আকাশে প্রেমের বাদল – বিপ্রদাশ বড়ুয়া

›› সম্পুর্ণ গল্প  

আমার জন্ম খরস্রোতা নদীর তীরে। ছোট্ট একটি পাহাড়ী নদী বড় নদীর সঙ্গে যেখানে মিশেছে তারই মধ্যবর্তী গ্রামে। পাহাড় থেকে জম বলে বর্ষায় নদীটির গতি হয় ক্ষুরধার—যেমন আমার ইচ্ছেরা প্রচলিত আইন-আনুন না মেনে সারা দেশে ঘুরে বেড়ায় এবং দেশান্তরেও পাড়ি জমায়, ঠিক তেমনি বড় নদীটিও কূলের কাছে যা-কিছু পায় গ্রাস করে সমুদ্রের দিকে তীব্র বেগে ছুটে চলে। পাহাড়ের মরা শুকনো গাছপালা ও খড়-কুটো, পোড়া কাঠ, গাছতলায় ঝরে পড়া ফল গিলা এমন কি মানুষ পর্যন্ত ভাসিয়ে আনে। পাড় ভেঙে ঘরবাড়ি ভেসে যাওয়ার খবরটাও ওর কাছে তখন এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ নয় । এর ওর দিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখাটাও বিশেষ আমল দেয় বলে মনে হয় না ।
আমার জন্মস্থান, ছেলেবেলার স্মৃতি, এমন কি যৌবনের উন্মেষে প্রথম ভালোবাসাও ফেলে এসেছি দুই নদীর জলে ধোওয়া গ্রামে। আমি প্রায় ভুলতে বসেছি ভালোবাসার সেই মিষ্টি-মধুর স্মৃতি। ঠিক ভুলে যাওয়া নয়, অনেক স্মৃতির মাঝে চুপটি করে থাকা এক আনন্দঘন গ্রাম-কাহিনী ।
পাহাড় পাহাড়ের ঢালুতে দাঁড়িয়ে থাকা বড় বড় গাছ, বর্ষার ঝমঝম এক টানা বৃষ্টি, নদীর কুলকুল, পাড়-ভাঙার শব্দ, ভাদ্রের শব্দহীন ভরা নদী, বিশাল বিশাল গাছের ভেসে আসা ভেলা, বাঁশের লম্বা চালি, দূরে বৃষ্টিতে বা কুয়াশায় ঢাকা পাহাড়—সেই আমার গ্রাম। একা একা হাঁটতে হাঁটতে পেরিয়ে যাই গ্রাম-সীমান্তের বন । বনের ঝাঁঝালো গন্ধ, মাঝে মাঝে ছুটে যাওয়া একটি হরিণের ছায়া, সন্ধে ও সকালে ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে আসা বক বা বানের জলে ডুবে যাওয়া গ্রামই আমার শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি। তার মাঝে কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলায় ভাই-বোনদের সঙ্গে বেড়ে ওঠা—। প্রিয় পাঠক বা পাঠিকা, এবার কৃষ্ণচূড়ার কথায় আসি ।
গ্রাম থেকে আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় দিয়েছি। শহরের হোস্টেলে থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েছে কৃষ্ণচূড়া কৃষ্ণচূড়ার মতো ঝলমল ওর লম্বা চুল, বারুদ-ঠাসা বুক আর শাণিত ছোরার মতো কথাবার্তা। গ্রামের এক আত্মীয়ের বিয়েতে তার সঙ্গে দেখা এবং নতুন করে পরিচয়। আমরা একই গ্রামের। আগে তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। অসুখের সম্ভবত তিন-চার বছর জন্য আমার দু’ বছর নষ্ট হয়েছিল প্রাইমারি স্কুলে। কৃষ্ণচূড়াও তাই আমার বয়েসী । বিয়ের লগ্ন ছিল রাত দুটোয়। কাজ করতে করতে আমিও ক্লান্ত মাঘের শীত পড়েছে জেঁকে, কুয়াশাও নেমেছে ঝেঁপে। কৃষ্ণচূড়া বলল, আমার সঙ্গে বাড়ি পর্যন্ত যাবে, পৌঁছে দেবে ? ভীষণ শীত করছে। ওর গায়ে ছিল কাশ্মিরী চাদর, রাজশাহী সিল্কের শাড়ি। প্রস্তাব শুনে আমি নিজেকে কেউকেটা ভেবে নিলাম। ওর ভাই থাকতে আমাকে কেন বলল আমার বোধে এল না। আমার বুকের ভেতরটা ঝলমল শব্দে বাজতে লাগল ।
হ্যাঁ, কৃষ্ণচূড়া খুব সাহসী। বিয়েবাড়ির হ্যাজাকের আলো পিছনে ফেলে কুয়াশার অন্ধকারে ঢুকতে ঢুকতে সে বলে বসল, তুমি কি কাউকে ভালোবাসো ?
