রতিবিলাস – সেলিনা হােসেন

›› সম্পুর্ণ গল্প  

ছেলেটা বড় কেমন যেন। বিধাতা বুঝি ওকে কেবল সুড়সুড়িময় তরল পদার্থ দিয়েই তৈরি করেছে। মিসেস খান আত্মতৃপ্তি পেলেও মাঝে মাঝে তার অনুভূতির দেয়ালে যে অস্বস্তির হাতুড়ি পড়তে থাকে না, তা নয়। নীলাও অবশ্য মাঝে মাঝে কেমন বিবর্ণ নীল হয়ে যায়-ওর চোখেমুখে একটা আতঙ্ক, একটা হতাশা, দানা বাঁধতে আরম্ভ করে । তখন মিসেস খানের দেহে পুলক জাগে। আঁটসাট বাঁধুনির চল্লিশ বছরের শরীর যৌনবটা দাপাদাপি শুরু করে।

মিসেস খান ভাবতে শুরু করেন। সেই কবে আঠারাে বছর আগে জীবনটাকে বেঁধে ফেলেছিলেন সব কামনাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে। যেদিন হাসিব খান মারা গেল তখন নীলা এক বছরের। অবশ্য ইচ্ছা করলে তিনি আবার নতুন করে জীবনটাকে সাজাতে পারতেন-সে সুযােগও পেয়েছিলেন। কিন্তু মনের কাছ থেকে কোনাে সাড়া পাননি। মনে হয়েছিলে হাসিব খানের স্মৃতিকে বুকে পুষে আরেকজনের ঘর করা তার পক্ষে অসম্ভব। এ কেমন করে সম্ভব যে, ভালােবাসি একজনকে কিন্তু ভাত খাব আর একজনের? নিজের মনের ইচ্ছাই জয়ী হলাে। যে হাসিব খানকে তিনি ভালােবেসে বিয়ে করেছিলেন-তাকে তিনি দৈনিক কামনার উর্ধ্বে ভালােবাসেন বলে অহরহ প্রচার করে বড়াতেন-যে হাসিব খান তার সমস্ত মন জুড়ে, তাকে তিনি কখনাে সরাতে পারলেন না। হাসিব খানের মৃত আত্মা বিজয়ী হলাে-হেরে গেলে মিসেস খানের সমস্ত দৈহিক অনুভূতির উদগ্র প্রকাশ। সবকিছুকে তিনি চোখ রাঙিয়ে শাসন করলেন-জোর করে দিলেন ঘুম পাড়িয়ে।

কতদিন রাতের অন্ধকারে হাসিব খান যখন উত্তেজিত হতাে-মিসেস খানের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও যখন হারিয়ে যেত যােনির এক সমুদ্র অন্ধকারের মাঝে তখন মিসেস খানের সমস্ত কাল্পনিক বােধশক্তি আহত হতাে-ক্ষুন্ন হতেন তিনি। তার ভাবুক মন শতমুখে প্রশ্ন করতো ভালােবাসাটি কি শুধুই দৈহিক? পর দিন, রাত একটি মানুষকে কেন্দ্র করে তিলতিল করে যে স্বপ্ন মনের কোণে গড়ে ওঠে তার শেষ পরিণতি কি সম্ভোগে! মিসেস খান দিশেহারা হতেন। দেহটার সঙ্গে ভালােবাসাকে তিনি কখনাে এক করে নিতে পারতেন না। হাসিব খানের উত্তেজিত মুহূর্তের অবসান হলে প্রশ্ন করতেন, আমার দেহটার মূল্যই কি তােমার কাছে বড়? তুমি কি আমায় ভালােবাসাে না? হাসিব খান হেসে ফেলতেন। আরাে ঘন হয়ে বলতেন, “আমি তােমায় ভালােবাসি অস্থিমাংসসহ। কিন্তু মিসেস খান এ জবাবে খুশি হতেন না। তার মনে হতাে তবুও কোথায় যেন ফাঁক রয়ে গেলাে। দেহের তৃপ্তি হলেও মনটা তার অহরহ খুঁতখুঁত করতাে-মনে হতাে এ না হলে ভালাে হতাে।

