……. তখনই পৌলমী নামক নারীর সঙ্গে দেখা হওয়ার সময়, যখন চোখের দেখা আর মনের রিমঝিম বাজনার সঙ্গে পারিপার্শ্ব এসে মেশে। কপিল মুনির আশ্রমের সামনে নােনাজলে পা ছুঁইয়ে সে হাঁটছিলাে। ওঁর শাড়ির নীল আঁচল উড়ছিলাে। শরীরে জড়ানাে গােলাপী শাড়িতে ভােরের সূর্যের লাল আগুন লেগেছে। অহঙ্কারী তখন তার দুই পাহাড় চূড়াে। সেই সুন্দরী নিজের সম্পূর্ণতায় রানীর মতাে হাঁটছিলাে তখন। বােধিসত্ত্ব দেখলো, তার কপালে সিঁদুর। বােধিসত্ত্বের অন্তর জুড়ে তখন গােবিন্দদাস– ‘পন পয়ােধর জঘনা গুরুতর/ভাবে গতি অতি মন্দ আরতি অন্তর পন্থ দূরতর/বিহিক বিরচন নিন্দগঢ়ল মনােরথে চলল সুন্দরী/ বিঘন বিপদ না মান। মিলল ভামিনী কুঞ্জধামিনী/দাস গােবিন্দ ভাণ।। এ দেখার মহিমাই আলাদা!………
……..ও এখন শাড়ি পরে টিপলে জল আনতে যায়। ঝম ঝমর হাটে। ঠমক চমক ঠাটে। শরীরে বান এসেছে অঞ্জলির। জলভরা কলসী কাকে নিয়ে সে যখন বাড়ির দিকে যায়, যােয়ান ছেলেগুলাে হা করে তাে দেখেই বুড়ােরাও তেরচা চোখে চট করে দেখে হঠাৎ নির্বিকার হয়ে যায়। চুলের ঢল নেমেছে মেয়েটার মাথা থেকে। কাঁচা অঙ্গের লাবণ্য ছড়ায় সৃষ্টিধরের মেয়ে অঞ্জলি দাস।……..
…….অঞ্জলি বাড়ির দিকে দৌড় দিয়েছিলাে। ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাে অঞ্জলি। ভীষণ ভয়। দাওয়ায় কলসী নামিয়ে রেখে ও পৌষের শীতেও হাঁফাচ্ছিলাে। ওর ভরা বুক দু’টো হাপড়ের মতাে ওঠানামা করছিলাে।……..
………দীপঙ্কর ভেতরের ঘরে ঢুকলাে। পৌলমীর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বাঁ হাতে ওঁর কোমর জড়িয়ে ধরলাে। ডান হাত উঠে এলাে স্তনচূড়ায়। পৌলমী চোখ বুজে তার যন্ত্রণা সামলাচ্ছিলাে। ঝটকা দিয়ে সে দীপঙ্করের ডান হাত সরিয়ে দিলাে। তার চেয়েও দ্রুত ডাক্তার দীপঙ্করের ডান হাতের মুঠি ফের চেপে বসলাে পৌলমীর বুকে।
পলু, বিছানায় চলাে। রােজ রােজ একই রকম ব্যাপার ভালাে লাগে না। ইজি হও পলু। কাম অন্। চলল, শোবে চলল।
দীপঙ্করের নিজেকে যদিও দারুণ ফ্রেশ লাগছিলাে, কিন্তু পৌলমীর মনে হচ্ছিলাে একটা সরীসৃপ যেন ওর শরীরটাকে ক্রমশঃ পেঁচিয়ে ধরছে। ওঁর চোখ থেকে ঠিকরে বেরােচ্ছিলাে ঘৃণা। ও হাঁসফাস করছিলাে।
প্রায় টানতে টানতেই দীপঙ্কর ওঁকে বেডরুমে নিয়ে গেলাে।
গা গুলিয়ে উঠছিলাে ওঁর খিদেটা একদম মরে গেছে। ধীরে ধীরে ওর শরীরটা শক্ত হয়ে উঠছিলাে। রােজকার মতােই ওর শরীর আর মনের মধ্যে পরিবর্তন শুরু হয়ে গেছে। ওঁর শরীরে এখন আর কোনাে পােশাক নেই। আদিম জীবন শুরু হচ্ছিলাে এই রাতে। কোন প্রেম ছিলাে না এখানে। পৌলমীর নগ্ন শরীরে ডাক্তার দীপঙ্করের পরুষ হাত দুটো খেলা করে বেড়াচ্ছিলাে অবহেলায়। নিষ্পেষিত হচ্ছিলাে পৌলমী। সে বাধা দেয়নি। সে কোনদিনই বাধা দিত না।…………
……..মনের দাহ শরীরী দাহে রূপান্তরিত হয়ে যায়। সেও যেন সরীসৃপ হয়ে যায়। দাহ থেকে তীব্র সুখের জন্ম হতে থাকে পৌলমীর শরীরে। দাহ তাকে উত্তপ্ত করে তােলে। উত্তাপ তাকে শরীরী সুখের দিকে ঠেলে দেয়। আশ্লেষে ডুবে যেতে যেতে সমস্ত কিছু ভুলে যায় সেই নারী। খেলা শুরু হয়ে যায় তখন।
