প্রসঙ্গ দেবদাসী – আরতি গঙ্গোপাধ্যায়

›› বই এর অংশ / সংক্ষেপিত  

সূচনা/১

দাসপ্রথারই একটা বিশিষ্ট দিক দেবদাসী প্রথা। দাসপ্রথার সূচনা আদিম সভ্যতার বিবর্তনের প্রাথমিক স্তর থেকেই; বিজয়ী জাতি বিজিত জাতিকে দাসে পরিণত করেছে। কিন্তু দেবদাসী প্রথার উদ্ভব আরাে ঘৃণিত, কারণ এরা সবসময়ই নিতান্ত ভােগসুখের উপকরণ হিসাবে ব্যবহৃত। মনােরঞ্জনই ছিলো এই দেবদাসীদের অবশ্য কর্তব্য। এই মনােরঞ্জন রাজার, রাজপুরুষদের এবং পুরােহিতদের। প্রধানতঃ পুরােহিতবর্গের চেষ্টায় এবং সহায়তায়ই এই প্রথা চলে এসেছে যুগযুগান্ত ধরে। অদ্যাবধি মন্দিরেয় আশ্রয়ে, দেবতার নামে চলে আসছে এই নিলজ নারীমাংসের ভােগ। অবশ্য মাঝে মাঝে কোনো কোনো সমাজতত্ত্ববিদ এক ঝলক আলো ফেলেছেন এই সমস্যার দিকে, তবে তা নিতান্ত বৈচিত্র্যের সন্ধানে যতটা, ততটা এর ভীষণতার উৎস সন্ধানে নয়। ইতিহাসের রূপরেখা রচনার সময় ঐতিহাসিকেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই কুপ্রথা সম্বন্ধে একান্ত উদাসীন। অথচ এই প্রথা আজও চলে আসছে জনজীবনের অন্তরালে।….

….নারীপণ্যের একটা বড়ো হট মন্দির প্রাঙ্গণ। দেবদাসপ্রথা এই হাটের শর্ত। এ প্রথা নতুন নয়, যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। ভারতবর্ষে এই দেবদাসী প্রথা সম্ভবত সবচেয়ে ব্যাপক। ভারতীয় নারী সমাজ বহুযুগ ধরে এই প্রথার প্রভাবে অত্যাচারিত।….

বিশ্ব পটভূমি

….এই ইতিহাসকে দেবদাসী প্রথার প্রাচীন ইতিহাস হিসেবে উল্লেখ করা যায়। সমাজের উচ্চ কোটির রমণীরা এবং ক্রীতদাসীর, উভয়েই মন্দিরের দেবদাসী পর্যায়ে পরিগণিত, তবে এই দাসীত্বের শ্রেণীভেদটিও লক্ষ্য করার মতো। এর পর আসীরিয় সভ্যতা ও ব্যাবিলোনিয়ার সভাতার ইতিহাসেও এই ব্যবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। এ যুগের সমস্ত সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলই ধর্মের প্রভাবে প্রভাবিত। ব্যাবিলনীয় সভ্যতার সবচেয়ে ক্ষমতাশালী দেবতারা ছিলেন মারডুক, শামাশ, তাম্বুজ ও ইশতার। দেবী ইশতারের সঙ্গিনীরূপে নারীগণকে মন্দিরে দেবদাসী রূপে নিযুক্ত করা হতো। প্রাচীন ব্যাবিলােনে এ নিয়মও ছিল, প্রতিটি বিবাহবােগা মীলােক দেবী ‘ইশতার’-এর মন্দিরে বসে থাকবেন এবং প্রথম যে পুরুষ এসে তার কোলে একটি রৌপ্যমুদ্রা ফেলে দেবেন তার সঙ্গেই তিনি মিলিত হবেন। প্রাক-বিবাহ বেশ্যাবৃত্তি এভাবে ব্যাবিলােনে মন্দিরকে সাক্ষী করেই শুরু হয়। মন্দির দাসীদের পক্ষে বাধ্যতমূলক বেশ্যাবৃত্তির ইতিহাস প্রাচীন ব্যাবিলােনে এভাবেই পাওয়া যায়।….

….গ্রীসের ইতিহাসে আমরা দেবদাসীর উল্লেখ পাই নানা ভাবে। চিরতরুণ সূর্যদেবতা এপােলাের মন্দিরে সর্বত্রই দেবদাসী নিযুক্ত। লক্ষ্য করলে দেখা যায় এর পূর্বে ও পরেও সর্বত্র সূর্যদেবের দেবদাসী নিযুক্ত করা হয়েছে। গ্রীসের মন্দিরবালাদের বলা হতো Hierodule। এদের দেখা যেতাে গ্রীসের প্রতিটি দেবমন্দিরেই। এদের কাজ ছিল দেশসম্মুখে নৃত্যগীত প্রদর্শন এবং বাধ্যতামূলক বেশ্যাবৃত্তি। প্রাচীন ব্যাবিলােনের ‘ইশতার’-এর মন্দিরের দেবদাসীদের মতােই এদের কাজ ছিল প্রধানতঃ পুরােহিতদের এবং পরে রাজাদের ও ক্ষমতাশালী বীয়দের মনােরঞ্জন করা।
এই দাসদাসী কারা ? দিগ্বিজয়ী রাজন্যবর্গের পদানত দেশ থেকে নিয়ে আসা কৃতদাসবর্গ এই দাসদাসীদের প্রধান অংশ। এদেরই কেউ কেউ মন্দিরে নিয়ােজিত হতো দাসীরূপে। এরা ছাড়া কাঞ্চনমূল্যে কিনে বা বল প্রয়ােগে এদের wগ্রহ করা হতো। অথবা রাজয়ে গৃহহুয়া মেয়েদের দাসীরূপে নিবেদন করত মন্দিরে। ইতিহাস এ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নীরব। আর্টেমিরে মন্দিরের দাসীরা বাধ্য হ’তে এক বিচিত্র জীবনযাপনে। পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কহীন এক অবাভাবিক জীবন ছিল তাদের। মদিরা দেব Bachhus-এর মন্দিরের দেবদাসীদের একটা বিশেষ শ্রেণীতে ফেলা হতো। এদের বলা হতো Macnad—এদের সম্পর্কেও ইতিহাস নীরব। বালিকা অবস্থায় দেবদাসীদের তালিম দিয়ে তৈরী করা হতো এই Maenad হবার জন্য। এর সঙ্গে আমরা জানতে পারি Amazon-দের কথা। এই Amazon মর্মীরা ছিল যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শনী। ডান কাধে তুণ রাখার অসুবিধা ঘটায় ডান দিকের শুনটিকে কেটে ফেলে বা শক্ত করে বেধে রাখতে বলে নাকি এদের নাম হয়েছিল Amazon বা এনী। এদের সন্তান হতো, তবে কেবল কন্যাসন্তানকেই বাঁচিয়ে রাখা হতো। প্রজননের জন্য পুরুষ ধরে এনে সন্তান উৎপাদনের পর হয় তাকে বিতাড়িত করা হতো, নয় বধ করা হতাে। কিন্তু এই Amazon-দেয় অস্বাভাবিক জীবনযাত্রারও কোনাে সামাজিক কারণ খুজে পান্না যায় না। নারীমুক্তির আদর্শ বলে এদের মনে করাও অর্থহীন, কারণ যৌন অস্বাভাবিকতা কখনো মুক্তির প্রেরণা আনতে পারে না। যে সমস্ত বালিকাদের তালিম দিয়ে এই অস্বাভাবিক জীবনে নিয়ে আসা হতো, তারাও দাসীই ছিল। Maenad বা Amazon-দের উৎপত্তি সম্বন্ধে ঐতিহাসিক তথ্য প্রায় নেই, বু একথা মনে না করায় কোন বাধা নেই, যে দেবমন্দিরের সম্মান, যা তারা সে যুগে পেতেন, তার আড়ালে এই ‘দেবদাসীদের অসুস্থ জীবন মনােবিকারের শিকার হয়ে উঠেছিল।…..