আকাশ-পাতাল বা কুয়াশা, স্কুলের সহপাঠিনী, কোনো নিকট বা দূর সম্পর্কের আত্মীয়া, অথবা স্বপ্ন হাতড়ে নাম করার মতো কাউকে তক্ষুণি খুঁজে পেলাম না। ঠিক সে সময় লক্ষ্মীপেঁচা বলে উঠল, বলে দাও তুমি তুমি তুমি। তোমাকেই ভালোবাসি কৃষ্ণচূড়া।
যে-আমি মেয়েদের সামনে মুখচোরা, চোখ তুলে তাকাতে পর্যন্ত পারি না, কথা বলতে গলা কাঠ হয়ে যায়, পাড়ার মেয়েদের সঙ্গেও কথা বলতে বুকের শব্দ নিজের কানে শুনি, সেই আমি তাড়াতাড়ি কুয়াশার বর্ম পরে লক্ষ্মীপেঁচার মতো জোর গলায় বললাম, তুমি । তারপর শুরু হল আমার বুকের শব্দ এক দুই তিন করে গোনা। এক সময় দেখি শুধু আমার নয়, কৃষ্ণচূড়ার বুকের শব্দও আমার বুকের শব্দের সঙ্গে এক তালে মিশে ঠুংরি শুরু করেছে। ওর গায়ে আমার অভিজ্ঞতার অতীত এক অপ্রাকৃত সুগন্ধ। তার মাঝে আমি ডুবে রইলাম ।
সেই আমার প্রথম ভালোবাসা, আমার হৃৎপিণ্ড দুমড়ানো শব্দ শোনা আলিঙ্গন। আমার অনভিজ্ঞ যৌবন ঐ আলিঙ্গন নিয়ে কী করবে কোনো কুল-কিনারা করতে পারল না। রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এভাবে প্রথম ভালোবাসার ভার সহ্য করা যে কী কঠিন তাও বোঝান শক্ত । বিয়েবাড়ি থেকে এই বুঝি কেউ এসে পড়ল, এই বুঝি কেউ দেখে ফেলল—ভয়ের বদলে গভীর উত্তেজনা ও আনন্দে ডুবে রইলাম। ছোট্ট একটা পাখির মতো আমার শরীরে ভার রেখে সে বলল–কে যেন আসছে, আমাকে নিয়ে চলো। সে-অবস্থায় ওকে কাঁধে তুলে প্রায় ডাকাতের ভঙ্গিতে ছুটে চললাম। পিছনের মানুষ পিছনে পড়ে রইল। ওর বাড়ির উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কুয়াশা- ভেজা খড় সরিয়ে তার মাঝে আমাদের দু’ জনের মতো জায়গা করে নিলাম। পাশাপাশি আরো দুটি খড়ের স্তুপ আমাদের পাহারা দিয়ে রইল। তারই মাঝে সঙ্গোপনে এবং আমার প্রায় অজান্তে ওর শাড়ির নিচে ব্লাউজের ভেতরে সুকোমল স্তনে হাত দিলাম । একটু পরেই কৃষ্ণচূড়া আমাকে আরো জোরে জাপটে ধরে কাঁদতে শুরু করল। সে কী আকুল কান্না। বলতে লজ্জা নেই সেদিন আমিও কেঁদেছি তার সঙ্গে। প্রথমে না বুঝে এবং পরে বুঝতে পেরে। কাদতে কাঁদতে সে বলল, ফাল্গুনে বিয়ে। মা-বাবার মতে বিয়ে হচ্ছে। বিয়ের পর চলে যাব আসামে। কাঁদতে কাঁদতে আমরা বুঝলাম আমাদের দেখা হাওয়াটাই নিয়তি। আমাদের ক্ষণিকের ভালোবাসাই হল আমাদের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ পাওয়া ও দুর্ঘাইনা। সে আমার শার্টের বোতাম খুলল, এবং অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে এক আনন্দঘন রতিক্রিয়ার সাহায্য করল। আরো অনেকক্ষণ পর আমরা উঠলাম। যতদূর সম্ভব ওর কাপড়চোপড় থেকে খড়কুটো ঝেড়ে তাড়ালাম। চুল ঠিক করল। তারপর মাকে ডেকে দরজা খুলে সে ঘরে ঢুকল। আমি ভুতে পাওয়া, চাঁদে পাওয়া বা পরীক্ষায় খুব ভালো নম্বর পাওয়ার মতো গর্বিত আনন্দে ঘরে চলে এলাম । কৃষ্ণচূড়ার সঙ্গে কথা হয়েছিল প্রতিবছর ঐ দিনটি আমরা স্মৃতি- বার্ষিকী পালন করব। আমরা বন্ধু হলাম ৷
দশ বছর পর গ্রামের খরস্রোতা নদী-তীরে বানে ডোবা ঘরে যাচ্ছি। হঠাৎ খুশিতে মেতে ওঠা একটি পাখির মতো সেই স্মৃতি মনে পড়তেই দেখি সামনে কৃষ্ণচূড়া। শহর থেকে গ্রামে যাওয়ার পথে একই নৌকোয় ওর সাথে দেখা। বড় রাস্তায় বাস থেকে নেমে দু’ মাইল দূরে আমার গ্রাম। বড় রাস্তা মাঝে মাঝে পানিতে ডোবা । হাঁটুজল ভেঙে বাস চলতে চলতে আমাকে নিয়ে এল। নৌকো নিলাম, ছোট্ট নৌকো। নৌকো ছাড়তেই চেনা গলা পেছন থেকে ডাক দিল— মাঝি মাঝি। ফিরে তাকাতেই দেখি বাদল । সঙ্গে তার বোন কৃষ্ণচূড়া ও দুই ছেলেমেয়ে। সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীরে বারো বছর আগের রোমাঞ্চ বান ডাকল । ওর চোখেও সেই আগের মতো উজ্জ্বল চাঞ্চল্য, শানিত কথা মুখে এবং চোখের ইশারায় ফিসফিস করে বলল, তুমি কি কাউকে ভালোবাসো ?
