যৌনপ্রবৃত্তি ও যৌনতপ্তি – রমেন্দ্রনাথ দে

›› বই এর অংশ / সংক্ষেপিত  ›› ১৮+  

ভুমিকাঃ যৌন-প্রবৃত্তি ও সমাজ

………সুপ্রসিদ্ধ জার্মান পণ্ডিত ডাঃ ম্যাগনাস হাসফিল্ড একবার ভাৰত-ভ্রমণে আসিয়া। মন্তব্য করিয়াছিলেন। সাধারণ লােক মনে করে যৌন-বিজ্ঞান আলােচনা পাপ ; উহা হইতে বিরত থাকাই শুদ্ধমপাপবিদ্ধং পুৰুষের লক্ষণ কিন্তু প্রকৃত কথা ঠিক তার বিপরীত-যৌন-বিজ্ঞান না জানাই পাপ-মানসিক বিকায়ের লক্ষণ। যৌনবিজ্ঞানালােচনার বিষয়ে ডাঃ হার্সফিল্ড প্রাচীন ভারতবর্ষকে আদর্শ স্বরূপ গ্রহণ করিয়াছেন তিনি বলিয়াছিলেন। প্রায় ২৫ হাজার বৎসর পূর্বে ভারতবর্ষে যৌন-বিজ্ঞানের আলােচনা হইত ও কামবিজ্ঞান সম্বন্ধে অনেক শাস্ত্রগ্রন্থও রচিত হইয়াছিল। তন্মধ্যে বাৎসায়নের কামসুত্র’ আজিও বর্তমান আছে। কিন্তু অঙ্গগুলি প্রায় লুপ্ত। ইহা হইতেই বুঝা বান, প্রাচীনকালে ভারতবাসীরা যৌন ৰিজনকে পাপ মনে করিয়া টর আলােচনায় লজ্জাবােধ করিতেন না।…….

……….আমাদের ধর্মের অঙ্গ হিসাবেও কামকলা চিরদিন পূজা পাইয়া আসিয়াছে। লিঙ্গ ও যােনীপিঠ সৃষ্টির মূলে কি সৃষ্টির মূলাধার কাম-ই পূজিত হইতেছে না?

এ যুগে ধর্ম ও সকল বিদ্যারই অপব্যবহারের ফলে কোন প্রকারই কামশাস্ত্র অধ্যাপনা করেন না, তাই কামশাস্ত্রের সুপণ্ডিত অধ্যাপকও আজ খুজিয়া মিলিবে না। সমাজে অযথা গােড়ামীর ফলেই না আজ সেই সকল কামশাস্ত্র-গ্রন্থগুলিও লুপ্ত হইয়াছে।

মহর্ষি বাৎসায়ন বলিয়াছেন: কাম শরীরকে রক্ষা করে, ধারণ করে, উহা ধর্ম ও অর্থের ফল স্বরূপ। বস্তুতঃ আহারে সংযম অভ্যাস না করিলে যেমন অজীর্ণ, অল্প প্রভৃতি পীড়ায় আক্রান্ত হইতে হয়, তেমনি কামক্রীড়ায় সংযম অভ্যাস না করিলে ও ত্রিকালজ্ঞ ঋষি নির্দিষ্ট উপায় অবলম্বন না করিলে অকালে জরাগ্রস্ত ও ভীষণ রােগাক্রান্ত হইয়া অকালে মানবলীলা সম্বরণ করিতে হয়।

এই সম্পর্কে ইয়ােরােপের অন্যতম দার্শনিক বালজাক্ বলিয়াছেন: “যৌন-সঙ্গমও একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাপার” এবং এই বিজ্ঞানকে না জানার দরুণ কত কত জীবনই না ব্যর্থতার গ্লানিতে ভরিষা উঠিতেছে! কত অসুখী স্বামী-স্ত্রী’ই না ইহার জন্য চরম দুঃখময় জীবনকে বরণ করিয়া লইতেছেন।………

……….জন্ম-নিয়ন্ত্রণের প্রণালী সমূহের মধ্যে withdrawal বা সহবাস-বিরতি বলিয়া যে প্রথা আছে তাহা এইরূপ : সঙ্গম সময়ে রেতঃস্থলনের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে স্ত্রী-অঙ্গ হইতে পুংজননেন্দ্রিয় খুলিয়া ফেলা। ইহাতে স্ত্রী-অঙ্গ মধ্যে রেতঃপাত না হইয়া বাহিরে রেতঃপাত ঘটিয়া থাকে। জন্ম-নিয়ন্ত্রণের এই প্রক্রিয়া অনেককাল অবলম্বন করার ফলে স্বামী স্ত্রী উভয়েরই মনে অতৃপ্ত ইচ্ছা ধীরে ধীরে জমা হইতে থাকে এবং ইহার ফলে একদিন স্বামী অথবা স্ত্রী অনেক সময় উভয়েই দারুণ উৎকণ্ঠা রােগে আক্রান্ত হয়।……..

……এসব কথা তাহার পঠিত কেতাৰে লেখে না, বাপ-মা শিখায় না, বিবাহিত সখীর শুধু মুচকি হাসিয়া একটু ইসারা প্রকাশ করে মাত্র। সুতরাং সে শিখিবে কোথায়? কাজেই সে ইহার জন্য প্রস্তুত থাকে না মােটেই। হঠাৎ প্রথম রজনীর স্বামী-সহবাস তাহার নিকট ঘৃণার ৰন্ত ও কষ্টদায়ক হইয়া পড়ে। মানসিক দিকটা হাড়িয়া দিলেও শারীরিক দিক হইতেও এরূপ অবস্থা সৃষ্টির একটা কারণ থাকে। সাধারণতঃ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কুমারী কন্যার যােনীর সতীচ্ছদ (Hymen) নামক একটা ঝিল্লীর মত পর্দায় ঢাকা থাকে। প্রথম স্বামী-সহবাসের সঙ্গে সঙ্গে উহা ছিন্ন হইয়া যায় এবং সারিতে কিছুটা সময় লাগে। এ সময় যােনীদেশেও খানিকটা বেদনা অনুভূত হইয়া থাকে।……

প্রথম অধ্যায় সহজাত প্রবৃত্তি :

……অনেক বনবাসী মানুষের সমাজে শিশুরা অতি শৈশবকাল হইতেই যৌনজীবনে পরিপক্কতা লাভ করিয়া থাকে। মলিনােউস্কি সাহেব ‘সেক্সয়েল লাইফ অব স্থাভেজে গ্রন্থে নিজ অভিজ্ঞতালব্ধ অনেক দৃষ্টান্ত দেখাইয়াছেন : নিউ গুয়েনা দ্বীপের অন্তর্গত ট্রাৰিয়াণ্ড। দ্বীপবাসী লােকেরা শিশুদের সমক্ষেই নিঃসঙ্কোচচিত্তে স্বাভাবিকরূপেই যৌনক্রিয়া সম্পাদন ও যৌন বিষয়ক আলাপ আলােচনাদি করিয়া থাকে। সেখানকার বালিকাদের পুংজননেন্দ্রিয় সম্পর্কেও কোনপ্রকার কৌতুহল নাই, কারণ তাহারা পিতা ও অন্যান্য পুরুষদের হামেশাই তাহাদের চক্ষের সমক্ষে উলঙ্গ হইয়া মৎস্য-শিকার করিতে দেখিয়া থাকে। ইহাতে পুংজননযন্ত্র সম্পর্কে তাহাদের কৌতুহল দমিত হইয়া যায়। অতি অল্প বয়স হইতেই এদেশের বালক-বালিকাগণ যৌন-উপদেশ লাভ করতঃ যৌনসম্পর্কীয় নানারূপ ক্রীড়া-কৌতুকে মত্ত হয়। অবশ্যই এসময় হস্ত ও মুখই তাহাদের এই কার্যের প্রধান সহায়ক হইয়া থাকে বটে; কিন্তু ৫-৬ বছর বয়স হইতে ইহার প্রকৃত যৌনকার্যেও সাড়া দেয়। তখন তাহারা ইহাকে এক প্রকার খেলার বস্তু হিসাবে মনে স্থান দিলেও আট বছর বয়সের মধ্যে প্রায় সমস্ত বালিকারই প্রকৃত যৌনজীবনের ভিত্তি স্থাপিত হইয়া যায়। তবে এ দেশের বালকদের প্রকৃত যৌনজীবন সুরু হয় আরও একটু বেশী বয়সে অর্থাৎ সাধারণতঃ ১০ হইতে ১২ বৎসরের মধ্যেই। অতি শৈশব হইতেই যে এ দেশের বালক-বালিকারা নানারূপ যৌন-বিষয়ক খেলায় মাতে তাহাতে কাহাকেও কোন আপত্তি করিতে দেখা যায় না।…..

……মার্গারেট মিড-এর সামােয় দেশ সম্পর্কে লিখিত গ্রন্থপাঠে জানা যায় সে দেশের বালক-বালিকাগণেরও অতি শৈশবেই যৌন-উন্মেষ দেখা দেয় ও যৌনজ্ঞান লাভ করে। যদিও সেখানে ছেলে ও মেয়েরা দূরে দূরে অবস্থান করে তথাপি তাহাদের নিকট যৌন ব্যাপারটা কোন অপরিজ্ঞাত বিষয় নহে। অতি বাল্য বয়সেই সেখানকার বালক-বালিকারা এ বিষয়ে সকল রকম পটুতা লাভ করে। ৬৭ বছর বয়স হইতেই সে দেবে বালিকাগণ পানিমেহন সুরু করে, আর বালকেরা দলবদ্ধ অবস্থায়ও ঐ কাৰ্য্য ও সমমেহন কাৰ্য্যাদি লােক সমক্ষে সম্পন্ন করিতে কুষ্ঠিত হয় না।…..

…অষ্ট্রেলিয়ার আদিম জাতিগণের মধ্যে দেখা যায় , সেখানেও বালকবালিকারা উন্মুক্ত স্থানেই কোন প্রকার লজ্জা সরম না করিয়া যৌনসঙ্গমে রত হয়। তবে ইহাদের বালক-বালিকাগণ একটু বেশী বয়সে যৌনপক্কতা লাভ করে অথাৎ ১৫ বছর বয়স্ক বালক এবং ১০ বছর বয়স্ক বালিকাদেরই অধিক ক্ষেত্রে যৌনপক্কতা লাভ করিতে দেখা যায়।…..

…….কিন্তু সেদেশের বালিকার বিশেষ করিয়া এ্যামেরিকান বালিকাগণ যত অল্প বয়সে যৌনচেতনা লাভ করিয়া ইহার ব্যবহারিক তৃপ্তিলাভে অগ্রসর হয়, আমাদের দেশের বালিকাগণের মধ্যে তাহা দেখা যায় অতি অল্প ক্ষেত্রে। আমাদের দেশের মেয়েদের নিকট হস্তমৈথুন ব্যাপারটা ইতিপূর্বে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপরিজ্ঞাতই ছিল। কিন্তু অধুনা সহরের মেয়েদের মধ্যে এ প্রথাটি অধিক পরিমাণে বিস্তার লাভ করিয়াছে; তথাপি বহু বহু গ্ৰাম্যবালা এ বিষয়ে আজিও অনভিজ্ঞ। ইহা আমার ব্যক্তিগত অনুসন্ধানের দ্বারাও প্রমাণ পাইয়াছি। আমার পরলােকগতা প্রথমা পত্নী ও আমার বর্তমান সহধর্মিণী এ অনুসন্ধান কার্যে আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করিয়াছে। তবে সমমিথুন ব্যাপারটা যে গ্রাম্যবালিকাগণের মধ্যেও দেখা যায় না তাহা বলা চলে না। আমার পরলোকগতা পত্নী অকপটে আমার নিকট ব্যক্ত করিয়াছিল যে, তাহার বাল্য সময়ে তাহাদের পাশের গ্রামের কোন বয়স্কা অবিবাহিতা বালিকা জোর করিয়া তাহার উপর নিজের সমকামিতা প্রবৃত্তি চরিতার্থ করিতে যাইয়া তাহাকে সামান্যরূপে আহত করিয়াছিল। এমনি ধরণের আরও প্রমাণও আমি সংগ্রহ করিয়াছি।…..

…..আমাদের দেশের ছেলেদের কৈশােরত্ব প্রাপ্তি ঘটে স্বাভাবিক ক্ষেত্রে প্রায় চৌদ্দ, আর মেয়েদের বারাে বছরে এবং এই কৈশােরত্বের পরিসমাপ্তি ও যৌবনের উদ্বোধন ছেলেদের স্বাভাবিক ক্ষেত্রে প্রায় সতেরাে-আঠাবােয়, আর মেয়েদের প্রায় পনেরাে-ষোলয়। ঐ সময়টার মধ্যেই পুরুষ ও নারীর যৌবনােদ্ভেদ ঘটিয়া থাকে অর্থাৎ Puberty Period. ঐ সময়েই নারী পুরুষের যৌনঅঙ্গগুলি পরিপূর্ণতা লাভ করে। মেয়েদের স্তনােভেদ, যৌনকেশ দেখা দেওয়া, জননযন্ত্রগুলিব স্বাভাবিকতা প্রাপ্তি, ঋতু প্রকাশ প্রভৃতি ব্যাপার গুলি ঐ কৈশাের সময় হইতে যৌবন প্রাপ্তির মধ্যে ঘটিবেই। যে ক্ষেত্রে উহা না ঘটে সে ক্ষেত্রে তাগ ব্যাধির পৰ্যায়ভুক্ত এবং কৈশােরত্ব প্রাপ্তির পূর্বে ঘটিলে উহাও স্বাভাবিক নহে। পুরুষদের বেলায়ও ঠিক ঐ কথা। কৈশাের হইতে যৌবন প্রাপ্তিকালের মধ্যে তাহাদেরও যৌনকেশ দেখা দেওয়া, দাড়ি গােফ উঠা, বীর্যের পরিপক্কতা প্রভৃতি ছটিয়া থাকে।

অনেক তরুণ ও তরুণীরই বিবাহিত জীবন আরম্ভ না হইবার ফলে তাহারা অনেকেই গোপনে স্বমেহন ও সমমেহনাদি কাৰ্যে রত থাকে এবং যাহাদের সাহস অত্যন্ত বেশী ও উপযুক্ত সুযােগ সুবিধা জোটে তাহারা সমাজের রক্তচক্ষুকে ভয় না করিয়া কুমার বা কুমারী জীবনেই যৌনলালসাকে স্বাভাবিক পথেই চরিতার্থ করে।……

……নারীর গর্ভধারণ ও সন্তান পরিচর্যার জন্যে প্রকৃতি তাহার সারাদেহেই জননেন্দ্রিয়ের সৃষ্টি করিয়াছে। নারীর দেহভ্যন্তরে ডিম্বকোষ (Ovary). ডিম্ববাহীনল (Fallopian tube), জরায়ু (Uterus or Woinb), স্তন্যকোষ প্রভৃতি গর্ভধারণােপযােগী বিবিধ জটিল যন্ত্রাদি ও মুক্তদেহে কুচযুগ, গুরু নিত, কোমল অঙ্গ, স্কুল উরু প্রভৃতি তাহার প্রমাণ।…..