কিন্তু তবুও তাদের সংসারযাত্রা চলে যাচ্ছিল। মনের অসন্তোষটুকুকে এরপাশে সরিয়ে রেখে দিনের পর দিন তারা এক বিছানায় ঘুমাতাে, এক টেবিলে খেত, একই ছাদের নিচে বাস করতাে। মিসেস খানের অতিরিক্ত কল্পনাবিলাসী মনটার আহতড় ক্ষতে সান্ত না লাগাতে মাঝে মাঝে ছুটে যেতেন তিনি প্রকৃতির কোনাে নির্জন অস্তিত্বে। সেখানে হাসিব খানেরও কোনাে অধিকার ছিল না। সেই মুহূর্তে তিনি শুধু একা-ভয়ঙ্কর একা। তার চারপাশের অখণ্ড নির্জনতার পাশে শুধু যৌবনী স্বপ্ন রচনা করার আকুতি-ভালােবাসাকে নেড়েচেড়ে দেখার প্রবল ইচ্ছা। সে এক দুর্বল মুহূর্ত তার কাছে। মিসেস খান পুলকিত হতেন।

তারপরই অ্যাকসিডেন্টে হাসিব খানের মৃত্যু। মিসেস খান বিধবা হলেন। তারপর ষোল বছর হাসিব খানকে বুকের ভেতরে রেখে-নীলাকে অবলম্বন করে নির্বিবাদে কাটিয়ে দিলেন। প্রথম প্রথম বন্ধু-বান্ধবরা বােঝাতে চেষ্টা করতাে। বলতাে, তােমার এ দৃষ্টিভঙ্গি সুস্থ চেতনার লক্ষণ নয়। একদিন দেখবে, তােমার সব স্মৃতি ফিকে হয়ে আসবে-তুমি তখন বাঁচার জন্য অবলম্বন খুঁজবে।’ মিসেস খান নিঃশব্দে হাসতেন। কারাে কোনাে কথার জবাব দেয়ার প্রয়ােজন মনে করতেন না। শুধু অবাক হয়ে ভাবতেন, এরা কেন মনের মূল্য দেয় না? যে মেয়ে হাজার জনের সঙ্গে দেহের কারবার করে সে যদি বেশ্যা হয়, তাহলে যে হাজার জনের সঙ্গে মনের বেসাতি করে সেও বেশ্যা। মিসেস খান নিজের মনের দিকে তাকিয়ে কিছুতেই আরেকটি বিয়ের সাড়া পাননি। একদিন বন্ধুদের সঙ্গে তর্ক প্রসঙ্গে বলেছিলেন, জানাে, বিয়ের ক্ষেত্রে মনের মিল না হলে বিয়েটা একটা অতি স্কুল বেশ্যাবৃত্তিতে পরিণত হয়-কোনাে সময় ঘটে দুপক্ষেরই তবে বেশিরভাগই ঘটে সাধারণভাবে মেয়েদের, যাদের সাধারণ গণিকা থেকে এটুকু পার্থক্য থাকে সে, তারা মজুরের মতাে সাময়িক মজুরি নিয়ে দেহ বিক্রি না করে চিরদাসত্বের পায়ে নিজেদের বিকিয়ে দেয়। কথা বলতে বলতে মিসেস খানের। ঠোট কাঁপতাে, ভুটা প্রসারিত হতাে। বন্ধুরা অবাক হতাে। কেউ কেউ বলতাে, যবসব শুকনাে কথার প্যানপ্যানানি।’ কেউ বলতাে, “যে বােঝে না তাকে বােঝানাে যায় না। এ মেয়ে একেবারে অন্য ধাঁচে তৈরি। তারপর একদিন সবাই সরে পড়ল। মিসেস খান আপন মনের সাথেই একটা নিজস্ব জগত গড়ে তুললেন।

তারপর অনেকদিন কেটে গেছে। মাঝে মাঝে মিসেস খান দেহের মাঝে একটা অদৃশ্য চিনচিনে ব্যথা অনুভব করতেন। কিন্তু জোর করেই তিনি তাকে আমল দেননি। এভাবেই কেটে যাচ্ছিল। তারপর সতেরাে বছর পর আঠারাে বছরের নীলার জীবনে রাতুলের আবির্ভাব । মিসেস খান ওকে দেখে খুশি হয়েছিলেন। তাই রাতুলকে নীলার জীবনে নির্বিবাদ প্রবেশের অধিকার দিয়েছিলেন। নীলাও খুশি হয়েছিল।

তবে ছেলেটা বডড কেমন যেনাে।

এক মুহুর্ত চুপচাপ বসে থাকতে পারত না। সবসময় ছুঁইছুঁই ভাব। নীলার কাছে ঘেঁষে বসতে পারলে ওর শান্তি হতাে না। শাড়িটা ওর গায়ে না ঠেকলে ওর ভালাে লাগত না। ওর এই ছটফটানিই মিসেস খানের ভালাে লাগতাে। হাসিমুখে দেখতেন ওদের খুনসুটি। মনে পড়তাে হাসিব খানকে।

