লীলী উলঙ্গ হয়ে শুয়েছিল। কেননা নগ্ন শরীরে চাদরের আদরমাখানো ছোঁয়া । তার পছন্দ এবং এতে লন্ড্রির খরচা বাঁচে।
প্রথমদিকে এনরি আপত্তি জানাতো। বিছানায় এরকম সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে শোয়া ঠিক নয়, উচিৎ নয়, নোংরা অভ্যাস। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত লীলী-র দৃষ্টান্তই অনুসরণ করেছে এনরি। অবশ্য ওর ক্ষেত্রে এটা নিছক আলস্যের দরুণ। লোকজন এন্সে এনরি তার সাবলীলতা হারিয়ে ফেলে। সুই-দের খুব পছন্দ করে এনরি। কেননা ওরা কাঠের মত শক্ত ও আড়ষ্ট। কিন্তু ছোটখাট ব্যাপারে ও উদাসীন, অমনোযোগী। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এনরি খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন নয় ও নিয়মিত আণ্ডারউইয়্যার বদলায়না। নোংরা লন্ড্রি-ব্যাগে নোংরা আণ্ডারউইয়্যার ভরার সময় লীলী খেয়াল না করে পারে না যে দুপায়ের ভেতরের দিকে ঘসা লেগে আণ্ডারউইয়্যারে হলুদ দাগ ফুটেছে। ব্যক্তিগতভাবে, অপরিচ্ছন্নতা অপছন্দ নয় লীলীর। কেননা এই অপরিচ্ছন্নতার ভেতরে মিশে আছে অন্তরঙ্গতা। যেমন বগলে। ইংরেজদের নৈর্ব্যক্তিক শরীরে কোন গন্ধ নেই, তাই ওদের সহ্য করতে পারেনা লীলী। কিন্তু স্বামীর অমনোযোগিতা ও বরদাস্ত করতে পারেনা।
লীলী এখন চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। তার গায়ের বুড়ো আঙুল চাদরের ছেঁড়া জায়গাটার ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আছে। আসলে ছেঁড়েনি, সেলাই খুলে গেছে। লীলীর বিরক্তি জাগে। সকালে ওটা সেলাই করবে। কিন্তু তার পায়ের আঙুল আরো চাপ দিয়ে আরও সূতো ছিঁড়তে চায়। এনরি এখনও ঘুমোয়নি, তবে চুপচাপ শুয়ে আছে। ও বলে, চোখ বুঝলেই ওর মনে হয়, ও যেন শক্ত বাঁধনে বাঁধা, ও যেন কড়ে আঙুলটাও নাড়াতে পারছে না। যেন মাকড়সার জালে ধরা পড়েছে মস্ত বড় একটা মাছি। নিজের নগ্ন শরীরে বন্দী এনরির সেই পুরুষ শরীরের ছোঁয়া লীলীর ভালো লাগে। ও যদি ওই রকম ভাবেই থাকতো, পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীর মত, কত ভালো হত। আমি ওর যত্ন নিতাম, শিশুর মত পরিষ্কার করে দিতাম ওর শরীর, ওকে উপুড় করে শুইয়ে ওর পাছায় থাপ্পড় মাবতাম। ওর মা ওকে দেখতে এলে আমি হঠাৎ চাদরটা খুলে দিতাম। ওর মা বোধহয় অজ্ঞান হয়ে যাবে। কেননা অন্ততঃ পনেরো বছর আগে ছেলেকে শেষবার উলঙ্গ দেখেছে ওর মা। লীলী তার স্বামীর পাছায় হাল্কা হাত বুলিয়ে দেয়, আস্তে চিমটি কাটে ওর কুঁচকিতে, এনরি বিড়বিড় করে, অথচ নড়ে না। পুরুষত্বহীন। ‘পুরুষত্বহীন’ শব্দটার কথা ভাবলে লীলীর হাসি পায়। যখন এনরিকে ওর ভালো লাগে, ছোট ছোট বামন লিলিপুটরা এনরিকে বেঁধে রেখেছে, ‘গালিভার্স ট্র্যাভেলস্’ এর পাতায় দেখা ছবির মতন। লীলী কখনও কখনও স্বামীকে ‘গ্যালিভার’ বলে ডাকে। এই নামটা এনরি-র পছন্দ। কারণ ইংরিজী নাম, লীলীর মুখে নামটা শুনলে মনে হয় ও শিক্ষিতা। নামের উচ্চারণে ইংরেজদের মত টান থাকলে আরও খুশী হত এনরি। ঈশ্বর, এসব শুনলে আমার এতো বিরক্তি লাগে। শিক্ষিতা মেয়ে পছন্দ হলে ও জীন বেইদার-কে বিয়ে করতে পারতো। জীনের স্তন দুটো ঝুলে গেছে, কিন্তু ও পাঁচটা ভাষা জানে। আমরা যখন ‘শো-য় থাকতাম, এনরির পরিবারের সবাইকে আমাব এতো খারাপ লাগতো যে আমি যে কোন বই পড়তাম। মুস্কিল হতো, বই পড়ার সময় কেউ না কেউ আমার ওপর নজর রাখতো। ওর ছোট বোন বলতো— ‘তুমি বই পড়ে বুঝতে পারো?’ মুস্কিল হল, আমার স্বামী ভাবে, আমার মধ্যে যথেষ্ট বৈশিষ্ট নেই। ওর মতে, সুইজারল্যাণ্ডের বাসিন্দাদের মধ্যে বৈশিষ্ট্য আছে। কেননা একজন সুইস ভদ্রলোকের সঙ্গে এনরির বড়দিদির বিয়ে হয়েছে এবং ওদের পাঁচটি ছেলেমেয়ে হয়েছে। তাছাড়া সুইজারল্যাণ্ডের পাহাড়গুলোর বৈশিষ্ট্য আছে। আমার ছেলেমেয়ে হলনা আমার শরীরের দোষে ।
লীলী চোখ বন্ধ করে। তার চোখের সামনে ঘুরতে থাকে কয়েকটা নীল রঙের বৃত্ত। কার্নিভালে দেখা দৃশ্যের মত। কাল আমি কল্পনায় ওই বৃত্তগুলোর দিকে রবারের তীর ছুঁড়ছিলাম। প্রত্যেকটা তীর লক্ষ্যে বেঁধার সঙ্গে সঙ্গে ফুটে উঠছিল এক একটা মহানগরের নাম। খেলাটা ও শেষ করতে দিল না। পেছন থেকে আমার নিতম্বে চাপ দেওয়া ওর এক বদভ্যাস। কেউ পেছন থেকে আমায় ছুলে আমার খুব খারাপ লাগে। আমার শরীরের পেছন দিকটা না থাকলেই ভালো হত। যেখানটা আমি দেখতে পাইনা, সেখানটা লোকে ছোঁবে, হয়তো শরীরের খানিকটা অংশ হাতে তুলে নেবে, ওদের হাত দেখা যাবেনা, শুধু হাতের ছোঁয়া টের পাওয়া যাবে—এইসব আমার ভালো লাগেনা। এইসবই ওর পছন্দ। এনরি এসব কথা ভাবেনা। কিন্তু সে খালি আমার পেছন থেকে আমার নিতম্ব ছুতে চায়। আমার এই পেছন দিকটা আছে বলে আমি লজ্জিত।
কিন্তু আমার নিতম্ব ছুলে ওর উত্তেজনা হয়। রিরেইৎ-এর কথা ভাবতে এখন আমার ভালো লাগছে। প্রত্যেক দিন সন্ধ্যায় বিশেষ একটা সময়, যখন এনরি নাক ডাকায়, তখন লীলী রিরেইতের কথা ভাবে। ভাবনাটায় সে বাধা পায়। রিরেইতের সুখের বদলে অন্য কোন সুখ তার মনে ফুটে ওঠে। শক্ত কালো চুলের চকিত ঝিলিক। সে ভাবে, এইবার…….এইবার কি হবে, সে নিজেও জানেনা। কোন কোন রাতে সে চোখ বুঝতে পারেনা। কেননা এইসব ভয়ংকর স্মৃতি মনে আসে। যখন তুমি কোন পুরুষের সবকিছু, বিশেষ করে তার ‘ওই জিনিসটা’ দেখেছো, স্মৃতি ও স্বপ্ন বিশ্রী হতে পারে। এনরিকে আমার অন্য পুরুষের মত খারাপ লাগেনা। এর মাংস নরম, ওর চামড়ার রং ধুসর, শুধু পেটের কাছটা লাগছে।
রিবেইং-এর কথা ভাবলে এখন লীলীর বিরক্তি আসে। রিরেইৎ বলেছিল— ‘লীলী, সুপুরষ-এর চেহারা কেমন হয়, তোমার কোন ধারণা নেই।’ পুরুষ বলতে মেয়েটা বোঝাতে চাইছে পাথরের মত শক্ত ও পেশীবহুল শরীর। ওসব আমার পছন্দ নয়। এনরি আমায় জড়িয়ে ধরলে নিজেকে আমার গুটিপোকার মত নরম লাগে । এনরির শরীর নরম বলেই ওকে আমি বিয়ে করেছি। ওকে খৃষ্টান ধর্মযাজকের মত দেখায় বলেই আমি ওকে পছন্দ করছি। খৃষ্টান ধর্মযাজকদের শরীর কালো গাউন- পরা কোনো মেয়ের মতই নরম। ওরা মেয়েমানুষের মত মোজা পরে। যখন আমার বয়স মোটে পনেরো, আমি খৃষ্টান ধর্মযাজকদের স্কার্ট আস্তে আস্তে তুলে দেখতাম, ওদের শক্ত হাঁটু. ওদের মোজা। ওদের দুপায়ের মাঝখানে ওদের পুরুষাঙ্গ দেখতে আমার মজা লাগতো। এক হাতে গাউন ধরে অন্য হাতে আমি ওদের পা বেয়ে যতোটা সম্ভব উঁচুতে আমার হাত নিয়ে যেতাম। মেয়েদের দুপায়ের মাঝখানের জায়গাটা আমার তেমন পছন্দ নয়। কিন্তু পুরুষের ওটা স্কার্টের নীচে থাকলে খুব নরম লাগে। যেন মস্ত বড় একটা ফুলের মত। মুস্কিল হল, পুরুষের ওই জিনিষটা যখন জীবন্ত প্রাণীদের মত লাফাতে নড়তে শুরু করে, শক্ত হয়ে ওঠে, হাওয়ায় উঁচিয়ে থাকে, আমার ভয় লাগে। ঈশ্বর, এই ভালোবাসা জিনিষটা কি বিশ্রী! আমি এনরিকে ভালোবাসি। কারণ ওর দুপায়ের মাঝখানের ছোট্ট জিনিষটা কখনও শক্ত হয়না, কখনো মাথা তোলেনা। আমি দেখে হাসি। কখনও কখনও ও লজ্জা পায়। বাচ্চা ছেলের ওই জিনিষটা দেখলে আমার যেমন ভয় হয়না, তেমনি এনরির ওই জিনিষটা দেখলে আমার ভয় হয়না । রোজ সন্ধ্যাবেলা আমি ওর ছোট্ট নরম পুরুষাঙ্গটা আঙ্গুলের মধ্যে ধরি। ও লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে, মুখ সরিয়ে নেয়। কিন্তু ওর পুরুষঙ্গটা শক্ত হয়না, আমার হাতের নিয়ন্ত্রণে থাকে। আমি ওটার ওপর চাপ দিইনা, শুধু অনেকক্ষণ ধরে থাকি। এনরি ঘুমিয়ে পড়ে চোখ বুজে সে দেখছে, শক্ত খাড়া কালো চুল। নিগ্রোর মত। যন্ত্রণা গলার কাছে উঠে আসছে। সে শক্ত করে চোখ বন্ধ করে। এবার লীলী দেখতে পায় রিরেইৎ- এর কান। মেয়েমানুষের ছোট্ট কান, লাল আর সোনালীতে মেশানো, মিষ্টি লজেন্সের মত। কিন্তু এখন কানটা দেখে তার আনন্দ হয়না। কারণ রিরেইৎ কি বলেছিল, তার মনে পড়ে যায়। ওর গলার স্বর তীক্ষ্ণ, স্পষ্ট এবং সেই কারণেই লীলীর অপছন্দ। রিরেইং বলেছিল—’পিয়ের-এর সঙ্গে তোমার চলে যাওয়াই বুদ্ধিমতীর মত কাজ হবে। কিন্তু রিরেইৎ যখন নিজেকে বড্ড বেশী গুরুত্ব দেয় ও নিজের যুক্তির স্রোতে ভেসে যায় আমার খারাপ লাগে। আগের রাতে কিছুটা দুঃখিত ও যুক্তিসংযত ভঙ্গীতে রিরেইং বলছিল ‘লীলী, তুমি এনরিকে ভালোবাসোনা। সুতরাং তোমার পক্ষে এনরির সঙ্গে থাকা একটা ক্রাইম।’ এনরির সম্বন্ধে কিছু বলার সুযোগ কখনও ছাড়েনা ওই মেয়েমানুষটা। এটা বিশ্রী ব্যাপার। কেননা এনরি রিরেইতের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে না। হয়ত সত্যিই আমি এখন আর আমার স্বামী এনরিকে ভালোবাসিনা। কিন্তু সে কথা রিরেইৎ আমায় বলবে কেন? ওর কাছে সমস্ত ব্যাপারটা খুবই সরল, নেহাৎই সোজা। তুমি পুরুষকে ভালোবাসো অথবা ভালোবাসোনা। কিন্তু আমি তো অতো সহজ বা সরল নই। পিয়ের রিরেইতের নাম দিয়েছে— ‘মুটকী মিনার্ভা ! নামটা রিরেইতের পছন্দ নয়। লীলী হাসে। কেননা তার মনে পড়ে, একদিন যখন সে শুধু জাঙ্গিয়া পড়ে ছোট ভাই রবারং-এর সামনে দাঁড়িয়েছিল, ভাই বলেছিল – “তোর বগলে চুল কেন, দিদি ?’ লীলী সামনে পোষাক বদলাতে ভালোবাসতো। কেননা ভাই মজার মজার কথা বলতো। কথাগুলো কোথা থেকে ও শিখেছিল, কে জানে। কোন মহিলা আমার হাতে পঞ্চাশ ফ্রাঁর নোট দিয়ে বলে—‘চার্চের চাঁদা দিলাম, সিষ্টার।’ আমি বলি—’ধন্যবাদ, মাদাম। ঈশ্বর তোমায় আশীর্বাদ করবেন। আবার দেখা হবে।’ কিন্তু সত্যিকারের ধর্মযাজিকা হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বাসে আমি কোন পুরুষকে চোখ মারবো। প্রথমে সে খৃষ্টান ধর্মযাজিকাকে চোখ মারতে দেখে অবাক হবে, তারপর আমায় অনুসরণ করবে। তখন আমি পুলিস ডাকবো। পুলিস ওকে অ্যারেষ্ট করবে। চার্চের চাঁদের টাকা আমি নিজে রেখে দেবো। ওই টাকা দিয়ে কি কিনবো ? বিষের প্রতিষেধক ! বোকার মত কিসব ভাবছি ? চোখদুটো আমার বুজে আসছে।
‘তোমার পক্ষে এনরির সঙ্গে থাকা একটা ক্রাইম।’ অন্ধকারে সে লাফিয়ে উঠে বসে, তার চোখদুটোর চাউনি এখন কঠিন। ওরা দুজনে মিলে আমায় যন্ত্রণা দিচ্ছে। পিয়ের বলছে—’তুমি আমার বাড়ী চলো। আমার খারাপ কোন উদ্দেশ্য নেই।’ এবং রিরেইৎ, অন্য লোকেদের সম্বন্ধে যে মেয়ে এত যুক্তিসংযত কথা বলে, তার তো অন্তত বোঝা উচিৎ, আমার সবকিছু ভেবে দেখার সময় চাই। পিয়ের আমার দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে বলছে—তুমি আসবেই। তুমি আসবেই। তুমি আমার বাড়ী আসবে।
আমি তোমায় একা পেতে চাই!’ পুরুষের চোখদুটো দেখলে তখন আমার ভয় লাগে, পিয়ের যেন আমাকে সম্মোহিত করতে চায়, ও আমার বাহু চেপে ধরে, ওর ওইরকম চোখ দেখলেই ওর বুকের চুলের কথা আমার মনে পড়ে যায়, আমার ভয় হয় । তুমি আসবেই। আমি তোমায় একা পেতে চাই।’ এসব কথা ও কিভাবে বলতে পারে ? আমি তো কুকুর নই।
আমি বসলে ও হাসে। পিয়েরের জন্যে আমি আমার পাউডারের ব্র্যাণ্ড, চোখের মেক-আপ বদলেছি। কিন্তু ও আমার মুখের দিকে তাকায় না। পিয়ের আমার স্তনদুটোর দিকে তাকিয়ে আছে। আমার স্তনদুটো যদি শুকিয়ে যেতো, পিয়ের বিরক্ত হতো, বেশ হতো। এমনিতেই আমর স্তনদুটো বড় নয়, বেশ ছোটো ।
‘তুমি নীসে আমার ভিলায় আসবে। ভিলার রং সাদা। শ্বেতপাথরের তৈরী সিঁড়ি। সারাদিন আমরা উলঙ্গ হয়ে থাকবো। উলঙ্গ অবস্থায় সিড়ি বেয়ে উঠে যাওয়া খুব মজার।’
তাহলে আমি পিয়েরকে বলবো, তুমি আমার আগে আগে সিঁড়ি দিয়ে ওঠো। তাহলে ও পেছন থেকে আমায় দেখবে না। ও পেছন থেকে আমার দেখলে আমার একপাও এগুনো হবে না। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে একমনে চাইবো, পুরুষ অন্ধ হয়ে যাক। এমনিতেই পিয়ের আমার দিকে তাকালে আমার মনে হয়, আমি যেন উলঙ্গ হয়ে আছি। ওর যৌনসঙ্গমের ইচ্ছে হলেও মাঝরাতে আমার ঘুম ভাঙাবে। কোন রাতে আমি আমি শান্তিতে ঘুমুতে পারবো না। শুধু মাসিকের সময়টা ছাড়া। কিন্তু কোন কোন মেয়ে নাকি মাসিকের সময়েও ওই কাজটা করে। তারপরে পুরুষের শরীরে রক্তের ছিটে লাগে, বিছানার চাদরেও, সব জায়গায়। কি বিশ্রী! আমাদের এই শরীর না থাকলেই ভালো হত।
লীলী চোখ খোলে। রাস্তা থেকে আলো আসছে। সেই আলোয় পর্দাটা লাল দেখাচ্ছে, আয়নায় রক্তাভ প্রতিচ্ছবি। এই লাল আলো, জানলার ধারে আর্মচেয়ারটার অদ্ভুত ছায়া লীলীর ভালো লাগে। প্যান্ট খুলে চেয়ারের হাতলে ঝুলিয়ে রেখেছে এনরি। ওকে নতুন সাসপেনডার কিনে দিতে হবে। আমি ওকে ছেড়ে যেতে চাইন৷৷ সারা দিন আমাকে চুমু খাবে এনরি। আমি ওর, ও আমাকে দেখবে, ভাববে : ‘এই আমার সুখ।
লীলী এনরিকে লাথি ছোঁড়ে। ওর ঘুম ভাঙাতে চায়। ‘হু’—এনরি বলে। তার ঘুম ভাঙেনা।
এমন যদি হতো, সুন্দর এক যুবকের সঙ্গে পরিচয় হতো আমার, যে যুবক সত্যিকার, কুমারী মেয়ের মতো পবিত্র—আমরা পরস্পরকে ছুতামনা, সমুদ্রের ধারে হাঁটতাম হাত ধরাধরি করে, রাতে আলাদা বিছানায় শুতাম, ভাই-বোনের মত, ভোর অবধি গল্প করতাম ।
