচাচ্ছে আমাকে, নিকটে এগােতে দিচ্ছে, কিন্তু আদি অতলের চাবি রেখেছে লুকিয়ে। কী খুঁড়ি! কী অবিশ্বাসপ্রবণ হুঁড়ি! যদি আমি ওকে একবার মুষ্টির ভিতরে পাই। যদি ওকে জঘন্যভাবে শাস্তি দিতে পারতুম এই উপদ্র-প্রবণতার জন্য! চমৎকার আকাক্ষার হায় উচ্চতা, বা নিম্নতা, যদি আমাকে কেবলি বিদেশি চাটি মেরে নাযেত । আমি ওর মানদণ্ডহীন স্তনদ্বয়ে দুই অসীম সূচাগ্র ঠুকে ঠুকে যুক্তিবাগীশ হৃৎপিণ্ড ছোঁব, আমি ওর গভীর পরােক্ষে বন্দুকের নল স্থাপন করে অন্ধ ও বধির গুলি করব।’ মুঠি পাকিয়ে মানুষটা অন্যমনস্কতাভরে চলতে লাগল সন্ধে ছ’টার বাস্তবপীড়িত ভিড়ের মধ্য দিয়ে পথ তৈরি করে করে। বদমাশ ভিড় কমে এল এক সময়, পিছনে পড়ে রইল আলােকিত প্রধান জিন্নাহ্ এভিন তার জ্যান্ত কিংবদন্তী ছড়িয়ে। পরিচ্ছন্ন, কূলে-কূলে গাছ একটি রাস্তায় হাঁটতে লাগল সে। কী নির্জন চারিদিক, ঠাণ্ডা জ্যান্ত বাতাস মানুষের মতাে ছুটে যাচ্ছে, গাছপালা, বাড়িঘরের ফাক দিয়ে দেখা গেল ঐ রাস্তায় একটি মােটরকার ইদুরের মতাে চলে গেল, রাতের ও ডিসেম্বরের চুলহীন শান্ত গাছ আপনাপন চরণভরে দাঁড়িয়ে আছে, ল্যাম্পােস্টের মাথায় মাথায় প্রস্তরসম শাদা বাতির নিঃশব্দ হাস্য কালাে পিচের রাস্তার প্রতি, বাস্তবপীড়িত স্বপ্নময় এই রাস্তা, এক বিদেশিনী পার্শ্ববর্তীর পাগল হাতের নিচে পশ্চাদ্দেশ ভীষণরকম পূর্বাপরময় করতে করতে তাকে পেরিয়ে সম্মুখে পরােক্ষে চলে যায়। ‘কী মজা। কী মজা! বিপদ-আপদে! কী মজা ভুলে যাওয়ার পর মনে হওয়ায়! ভুলেই গিয়েছিলুম আজ ও যেতে বলেছে আমাকে!’ প্রসন্নতাভরে তার পায়ের গতি দ্রুত হলাে। কিন্তু বিপদ, এই বিপদ আছে সমস্ত পশুপ্রাণ সুখের মধ্যে, সুখের মধ্যকার ভয়ের মতােই, বিষাদের নমনীয়-বলীয়ান সাঁড়াশিগণ পেয়ে বসল তাকে, কারণ যুক্তিপ্রধান যাতায়াত চিরকাল তাকে এখানে ঘাড় ধরে নামিয়ে আনে। “হুঁড়িটি যে আমাকে বাদরসম নাচাচ্ছে; তার জন্য হুঁড়িটিকেই ঠিক দায়ী করা যায়।

ওর ঘনিষ্ঠেরাই যেন ওকে তদন্তে লাগিয়ে আমাকে মানদণ্ডহীন নাচাচ্ছে। কেননা রক্তের ভিতরে আমি জানি, ঘুড়িটি আমার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছে, অবশ্য ভালােবাসা নিশ্চয় নয়, মেয়েমানুষের চিরকালীন আক্রমণলােভ, উপদ্রলােভ, শাস্তিলােভ। কিন্তু কেবলি বাদ সাধছে হাসির হাড়ে হাড়ে চালিত ওর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়েরা। খুঁড়িটি আমারও নিকটাত্মীয়, রােজ আমি যেতুম ওদের বাড়ি, আলাপ থেকে প্রলাপে গড়াল। কিন্তু যখনই আলাপের ছলে আমার মধ্যে কাম জাগ্রত হয়েছে, দরােজায় দেখেছি তালশাসের মতাে প্রখর ও শান্ত এক জোড়া চোখ, আমার বােনের, আমি