…..বেশ্যাবৃত্তিকে স্বাধীনবৃত্তিরূপে প্রতিষ্ঠা করার পিছনে দেবদাসীবৃত্তিই সবপ্রথম প্রচেষ্টা। মন্দিরদাসীরা যে কার্যতঃ পুরােহিতদের মনােরঞ্জন করতেন সে সম্বন্ধে ইতিহাসে বহুবিধ তথ্যপ্রমাণ আছে। তবে এই দেবদাসীদের পাশাপাশি রাজনটী ও নগরনটীদের আবির্ভাব ঘটেছে। সম্ভবতঃ দেবতার ভােগ এবং রাজা ও রাজপুরুষদের ভােগ সমপর্যায়ের হবে, এ ধারণাই ছিল এই প্রথার পিছনে। দেবদাসী ও নগরনটীরা সকলেই যে ক্রীতদাসী ছিলেন না, এ অনুমানের পশ্চাতে যে কারণটি দেখানো যায়, তা হ’ল ক্রীতদাসী এবং কৃতদাসী (যাকে যুদ্ধের ফলে দাসী করা হয়েছে দের কোনাে রকম সামাজিক অধিকার ছিল না। কিন্তু নগরনটীদের সম্মান ছিল যথেষ্ট। এই নগয়নটীদের খ্রীসে Hataera বলা হতো। এদের গৃহে দেশের আনীগুণীরা আসতেন, নানা বিষয়ে আলাপ আলোচনা করতেন এবং এদের মতামতও সাগছে শুনতে।
থিওড়ােয়া নামে বাইজেন্টিয়ান সম্রাটের পত্নী নিজে একজন Hataera ছিলেন। দেবদাসীদের সম্মানিত অতিফের প্রমাণও আছে, তবে তা Hataera-দের সমতুল্য নয়, কারণ তাদের কেন্দ্র করে ছিল ধর্মের পরিমণ্ডল।….

….ইনকা সম্রাটরা সকলেই সূর্যের সন্তান’ বলে পরিচিত ছিলেন। এদের ক্ষমতা ছিল অপরিসীম। এরাও মিশরের ফারাও দের মতাে সহােদরা ভগিনীকে বিবাহ করতেন। ইনকা রাজ্যে সূর্যের মন্দিয় তত্ত্বাবধানের কাজ করতেন পুরােহিতগণ। সুন্দরী মেয়েদের অল্প বয়সেই বেছে নিয়ে Cuzco বা শিক্ষালয়ে নিয়ে যাওয়া হতো শিক্ষা দেওক্সার জন্য। তারা বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে পরে হয় স্বয়ং রাজার উপপত্নী হিসাবে রাজাবরােধে প্রেরিত হতে অথবা সূর্যকুমারী’ বা ‘Virgins at the Sun’ রূপে মন্দিরবাসিনী হতো। মন্দিরবাসিনী এই কন্যাদের কাজ ছিল পুরােহিত, রাজা বা রাজবংশীয় পুরুষদের মনােরঞ্জন এবং অন্যান্য শিল্পকাজ।…

প্রাচীন ভারতে দেবদাসী প্রথা

….উর্বশীর মুখের এই কথাগুলি শুনলে বােঝা যায় যে বেশ্যাদের অবস্থাও ছিল ক্ষণিক সুখ ও আনন্দের বিলাসদ্রব্য স্বরূপ মাত্র। দেবগণ এবং দেবপ্রসাদ প্রাপ্ত রাজগণ এই স্বর্বেশ্যাদের সঙ্গ পেতেন এবং এই অপ্সরাসঙ্গ যথেষ্ট সম্মানজনক বলেই বিবেচিত হতাে। মহাভারতে শকুন্তলার উপাখ্যানে আমরা দেখি যে, অপ্সরা কন্যা শকুন্তলা রাজেন্দ্র দুষ্মন্তের মহিষী হয়েছেন। অন্যত, অর্জুনের আনন্দ বিধানের জন্য দেবরাজ ইন্দ্র ঊর্বশীকে তার কাছে প্রেরণ করেছেন, যদিও অর্জুন তাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। সামাজিক বিধিবিধান অনুযায়ী বেশ্যা অপ্সরাদের সঙ্গলাভে কোনো stigma বা কলঙ্ক আরােপ করা হয় নি। দেবদাসী প্রথায়ও এই ধারণাটিই স্পষ্ট দেখা যায়। মহাভারতে বারে বারেই অপ্সরাবৃত্তিকে ন্যায়সঙ্গত করার কাহিনী দেখানাে হয়েছে। শকুন্তলার কাহিনী সর্বজনবিদিত। ঊর্বশীর পুত্র আয়ু পুরুরবার ঔরসজাত এবং রাজ্যাভিষিক্ত। অঙ্গরাগণ বিভিন্ন সময়ে মুনিদের ধ্যান ভাঙানাের জন্য নিয়ােজিত হয়েছেন, তার জন্য কোন সামাজিক বাধা নেই। বরং এই ক্ষণমিলনজাত সন্তানরাও সমাজে সগৌরবে গৃহীত হয়েছে। দেবদাসীগণ দেবমূতির পত্নীস্বরুপ, সুতরাং তাঁদের সন্তানগণও সমাজে স্বীকৃত।…..

….দেবদাসীদের মর্যাদা অন্যান্য দাসদাসীদের চেয়ে তাে বটেই, সুশিক্ষিতা বারমুখাদের চেয়েও বেশী ছিল। এদের নিয়ােগ করা হতে কেবলমাত্র কলাবিদ্যা শেখানাের জন্যই। কঠোর পরিশ্রমে তাদের অধিগত করতে হতো নৃত্য, গীত, বাদ্য ও অভিনয়। বয়ঃপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে আপ্রাণ পরিশ্রমে অধিগত শিক্ষার পর তাদের উপস্থিত করা হতো নাটমন্দিরে দেবতার সামনে, যেখানে অন্যান্য রসিকজনেরাও উপস্থিত থাকত। এখানে নৃত্যপ্রদর্শনের পর বিচারক স্থির করতেন কে রুদ্ৰগণিকা হবে, এবং কে রাজগণিকা হবে। রুদগণিকা বা দেবদাসী হিসাবে যারা মনােনীত হতেন, তাদের মর্যাদা ছিল বেশী। শিল্পী হিসাবে তো বটেই, সামাজিক মর্যাদাও তাদের অলভ্য ছিল না। স্বয়ং রাজাও এদের প্রতি কামনার দৃষ্টি ক্ষেপণ করতে পারতেন না। সে অধিকার ছিল একমাত্র প্রধান পুরােহিতের।….

