যুগ যুগ জীয়ে – সমরেশ বসু

›› উপন্যাসের অংশ বিশেষ  

……সেই সময়ে সাধুদের আস্তানার পিছনের ঝুপড়ি থেকে ফুলবাসিয়া বেরিয়ে এসেছিল। ত্রিদিবেশ তাকিয়ে দেখেছিল, সাধুও দেখেছিল, ফুলবাসিয়াও তাদের দিকে তাকিয়েছিল, তার ঠোঁটের কোণে হাসি ছিল। ত্রিদিবেশ দেখেছিল সাধুর দাড়ির ভাঁজে হাসি, চোখের তারায় ঝিলিক। ফুলবাসিয়া ঠোঁট উলটে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, ঘাটের দিকে চলে গিয়েছিল। ফুলবাসিয়ার খোলা চুল পিঠে ছড়ানাে। শাড়ি জড়ানাে তার পিঠ, কটি, কোমর, জংঘা, উরু, পায়ের গােছা একটা ঢেউ খেলানাে দর্পে দুলছিল। সাধু বলেছিল, ‘তারপরে সাহকে কেউ উপদেশ দিয়েছিল, উদ্ধার পেতে হলে ওকে নিস্পাপ কুমারী মেয়ের মদত নিতে হবে। তা হলে ও আবার সব কিছু, ফিরে পাবে। তখন ও এই ফলবাসিয়াকে দেহাত থেকে কিনে নিয়ে এলো উর পতনের পরেও, ও বরাবর আমাদের সেবা করে এসেছে, ওর বিশ্বাস সাধুসন্তদের সেবাকর্লে ও উদ্ধার পাবে। তবু ও এই মেয়েটাকে নিয়ে এলাে। দু তিন বছরের মধ্যেই মেয়েটার কীরকম চেহারা ফিরে গেল, তােমরাও দেখেছ। কিন্তু লাভ কী হয়েছে ? সাহ, উদ্ধার পেল না সাহ, অনাচারে ডুবে গেল। এখন সাহ আমাদের ঘৃণা করে, ফলবাসিয়াকে চোখে চোখে রাখে, ফুলবাসিয়ারই বা উপায় কী? তুমি ওকে দেখেছ, সাহর মতাে একটা লােকের সঙ্গে ও থাকতে পারে না। পেটে খাওয়াটাই সব না। তাই যােগীরাই এখন ওর জীবন যৌবন। সাহ, সূরইঞ্জীনে, জেনেও ওর কিছু করার নেই। ও ওর এত বড় নৌকা সামলাতে পারে, ফলবাসিয়াকে কী দিয়ে সামলাবে?….

…..ত্রিদিবেশ বটের দাওয়া থেকে নেমে নদীর দিকে তাকায়। ফলবাসিয়া জল থেকে উঠে আসে। তার বুকে এক ভাঁজ ভেজা শাড়ি, এবং কোমরে। উদ্ধত শরীরের সঙ্গে, দৃষ্টির কোনাে মিল নেই, অন্যমনস্ক, উদাসী।….

……একেবারে পিছনের ঘরে, চারজন ঘরের এক কোণে, গােল হয়ে মাথায় মাথা ঠেকিয়ে কী যেন দেখে। মেঝের মাদরের ওপর লুডাের ঘর পাতা। বােঝা যায়, লডাে খেলা বন্ধ করে, সকলে অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত। ব্যস্ততা আর কিছু না, ওদের হাতে কার্ড সাইজের কয়েকটা ফটো। কোনাে সুন্দরী বিদেশিনী, যাকে মেমসাহেব বলে, তার ফটো। গােপনীয়তার কারণ, সুন্দরীর গায়ে কিছু নেই, দুই উরতের মাঝখানে এক গুচ্ছ ফুল, তার একমাত্র লজ্জা নিবারণ করছে। অভাবনীয়, অভূতপর্ব, উত্তেজনাকর। সুন্দরীর ঠোঁটে মদির হাসি, নিটোল বুক, পেট, কোমর, নাভির দিকে তাকালে, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। সকলের মুখেই বিন্দু বিন্দু ঘাম। ছােটন, অরণ, শঙ্কর, বিল, সকলেরই বয়স চৌদ্দ পনেরাের মধ্যে। দেওয়াল ঘেষে আলমারির তলায়, প্রথম অরুণের চোখ পড়ে, একটা ময়লা খাম। মুহর্তে ওর মস্তিষ্কে ঝিলিক হানে। মনে পড়ে যায়, বকুলতলা ক্লাবে কয়েকদিন ধরে, এক অস্তৃত ভূতুড়ে খেলা চলছে।….