এখন আমি আর আগের মতো ঠিক লাজুক নেই। সেদিনের লক্ষ্মীপেঁচার শেখান সেই কথাটি তবুও আগের মতো অবিকল মুখে চলে এল, তুমি ।
বাদল ছেলেমেয়েকে শাসাচ্ছে । সে কি আমার মনের কথা শুনে নিয়েছে ? কৃষ্ণচূড়া অনেক দিন পর দেশে বেড়াতে এসেছে ৷ এসেই যে-বানের দেখা পেয়েছে সে-বানের মূল উৎসও আগরতলা ও আসাম ৷ ফনী, কর্ণফুলী ও ব্রহ্মপুত্রের কূলফাটা ঢল এসে তলিয়ে দিল চারদিক। তার ওপর বৃষ্টির দাপট। কৃষ্ণচূড়া সেই আগের মতো ঝলমলে, অবিকল আগের চেহারা, ব্যবহারেও এক চুল এদিক-ওদিক নয়। তফাৎটুকুও যেন অনেক দিন না দেখার জন্যে। সেদিন মাঘের কুয়াশার রাতে যে আনন্দঘন উৎসব হয়েছিল আজ দিন- দুপুরে নৌকোতে মনে মনে তার পুনরাবৃত্তি হল বুঝি। কৃষ্ণচূড়া খুব হাসিখুশি কথা বলে চলল ।
বাদল আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু । সে জানে না আমরা চোখের পলকে কী কথা বললাম, জানে না বারো বছর আগের এক রাত্রির অমলিন ভালোবাসার কথা। প্রিয় পাঠিকা বা পাঠক, আপনারা এর নাম ভালোবাসা নয় বলবেন। চোখ বুজে এর দৈহিক রূপটি দেখতে পাবেন, নগ্নতা বলবেন এবং আরো অনেক কিছু। আমি আপনা- দের কথা মানি না, কিন্তু কোনো যুক্তিও দেব না, সাফাইও গাইব না! আপনাদের জীবনে এরকম কোনো ঘটনা ঘটলে তবেই বুঝবেন ।
শেয়ালটা সাঁতারে এসে দরজা দিয়ে কখন ঢুকল, তারপর কখন ঘরের কোণের বেড়া বেয়ে উঠতে শুরু করল একটুও টের পাই নি। কাঠের উঁচু বড় সিন্দুকের ওপর আমার বিছানা। সেখানে বসে বসে দুপুরের খাবারের অপেক্ষা করছি। বাড়ি পাহারা দিচ্ছি। মা-বাবা ছোট ভাইবোন চলে গেছে পাশের গ্রামে। আমার মতো অনেকে বাড়ি পাহারা দিচ্ছে। বানে ডোবা ঘর বিনা পাহারায় রাখা যায় না। মুন্সিদার নৌকোয় করে আমার মতো প্রায় সবার জন্যে খাবার আসে। পাশের গ্রাম উঁচু টিলার ওপর। প্রায় দু-এক বছর পর পর বান হয়, আর আমাদের পালাতে হয় সে-গ্রামে ৷ আমরা বানভাসি গ্রামের মানুষ ।
শেয়ালটা শেষ পার্যন্ত উঠল। আঁচড়ে-কামড়ে ও কসরত করে বেড়ার তাকের ওপর উঠে আয়েশ করে গা-ঝাড়া দিল। সবকিছু দেখে শুনে বললাম, যাক, তাহলে আর একা থাকতে হবে না। তোর সঙ্গে কথা বলা যাবে।
খুব ধকল গেছে কি ?—আমি বললাম ৷
উত্তরে সেও যেন বলল, ঠিক তাই, একেবারে নাস্তানাবুদ ।
ক’দিন থাকবি ?
থাকি! যে-ক’দিন পারি !
পেটে কিছু পরেছে? মুরগী-টুরগী, মরা গোরু, ব্যাঙ ? কিছুই না-বলে মাথা ঝাঁকাল, মুখ-ভেঙচি করল। বললাম, ঘর-সংসার, পরিবার কোথায় ?
সেও কেন জানি না আমার কথার উত্তর না দিয়ে প্রশ্ন করল, তুই বিয়ে করেছিস ? তোর পরিবার ? নাকি মখলস ?
আমি হা হা করে হাসলাম। সেও খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসল, তারপর বাঁ হাতের থাবা দিয়ে চোখ-মুখ মুছল। জানতে চাইল খাবার- দাবার কিছু আছে কিনা ।
উত্তরে বললাম, আছে। শুকনো চিঁড়ে, গুড়, মুড়ি আর চুরুট ও দেশলাই। কি, চলবে ? ঘরে উত্তর-দক্ষিণ জোড়া বেড়ার লম্বা তাক। তার এক পাশটা আমার সিন্দুক থেকে হাতের নাগালে পড়ে। পুরানো দিনের মস্ত বড় সিন্দুক, চাপালিশ কাঠের তৈরি। মাথা সমান উঁচু। অর্ধেক ডুবে আছে পানিতে। তার ওপর আমার বিছানা। বেড়ার তাকে সংসারের নানা টুকিটাকি—কাপড়ের পুঁটলি, বাক্স, কিছু হাঁড়িকুড়ি, কুলাচালুন, বাতিদানী ইত্যাদি অনেক কিছু । তারই এক পাশে ফাঁকা দেখে শোয়ালটা উঠল। উঠে খুব করে গা ঝাড়ল ৷
তাক থেকে মাটির সানকি নিয়ে কিছু চিঁড়ে-মুড়ি দিলাম !