….দাসীবৃত্তি দুই ভাবে হতো। রঙ্গভােগ’ ও ‘অঙ্গভােগ। রঙ্গভােগের অধিকারিণী যারা তারা ছিলেন নৃত্যগীতে দেবতার মনােরঞ্জনকারিনী। ‘অঙ্গভােগ’-এর অধিকারিণীয়া দেবমূতির অঙ্গসেবা করতেন। এই দ্বিতীয় স্তরের দেবদাসীরা নিতান্তই ‘ভূত্যা’ শ্রেণীর। কালক্রমে এই ‘ভৃত্যা’ শ্রেণীর মেয়েরাই হয়ে পড়তেন বেশী অত্যাচারিত, কারণ দেবমূতির ‘ভৃত্যার’ পক্ষে পুরােহিতবর্গের ‘ভূত’ হয়ে পড়াটা অনিবার্য হয়ে উঠতো।

দেবদাসীদের আবার শ্রেণীবিভাগ ছিল। কীভাবে এবং সমাজের কোন স্তর থেকে এরা আহরিত হতো তার একটা ইঙ্গিত এই শ্রেণীবিভাগে পাওয়া যায়। দেবদাসাঁদের মধ্যে ছিল –

সত্তা—কোনাে পুণ্যলােভী গৃহস্থ স্বেচ্ছায় মন্দিরে কন্যা দান করলে সে হতো ‘দত্তা’ দেবদাসী । উদাহরণ স্বরূপ, কবি জয়দেব-গৃহিণী পদ্মাবতীর কথা উল্লেখ করা যায়। পদ্মাবতী নৃত্যগীতে সুনিপুণা ছিলেন বলে তার পিতামাতা তাকে জগন্নাথদেবের মন্দিরে দেবদাসীরুপে দান করেন।

হৃতা- যেসব মেয়েকে হরণ করে নিয়ে এসে মন্দিরে উপহার দেওয়া হতো। এই হরণ কার্য কার দ্বারা বা কার সহায়তায় (রাজা অথবা পুরােহিত) ঘটত তার সঠিক উত্তর পাওয়া যায় না।

বিক্রীত-মন্দিরের কর্তৃপক্ষের কাছে নিদিষ্ট অর্থের বিনিময়ে কন্যাকে বিক্রয় করলে সে বিক্রীতা দেবদাসীরূপে গণ্য হতো।

ভৃত্যা -যে দেবদাসী মন্দিরের কাজে ভূত্যারূপে আত্মোৎসর্গ করার জন্য সেচ্ছেয় মন্দিরবাসিনী হতো সে ভূতা।

ভক্তা- সেচ্ছায় আত্মসমর্পণকারিণী স্ন্যাসিনীকে ভক্তা দেবদাসী বলা হতো।

অলংকারা-নৃত্যগীত ও কলাবিদ্যা শিক্ষা সমাপ্ত হবার পর যে নারীকে অলংকৃত করে দেবমন্দিরে অর্পণ করা হতো, সে অলংকারা। রাজকন্যারাও
এভাবে মন্দিরে অপিতা হতেন।

গােপিকা বা রুদগণিকা—এর নিদিষ্ট সময়ে নৃত্যগীত করার জন্য মন্দিরের বেতনভােগিনী দেবদাসী সম্প্রদায় রূপে পরিচিত।

……অবশ্য নৃত্যকলা বিশেষজ্ঞ নর্তক-নর্তকীদের কথাও বলা হয়েছে রায়পসে নীয় সূত্রে মহাবীরের সম্মুখে নৃত্যের জন্য আহূত হয়ে নট ও নটীরা বত্রিশ রকমের ভঙ্গীতে নৃত্য প্রদর্শন করেছিল। সুপুরুষ তরুণ নর্তকগণ একদিক থেকে রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করছে, তাদের পরিধানে অযথােবাস, কটিদেশে বিচিত্রবর্ণ পটিক, উত্তরবাস হিসাবে কেবল উত্তরীয় এবং কষ্ঠেমাল্য ও অন্যান্য অলংকার। আর এক দিক থেকে নর্তকীর প্রবেশ করছে, তাদের ললাটে তিলকরেখা, সর্বাঙ্গ অলংকারভূষিত, শিবরাদেশে রত্নহার এবং বক্ষে বিচিত্র স্তনপট্র।…

…..অনুমান করা যায়, নিম্নশ্রেণীর সুন্দরী মেয়েদের যে কোনো উপায়ে গ্রহ করে তাদের দেবদাসীরূপে উৎসর্গ করে উচ্চবর্ণের প্রয়ােজন মেটানাের ব্যবস্থা করা হতো।
দেবদাসীদের শ্রেণীবিন্যাসের মধ্যে রয়েছে দেবদাসী সংগ্রহের রূপরেখা। রাজশক্তি ও পুরােহিততন্তু কীভাবে ধর্মের ব্যাখ্যা ও শক্তিকে কাজে লাগিয়েছে, তার প্রমাণ যথাক্রমে, ‘হৃতা’ ও ‘দত্তী পর্যায়ে পাওয়া যায়। সমাজ-ব্যবস্থায় রাজশক্তির এই প্রয়ােগ এবং পুরোহিততন্ত্রের কঠোর শাসন দেবদাসীদের কীভাবে সাক্ষাৎ প্রহরাধীনে রাখতে, তার টুকরো টুকরো বর্ণনাও পাওয়া যায়। সাধারণ বারাঙ্গনার ছিলেন জনসাধারণের যথেচ্ছ ব্যবহার্য সম্পত্তি, কিন্তু দেবদাসীরা ছিলেন সুরক্ষিতা, সাধারণ লােকের ধরাছোঁয়ার বাইরে।….

অর্থনৈতিক ও সামাজিক পশ্চাদপট

মদ চোয়ানো, সাকো গড়া, নৃত্যগীত, ইত্যাদি সব রকমের পেশাতেই লোেকদের স্থান ছিল। এই নিন্মশ্রেণী থেকে মেয়েদের যে অসাধনায় নেওয়া হতো, তারও প্রমাণ আছে। যতঃ বর্ণের লােকের নারীসংগ লালসা মেটাবার জন্য দৃঢ়যৌবনা নিন্মশ্রেণীর মেয়েদের নিয়ে ধর্মীয় আচারের সাহায্যে শােধন করে নিয়ে যােগিনী, অবধূতী ক দেবদাসী বানাতেন, অদ্যাবধি এই প্রথাই চলে আসছে ভারতের বহু জায়গায়।….
….স্বামী বিবেকানন্দের এই তীব্র সমালােচনা তৎকালীন ভারতের ধর্মজীবনের দিকে একটা বিশেষ আলোকপাত করেছে। সমাজ-ব্যবস্থায় এই পুরােহিত সমাজের সহায়তায় যে সমস্ত ঘৃণ্য প্রথার সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যে প্রধান হল দেবদাসী প্রথা।….