……মালতীকে স্পর্শ করেছিল । মালতীর দু হাত ধরে তিনি টেনে তুলেছিলেন। মালতীর ঘােমটা খসে গিয়েছিল, খােলা চুল, মুখের দুপাশে অনেকখানি ঢেকে দিয়েছিল, অন্তর্বাসহীন বাসন্তী রঙের জামার বুক থেকে অচল খসা, এবং তখনাে চোখ বোজা, গালে জলের ধারা। দাঁড়াবার এক মহত পরে মালতী চোখ মেলে তাকিয়েছিল, আর তৎক্ষণাৎ দুই সবল হাতে চন্দ্রনাথকে জড়িয়ে ধরেছিল, মুখ গুজে দিয়েছিল ওঁর কাঁধের কাছে।

তখন চব্বিশ চন্দ্রনাথের বয়স, মালতী প্রথম নারী, যে তাকে আলিঙ্গন করেছিল, যার নিশ্বাসের গন্ধ যৌবনচম্পার মতাে মনে হয়েছিল তাই, যদি নারীকে কনক বা স্বর্ণচাঁপার মতাে যৌবনচপি নাম দেওয়া যায়, এবং যা মানুষ ভাষায় বর্ণনা তে চেয়েছে অথচ বর্ণনাতীত সেই অনুভতি-স্তন যে-অঙ্গের নাম, উদ্ধত অথচ কোমল পিষ্ট স্পর্শ, এবং কুসমগন্ধ কেশ চিবুকে বর্ণনাতীত, এবং বাহুর কঠিন আলিঙ্গন, আর শ্রোণী বস্তিদেশ উরু জংঘা, চন্দ্রনাথে লীন হওয়ার ব্যাকুল স্পর্শ-বর্ণনাতীত সকলই, এবং বর্ণনাতীত সেই মুখ, যে-মুখ চন্দ্রনাথ তাঁর কাঁধের থেকে তুলে, চোখের সামনে তুলে এনেছিলেন। প্রাণীর মহাপ্রাণ পাপবােধ রহিত, দ্বিধা ঝটিতি লােপ-কান্না শোক স্নেহ ক্ষধা মলমূত্রত্যাগ সুখ ক্রোধ কাম এবং আত্মরক্ষায় পরকে নিধন মহাপ্রাণ-ধম। চন্দ্রনাথ থলি থেকে আবীর তুলে মালতীর কপালে গালে মাখিয়ে দিয়েছিলেন। রাঙানাে সেই মখ বুকে নিয়েছিলেন।–মখে নামিয়ে যৌবনচাঁপার নিবাসের ঘ্রাণে মাতাল চোখ বুজে, ওর খােলা বিঘােষ্ঠে চুম্বন করেছিলেন, এবং তখন চকিতের জন্য যেন সমগ্র বাডির ইমারত তাঁর বন্ধ চোখে ভেসে উঠেছিল, আর সকলের মুখে।…..

…..এ সময়েই গাড়ির গতি কমে আসে, গাড়ি একটা স্টেশনে ঢােকে এবং ত্রিদিবেশ জোঁক আর এলিযুক্ত মেয়েটিকে দেখতে পায়, লাল জামার অনেকখানিই বুকের কাছে নেই। সাদা ধান কাপড়ের সাধারণ বডিস টেনে নামানাে, অধরা বুকের একটি কালাে পিণ্ড মুক্ত। …..

……কারণ, গরমে ঘেমে যাওয়ার জন্যই হােক, বা বাতাস না থাকা সত্ত্বেও বাতাস লাগাবার জন্যই হােক, ফুলবাসিয়ার বুকের আঁচল অনেকখানি ভােলা। তার বুকের আঁচল ঘাড়ের ওপর দিয়ে টানা না, কুক্ষির নিচে ডানায় চাপা, কণ্ঠা থেকে অনেকখানি নামান এবং শ্যাম রঙ বেল বুক জোড়ার একটি সল্পণ অচিল মত, যেন গাছের ফলের মতােই উদাস, কিন্তু এমন উদ্ধত আর অনা, শিউলীর গা পাক দেওয়া লজ্জা বােধ হয়। ফুলবাসিয়া অকাতর, শরীর বা আবরুণ বিষয়ে উদাসীন এবং ক্রমে তার শরীরের নানা অংশে মােচড় লাগে, বাঁক খায়, দোলে, অনেকটা নাচের ভঙ্গিতে, যার তাল তার গানের সুরে বর্তমান।……