রিরেইতের সঙ্গ আমার ভালো লাগতো। মেয়েমানুষ হয়ে মেয়েমানুষের সঙ্গে শোয়া কি সুন্দর। ওর কাঁধ দুটো কেমন মসৃণ, কেমন নরম। রিরেইং যখন ফ্রেইনেইনলকে ভালোবেসে ফেললো, আমার খুব খারাপ লাগতো। একটা পুরুষ ওকেআদর করছে, ওর কাঁধে, উরুতে হাত বোলাচ্ছে,—এসব ভাবতে আমার ভালো লাগতো না। রিরেইৎ যখন পুরুষ শরীরের নীচে সম্পূর্ণ উলঙ্গ, চিৎ হয়ে শুয়ে আছে, পুরুষের হাত ওর মাংস টিপে টিপে দেখছে, রিরেইতের মুখটা তখন কেমন দেখাতো ? আমাকে লাখ টাকা দিলেও আমি আর রিরেইংকে ছোঁবোনা। ও যদি চায়, ও যদি বলে, ‘সেই কাজটা আমার সঙ্গে করো,’ আমি কি করবো, কি জানি। আমি যদি নিজে অদৃশ্য থেকে দেখতে পেতাম, পুরুষ রিরেইতের সঙ্গে ওই কাজটা করছে, তখন যদি ওর মুখ দেখা যেতো—তখনো কি ওর মুখটা মিনার্ভার মত মনে হবে—ও হাঁটু দুটো আস্তে আস্তে সরাচ্ছে টোকা দিচ্ছে, শীৎকারের মৃদু শব্দ করছে রিরেই .. এনরির নাক ডাকছে। লীলী চটে ওঠে। আমি ঘুমুতে পারছি না আর উজবুকটা নাক ডাকাচ্ছে। ও যদি এখন আমায় জড়িয়ে ধরে বলতো–‘লীলী, তুমি আমার, আমি তোমায় ভালোবাসি, তুমি আমায় ছেড়ে যেওনা’…হ্যাঁ, আমি ওর জন্যে আত্মত্যাগ করতাম, আমি থেকে যেতাম, ওকে আনন্দ দেওয়ার জন্যে সারাজীবন ওর সঙ্গে থাকতাম…
→ দুই কাফের উঁচু সমতল ছাদ। এক গ্লাস পোর্ট-এর অর্ডার দেয় বিবেইং । সে ক্লান্ত । লীলীর ওপর তার রাগ হয় । রোগা কুঁজো এক ছোকরা অনেকক্ষণ ধরে রিরেইং-এর দিকে তাকিয়ে আছে।
রিরেইৎ কাঁধ ঝাঁকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়। মেয়েদের দিকে চোখ মারবার আগে ছোকরার অন্ততঃ আণ্ডারউইয়্যার বদলানো উচিত। লীলী এখনও আসছে না কেন ? লীলী এনরিকে ছেড়ে যেতে চায় না। আমার মনে হয়, এটা বোকামি। ধ্বজভঙ্গ একটা পুরুষের জন্যে কোন মেয়ের নিজের জীবনটা নষ্ট করা উচিত নয়। শরীরের দিক থেকে পুরুষত্বহীন পুরুষদের ঘেন্না করে রিরেইৎ। সে ভাবে, লীলীর উচিত এনরিকে ছেড়ে যাওয়া। লীলী, তোমার সুখ নিয়ে তোমার জুয়ো খেলার কোন অধিকার নেই। কথাটা ওকে অন্ততঃ একশবার বলেছি। কেউ সুখী হতে না চাইলে তাকে জোর করে সুখী করা যায় না। রিরেইতের মাথাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে । বড্ড ক্লান্ত। গ্লাসে পোর্টটা চিটচিট গুড়ের মত। তার শরীরের অন্তরালে কে যেন বলে—‘সুখ, সুখ।’ পৃথিবীটা যেন স্তব্ধ! শান্ত, নরম। প্যারী-সোয়ার’ পত্রিকায় যদি একটা প্রতিযোগিতা হয়—ফরাসী ভাষায় সবচেয়ে সুন্দর শব্দ কি? সে লিখতো ‘সুখ’। আর কেউ বোধহয় ওরকম ভাবতো না। ওরা লিখতো, ‘সাহস’ ও ‘শক্তি’। কিন্তু ওরা পুরুষ, ওরা বোঝেনা। দুটো পুরষ্কার থাকা উচিত। একটা মেয়েদের জন্যে। একটা পুরুষদের জন্যে। পুরুষ লিখতো, সবচেয়ে সুন্দর শব্দ ‘সম্মান’। মেয়েদের বিভাগে আমি জিততাম, লিখতাম, সবচেয়ে সুন্দর শব্দ ‘সুখ’। সম্মান ও সুখ। আমি লীলীকে বলবো, তোমার সুখ এভাবে নষ্ট করার কোন অধিকার তোমার নেই। তোমার সুখ, লীলী তোমার সুখ। ব্যক্তিগতভাবে, আমার ধারণা, তোমার প্রেমিক পিয়ের ভালোমানুষ, সত্যিকারের পুরুষ, বুদ্ধি আছে, পয়সা আছে, তোমার জন্যে সে সবকিছু করতে পারে। জীবনের ছোটখাট ঝামেলাগুলো কিভাবে সরাতে হয় সে জানে।
ঘড়িতে এগারোটা বেজে কুড়ি মিনিট। লালীকে আমি বুঝতে পারি না। ওর মেজাজ আমার কাছে দুর্বোধ্য। পুরুষদের ও পছন্দ না অপছন্দ করে, আমি ঠিক বুঝতে পারি না। পিয়েরকে নিয়ে এর খুসী হওয়া উচিত। অন্ততঃ গতবছর যে পুরুষ বন্ধুটা ও জোগাড় করেছিল, তার থেকে ভালো। তার নাম ছিল রাধীং, আমি বলতাম রেইবীং।
রিরেইং হাসি চাপে। কাফের সেই ছোকরা এখনও তাকে দেখছে। সে মুখ ঘোরাতে ছোকরা অবাক হয়। রাবীং-এর মুখে ছিল অজস্র ব্রন। লীলী নখ দিয়ে ওর মুখের ব্রণ গেলে দিল। বিচ্ছিরি ব্যাপার। কিন্তু লীলীর দোষ নেই। সুপুরুষ কেমন দেখতে হয় সে জানেনা। গত বছরে যে পুরুষ বন্ধু লুই রিরেইৎকে ছেড়ে গেছে, তার কথা মনে পড়ে যায় রিরেইতের। লুই নিজেকে ভালোবাসতো, এর কিছু কিছু ছোটখাট বাতিক ছিল, সোনার আংটি আর সিগারেট কেস, নানা রকম ছোটখাট ম্যানিয়া…কিন্তু এধরণের পুরুষ নিষ্ঠুর হতে পারে, মেয়েদের থেকেও নিষ্ঠুর। সবথেকে ভালো চল্লিশের কাছাকাছি বয়সের পুরুষ, যে শরীরের যত্ন নেয়, যার জুলফিতে পাক ধরেছে, ব্যাকব্রাশকরা শুকনো চুল, চওড়া কাঁধ, অ্যাথলিটের মত চেহারা—জীবন সম্বন্ধে যার অভিজ্ঞতা আছে, যে যন্ত্রণার অর্থ জানে। লীলীর বয়স কম, আমার মত বান্ধবী পেয়েছে—ওর ভাগ্য ভালো। কেননা লীলীর ব্যবহারে ক্রমশঃ ক্লান্ত হয়ে উঠছে ওর বয়-ফ্রেণ্ড পিয়ের। আমার জায়গায় অন্য কোন মেয়ে হলে এই পরিস্থিতির সুযোগ নিতো। আমি পিয়েরকে ধৈর্য্য ধরতে বলি। পিয়ের আমার দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে বুঝেও না বোঝার ভান করি আমি, লীলীর সম্বন্ধে ভালো ভালো কথা বলি। আমার মত বান্ধবী থাকা কতো বড় সৌভাগ্য, বোঝেইনা লীলী। লুই আমায় ছেড়ে যাওয়ার পর আমার যে অবস্থা হয়েছিল, সেই রকম লীলীর হলে তবে ও বুঝতো।
ঘড়িতে সাড়ে এগারোটা বাজছে। লীলী আধ ঘন্টা দেরী করেছে। এটা স্বাভাবিক। স্বামীকে ছেড়ে যাওয়ার সময় নেই লীলীর। আসলে সম্রান্ত সচ্চরিত্র সেজে থাকার ধান্দাতেই ও এনরির সঙ্গে জীবন বাচাচ্ছে। ও এনরিকে ঠকাচ্ছে অন্য পুরুষের সঙ্গে মিশছে, কিন্তু ওরা যেহেতু তাকে ‘মাদাম’ বলে ডাকে। অতএব এসবে তার কিছু এসে যায় না। স্বামী এনরির বিরুদ্ধে লীলী আজ হয়তো একটা কথা বললো। কাল আমি যদি সেই কথাটাই আবার বলি, ও জ্বলে উঠবে। আমি তো আমার যথাসাধ্য করেছি। যা কিছু ওকে বলা দরকার, যত খারাপই হোক, আমি বলেছি।
কাফের সামনে ট্যাক্সি থামে। বড় একটা ব্যাগ হাতে নামে লীলী। ওর মুখটা গম্ভীর। আমি এনরিকে ছেড়ে এলাম—’
‘সে কী? তার মানে –
হ্যাঁ, সব শেষ, আমি আর ওর সঙ্গে থাকবো না।’
সুখবর। তোমার সাহস আছে।
কাজটা খুব শক্ত নয়, ওর বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল। বললো না। কেননা লীলী প্রশংসা ভালোবাসে। ও গালে রুজ লাগিয়েছে। ওর চোখ দুটো উজ্জ্বল, চামড়ার তৈরী ট্র্যাভেলিং ব্যাগটা নামিয়ে রেখে ও বসে। পরণে ধুসর রঙের পশমী কোট, চামড়ার বেল্ট, হাই–কলার, হাল্কাহলুদ রং সোয়েটার। অন্যায় করেছে, অথচ মজাও পাচ্ছে—এমন একটা ভাব। মেয়েটা প্রাণশক্তিতে ভরপুব। ওর সম্বন্ধে এটাই আমার ভালো লাগে।
‘এনরিকে সোজাসুজি বলে দিলাম, ওর সম্বন্ধে আমার কি ধারণা। ও বোবা হয়ে গেছে।’
‘বুঝতে পারছি না, হঠাৎ তোমার হল কি, ডার্লিং। কাল সন্ধ্যায় আমি তো বাজি ফেলতে পারতাম যে তুমি কোনদিন তোমার স্বামীকে ছেড়ে যাবে না— ‘এসব আমার ছোট ভাইয়ের জন্যে। এনরি আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে আমি সহ্য করেছি। কিন্তু আমার পরিবারের কারো সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে আমি কিভাবে সহ্য করবো ?’