তখন বাঁকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে পশ্চাতে লুকিয়ে ফেলেছি নিজেকে। তখন ভেবেছি, কেন আমি লােকচক্ষুর সম্মুখে জানােয়ারশােভন ব্যবহার করতে পারি না, তখন আমি সত্যি প্রার্থনা করেছি যেন একটি জন্ত হয়ে যাই বিশ্বনাথ, আমাকে জন্তু করে দাও, ওদের গৃহপালিত কুকুর নিতান্তপক্ষে, যেন নির্বিবাদে চক্ষুস্থাপন করতে পারি ওর শরীরের যে-কোনাে স্থানে, যেন স্বর্গ থেকে মুষ্টির ভিতরে সুযােগ খশে পড়বে জিহ্বাবিন্যাস করতে পারি ওর শরীরের যেকোনাে স্থানে।’—এইসব অসম্ভব আমার কামনায় একলব্যের প্রকাশ। কিন্তু আত্মীয়েরা মানা তুলে রইল আমাদের দুজনকে আলাদা করে : আমি যখনই আক্ৰমে পেীছেছি, কিংবা হুঁড়িটি, দেখি সব সামাজিক মুখ কুটিল চক্ষে যাতায়াত করছে আমাদের চারিপাশে; ও ভীত হয়েছে, সরে গিয়েছে পশ্চাতে, আমি ভীত হয়েছি, সরে গিয়েছি পশ্চাতে। আজ চারি বৎসর ধরে, একই শহরে থেকে আমরা পরস্পরকে কেবলি কামনা করেছি নিকটে; কিন্তু আদি লেনদেন রয়ে গেল অসম্ভবে, এখনাে। আমি অবশ্য ক্ষুধাভরে অন্যফল ছিড়েছি; হুঁড়িটি অন্যত্র যাতায়াত করছে কিনা জানি না-ড়িটি অন্যত্র গেলেও ওর প্রতি আমার প্রবৃত্তিবাগীশ মনােবিন্যাস ফেরেনি। কী জানে যে ছুড়িগণ : একবার আকর্ষণ তৈরি হলে চারিদিক ভয় দেখালেও শেষাবধি না-দেখে লােকে ফেরে না। পুরুষেরা ভাগ্যচালিত, হুঁড়িগণ ভাগ্যনির্মাতা। আমি অবশ্য ঠিক বুঝতে পারি না : হুঁড়িটিই আমাকে এইমতাে নাচাচ্ছে, না কি ভাগ্যশক্তি? তবে পরিবেশ ও আত্মীয়দেরই আমি দোষ দেবাে : এটা কোনাে আত্মিক সমস্যা নয়, বাহ্যিক ভাগ্যরহস্য। আমার নিজের মধ্যে এই অবৈধ সংগমের আনন্দই বড়, দ্বন্দ্ব নেই, আমি দ্বন্দ্বরহিত, নিজের সঙ্গে কোনাে চক্রবর্তী বিরােধ নেই আমার।’ ভাবনাপ্রবাহ যখন এরকম জটিল পথে চলেছে, লােকটা ঘাড় নিচু করে চলে যাচ্ছিল খণ্ড পত্রিকা মাড়িয়ে রাস্তার উপরকার। এখন সময় এসেছে ভাবনাগুলি সংকলনের, কিন্তু মনে মনে যেইমাত্র সাজাতে বসল সে, অমনি রাস্তার উপর ঝুঁকে-পড়া গাছসকল থেকে কেঁদে উঠল একটি প্যাচা এবং সে দাড়িয়ে পড়ল, শহরের কোনাে পথে এরকম পাচার পাণ্ডিত্য শুনতে পেয়ে নিজের সৌভাগ্য মানলে। চাদের ভালােমানুষ আলােয় পঁাচাটিকে স্পষ্ট দেখতে পেল, “নিশ্চয় এটি হুঁড়ি-পাচা’, চোখ টিপল সে পঁাচাটির চক্ষের প্রতি। পরমুহূর্তে প্যাচাটি আলপিনবিদ্ধ হয়ে পুনর্বার কেঁদে উঠতেই, ভয় পেয়ে কিছুদূর ভাবনারহিত ছুটে গেল, যেখানে রাস্তাটি যেন এই ভীষণ শহরের ভয়ে তারাসকলের দিকে ঢালু হয়ে গেছে নেমে। কিছুক্ষণ সে ভাবনারহিত হয়ে রক্তচালিত হয়ে শ্বেত চাদের নিচে চলতে লাগল। তারপর ঘাের মােড় ফিরে লােকজনের