….ফুলবাসিয়া এখন দু হাতে করতালি দেয় যার ফলে কুক্ষির নিচের অচল আর ডানা চাপা থাকে না এবং তার শ্যাম রঙ জোড়া বেল, মেদবজিত পেট ও নাভির নিচে দেহাতি ঢঙে শাড়ির বধনী সকলই আঢাকা হয়ে পড়ে। কিন্তু সে রঙ্গিণী ভঙ্গিতে হাততালি দিয়ে নত্য করে, ঘাড় ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে যেন গানের সুরে কিছু জিজ্ঞাসা করে এবং বসন্তের দাগ তার সচের শিল্প কাজ করা মুখে ঘাড়ে খােলা চলে আলুথাল হয়ে পড়ে।……

…..মধুদি ত্রিদিবেশকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে, ওর মুখের ওপর গাল চেপে ধরেন। ত্রিদিবেশ অনুভব করে, মধুমতী রায়ের জামার বােম খােলা এবং তার কোমল উষ্ণতা ওর বুকের কাছে। প্রচণ্ড শব্দে কলকাতা এবং সমস্ত বাড়িটা কেপে ওঠে। অন্ধ শাবকের মুখে যেমন করে মাতৃতন পর্শ করে, তেমনি ভাবে মধুমতীর ঠেটি ত্রিদিবেশের ঠোটের দরজায় থরথর করে কাঁপে। ত্রিদিবেশ তাঁর ঠোঁট দুটি নিজের মধ্যে গ্রহণ করে এবং মহতে দেওয়াল সিড়ি প্রকম্পিত করে প্রচণ্ড বােমাবর্ষণের শব্দ হয়। ত্রিদিবেশ ধারালাে দংশনে ঠোট আলগা করে দেয়, মধুমতী ওর হাত টেনে নিয়ে নিজের বুকে চেপে ধরেন।…..

……শিউলী ওর মুখের ওপর রাখা ত্রিদিবেশের হাত নিজের মুঠোয় চেপে ধরে, ওর ঠোঁট খােলা মুখের কাছে টেনে নেয়, দাঁতে ছোঁয়ায়। ত্রিদিবেশের মনে হয় শিউলী শেখের ভিতর জিভটা অসম্ভব গরম। শিউলী ত্রিদিবেশের আঙ্গুলে গরম জিভ দিয়ে স্পর্শ সাত দিয়ে আলতাে করে চাপ দেয়, তারপর হাতটা টেনে নিয়ে বুকের ওপর চেপে ধরে। পৌষের শীতার্ত রাত, শিউলীর জামার বােতাম খােলা এবং বুক গরম। বুক এখন এক বড়, যেন ওর দিনে দিনে বেড়ে ওঠা গর্ভের সঙ্গে ফলের মতাে রসের ভারে একটু বড় হয়ে উঠেছে গর্ভবতী, এখন পাঁচ মাস। ত্রিদিবেশ হাত বাড়িয়ে ওর নাভির কাছে স্পর্শ করে। উচু ভিথলের শাড়ির বন্ধন শিথিল। ত্রিদিবেশ আস্তে আস্তে শাড়ির শিথিল বন্ধনীর মধ্যে হাইটকিয়ে আলগােছে বােলায়, অনুভব করে, সবত নাভি যেন নিচের থেকে ভরাট হয়ে উঠে শিউলীর বুকে চেপে ধরা হাতে বুকের ঠোঁটের স্পর্শ আসে, যা ওর বুকের বন্ধিকার্গে ছন্দে মিলেছে।……

……অজয়ের মনে হয়, তার শরীরে কাননের শরীরের উত্তাপ লাগে এবং তার দৃষ্টি কাননের কণ্ঠার নিচে ; বক্ষস্থলের অচিলের সীমায় ছয়ে আসে। সে কাননের ডান হাত নিজের হাতের মধ্যে টেনে নেয়। কানন বাঁ হাত দিয়ে অজয়ের সেই হাতের ওপর চেপে ধরে এবং তার বুকের কাছে ওর মুখ এগিয়ে আসে।…..