….দেবদাসী প্রথার পশ্চাৎপট রচনায় এই ধর্মীয় পটভূমি উনিশ শতকের ফুরােপীয় চিন্তানায়কদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় নি। Karl Marx-এর The British Rule in India’ নামক রচনায় স্পষ্ট উল্লেখ আছে,
“…in a social point of view, Hindoostan is not Italy, but the Ireland of East. And this strange combination of Italy and Ireland, of a world of voluptousness and of a world of woes, is anticipated in the ancient traditions in the religion of Hindoostan. That religion is at once a religion of sensualist exuberance and a self-torturing ascoticism : a religion of the Lingam and of the Juggernaut ; the religion of the Mook and of the Bayadere.” | সমাজে ‘দেববং পূজিত এই পুরোহিত শর্থ সমাজ গঠনে নেতৃ করতেন। তাঁদের নির্দেশ অনুযায়ী নারীভােগের উপচার সংগ্রহ করা হতাে।
দেবদাসী প্রথার আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা এখনও চালু আছে অনেক জায়গায়। পতিতাবৃত্তিতে মেয়েদের নিয়ােজিত করার উদ্দেশ্যেই দেবদাসী প্রথার সুযােগ নেওয়া হচ্ছে।….

ধৰ্ম-বিপর্যয়ের যুগ

….চৈতন্যদেবের ও তার সহচারীদের সাক্ষাৎ প্রভাবের অন্তরালে আবার ধীরে ধীরে এই নারীলোলুপতা যে শিকড় মেলছিল তার প্রকাশ ঘটতে থাকে সপ্তদশ শতাব্দীর পরে। বিভিন্ন বৈষ্ণব আখড়াগুলিতে আবার ধর্মের আবরণে নারী উপচার সংগ্রহের অপচেষ্টা ব্যাপক ভাবে শুরু হতে থাকে। এ সম্বন্ধে ঐতিহাসিক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের উক্তি উদ্ধত করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না,
…তন্ত্রশাস্ত্রে তান্ত্রিক দিগকে বেদাচারী, বৈষ্ণবাচারী, শৈবচারী, দক্ষিণাচারী, বামাচারী, সিদ্ধান্তচারী এবং কোলাচারী প্রভৃতি ক্রমোচ্চ নানা পর্যায়ে বিভক্ত করা হইয়াছে। ইহাদেব মধ্যে কেলিইি সর্বশে। কেহ এই সম্প্রদায়ে প্রবেশ করতে ইচ্ছুক হইলে তাহাকে ঐ সম্প্রদায়ভুক্ত একজনের নিকট দীক্ষা গ্রহণ করিতে হয় এবং দিবাভাগে নানাবিধ অনুষ্ঠানের পর ঘােষণা করিতে হয় যে সে পূর্বেকার ধর্মসংস্কার সমস্ত পবিত্যাগ করিল এবং ইহার প্রমাণস্বরূপ তাহার বন্ধি শ্ৰাদ্ব-কিয়া সম্পন্ন হয়। রাত্রিকালে গুরু ও শিষ্য ও আটজন বামাচারী তান্ত্রিক পরষ এবং আটটি স্ত্রীলােক ( নর্তকী, তাবি কন্যা, গণিকা, ধােপানী, নাপিতের স্ত্রী বা কন্যা, ব্রাহ্মণী একজন ভূস্বামীর কন্যা ও গােয়ালিনী)-সহ একটি অন্ধকার কক্ষে প্রবেশ করে এবং প্রতি পুরুষের পাশে একটি স্ত্রালোক বসে। গুরু তখন শিষ্যকে নিম্নলিখিতরূপ উপদেশ দেন। আজি হইতে লজ্জা, ঘৃণা, শুচি অশুচি জ্ঞান, জাতিভেদ প্রভৃতি সমস্ত ত্যাগ করিবে। মদ্য, মাংস, স্ত্রীসম্ভোগ প্রভৃতি দ্বারা ইন্দ্রিয় বৃত্তি চরিতার্থ করিবে কিন্তু সর্বদা ইষ্টদেবতা শিবকে স্মরণ করিবে। এবং মদ্য, মাংস, প্রভৃতি ব্রহ্মপদে লীন হইবার উপাদানস্বরূপ মনে করিবে। তান্ত্রিকেরা অনেক বীভৎ আচরণ করে যেমন মানুষের মৃতদেহের উপর বসিয়া মড়ার মাথার খুলিতে উলঙ্গ স্ত্রী-পুরুষের একত্র সুরাপান ইত্যাদি।
বৈষ্ণব সহজিয়াদেরও অনেক শাখা আছে। আউল, বাউল, সাই ইত্যাদি ছাড়াও কর্তাভজা, স্পষ্টদায়ক, সখী ভাবক, কিশােরী ভঞ্জনী, রামবল্লভ, জগম্মােহিনী প্রভৃতি নানা সম্প্রদায় সহজিয়া মতাবলম্বী। এই বিভিন্ন শাখার সহজিয়াদের মধ্যে সাধন প্রণালীর যথেষ্ট প্রভেদ থাকলেও গুরুবাদ, পুরুষের অবাধ মিলন ও পরকীয়া প্রেমের মাহাত্ম্য সকলেই স্বীকার করে।
দুর্গাপূজার শররােৎসব নামে যে উৎসব প্রচলিত ছিল, তার প্রধান অঙ্গ ছিল অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি সহকারে নৃত্যগীত। বৃহদ্ধর্ম পুরাণ ও কালবিবেক গ্রন্থে এর উল্লেখ আছে। এই পূজা উপলক্ষে যে নৃত্যগীত হতো তার সম্বন্ধে ঐতিহাসিকে, উল্লেখ,
“দিনের পূজা শেষ হইলে ধনী লােকের বাড়িতে একদল বেশ্যার নৃত্যগীত আরম্ভ হয়। তাহাদের পরিধেয় বস্ত্র এত সূক্ষ যে তাহাকে দেহের আবরণ বলা যায় না। গানগুলি অত্যন্ত অশ্লীল ও নৃত্যভঙ্গী অতিশয় কুৎসিত।” সপ্তদশ শতাব্দীর পর থেকেই আমরা দেখতে পাই বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের আখড়াগুলিতে ‘কিশােরী ভজনের নামে বালিকা সংগ্রহ এবং তাদের নিয়ে এক নতুন দেবদাসীবৃত্তির সূচনা। নবদ্বীপ, কেন্দুলী ও অন্যান্য বৈষ্ণবপ্রধান অঞ্চলের মেলায় ‘সেবাদাসী’ সংগ্রহের নানা কৌতুককর প্রথা দেখা যায়। সাধারণ বৈষ্ণবগণ কঠী বদলের মাধ্যমে সঙ্গিনী সংগ্রহ করেন, আবার সেবাদাসী’ সংগ্রহ করাও হয় কৌতুককর একটি প্রথার মাধ্যমে। আপাদমস্তক আবৃত অবস্থায় হাতের একটি আঙ্গুল বের করে মেয়েরা সারি সারি বসে থাকে এবং সংগ্রাহকেরা তাদের হাত ধরে নিয়ে যায়। ভাগ্যের হাতে নিজেদের ছেড়ে দেবার ফলে কারুর জোটে সুন্দরী দাসী, কারুর বা অসুন্দরী। এই ‘সেবাদাসী’র দল অবশ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গার্হস্থ্য জীবনের সঙ্গিনী। তবে অন্যান্য ভাবেও যে ‘সেবাদাসী’দের সংগ্রহ করা হতো তারও যথেষ্ট প্রমাণ আছে। অর্থের বিনিময়ে, কখনাে বা বলপ্রয়ােগে নিম্নশ্রেণীর বালিকাদের নিয়ে ভেক দিয়ে তাদের বিভিন্ন আখড়ায় নিয়ােজিত করা হয়। এই সেবাদাসীর দল দেবদাসী প্রথারই বিবতিত রূপ বললে খুব ভুল করা হয় না। বারাঙ্গনাদের তুলনায় এদের সামাজিক মর্যাদা অধিকতর ছিল। উপরন্তু এই সেবাদাসীরা কেবল আখড়ার প্রধান বৈষ্ণবেরই সেবাদাসী, সাধারণ লােকের ভােগ্য নয়। এদের সামাজিক মর্যাদাও তাই তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী।…..