দ্বিতীয় অধ্যায় প্রাচীন সমাজচিত্র ও যৌন-ইতিহাস:

লক্ষ লক্ষ বছর আগে অনাৰ্য মানুষের যুগে দৃষ্টিনিবদ্ধ করিলে আমরা দেখিতে পাই, তখন একজন পুরুষ বহু স্ত্রীলােকের অধিশ্বর হইয়া পাহাড়ের গুহায় বাস করিত। প্রথমতঃ একটী পুরুষ একজন স্ত্রীলােককে লইয়াই নীড় বাধিত ও তাহার সহিত যৌন-সংযােগের অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ ঐ রমণীর গর্ভে যেসমস্ত পুত্রকন্যা জন্মাইত তন্মধ্যে পুরুষ সন্তানগুলিকে পিতা হয় হত্যা করিত নতুবা একটু বড় হইলেই তাহাদিগকে দূর করিয়া তাড়াইয়া দিয়া কেবলমাত্র কন্যাগুলিকে নিজের কাছে রাখিয়া দলপুষ্ট করিত এবং সেই কাগুলি ক্রমে ক্রমে একটু বড় হইলে পিতাই হইত তাহাদের স্বামী, রক্ষাকর্তা ও রমণকর্তা। যৌনসহবাসের ফলে সেই কন্যাগণের গর্ভেও আবার সন্তান আসিত ও তাহাদের সন্তান-সমূহ হইতেও পুনরায় স্ত্রী-শিশু রাখিয়া পুংশিশুগুলিকে হত্যা বা বিতাড়িত করিত। অতঃপর আবার সেই পুনরাবৃত্তি। এমনি করিয়া একটী পুরুষ অগণিত নারীর অধিশ্বর হইয়া বিভিন্ন বয়সের বালিকা, কিশােরী, তরুণী, যুবতী, প্রৌঢ়া ভাৰ্যাগণের সঙ্গে প্রয়োজন মত সহবাসরত হইত। ঐ একটামাত্র পুরুষকে বিভিন্ন বয়স্কা অসংখ্য নারীর যৌনক্ষুধা মিটাইতে হইত। তখনকার দিনে নারীগণ ঋতুয়াতা হইলে পর অতিমাত্রায় কামার্তা হইয়া পড়িতেন। ঐদলে অনেক নারী হয়ত একই সময়ে ঋতুয়া হইত, আবার অনেকে হয়ত বিভিন্ন সময়ের পরিবর্তনে পর পরও ঋতুমতী হইত। কাজেই সেই পুরুষের বিভিন্ন রমণীকে প্রত্যহই যৌনসঙ্গ দান করিতে হইত অনেকবার করিয়া। সেই দলে প্রৌঢ়া, যুবতী, তরুণী, কিশােরী প্রভৃতি নানা বয়সের অনেক স্ত্রীলােকই থাকিত এবং তাহাদের সকলের যৌনক্ষুধাও সমান হইত না। প্রৌঢ়া ও অল্পবয়স্কদের যৌনক্ষুধার পরিতৃপ্তি সেই এককপুরুষ সহজে আনিয়া দিতে পারিলেও যৌবনপীড়িত যুবতীদের সকলের কামপরিতৃপ্তি দান করা তাহার পক্ষে বড় সহজ হইয়া উঠিত না, অথচ যে কোন সময়েই তাহাকে প্রস্তুত না থাকিয়া উপায় ছিল না। অতি কামার্তা নারীরা বার বার যৌনসঙ্গ লাভ করিতে চাহিলেও সেই দলপতিপুরুষকে তাহা দান করিতেই হইত। এমনি করিয়া পুরুষ সেই আদিমপ্রভাতেই তাহার স্বাভাবিক জৈবধৰ্ম বিসর্জন দেয়। প্রকৃতির প্রেরণাবশে নির্দিষ্ট সময়ে যৌনকার্যে রত হওয়ার পশুসুলভ প্রবৃত্তিটী সেইখানেই সে হারাইয়া ফেলে। কিন্তু সেই একটামাত্র পুরুষ অসংখ্য নারীকে যৌনসঙ্গ দান করার ফলে সেই পুরুষের যৌনষ ক্রমেই দুর্বল ও অক্ষম হইয়া আসিত এবং শুক্রতারল্য প্রভৃতি রােগবশতঃ ইন্দ্রিয় দুর্বল ও শিথিল হইয়া গেলে দলের অল্প বয়স্করা যৌবনসমাগমে অতিমাত্রায় কামার্তা হইয়া দিনরাত সহবাসাকাঙ্ক্ষায় আকুল হইত, তখন তাহাদিগকে তৃপ্ত করিবার ক্ষমতা সেই বৃদ্ধ বা | প্রৌঢ়ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব হইত না। কাজেই দলের মাঝে অপর কোন পুরুষ না থাকায় সেই কামার্তা নারীগণ নানারূপ অস্বাভাবিক উপায়ে যৌনতৃপ্তি খুঁজিয়া বেড়াইত। যদিও দুৰ্বল ইন্দ্রিয় লইয়াও সেই দলপতি কোনক্রমে কোন কামার্তা যুবতীর সঙ্গে বিহার করিত বটে, কিন্তু তাহা হইত নিতান্তই নিয়মরক্ষা ব্যাপার। তাহাতে যৌবনমত্তা কোন যুবতীই পরিতৃপ্ত হইতে পারিত না। ফলে সেই অতৃপ্তকামা নারীর উত্তেজনাবশে সমমিথুনে লিপ্ত হইত অথবা স্বমিথুনের দ্বারা যৌনক্ষুধার তৃপ্তিসাধন করিত। এইভাবে নারীগণও তাহাদের নির্দিষ্ট সময়ে যৌনক্ষুধা-বােধশক্তি হারাইয়া স্বভাবজাত ধৰ্ম্মনী চিরদিনের মত হারাইয়া ফেলে। কারণ নারীরা নির্দিষ্ট সময়েই যৌনক্ষুধা অনুভব করিত। কেবলমাত্র ঋতুসমাগমেই কামােত্তপ্ত হইয়া পুরুষকে আহ্বান করিত ও সেই আদিমযুগের পশুভাবাপন্ন শক্তিশালী পুরুষ অমিতবিক্রমে সেই নারীর সঙ্গে সঙ্গম করিয়া তাহার যৌন ক্ষুধার তৃপ্তি আনিত ; তাহার ফলে সেই নারীর মাসিক ঋতুর পুনরাগমন না হওয়া পর্যন্ত সে আর কোনরকমে যৌনক্ষুধা বােধ করিত না।

এইবার দেখা প্রয়ােজন, দলপতি কর্তৃক যে সকল পংশিশু বিতাড়িত হইত, তাহারা কিরূপে যৌন-জীবন যাপন করিত। একে একে পিতৃপরিত্যক্ত সন্তানগণ ক্রমে ক্রমে সকলে মিলিত হইয়া একটা দল বাধিত এবং যৌবনাগমনে তাহারা যখন যৌনক্ষুধা বােধ করিত তখন সকলে। মিলিয়া সমমিথুনে লিপ্ত হইত, অথবা পানিমিথুন প্রভৃতি অস্বাভাবিক উপায়ে যৌনক্ষুধার তৃপ্তিসাধন করিত। ইহাদের মধ্যে যদি কখনও দৈবাৎ কোন নারী আসিয়া পড়িত, তখন ইহারা সকলে মিলিয়া একে একে তাহার সহিত বিহার করিত। কখনও কখনও এই সকল বিতাড়িত ছেলেরা কোন কোন হারেমে যাইয়াও হানা দিত। তৎপর তাহাদের পিতা যখন দুর্বল ও বৃদ্ধ হইয়া আসিত তখন সেই বিতাড়িত দলের সবচেয়ে বলিষ্ঠ যুবা হঠাৎ একদিন পিতার হারেমে হানা দিয়া সেই প্রৌঢ় বা বৃদ্ধ পিতার জীবন-সংহার করতঃ সে দলপতির আসন অধিকার করিয়া তাহার মাতা, ভগিনী প্রভৃতির সহিত অমিতবিক্ৰমে বিহার করিয়া নূতন নূতন জন্মদান করিত।

পরে আবার একব্যক্তি ক্রমান্বয়ে অনেককাল যাবত বহু স্ত্রীলােকের ভর্তা হইয়া থাকিতে পারিত না, কারণ পূর্বোক্ত বিতাড়িত দলের মধ্যে যে যুবক পুনরায় শক্তিমান হইয়া উঠিত সে আবার তাহার ভাইকে হত্যা করিয়া সেস্থান অধিকার করিত। এরূপ হানাহানি তখনকার দিনের নিত্য ঘটনা। সেই পাষাণ-যুগের যবনিকা এইখানেই টানিয়া দিলাম।

প্যালেষ্টাইন

খৃষ্টজন্মের দুই সহস্র বৎসর পূর্বে প্যালেষ্টাইনের ইহুদী জাতি অতিথিবৎসল হিসাবে জগতে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করিয়াছিলেন। কিন্তু এই অতিথি সেবাপরায়ণতা প্রত্যেক ইহুদী পরিবারের মধ্যে এতটা মাত্রা ছাড়াইয়া উঠিয়াছিল যে, অতিথি সেবার জন্য তাহারা আপন আপন বন্ধু-কন্যাদের সতীত্বও নির্বিচারে অতিথির নিকট তুলিয়া ধরিতে কুষ্ঠিত হইত না। তাহাদের মধ্যে এই বিশ্বাস বদ্ধমূল ছিল যে, স্বর্গের দেবতা ও দেবদূতগণই মানবরূপে গৃহস্থের কুটিরে আতিথ্য গ্রহণ করেন এবং এই বিশ্বাসের বশবর্তী হইয়াই তাহারা আপন বধুকন্যাদের অতিথির শয্যাসঙ্গিনী করিয়া দেওয়াটা দেব-সেবারই তুল্য মনে করতেন। তাহাছাড়া ইহাও মনে মনে পােষণ করিতেন, অতিথিরূপ দেবতা বা দেবদূতগণের এই মিলনের ফলে তাহাদের বধু-কন্যাদের গর্ভে যে সকল সন্তানাদি জন্মগ্রহণ করিবে তাহারা দেবতাসদৃশ রূপবান, গুণবান, বলবান ও চরিত্রবান হইয়া জন্মলাভ করিবে। কিন্তু অতিথিসেবার এই সুযােগ গ্রহণ করিবার ছলে ক্রমান্বয়ে দিনের পর দিন অতিথির সংখ্যা বৃদ্ধি পাইতে আরম্ভ করিল এবং এইরূপে অতিথির সহিত অবৈধ সংযােগের ফলস্বরূপ ইহুদী যুবতীদের গর্ভে যে সকল সন্তান-সন্ততি আসিয়া জন্মলাভ করিল, তাহারা দেবতাসদৃশ না হইয়া পুরােপুরি মানুষরূপেই জন্মগ্রহণ করিতে লাগিলেন। শুধু তাই নয়, সেই সকল অবৈধ-সংসর্গের সন্তানগণ এত দুষ্ট ও দুর্দান্ত প্রকৃতির হইয়া উঠিতে লাগিল যে, ইহাদের জ্বালায় অতিষ্ঠ হইয়া ভগবান একদিন ধ্বংসের বন্যায় সমস্ত ইহুদী জাতিটাকেই সলিল-সমাধি প্রদান করিলেন। কেবলমাত্র বাচিয়া রহিল একটা ধার্মিক ইহুদী পরিবার।

ধবংসের মধ্যেই হয়ত অনন্ত সম্ভাবনার বীজও লুক্কায়িত ছিল, তাই সেই বিরাট ধ্বংসের পরে পুনর্বার নবতর ইহুদীজাতির জন্ম হইল। যে পাপ ধুইয়া মুছিয়া নিশ্চিহ্ন করিয়া দিতে ভগবান ধ্বংসের বন্যায় সমস্ত জাতিটাকেই শেষ করিয়াছিলেন, পুনরায় নবতর ইহুদীজাতির মধ্যেও সেই পুরাতন পাপ যৌনঅনাচার মাথাচাড়া দিয়া উঠিল–নব নবতর রূপে। এখানে দৃষ্টান্ত দেখাইতে গেলে তখনকার ইহুদী সমাজের একজন দলপতি জুদার কাহিনী বিস্তৃত করিতে হয়।

জুদা ছিলেন ইহুদীজাতির সর্দার। তাঁহার তিন পুত্র এ্যার, ওন্যান ও শেলা। এ্যার ছিল সকলের বড়, তারপর ওন্যান ও সর্বকনিষ্ঠ শেলা। সর্দার জুদা তামার নামী এক সুন্দরী যুবতীর সহিত এ্যারের বিবাহ দিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ বিবাহের সামান্য কিছুদিন পরেই তাহার মৃত্যু হয়। জুদা বিধবা তামারকে ওন্যানের সহিত পুনৰ্ব্বার বিবাহ দিলেন। কিন্তু ওন্যান স্ত্রী-সহবাস আদৌ পছন্দ করিত না; সে ছিল অস্বাভাবিক রতিক্রিয়াশক্ত। পানিমৈথুন, সমমেহন প্রভৃতি ক্রিয়ায় ওন্যান চিরঅভ্যস্ত হইয়াছিলেন এবং ঐ অস্বাভাবিক বৃতিপাপে সর্বদা লিপ্ত থাকার ফলে অচিরেই তিনি ধরাধাম ত্যাগ করেন। ভরা যৌবনে অতৃপ্তবাসনা লইয়া সুন্দরী তামার আবার বিধবা হইল। কিন্তু ভাদ্রের ভরানদীর মত তামারের সারাদেহতটে তখন ভরা যৌবন, তদুপরি কামনা-বাসনা ও মাতৃত্বের ক্ষুধা তামারের মনে-প্রাণে পঞ্চ-প্রীপ আলিয়া দিয়াছে। যৌবনের দুরন্তনেশা আমাকে আকুল করিয়া তুলিল—যেমন করিয়া কস্তুরীর গন্ধে মৃগ আকুল হয়। | জুদার সর্বকনিষ্ঠ পুত্র শেলা তখনও কৌমার্যব্রত ভঙ্গ করেন নাই। তামার সতৃষ্ণ নয়নে তাহার পানে তাকায়, কিন্তু জুদা কনিষ্ঠপুত্রের বিবাহ তামারের সহিত দিতে কিছুতেই সম্মত হইলেন না এই বলিয়া যে, তামারের গর্ভকোষ সন্তানধারণের উপযুক্ত নহে—সে স্বভাবতঃ বন্ধ্যা। কিন্তু এই মিথ্যা অপবাদ ও অন্যান্য যুক্তিকে যুবতী তামার কিছুতেই মানিয়া লইতে পারিলেন না।

তখনকার দিনে প্যালেষ্টাইনে সবেমাত্র একপ্রকার সাধারণ বেশ্যাবৃত্তি আরম্ভ হইয়াছে। দেশে রীতি ছিল যে, কোন নারী চৌরাস্তার মােড়ে অবগুণ্ঠনাবতী অবস্থায় বসিয়া থাকিলেই সাধারণে বুঝিতে পারিত, ঐ নারী বারবণিতাবৃত্তি অবলম্বন করিয়াছে।

একদা সর্দার জুদা মেষপালের লােম ছাটাই করিতে অদূরবর্তী এক পাহাড়ে গিয়াছিলেন।

এদিকে তামার বৈধব্যের বেশ পরিত্যাগ করিয়া সাজগােজপূর্বক ওড়নায় মুখ ঢাকিয়া চৌরাস্তার পারে যাইয়া বসিলেন। জুদা বাড়ী ফিরিবার পথে পুত্রবধূ তামারকে চৌরাস্তার মােড়ে বসিয়া থাকিতে দেখিলেন, কিন্তু মুখ ওড়নায় ঢাকা থাকায় চিনিতে পারিলেন না। জুদার যৌনচেতনা উদ্ব দ্ধ হইল এবং সে তাহার নিকট যাইয়া আপন মনােবাসনা ব্যক্ত করিলেন।

তামার শ্বশুরকে চিনিতে পারিয়াও সম্মতি জ্ঞাপন করিল। কিন্তু তাহার জন্য তাহাকে কি পারিতােষিক দেওয়া হইবে সে বিষয়ে প্রশ্ন করিলে জুদা বলিল, “একটা ভেড়ার ছানা বাড়ী থেকে এনে তােমায় দান করে যাব।”

তামার উত্তর দিল, “তােমার যা খুশী তাই দিও, কিন্তু তার পূর্বে জামীনম্বরূপ এখন তােমার নামাঙ্কিত ঐ হাতের আংঠী, বালাজোড় ও পাচনদণ্ড আমার কাছে রেখে যেতে হবে। পরে ভেড়ার ছানা পাঠিয়ে ওগুলাে ফেরৎ নিয়ে যেও।”

তারপর সম্মুখের অন্ধকার ঝোপে সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারে শশুর-জুদা পুত্রবধু তামারের দেহগ্রহণ করিলেন। দৈব বিড়ম্বনায় তাহারই ফলে তামারের গর্ভসঞ্চার হইল।