‘ঘটনাটা কিভাবে ঘটলো?”
“ওয়েটার কোথায়? এখানে সময়মত ওয়েটার পাওয়া যায় না। সেই বাদামী চুল ওয়েটার তো?
“হ্যাঁ। তুমি কি জানো, ও আমার জন্যে পাগল ।’
“তাহলে তুমি ওয়াশরুমের মেয়েটির সম্বন্ধে সাবধান থেকো। ও মেয়েটির দিকে নানারকম ইঙ্গিত করে। আসলে বোধহয় মেয়েরা টয়লেটে ঢুকছে, তাই দেখার ধান্দা। টয়লেট থেকে কোন মেয়ে বেরিয়ে এলে এমনভাবে তাকায় যে লজ্জা
লাগে। ভালো কথা, আমি এখুনি যাবো। পিয়ের-এর কাছে ফোন করবো। এর মুখটা কেমন হয়ে যাবে বলোতো। ওয়েটার এলে আমার জন্যে কাফেক্রেইম- এর অর্ডার দিয়ো। এক মিনিট, তারপর তোমায় সব বলবো।’
লীলী চলে যেতে রিরেইৎ ভাবে, ও শেষ পর্যন্ত স্বামীকে ছেড়ে যেতে পারবে, আমি কোনদিন ভাবিনি। কয়েক মিনিট পরে ফিরে এসে লীলী বলে—
‘পিয়ের তো একেবারে চমকে গেছে। ও বিশদভাবে ব্যাপারটা শুনতে চাইছিল। আমি বললাম, পরে সব বলবো। আজ ওর সঙ্গে লাঞ্চ খাবো। ও বললো, কাল রাতে আমরা প্যারী ছেড়ে যেতে পারি।’
‘লীলী, আমি খুব খুসী হয়েছি। আচ্ছা, তুমি কি তাহলে কাল রাতেই মনস্থির করেছিলে?”
‘তুমি তো জানো, ওসব মনস্থির করা, সিদ্ধান্ত নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আপনা থেকেই সব ঠিক হয়ে গেল। ওয়েটার, ওয়েটার। ঈশ্বর, লোকটা এতো জ্বালায়। আমার জন্যে কাফে-ক্রেইম নিয়ে এসো।’
রিরেইৎ স্তম্ভিত হয়ে যায়। লীলীর জায়গায়, এই ধরণের একটা পরিস্থিতিতে সে নিজে হলে কখনোই এই মুহূর্তে ‘কাফে-ক্রেইম’ নিয়ে মাথা ঘামাতো না। লীলীকে তার ভালো লাগে। কিন্তু কোন কোন মুহূর্তে লীলী তুচ্ছ, অসার, নিরর্থক — পাখীর মতন।
লীলী হেসে বলে—“তুমি যদি এনরির মুখটা দেখতে!’
‘তোমার মা কি বলবে, ভেবে দেখেছো?’
“মা খুশী হবে। মা-র সঙ্গেও অভদ্র ব্যবহার করেছে এনরি। মায়ের ধৈর্য্যের বাধ ভেঙেছিল। এনরি প্রায়ই অভিযোগ জানাতো, মা নাকি আমায় ঠিক মতো মানুষ করেনি। আমি গাঁয়ের খামার বা গোলাবাড়ীতে মানুষ হয়েছি। আমি যা করেছি, তা কিছুটা মায়ের জন্যেও—
‘ঘটনাটা কি ঘটেছিল ?”
ও আমার ছোট ভাই রবারকে থাপ্পড় মেরেছিল।’
‘রবারৎ তোমার বাড়ী গিয়েছিল?”
‘হ্যাঁ। মা চায়, ও গঁপেইজ-এর ওখানে অ্যাপ্রেনটিস হবে। যাওয়ার পথে আজ সকালে আমার বাড়ী এসেছিল রবারৎ। তখন আমরা ব্রেকফাষ্ট খাচ্ছি। এনরি আমার ছোট ভাইকে চড় মারলো।’
‘কিন্তু কেন?’ বিরেইৎ একটু বিরক্ত হয়। লীলীর গল্প বলার ধরণটা তার পছন্দ নয়।
‘ওদের মধ্যে তর্ক বেঁধেছিল। আমার ভাই অপমান সহ্য করার বান্দা নয়।
সে রুখে দাঁড়িয়ে এনরিকে মুখের ওপর বললো—ওল্ড অ্যাশহোল। ‘এনরি বলছিল, আমাদের নাকি ঠিকমত মানুষ করা হয়নি। আমার মনে হচ্ছিল, আমি হাসতে হাসতে মরেই যাবো। হঠাৎ এনরি উঠে দাঁড়ালো এবং আমার ভাইকে চড় মারলো । তখন আমার এনরিকে খুন করতে ইচ্ছে হচ্ছিল – ‘
‘ভালো কথা। তোমার স্বামী এনরি তোমার ছোট ভাই রবারৎকে চড় মারলো। তারপর কি হল?”