বললাম, খাঁ, খেয়ে দু’ ঢোক পানি খেয়ে নে । তবে হ্যাঁ, তার জন্যে আমাকে সিন্দুকের আস্তানা ছেড়ে নামতে হল না। হাত বাড়িয়ে ওর সামনে গিয়ে তাকের ওপর তুলে দিলাম। ভয়ডর পেল না। শুঁকে দেখল, মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল এক নজর। বললাম, খেয়ে নে। খিদে পেটে অত জাতবিচার করতে নেই। খাবারেরও নয়, যে দেয় তারও না। ভয়েরও কিছু নেই । নে, শেষ করা খুব একটা চিবোলে না। স্বাদ পেল কিনা কিছুই বলল না ৷
তবে খাওয়ার ধরন দেখে মনে হল একেবারে অপছন্দ নয়। বললাম, পেট ভরল ? এবার পানি খেয়ে নে ৷
তাকের ওপর থেকে মুখ বাড়িয়ে পানির নাগাল পায় না বলে সানকিতে ভরে তুলে দিলাম। খেয়েদেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মানুষের মতো বলল, মানুষ হলেও তোর দয়াময়া আছে। এই প্রথম একজন দয়ালু মানুষ দেখতে পেলাম। সবাই আমাদের দেখলে লাঠিসোটা নিয়ে ওঠে, নয়তো কুকুর লেলিয়ে দেয়। দেখি, আমি কিছু করতে পারি কি না। কোনো দিন সুযোগ পেলে ফিরিয়ে দেব। মনে মনে বললাম, তুই আবার কি উপকারটা করবি ! মুন্সিদা রাতের খাবার দিয়ে গেছে তার নৌকোয় করে। আমা- দের বহু দিনের পুরোনো ঘাট-মাঝি আইনুদ্দিন মুন্সির সঙ্গে এল তার ছেলে আবুল। দুপুরে আনা টিফিন ক্যারিয়ার দিয়ে দিলাম।
মুন্সিদাকে বললাম, একজন অতিথি আছে । কাল থেকে দুজনের ভাত পাঠাতে বলো ।
শেয়াল ও আমি দু’ জনে খেয়ে নিলাম। কলাগাছের ছোট্ট ভেলাটা ঘরের দরজায় বাঁধা আছে। তাতে চড়ে ভিটে ঘুরে এলাম। দু তিনটা হাঁক দিলাম, পাশের বাড়ির পল্টনকে ডাক দিলাম । সেও উত্তর দিল। একটু দূরে আছে শ্যামল, তারপর বাবু, বেশ খানিকটা দূরে বশর, মতিন, পুভুল ও টিটো। আকাশে ঝলমলে তারা। কৃষ্ণ- পক্ষের একাদশী। কোটি আলোকবর্ষ দূরের একটি তারা উত্তরাকাশ থেকে তাকিয়ে আছে। দুপুর থেকে বৃষ্টিটা থেমেছে। আকাশ প্রায় মেঘহীন। বঙ্গোপসাগরের দিক থেকে মাঝে মাঝে গর্জন শোনা যায় কামান দাগার মতো। দক্ষিণ দিকের আকাশে ফল্স্ ক্রসের তারা একটু একটু দেখা যাচ্ছে। এক ডাকে সাড়া দিল পল্টন। তারপর বানের জলে বাহ্য- কর্ম সেরে আরেক বার পল্টনকে ডেকে বললাম, পড়ে পড়ে ঘুমোস না যেন। মাঝেমধ্যে গলা খাঁকারি দিস, গানটান গেয়ে শোনাস। সঙ্গে সঙ্গে সে গেয়ে উঠল, বানের জল চোখের জল হল একাকার।
রাতে পাহারা দিতে হয়। এসময় ঘরের চালের টিন ও দামী কাঠ চুরি করতে আসে সংঘবদ্ধ দল। আমরাও সজাগ । সবাই মিলে মুন্সিদার নৌকো কেরায়া করেছি। সেটা সারারাত টহল দেবে, পালা করে পাঁচ-ছয় জন লোক থাকবে, আর আমরা তো প্রায় বাড়িতে দু-এক জন করে আছিই। পল্টন উত্তর দিল, সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছি। এখনো চোখে ঘুম লেগে আছে। ছাড়তে চায় না, গানও বের হচ্ছে না ঠিক মতো। তারপর গান ধরল, আকাশে প্রেমের বাদল নেই…। ঘরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে কথা শুরু করলাম ওর সঙ্গে । এবার একটু ঘুমিয়ে নে। নিশ্চিন্ত থাকতে পারিস, কেউ তোকে ঘাঁটাবে না । মাথায় বাড়ি মারবে না। পড়ে পড়ে ঘুমিয়ে নে । সেও বলল, রাতে তো ঘুমুই না। তবে আজ সারা দিন বানের
পানিতে ভেসেছি। শরীরটাও খারাপ। রাতে খাবার খোঁজার ধান্দাও করতে হবে না। ঘুমুতে পারি বৈকি!
হ্যাঁ, ঘুমিয়ে পড় ।
তারপর সে বলল, শুভরাত। রাতে তোর চোখে ভালো মানুষের স্বপ্ন নামুক। মনের মানুষের স্বপ্ন।
ওর সামাজিকতা ও ভব্যতার পরিচয় পেয়ে খুব খুশি হলাম । তা ছাড়া মনের মানুষের স্বপ্ন দেখার কথাও বলেছে। এ তো রীতিমতো প্রাক্ত! তাহলে শেয়ালও স্বপ্ন দেখে । আমিও বললাম, মস্ত বড় একটা মুরগীর স্বপ্ন যেন দেখতে পাস। শুভরাত, শুভরাত। তোর ইচ্ছে ফলবতী হোক। তারপর আমি ভাবলাম, কৃষ্ণচূড়া, কৃষ্ণচূড়া …কৃষ্ণচূড়ার আগুন তুমি। রতি ভালোয় ভালোয় কাটল। একবার টুপটাপ বৃষ্টি পড়েছে। বানের জলে বৃষ্টির শব্দ সেতারের ছড়িয়ে পড়া সুর মনে হয় । আবার কান পেতে শুনি কৃষ্ণচূড়ার নিঃশ্বাসের শব্দ, আর তার শরীরের সেই সুগন্ধ। ঘুমের ঘোরে কি স্বপ্নে জানি না, মনে হল বেড়ার তাকের ওপর বসে কৃষ্ণচূড়া আমাকে ডাকছে। স্বপ্নের মাঝে ভাবছি আমি জেগে আছি, আবার ভাবছি আমি স্বপ্ন দেখছি। আমার স্বপ্নের রাজ্যও বানে ডুবে আছে, আমি নৌকোয় বসে বসে ছলছল শব্দ শুনি, বৃষ্টি আর বৃষ্টির সেতার শুনি। রাতে ভালো ঘুম হল না । সকালে প্রভাত জেলের নৌকো পেলাম । সে লোকজন আনা- নেওয়া করতে বেরিয়েছে। ডাক দিতেই সে এসে ভিড়ল। বললাম, আমাকে নাও, আজ সারা দিন আমার ভাড়া খাটবে । পটনকে ভেলাটা দিয়ে বললাম, পাহারা দিস। আমার অতিথিকে তাড়াস নে। অতিথিকে বললাম, ভয় নেই। ভাত খেয়ে পড়ে পড়ে ঘুমোস। পালিয়ে যেতে চাস নে যেন। উত্তরে সে বেশ হাসিখুশি তাকাল। হৌ হোঁ করে দু-তিনটা অস্ফুট ডাক দিল। শেয়াল শেয়াল গন্ধ ছাড়ল। তারপর যেন বলল, ভালোবাসার মূল্য অনেক।
প্রভাত দেখল। পল্টন বলল, অবাক কাণ্ড! মজার ব্যাপার!