গাড়িঘােড়ার বিপদআপদের দেখা পেলে ফের যেন, এই রাস্তা তার একাকিত্ব থেকে উদ্ধার করল তাকে : মনে মনে এই পরিচয়হীন চলমান লােকসকলকে ধন্যবাদ জানালে—ধন্যবাদ, অপরিচিত লােকসকল! আমি বহুদিন থেকে নিত্য প্রার্থনা করি : আমি মনােহীন হবাে, কিন্তু এক পা-ও বােধহয় অগ্রসর হইনি ঐ পথে। আমি এখনাে ভয়ের অতীত হইনি। নির্জনতা থেকে ছুটে এলাম তাই। কী করে আমি নিজেকে দ্বন্দ্বরহিত মনে করেছিলাম কিছুক্ষণ আগে? যে দ্বন্দ্বরহিত, সে কী এত ভাবনায় ভাসে? মৌল রাস্তাটি এড়িয়ে আমি কোথাও যেতে পারি না; জড়িয়ে আছি চক্রবর্তী অঙ্কের চক্রান্তে—আমার নিজেরই ভিতর থেকে নিঃসৃত। অবশ্য এই অন্তর্গত দ্বন্দ্বের চেয়ে | বড় হয়ে উঠেছে আমার কাম, তাই ভীষণ বাঁচোয়া, আমার সমুদয় বাধা ও ব্যাঘাত মনােলােক থেকে উৎসারিত নয়, বাইরের মানুষ ঘিরে। বাইরের বাধা ও ব্যাঘাত দীর্ঘজীবী হলেও হঠাৎ কোনাে দিন ছােট্ট একটি ছিদ্র, অন্তত সশঙ্কভাবে, পেয়ে যাব | আমি—এই ভেবে আমি নিজেকে চালিয়ে এনেছিলাম বহুমান্য দিবারাত্রির মধ্য দিয়ে। আজই, যদি আমার ভাগ্য চিরাচরিত চাটি না-মারে, হয়তাে সেই সমাজঅসম্মত রাত্রি আসন্ন।’ তখন সে খুশিভরে হাঁটতে লাগল, বড় রাস্তা পশ্চাতে ছেড়ে, ছােট একটি কানাগলির চোখের মধ্য দিয়ে রাজার মতাে। কয়েক দিন আগে খুব অসহায় অবস্থায় পড়ে গিয়েছিলাম ওদের বাড়িতে ওকে একেলা ঘরে দেখে আমি একটু ক্লিন্ন প্রত্যঙ্গ-প্রবণ হয়েছিলাম, আমি ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে প্রত্যঙ্গপ্রহার করছিলাম, আর ও বিপন্ন বিস্ময়ে একদৃষ্টিতে দাঁড়িয়েছিল।’ ঘটনাটি মনে পড়ায় তার কটিতলে তৃতীয় চক্ষু উদ্ভিন্ন হলাে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত হঠাৎ বাড়ির একটি দাসী ঢুকে পড়েছিল ঘরে, আমি পাগলের মতাে দ্রুত সম্ভম টেনে দিলাম, অন্যত্র ও চক্ষুনিবেশ করলে। দাসী চলে গেলে আমাকে ও হাতুড়িসম ধমক বসিয়ে দিলে, আমি হাসতে চেষ্টা করলুম বটে, কিন্তু সেদিন সারাদিন এই হতভাগ্য ঘটনাটি ভুলতে পারলুম না। দাসী দেখেছে কি দ্যাখেনি,—এই জিজ্ঞাসা সমস্ত অনুসঙ্গসমেত কয়েকদিন আমাকে বদমাশ মানুষের মতাে কামিয়ে কামিয়ে খেল—আমি কয়েক দিন পাগলের মতাে আপন প্রত্যঙ্গপ্রহার করে বেড়ালাম। গতকাল রাত্রে যেন ঐ কদিনের ফল প্রসব হলাে : স্বপ্নে আমি দেখলুম, কয়েকজন লােক, তারা হুঁড়িটির আত্মীয়দের, অর্থাৎ আমারও বিকৃত চেহারা ধারণ করেছে। সেই কয়েকজন আমাকে ভুলিয়ে এনে জোর করে আমাকে মাতৃগর্ভে ঢুকিয়ে দিতে চাচ্ছে, আমি কিছুতেই যাব না, কিন্তু সেই কুকড়ােনাে আত্মার অস্বচ্ছ ও পরিবর্তমান লােকসকল আমাকে জোর করে ঢুকিয়ে দিতে চাচ্ছে। আমি আদর্শ টীকার করে উঠলুম, ‘আমাকে কেন ফিরিয়ে দেবে?’ তারা আদর্শ চীৎকার করে, আদিম হাে-হাে হাস্য উড়িয়ে বলছে, “জন্ম, তােমার ভুল জন্ম হয়েছিল। তুমি জননার যােগ্য হওনি। তােমার ভুল জন্মের মালে আমরা ভুগছি। আমাকে ওরা ফেরত করলে। কালাে, বিরাট হাতির মতাে দোতলা একটি বাড়ির সম্মুখে এসে লােকটা দাঁড়িয়ে থাকল। সদ্যোজাতের মতাে দাগ না-পড়া মন নিয়ে; একবার তাকাল উপরে, শহরের পূর্ব আকাশ যেখানে আলােময়, কিছুক্ষণ আগে ঐখানে ঘুরছিল সে, ঐদিকের লম্বা রাতের ও ডিসেম্বরের গাছের গলায় শ্বেত মুদ্রার মতাে আটকে গিয়েছে চাঁদ। দরােজায় কড়া নাড়ল ইদুরের মতাে তার হাত; অন্ধকার সারা বাড়িটায় সেই শব্দে কোনাে প্রতিক্রিয়া হলাে না, শুধু দোতলার একটি কক্ষে হেঁকে উঠল আলাে, সমগ্র বাড়িটির মধ্যে দোতলার একটিমাত্র জানালার চতুষ্কোণ আলােকিত হয়ে উঠতে তার মনে হলাে, যেন কোনাে একচক্ষু শয়তান একটিমাত্র চক্ষে আলাে বিকোচ্ছে আর তারপরই দরােজা খুলে গেল। ছুঁড়িটি। মন নেই, তবু অনেক অবান্তর কথা বলতে হয়। মৃত মানুষের জন্য আগামীকাল নেই, তাই প্রতীক্ষা সয় না। অন্যমনস্কতাভরে কুশলাদি বিনিময়, সরকারের বিরুদ্ধে অননুভূত নালিশ, আদি উত্তেজনাকে আক্রমসম্মত বােরখা পরিয়ে কয়েকবার সিড়ি মাড়িয়ে দোতলায় পাঠিয়ে দিল। এক আত্মীয় মরণের পরােক্ষে গমন করেছেন, উপলক্ষে বাড়ি-শুধু সবাই সেখানে গেছে; লাশ দেখলে ওর ভয় লাগে, তাই যায়নি। কিন্তু আঁধার ভয় লাগে না? ‘একা বাড়িতে ছিলে যে ভয় লাগেনি?’ লােকটি এই গভীর জিজ্ঞাসা নাকরে পারল না। তুমি আসবে জানতুম, তােমাকে তাে আসতে বলেছিলাম।’ লােকটি কিসের মতাে হাসতে চেষ্টা করলে, আমাদের ভাগ্য ভালাে ঃ তুমি আমাকে আসতে বলেছিলে, আর আজই কিনা বাড়িতে কেউ নেই। আচ্ছা, সেদিনের ব্যাপারটির জন্য আমার ভয় লাগে, জানাজানি হয়েছে কি, মেয়েলােকটি সবাইকে বলে দিয়েছে?’ মেয়েটি শুধু কেনা হাসি হাসল-উত্তর বাদে। ‘কেন যে তুই হাসিস, তাের হাসিটি বড় বিশ্রী, দাঁতের উপরের লাল অংশ বিশ্রীভাবে বেরিয়ে চেয়ে থাকে, মেয়েমানুষের যে একটি স্বভাবজ সচেতনতা থাকে, হায়, তা-ও তাের নেই।’ মেয়েটির পশ্চাতে সিড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে লােকটা আপন মনে বলল।