দেবদাসী প্রথার বর্তমান প্রেক্ষাপট

…বর্তমানে দেবদাসী প্রথা ব্যাপক ভাবে বেড়ে চলেছে বিশেষ একটি ভূখণ্ডে। কর্ণাটক, কেরল, মহারাষ্ট্র, গােয়া, অন্ধ্র ও তামিলনাডুতে এই প্রথার ব্যাপক বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো শিল্পসমৃদ্ধ পশ্চিম উপকুলের শহরগুলিতে বারবণিতার চাহিদা। সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্য এলাকায়ও যে-সমস্ত মেয়ে-চালানী কারবার চলছে, তার সঙ্গে এই অঞ্চলের যােগ সবচেয়ে বেশী, অবশ্য ভারতের পূর্বাঞ্চলের উদ্বাস্তু পরিবারও তার বাইরে নয়। দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলে এই প্রথার ব্যাপ্তি প্রধানতঃ নিম্নশ্রেণীর মধ্যে।
মহারাষ্ট্রের সাংলী জেলার গেজেটিয়ারটি কৌতুহলোদ্দীপক। এই গেজেটিয়ারে দেবদাসী প্রথার উল্লেখ কোথাও নেই। কিন্তু মহারাষ্ট্রের বিচিত্র জাতিবিন্যাসের বর্ণনায় বলা হয়েছে কতকগুলি তপশীলভুক্ত নিম্নজাতির মধ্যে ‘মা’ জাতি, ‘মাহার’ জাতি ও চামার’ জাতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য, এরা নাচগানে পারদর্শী। বর্তমানে মহারাষ্ট্র অঞ্চলের এই সাংলী জেলাতেই মাঙ্গ জাতির উপাস্য দেবী ইয়ালাম্মা’কে কেন্দ্র করে দেবদাসী প্রথা চালু আছে।

বিভক্ত বাসবি সম্প্রদায়ের উদ্ভবের কারণ হিসাবে যা জানা গেছে, তা নিম্নলিখিতরূপ :

ক. এই মেয়েরা নৃত্যগীতবাদ্যে পারদশনী ও সুন্দরী। কারণ সুন্দরী মেয়েদেরই উৎসর্গ করা হয়। উদ্দেশ্য সহজেই অনুমেয়, পুরােহিত ও মাজার মনােরঞ্জন।
খ. স্থানীয় রাজন্যবর্গের পৃষ্ঠপােষকতা স্থায়ী ছিল না। মেয়েদের নিজস্ব উপার্জনের ক্ষেত্রও ক্রমশ সংকুচিত হয়ে যাচ্ছিল। জীবিকার জন্য বাধ্য হয়ে তারা বারবণিতা বৃত্তির সহজ আশ্রয় নিয়েছে।
গ. দাক্ষিণাত্যের ছােটো ছােটো রাজাদের আন্তঃকলহ এবং যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকত। রাজা বদল হয়েছে অনেকবার, ধর্মেরও বদল ঘটেছে। ফলে মন্দিরের সাক্ষাৎ রক্ষণাবেক্ষণে থাকার সুবিধা মন্দিরদাসীদের ভাগ্যে ঘটে নি। রাজকোষে রত্নবাজি, মন্দিরের বিগ্রহের রত্নরাজি এবং রাজঅন্তঃপুর ও মন্দিরঅন্তঃপুরে স্ত্রী-রত্নরাজি বার বার লুষ্ঠিত হয়েছে। ফলে কেবা নিত্য নতুন রাজাদেরই নয়, এই মন্দির-দাসীরা নিত্য নতুন ক্ষমতাশালী পুরুষদেরও ভােগের সামগ্রী হয়ে গেছে।

এই অবস্থাটা কিছু বৃত্তিসন্ধানী সুযােগকামীদের কাছে একটা নতুন মত্তকা হিসাবে এসেছে। সাধারণ মানুষের অন্তনিহিত ধর্মবােধের সুযােগ নিয়ে অর্থোপার্জনের একটা সহজ উপায় হিসেবে এই বৃত্তি স্বীকৃত হয়ে গেলাে। এই বৃত্তির স্তরভেদ আছে নানা রকম। তা হল
১. বালাগাডা বাসবি-কোনো পরিবারের একটি বিশেষ শাখা বা তার আত্মীয়দের পরিচর্যায় নিযুক্ত থাকত। সমাজের উচ্চতম শ্রেণীর ক্ষিতা হিসাবেই এরা থাকত। মন্দিরের পুরােহিত, কোনো বিশেষ নৃত্যশিক্ষক, বা কেবলমাত্র গ্রামেব প্রধান মোড়ল, এরাই এই শ্রেণীর বাসবি’দের পরিচর্যা পেত। এই শ্রেণীর বাসবিরা সামাজিক মর্যাদাবও আধিকারী ছিল। এদের সন্তানাদির উপরও কোনো কলঙ্কচিহ্ন বা Social Stigma আরােপিত হতে না। বাসবি’ শ্রেণীর মেয়েদের জাতিগত বৈশিষ্ট্যও উপেক্ষিত হত, কাৰণ দেবতার নির্মাল্য হিসাবে তাদের কোন জাতি থাকত না।
২. মনে বাসবি-একটি পরিবারের যুবকদের উপপত্নী হিসাবে এর। থাকে। ব্যবস্থাটি সম্ভবত এজন্যই, যাতে যুবকরা স্থানীয় পতিতা পল্লীতে না গিয়ে ঘরেই বৈচিত্র্যের স্বাদ পায়। উত্তর ভারতেও এরকম পারিবারিক দাসী থাকে, যারা গৃহকর্মের সঙ্গে সঙ্গে মনিবের শয্য।ভাগিনীও হতে বাধ্য। মুসলমান পরিবারে বাদীদের অখস্থাও একই রকম। দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন পরিবারে জীবনযাত্রা বিচিত্র। এই গৃহরক্ষিত উপবণিতারা ধর্মাশ্রিত বলে। গৃহিণীর পক্ষে সান্ত্বনা সূচক এবং বহুভােগী পুরুষদের পক্ষেও বিনা খরচে কেবল সামান্য খাওয়া-পরার বিনিময়ে নারীসঙ্গ লাভের সুবিধা। পারিবারিক দায়িত্ব তাদের প্রতি নেই এই মেয়েরা আর্থিক স্থিতির দিক থেকে সবচেয়ে অবহেলিত, তাড়িয়ে দিলেও তাদের যাবার জায়গা কোথায় ?
৩. জাতি বাসবি-কোনো বিশেষ একটি জাতিরই সেবা করবে। অন্য জাতির নয়। এ ক্ষেত্রে সম্ভবতঃ ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ই এ সুযােগের অধিকারী। অথবা অন্য নিম্নজাতিও হতে পারে। এ সম্বন্ধে ব্যবহারিক বাস্তব উদাহরণ পাওয়া কঠিন।
৪. বিডি বাসবি-বিডি অর্থাৎ পথ। পথে যারা দাড়িয়ে বেশ্যাবৃত্তি করে, তারাই এই বিডি বাসবি। বর্তমানে বাসবি’ কথাটা এ ভাবেই পতিতাবৃত্তির পরিভাষা হিসাবে ব্যবহৃত হতে শুরু করেছে।