এদিকে বাড়ী আসিয়া জুদা প্রতিশ্রুত ভেড়ার ছানা পাঠাইয়া আপন জিনিষগুলি ফেরৎ আনিতে পাঠাইলেন। কিন্তু রতিপাপের অব্যবহিত পরেই তামার বারবণিতার বেশ পরিত্যাগপূর্বক শ্বশুরের অজ্ঞাতে অ পথ দিয়া শ্বশুরালয়ে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। সুতরাং জুদার প্রেরিত লােক অার সেই বারবণিতার সন্ধান পাইলেন না।

জুদা একদা জানিতে পারিলেন, পুত্রবধু তামারের গর্ভ হইয়াছে। কিন্তু বিধবার গর্ভ হওয়া (তখনকার দিনেও) যে মস্তবড় অপরাধ, তাহা ধৰ্ম প্রাণ জুদার অজ্ঞাত ছিলনা। তাই সে তামারকে আগুনে পােড়াইয়া মারিবার ব্যবস্থা করিলেন; কিন্তু তামার শ্বশুরের নামাঙ্কিত অঙ্গুরী, যষ্টি ও বালা বাহির করিয়া শ্বশুরকে প্রমাণ করিয়া দিলেন যে, অনাগত শিশুর পিতা সে-ই — অন্য কেহ নহে।

বর্তমান জগতের বহু পুরাতত্ত্ববিদ পণ্ডিত বিশেষ অনুসন্ধানের ফলে জানিতে পারিয়াছেন যে, সেই যুগে একসময় ইহুদীসমাজের নারীগণ ভীষণ কামব্যাধিতে আক্রান্ত হইয়াছিলেন। তদুপরি পুরুষেরা তাহাদের এড়াইয়া চলিত বলিয়া স্ত্রীলােকেরা পুরুষদিগকে কাছে পাইলেই রতিবাসনা পুরন করিতেন।……

….ধৰ্ম্মমন্দিরগুলি তখন অবৈধ যৌনচর্চার জন্যই যেন উন্মুক্ত ছিল। ধৰ্ম্মমন্দিরগুলি ছিল যেন নর-নারীর যথেচ্ছা কেলি করিবার একটা আশ্রয়স্থল। …বিবাহিতা নারীর সতীত্ব তখন লােকচকে মূল্যবান সম্পত্তি বলিয়া গণ্য হইলেও অবিবাহিতা কুমারী কন্যাগণ পরপুরুষ গমন করিলে তেমন কোন দোষাবহ ছিল না। এমনকি বহু পিতা কুমারী কন্যাকে বেশ্যারূপে কামবিলাসীদের নিকট বিক্রয় কিম্বা ভাড়া খাটাইতেন।….

….কন্যাগমন বা পিতৃগমন পাপেও এদেশ অভ্যস্ত হইয়াছিল। দৃষ্টান্ত স্বরূপ একটা ঘটনার উল্লেখ করা যাইতেছে।

গােমরা সহরের মহাসম্ভ্রান্ত ব্যক্তি লট, অতিথিপরায়ণ ও নানা সদগুণে বিভূষিত ছিলেন কিন্তু তাহার অতিরিক্ত পানদোষ ছিল। তাহার গৃহে ছিল দুইটী মাতৃহারা আইবুড়াে কন্যা। কন্যা দুইটী পিতার এই মাতাল হওয়ার সুযােগ লইয়া পিতার দ্বারা নিজদের প্রবৃত্তি চরিতার্থ করিয়া লইত। কিন্তু পরে ব্যাপারটা আর পিতারও অগােচর রহিল না। তখন স্বাভাবিক জ্ঞানাবস্থায়ই ঐ অবৈধ পাপকাৰ্য্য অনুষ্ঠিত হইতে লাগিল এবং এই জঘন্যতম পাপ সহবাসের ফলে কয়েকটী সন্তান-সন্ততিও জন্মগ্রহণ করিয়াছিল।

সেই সময়ে এককালে প্যালেষ্টাইনের কোন রমণীই সত্যিকারের সতীত্বের গর্ব করিতে পারিতেন না। তাহার উপর নানারূপ অস্বাভাবিক যৌনপাপে সারাদেশ ছাইয়া গিয়াছিল। ফলে সমস্ত দেশ উপদংশ ও প্রমেহ রােগের প্রভাবে জর্জরিত হইয়া লােকের পারিবারিক সুখ স্বাচ্ছন্দ্য লুপ্ত হইয়াছিল।

মিশর

পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বের মিশরের ইতিহাসের দিকে একবার দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, এদেশ তখন দেবতার নামে বহুপ্রকার অসঙ্গত যৌনলীলার প্রশ্রয় দিয়াছিল। কৌমার্য অথবা বিবাহিত জীবনেও নারী-পুরুষ যেমন খুসী বা যাহার সহিত ইচ্ছা যৌনসম্বন্ধ স্থাপন করতঃ আপন আপন প্রবৃত্তি চরিতার্থ করিত।

মিশরীয়দের প্রধানদেবতা আইশিশ ও অশিরিশ ইহারা পরস্পরে সহােদর ভ্রাতা-ভগ্নী হইলেও বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হইতে তাহাদের কোনই বাধা হয় নাই। আপন কন্যা অথবা ভ্রাতুস্পুত্রীর দেহ-বিক্রয়ের অর্থে জীবিকানির্বাহ করাটা তখনকার মিশরীয় সমাজে বিশেষ কোন অন্যায় বলিয়াই গণ্য হইত না।

মিশরের কোন রাজা একবার কোন চোর ধরিবার জন্য আপনার রূপবতী কুমারী কন্যাকে দিয়া গণিকাবৃত্তি করাইয়াছিলেন। ঘটনাটা এইরূপ : খৃষ্ট জন্মাইবার ২২শত বৎসর পূর্বে মিশরের রাজা প্রথম রামেশিশের রাজত্বকালে একবার তাহার কোকার হইতে বহু জহরৎ অপসারিত হয়। রাজপুরুষগণের সমবেত চেষ্টায় যখন চোর কিছুতেই ধরা পড়িল না তখন রাজা এক চমৎকার ফন্দী বাহির করিলেন। হঠাৎ কয়েকদিন পর রাজ্যময় হৈ হৈ পড়িয়া গেল বাপের সঙ্গে ঝগড়া করিয়া রাজার যুবতী কন্যা কুলের বাহির হইয়াছে। সামান্যমাত্র অর্থের বিনিময়ে যে কেহ তাহার ফুলের মত কোমল ও লাবণ্যপুঞ্জদেহ উপভােগ করিতে পারে। কোন বাধা নাই—কিন্তু নিজ নিজ জীবনের একটামাত্র দুঃসাহসিক কার্যের কাহিনী রাজকন্যাকে শুনাইতে হইবে। এমনিভাবে শত শত কামবিলাসী ও দুশ্চরিত্রের দল জীবনের কঠিনতম দুঃসাহসিকতার কাহিনী শুনাইয়া প্রত্যহ পরমানন্দে রাজকন্যার দেহ উপভােগ করিয়া যাইতে লাগিল। তারপর একদা সেই চোরও রাজকন্যার দুয়ারে আসিয়া উপস্থিত হইল এবং রাজকন্যাকে সে আপন দুঃসাহসিকতার কাহিনী শুনাইয়া তাহার দেহপ্রার্থী হইল। রাজকন্যা চোরের হাত ধরিয়া চীৎকার করিতেই শেয়ানা চোর হাত রাখিয়াই পলাইল। পরে জানা গেল, কোন সদ্যমৃত ব্যক্তির হাত কাটিয়া চোর নিজের আলখেল্লার মধ্যে লুকাইয়া আনিয়াছিল এবং তাহা ফেলিয়াই সে পলাইয়াছে। | চোরের এই অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাইয়া রাজ্যময় ঢােল দেওয়া হইল—যিনি এই অসাধারণ তঙ্কররাজ, তিনি অবিলম্বে রাজার সহিত সাক্ষাৎ করুন—রাজকন্যার সহিত তাহার বিবাহ দেওয়া হইবে। পরে তঙ্করাজ রাজার সহিত সাক্ষাৎ করিলে সম্রাট তাহার শতভােগ্যা রাজকুমারীকে সেই অঙ্করের সহিত বিবাহ দিয়া নিজ প্রতিজ্ঞা পালন করিলেন। …

….খৃষ্ট জন্মের বারোশত বৎসর পূর্বে মিশরের কেওঙ্গে নামক রাজা | তাহার বিখ্যাত পিরামিড নির্মাণের জন্য রাজকোষের সমস্ত অর্থ নিঃশেষ করিয়া ফেলেন। কয়েক হাজার লােক ২০ বৎসর যাবৎ ক্রমান্বয়ে পরিশ্রমের পর পিরামিড তৈয়ার সম্পূর্ণ করিল বটে কিন্তু রাজকোষ একেবারে কপর্দকশূন্য হইল। রাজমিস্ত্রীর অনেক প্রাপ্য তখনাে মিটানাে হয় নাই। রাজা অন্য কোন উপায় না দেখিয়া নিজের সৌন্দর্যের প্রতিমা অনুঢ়া কন্যাকে কিছুদিনের জন্য বেশ্যাবৃত্তি অবলম্বন করিবার উপদেশ দিলেন। | তাবপর রাজকন্যা কয়েক বৎসর নিজের দেহপাত্রখানি বিভিন্ন প্রেমিকের নিকট তুলিয়া ধরিয়া পিতার সমস্ত ঋণ পরিশোধ করিল। কিন্তু রাজকন্যা | নিজের জন্য ও একটী স্মৃতিসৌধ বা পিরামিড নির্মাণ করিয়া যাইবার মানসে | এই ঘৃণ্যতম পাপব্যবসায় পরিত্যাগ করিলনা এবং প্রত্যহ প্রত্যেক প্রেমিকের নিকট হইতে একখণ্ড করিয়া পাথর নজরানা স্বরূপ আদায় করিতে লাগিলেন। শেষ জীবনে তিনি অসংখ্য প্রেমিকের প্রদত্ত ক্ষণিক প্রেমের নজরানার অসংখ্য প্রস্তর ও অর্থপাশি দিয়া এক বিরাট পিরামিড | নিৰ্মাণ করিয়া যান। রাজকন্যার ঐ পাপকাৰ্য্যের সাক্ষ্য দিতে আজিও সেই পিরামিড অযুত পৰ্যটকের বিস্ময়পূর্ণ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। | পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বে অস্বাভাবিক যৌনপাপ মিশরে বর্তমান ছিল। দেবতার মন্দিরে পূজা নিবেদনের অজুহাতে বহু অবাধ রতিলীলা | অনুষ্ঠিত হইত। তখন মিশরের মন্দিরচত্বরে ও দেওয়ালে যৌন-সংযােগের যে সমস্ত অপরূপ ও অশ্লীল চিত্ৰসকল অঙ্কিত থাকিত তাহা কল্পনা করাও দুঃসাধ্য। মন্দিরের বহু দেব-দেবীর চিত্ৰই ভীষণভাবে উলঙ্গ, বহু দেবতার ইন্দ্রিয় উজ্জিত রহিয়াছে, কোন কোন পাথরমূর্তি-দেবতা পানিমেহনে নিযুক্ত, কোন দেবতা হয়ত কোন গৃহপালিত পশুর সহিত জঘন্যতম ও চক্ষুর পীড়াদায়ক ব্যাপারে রত। এমনি অসংখ্য অসঙ্গত পাপপূর্ণ যৌনচিত্র সকল হইতে তখনকার মিশরীয় সমাজের চরিত্রটা ভাল ভাবেই অধ্যয়ন করা যায়।….

……মিশরসম্রাজ্ঞী সুন্দরীশ্রেষ্ঠা ক্লিওপেট্রার কলঙ্কিত কাম-পঙ্কিলতার কথা কে না জানেন ? তাহার স্তন্যহীন পীনবকে কোনদিন মাতৃধা জাগে নাই—তার লজ্জাহীন হৃভঙ্গীর তলায় নতনেপাতে কোনদিন ঘরের কল্যাণদীপশিখা জ্বলে নাই। দিগ্বিজয়ী রােমানবীর সীজার ও তাঁহার প্রধান অনুচর মার্ক এন্টনীর প্রতি ক্লিওপেট্রার নির্লজ্জ প্রেম নিবেদনের কথা ঐতিহাসিক্ত ব্যক্তিমাত্রেই জানেন। তাহা ছাড়া সমগ্র মিশর সাম্রাজ্য ছিল তাহারই জন্যে, শুধু তাহারই বাসনা চরিতার্থ করিবার জন্যে। রাজ্যের মধ্যে যে সকল পুরুষ ছিল সুন্দরতম, বলিষ্ঠতম, মিশরে রাণী ক্লিওপেট্রার জীবনের সঙ্গে তাহাদের দুই এক রাত্রির যৌনসম্পর্ক গড়িয়া উঠিতই। যদিও ক্লিওপেট্র। তাঁর ভাই রাজা বাদশ টলেমীকে বিবাহ করিয়াছিলেন কিন্তু বিবাহিত ও অবিবাহিত প্রেমের কোনরূপ পার্থক্য তাহার কাছে ছিলনা। সীজারের সঙ্গে যৌনব্যভিচারে লিপ্ত হইবার ও ছাড়াছাড়ি হইবার পর তিনি তাহার আর এক ভাইকেও বিবাহ করিয়াছিলেন। যদিও এ বিবাহ শুধু রাজনৈতিক কারণেই ঘটিয়াছিল। কারণ নিত্য নব পুরুষদেহ উপভােগ করিবার জন্য ক্লিওপেট্রার কোন অভাব হইত না, কিন্তু সে কাহিনী বাহিরে ব্যক্ত হইবার আশঙ্কা ছিল খুবই কম। প্রাসাদ-অভ্যন্তরে গুপ্তপরীখায় থাকিত | অসংখ্য নরখাদক কুম্ভীর। পূর্বরাত্রিতে যে পুরুষের সঙ্গে ক্লিওপেট্রার | যৌনসঙ্গ হইত, পরের দিন সেই পুরুষ হইত তাহার পালিত কুম্ভীরের | খােক। দিনের পর দিন অসংখ্য নরদেহ ক্লিওপেট্রার কামবহ্নিতে ইন্ধন যােগাইবার সঙ্গে সঙ্গে কুমীরের খাদ্য হইয়াছে।

ব্যাবিলােন

…..ব্যাবিলােন দেশে সেইযুগে ধর্মের নামে ধৰ্ম্মমন্দিরে একপ্রকার অবৈধ যৌনসম্বন্ধ স্থাপিত হইত। অর্থাৎ মাইলিত্তা’ নামক দেবীমন্দিরে প্রত্যেক বিবাহিতা বা অবিবাহিতা রমণীকেই দেবীর তৃপ্তিসাধনের নিমিত্ত অন্ততঃ একবার অবৈধ রতিপাপে লিপ্ত হইতে হইত। রমণীগণ জীবনে অন্ততঃ একবার দেবমন্দিরের মাঝে পরপুরুষােপভােগ্য হইলেই মন্দির হইতে দুটি হইত অর্থাৎ দেবী তাহার প্রতি প্রসন্ন হইতেন।

ব্যাবিলােনের অন্তর্গত চ্যালডিয়া রাজ্যে তখন অতিথি সৎকারের নামে সতীত্ববিসর্জন প্রথা প্রচলিত ছিল। গৃহে অতিথি আসিলে কন্যা ও বধুগণ তাহার সর্বপ্রকার সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ও সৎকারের জন্য সর্বদা নিয়ােজিত থাকিতেন। অতিথিও যদৃচ্ছা দেহ-মনের ও সৰ্ব্বপ্রকার সুখ-সুবিধার সুযােগ গ্রহণে কুণ্ঠিত হইতেন না।

ব্যাবিলােনের সিংহাসনে তখন সম্রাট নেবুসাড় নেজার। তাঁহার রাণী ছিলেন ব্যাবিলােনের শ্রেষ্ঠ। সুন্দরী। কিন্তু কি কারণে নেবুসাড় নেজার হঠাৎ উন্মাদ হইয়া যান। উন্মাদ হইয়াও তিনি প্রাসাদ সংলগ্ন বিরাট উপবনে ছাগলের মত চরিয়া বেড়াইতেন এবং মানুষের খাদ্য পরিত্যাগ করিয়া ঘাস চিবাইয়া খাইতেন। প্রাসাদে রাজত্ব করিতেন রাণী-ব্যাবিলােনের সেই শ্ৰেষ্ঠা সুন্দরী।

প্রত্যহ সন্ধ্যায় সেনাপতি নামানের সহিত কুঞ্জভবনে রাণীর অভিসার রাত্রি অতিবাহিত হইত। উন্মাদ সম্রাট নেবুসাড় নেজার উপবন হইতে রাণীর অভিসারযাত্রা লক্ষ্য করিয়া বিরাট চিৎকার করিয়া উঠিতেন। তারপর একদা হঠাৎ সেই উন্মাদ সম্রাট সােজাপায়ে দাড়াইয়া রাজ প্রাসাদে প্রবেশ করেন। অবসরকক্ষের সম্মুখে সেনাপতি নামান সেই দীর্ঘ বলিষ্ঠদেহ সুস্থমুৰ্ত্তিকে সম্মুখে দেখিয়া বিমুঢ় হইয়া যান। নেবুসাড় নেজার গর্জিয়া উঠেন : নামান’!