উপরে মেয়েটির শােবার ঘরে পৌছে, ওরা বসল। তােমাকে ধন্যবাদ জানাই, “আজকের মৃত হে। তুমি মরে গিয়ে আজ আমাদের দুই বিভিন্নকে সুযােগ করে দিলে মিলিত হবার; মৃত অপরিচিত মানুষ এভাবে সাহায্য করতে পারে জানতুম না; তােমার কুশল প্রার্থনা করতে পারতুম, কিন্তু তুমি বস্তুসকলের অতীতে চলে গেছ, তাই তােমার আত্মা—আত্মা কী, আত্মা কোথায় থাকে জানি না—তবু সাধারণ যে-ভাবে বলে থাকে তার অনুকারে বলি : তােমার আত্মার শান্তি কামনার কোনাে অধিকার আমার আছে কিনা জানি না, কেননা আমি একটি তথাকথিত পাপ করতে যাচ্ছি—“তথাকথিত” বলছি এজন্য যে এটাকে পাপ বলে মনে করি না। পাপ কোনাে মানুষকে অর্শায় তখনই, যখন সে উপস্থিত হয় ভাবনায়, আমি দায়মুক্ত। কিন্তু সত্যিই কি আমি ভাবনামুক্ত? তুই, ছুঁড়ি, চুল খুলছিস এখন, ভয়ে আমার বুক কাপছে কেন? একটু আগে, অকারণে, সম্পূর্ণ অকারণে, কেন আমার সিঁড়ি গিয়ে উঠতে উঠতে মনে হচ্ছিল হাঁটুর ব দুটি খুলে পড়ে যাবে, আর তাের ছােট ভাইটিকের রাজা—তাই নিয়ে হয়তাে কাল ভাের থেকে খেলা শুরু করে দেবে? কিন্তু তাের সাহসের প্রশংসা করি, তুই এখন খাটের উপর পা তুলে বসে হাসছিস, কামনার হাসি, ম্লান কামনা-ভরা হাসি বারে বারে ব্যর্থ হচ্ছে, জোরকরা হাসি তবু।’ খুঁড়িটি তারার মতাে বিড়বিড় করে বললে, “বাড়ি থেকে কখন বেরিয়েছ? খিদে লেগেছে নাকি? কিছু খাবে? মুখে হেসে মানা করে, মনে মনে সে একটি অশ্লীল উক্তি করলে খাদ্যবিষয়ক। লােকটা একটু একটু কাঁপছে কামনায়, ঘুড়িটিওঃ চেয়ার থেকে উঠে খাটের দিকে অতিচৈতন্যের মধ্য দিয়ে, অর্থাৎ অচেতনতা, লােকটা যাবতীয় ভাবনা পরস্পরের উপর চাপিয়ে এগােতে লাগল। ঘুড়িটি চেষ্টাকৃত অবহেলাভরে ভীষণ অশংক আড়মােড়া ভাঙতে ভাঙতে শুয়ে পড়ল। অচিন্ত্য শয়নে। লােকটা খাটের উপর পাশে বসে পড়ল দুই পা ঝুলিয়ে মেঝেয় । “আমাদের দুজনের ধর্মাধর্মহীন পারস্পরিক কামনা, এক মুতের সৌজন্যে, আজ বস্তুত চরিতার্থ হবে।’ উপদ্রলােভী হুঁড়িটির শরীর উদ্বেল, কম্পমান, অগ্রসরমান, চক্ষু তমসায় যাতায়াত করে, মুখমণ্ডল এক পাশে কাত হয়ে আছে; মুখের কোমল অংশ তার দিকে নিয়তিসমান লােভায় বলে মানুষটার হাত নিশপিশ করে ওঠে, পরমুহর্তে খুঁড়িটির গালের উপর পর-পর কয়েকটি প্রকৃত চাটি এসে পড়ে, চোখ খুলে আশ্চর্য খুঁড়িটি তাকায়, গভীর, নিবিড়, স্বপ্নসম, যেন তীক্ষ আলপিনচক্ষে আমার মানবেন্দ্রকে বিদ্ধ করছে কুশল ছুঁড়িটি মানুষটি এইমতাে ভাবল। কিন্তু তখন, ঘাের মায়াবন পশ্চাতে হঠিয়ে, তার লাল বল জাগ্রত হয়েছে; তার আক্রমসম্মত বাণী ঝরে পড়ছে ন্যস্ত হুঁড়িটির যুক্তিহীন চক্ষে, কেশগুচ্ছে, তােষামােদকাতর দেহদৈর্ঘে; তার আক্রমসম্মত হাত ছুঁড়িটিকে বস্ত্রহীন আক্রমণবিন্যাসে ভরে দিতে যাতায়াত করে। কিন্তু যখনই অপসারিত হলাে হায় ব্লাউজ, চীকার করে উঠল মানুষটা, একি তােমার তিনটি স্তন! একি তােমার তিনটি স্তন!’ তার মনােহীন মুখ হঠাৎ নীল হয়ে গেল, শিশ্ন মুহূর্তে গুটিয়ে এতটুকু, দরােজা খুলে সিড়ি ভেঙে দরােজা খুলে পালিয়ে যায়।

(১৯৬২)

Leave a Reply