…মনে হচ্ছে যেন একটা সাপআমাকে তার পিচ্ছিল শরীর দিয়ে পেঁচিয়ে ধরেছে। আমি চিৎকার করতে চাই। গলা দিয়ে শব্দ বেরােয় না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। সরীসৃপটা আমার শরীরে খেলা করতে শুরু করেছে। আমার লজ্জার সমস্ত পাপড়ি খুলে নিয়ে আমাকে আবরণহীন করে ফেলেছে। সেই অজগর হিসহিস শব্দে বিষ নিঃশ্বাস ছড়িয়ে দিচ্ছে আমার শরীরে। আমাকে ছােবল মারছে। আঃ! আবার ছােবল এসে পড়লাে আমার ঠোটে। আমি ছাড়াতে পারছি না এই ভয়ঙ্কর সাপটাকে। আবার ছােবল! হিস-হিস শব্দ ঘুরছে আমার চারদিকে। ছােবলের পর ছােবল।’
….এ কি! আর তাে কোন যন্ত্রণা নেই। প্রতিটি ছােবল আমার শরীর আর মনের ভেতরে উত্তপ্ত সুখ নিয়ে আসছে। আঃ! সুখ! আমার শরীরটাও যে পিচ্ছিল হয়ে যাচ্ছে। আমি কোন অতল গহ্বরে নেমে যাচ্ছি। আগুন আগুন সুখের মধ্য দিয়ে আমি সাপিনী হয়ে যাচ্ছি। আমিও ছােবল মারলাম। সুখ! আমি ফের ছােবল মারি। আগুনের গহূরে আমার সুখ চলতে থাকে। কর্দমাক্ত নােংরা সুখের মধ্য দিয়ে আমি পৌলমী, ক্ৰমশঃ অতলে নেমে যাই। সময়ের হিসাব থাকে না।
মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে। হাজার বছরের ঘুম চোখে নিয়ে পৌলমার নগ্ন শরীরটা বিছানায় পড়ে আছে। ডাক্তার দীপঙ্কর উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিদ্রামগ্ন।………
………এক যুগ পেরিয়ে যাবার পরে বােধিসত্ত্বর সামনে এসে দাঁড়ালাে পৌলমী।
আকাশ ছুঁয়ে যাওয়া নগ্নতায় আচ্ছন্ন পৌলমী শেষ পর্যন্ত এখন বােধিসত্ত্বর সামনে দাঁড়িয়ে। বােধিসত্ত্বর মুখখামুখি। | আমার আর কোনাে দ্বিধা নেই বুধ। তােমার কাছে আমার কোনাে লজ্জা নেই। তুমি আমার ঘরে প্রথম এলেও তুমি আমার সদরে-অন্দরে আছে সবসময়।
বােধিসত্ত্বর বুকের মধ্যে জলপ্রপাত। এ কোন পৌলমী? দেলাক্ৰেয়া, না কি রেনােয়ার ক্যানভাস থেকে উঠে আসা নারী শরীরের কারুকাজ!না কি পাথরের শরীরে | রার ছেনি-হাতুড়ির নিপুণ কারুকৃতিতে গড়ে ওঠা ভাস্কর্য! পৌলমী, তুমি আমার প্রেম, তুমি আমার কাছে সুন্দর আর পবিত্র সুখের প্রতিমূর্তি। তােমাকেই আমি চেয়েছিলাম। | বিমর্ষ-বিষয় এই ঘরে এখন লক্ষ তারা ঝিকমিক করে উঠলাে। বােধিসত্তর বুকের মধ্যে জলপ্রপাতের শব্দ তুমুল হয়ে তুললাে ঝড়।
ঝড় শুরু হয়ে গেছে। আবরণহীন দুই নরনারী উদ্দাম হয়ে উঠেছিলাে। সীমানাহীন সুখের গভীরতায় হারিয়ে যেতে যেতে তীব্র আশ্লেষে-চুম্বনে মাতাল দু’জনের শরীর মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।’
জলপ্রপাতের লাগামছাড়া শব্দ বােধিসত্ত্বর বুকে, ঘূর্ণিঝড়ের একটানা আওয়াজ পৌলমীর মাথায়। গহীন শরীরে অকৃপণ সুখের মহল-বাতাস, ছাতিমের ঘ্রাণ, দু’জনেরই।
আমি তােমাকেই চাই! আমিও চাই তােমাকে! অনেক যুগের পরে, দ্বিধামুক্তির কণ্ঠস্বর দু’জনের মধ্যেই। শরীরের মধ্যে শরীর, আর মনের মধ্যে মন ডুবে গেল শেষ পর্যন্ত।…….