সেই আহ্বানে ভুলিয়া-যাওয়া-ভঙ্গী আপনা হইতে ফিরিয়া আসে। নামান নতমস্তকে প্রভুকে অভিবাদন করে।

তারপর নেবুসাড় নেজার রাণীর গুপ্ত-অভিসারের জন্য যথেষ্ট ক্ষোভ প্রকাশ করেন ও বলেন,•••••‘প্রতিদিন সন্ধ্যায় তুমি রাণীকে নিয়ে ঐ উপবনে কুঞ্জভবনে ঢুকতে তােমাদের চুনশব্দে তৃণফুল রক্তিম হয়ে উঠতাে। আমি সেইখানে ঘুরে বেড়াতাম। একটা মাছি এলে যতটুকু বাধা হয়, আমার উপস্থিতিতে ততটুকু বাধা তােমরা বােধ করতে না। রাত্রির শেষদিকে দেখতাম, তুমি আর সে, শেষ অন্ধকারে প্রাসাদের দিকে চলেছ। শেষরাত্রির সেই পাণ্ডুর অন্ধকারে তার নগ্ন-শুভ্রতার জ্যোতি দেখে মনে হােত, যেন উপবন থেকে উষা চলেছে দিবসের দিব্যজ্যোতি অঙ্গে বহন করে। পিছু পিছু গিয়ে দেখতাম, শত শত ক্রীতদাস রাত্রি জেগে দাঁড়িয়ে আছে—শুধু সেই নগ্ন-মুহূর্তটুকু, অন্ততঃ তােমার মত না হােক, কিছু উপভােগ করবার জন্যে। আমি জানি ক্রীতদাসদেরও কামনা আছে। তুমি, আমি যেমনভাবে রাণীকে চাই, কি বল নামান, তারাও কি মনে মনে ঠিক সেই কামনাই করে না? শােন নামান! তােমারই উপর আমার আদেশ, কাল রাত্রিতে তুমি নিজে রাণীকে ক্রীতদাসদের মহলে পৌছে দেবে।”

পরের দিন সন্ধ্যায়। রাণীর দাসীরা সব প্রসাধন লইয়া ব্যস্ত। কুঞ্জভবনে অভিসারের লগ্ন আসিয়াছে। মরুভূর রক্তকুসুম নিষ্পেষণে অধর রক্তিম হইয়াছে, সারা অঙ্গে চন্দনের সুরভি, অঙ্গে ক্ষীণ অকারণ বস্ত্র। রাণী ডাকিলেন, নামান। | সেই উপবনের পথ। সন্ধ্যার সদ্যফোটা ফুলের গন্ধে মধুমান্ সেই অভিসার-রজনীর অন্ধকার।

হঠাৎ কুঞ্জভবনের পথে আসিয়া রাণীর খেয়াল হয়, আজ ত তাহার উন্মাদ স্বামীর চীৎকার শােনা গেলনা! এমনি সময় তাঁহাকে আসিতে দেখিলেই সে চীৎকার করিয়া উঠিত। আজ সে কোথায় ? ক্রীতদাসীরা অনুসন্ধানে যাইয়া কেহই আর ফিরিয়া আসিল না।

সম্মুখে নামানও প্রস্তরমূর্তির ন্যায় দণ্ডায়মান। শঙ্কিতকণ্ঠে রাণী ডাকিলেন, নামান। রাজ উপবনে তখন সবেমাত্র নিশিগন্ধারা দল মেলিয়া চাহিতেছিল। এমন সময় সহসা রাজপ্রাসাদের ভিতর হইত শত শত ক্রীতদাস আনন্দে চীৎকার করিয়া উঠিল। রাণী বিস্ময়বিমুঢ় নেত্রে চাহিয়া দেখিলেন, তাহারা তাহারই দিকে ছুটিয়া আসিতেছে……রাণী ফিরিয়া, দেখেন নামানও সেই অন্ধকারের বুকে অদৃশ্য হইয়াছে !••••••তারপর বহুকাল পৰ্যন্ত সেই কাহিনী মরুবাসিনীদের মুখে মুখে প্রচলিত ছিল, কেমন করিয়া একদা শত শত ক্রীতদাসের চুম্বনে ব্যাবিলােনের রাণীর দেহ চূর্ণিত হইয়া গিয়াছিল।…..

সিরিয়া

…..পৃথিবী-দিগ্বিজয়ী সম্রাট আলেকজাণ্ডার যখন সিরিয়া ও ব্যাবিলােনিয়া রাজ্য জয় করেন, তখন ঐ দেশগুলি দুর্নীতির প্রবল বন্যায় ভাসিতেছিল। বহু সম্রান্ত পরিবারের নর-নারীগণ উৎসবাদিতে অবাধে মদ্যপান করিত এবং ভােজসভাদিতে আহারের সময় যুবতীকন্যা ও বধূগণ মাতাপিতা, শ্বশুর-শ্বাশুরী কিংবা স্বামীকে কিছুটা সমীহ করিয়া চলিতেন। কিন্তু শেষটায় মদ্যপান করিতে করিতে যখন নেশা বেশ জমিয়া উঠিত তখন ঐ নারীগণ নিজেদের পােষাকগুলি একটার পর একটা ক্রমান্বয়ে খুলিয়া ফেলিয়া নগ্ন হইয়া যাইত। বধু-কন্যাদের গুরুজনগণ তখন আলগােছে একদিক দিয়া সরিয়া পড়িতেন। তারপর অন্যান্য অতিথি অভ্যাগতদের সহিত বধূ-কন্যাদের যে জঘন্য রতিমজলিস জমিয়া যাইত তাহা বর্ণনা করাও অসম্ভব।…..

ফিনিসিয়া

ফিনিসিয়া, সিরিয়া, অকাদিয়া প্রভৃতি দেশেও ধর্মের নামে একপ্রকার অবৈধ যৌনানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হইত—ইহাও প্রায় ব্যাবিলােনিয়ার মতই। ব্যাবিলােনিয়ায় যেমন ‘মাইলিত্তা দেবীর মন্দিরে যে কোন বিবাহিতা বা কুমারী মেয়েকেই জীবনে অন্তত একবার অবৈধ যৌনপাপে লিপ্ত হইতে হইত, তেমনি ফিনিসিয়া, আর্মেনিয়া, অকাদিয়া, সিরিয়া প্রভৃতি দেশেও ‘আস্তারতে দেবীর মন্দিরে যে রমণী যত বেশী পরপুরুষ সংসর্গিণী হইত, তিনি নাকি ততবেশী দেবীর আশীৰ্বাদ লাভ করিত।

তাহা ছাড়া ঐ সকল দেশেও গৃহে অতিথি আসিলে নারীগণই তাহার পরিচর্যা করিত এবং ঘরের কুমারীকন্যাগণকে রাত্রিতে অতিথির সহিত সারানিশি যাপন ও অবৈধ সংসর্গে মাতিতে হইত। ফিনিসিয়া দেশে এই প্রথাটি প্রথম বিদেশাগত রাজপুরুষ ও ব্যবসাদারগণকে হাত করিবার জন্য আপনাপন গৃহকন্যাদের দ্বারা তাহাদেব যৌনাভিলাষ পূরণ করতঃ কাৰ্য্য হাসিল করিত, কিন্তু পরে এই পাপ প্রথাটি সহজ সাধারণ অতিথির জন্যও দাঁড়াইয়া গেল। তাহা ছাড়া কুমারী কন্যাগণ দেবীমন্দিরে পরপুরুষগণের নিকট নিজেদের সতীত্ব-বিসর্জন দিয়া যে সকল অর্থ উপার্জন করিতেন তাহা তাহাদের নিজ নিজ বিবাহের যৌতুকরূপে ব্যবহার করা হইত।

পারস্য

আদিম পারসী জাতিও দেবতার নামে অবৈধ যৌনােৎসবের প্রশ্রয় দিয়াছিল। তাহা ছাড়া পূজাপাৰ্বন ও উৎসবাদি উপলক্ষে গৃহে আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবের সমাগম হইত। সকলে মিলিয়া পাননাৎসব, নৃত্য ও ভােজনে উম্মত্ত হইয়া উঠিতেন। দেবতার প্রসাদী-করা সুরা বালক বালিকা নির্বিশেষে সকল বয়সের নারী-পুরুষগণ মিলিয়া পান করিতেন। কোন কোন দিন মুরার মাত্রা অসম্ভবরূপে বাড়িয়া গেলে ঘােট ঘােট বালক-বালিকাগণ অজ্ঞান হইয়া পড়িত। তারপর গীতবাদ্যের উৎসবে বয়ৰু নর-নারীগণ গা ভাসাইয়া দিয়া ক্রমে দেহে অবসন্নত। আসিলে লাজ-লজ্জা, মান-সম্রম পরিত্যাগপূৰ্ব্বক সর্বপ্রকার রক্তের সম্বন্ধ বিস্মৃত হইয়া অবাধ রতি-সংগ্রামে মাতিয়া উঠিতেন। সারানিশি এমনি কুৎসিৎ ও পৈশাচিক মদনযজ্ঞে নিজেদের অহতি দিয়া উষার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে তাহারা আবার প্রাচীন সম্বন্ধে ফিরিয়া আসিত।

তখন ইয়ােরােপ ও পশ্চিম এশিয়াস্থ দেশসমূহে হাটেবাজারে নরনারী ছাগল-ভেড়ার ন্যায় বিক্রয় হইত। বহুকাল ধরিয়া এই পাপব্যবসায় চলিয়া আসিতেছিল। কিন্তু পারস্যে ইহার মাত্রাধিক্য পরিলক্ষিত হইত। দাস-ব্যবসায়িগণ বিভিন্ন দেশের দরিদ্র আত্মীয়-স্বজনের নিকট হইতে অল্পমুল্যে বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ ক্রয় করিয়া, কোন কোন ক্ষেত্রে চুরি করিয়া, হাটে-বাজারে তাহাদিগকে বিক্রয় করিতেন। প্রায় নগ্নাবস্থায় ঐ সকল স্ত্রী-পুরুষকে সারি সারি দাঁড় করাইয়া রাখা হইত। তারপর ধনী ক্রেতার দল দাস খরিদ করিতে শুধু খুজিতেন তাহার বলিষ্ঠ ও সুন্দর দেহ; কিন্তু দাসী খরিদের বেলা বাছিয়া বাছিয়া বাহির করিতেন অল্পবয়স্কা ও সুন্দরী। অবশ্যই অল্পবয়স্ক নরনারীর মূল্যও ছিল এজন্য বেশী। তদুপরি সুন্দরী নারী বা সুন্দর দাস হইলে বিক্রেতাগণ দাম আরও বেশী হাঁকিতেন। | নারী খরিদের বেলা ক্রেতাগণ জঘন্য নির্লজ্জতার পরিচয় দিতেন। অনেক সময়ই ক্রেতাগণ ঐ সকল নারীদের লজ্জাস্থানগুলি নাড়িয়া চাড়িয়া যাচাই করিতেও কুণ্ঠিত হইত না। কারণ ক্রেতাগণ এইসব দাসীবাদীদের দ্বারা কেবলমাত্র চাকরাণীবৃত্তিই করাইত না—প্রথমতঃ ধনীপ্রভু ক্রীতদাসীর রূপ যৌবন নিঃশেষে উপভােগ করিয়া যখন মধু ফুরাইয়া যাইত, তখন ইহাদিগকে সাধারণ দাসী শ্রেণীতেই ফেলিতেন অর্থাৎ ইহার পর বাকী জীবন তাহাদের দাসীবৃত্তি করিয়াই কাটত। তাহাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বা সুখ-দুঃখের কোন মূল্যই থাকিত না—তাহাদের ছিল মাত্র সারা দিনরাত্র হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম। এমনিভাবে একের পর আর নুতন দাসী ধনীপ্রভুর আটপৌড়ে মদন পিপাসা মিটাইত কিন্তু সুন্দর ক্রীতদাসগণ অনেক সময় ইহার সুন্দর ঋণ পরিশােধ করিত ধনী প্রভুর গৃহকত্রী বা তাহার কন্যাদের শয্যাসাথী হইয়া।

আপন বিবাহিত পত্নীকে অপরকে ধার দেওয়ার পাপ প্রথাটি তখনকার পারস্যে বহুকাল যাবৎ প্রচলিত ছিল। দরিদ্র স্বামীর কিছু টাকা লইয়া স্ত্রীকে কিছুকালের জন্য অন্যের উপভােগের জন্য ছাড়িয়া দিত। এই সময়ের মধ্যে স্বামীর সেই স্ত্রীর উপর কোন দাবীদাওয়া থাকিত না। যে প্রভু ইজারা লইত, সে তাহার উপর নিজের ইচ্ছামত গমন ও বিহার করিত—ইহাতে ঐ নারীর কোনরূপ প্রতিবাদ বা অনিচ্ছা প্রকাশ করিবার স্বাধীনতা থাকিত না। পারস্যে তখন বহু ব্যাপকভাবে এই পাপ-ব্যবসায় প্রচলিত ছিল। ঠিক এই কারণেই প্রাচীনকালে পৃথিবীর সর্বত্র স্ত্রীকে একটা বিশেষ সম্পত্তি বলিয়া মনে করা হইত এবং প্রয়ােজন হইলে সােনা-রূপার জিনিষের মত স্ত্রীকে অপরের নিকট নির্দিষ্ট সময়ের জন্য গচ্ছিত বা বন্ধক রাখিয়া টাকা ধার লওয়া হইত। মেয়াদ ফুরাইলে আবার স্ত্রীকে ফিরাইয়া লইত। ঐ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যদি স্ত্রীর গর্ভে সন্তান আসিত, ঐ সন্তানও ইজারাদারেরই হইত এবং মেয়াদ ফুরাইবার সময় যদি কোন স্ত্রীর গর্ভলক্ষণ প্রকাশ পাইত, তাহা হইলে গর্ভ খালাসের পর সেই সন্তানের পিতা হইত সেই ইজারাগৃহিতাই। সন্তানের ভরণপােষণের জন্য সেই আইনতঃ বাধ্য থাকিত।