‘তারপর আমি আমার স্বামী এনরিকে ব্যালকনিতে আটকে ফেলে চাবি বন্ধ করে দিলাম। ওর পরণে শুধু পায়জামা। ও জানলায় টোকা মারছে কিন্তু কাচ ভাঙতে সাহস করছে না। আসলে ও হাড়কঞ্জুস! আমি হলে সব ভেঙে তছনছ করে দিতাম। তাতে আমার হাত কাটলেও থামতাম না। ইতিমধ্যে টেক্সিয়াররা বেড়াতে এসেছে আমাদের বাড়ী। কাচের আড়াল থেকে এনরি এমনভাবে হাসছিল যেন গোটা ব্যাপারটাই একটা রঙ্গরসিকতা।’
এই সময় ওয়েটার পাশ দিয়ে যেতেই লীলী তার হাত ধরে টেনে বলে— ‘ওয়েটার, আমার জন্যে কাফে ক্রেইম নিয়ে এসো।’
নীচুস্তরের মানুষের সঙ্গে কিভাবে কথা বলতে হয়, লীলী জানেনা। কখনো বেশী অন্তরঙ্গতা দেখায়, কখনো বা বেশী মেজাজে কথা বলে। এজন্যে একটু বিরক্ত হয় রিরেইং। লীলী কিন্তু হাসতে শুরু করেছে।
‘আমি হাসছি কেন জানো? আমি এখনো যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি কিভাবে এনরিকে ব্যালকনিতে রেখে আমি দরজার তালা বন্ধ করে দিলাম। কি ভাবে করলাম যেন? ও তো রান্নাঘরে, আমার ভাই ছোট রবাৎ কাঁদছে আর ওকে ভারিক্কী উপদেশ দিচ্ছে এনরি। একটা ট্যাক্সি চাপা দিয়েছে ফুলওয়ালীকে। তাড়াতাড়ি ব্যালকনিতে ছুটে বের হয়ে এল এনরি। ফুলওয়ালী জাতে সুইস, ওকে খুব পছন্দ করে এনরি, ওর ধারণা; ফুলওয়ালী ওকে ভালোবাসে। আমি চুপচাপ ঘরের ভেতর যেয়ে ব্যালকনির জানলা বন্ধ করে কাচের ওপার থেকে চেঁচিয়ে বললাম—আমার ভাইয়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার এই শাস্তি। ব্যালকনিতে এক ঘন্টা রইল এনরি। কাঁচের আড়াল থেকে আমাকে ও রবারৎকে গোল গোল চোখে দেখছিল এনরি। ‘আসলে এনরি এখন ব্যালকনিতে, বন্ধ জানলার ওপারে। কি মজা !’ রিবেই হাসিতে ফেটে পরে।
লীলী হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে বলে, ‘আমার ভয় হলো শেষে এনরির না ঠাণ্ডা লেগে যায়। আগে রাগের মাথায় এসব খেয়াল করিনি।
ও আমাদের দিকে ঘুষি দেখাচ্ছিল, অনর্গল কথা বলছিল। যদিও এনরির অর্ধেক কথাই আমরা শুনতে পাইনি। তারপর আমার ছোট ভাই রবারৎ চলে গেল। ঠিক তারপর টেক্সিয়ার্সরা কলিং বেল টিপতে গুদের ভেতরে আসতে দিলাম । ওদের দেখে কাচের ওপার থেকে হাসলো ও অভিবাদন জানালো এনরি। আমি ওদের বললাম, দ্যাখো, আমার স্বামী এনরি ডার্সিংকে এখন অ্যাকোরিয়মে বন্দী মাছের মত দেখাচ্ছে। ওরা ভেতরে ভেতরে অবাক হলেও মুখে কিছু বললো না।’ ‘আমি কল্পনায় সব দেখতে পাচ্ছি। হা হা! ব্যালকনিতে তোমার স্বামী, রান্নাঘরে টেক্সিয়ার্স দম্পতি—’
তারপর আমি জানলা খুলে দিতে এনরি ভেতরে এসে ওদের সামনে আমায় চুমু খেল, ভাঁড়ামির জন্যে ঠাট্টা করে বললো- আমার বউ আমার সঙ্গে ফাজলামি করছিল।’ সবাই হাসলাম। কিন্তু ওরা চলে যেতে এনরি আমার কানে ঘুষি মারলো। আমিও ব্রাশটা তুলে ওর ঠোটের কোনে মারলাম। ওর ঠোটটা ফেটে গেল।’
‘বেচারা মেয়ে!’
‘তারপর আমি ওর মুখটা ধুয়ে তোয়ালে দিয়ে মুছে দিয়ে বললাম, এসব আমার আর ভালো লাগছে না, আমি এনরিকে আর ভালোবাসিনা এবং এনরিকে আমি চিরতরে ছেড়ে যাচ্ছি। এনরি কাঁদতে লাগলো। ও বললো, ও আত্মহত্যা করবে। কিন্তু ওসবে আর কাজ হবে না। তোমার মনে আছে, রিরেইং, গত বছর রাইনল্যাণ্ডে আমাদের ঝগড়ার সময়ে আমার স্বামী বলেছিল; বিশ্বযুদ্ধ বাঁধতে চলেছে, আমি সেনাবাহিনীতে নাম লেখাবো, যুদ্ধে মরে যাবো, তখন তুমি দুঃখ পাবে। আমি তখন বলেছিলাম : খুব হয়েছে, তুমি ধ্বজভঙ্গ, পুরুষহীন পুরুষদের সেনাবাহিনীতে নেওয়া হয় না। যাই হোক, এবার এনরি আমায় বান্নাঘরে তালাবন্ধ করে রাখবে বলছিল। তাই ওকে নিশ্চিন্ত করার জন্য বললাম, এক মাসের মধ্যে আমি যাচ্ছি না ।
তখন আমার স্বামী অফিসে গেল। কেঁদে কেঁদে ওর চোখ দুটো লাল, ফাটা ঠোটে এক টুকরো কাপড় সেঁটে আছে—ওকে ভালো দেখাচ্ছিলনা। আমি ঘরের কাজকর্ম করলাম, মুসুর ডাল ষ্টোভে বসালাম, ব্যাগটায় জিনিষপত্র ভরে রান্নাঘরের টেবিলে চিঠি রেখে চলে এলাম—’
“চিঠিতে কি লিখে এসেছো ?”
‘লিখলাম, ষ্টোভে মুসুর ডাল গরম করা রইলো। খেয়ে নিও। গ্যাস বন্ধ করে দিও। আইসবক্সে শুয়রের মাংস আছে। আমার অসহ্য লাগছে। আমি চলে যাচ্ছি।
.. বিদায়। ওরা দুজনেই হেসে উঠলো।
লীলী উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমি এখন যাই। দুপুরে পিয়েরের সঙ্গে দেখা হবে। ব্যাগটা কোথায় রেখে যাবো?”
‘এখন আমার কাছে থাক। আমি লেডিজ রুমের ওই মেয়েটির কাছে রেখে দেবো। কখন তোমার সঙ্গে যাবো ?’
দুটো নাগাদ তোমার ওখানে যাবো। অনেক ছোটখাট কাজ বাকী। অর্ধেক জিনিষ নেওয়াই হয়নি। পিয়েরের কাছে টাকা চাইবো।’
লীলী চলে যাবার পর ওয়েটারকে ডাকে রিরেইং। লীলীর মধ্যে যে বিষণ্ণতা ও গাম্ভীর্য্য এ ধরণের পরিস্থিতিতে থাকার কথা দুজনের হয়ে হাবভাবে সেটা ফুটিয়ে তুলেছে রিরেইত। ওয়েটার ছুটে আসে। রিরেইৎ লক্ষ্য করেছে, ও ডাকলেই এই ওয়েটার ছুটে আসে।
‘কাল সন্ধ্যাব আগে এইসব রা ভাদামে হতেইল দী থেয়াতর-এ পাঠাবেন।’— মেজাজে ক্যাশিয়াবকে বললো লীলী, তারপর রিরেইং-এর দিকে ফিরে —কাজ শেষ। এবার চলো।’
‘নামটা বসলেন না?’ ক্যাশিয়ার বলে। ‘ম্যাদাম লুসিয়েন ক্রিসপ্যা’।
কোট কাঁধে ফেলে একরকম ছুটে সামারিটার চওড়া সিঁড়ি বেয়ে নামছে লীলী।
তাকে অনুসরণ করে রিরেইৎ। লীলীর চলার সঙ্গে তাল রাখা ওর পক্ষে শক্ত। কেননা ওর চোখ ওর বান্ধবীর রোগা শরীরের সিল্যুট ছায়ার দিকে—নীল ও হাল্কা হলুদ পোষাক পরা ছায়াটা নেচে নেচে এগিয়ে চলেছে—সত্যিই, লীলীর শরীর কেমন যেন অশ্লীল। …যখনই পেছন থেকে কিম্বা প্রোফাইলে লীলীকে দেখে রিরেইং, তার মনে হয়, ওর শরীর কেমন যেন অশ্লীল। ওব শরীর রোগা ও নমনীয়, খারাপ কিছু নয়, তবুও। হয়তো লীলী নিজের শরীরটা প্রকট করে তোলার চেষ্ঠা করে। ও বলে, নিজের নিতম্বের জন্যে ওর নাকি লজ্জা হয়। অথচ ও এমন সব স্কার্ট পরে যা পাছার দিকটায় আঁটসাঁট। ওর পাছা দুটো আমার চেয়ে ছোট অথচ আমার পাছার তুলনায় লোকের নজরে বেশী আসে। কেননা পাছা দুটো গোলগাল, স্কার্ট উপছে পড়তে চায়, পিঠটা রোগা বলে বেশী নজরে আসে। তাছাড়া লীলী পাছা দুলিয়ে হাঁটে।
লীলী ফিরে তাকায়। দুজনেই হাসে। রিরেইৎ ভাবে ওর বান্ধবীর অশ্লীল শরীরের কথা—পাপের প্রতি আসক্তি এবং অবসাদ যেখানে মিশে আছে। স্তনদুটো শক্ত, ছোট মসৃন পালিশকরা মাংস, হলুদ, টিপলে মনে হয় যেন রবার। দীঘল উরু। সাধারণ, দীঘল শরীর। কিন্তু দীঘল পা দুটো নিগ্রো রমনীর শরীরের মত। নিগ্রো রমণী যখন রূম্বা নামের কিউবান-নিগ্রো-লোকনৃত্য নাচে ঠিক তেমনি। রিভলবিং ডোরেব আয়নায় রিরেই-এর নিজের শরীরের ছায়া দেখা যায় ।
আমার শরীর অ্যাথলীটের মত। পোষাক পরলে লীলীকে ভালো দেখায়। উলঙ্গ হলে আমাকে বেশী ভালো দেখায় !
ওরা খানিকক্ষণ চুপচাপ থাকে। তারপর লীলী বলে—পিয়ের খুব ভালো। তুমিও খুব ভালো। তোমাদের দুজনের কাছেই আমি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। একটু যেন আড়ষ্টভাবে কথা বলছে লালী। রিরেইৎ জানে, অন্যকে ধন্যবাদ দিতে অভ্যস্ত নয় লীলী, সে বড্ড লাজুক।
“ওঃ, আমাকে একটা ব্রা কিনতে হবে।’
‘এখানে?’
‘না, আমি ফিশেইর-এর দোকানে ব্রা কিনি।’
‘ব্যুলেইভার্স মংপারনাস্-এ? দ্যাখো, লীলী, ওখানে এখন না যাওয়াই ভালো ।
এনরির সঙ্গে দেখা হলে ঝামেলা বাড়বে।’
‘এনরি? কেন?’