দাক্ষিণাত্যে এই বাসবিদের পাশাপাশি একটি শ্রেণী দেখা যায়, তাদের ‘জোগতি’ বলে। এদের মধ্যে পুরুষদের বলা হয় ‘জোগত।। এরাও দেবদাসীই ছিল। তবে এরা ছিল সন্ন্যাসিনী। কোলাপুর অঞ্চলে অবশ্য যযাগিনী’ ও ‘দেবদাসী’ সমার্থক ছিল। তবে প্রভেদ ছিল এই যে যযাগিনী’ বা ‘জোগতি’ দেবতার পূজারিণী, অন্যের যৌনকামনা তৃপ্তির উপাদান নয়। দেবদাসী’র কর্তব্য যৌনকামনা তৃপ্তি সম্পাদন-পুরোহিরে এবং সমপর্যায়ের প্রভুদের। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধা ‘দেবদাসী’দের ‘জোগতি’ বলা হয়। এরা ‘জগ বা দেবমূতি বহন করে, ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনা করে এবং দেবতার আদেশ ভরের মাধ্যমে প্রচার করে।

এরাই নতুন দেবদাসী সংগ্রহ ও তাদের ব্রত ধরণের আয়ােজন করে, কারণ উৎসর্গের সময়ে অন্তত পাঁচজন দেবদাসীর উপস্থিতির প্রয়োজন হয়।
এ সবের সাধারণ উদ্দেশ্য ছিল মন্দিরের দাসীবৃত্তি। মন্দির পরিমার্জনা, পূজার উপকরণ সজ্জা, বিগ্রহের সাজসজ্জা ইত্যাদি। কিন্তু আর্যপ্রভাবিত দেবদাসী প্রথার সর্বনাশা দিকটাই এখানেও প্রকট-ধর্মীয় আবরণের আড়ালে দেবদাসীদের উপভােগের সামগ্রীতে পরিণত করা।
‘বাসবি’ ছাড়াও ভারতে পতিতাবৃত্তির ইতিহাসে তিন রকমের পতিতাবৃত্তির নাম পাল্লা যায়।

১। ব্যক্তি সুলে—কোনাে ব্যক্তির রক্ষিতা উপপত্নী। অষ্টাদশ শতকের বিদেশী বণিকর উপপত্নী প্রথাকে খুবই ব্যাপক করে দিয়ে ছিল। পতুগীজ, ফরাসী, ইংরেজ সকলেই স্থানীয় মেয়েদের উপপত্নী হিসেবে বাড়িতে রাখতে। এদের সন্তান-সন্ততিরা বর্তমানে ভারতীয় জাতিবিন্যাসে একটা বড়ো অংশ। এদেরই দেখাদেখি স্থানীয় ধনী ব্যক্তিরা উপপত্নী গ্রহণ শুরু করে। বর্তমানে অবশ্য পরিবারভুক্ত উপপত্নী কম দেখা যায়।
২। সমাজ সুলে—একটা সুনির্দিষ্ট পল্লীবাসিনী পতিতা। সর্বশ্রেণীর মানুষেরই তারা ভােগ্য।
৩। দেবদাসী-মন্দিরের পৃষ্ঠপোষকতায় এক বিশেষ ধরনের বারবনিতা। সমাজসলেদের সঙ্গে এদের প্রধান প্রভেদ হলো এই যে, এদের উপর সামাজিক কলক আরােপিত হয় না। ব্যাপারটি নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পূর্ণ যৌন স্বাধীনতা যদি সমাজে স্বীকৃত হয়, তবে তার একটা বিশেষ মূল্য আছে। দেবদাসী প্রথার মূল্য সেখানেই। তবু এই দেবদাসীদের জীবন স্বাভাবিক নয় বলেই এই প্রথা নারীচেতনার উপর অত্যাচার বলেই স্বীকৃত।

দেবদাসী সংগ্রহ ও সমাজ-বিন্যাস

…মহারাষ্ট্রের ও কর্ণাটকের শিল্পসমৃদ্ধ অঞ্চলের পতিতালয়গুলিতে নিয়মিত ভাবে এই দেবদাসী সম্প্রদায় থেকে মেয়েদের পাঠানো হচ্ছে। কলকাতা, মাদ্রাজ, দিল্লীও বাদ যাচ্ছে না। একটি সুচিন্তিত পরিকল্পনা এর পশ্চাতে কাজ করে চলেছে। এই মেয়েরা ক্রমেই শহরের পতিতালয়গুলি ভরে তুলছে। আন্তর্জাতিক পণ্য হিসাবেও এরা ব্যবহৃত। মধ্যপ্রাচ্যের বহু অঞ্চলে ভারতীয় শ্রমিকরা উপনিবেশ স্থাপন করেছে। তাদের এবং স্থানীয় নবধনিকবর্গের প্রয়ােজন মেটাবার জন্য যে মেয়েরা ভারতবর্ষ থেকে চালান হয়ে যাচ্ছে তার একটি বড় অংশ এই দেবদাসী সম্প্রদায়।

কুরুচিপূর্ণ যৌন-চিত্র ও যৌন-চলচ্চিত্রের একটা ঘৃণিত ব্যবসায় এই সমস্ত অঞ্চল থেকে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে রীতিমত সার জমিয়েছে। কেরল অঞ্চলের সমুদ্রবেলা কোভাল ও গােয়ার সমুদ্রবেলার ছােটবড় হােটেলে অাবৃত যৌনত্য ‘ক্যাবারে এখন প্রায় অভাবিক ব্যাপার। এই ক্যাবারে আর্টিস্ট হিসাবে যে মেয়েরা নিযুত হয়, তাদের কাজ যৌন উদ্দীপনাময় নৃতপ্রদর্শন এবং সময়ে সময়ে বেশ্যাবৃত্তি। ধনদেবতা কুবেরের নব মন্দিরের এই নতুন দেবদাসীরা মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রাম থেকে সংগৃহীত।
দেবদাসী নিয়ােগের গৌণ কারণগুলির মধ্যে কতকগুলি হল নিম্নজাতীয়দের লােকাচার বা সংস্কারপ্রসূত।
প্রথমতঃ পরিবারে অনেকগুলি মেয়ে থাকলে অন্ততঃ একটিকে দেবতার কাছে দিতে হবে, এটা প্রায় স্বতঃসিদ্ধ। এর জন্য মেয়েটির মা-বাবাও বিশেষ লখিত হন না। অবশ্য এর পিছনে একটা গুঢ় কারণ আছে। এতদঞ্চলে
মেয়েরা পৈতৃক সম্পত্তি বা বাড়ি ঘরের অংশ পায়। মেয়ে দেবদাসী হলে সত্তি অন্য পরিবারে না গিয়ে ঘরেই থাকে, তা ছাড়াও তার উপার্জনের ভাগও পরিবার পায়।
দ্বিতীয়ত, কোনো দম্পতি সন্তানহীন হ’লে মানত করে প্রথম কন্যা সন্তানটিকে দেবতার কাছে উৎসর্গ করা ছিল প্রাচীন রীতি। সাত-আট বছর বয়সেই মধ্যেই তাকে উৎসর্গ করতে হতো।
তৃতীয়তঃ, এবং সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য কারণ হ’ল দেবদাসী হিসাবে উৎসর্গীকৃত কন্যা পরিবারে পুত্রসন্তানের মর্যাদা পেয়ে থাকে। দেবদাসী উৎসর্গের সময় নিয়ম অনুযায়ী অন্ততঃ পাঁচজন জোগতি’কে আহ্বান করতে হয়। তাদের ভিক্ষাপাত্রে যথেষ্ট টাকা পয়সা ইত্যাদি ও অন্যান্য উপহারদ্ৰব্য দেওয়া হয়, যা ঐ দেবদাসীর পরিবারের প্রাপ্য। সুe:ং স্বভাবতই দরিদ্র হরিজনদের উপর এই প্রথার প্রভাব ব্যাপক হতে বাধ্য।
পতিতাবৃত্তিলব্ধ অর্থ পরিবার প্রতিপনের কাজে লাগে বলে সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটিকে দেবদাসীর জন্যে বেছে নেওয়া হয়, যাতে যৌবনে সে যথেষ্ট আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে।
অবশ্য যে মেয়ের পাত্র জোটে না শারীরিক কোনাে তুটির ফলে, সে দেবদাসী হিসাবে উৎসর্গীকৃত হয়। অথবা কোনো দুরারােগ্য রােগের আরোগ্য কামনা করেও কন্যা-উৎসর্গ করা হয় দেবী মন্দিরে। এগুলির নানা চেহারা ভারতের নানা জায়গায়। কোথাও মানতের জট কামানাে হয়, কোথাও বা নাক বা কানে ফুটো করে দেওয়া হয়। কিন্তু কন্যা-উৎসর্গের এই প্রথাটি এতদঞ্চলের বৈশিষ্ট্য।