গ্রীস

প্রাচীন গ্রীসে ভিনাস পেরিবেসিয়া মন্দিরে বৎসরে একদিন বিভিন্ন সহরের ও মফঃস্বলের সঙ্গীতানুরাগী ও বংশীবাদিনী নারীগণ উৎসবে মত্ত হইত। সেইদিন নারীদের মধ্যে সুর, সঙ্গীত ও রূপের প্রতিযােগিতা চলিত এবং যে সকল নারী শ্রেষ্ঠত্বের আসন অধিকার করিত তাহারা পুরস্কৃত হইতেন। এই উৎসবে সারানিশি অতিবাহিত হইত ; কোন পুরুষেরই সেখানে প্রবেশাধিকার থাকিত না। কিন্তু সূৰ্যাস্ত হইতে আরম্ভ করিয়া পরের দিন সূর্যোদয় পর্যন্ত এই উৎসবে যে সমস্ত নির্লজ্জ কদর্যতার অভিনয় চলিত, তাহা সে যুগের পুরুষগণও সহ করিতে পারেন নাই। সুর, সুরা, বিবিধ প্রসাধন ও বিলাসখাদ্যে, পুষ্পরাজি ও গন্ধদ্রব্যাদির প্রাচুর্যে মন্দির প্রাঙ্গন পূর্ণ থাকিত। নারীগণ গীতবাদ্যের প্রতিযগিতার পর সুরাপানে মত্ত হইতেন। অবশেষে লজ্জা-শরম বিসর্জন দিয়া তাহারা বিপক্ষদলের সহিত রূপ-প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মাতিয়া উঠিত। প্রতিদ্বন্দ্বিনী যুবতীগণ পরস্পর নিজ নিজ সৌন্দৰ্য্যস্থানের বিশিষ্টতা জঘন্যতম অশ্লীল ভাষায় ছড়া কাটিয়া বর্ণনা করিত ও পরে তাহারা একে অপরের সহিত সমরতিলীলায় মাতিতেন এবং বাকী রাত্রিটুকু এমনিভাবেই। অতিবাহিত হইত।

বিশেষ বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের ফলে জানা গিয়াছে যে, সভ্যতা-বিস্তারের পর পুরুষের প্রতি পুরুষের মিথুনানুরাগের প্রথম উৎপত্তি প্রায় সাত হাজার বৎসর পূর্বে-প্যালেষ্টাইনের সােডাম প্রদেশে এবং Lesbianism বা নারীর প্রতি নারীর সমমিথুনানুরাগের উৎপত্তি গ্রীসের Lesbos দ্বীপে।

নারীর প্রতি নারীর সমমিথুনানুরাগের সম্বন্ধে ঐতিহাসিকগণ যেভাবে সাধারণকে আলােকিত করিয়াছেন তাহাতে দেখা যায়, গ্রীসের Lesbos দ্বীপ এই প্রকার অদ্ভুত রতিকলার প্রথম উৎপত্তিস্থান। লেসবস দ্বীপের স্যাফো নাম্নী এক সন্ত্রান্ত বংশীয়া যুবতীর এ্যাণ্ডস দ্বীপ নিবাসী এক ধনী ব্যবসাদারের পুত্রের সঙ্গে বিবাহ হয়। স্যাফোর বিবাহিত-জীবন খুব সুখের ছিল না বলিয়া ঐতিহাসিকগণের ধারণা। সে একটা অল্পবয়স্ক পুত্র কোলে করিয়া অল্পদিনের মধ্যেই বিধবা হন।••••••খৃঃ পূর্ব ৬০০ শতকে এই নারী জীবিত ছিলেন।…..

….ক্রমে ক্রমে স্যাফো এই অস্বাভাবিক প্রেম শিক্ষা দিবার জন্য একটা Boarding school অবধি খুলিয়াছিলেন এবং সেখানে যুবতী মেয়েদের এই বিজাতীয় প্রেমে দীক্ষিত করিতেন অর্থাৎ The young girl early learned to make an unnatural employment of their nascent charms. অবশ্যই এই সমমিথুন ব্যাপারে পুরুষ-নারীর মতই এক নারী সক্রিয় ও অপরা নিষ্ক্রিয় অংশ গ্রহণ করিত। এই শ্রেণীর সমমিথুন ব্যাপারে উভয় নারীরই যৌনাবেগ অত্যন্ত প্রবল ও গভীরতর হইয়া উঠিত। স্যাফো এই প্রেমে বহুনারীকেই দীক্ষিতা করিয়াছিলেন। তিনি ব্যবহারিকভাবে তাহার শিষ্যাদের সহিত এই ব্যাপারে নিযুক্ত হইতেন।

গ্রীসের বংশীবাদিনী সমাজের নাগােড়া, মেগেরা, শীর্ণ, ইউনীকা, যাণ্ডোমেডা, এনাথােরিয়া প্রভৃতি অনেক প্রসিদ্ধ ও সম্ভ্রান্ত গণিকা নারীগণ কবি স্যাফোর প্রধান শিষ্যা ও প্রণয়িনী শ্রেণীভুক্ত হইয়াছিলেন। ঔলেত্ৰাইদি সমাজের বহুনারী এবম্বিধ সমকামের নেশায় ভীষণভাবে মত্ত হইয়াছিল। বহু বহু সম্রান্তবংশীয়া কুমারী মেয়ে স্যাফোর নিকট সমপ্রেমে দীক্ষিত হইয়া আজীবন বিবাহ করেন নাই। | কোন কোন রমণী এইরূপ সমপ্রেমের নেশায় সংসার পরিত্যাগপূর্বক বেশ্যা শ্রেণীভুক্ত হইয়া সমপ্রেমে মত্ত থাকিতেন। মনােবিজ্ঞানবিষ্মণ স্যাফোর সমমিথুন প্রবৃত্তির মূল অনুসন্ধান করিতে যাইয়া যে সকল তথ্য বাহির করিয়াছেন, তাহার কিয়দংশ নিম্নে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হইল।

স্যাফো আজন্মকাল হইতেই বিলাসিতা ও ঐশ্বর্যের মাঝে লালিতাপালিত হইয়া বাল্য হইতেই তাহার প্রকৃতিটী হইয়াছিল অনেকটা খামখেয়ালী গােছের। তদুপরি স্যাফো কিছুটা ভাবপ্রবণ ও আবেগময়ী হওয়ার দরুণ তিনি নিজ ইচ্ছাটাকেই অত্যন্ত বলবতী করিয়া ভাবিতেন।

ক্যারাক্সাস নামে স্যাফোর এক ভাই ছিল। বালিকা বয়স হইতেই স্যাফো সেই ভ্রাতাকে মন-প্রাণ-দেহ সমাপনার ভালবাসিয়া বসেন। তাহাকেই সে প্রিয়তমের আসনে অধিষ্ঠিত করিয়া দেহদান করিয়া আসিতেছিল। এমন কি বিবাহের পরও তিনি ক্যারাক্সাসকে শ্বশুরালয়ে মাঝে মাঝে ডাকাইয়া পাঠাইয়া ভ্রাতা-ভগিনীর পবিত্র সম্বন্ধকে বিশ্বতির অতলজলে ডুবাইয়া উভয়ে অবৈধ পাপে নিমগ্ন হইতেন। বিবাহে স্টফোর আদৌ ইচ্ছা ছিলনা এবং তাহার বিবাহিত জীবন এই কারণে মােটই সুখপ্রদ হয় নাই।

তাহার উপর ভালবাসার-জগতে রমণীজাতি চিরদিন ভয়ানক সঙ্কীর্ণমনা, অভিমানিনী ও প্রতিহিংসাপরায়ণা। জনৈক রহােদোপিস জাতীয় বেশ্যার প্রেমে যখন ক্যারাক্সাস আত্মহারা, তখন সেই খবর পাইয়া স্যাফে। রাগে, ক্ষোভে, অভিমানে পাগলপারা হইল। তারপর স্যাফো তাহার প্রেমাস্পদের নিকট হইতে প্রত্যাখানের আঘাত পাইয়া তিনি সমগ্র পুরুষজাতির উপর বিতৃষ্ণ হইয়া উঠিলেন এবং ইহার প্রতিশোেধ লইবার মানসে পুরুষের প্রেমকে তিনি হৃদয় হইতে উৎপাটিত করিয়া আবিষ্কার করিলেন—নারীর প্রতি নারীর প্রেমের এক অভিনব পথ। তিনি তাহার কাব্যপ্রতিভাকেও এই সমজাতীয় প্রেমের উৎকর্ষতা সাধনেই নিয়ােজিত করিয়াছিলেন। নারীর প্রতি নারীর সমপ্রেম বা সমমিথুনের নাম Lesbian Love; কিন্তু ইহা স্যাফোর প্রবর্তিত বলিয়া ইহার অপর এক নাম Saphism.

লুসিয়ানের Dialogues of Courtezans নামক প্রাচীন প্রামাণ্য গ্রন্থেও এই বিজাতীয় প্রেম বা Lesbian Love-এর অনেক উদাহরণ আছে। এখানে এস দুই একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাইছে।

ফাইলেমেটাম নামে এক আধা বয়সী প্রৌঢ়া বেশ্যার সহিত চার্মাইড নামে ভদ্রঘরের এক সুন্দরী যুবতী ক্রমান্বয়ে সাত বছরকাল লেসবিয়ন লাভে একান্ত রত ছিলেন। প্রকারন্তরে ঐ প্রৌঢ়া বেশ্যা যুবতী চাৰ্মাইডকে একপ্রকার রক্ষিতার মত রাখিয়াছিল। সে তাহার খাওয়াপরার যাবতীয় খরচ জোগাইত। কিন্তু যুবতী হঠাৎ একটা সুন্দর যুবককে ভালবাসিয়া বেশ্যাটির নিকট হইতে সরিয়া পড়ে। তাহার জন্য যে কান্না সে কাঁদিল, কোন রমণীর স্বামী বিয়ােগেই কেবল সে রকম কান্না কাদিতে পারে। কিছুকাল অতিবাহিত হইলে শােকোচ্ছাস যখন একটু মন্দীভূত হইল তখন ফাইলেমেটাম তাহার অতৃপ্ত অদ্ভুত রতিক্ষুধা মিটাইতে ত্রাইফিণী নামে এক যুবতীকে তাহার ঘরে আনিল ও প্রথম নিশি যাপনের পর পরদিন ভােরে তাহাকে পাচ দ্রাকামা (গ্রীস মুদ্রা) উপহার দিল। এইভাবে কিছুকাল তাহাদের সমমিথুনলীলা চলিবার পর যখন ফাইলেমেটাম জানিতে পারিল যে, তাহার নবাগতা শয্যাসঙ্গিনী তাহার দিদিমার বয়সী কেবলমাত্র প্রসাধন চাতুর্যে এতদিন তাহার চক্ষুকে ফাকি দিয়া আসিয়াছে, তখন সে নবাগতা সঙ্গিনীকে সম্বােধন করিয়া বলিতেছে, বল কি সখী, তুমি আমায় চেয়েও বড় ? তবে ত আমাতে তােমাতে প্রভেদ নাই। এসাে, এসাে। আমার গণ্ডদেশে চুম্বন দাও, তােমার বাহুবেষ্টনে আমায় বুকে চেপে ধর; এসো আমরা সৌন্দর্যের অধিষ্ঠাত্রী ভিনাস দেবীর পাদমূলে নিজেদের সঁপে দেই।

মেগিল্লা ও ডিমন্যাস্বী নামক দুইজন আলোদিন্ নারী তাহাদের প্রতিবেশিনী লীনা নাম্নী এক কিশােরীকে লেসবিয়ান প্রেমে দীক্ষিত। করিয়া কিছুদিন সমমিথুনের ব্যবসা চালাইতেছিল। কিন্তু এই কিশােরীর সহিত এক যুবকের প্রণয় ছিল। যুবক একদা সন্দেহ করিয়া লীনাকে খুব জেরা করায়, সে সলজ্জ কুণ্ঠায় স্বীকার করিল যে, মেগিল্লা নামে এক প্রতিবেশিনী নারীকে সে গভীরভাবে ভালবাসিয়া ফেলিয়াছে।

স্পার্টারাজ্যের আইন প্রণেতা নেতা লাইকারগাস স্পার্টার প্রত্যেক নর-নারীকে দৈহিক শক্তিসঞ্চয়ের জন্য ব্যায়াম প্রথা বাধ্যতামুলক করিয়াছিলেন। কিন্তু তিনি নারী-পুরুষে কোনই ভেদাভেদ রাখিলেন না। নারী-পুরুষ, বালক-বালিকা, যুবক-যুবতীগণ রাস্তা-ঘাট, সভা-সমিতি ও ব্যায়ামাগারে দৌড়-ঝাপ, কুস্তি প্রভৃতি বিবিধশ্রেণীর ব্যায়াম একত্রে করিত। নারীদিগের পােষাক ছিল অত্যন্ত সাদাসিধা ও উহ রা ঘাগরার মত করিয়া উহা পরিত এবং কোমরের নিম্নের দিকে পােষাকটীর দুইধার দ্বিখণ্ডিত থাকায় নারীগণের লম্বা লম্বা পা ফেলিয়া চলাফেরা করিতে কোন অসুবিধা হইত না। কিন্তু পােষাকের এই সুবিধাটুকু লইয়া তাহার তাহাদের গােপনঅঙ্গ অতি সহজেই উন্মুক্ত করিয়া পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করিত। ইহাতে না-পুরুষের অবাধ মেলামেশার যে ফল, তাহা সহজেই অনুমেয়।

ভদ্রঘরের মেয়েরা রাষ্ট্রীয় এই ঔদাসিন্তের ফলে প্রকাশ্য ব্যাভিচারে একান্তভাবে লিপ্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন—নারীগণ লজ্জা-সরম হারাইয়া ফেলেন। তাহা ছাড়া কোন কোন ক্ষেত্রে স্পার্টানের স্বামীগণ স্ত্রীকে যে কোন সুন্দর স্বাস্থ্যবান পুরুষের সহিত বিহার করিতে দিতে কোনপ্রকার আপত্তি উত্থাপন করিতেন না। রাষ্ট্রেরও অনুমতি ছিল সুসন্তানের জন্ম দেওয়া।

মন্দিরের সেবাদাসী বলিয়া গ্রীসে একশ্রেণীর নারী ছিল, যাহারা সামান্য দুই তিন পয়সা পাইলেই পুরুষের প্রবৃত্তি চরিতার্থ করিত। কতপ্রকার বেশ্যাবৃত্তি যে গ্রীসে প্রচলিত ছিল তাহার সংখ্যা নিরূপণ করাও শক্ত। কোবিন্থ বন্দরে দুর্নীতি এতদুর প্রসার লাভ করিয়াছিল যে, প্রতি লােকের বাড়ীকে গণিকালয় বলিলে বিশেষ অতিশয়ােক্তি করা হয় না।

রােম

রােমের সমাজ-জীবন ও যৌনেতিহাসের সামান্য কয়েকটী ছিন্নপত্র নিমে তুলিয়া ধরিতেছি। প্রথমেই তার সম্রাটগণের চরিত্র কাহিনী দুইএক কথায় বর্ণনার প্রয়াস পাইব। | প্রথমেই আসিয়া পরে দিগ্বিজয়ী বীর জুলিয়াস সীজারের কথা। তখনকার গৌরবময় নােমীয় সমাজে দিগ্বিজয়ী বীর জুলিয়াস সীজারকে Husband of all men’s wives 71779 catopa poistanta in নামে অভিহিত করা হইত। জুলিয়াস সীজার তাঁহার সন্ত্রান্ত ও অভিজাত বংশীয় রাজকর্মচারিদের অধিকাংশের কন্যা ও বধুগণের সতীত্ব ছলে, বলে বা কৌশলে অপহরণ করিয়াছিলেন। ক্রুটাস নামে তাহার এক প্রিয় সহচরের মায়ের প্রতি সীজার আকৃষ্ট হন ও তাহাকে নাকি তিনি প্রকৃত ভালবাসা প্রদান করিয়াছিলেন। এই নারীর নাম ছিল সার্ভিলিয়া। জুলিয়াস সীজার নােমর প্রথম কনসাল হইয়াই সার্ভিলিয়াকে একটী বহুমূল্য মুক্তা উপহার দেন।•• সার্ভিলিয়া তাহার গর্ভজাতা কন্যাকেও সীজারের কামানলে আহুতি প্রদান করেন। | সীজার মিশর-সম্রাজ্ঞী ক্লিওপেট্রারও গর্ভ উৎপাদন করিয়াছিলেন ও ক্লিওপেট্রার স্বামীকে মিশরের সিংহাসন হইতে বিতাড়িত করিয়া ক্লিওপেট্রাকে মিশরের একেশ্বরী করিয়াছিলেন। অবশ্য ইহাতে ক্লিওপেট্রার নিজের দোষই ছিল বেশী।