‘লীলী, তুমি যখন কোন কিছু পছন্দ করোনা, তার অস্তিত্বও তুমি স্বীকার করতে চাওনা। যেহেতু তুমি ফিশেইর-এর দোকানে ব্রা কিনতে চাও, এনরি যে বাড়ী ফেরার সময় রোজ সন্ধ্যে ছটায় ব্যুপেইভার্দ মৎপারনাসে আসে, তুমি তা অস্বীকার করছো… ‘এখন মোটে পাঁচটা বাজে। তাছাড়া এমনও তো হতে পারে যে ও আজ আর অফিসে যায়নি। আমার চিঠি পেয়ে হয়তো…..
‘কিন্তু লীলী, অপেরা-র কাছে ফিশেইর-এর অন্য একটা ব্রাঞ্চ আছে, রী দী কীয়াতর সেইপতেইমবর–এ।’ ‘হ্যাঁ, কিন্তু অনেকটা দূর?’
‘মোটে দু’মিনিটের রাস্তা, মৎপারনাসের থেকেও কাছে।’
‘ওদের জিনিষ আমার অপছন্দ।’ রিরেইৎ মজা পেয়ে ভাবে; দুটো দোকানে একই জিনিষ পাওয়া যায়।
কিন্তু লীলীর একগুয়েমি গেলনা। এখন এনরির সঙ্গে দেখা হওয়া বাঞ্ছনীয় নয় জেনেও সে ঝুঁকি নিচ্ছে।
‘বেশ, ওর সঙ্গে দেখা হলে হবে। ও তো আর আমাদের খেয়ে ফেলবে না।’ লীলী পায়ে হেঁটে যাবে। কেননা তার হাওয়া খাওয়া দরকার! অগত্যা ওর
সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে ওর বয়ফ্রেণ্ড পিয়ের-এর গুণগান করে রিরেইং। কিন্তু পীলী বলে- ‘প্যারী আমার বড় ভাল লাগে। প্যারী ছেড়ে যেতে মনটা বড় খারাপ লাগবে।’ ‘থামো, লীলী। আমি কোথায় ভাবছি, তোমার ভাগ্য কতো ভাল, তুমি নীসে যাচ্ছো। আর তুমি কিনা বলছো, প্যারী ছেড়ে যেতে মনটা বড় খারাপ লাগবে।”
লীলী জবাব দেয় না। সে ডাইনে-বায়ে তাকাচ্ছে। কি যেন খুঁজছে।
ফিশেয়ারের দোকানে ব্রা কিনে বার হতে ছ’টা বাজে। লীলীর হাত ধরে তাড়াতাড়ি হাঁটার চেষ্টা করে তার বান্ধবী। লীলী কিন্তু ফুলওয়ালা বোহম্যান-এর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বলে— দ্যাখো, রিরেইং, আজালেইরাগুলো কি সুন্দর। আমি বড় ঘরে থাকলে ঘরে এই গাছের টব রাখবো।’
‘টবের গাছ আমার ভালো লাগে না।’
রিরেইৎ খুবই বিরক্ত হয়ে উঠছে। আশংকিত চোখে সে রী দা-রেইনেই-এর দিকে তাকায় এবং এনরির প্রকাণ্ড নির্বোধ শিল্যুট ছায়া এক মিনিট পরে দেখা যায়। তার মাথায় টুপি নেই, পরণে বাদামী রঙের ট্যুইড স্পোর্টস কোট । —ওই দ্যাখো লীলী—
‘কোথায়, এনরি কোথায় ? ”
‘আমাদের পেছনে। রাস্তার উল্টো দিকে। তাড়াতাড়ি চলো। পেছনে তাকিওনা।’ পেছনে তাকিয়ে লীলী বলে, ‘দেখেছি।’
‘এনরিও বোধহয় আমাদের দেখেছে। ভগবানের দোহাই, লীলী, আর পেছনে তাকিওনা। ডানদিকে রী দেইলাব্র—আমরা ওই রাস্তা ধরে ছুটবো।
ওরা অন্য পথিকদের ধাক্কা দিয়ে জোরে হাঁটে। কখনও লীলী পিছিয়ে পড়ছে। কখনও আবার রিরেইং। কিন্তু রী দেইলাব্র-র কোণে পৌঁছুবার আগেই রিরেইং দেখে, এখন লীলীর পেছনে হাঁটছে বাদামী রঙের একটা ছায়া। এনরির ছায়া। রাগে কাঁপছে রিরেইৎ। নিজের ভুল বুঝতে পেরে মুখ নীচু করে হাঁটছে লীলী। ওকে দেখলে এখন চতুর ও দৃঢ় সংকল্প বলে মনে হয়। কিন্তু এখন ওর পালা, বড় দেরী হয়ে গেছে।
আমরা এমন ভাব দেখাবো, যেন ও এখানে নেই। রিরেই ভাবে। যেন ওর অস্তিত্বই নেই। কিন্তু আড়চোখে এনরির দিকে না তাকিয়ে পারছেনা রিরেইং। লোকটার মুখ কাফনের মত সাদা, চোখের পাতা প্রায় বোজা। যেন ঘুমের মধ্যে হাঁটছে এনরি, আতংকিত হয়ে ভাবে রিরেইৎ। এনরির ঠোটদুটো এবং নীচের ঠোঁটের কাটা জায়গায় সাঁটা লালচে রঙের গজের টুকরোটা কাঁপছে। এবং এনরির নিঃশ্বাসের সেই নিয়মিত ভারী শব্দে এখন মিশেছে একটা অনুনাসিক সুর। রিরেইতের খারাপ লাগে। এনরিকে সে ভয় পায়না। কিন্তু অসুস্থতা ও ভাবাবেগকে একটু ভয় পায়। একটু পরে হাত বাড়িয়ে লীলীর হাত ধরে এনরি। লীলী মুখ ; একটু বিকৃত করে। যেন সে এক্ষুণি কেঁদে ফেলবে। সে কেঁদে ওঠে, হাত ছাড়িয়ে নেয়।
ফুঃ!’—এনরি বলে।
থামবার একটা উন্মাদ বাসনা জাগে রিরেইতের, তার শরীরের পাশে ব্যথা লাগছে, দু কানে ভোঁ ভোঁ শব্দ হচ্ছে। কিন্তু লীলী প্রায় ছুটছে। লীলী ও যেন ঘুমের মধ্যে হাঁটছে। রিরেইতের মনে হয়, ও যদি এখন লীলী-র হাত ছেড়ে দেয়, লীলী ও এনরি পাশাপাশি ছুটতে থাকবে—
নীরব, ফ্যাকাশে, চোখ বন্ধ দুজনের, মরার মত….
এনরি যেন অপরিচিত ভারী গলায় বলে— ‘আমার সঙ্গে ফিরে চলো।’ লীলী কোন জবাব দেয় না। একই রকম স্বরে এনরি বলে—’তুমি আমার স্ত্রী। আমার সঙ্গে ফিরে চলো।’
“ভগবানের দোহাই, লীলীকে একা থাকতে দাও’— তীক্ষ্ণ স্বরে বলে রিরেইং। ‘এনরি, তুমি তো বুঝতে পারছো, ও ফিরে যেতে চায়না।’
রিরেইতের কথা যেন শুনতেই পেলনা এনরি। সে বলে- আমার স্ত্রী । আমি চাই, আমার সঙ্গে ও ফিরে যাক।’
এখন সে লীলীর হাত ধরেছে। লীলী হাত সরিয়ে নেয় না।
‘তুমি যাও, এনরি’—রিরেইং বলে।
“যাবোনা। ও যেখানে যাবে, আমি ওর পেছন পেছন যাবো। আমি চাই, ও আমার সঙ্গে বাড়ী ফিরে যাবে।’
হঠাৎ দাঁতমুখ খিঁচিয়ে সমস্ত শক্তি দিয়ে চীৎকার করে ওঠে এনরি— ‘তুমি আমার !’
কিছু লোক ফিরে তাকায়, হেসে ওঠে। এনরি লীলীর হাত ধরে টানে, মুখ বিকৃত করে জন্তুর মত গর্জন করে।
ভাগ্য ভালো, খালি একটা ট্যাক্সি পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। রিরেই হাত নাড়তে ট্যাক্সি থামে। এনরিও থামে। লীলী হেঁটে এগিয়ে যেতে চায়। কিন্তু ওর এক হাত ধরেছ ওর বান্ধবী রিরেইৎ, আর এক হাত ধরেছে ওর স্বামী এনরি।
‘এনরি, তোমার বোঝা উচিত, গায়ের জোরে তুমি লীলীকে ফিরে পাবেনা লীলীর হাত ধরে ট্যাক্সির দিকে টানে রিয়েইং।
‘ওকে ছেড়ে দাও। আমার স্ত্রীকে ছেড়ে দাও’—লীলীর অন্য হাত ধরে উল্টোদিকে টানে এনরি।
মাঝখানে লীলী, তার শরীর লন্ড্রি-ব্যাগের মতন শিথিল ।
‘তোমরা ট্যাক্সিতে উঠবে না উঠবে না?”