এ ছাড়াও কতকগুলি সংস্কার চালু আছে। শুকনো কূপে জল আমার জন্য দেবদাসী মানত করা হয়। আকস্মিক ভাবে মাথার চুলে জট পড়লে সেট। দেবতার প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত বলে বিবেচনা করা হয়, ও জট যার মাথায় পড়েছে, সেই বালিকাটিকে দেবদাসী হিসাবে উৎসর্গ করা হয়।

এই সংস্কারগুলিকে আরো বেশি বন্ধমূল করে তােলার পিছনে কিছু প্রয়াস থাকে। হঠাৎই চুলে জট পড়ে না, মাঝে মাঝে চিটচিটে পদার্থ (মধু, হলুদ জল) চুলে লাগিয়ে দেওয়া হয়। পিতামাতা নিজেদের স্বার্থেই এই কাজ করেন। কারণ, বালিকাটি দেবদাসী হলে তাদের লাভ দুই ভাবে। সম্পত্তি বাড়িতেই রইল, উপরন্তু দেবদাসীর প্রাপ্যও ভােগ করার অধিকার রইল। গ্রামের প্রধান ব্যক্তির সহায়তাও লাভ করা গেল। একটি মেয়ের শরীরের বিনিময়ে এতখানি লাভের আশা ছাড়া কঠিন।
পুরােহিত ও পণ্ডিতের এ প্রথাকে সমর্থন করে চলেছেন প্রায় প্রকাশ্যেই। কারণ, তাদের আর্থিক প্রাপ্যও এই উৎসর্গের মাধ্যমে যথেষ্ট। দেবদাসীর উপার্জনের একটা অংশ নিয়মিত ভাবে এরা পান। তা ছাড়া ধর্মের আবরণে একাজ চালিয়ে যেতে পারলে আইন নাগাল পায় না।
বেলগাও জেলায় তামাক উৎপাদন কেন্দ্র নিপানীতে শ্রমিক হিসাবে নিযুক্ত লােকের সংখ্যা ২০০০। এর মধ্যে একটা বড় অংশ মেয়েরা। এদের মধ্যে
অধিকাংশই হরিজন। এই অঞ্চলটি প্রধানতঃ বােয্যই বাজারে পতিত সরবরাহের কেন্দ্রস্বরূপ। এই শহরের ৮০০ জন পতিতার মধ্যে ২০০ জনই দেবদাসী। এখানে নিম্নশ্রেণীর মেয়েরা তামাকের কারখানায় কাজ করে। মেয়ে শ্রমিক যারা কারখানায় কাজ করে, তারা দৈনিক পাঁচ টাকা হারে মজুরী পায়। রাত্রে তারাই আবার বেশ্যাবৃত্তি করে। দৈনিক দশ টাকা হিসাবে তারা গড়ে উপার্জন করে।
বেলগাও জেলারই আঠানী বােম্বাই পতিতালয়ের নারী সরবরাহের আর একটি কেন্দ্র। তেরাদল-মাঙ্গসুলী-আঠানী, তিনটি অঞ্চল এক ত্রিভুজাকৃতি ভৌগােলিক অঞ্চল তৈরী করেছে। বেশ্যা চালানকেন্দ্র হিসাবে এই অঞ্চলগুলি প্রসিদ্ধ।
আঠানীর লােকসংখ্যা ৩০,০০০। তার মধ্যে ৫০০০ হরিজন। ৫০০ পরিবারে এরা বিভক্ত। এই হরিজনদের মধ্যে শতকরা ৯৮টি পরিবারই পতিতাবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত। প্রতিটি পরিবারের অন্তত তিনটি মেয়ে এই বৃত্তিতে নিযুক্ত। পতিতাদের মােট সংখ্যা প্রায় ১০০০। এই সংখ্যায় অন্য সম্প্রদায়ভুক্ত পতিতাদের ধরা হয় নি। আঠানীর লােকসংখ্যা অনুযায়ী পতিতাবৃত্তিতে নিযুক্তদের হার অনেক বেশী।

হোনুসনুর জেলা দেবদাসী ও সাধারণ পতিতা সম্প্রদায়ের জন্য বিখ্যাত। উত্তর কর্ণাটকের বিভিন্ন নাটকের দলে এখান থেকে মেয়ে সংগ্রহ করা হয় নৃত্যগীত ও অভিনয়ের জন্য। গদাগ (Gadag) ও হাভেরি প্রভৃতি অঞ্চলে অভিনয় শিল্পের জন্য এই অঞ্চলের মেয়েদেরই বেশী পছন্দ করা হয়।
এই সমস্ত অঞ্চলগুলির অধিকাংশ হরিজন সম্প্রদায়ের মধ্যে এই বেশ্যাবৃত্তির হার ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ার কয়েকটি কারণ আছে। প্রথমত—মহারাষ্ট্রের সীমান্তবর্তী অঞ্চল বলে, এবং বােম্বাই বাজারের কাছাকাছি বলে এই অঞ্চলে মেয়ে চালানী ব্যবসায়ের সুবিধা অনেক বেশি।
দ্বিতীয়ত-এতদঞ্চলের মেয়েদের স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্যের খ্যাতি।
তৃতীয়ত-গ্রামাঞ্চলে উচ্চবর্ণের অত্যাচার ক্রমশঃ বেড়ে চলায় হরিজন। পতিতারা নগরপ্রান্তে আশ্রয় নিচ্ছে।
চতুর্থত-হরিজন যুবকদের কর্মসংস্থানের যথাযথ ব্যবস্থা না থাকায় পরিবারের মেয়েরা পতিতা বৃত্তি গ্রহণে বাধ্য হয়েছে।
দেবদাসী-উৎসর্গ প্রথার নিয়মাবলী অদ্ভুত। সচরাচর আট থেকে দশ বৎসর বয়সের বালিকাদের এ প্রথায় উৎসর্গ করা হয়। অবশ্য বিবাহিত মেয়েরাও আসে, আবার ১৭১৮ বৎসর বয়সের মেয়েরাও আসে উৎসর্গীকৃত হতে। তবে শিশুকালে উৎসর্গ করাই বিধি। জোগতি’ বা অবসর প্রাপ্ত দেবদাসীরা
কোনো এক উৎসবের সময় ‘ভর প্রাপ্ত হয় এবং কোনাে একটি বিশেষ পরি বারের নাম করে, যার থেকে একটি মেয়েকে দেবদাসী করা হবে। এমন কি, কোন মেয়েটিকে নেওয়া হবে, তাও সে বলে দেয়। বেশ বােঝা যায়, ক্ষমতাশালী ও সমৃদ্ধ ব্যক্তিরা আগে থেকেই জোগতি’ কে এ সম্বন্ধে শিখিয়ে পড়িয়ে রাখেন।