ওরে নিয়ে কি করবে ? আমি হাসলাম। তারপর দরজা বন্ধ করে প্রভাতের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম । আকাশে মাঝে মাঝে পুষ্কর মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে। দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে হয়তো। ধোওয়া-মোছা গাছের পাতা ঝলমল করছে। গলা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কলাগাছ। গ্রামের শোভা বট-গাছের প্রাঙ্গণ জলের নিচে। ওর পাশ দিয়ে নৌকো চলল। এমন সময় মতিন ডেকে বলল তার জন্যে একটা দেশলাই নিয়ে আসতে । প্রভাত বলল, দেশটা ছারখার হইয়া গেল। গত বছর হইল খরা, নদীর পানি পর্যন্ত শুকাই গেইল, এইবার হইল বান। মানুষ যাইব কোন হানে ? হিয়ালডা সোন্দর জাগা পাইছে ।
আমিও তাই ভাবছি। জিজ্ঞেস করলাম, তোর ছেলেমেয়ে কোথায় ? ওরা কলেজের টিলায় আশ্রয় নিয়েছে। সেখানে অনেক মানুষ, মানুষের গায়ে মানুষ। দু’ বার রিলিফ পেয়েছে বলল। এক দিন দিয়েছে আটা আর এক দিন গম। গম ভাঙাবে কোথায়? বাজারের মেশিনঘরই ডুবে গেছে। কথায় কথায় অনেক কথা হয়। বৃষ্টি আসতে আসতে হাওয়ার তোড়ে চলে যায়। বাদলের বাড়িতে চললাম। সে ও তার ভাই ঘরের ভেতর মাচায় বসে আছে। দরোজা দিয়ে নৌকো ঢুকিয়ে মাঝে ওকে তুলে নিলাম। ওদের পুকুরের পাড় অনেক উঁচু, তা-ও ডুবে গেছে। বড় বড় মাছ ছিল ওদের পুকুরে, দশ বারো বছরের পুরনো রুই-কাতলা-সব মাছ গেছে। অনেক দিন পর আবার ওর সঙ্গে বন্ধুত্বের পুরোনো দিনগুলোর কথা শুরু করলাম। মাঝে হাদয়টা খুলে ধরতে এত যে ভালো লাগে! ওকে ছাড়া কৃষ্ণচুড়ার কাছে যাওয়া ঠিক হবে না ভেবেই সঙ্গী করলাম । এখনো বোধ করি পিছু টান আছে। হ্যাঁ, বন্ধুত্ব সামাজিকতা ও লৌকিকতা কিছুই ফেলা যায় না। নৌকোয় করে বিল পাড়ি দিতে দিতে দেখা হল রিলিফের হোমরাচোমরাদের সঙ্গে। স্রোতের শেওলার মতো বা স্মৃতিতে গা ঘষার মতো কৃষ্ণচূড়া এল অনেক দিন পরে। আকাশপথে পারি দিয়ে গেল হেলিকপ্টার। চারদিকে আধ-ডোবা গ্রাম। শুধু উত্তর দিকে কলেজের টিলা ও নীলসাগর গ্রামের টিলা জেগে আছে। সেদিক থেকে পাহাড়ী ঢল নেমে এসেছে। বাদল বলল, রোয়া ধান থাকবে বলে মনে হয় না। দেখছিস কেমন ঘোলা পানি। পলি পড়ে রোয়া পচে যাবে৷ কিছুই থাকবে না ।
প্রভাত বলল শেয়ালটার কথা। বাদলও খুব অবাক হল। জিজ্ঞেস করল, ওটাকে নিয়ে কি করবি রে ? শেয়াল হল অস্বস্তিকর ও বিটকেলে জীব। একটা ভালো শেয়ালের গল্প তুই কখনো শুনেছিস ? বইয়ে পড়েছিস ?