ট্যাক্সি ড্রাইভার জানতে চায় ।
লীলীর হাত ছেড়ে এনরির হাতে ঘুসির পর ঘুসি মারছে রিরেইং। কিছু যেন টের পাচ্ছেনা এনরি। একটু পরে সে লীলীর হাত ছেড়ে বোকার মত তাকিয়ে
থাকে রিরেইতের দিকে। রিরেইতও তাকায়। তার খারাপ লাগে। একটু সময় ওরা পরস্পরের চোখের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয়। তারপর রিরেইংই প্রথম সম্বিত ফিরে লীলীর কোমর ধরে টেনে ওকে ট্যাক্সিতে উঠিয়ে নেয়। ‘কোথায় যাবে?’—ট্যাক্সি ড্রাইভার জনতে চায় ।
এনরিও ট্যাক্সিতে ওঠার চেষ্টা করছিল। সমস্ত শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ওকে সরিয়ে তাড়াতাড়ি ট্যাক্সির দরজা বন্ধ করে রিরেইং ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বলে— ‘গাড়ী চালাও। কোথায় যাবো, পরে বলছি।’
ট্যাক্সি ষ্টার্ট দিতেই পেছনের সীটে গা এলিয়ে দেয় রিরেইং। কি বিশ্রী, কি কুৎসিৎ এই সব! সে ভাবে। লীলীর ওপর তার ঘেন্না হয়।
‘লীলী, কোথায় যাবে তুমি? পিয়েরের ঠিকানায় নামিয়ে দেবো তো!’ লীলী কোন জবাব দেয়না। রিরেইং ঝুঁকে বলে— ‘১১ নম্বর রী মেসিনে যেতে চাই।’ রিরেইত ফিবে তাকিয়ে দেখে, অদ্ভুত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে লীলী। ‘কী হয়েছে?”
‘তোমাকে, পিয়েরকে, এনরিকে আমি ঘেন্না করি। আমি তোমাদের কী ক্ষতি করেছি? তোমরা আমায় যন্ত্রণা দিচ্ছো।’ চেঁচিয়ে ওঠে লীলী ।
‘কাদো। কাঁদলে তোমার ভালো হবে।’
লীলী ফুপিয়ে কাঁদে। ওকে আলিঙ্গনে বেঁধে রেখে ওর মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে বিবেইত। কিন্তু তার ভেতরে ভেতরে অবিশ্বাস। ট্যাক্সি যখন থামে, লীলী তখন শান্ত। ও চোখ মুছে নাকে পাউডার লাগায়। ও বলে—
“আমাকে মাফ করো। নার্ভ ঠিক ছিলনা আমার। এনরিকে ওই অবস্থায় দেখে আমার খুব খারাপ লাগছিল—’
‘তোমার সঙ্গে আবার কখন দেখা হবে আমার ?”
‘কালকের আগে নয়। তুমি তো জানো পিয়ের ওর মায়ের আপত্তির দরুণ আমাকে ওই ফ্ল্যাটে নিয়ে যেতে পারছে না। আমি হোটেলে আছি। তোমার যদি অসুবিধে না হয় কাল সকাল নটা নাগাদ এসো। তারপর আমি মার সঙ্গে দেখা করবো।’
‘আজ রাতে বেশী মন খারাপ করোনা ।’
‘আমি বড় ক্লান্ত। পিয়ের তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিলে ভালো হয়। কিন্তু পিয়ের এসব কিছুই বোঝেনা ।
ট্যাক্সিতে বাড়ী ফিরে যায় রিরেইত। এখন সিনেমায় যেতেও ভালো লাগবে না। টুপিটা চেয়ারে রেখে জানলার দিকে এগিয়ে যায় রিরেইত। কিন্তু বিছানাটা
তাকে কাছে ডাকে। সাদা, নরম, মোলায়েম। জ্বলন্ত গালে নরম বালিসের আদর। আমি লীলীর জন্যে সবকিছু করেছি। এখন আমি একা। কেউ আমার জন্যে কিছু করবে না। একটা বোবা কান্না তার গলায় উঠে আসে। ওরা নীসে যাবে। আর হয়তো ওদের সঙ্গে দেখাই হবে না। আমার জন্যেই ওরা সুখী হবে। কিন্তু ওরা আমার কথা ভাববে না। আমি দিনে আট ঘন্টা নকল বার্মিজ মুক্তো বেচবো। তার চোখে জল আসে। বিছানায় শুয়ে সে কাঁদে, বলে—’নীস্… রোদের আলো…রিভিয়েরা—
‘ফুঃ!’ অন্ধকার কালো রাত। মনে হয়, কে যেন ঘরের ভেতরে চারপাশে ঘুরছে। পায়ে স্লিপার, একটা পুরুষ। আস্তে আস্তে পা ফেলছে, থামছে, আবার উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটছে। লীলীর শীত করছে। কম্বলটা বড্ড পাতলা। ‘ফু!’—বলার সময় নিজের গলার শব্দে লীলীর ভয় হয় ।
ফুঃ! ও এখন বাইরে আকাশ দেখছে, আকাশের তারা দেখছে। সিগারেট ধরাচ্ছে। রাতের প্যারীর আকাশে বেগুনী রং ওর ভালো লাগে। যৌনসঙ্গমের পরেই ওর কবিত্ব জেগে ওঠে। গরুর দুধ দুয়ে নিলে গরুর যেমন হাল্কা লাগে, ওর এখন তেমনি হাল্কা লাগে। কিন্তু আমি, আমি তো নোংরা হয়ে গেছি, পুরুষের নোংরা আমার ভেতরে, এখানে, এই অন্ধকারে। একটা তোয়ালে ভিজে গেছে, বিছানার মাঝখানে চাদরের একটা জায়গাও ভিজেছে।
ঘরে আসার সময় পিয়ের বলেছিল— ‘এক মিনিট থাকবো। তোমার ঘরটা দেখবো।’ পিয়ের দু’ঘন্টা রইলো। ও যখন সেই কাজটা করছিল, জঘন্য এই লোহার খাটটা ক্যাচক্যাচ করছিল। এই হোটেলের কথা ও জানলো কি করে কে জানে। ও বললো, এখানে এক সময় ও নাকি দু’সপ্তাহ ছিল। নিশ্চয়ই কোনো মেয়ের সঙ্গে ছিল। ছোট ছোট ঘর, আসবাবে ভর্তি, কুশন, কোচ, ছোট টেবিলে কামনার দুর্গন্ধ। আমাকে ও যখন এখানে এনে তুলেছে, আমার সম্বন্ধে ওর ধারণা নিশ্চয়ই খুব উঁচু নয়। আমরা যখন উপরে উঠছিলাম, আলজেরিয়ান বেল-বয় হাসছিল, এরা দুজনে ওই কাজটা করতে এখানে এসেছে। ও আরও অনেক নোংরা কথা ভাবছিল হয়তো। আলজেরিয়ার ওরা এইসব করে। কোন মেয়ে কোন আলজেরিয়ান পুরুষের পাল্লায় পরলে তাকে সারা জীবন খুড়িয়ে হাঁটতে হয়। যখন পিয়ের আমায় বিরক্ত করছিল, ওই কাজটা করছিল, আমি ভাবছিলাম সেই আলজেরিয়ান পুরুষের কথা। ও আমাদের সম্বন্ধে এখন কতো নোংরা কথা ভাবছে।
এখন থেকে রোজ রাতে এমনিই লাগবে। শুধু কাল রাতটা ছাড়া। কেননা কাল রাতে আমরা ট্রেনে যাব। লীলী ঠোঁট কামড়ায়। ও যখন কাজটা করছিল, আমি মৃদু আর্তনাদ করেছিলাম। না আমি শুধু জোরে নিঃশ্বাস নিয়েছিলাম। পিয়েরের শরীরটা ভারী, ও আমার ওপর চাপলে আমার নিঃশ্বাসের কষ্ট হয়। পিয়ের বলছিল– ‘তুমি কাতরাচ্ছো, এইবার তুমি মজা পাবে।’ ওই কাজটা করবার সময় পুরুষ কথা বললে আমার খারাপ লাগে। অথচ পিয়ের খালি নানা নোংরা কথা বলছিল। আমি চেঁচাইনি। ডাক্তার বলেছে, পুরুষের শরীরের ক্লান্তি মানেনা। ‘থামো, লীলী। আমি কোথায় ভাবছি, তোমার ভাগ্য কতো ভাল, তুমি নীসে যাচ্ছো। আরে তুমি কিনা বলছো, প্যারী ছেড়ে যেতে তোমার কতো খারাপ লাগবে!’ ‘আমি তোমায় শেখাবো।’ আমি ওদের বলতে দিই। আসল ঝামেলাটা কোথায় আমি তো জানি। শরীরের ব্যাপার, ডাক্তার বলেছে। কিন্তু ওরা তা জানে না, ওরা উত্তেজিত হয়ে ওঠে।
কে যেন সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে। ঈশ্বর, পিয়ের যেন ফিরে না আসে। ওর আবার ইচ্ছে হলে ও আবার হয়তো এই কাজটা করবে। না, পিয়ের নয়। ভারী পায়ের শব্দ। লীলীর বুকের আড়ালে হৃৎপিণ্ডটা দুলে ওঠে। ওই আলজিরিয়ান পুরুষটা নয়তো?
পনেরো মিনিট পরে ও এনরির দরজায় ধাক্কা দেয়।
দরজার আড়াল থেকে এনরি বলে, “ওখানে কে ?