অগাষ্টাস সীজারপূর্বনাম অগাষ্টাস অক্টোভিয়াস। ইনিই রোমের প্রথম সম্রাট। যৌবনে অগাষ্টাস সীজার অসংখ্য সুন্দরী বারবণিতার সহিত তাহার যৌনক্ষুধা মিটাইয়া শেষে তিনি ভদ্ৰনারীদের প্রতি মন দেন এবং নগর ও পল্লীর বহু বহু সুন্দরী কুমারী ও বিধবার সর্বনাশ সাধন করেন। যে সব কর্মচারিগণ তাহাকে রূপসী নারী জুটাইয়া দিতে লাগিল, তাহাদের সমাদর ও পদপসার বৃদ্ধি পাইতে লাগিল এবং তাহার যথেষ্ট পুরস্কৃতও হইত। এইভাবে বৃদ্ধকাল পর্যন্ত তিনি তিন সহস্র বিবাহিতা ও কুমারী নারীর সতীত্ব অপহরণ করিয়াছিলেন। এতদ্ভিন্ন সীজারের ন্যায় সমমিথুনের নিষ্ক্রয় ভূমিকা গ্রহণ করিবার দুপ্রবৃত্তি ইহারও ছিল।

রাজকুমারী জুলিয়া—সম্রাট অগাষ্টাস সীজারের একমাত্র রূপসী কন্যা জুলিয়ার চরিত্র ছিল ভয়ানক রকমে কদৰ্যপূর্ণ। একবার ইনি দেবমন্দিরে দেবতার পিছনে দাড়াইয়াই পর পুরুষের সঙ্গে সহবাসরতা হইয়াছিলেন। বিবাহের পূর্ব পর্যন্ত রাজকুমারী জুলিয়া বহু প্রেমিকের নিকট নিজের দেহ দান করিয়া অবশেষে পিসিমার ছেলে মার্সেলাসের সহিত চৌদ্দবছর বয়সে তাহার বিবাহ হয়। সম্রাট অগাষ্টাস্ বিবাহ করিয়াছিলেন তিনটা। জুলিয়া ছিলেন সম্রাটের দ্বিতীয়। পত্নী স্কাইকেনিয়ার গর্ভজাতা। মার্সেলসের সঙ্গে জুলিয়ার বিবাহ হওয়ার দুই বৎসরের মধ্যে মার্সেলাসের মৃত্যু হয়। সম্রাট অগাষ্টাস পুনরায় তাহার প্রধান সেনাপতি এগ্রিপ্পাকের সঙ্গে জুলিয়ার বিবাহ ঠিক করিলেন। সম্রাটের আদেশে বিবাহিত সেনাপতি এ্যাগ্রিপ্পাক তাহার পূর্ব বিবাহিতা পত্নী মার্শেলকে পরিত্যাগপূৰ্ব্বক জুলিয়াকে বিবাহ করিল। এই বিবাহ হয় জুলিয়া বিধবা হওয়ার দুই বৎসর পরে অর্থাৎ জুলিয়ার অষ্টাদশ বর্ষ বয়সের সময়। মাঝের এই দুই বৎসরে জুলিয়া বহু প্রেমিককে আত্মদান করিয়া অনেকের সঙ্গেই গােপন অভিসার করিয়াছেন। | এদিকে সম্রাট অগাষ্টাস তাহার দ্বিতীয় পত্নীকে পরিত্যাগপূৰ্ব্বক লিভিয়াশীলা নামে তাঁহার এক কর্মচারির মধ্যবয়স্কা সুন্দরী স্ত্রীকে জোর করিয়া বিবাহ করিলেন।

এদিকে ২৮ বছর বয়সে অর্থাৎ খঃ পূঃ ১২ সালে রাজকুমারী জুলিয়া দুইটা পুত্র ও সাত মাসের গর্ভ লইয়া পুনরায় বিধবা হইলেন। টাইবেরিয়াস তখন রােমের সিংহাসন লাভের আশায় বিশেষভাবে চেষ্টা করিতেছিলেন। সেই সময় সে বৃদ্ধ সম্রাট অগাষ্টাসের সম্মতি লইয়া বহু উপভােগ্যা রাজকুমারী জুলিয়া অর্থাৎ বৈমাত্রেয় ভগ্নিকে বিবাহ করিল। কিন্তু তাহাদের এ বিবাহ মােটেই সুখের হইল না। কয়েক বছর পরে সম্রাট অগাষ্টাস তাহার সৎপুত্র এবং জুলিয়ার তৃতীয় জামাতা টাইবেরিয়াসকে বিশেষভাবে ঘোষণাপূৰ্ব্বক পােষ্য গ্রহণ করতঃ রাজপ্রতিনিধিরূপে তাহাকে রােডাসে প্রেরণ করিলেন। স্বামীর প্রবাসকালে জুলিয়া তাহার ইচ্ছামত পরপুরুষের সহিত রতিপাপে নিমগ্না হইয়া তাহার রাক্ষুসী ক্ষুধার তৃপ্তি সাধন করিতে লাগিল। জুলিয়ার বয়ঃক্রম তখন সাইত্রিশ অতিক্রম করিয়াছে। সেই বয়সেও তাহার ইন্দ্রিয়বাসনা তৃপ্ত না হওয়ায় সে কেবলই নিত্য নুতন প্রেমিককে নিযুক্ত করিতেছিল। অবশেষে অবস্থা এমন দাড়াইল যে তাহার পাপকুৎসা রাস্তাঘাটে লােকের মুখে মুখে প্রচারিত হইতেছিল। এই সকল দেখিয়া শুনিয়া অগাষ্টাস ও টাইবেরিয়াস অতিষ্ঠ হইয়া উঠিলেন ও তাহাকে নির্বাসন দণ্ডে দণ্ডিত করিলেন। , সম্রাট অগাষ্টাসের প্রিয়বন্ধু কবি ওভিডাসও জুলিয়ার সহিত প্রেমচর্চা করিতেন। কবি ওভিডাস তাহার কাব্যগ্রন্থের একস্থানে যে ইঙ্গিত দিয়াছেন, উহার উপর আস্থাবান হইলে এইমাত্র বলা যাইতে পারে যে, সম্রাট অগাষ্টাস্ জ্ঞান-বিবেক হারাইয়া সন্তানম্নেহের পবিত্র সম্বন্ধকেও কলঙ্কিত করিয়াছিলেন।

ক্যালিগুলাস-প্রথম যৌবনে সম্রাট ক্যালিগুলাস, ক্যাটালাস, | নেষ্টার, ভেলেরিয়া প্রভৃতি রাজ্যের সভ্রান্ত বংশীয় যুবকদের সমমেহন পাপে নিযুক্ত রাখিয়াছিলেন। তৎপর তিনি বেশ্যাদের উপর আয়কর স্থাপন করেন ও রাজপ্রাসাদের মধ্যে বাছাইকরা সুন্দরী বেশ্যাদের আনিয়া একটা সরকারী বেশ্যালয় স্থাপন করেন। উচ্চদর্শনী দিয়া যে কোন লােকের রাজপ্রাসাদে প্রবেশ পূৰ্ব্বক ইচ্ছানুরূপ যে কোন রমণীর সহিত রমণ করা চলিত।

সম্রাট: ক্যালিগুলাস কৈশােরে ও যৌবনে অকুণ্ঠিত চিত্তে তাহার সমস্ত ছােট ও বড় ভগিনীদের সতীত্ব নষ্ট করেন। প্রৌঢ়াবস্থায় নিজ সম্মানিত ব্যক্তিগণকে সপরিবারে রাজসভায় নিমন্ত্রণ করিয়া তিনি পছন্দমত যে কোন মহিলাকে হাত ধরিয়া পার্শ্বের গুপ্ত প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করিতেন ও সেই প্রকোষ্ঠে তাহার দেহ উপভােগ করতঃ রাজসভায় ফিরিয়া আসিয়া অশ্লীল ভাষায় সেই রমণীর দেহ উপভােগের বিবরণ সৰ্ব্বজন সমক্ষে প্রচার করিতেন।

ক্লডিয়াস জার্মেনিকাস-ক্লডিয়াস সম্রাট ক্যালিগুলাসের খুড়া। ক্লডিয়াস প্রথমতঃ মেসালিনা নামক এক দুশ্চরিত্রা সুন্দরী নারীকে পাপপথ হইতে ফিরাইয়া আনিয়া বিবাহ করিলেন। মেসালিনা হইলেন ক্লডিয়াসের তৃতীয়া পত্নী। হঠাৎ সম্রাট ক্যালিগুলাস নিহত হইলে খুড়। ক্লডিয়াস পঞ্চাশ বছর বয়সে রােমের সম্রাটের আসন অধিকার করেন এবং অতঃপর মেসালিনা সম্রাজ্ঞী হন। সম্রাজ্ঞীর আসনে বসিয়াও গতযৌবনা মেসালিনা নার্সিসাস, পল্লাস প্রভৃতি ক্লডিয়াসের কয়েকজন মুক্তদাসের সহিত নির্লজ্জ প্রেমলীলা আরম্ভ করিলেন। ইহাদের সাহায্যে মেসালিন রাজ্যের অভিজাত সম্প্রদায়কে শুধু শুধু যথেচ্ছা উৎপীড়ন করিতে লাগিলেন। বিচারের ভার তিনি নিজ হস্তে গ্রহণ করিলেন।

একদা মেসালিন। সাইলিয়াস নামক এক অভিজাত বংশীয় সুন্দর যুবকের বিচার করিতে যাইয়া তাহার প্রতি আকৃষ্ট হন ও তাহার সহিত বেশ কিছুদিন অবৈধ তিপাপে নিমগ্ন থাকেন। ক্লডিয়াস এই ব্যাপার জানিয়া শুনিয়াও হ শব্দটী করিতেন না। কারণ মেসালিনা ক্লডিয়াসকে হাতের পুতুলে পরিণত করিয়াছিলেন। কিন্তু তারপর একদিন যখন মেসালিনার সহিত সাইলেসিয়ার গােপন-বিবাহ হইতেছিল, তখন মুক্তদাসগণ তাহাতে বাধা দেয় এবং তাহাদের উভয়কেই হত্যা করে। | মেসালিনার মৃত্যুর পর বৎসর ক্লডিয়াস তাহার ভ্রাতুস্পুত্রী যাগ্রিপিনাকে বিবাহ করেন। য্যাগ্রিপিনা পূৰ্ব্ব হইতেই ঘােতর দুশ্চরিত্রা ছিল। সে নিজের বৃদ্ধ স্বামী ডােমিটিয়াকে বিষ প্রয়ােগে হত্যা করে। এই ডােমিটিয়াসের ঔরসে ম্যাগ্রিপিনার গর্ভে যে ছেলের জন্ম হয়, পরবর্তীকালে তিনি সম্রাট হন। তাহারই নাম সেই ইতিহাস কলঙ্কিত নিষ্ঠুর ও খেয়ালী সম্রাট নীরো।

নীরো—বাল্য হইতেই নীরে ছিল উচ্ছল ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির। যৌবনে পদার্পণ করিয়া নীরাে নিজ ও বৈমাত্রেয় ভগিনীগণের সতীত্ব হরণ করেন। সম্রাটের আসনে আরােহণ করিয়া নীরাে সর্দার ওপাের পত্নী পপিয়ার প্রেমে আত্মহারা হইয়া পড়েন। তাহারই প্ররােচনায় নীরাে আপন মাতাকেও হত্যা করিয়াছিলেন এবং স্বীয় পত্নী অক্টেভিয়াকে পরিত্যাগ করিয়া পপিয়ার পানিপীড়ন করেন। রােম নগরীর সকল সুন্দরী রমণীগণ তাঁহার কামানলে আহুতি প্রদান করিয়া তাহার দুর্দমনীয় প্রবৃত্তিকে শান্ত করিতে পারে নাই। অবশেষে নীয়রা প্রত্যহ সন্ধ্যায় বেশ্যালয় পরিভ্রমণে বাহির হইতেন এবং যদৃচ্ছা কামক্ষুধা মিটাইতেন। স্নানে, ভােজনে, ভ্রমণে, রাজকার্য পরিদর্শনে, সর্বদাই তিনি অসংখ্য সুন্দরী রমণী পরিবেষ্টিত হইয়া থাকিতেন। অবশেষে তিনি নেপলস দ্বীপে একটা গণিকা-উপনিবেশ স্থাপন করিয়া আপন প্রবৃত্তির তৃপ্তি খোঁজেন। সুপ্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ট্যালিটাসের গ্রন্থ হইতে জানা যায়, একবার তিনি নােম কর্তৃক বিজিত গ্রীসে ভ্রমণ করিতে যাইয়া গ্রীসের নাগরিকগণ কর্তৃক আদর আপ্যায়ন ও অসংখ্য সুন্দরী যুবতীর সঙ্গলাভ করিয়া এতটা পরিতৃপ্তি লাভ করেন যে, ইহার জন্য তিনি গ্রীসের স্বাধীনতা প্রত্যর্পণ করিয়াছিলেন।

মিশর, গ্রীস প্রভৃতি দেশের ন্যায় রোমের দেবমন্দিরেও যৌন উজ্জ্বলতার চরম ব্যাপার অনুষ্ঠিত হইত। রােমের রণদেবী ভিনাস’ সম্পূর্ণ উলঙ্গমীতিনি নর-নারীর প্রণয় ব্যাপারে উৎসাহদাত্রী। উজ্জিতান্দ্রিয় উলঙ্গ দেবতা প্রায়াপাস-এর মুক্তি যেখানে সেখানে প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই দেবতার নামকরণ হইতেই প্রায়াপিজম বা ইন্দ্রিয়-উচ্ছাস নামক যৌনব্যাধির নামকরণ করা হইয়াছে। আবার মিউনিটাস দেবমন্দিরে প্রত্যেক বিবাহার্থিনী কুমারী কন্যাকেই মিউনিটাস দেবতার নিকট কুমারীত্ব বিসর্জন দিতে হইত। এই মিউনিটাস দেবতা ছিল অবিকল একজন পরিণত মানুষের আকৃতিবিশিষ্ট। সেই উলঙ্গ প্রস্তরমূৰ্ত্তি দেবতা সিংহাসনে উপবিষ্ট থাকিতেন ও তাহার যৌনেন্দ্রিয় উচ্ছিতাবস্থায় উর্কিত রহিত। বিবাহের দিন প্রাতে অনেক সধবা নারী একত্রিত হইয়া বিবাহার্থিনী কন্যাকে সঙ্গে লইয়া সেই দেবতার মন্দিরে উপস্থিত হইতেন। মন্দিরের পুরােহিত কেবলমাত্র সেই কন্যাকে হাত ধরিয়া দেবতার সমীপে লইয়া যাইতেন- কন্যা অগ্রে ফুল চন্দন দিয়া দেবতাকে পূজা করিয়া তাহার কোলে এমনভাবে বসিত যাহাতে দেবতার উর্কিত ইন্দ্রিয় তাহার শ্রীঅঙ্গে প্রবিষ্ট হইয়া সতীচ্ছদ ( hymen) ছিন্ন করিয়া দিত।

তৎকালে রােমীয় মহিলাগণ উপচিত হইয়া যাদুবিদ্যাবিশারদগণের দ্বারা যৌনসম্ভোগ করতঃ নিজেদের সম্মানিত বােধ করিতেন। এইরূপ সম্ভোগকে তাহারা খুব উপভােগ্য ও আনন্দদায়ক ব্যাপার মনে করিতেন এবং এই মিলনের ফলে উৎপাদিত সন্তানগণ নাকি বেশ তেজোদৃপ্ত ও বীৰ্য্যবান হয় বলিয়া তাহাদের ধারণা ছিল।