না।
তুই ঠিকই বলেছিস হয়তো। কিন্তু ওটা তো আর আমার পোষা এসে জুটেছে। দেখি না কি করে ! এবার হয়তো একটা ভালো পরিষদের শেয়ালের গল্প পেয়ে যাব। দেখা যাক! নীলসাগর গ্রামে পৌঁছতেই অনেকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। বুড়ি দয়ার মা লাঠি হাতে বাজারের দিকে চলেছে। দেখা হতেই পুরোনো কথা শুরু করল। কবে একবার পাঁচটা টাকা দিয়েছিলাম, তামাক কিনে দিয়েছিলাম—মনেও নেই আমার। রাস্তার ওপর বাজার বসেছে। রাস্তার কাঁধ বরাবর পানি। লোকজনে গমগম গিজগিজ করছে। তরিতরকারী উঠেছে। ছোট ছোট পেঁপে, কচি ঝিঙে, কাঁকরোল, তেলাকুচি পাতা, পুঁইডাঁটা ও ধুঁ দুল—যে যা পেয়েছে বানে ডোবা ভিটে থেকে তুলে নিয়ে এসেছে। ইউনিয়ন মেম্বার বসে আছে টিনের চালের চা-এর দোকানে। লোকজন তাকে ছেঁকে ধরেছে রিলিফের আটার জন্যে। ওর ইউনিয়নে কুড়ি বস্তা গম এসেছে। গম ভাঙাবে কোথায় ? একটা কলও নেই, সব পানির নিচে। গগন মিয়ার সঙ্গে দেখা হল । পরান আলী অনুনয় করে বলল দশটা টাকার জন্যে। অধ্যাপক আশরাফ আলী লুঙ্গী পরে লোক- জন নিয়ে গ্রামে-গ্রামে যাচ্ছে। কোথায় কে কী অসুবিধেয় কার ঘরে অসুখ, রাস্তায় আশ্রয় নিয়ে মানুষের কী হাল, খাওয়ার পানির সমস্যা—সব যেন তার নিজের সমস্যা। লোকটি পারেও বটে। কলেজ-টিলার কয়েক শ’ পরিবারকে যতদূর সম্ভব স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে এনেছে। ওরা কেউ না-খেয়ে নেই। বাদল তার বড় বোনের শ্বশুরবাড়িতে বলে এল সবকিছু ঠিকঠাক করে রাখতে, ফেরার পথে সে ভাত নিয়ে যাবে। আমি কিছু মুড়ি ও চিঁড়ে কিনে থলে ভরে নিলাম। থানার দারোগার সঙ্গে দেখা হতেই ডেকে নিয়ে গেল । বাদলের বোনের বাড়িতে পৌঁছানর সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণচূড়া হেঁকে ধরল শেয়াল সম্পর্কে জানতে। ওকে দেখাতেই হবে। শেয়ালের খাওয়া-দাওয়া ফলে কিছু প্রোটিন বিস্কিট মিলল।
স্বভাবচরিত্র—কত রকম প্রশ্ন। ওর ছেলেমেয়ে দুটিও ঝাঁপিয়ে পড়ল। দয়ার মাকে ডেকে নিতে হবে। তার বাড়ির ছাদে কী দরকারী জিনিষ আছে সেটা নিতে হবে। দুদু মিয়াকে পৌঁছে দিতে হবে তার ঘরে। পল্টনের জন্যে একটা মানচিত্র নিয়ে যেতে বলেছে। ত্রিপুরার রাতাছড়া, ধোয়াছড়া, কৈলাসহর—কোথায় কোন দিকে যাওয়া যায় সে দেখবে। বানে ডোবা ঘরে বসে তার এ খেয়াল কেন জাগল বলা মুশকিল। সে সব সময় এরকম খেয়ালী। আরো আছে সুবলের মা। তাছাড়া এর জন্যে খাবার জল, তার জন্যে বিড়ি ও তামাক—কত কী! হঠাৎ ঝমঝম করে নামল বৃষ্টি। আকাশ ফুঁড়ে ডাকল দেয়া। একটা কুরকাল ডাকল পদ্মপুকুর পাড়ের তালগাছে বসে। নৌকোয় পৌছে দেখি কৃষ্ণচড়া তার ছেলেমেয়েদের ফাঁকি দিয়ে ছাতা মাথায় বসে আছে। প্রভাতের সঙ্গে কথা বলছে। দয়ার মা, দুদু মিয়া, সুবলের মা, বাদল এবং এর-ওর জিনিষপত্র নিয়ে প্রভাতের নৌকো চলতে শুরু করল। টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছে, কলকল স্রোত বইছে । কৃষ্ণচূড়াকে দেখা অব্দি ভালো ও মন্দের জ্বর উঁকি দিচ্ছে শরীরে। জ্বরই-বা বলি কি করে? মন্দও বলছি কেন ? ছাতার নিচে বসে কী সুন্দর তাকিয়ে দেখছে বৃষ্টির ফোঁটা ৷ কৃষ্ণচূড়া চিরকালই একরোখা ও খামখেয়ালী ।
বাদল কথা শুরু করল, যাই বলিস, তুই একটা ঘটনা করে বসলি । দুনিয়ার ঐ একটা প্রাণীর প্রতি আমার কোনো মায়ামমতা নেই, কোনো আকর্ষণ নেই। একটা ভালো শেয়ালের গল্প বিশ্বসাহিত্যে তুই খুঁজে পাবি নে। এখন দেখবি তোর জিনিষপত্র ও বিছানার দফারফা। আমার ভাবতেও কেমন স্বপ্নময় মনে হচ্ছে। দুদু মিয়া বলল, ওটা মারলে এক টুকরা গোস্ত আমারে দিও। কোমরের ব্যথাড়া কাহিল কইরা মারছে। সুবলের মা-ও বলল ঐ কথা। শুধু দয়ার মা বলল, বানে ভাইসা আসা জীবন মাইরো না। গুনাহ অইব। ও অইল গিয়া অতিথ ! কৃষ্ণচূড়া সবার কথা মন দিয়ে শুনে বলল, সত্যি, অতিথির মন জোগান উচিত, অতিথি ও দূত অবধ্য। তারপর ছলছল চোখে আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে বলল, তুমি কি সত্যিই ওটাকে মারবে ? ঘরের