‘আমি।’
এক মিনিট পরে আধখানা দরজা খোলে। এনরিকে দেখা যায়। ফ্যাকাশে, নাকে ব্রণ। ও ঘুমোয়নি। লীলীর মনটা নরম হয়। এনরি মুখে কিছু বলে না। লীলী ওকে একটু ঠেলে ভেতরে ঢোকে। এনরি কি বোকা, সবসময় পথ আগলায়, গোল গোল চোখে আমায় দেখছে, হাত দুটো ঝুলছিল, ওর শরীরটা নিয়ে কি করতে হবে ও জানে না। চুপ করে থাকে। আমি জানি, তোমার মন খারাপ, তুমি কথা বলোনা। ও মুখের থুথু গেলার চেষ্টা করবে। লীলীকেই দরজা বন্ধ করতে হয়। ‘আমি ভালো বন্ধু হিসেবেই বিদায় নেবো।’ লীলী বলে।
ও মুখ খোলে, কথা বলার চেষ্টা করে, হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ায়, পালায়। ও কি করছে? কাঁদছে? না, কাশছে। ও বাথরুমে গেছে। ও ফিরে এলে ওর গলা জড়িয়ে ধরে বমির গন্ধ পায় লীলী। তখন লীলী ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। ‘আমার ঠাণ্ডা লাগছে’—এনরি বলে।
‘বিছানায় চলো। কাল সকাল অবধি এখানে থাকতে পারি।’ ওরা শুয়ে পড়ে। লীলী ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তার ঘর বিছানা কি পরিষ্কার। জানলায় সেই লাল আলো। ও ভেবেছিল, এনরি তাকে জড়িয়ে ধরবে। কিন্তু না, কাঠের মত আড়ষ্ট হয়ে পা ছড়িয়ে শোয় এনরি। দুজনে কাঁদে। তারপর আলো নিভিয়ে হাল্কাভাবে এনরির কাঁধে মাথা দিয়ে বসে থাকে লীলী। পবিত্র এবং বিষণ্ণ দুই অনাথ শিশুর মত। কিন্তু এটা সম্ভব নয়। জীবনে এরকম কখনও ঘটে না, জীবন সমুদ্রের ঢেউয়ের মত। লীলীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে ঢেউ। তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এনরির হাত থেকে। এনরির হাত, মস্ত বড়। ওই হাতের জন্য ও গর্বিত। ও বলে, অভিজাত পরিবারের সন্তানদের হাত দুটো মস্ত বড় হয়। ও এখন আর আমার কোমর ধরে না, একটু একটু সুড়সুড়ি দেয় শুধু…না, ও পুরুষত্বহীন নয়। ‘আমি আমার বাবা-মাকে কি বলবো?’ এনরি বলছে!
‘আমার মা এসব শুনলে মরে যাবে।’
মা, মাদাম ক্রিসপ্যা মরবে না। বরং এটা তো তারই জয়।
‘এনরি, আমি তোমায় খুব ভালোবাসতাম।’
‘এবং এখন বাসোনা?’
এখন আগের মত নয়।
‘তুমি কোন্ পুরুষের সঙ্গে পালাচ্ছো।’ এনরি কেঁদে বলে।
‘শোনো, এনরি, আমি শপথ করে বলছি, পুরুষদের আমার ভালো লাগেনা ।
আমি রিরেইদের বন্ধুদের সঙ্গে যাচ্ছি। আমি একা থাকতে চাই, চাকরী খুঁজতে চাই।’
এনরির পাজামার নীচে হাত গলিয়ে ওর সমস্ত শরীরে আদরের হাত বুলোয়
লীলী। ওর ঠাণ্ডা হাতের ছোঁয়ায় কেঁপে উঠলেও এনরি সরে যায় না, শুধু বলে ‘আমার আবার বমি পাচ্ছে।’
সত্যি, এনরির ভেতরে কি যেন ভেঙে গেছে।
সকাল সাতটার সময় বিছানা ছেড়ে উঠে লীলী। তার চোখ কেঁদে কেঁদে ফুলে
ওঠেছে। সে ক্লান্তভাবে বলে—’আমায় ফিরে যেতে হবে।’ ‘কোথায় ফিরে যাবে?
‘হতেইল দী থেয়াতর, রী ভাঁদামে।’
চাদরের বাইরে শুধু এনরির চুল আর কান দেখা যাচ্ছে। ও বলছে
‘এক হপ্তা ঘুমুতে ইচ্ছে হচ্ছে আমার।’
‘বিদায়, ডার্লিং।’
ঝুঁকে চাদর একটু সরিয়ে এনরিকে চুমু খায় লীলী। কপালে চুমু খায়। একটু সময় ও ল্যান্ডিং-এ দাঁড়িয়ে থাকে। দরজা বন্ধ করবে কিনা বুঝতে পারে না। এক লহমা পরে চোখ সরিয়ে ও জোরে দরজা বন্ধ করে। ভেতর থেকে শুকনো একটা শব্দ ভেসে আসে। লীলীর মনে হয়, ও অজ্ঞান হয়ে যাবে। ‘লীলী শেষ অবধি এই করলো।’—রিরেইত যেন অনেক দূরের দিকে তাকিয়ে তখন সন্ধ্যাবেলা। ছটার সময় রিরেইতকে ফোন করেছে পিয়ের।
‘কিন্তু সকাল নটায় লীলীর সঙ্গে তোমার দেখা করার কথা ছিলনা ?” পিয়ের জানতে চায়—
‘আমার সঙ্গে লীলীর দেখা হয়েছিল।’
‘ওকে অদ্ভূত মনে হল? ‘
“না। আমি তো কিছু খেয়াল করিনি! একটু ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। ও বললো,
তুমি চলে যাওয়ার পর ওর ঘুম হয়নি। কেননা নীসে যাওয়ার ব্যাপারে উত্তেজনা, তাছাড়া অ্যালজেরিয়ান সম্বন্ধে ওর ভয়। লীলীর চিঠি এখন পিয়ের-এর হাতে। ওটা পড়তে চায় রিরেইৎ। কিন্তু সে সুযোগ ওকে এখনও দেয়নি পিয়ের।
‘ওটা কখন পেলে ?’ ‘চিঠিটা?” সরলভাবে চিঠিটা ওর হাতে তুলে দেয় পিয়ের— ‘পড়ে দেখো। দুপুর একটায় দারোয়ানকে দিয়ে গেছে লীলী।’ ‘ডিয়ারেস্ট ডার্লিং, টেকসিয়ার্স দম্পতি এসেছিল। ওদের ঠিকানাটা কে দিয়েছিল, আমি জানিনা। আমি জানি, এই চিঠি পড়ে খুব দুঃখ পাবে। কিন্তু ডিয়াবেস্ট ডার্লিং পিয়ের আমি তোমার সঙ্গে যাবো না। আমি এনরির সঙ্গেই থাকবো। ও বড্ড অসুখী, ওরা আজ সকালে এনরির সঙ্গে দেখা করতে গেলে সে দরজা খুলতে চায়না। মাদাম টেকসিয়ার বলছিল, এনরিকে মানুষের মত দেখাচ্ছিলনা। হয়তো রিরেইতের সঙ্গে আমি হোটেল ছেড়ে যাওয়ার সময় ওরা আজ সকালেই আমায় দেখে ফেলেছে। মাদাম টেকসিয়ার বললেন, উনি আমায় দারুণ আত্মত্যাগ করতে বলছেন। কিন্তু উনি জানেন, এ অবস্থায় এনরিকে ছেড়ে আমি যাব না। তোমার সঙ্গে নীসে বেড়াতে যাওয়া হলনা ভাবতে আমার খুব ভালো লাগছে, ডার্লিং। কিন্তু আমি জানি, আমি তোমারই, এটা জানলে তুমি কম দুঃখ পাবে। আমার হৃদয়, আমার শরীর সব তোমার। আগের মত আমরা প্রায়ই পরস্পরের সঙ্গে দেখা করবো। কিন্তু আমি এনরিকে ছেড়ে গেলে ও আত্মহত্যা করবে। আমি এনরির কাছে ফিরে যাচ্ছি। ওকে ওই অবস্থায় দেখবো ভাবলে খারাপ লাগছে। কিন্তু আমার শর্তগুলো বলার মত সাহস আমি পাবো। প্রথমতঃ আমি বেশী স্বাধীনতা চাই। কোননা আমি তোমায় ভালবাসি। তাছাড়া ও যেন আমার ছোট ভাই রবারৎকে আর কিছু না বলে। আমার মায়ের সম্বন্ধেও এনরির খারাপ কিছু আর বলা চলবেনা।
প্রিয়তম, আমি খুব দুঃখিত, তুমি এখানে থাকলে আমি আনন্দ পেতাম। আমি তোমায় চাই। তোমায় জড়িয়ে ধরতে, সারা শরীর তোমার আদরের ছোঁয়া পেতে চাই, কাল পাঁচটায় কাফেতে তোমার সঙ্গে দেখা হবে।— ‘লীলী’ ‘বেচারা পিয়ের’—রিরেইৎ ওর হাত ধরে। পিয়ের বলে— ‘আমি এর জন্যে দুঃখিত। ওর দরকার ছিল ফাঁকা হাওয়া, রোদের আলো। কিন্তু ও যখন এটাই বেছে নিল…আমার মা খুব ঝগড়া করেছে। ভিলাটা আমার মায়ের। সেখানে আমার মেয়েমানুষ নিয়ে যাওয়া মায়ের পছন্দ নয়।’ ‘আহ্?’—ভাঙা গলায় বলে রিরেইৎ— তাহলে সব ভালো, তাহলে সবাই পিয়েরের হাত ছেড়ে দেয় রিরেইৎ। তার মনের অন্তরালে তিক্তবিষাদের সুখী ?’
বন্যাস্রোত বয়ে যায়। কেন, সে জানেনা।