যে সমস্ত অঞ্চলে দেবদাসী প্রথার বিরুদ্ধে জনমত বিশেষ শক্তিশালী, সেখানে মেয়েটির আত্মীয়রা মেয়েটির গর্ভবতী হবার ব্যবস্থা করে। পরে তারা গ্রামের কর্তাদের কাছে দাবি জানায় যে, হয় তার বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে, অথবা তাকে দেবদাসী হবার অনুমতি দিতে হবে। বলা বাহুল্য, এই বিষয়ে দায়ী লােকটি উচ্চবর্ণের, এবং বিয়ের ব্যবস্থাও বেশ খরচ সাপেক্ষ। বরং দেবদাসী হবার অনুমতি দেওয়া সহজ, কারণ তার ফলে মেয়েটি কারাে ব্যক্তিগত সম্পত্তি না হয়ে সাধারণের ভােগ্যা হয়ে থাকবে।
দেবদাসী উৎসর্গ উৎসবের চেহারাটি প্রায় বিবাহ উৎসবের মতো। এই উৎসর্গীকৃত মেয়েরা সচরাচর যৌবনারম্ভের পূর্বেই দীক্ষিত হয়। নির্দিষ্ট দিনে, (পূণিমা তিথিই প্রশস্ত বলে বিবেচনা করা হয় ) হরিজন পল্লীতে অন্য দেবদাসীরা উপস্থিত হয়। অঙ্গে তৈললেপন করে ‘জোগতি’দের জন্য নির্দিষ্ট জগুলা বাভীতে (জোগতিদের কূপ) উৎসর্গ করার আগে ভাবী দেবদাসীকে স্নান করানো হয়। এই কৃপ যদি মন্দির প্রাঙ্গণে অবস্থিত হয় তবে তাকে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে কেবলমাত্র নিমপাতার মালা ধারণ করে সেখানে যেতে হবে মান করার জন্য। তারপর সমবেত দেবদাসীদের ভিক্ষাপাত্রে আহার্য পরিবেশন করতে হয়।
স্নানের পর নববস্ত্র পরিধান করে মন্দিরে যেতে হয়। পুরােহিত নির্দিষ্ট দক্ষিণার বিনিময়ে দেবীর কাছে প্রার্থনা জানান। দেবতার পূজা নিবেদন করে প্রসাদমালস্বরুপ ‘তালী অথবা স্থানভেদে মঙ্গলসূত্র’ পুরােহিত নিজেই তাকে পরিয়ে দেন, অথবা তার হাতে দেন। তখন সমগ্র পরিবার বাড়ি ফিরে আসে এবং পাঁচটি মুক্তাসদৃশ কাচের পুতি ঐ সূত্রে গেথে মেয়েটিকে পরিয়ে দেয়া হয়। এর পরে সমবেত মেয়েরা কন্যার মাথায় অক্ষত চাল ছুড়ে দিয়ে আশীবাদ করেন। বরের স্থান নেয় একটি ছোটো তরবারি। মন্দিরভেদে অনুষ্ঠানের বৈচিত্র্য বিভিন্ন।

এই সময়কার দৃশ্যটা এই, দূর-দূরান্তর থেকে দলে দলে যাত্রীরা আসছে। মাইলখানেক লম্বা গাড়ির সারি। সারি সারি নগ্নদেহ নিমপাতার মালা পরা ছােটো ছােটো মেয়ে দাড়িয়ে আছে উৎসগিত হবার জন্য, শুকনাে উপবাসখিন্ন মুখ, মান করানন বলির ছাগশিশুর মতো! একবার দেবদাসী হয়ে গেলে তাদের বিবাহ নিষিদ্ধ।

দেবদাসী-উৎসর্গ করা হয় ইয়েলেম্মার মন্দিরেই সবচেয়ে বেশি। তুলসী গেরির হনুমান মন্দিরে, টিকেটার হনুমান মন্দিরেও দেবদাসীদের উৎসর্গ করা হয়। এ ছাড়া জমদগ্নি মন্দিরে ও পরশুরামের মন্দিরেও দেবদাসী উৎসর্গ করা হয়। উৎসর্গের নিয়মাবলী মােটামুটি একই, তবে হনুমান মন্দিরে পুরোহিত দেবতার পূজা করে দেবদাসীর বাঁ হাতে অথবা বা দিকের বুকে তপ্ত মুদ্রার ছাপ একে দেন।
এই উৎসর্গীকৃত দেবদাসীরা বয়ঃপ্রাপ্ত হলে স্থানীয় উচ্চশ্রেণীর লোকেরা যথােচিত (অর্থাৎ ১০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা) মূল্য দিয়ে তাদের সঙ্গে প্রথম সহবাসের সুযােগ পান।
এই দেবদাসী উৎসর্গ উৎসবটিকে অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ্য করে এবং তাতে অংশগ্রহণ করে বােম্বাই অঞ্চলের পতিতালয়ের মালিকরা, কর্ণাটকের
কৃতি প্রচার কেন্দ্রগুলি, এবং বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে মেয়ে কেনা-বেচার ব্যবসা যারা করে তারা। কারণ সহজেই অনুমেয়।
এই অঞ্চলের মেয়েদের দেহসৌষ্ঠব, সৌন্দর্য ও নৃত্য-গীতবাদ্যে স্বাভাবিক পটুত্বের খ্যাতি আছে। সম্ভবত আদিলশাহী সাম্র জ্যের রাজধানী হিসাবে বিজাপুরের সংস্কৃতি ও ভােগবিলাসের ব্যাপক বিস্তার এই মেয়েদের মধ্যে বহু যুগ ধরে প্রসারিত হয়ে এসেছে। হিন্দু-মুসলমান নিবিশেষে বারনারীরা তাদের নৃত্যগীত পটুত্বের ঐতিহ্য বজায় রেখেছে। ফলে একদিকে কর্মসংস্থানের সুযােগের অভাবে ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য, অপরদিকে মহানগরীর বিলাসবহুল বর্ণাঢ্য জীবন যাত্রার হাতছানি এই অঞ্চলের মেয়েদের গভীর অন্ধকারে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ।……..

Please follow and like us:

Leave a Reply