ঠিক এই আঠারাে বছরে হাসিব খান তার জীবননাট্যের পর্দার অন্তরালে চলে গেছে। তেমন করে তার স্মৃতি আর তাকে উত্তাপ দিতে পারছে না। মিসেস খান মাঝে মাঝে আপন মনে চিকার করে উঠতেন, ‘হাসিব খান, হাসিব খান কি আমার মনে নেই? হাসিব খান কি মুছে গেছে? হারিয়ে গেছে? ওকে কেন আর তেমন করে খুঁজে পাচ্ছি না?

মনের এই বিব্রত অবস্থা মিসেস খানকে ব্যাকুল করে তুলত। অ্যালবাম খুলে হাসিব খানের সমস্ত ছবি নিয়ে বসে থাকতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তবুও মাঝে মাঝে মনের খােরাক আর মিটছে না। তাকে একবার ছুঁয়ে দেখতে বড় ইচ্ছা করছে-একবার তার বুকের মাঝে মুখ লুকাতে কি যে ভালাে লাগে। তারপর আপন মনেই চমকে উঠতেন। এসব কি ভাবছেন? ভালােবাসাকে তিনি তাে সবসময় দৈহিক স্পর্শের উর্ধ্বে রেখেছেন। তবে কেন আজ এমন করে মনটা বারবার বিদ্রোহ করছে? মিসেস খান চিন্তার সাগরে দিশেহারা হয়ে যান। তবুও যেন জোর করে বলতে চান ভালােবাসি-ভালােবাসি-হাসিব খানকে এখনাে ভালােবাসি। গুনগুন করে গাইলেন,
রাতের সব তারাই আছে।
দিনের আলাের গভীরে।

কিন্তু তবুও খটকা থেকে যায়। মনে হয় এভাবে বাঁচা তাে বাঁচা নয়। শুধু স্মৃতি ছাড়া তার জীবনের সম্বল আজ আর কিছুই নেই। মনটা কেঁদে ওঠে। মাঝে মাঝে মনে হয় মৃত হাসিব খানের স্মৃতিটাই কি তার সারা জীবনের সঞ্চয়? আর কি পেয়েছেন তিনি? আর কি-আর কি-আর কি?

তাই রাতুল আর নীলার কৌতুকময় উচ্ছ্বাস তার দেহেও সুড়সুড়ি জাগায়। কেমন একটা পুলক অনুভব করেন ওদের দেখে। রাতুল আর নীলাকে ইচ্ছে করেই এক সােফায় বসতে দেন, নিজে অন্য সােফায় বসে ওদের দেখেন-গল্প করেন। রাতুল নীলার হাত ধরে একটু একটু চাপ দেয়-পাটা নাচায়-উসখুস করে। নীলা মাঝে মাঝে অস্বস্তি অনুভব করে-কেমন ফ্যাকাশে হয়ে যায়। মিসেস খানের তখন ভীষণ ভালাে লাগে। সমস্ত দেহটা উন্মুখ হয়ে ওঠে-অনুভূতিগুলাে সজাগ হয়ে থাকে-সমস্ত শরীরে একটা মৃদু কম্পন জাগে। ইচ্ছা হয় কাউকে জড়িয়ে ধরে চুমােয় চুমােয় ভরিয়ে দিতে মুখটা। নিজের এ দেউলেপনায় নিজের উপর ক্ষোভ জাগে মিসেস খানের। তার মনে হয়, ভুল করেছেন। কি যেন করা উচিত ছিল অথচ করেননি।

কদিন ধরে মিসেস খানের মনটা বড্ড খারাপ। চেহারাটা কেমন শুকনাে শুকননা । উজ্জ্বল রংটা ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে। রাতুল চলে গেছে। চাকরি পেয়েছে ফরাশগঞ্জে। আর অনার্স পরীক্ষা নিয়ে নীলা ভয়ানক ব্যস্ত। ডাকলেও সাড়া পাওয়া যায় না। নিজেকে ভয়ানক নিঃসঙ্গ লাগে মিসেস খানের। সমস্ত রাতদিনের একাকিত্বের বােঝা তার বুকের ওপর যেন পাথরের মতাে চেপে বসে আছে। ভয়ানক পিপাসা-শুধু জ্বালা মিসেস খানকে দিশেহারা করে দেয়। আর তখনই তিনি পাগলের মতাে নীলাকে জড়িয়ে ধরে চুমােয় চুমােয় ভরিয়ে দেন মুখটা। নীলা অবাক হলেও ভালাে লাগে। ভাবে, মা আজকাল ওকে বড় বেশি ভালােবাসে। হয়তাে চলে যাবে তাই।