পােপের আবাসস্থল ভ্যাটিকান প্রাসাদ। যে ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা একদিন বলিয়া গিয়াছিলেন : ‘স্বর্গস্থ আমার পিতার প্রাসাদ ইটকাঠে তৈয়ারী নয়, মহাব্যোম তার সিংহাসনের চাদোয়া-সেই ধর্মের গুরু পােপর প্রাসাদের দেয়ালে কামনাময় ফ্রেস্কোচিত্রের জন্য ডাক পড়িত শিল্পী মাইকেল এঞ্জেলাের। যে ধৰ্ম্ম ত্যাগের আদর্শকে সর্ব উচ্চে স্থান দিয়াছিল, সেই ধর্মের প্রধান অনুচারীর শয্যাপার্শ্বে দাড়াইয়া নগ্ন সুন্দরী তরুণীগণ করিত কামকেলি। নারীবিবর্জন প্রতিজ্ঞ পােপ পরিচালিত হইতেন কামাচারী নারীগণের দ্বারা।

শার্লমেনের সাম্রাজ্যগৌরব অস্তমিত হইবার পর হইতেই পােপের রাষ্ট্রীয় প্রাধান্য আরাে বাড়িয়া গেল। ঠিক এই সময়ে আলেকজান্দ্রিয়ার সম্ভ্রান্ত কুলললনা থিওডোরা নিজের দুইটা যুবতী মেয়েকে লইয়া ব্যভিচারের স্রোতে গা ভাসাইয়া ঐশ্বৰ্য ও যৌনতৃপ্তি একসঙ্গে লাভ করিতে অগ্রসর হইল। তাহাদের প্রধান শিকার হইল ধর্মগুরু পােপ। তারপর রাষ্ট্রনায়ক ডিউক প্রভৃতি অভিজাত সম্প্রদায়। থিমােডােরার মেয়ে দুইটার নাম ছিল ময়রাসিয়া ও থিয়ােডােরা। ইহারা যেমন রূপলাবণ্যবতী ছিল তেমনি ছিল ইহাদের বুদ্ধি-চাতুৰ্য্য ও অসাধারণ সম্ভোগ প্রবৃত্তি। তদুপরি সম্রান্ত ও ক্ষমতাসম্পন্ন টুঙ্কানী ও ডিউকেরা ছিলেন ইহাদের আত্মীয়। কাজেই ইহারা বিজয়গর্বে অভিযান শুরু করিল।

ধর্মগুরু পােপের প্রাসাদে তখন ব্যভিচারের বন্যা প্রবাহিত হইতে সুরু হইয়াছে। পােপের চিত্ৰদৌর্বল্যের সুযােগ লইয়া ইহারা ভ্যাটিকান প্রাসাদেও হানা দিল। পােপ ও অভিজাত সম্প্রদায়ের নিকট দেহ বিলাইয়া দিয়া ইহারা অপরিমিত ঐশ্বর্যের অধিকারিণী হইয়া উঠিল। পােপ তৃতীয় সার্ফিয়াসের কাম-সহচরী রূপে বড় বােন ময়রাসিয়া চতুর্দশ বছর বয়সেই সৰ্বত্ৰ অখ্যাতি অর্জন করিয়াছিল। মবসিয়া পােপের সহচরীর ক্ষমতাবলে নিজের পছন্দ মাফিক কাম-সহচরদিগকে সুউচ্চ ধর্মপীঠে উন্নীত করিয়া দিত। কিন্তু পােপ তৃতীয় সার্ফিয়াসের মৃত্যুর পর ময়রাসিয়া তাহার জনৈক প্রণয়াস্পদ আনাষ্টাসিউসকে পােপের গদীতে বসাইল এবং অতঃপর দুইটা বােনে ভাগাভাগি করিয়া এই নূতন পােপের দেহ-উপভােগ করিতে লাগিল। কিন্তু এরই মধ্যে আবার তাহাদের মা আপন প্রণয়াস্পদ লডােকে পােপের আসনে বসাইলেন। কিছুদিন গত হইতে না হইতেই মায়ের প্রেমাকাশে উদয় হইল জন নামে জনৈক নধরকান্তি তরুণ। ফলে ইনি হইলেন পােপ দশম জন। তারপর মায়ের মৃত্যু হইলে পর বড় বােন ময়রাসিয়া যখন দেখিল পােপ তাহার দিকে ততটা নজর দিতেছেন না—তখন সে পােপকে গােপনে এক রাত্রে হত্যা করিল।

এরপর পােপের আসনে দুই ভগিনীর খেয়াল-খুসী মাফিক যে-সে বসিতে লাগিল। নিজেদের জারজ সন্তানদেরও ইহারা পােপের গদীতে বসাইতে লাগিলেন। ধর্মকে লইয়া এমন ছিনিমিনি খেলা কোন যুগে, কোন দেশে ঘটে নাই।

জারজ পােপ নিজ পাশব প্রবৃত্তির তাড়নায় নিত্য নব কুলবধু ও যুবতী কুমারী নারীদের লইয়া যে যৌন-উৎসব সুরু করিয়া দিলেন তাহার শেষ মীমাংসা একদিন শাণিত কৃপাণের মুখেই হইয়া গেল।

ইহার পর রঙ্গমঞ্চে আসিয়া দেখা দিল সৌন্দৰ্য্যললামভূতা, নবযৌবনা, সদ্যবিধবা একটা মেয়ে। নাম ডােনা ওলিপ্সীয়া। ইনিও প্রখর বুদ্ধিশালিনী, তদুপরি ইনি ছিলেন আবার স্বামীঘাতিনী। পােপের আসনে তখন দশম ইনােসেন্ট। সম্পর্কে পােপ ছিলেন ওলিম্পীয়ার দেবর। পােপের প্রতিপত্তি তখন পৃথিবী-জোড়া। সারা খৃষ্টান-জগৎ হইতে বিপুল ধনসম্পদ আসিয়া পােপের ধনভাণ্ডার সমৃদ্ধ করিয়া তুলিয়াছিল। এই দেখিয়া ওলিম্পীয়ার মনে বিরাট ঐশ্বৰ্য্যশালিনী হইবার প্রবল বাসনা জাগিল। অর্ধ-পৃথিবীময় যিনি বিরাট আধিপত্য বিস্তার করিয়া আছেন, সেই ঈশ্বরের প্রতিনিধিকে যদি নিজের হাতের মুঠায় না আনিতে পারিতাম তবে বৃথাই এই রূপ-যৌবন। হইলও তাহাই। ওলিম্পীয়ার রূপ-যৌবনেব সম্মােহন জালে পােপ ধরা দিলেন- ডােনা হইল পােপের গুপ্তসঙ্গিনী ও শব্যাবিলাসিনী। ক্যাথোলিক খুষ্টান জগতের একাধিপতি পােপের হৃদয়াধিশ্বরী ওলিম্পীয়ার ইচ্ছায় পােপের বিপুল ধনভাণ্ডার ব্যয়িত হইত। নিজ অভিলাষ সিদ্ধির অন্তরায় হইতে পারে, এই আশঙ্কায় এই কুটনীতিজ্ঞ নারী আপন সন্তান ডন ক্যামিলােকেও নির্বাসিত করিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহাদের এই গুপ্তপ্রণয়ে প্রথমটায় কানাঘুষা চলিতে থাকিলেও পরে কিন্তু তাহা সারা ইয়ােরােপ ছড়াইয়া পড়িল। এমনকি এই কলঙ্ককাহিনী লইয়া দেশে দেশে নানারূপ নাটক রচিত হইয়া অভিনীত হইতে লাগিল।

ইহার পর নৈতিক অধােগতির চূড়ান্ত নিদর্শন পােপ আলেকজেণ্ডা বােজিয়ার সময়ের মােমের সম্বন্ধে দুই চাৰিটী ইঙ্গিত করিয়াই রােমে কলঙ্ক ইতিহাসের যবনিকা টানিয়া দিতে চাই। রােমীয় সমাজে ব্যভিচা এ সময়ে এতটা প্রাধান্য লাভ করিয়াছিল, যাহা কল্পনায়ও আনা যায় না। জারজ সন্তান, গণিকা আর ব্যভিচারীর দল ছিল তখন সমাজের শিয়ােমণি ! অভিজাত সম্প্রদায়ে ন্যায় নীতি বলিয়া কোন কিছুই ছিল না। যৌন-উচ্ছলতাই ছিল যেন ভদ্ৰত্বের একমাত্র পরিচয়। নিজের স্ত্রী, ভগিনী ও মেয়েকে লম্পটের ভােগে ইন্ধন যােগাইবার প্রেরণা দেওয়া হইত। গীর্জায় গীর্জায় প্রকাশ্যে দেওয়া হইত নানারূপ কামােদ্দীপক বক্তৃতা; আর পােপর ভ্যাটিকান প্রসাদ ছিল একটা বিরাট গণিকালয়বিভৎস যৌন-উৎসব দিবারাত্রি ধর্মগুরুর প্রসাদে ব্যভিচারের স্রোত বহাইত। অসংখ্য উলঙ্গ নারী পােপের শয্যা ঘিরিয়া থাকিত। শত্রুকে গােপনে বিষ প্রয়োেগ হত্যা করাটা তখন রীতিমত একটা রেওয়াজ হইয়া উঠিয়াছিল। রােমের জনগণ সেদিন যৌন-ব্যভিচারে ভগবানের আসনকেও কিভাবে কলঙ্কিত করিয়া তুলিয়াছিল, জনসমাজ ব্যভিচারের প্রবল বন্যায় কি ভাবে নিজেকে বন্ধুবিহীন অখের ন্যায় ছাড়িয়া দিয়াছিল, তাহা ভাবিলেও শিহরিয়া উঠিতে হয়।

পােপের গদীতে তথন আলেকজেণ্ডার বাের্জিয়া। হায়! ধর্মের গুরু হইয়া ধর্মের এতবড় অপমান বুঝি আর কেহ কোনদিন কল্পনায়ও আনিতে পারেন নাই। আলেকজেণ্ডার আর তাহার নিজের ছেলে সিজার একই সময়ে নিজের ঔরসজাত কন্যা লুক্রেসিয়া ওসহােদর ভগিনীলুক্রেসিয়ার উপর উপগত হইয়া সন্তান উৎপাদন করিতেছে। কামাচারিণী বােন ভাইকে প্রেরণা যােগাইতেছে বাপকে হত্যা করার জন্য। নােমর ইতিহাসে ইহার চেয়ে কলঙ্কমলিন কাহিনী আর কি হইতে পারে !! দুর্দান্ত যৌনপ্রবৃত্তি যে মানুষকে এতখানি উদগ্র করিয়া তুলিতে পারে, রক্ত সম্বন্ধও কাম-পরিপূরণের অন্তরায় হইতে পারে না—এ বােধশক্তি ধর্মগুরুর সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত থাকিয়াও আলেকজেণ্ডারের ছিল না। অথচ বিদেশী রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীন কর্তব্য সম্পাদনের ক্ষমতা নিজহস্তে পরিচালিত করিবার জন্য তিনি তীক্ষ্ণ ক্ষুরধার রাজনৈতিক বুদ্ধিচাতুর্য্য প্রয়ােগ করিতেন। রোমক চার্চের সর্বশ্রেষ্ঠ অধিনায়ক হইবার জন্য তিনি নিজের সুন্দরী মেয়ের দেহও কার্ডিয়াল শ্রেণীর ধর্মশ্রেষ্ঠীদের দ্বারা ভােগ করাইয়াছিলেন। অবশ্য তাহাতে তিনি তাহাদের সম্মতিও লাভ করিয়াছিলেন। তৎকালীন একজন সমসাময়িক ঐতিহাসিক বােজিয়াদের সম্বন্ধে এই মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছিলেন : They are geniuses of amorality. They know neither good nor bad. | অবশেষ পাপের অবশ্যম্ভাবী পরিণাম একদিন ঘটিলই—গােপন বিষে আলেকজেণ্ডার বাের্জিয়ার পােপ-জীবনের অবসান হইল।

ভারতবর্ষ 

ঋষিগণ হইলেন এই যজ্ঞানুষ্ঠানের প্রধান হােতা। ঋষিপ্রবর্তিত পদ্ধতিতে মন্ত্রোচ্চারণ (মন্ত্র মানে দেবতাগণকে নিবেদন) পূৰ্ব্বক যজ্ঞে তাঁহার বিসর্জন দিতে শিক্ষা করিল। প্রথমতঃ ঘৃত, গরু, ঘােড়, শূকর প্রভৃতি আহুতি দিত এবং সেই যজ্ঞানুষ্ঠানের সময় তাঁহারা সকলে মিলিয়া সােমরস পান করিত ও পরে স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে অবাধভাবে যৌনসম্পর্কে মত্ত হইত।

বৈদিক যুগের এই অবাধ যৌনমিশ্রণকে তেমন দোষারােপ করা চলে না; কারণ সভ্যতা তখন তেমনভাবে খাঁটি বাঁধিতে পারে নাই।

তখনকার যুগে কোন নির্দিষ্ট বা সুসামঞ্জস্য পন্থা, স্বাস্থ্য সুস্থ বিচার করিয়া গৃহীত হয় নাই। তখনকার যুগ কেবল পরীক্ষার যুগ—সভ্যতা গড়িয়া উঠার যুগ। তখনকার সমাজে যৌন-সংমিশ্রণ কেবলমাত্র মানুষ বৃদ্ধির জন্যেই প্রচলিত ছিল। এই অবস্থা কিছুকাল অতিবাহিত হওয়ার পর দলবদ্ধভাবে বিবাহ বলিয়া একটা প্রথা প্রচলিত হইল; কিন্তু যখন তাহারা দেখিলেন যে, একজন মেয়ে একদল পুরুষকে যৌনসঙ্গ দান করিতেছে এবং উহার ফলে যে সন্তান জন্মিতেছে তাহাতে কাহারাে কোন অধিকার থাকিতেছে না, তখন তাহারা সন্তানের প্রতি মাতার দাবী বলিয়া একটা প্রথার সৃষ্টি করিলেন। নারীগণ বিভিন্ন পুরুষের সহিত যৌনসঙ্গ করিলেও সন্তানাদি জন্মিলে তাহার উপর মাতারই সম্পূর্ণ অধিকার জন্মিল। এমনিভাবে বহুকাল অতিক্রম করিয়া পূর্বোক্ত বৈদিক যুগের অবসানের পর ঋক্ ও যজুৰ্বেদীয় যুগের আরম্ভ।

মহাভারত পাঠে জানা যায়, অতি প্রাচীনকালে ব্যাভিচার দোষ মানবসমাজে দোষ বলিয়াই গণ্য হইত না। জন্ম-প্রবাহ সংরক্ষনার্থে স্ত্রী-পুরুষের যৌন-সংবােগ অতি স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। কিন্তু বেদাদি গ্রন্থে যদিও প্রজা সৃষ্টির জয় অযােনী সম্ভোগ ও অজ্ঞাত অলৌকিক প্রক্রিয়ার কথাও জানা যায়। কিন্তু মন্ত্রাহ্মণে নারীর উপস্থ দেশকে (যােনি) প্রজাপতির দ্বিতীয় মুখ বলিয়া বর্ণিত করা হইয়াছে।

মহাভারতে মহারাজ পাণ্ডু কুন্তীদেবীকে বলিতেছেন: “হে পতিত্ৰতে রাজপুৱী! ধৰ্ম্মজ্ঞের ইহাই ধৰ্ম্ম বলিয়া জানেন যে, প্রত্যেক ঋতুকালে স্ত্রী স্বামীকে অতিক্রম করিবে না, অবশিষ্ট অন্যান্য সময়ে স্ত্রী স্বচ্ছন্দচারিণী হইতে পারে, সাধুজনেরা এই প্রাচীন ধর্মের কীৰ্ত্তন করিয়া থাকেন। ইহার দ্বারা প্রমাণিত হইতেছে যে, স্ত্রীলােকগণ প্রাচীন সময়ে কেবলমাত্র ঋতুকালে স্বামী ভিন্ন অন্য পুরুষে উপগতা হইত না, কিন্তু অন্য সময়ে তাহারা স্বচ্ছন্দে অন্য পুরুষে উপগত হইতে পারিত।