…অজয় দ্রুত পাশের ঘরের ভেজানাে দরজা ঠেলে দিয়ে ঢেকে এবং প্রস্তরবৎ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ায়। অবিশ্বাস্য দশ্য তার সম্মুখে, ওয়ার্ডেন বিজয় চক্ৰবতী সম্পর্ণ নগ্ন এবং দুটি মেয়ের একই অবস্থা। একজন শায়িতা খাটিয়ার ওপরে, আর একজন এই মহতে নিজের দুই উরুর মাঝখানে দুই হাত দিয়ে আবৃত করে ঘরের এক কোণে চকিত ভীরু পায়ে ছুটে যায়।…..অজয়কে দেখা মাত্র বিজয় মেঝেয় ঝাঁপিয়ে পড়ে তার নীল রঙ কুর্তা তুলে নেয় এবং তার পায়ের ধাক্কায়, একটি চটের ব্যাগ উলটে ছড়িয়ে পড়ে চালের দানা এবং খাটিয়ার ওপর কালাে স্বাস্থ্যহীন রমণী খাটিয়া থেকে নেমে মেঝেয় শুয়ে পড়ে নিজেকে আড়াল করে। অজয় তখনাে যেন বিশ্বাস করতে পারে না। তার চোখের সামনে এই চিত্র ও চরিত্র। ঘটনাসমূহ প্রকৃত এবং বাস্তব।…..

……শিশু সামনের দিকে ঝকে হাত বাড়িয়ে পা ঠেলে ঠেলে দাপায়, অতএব, শিউলীর শরীরও আন্দোলিত হয়। ওর বুকের আঁচল সম্পূর্ণ খলিত, কোনাে সম্বিত নেই, কারণ এই মহতে
ওর মস্তিষ্ক জুড়ে অন্য জগতের অন্য মানুষদের ভিড়। ওর মাতৃবক্ষ পর্বের তুলনায় স্ফীত, কিন্তু ততােধিক নম্র না।….. কথা শেষ করবার মুহর্তে, মােহনের চকিত দৃষ্টির লক্ষে, শিউলী নিজের বুকের দিকে তাকায় এবং তাড়াতাড়ি আঁচল তুলে ঢাকা দেয়। মােহন অপ্রস্তুত বােধ করে। একটি মুগ্ধতার রেশ ওর দৃষ্টিতে লেগে থাকে…..

……ত্রিদিবেশ মঙলির অবস্থান নির্ধারণ করতে পারে না। বধয়ার বাবার পাশে নিজেকে এলিয়ে দেয়, এবং কাঁথার তলায় নিজেকে ঢাকা দিতে উদ্যত হয়। কিন্তু তুর্কে আগেই ওর গায়ে কাঁথা ঢাকা পড়ে, এবং শরীরের অতি ঘনত্বে নারীর নগ্ন শরীর অনুভূত হয়। বুধয়ার বাবার ডাক শােনা যায়, মঙলি !
ত্রিদিবেশের কানের কাছে উষ্ণ নিশ্বাস লাগে এবং সেখান থেকে মঙলির জবাবের ধনি শােনা যায়, ‘হ।
এক অবিশ্বাস্য, তার সংজ্ঞা নিরুপণের যষ্টি অথবা বাস্তবের অথবা প্রচলিত ন্যায় অন্যায়ের বােধ বা শুভাশুভর পরিণতি এবং মূল্যবোেধ, কোনাে কিছুই এই যাত্রার পথরােধ করে না। ত্রিদিবেশের সমস্ত সত্তা একাগ্র হয়, এক গভীর সুখের অনুভূতি বেচে ওঠার মতাে মহিমান্বিত হয়ে ওঠে। নারীর তপ্ত বাহর সুকঠিন আলিঙ্গন, কোমল বক, সংযােগ বেদীমুল, পদযুগলের বঞ্চন, মাধ্যাকর্ষণ শক্তির মতাে আকর্ষণ করে, তীব্রতা এনে দেয় ত্রিদিবেশের আবেগে, এবং ওকে কেবল ক্রিয়াশীল করে তােলে না, ক্ষমতা ও প্রমত্ত আনন্দে যেন বাঞ্ছ পূর্ণ করে, নিজের এবং আর একজনের। আঁকা ছবির মৌনতা কথা বলে, অন্ধ পথদ্রষ্টার কাজ করে যেন ছবি আঁকা হতে থাকে অনুশীলিত পরিশ্রমী প্রতিটি নির্ভল রেখায়। সষ্টি আনন্দের প্রবাহে বহে, মতি রুপ পেতে থাকে রঙের ছটায়। এ অনিবার্যতায় এখন কোনাে অবােধ বিস্ময় বিভ্রান্তি এবং সংকটের স্থান নেই। মানুষেরা জীবনধর্মের প্রবাহে বহে, এবং তারপরে, গন্তব্যের যাত্রাশেষে উভয়ের আলিঙ্গনের মধ্যে ঘুমায় তৃপ্ত জীবগণ।……..

Please follow and like us:

Leave a Reply