মিসেস খান যখন শান্ত হয়ে নিজের মাঝে গুটিয়ে যান তখন নিজের উন্মত্ততার জন্য লজ্জিত হন। কেমন নিঃসাড় হয়ে যায় সমস্ত অনুভূতিগুলাে। শুধু ভাবেন, একি হলাে। আজকাল হাসিব খানের ছবি ভর্তি অ্যালবামটা নিয়ে বসে থাকলেও আর ভালাে লাগে না। দেখতে দেখতে ঐ ছবিগুলাের প্রতিটি ভঙ্গি তার মুখস্থ হয়ে গেছে। মিসেস খান অবাক হন। মনের দুয়ারে হাসিব খান আর তেমন করে সাড়া জাগাতে পারছে না। চমকে ওঠে দেখেন, হাসিব খান আজ তার কাছে মৃত। তখনই ভয় লাগে তার। মনে হয়, এরকম কালাে অন্ধকার বুঝি তার চারদিকে বেষ্টন করে আছে। হাসিব খান ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। বিষন্ন ক্লান্ত চাউনি-হতাশ ভঙ্গি-একটা বেদনাহত দেহ। মিসেস খান চিৎকার করে ওঠেন।

রাতুলের চিঠি এসেছে। ও নীলাকে বিয়ে করতে চায়। গতকাল নীলার অনার্স পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মিসেস খান চিন্তিত হয়ে পড়েন। নীলাকে ছাড়া তিনি থাকবেন কি করে? ভাবলেন, আরেকটা বছর যাক। কিন্তু হলাে না। ওদের দুজনের ইচ্ছাকেই শেষ পর্যন্ত প্রাধান্য দিতে হলাে।

সেদিন ছিল এক আশ্চর্য রাত-এক আশ্চর্য মােহিনী রাত। সমস্ত দিনের কোলাহলাে। শান্ত হয়ে এসেছে। অতিথিরা বিদায় নিয়েছে। সমস্ত বাড়িটা নিস্তব্ধ মিসেস খান অবসন্ন, ক্লান্ত। ক্লান্তিতে দেহটা ভেঙে পড়তে চায়-তারও চেয়ে বেশি ক্লান্ত বুঝি মন। বারান্দায় ফুরফুরে হাওয়ায় বসে আছেন মিসেস খান-সেদিনের হাওয়াটা ছিল আশ্চর্য ফুরফুরে। ঘুম আসছে না তার। ওদের বাসরের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। মিসেস খান তাকালেন দরজার দিকে। নিশ্বাসটা ঘন হয়ে এলাে। ওদের হাসির শব্দ আসছে-টুকরাে টুকরাে কথা খাপছাড়াভাবে ঘেউ ঘেউ শব্দ। মিসেস খান বেতের চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন। রাত বাড়ছে-একটু একটু করে রাত বাড়ছে। সমস্ত বাড়িটার ওপর অন্ধকার আরাে গাঢ় হয়ে-আরাে গভীর হয়ে চেপে বসেছে। মিসেস খান বুখতে পারছেন কেন। জানি তার কান্না আসছে-একটু একটু করে হামাগুড়ি দিয়ে কান্নার মেয়েটা এগিয়ে আসছে-চুপিচুপি, নিঃশব্দে।

হঠাৎ কাচভাঙার মতাে ওদের সম্মিলিত কণ্ঠের উচ্চহাসি ছড়িয়ে গেলাে। সমস্ত বাড়িটায়-ছুঁয়ে গেল বেতের চেয়ারে বসে থাকা মিসেস খানের মনটা একটা ক্লান্ত, অবসন্ন মন-একটা উন্মুখ মন। কুকুরটা আর শব্দ করছে না। ফুরফুরে বাতাস তেমনিভাবে বইছে। হাসির রেশটা বুঝি এখনাে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। মিসেস খান ওদের ঘরের দিকে তাকালেন।

আর হঠাৎ অজস্র কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। বেতের চেয়ারে তার দেহটা বারবার আন্দোলিত হলাে।

Please follow and like us:

Leave a Reply