দরজা বন্ধ করে এসেছ ? ফিরে বললাম, তোমার কি মনে হয় ? বাদল বিরক্ত হয়ে বলল, তোরা কি থামবি ? বাঘ নয়, হরিণ নয়, এমনকি কোড়া পাখিও যদি হত একটা কথা ছিল। শেয়াল হচ্ছে একটা বদখত প্ৰাণী ।আমি হাসতে হাসতে সবার দিকে এক বার তাকিয়ে কৃষ্ণচূড়ার দিকে।
এমন সময় বৃষ্টি ধরে এল, ঝলমল করে উঠল রোদের আকাশ, এবং টলটল জল। প্রভাতও বলা-কওয়া ছাড়া গান ধরল, সোনা বন্ধুরে বৈদেশেতে কেন গেলা রে … । গান শুনে সবাই একসঙ্গে চুপ মেরে গেল ৷ প্রভাতের গলায় গানটা ভারি ভালো লাগল। বুড়ি দয়ার মা পর্যন্ত ওর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল, সুরে সুরে মাথা নাড়তে লাগল । দুদু মিয়া নৌকোর বেড়ার পাটাতনে তাল ঠুকতে লাগল । গলা-জলে ডুবে গাছপালা শুনল, আকাশের ছেঁড়াখোঁড়া অলক মেঘ দু’ চোখ ভরে দেখল, সুবলের মায়ের চোখ চিকচিক করে উঠল। কৃষ্ণচূড়ার কথা তো বলাই বাহুল্য । আমি? আমার কথা থাক। প্রকৃতি ও মানুষ আমার কাছে অচ্ছেদ্য । প্রথমে বাদল নামল। কৃষ্ণচূড়া বাদলকে বলল সে একটু পরে ফিরবে। তারপর নামল দুদু। সে বলল ফেরার পথে তাকে যেন তুলে নেওয়া হয়। নামল দয়ার মা, সে বিকেলে অন্য কোনো নৌকোয় ফিরবে । তার নাতিকে তিন দিন ধরে দেখে না বলে মনটা ছটফট করছে। সবশেষে নামল সুবলের মা। বেড়ায় ছোট দেউড়িঘরে আছে সুবল। ওদের মাটির ঘর পড়ে গেছে, টিনের চাল উবু হয়ে পড়ে আছে। সুবল বসে বসে আকাশ-পাতাল ভাবছে। ভাবনা ছাড়া আর কিছু নেই-ও প্রভাত আবার নতুন গান ধরল–আমি স্বপন দেশে পথ চলেছি বন্ধুরে…। রমেশ শীলের গান। আমার বুকটা ধক্ ধক্ করে উঠল । প্রভাত এ-গান ধরল কেন ? সে কী আমার মনের কটা টের পেয়েছে ? কৃষ্ণচূড়া তো আজ আগের সেই দিনে দাঁড়িয়ে নেই ! তার বড় ছেলের বয়স এগারো বছর, তাকে আসামে রেখে এসেছে। গান শুনে কৃষ্ণচূড়ার মনে কোনো ভাবান্তর হয়েছে বলে মনে হয় না। আমার দিকে পরিপূর্ণ ও স্বাভাবিক চোখে তাকাচ্ছে। মানুষের চোখ আগেভাগে মনের কথা বলে দেয়। কৃষ্ণচড়ার চোখে আছে সরলতা ও মাধুর্য। গান শুনতে শুনতে সে কখনো বানের দৃশ্য দেখে, জলে-ডোবা সারি সারি গাছপালার করুণ মিনতি আমাদের নিধন নয়, বরং আমাদের অনিষ্ট করলেই তোমাদের ধ্বংস শোনে। এক বার বলল, জানো, গাছেরা বলছে তোমাদের হাতে অনিবার্য। পানিতে আমরা মরব না ।
আমি অবাক হয়ে বললাম, আর কী কী বলে ? তুমি তো দেখি আসামে গিয়ে প্রকৃতিবিদ হয়ে গেলে !
উত্তরে সে বলল, আসলে প্রকৃতি আমাদের এই শিক্ষাই দেয়। প্রকৃতির হাত থেকে কারো রেহাই নেই। প্রকৃতি প্রতিশোধপরায়ণ। বানের পানির কথা ভাবো।
প্রভাত তখন গানের শেষ কলি উল্টেপাল্টে গাইছে, আমি নিজেকে নিয়ে হারিয়ে যাব বন্ধুরে আমি নিজের তরে কিছু রাখব না ধরে বন্ধুরে…
প্রভাতকে বাইরে রেখে হাঁটুপানি ভেঙে ঘরে ঢুকতেই শেয়াল দাঁড়িয়ে কাঁধের লোম খাড়া করে চোখে-মুখে রাগ প্রকাশ করল। আমি তাড়াতাড়ি বললাম, কী হয়েছে ? খিদে পেয়েছে ? একা একা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিস? ক্লান্ত ? ভাই-বোন আত্মীয়-স্বজনের কথা মনে পড়ছে ?…রাগ কেন? ঘরের দরজা বন্ধ করে গেছি বলে ? ছেলেমেয়ে ও পরিবারকে হারিয়ে এসেছিস ? কি হয়েছে ?…
কৃষ্ণচূড়া অবাক চোখে খুঁটে খুঁটে দেখতে লাগল। সে যখন কল- কাতার চিড়িয়াখানায় গিয়েছিল তখন সেখানে শেয়াল ছিল না । ঢাকার চিড়িয়াখানায় গিয়ে দেখেছিল শেয়ালের লেজ। খাঁচার ভেতরের গর্তে সে তখন দিবানিদ্রায় মগ্ন ছিল। আজ সামনা-সামনি পেয়ে ভালো করে দেখছে। সারা গায়ে ধূসর ঝাঁকড়া লোম, মুখে চোর-চোর ভাব… ! অনেকক্ষণ পর কৃষ্ণচূড়া কথা বলল । কী গুণে পোষ মানালে । বললাম, পোষ মেনেছে কিনা জানি না। বানের ভোড়ে ভেসে এসেছে। মনে হয় অনেক কিছু বোঝে, বুদ্ধিও রাখে। আলাপ করার চেষ্টা করো ৷ খুব আলাপী । আমার সঙ্গে কিছু কিছু বলেছে। আমার ঘর-সংসারের কথা, ওর দানাপানির খতিয়ান, পছন্দ-অপছন্দ–কত কথা !
তোমার আবার ঘর-সংসার কবে হল? কাকে ভালোবাসো ?
বিয়ে করেছে বুঝি! গত রাত ঘুমুবার আগে শুভরাত্রি জানিয়েছে। সুন্দর স্বপ্ন দেখার ‘কথা যে বলতে হয় তাও জানে । কৃষ্ণচূড়া অবাক হয়ে বলল, স্বপ্নের কী বোঝে সে ? শেয়ালেরা আবার স্বপ্নও দেখে বুঝি ? তুমি খুব হাসাতে পারো দেখছি । আরো কত কথা বলেছে! এক বার চেষ্টা করে দ্যাখোই না।
আমরা পা তুলে বিছানায় বসেছি। বসার জায়গা তো আর কোথাও নেই, সিন্দুকও বেশ উঁচু, কৃষ্ণচূড়াকে ধরে তুলতে হল। প্রভাত গেছে পল্টনের জিনিস দিতে। মাঝে মাঝে ঢেউ ভেঙে পড়ে ঘরের বেড়ায় এসে। একজোড়া শালিক কথা-কাটাকাটি করছে উঠোনের আমলকি গাছে বসে। কৃষ্ণচূড়া দু’ হাঁটুর ওপর থুতনি রেখে এক বার আমার দিকে তাকায় আবার শেয়ালকে দেখছে। সে তেমনি হাল্কা-পাতলা আছে। বয়স বাড়লেও চোখের কোণে ভাঁজ পড়ে নি, কিন্তু অনেক কিছুর বদল হয়ে গেছে। হঠাৎ কৃষ্ণচূড়া গুন গুন করে গান ধরল ।
গান শুনে নাকি অন্য কোনো কারণে জানি না শেয়াল উসখুস শুরু করল, রাগ দেখাতে লাগল এবং পিঠের লোম খাড়া করে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। মুখে আর চোর চোর ভাব নেই । আর পারি নে বাপু, ঐ দ্যাখো রাগে ফুঁসছে। তারপর আমার দিকে তাকাচ্ছে, কখন আক্রমণ করে বসে বলা যায় না। বলতে বলতে হঠাৎ গান বন্ধ করে কৃষ্ণচূড়া বলল, আপদটা বিদেয় করো ।
সে আমার কাছে সরে এল, এক হাত আমার কাঁধে রেখে বলল, দ্যাখো দ্যাখো, কেমন কটমট করে তাকাচ্ছি. আমার ভীষণ ভয় করছে, আপদটা দূর করো, একটা বিহিত করো।
আমি সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, কোনো ভয় নেই। আমার হাতে খাবার খেয়েছে। তারপর শেয়ালের দিকে তাকিয়ে বলললাম, কিরে অমন করছিস কেন ? একটু হাসি হাসি মুখ কর, অভয় দে, এক জন অতিথি”বুঝলি?
না, শেয়াল কোনো কথা শুনল না, বরং আরো বেশি রাগ দেখাতে লাগল ! আমি তাড়াতাড়ি কিছু খাবার এগিয়ে দিলাম ।
বিছানা থেকে হাত বাড়িয়ে দিতে দিতে বললাম, তুইও আমার অতিথি।
কৃষ্ণচূড়া আমার অনেক দিনের বন্ধু, এগারো বছর পর এসেছে”একটু হাসি হাসি মুখ কর ? কৃষ্ণচূড়া আমাকে আগলে ধরতে ধরতে বলল, কি যা-তা বলছ ? আর কাজ পেলে না, শেয়ালকে পোষ মানতেও চাও, ভালোবাসার কথা শোনাও ? ভালোবাসার কী বোঝে ? তুমিই এখনো বুঝলে না ! আমি কিছু না বলে কৃষ্ণচূড়ার মুখের দিকে তাকালাম। সেও আমার মুখের কাছে মুখ এনে তাকিয়ে রইল । সঙ্গে সঙ্গে শেয়াল প্রতিবাদের ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। অমনি কৃষ্ণচূড়াও আমাকে দু’ হাতে প্রবল বেগে আগলে ধরল। সেই শালিক জোড়া ডেকে উঠল, কীকি-কীকি-কীকি, প্রেইক-প্ৰেইক, টুই-টুই। স্মৃতি ও অনেক দিন আগে ফেলে আসা কথাগুলো বেনো জলের সঙ্গে মাতামাতি শুরু করল। শেয়াল একবার আমার দিকে আবার কৃষ্ণচূড়ার দিকে তাকিয়ে দুর্বোধ্য ভাষায় আমাকে শাসিয়ে দিল ।
আমিও সঙ্গে সঙ্গে বিছানার নিচ থেকে রামদা বের করে ধমক দিয়ে বললাম, চুপ, এত রাগ দেখাচ্ছিস কেন ? কি হয়েছে ?
সেও আর দেরি করল না, এক লাফ দিল পানিতে, তারপর সাঁতার কেটে দরজা পেরিয়ে চলে গেল । একবার ডাকব ভাবলাম, কিন্তু কৃষ্ণচূড়া ততক্ষণে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আমার বুকে মুখ লুকিয়ে বলল, ওর সামনে খুব লজ্জা করছিল, বোধয় বুঝে-শুনে চলে গেল।
{গল্পগ্রন্থ : আকাশে প্রেমের বাদল ]