পাণ্ডু আরও বলিতেছেন যে, স্ত্রীলােকগণ পূৰ্বে গৃহে রুদ্ধা থাকিত না, তাহারা সকলের সহিতই আলাপ করিত, সকলেই তাহাদিগকে দেখিতে পাইত। স্ত্রীগণ ছিল স্বতন্ত্র। পরতা নহে। উহারা রতিসুখাৰ্থ স্বচ্ছন্দে যে-সে পুরুষে উপগত হইতে পারিত—যে-সে পুরুষের নিকট যাইতে পারিত। তাহারা কুমারী অবস্থা হইতেই ব্যাভিচারিণী হইত এবং উহাদের পতিরা কোন বাধা প্রদান করিত না ও উহা কোন অধৰ্ম্ম বলিয়াও পরিগণিত হয় নাই। কি প্রকারে এই প্রথা লােপ পায় সেকথা মহারাজ পাণ্ডুর কথায়ই ব্যক্ত হইতেছে : পূৰ্বকালে উদ্দালক নামে এক মহর্ষি ছিলেন। তাঁহার পুত্রের নাম শ্বেতকেতু। শ্বেতকেতু দ্বারাই প্রথমে স্ত্রীগণের স্বচ্ছন্দ বিহার প্রথায় বাধাদানকারী মৰ্যাদা স্থাপিত হয়। অবশ্যই শ্বেতকেতু কোপাবিষ্ট হইয়াই এই মৰ্যাদা স্থাপন করেন। একদা । উদ্দালক, শ্বেতকেতু ও তাহার মাতা উপবিষ্ট আছেন। এমন সময় এক ব্রাহ্মণ আসিয়া খেতকেতু-মাতার হস্তধারণ করিয়া বলিলেন, “এসাে আমরা যাই বলিয়া নির্জনে লইয়া গেলেন। ঋষিপুত্র পিতাকে ইচ্ছার কারণ জিজ্ঞাসা করিয়া যাহা অবগত হইলেন, তাহাতে শ্বেতকে কুপিত হইল। উদ্দালক পুত্রকে সান্ত্বনা প্রদান পূর্বক বলিলেন: “বৎস কুপিত হইও না—ইহাই সনাতন ধর্ম। জগতে সকল বর্ণের স্ত্রীই অরক্ষিত। গাভীগণের ন্যায় মানুষেরাও স্ব স্ব বর্ণে স্বচ্ছন্দে বিহার করিতে পারে।”

মহাভারতের আদি পর্বের চতুষষ্টিতম অধ্যায়ে পরিদৃষ্ট হয়—ব্রাহ্মণগণ ঋতুকালে সমাগত ক্ষত্রিয় কুলকামিনীদিগের অভিলাষ পূর্ণ করিতেন। কিন্তু কামত বা ঋতুকালাতিক্রমে তাহাদিগের সহিত সহবাস করিতেন না। ক্ষত্রিয় রমণীগণ এইরূপে ব্রাহ্মণ সংযােগে গর্ভবতী হইয়া যথাকালে সাতিশয় বীৰ্য্যবান পুত্র ও কন্যা প্রসব করিতে লাগিলেন। সেই সময় এইরূপ আচরণ রমণীগণ বাধ্য হইয়াই অবলম্বন করিয়াছিলেন, কারণ পরশুরাম কর্তৃক বহু ক্ষত্রিয় পুরুষ নিধন হওয়ায় ক্ষত্রিয় রমণীগণ এইভাবে ব্রাহ্মণ সংযােগে গর্ভবতী হইতেন।

মহাভারতের পাঠকগণ অবগত আছেন যে, কুন্তীদেবী ও তাহার পত্নী মাদ্রীদেবী তাহাদের স্বামী মহারাজ পাণ্ডু কর্তৃক আদিষ্ট হইয়া পরপুরুষ সংঘােগে পুত্র উৎপাদন করিয়াছিলেন এবং কুন্তীদেবী কুমারী অবস্থায়ও কর্ণকে প্রসব করেন। তবে এই ব্যাপারে দেবতাকে মর্ত্যে টানিয়া আনা হইয়াছে ও ইহার ধর্ম-ব্যাখ্যাও আছে। মােটামুটিভাবে ব্যাপারটা এইরূপ:

একদা মহারাজ পাও তাহার দুই পত্নী সমভিব্যবহারে মৃগয়ায় গিয়াছিলেন এবং বনে এক মৃগ মৃগীর সহিত ক্রীড়াসে ব্যাপৃত ছিল দেখিলেন। এমন সময় পাণ্ডু মৃগ ও মৃগীকে একেবারে প্রমত্ত দেখিয়া উপর্যুপরি পাঁচবাম শর নিক্ষেপ করেন। ফলে মৃগ ও মৃগী মৃত্যুমুখে পতিত হয়। কিন্তু ঐ মৃগ ও মৃগী প্রকৃতপক্ষে উহাই ছিল না-মৃগ ছিল এক মহাতেজা ঋষিপুত্র ; ঋষিতনয় আপন ভাৰ্যার সহিত মৃগরূপ পরিগ্রহ করিয়া • পরম সুখে ক্রীড়া করিতেছিলেন; এমনি সময় পাণ্ডুর বজ্রসম শরাঘাতে ব্যাকুলেন্দ্রিয় হইয়া তৎক্ষণাৎ ধরাতলে পতিত হন এবং বিলাপ সহকারে মহারাজ পাকে যথেষ্ট ভৎসনা করিয়া অবশেষে এই বলিয়া শাপ দেন। “তুমি যেমন আমাকে ভাৰ্যার সহিত অপবিত্র সময়ে বধ করিলে, আমিও শাপ দিতেছি, তােমারও এইরূপ অপবিত্র সময়ে মৃত্যু হইবে। আমি তপঃনিরত মুনি ; আমার নাম কিম, আমি লােক-লজ্জাভয়ে মৃগরূপ ধারণপূর্বক গহন বনে আসিয়া মৃগরূপী ভাৰ্য্যায় আসক্ত হইয়াছিলাম। যদিও ব্রহ্মহত্যার পাপ তােমার উপর দণিবে না, কারণ তুমি মৃগভ্রমেই শর নিক্ষেপ করিয়াছ; কিন্তু সঙ্গমকালে আমাকে বধ করায় তােমার যে পাপ হইয়াছে তাহা তােমাকে ভােগ করিতেই হইবে। তুমি যে সময় স্ত্রী-সংসর্গ করিবে সেই সময় তােমার মৃত্যু হইবে।” এই বলিয়া তাহারা মৃত্যুমুখে পতিত হন।

তদবধি পাও ভয়ে আর স্ত্রীগণের সহিত সহবাস করিতেন না। অতঃপর পাণু একদিন নির্জনে কুন্তীকে ডাকিয়া বলেন, “তুমি এই আপৎকালে অপত্যোৎপাদনে যত্নবতী হও। তুমি জ্ঞাত আছ যে মুগশাপে আমার পুত্রোৎপাদন শক্তি নষ্ট হইয়াছে, সুতরাং অন্য উপায় দ্বারা অপত্যোৎপাদনে যত্নবান হইতে হইবে। আমি স্বয়ং পুত্রোৎপাদনে অসমর্থ; অতএব তােমাকে তুল্যজাতি বা তদপেক্ষা শ্রেষ্ঠজাতি দ্বারা পুত্রোৎপাদন করিতে অনুজ্ঞা করিতেছি। দৃষ্টান্ত স্বরূপ পাণ্ডু উল্লেখ করেন। “আপৎকাল উপস্থিত হইলে দেবর দ্বারাও পুত্রোৎপাদন করিয়া লওয়া যায়। পূৰ্বে শরঙ্গণ্ডায়ন স্বীয় পত্নীকে পুত্র উৎপাদনে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। শরদায়নের পত্নী স্নান সমাপনাস্তর বিচিত্র পুষ্পমাল্যে ভূষিত হইয়া চতুষ্পথে উপস্থিত হয় এবং তথায় এক সিদ্ধ দ্বিজবরের সহবাসে তিনটা মহাবল পরাক্রান্ত পুত্ৰ উৎপাদন করিয়া লইয়াছিলেন।” | মহারাজ পাণ্ডুর উপরােক্ত ও পূৰ্বোল্লিখিত দৃষ্টান্ত সমূহ হইতে সমাজ অনুমােদিত ভাবে যৌন-উচ্ছলতার কিঞ্চিৎ আভাষ পাওয়া যায়। তবে সকল ক্ষেত্রেই এরূপ ব্যাপার প্রচলিত ছিলনা, কারণ কুন্তীদেবী এই সকলের বিরােধিতা করিয়া স্ত্রীগণের সতীত্ব আদর্শের প্রতি পাণ্ডুর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ইহাতে পাও দৃষ্টান্ত স্বরূপ কুন্তীকে আরও বলেন, “কল্মষপাদ রাজার পত্নী ময়ন্তী স্বামীর নির্দেশানুসারে মহর্ষি বশিষ্ঠদেবের ঔরসে অশুকনামা পুত্রোৎপাদন করিয়াছিলেন। তাহা ছাড়া পাও নিজেদের জন্মবৃত্তান্ত কথাও উল্লেখ করেন। পাওদের জন্মবৃত্তান্ত এইরূপ : ভীষ্মদেব স্বকীয় বলবিক্ৰমে কাশীশ্বরাজের তিনটী কন্যাকে তদীয় বৈমাত্রেয় ভাতা বিচিত্রবীর্যের জন্য আহৃত করিয়া আনেন। কন্যা তিনটীর নাম—অন্ধ, অম্বিকা, অম্বালিকা। অষা শারাজকে পতিত্বে বরণ করিতে চাহিলে সেইমত ব্যবস্থা করা হয়। অধিকা ও অম্বালিকার সহিত ভীষ্মদেব আপন ভ্রাতার বিবাহ দেন। তরুণবয়স্ক বিচিত্রবীৰ্য্য সেই কামিনীযুগলের পানিগ্রহণ করিয়া এককালে কুমায়ুধের অধীন হইলেন। সেই নিবিড় নিতম্বিনীদ্বয়ের পীন পয়োধরযুগল ক্ষীণ কটিদেশ ও নখসকল রক্তবর্ণ ছিল। তাহাদিগের ঘন কেশপাশের অনির্বচণীয় শােভা বর্ণনাতীত। তাঁহারা আপনাদিগকে অনুরূপ ভর্তৃভাগিনী জানিয়া কীত প্রফুল্লচিত্তে পতিসেবা করিতে লাগিলেন। বিচিত্রবীৰ্য্য মহিষীদিগের সহিত ক্রমাগত সাতবৎসর নিরন্তর বিহার করিয়া যৌবনকালেই যক্ষ্মরােগে আক্রান্ত হন। বহু চিকিৎসকদ্বারা তাঁহার চিকিৎসা করা হয় কিন্তু সকল চেষ্টাই বিফল হয়। বিচিত্রবীর্যের পরলােক প্রাপ্তি ঘটিলে ভীষ্ম ভ্রাতৃশােকে নিতান্ত কাতর ও বিষন্ন হন। | অতঃপর পুত্রশোকাতুরা জননী সত্যবতী ভীষ্মকে সান্ত্বনা দানান্তর বলেন, “তােমার প্রিয়তম ভ্রাতা পুত্রবিহীন হইয়া পরলােকগমন করিয়াছেন। তাহার পরম রূপবতী ও সম্পূর্ণ যৌবনবতী মহিয়ীদ্বয় পুত্রার্থিণী হইয়াছেন , অতএব আমি অনুমতি করিতেছি, তুমি বংশরক্ষার নিমিত্ত তাহাদিগের গর্ভে সন্তান উৎপাদন কর।” কিন্তু ভীষ্মদেব তাহার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ না করিয়া মাতাকে এ বিষয়ে বিরত হইতে বলেন ও অপর কোন ব্রাহ্মণ দ্বারা ভ্রাতৃজায়াদের গর্ভে সন্তান উৎপাদন করিবার কথা বলেন। এ সম্বন্ধে ভীষ্মদেব কয়েকটা দৃষ্টান্ত দেখান। প্রসঙ্গক্রমে ভীষ্ম বলেন, “পূৰ্বে উতথ্য নামে এক মহর্ষি ছিলেন এবং তাহার এক সহধর্মিণী ছিলেন। একদা মহর্ষি উতথ্যের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা দেব পুরােহিত বৃহস্পতি মদনাতুর হইয়া মমতার নিকট উপস্থিত হন। মমতা দেবরকে সম্বােধন করিয়া বলেন, “তােমার জ্যেষ্ঠের সহযােগে আমি গর্ভবতী হইয়াছি, অতএব রমণেচ্ছা সংবরণ কর। আমার গর্ভস্থ উতথ্যকুমার কুক্ষিধ্যেই ষড়ঙ্গবেদ অধ্যয়ন করিয়াছেতুমিও অমােঘরেতাঃ ; কাজেই একই গর্ভে দুইজনের সন্তান নিতান্ত অসম্ভব। অতএব তুমি এই দুৰবসায় হইতে নিবৃত্ত হও।” কিন্তু বৃহস্পতি চঞ্চলচিত্তকে দমন করিতে না পারিয়া মমতার অসম্মতি থাকিলেও বলপূর্বক তাহাতে আসক্ত হইলেন। গর্ভস্থ ঋষিকুমার বৃহস্পতিকে কামক্রীড়ায় যত দেখিয়া মদনবেগ সংবরণ করিতে অনুরোধ করিয়া বলিলেন, “আমি পূর্বেই এই গর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছি, অতএব আমাকে পীড়িত করা আপনার অযােগ্য কৰ্ম্ম হইতেছে। বৃহস্পতি ইহাতে কর্ণপাত না করিয়া স্বীয় প্রবৃত্তি চরিতার্থ করিতে লাগিলেন! গর্ভস্থ মুনিবুমার অসহিষ্ণু হইয়া পাদদ্বারা তদীয় শুক্রের পথরােধ করিলেন। রেত প্রবেশমার্গ না পাইয়া প্রতিহত হইয়া সহসা ভূতলে পতিত হইল। ইহা দেখিয়া বৃহস্পতি উতথ্যনন্দকে অভিশাপ করিলেন, “তুমি যাবজ্জীবন অন্ধত্ব প্রাপ্ত হইবে।” ;

ইহার পর বৃহস্পতির শাপ প্রভাবে সেই পুত্র অন্ধ হইয়াই জন্মগ্রহণ করিলেন। তাহার নাম হইল দীর্ঘতমা। এই দীর্ঘতমাই নারীগণের এক পতিত্ব প্রতিষ্ঠার অন্যতম ঋষি। বেদবিৎ প্রজ্ঞা ঋষি দীর্ঘতমা স্বীয় বিদ্যাবলে প্ৰদ্বেষী নাম্নী এক পরম রূপলাবণ্যবতী যুবতীর পানিগ্রহণ করেন। দীর্ঘতমার পত্নী প্রদ্বেষী, গৌতম প্রভৃতি কয়েকজন পুত্রলাভের পর আর পতির সন্তোষ জন্মাইতেন না। দীর্ঘতমা পত্নীর এরূপ আচরণ ও অভক্তি লাভ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি আমার প্রতি বিদ্বেষ প্রদর্শন করিতেছ কেন? উত্তরে প্রন্বেষী বলেন, “স্বামী স্ত্রীর ভরণ পােষণ করেন তাই তিনি উক্ত নামে অভিহিত। কিন্তু তুমি জন্মান্ধ, তাহার কিছুই করিতে পারনা। বরং আমিই তােমার ও পুত্রগণের ভরণ পােষণ করিয়া নিতান্ত শ্রান্ত ও পীড়িত হইয়াছি, অতএব আমি আর ইহা পারিব না।” মহর্ষি দীর্ঘতমা পত্নীবাক্য শ্রবণ করিয়া ক্রোধান্বিত হন ও বলেন, “তুমি আমাকে রাজদ্বারে লইয়া চল—অর্থলাভ হইবে।” প্রত্যুত্তরে প্রদ্বেষী বলেন, “ধনে আমার অভিলাষ নাই তোমার যেমন খুসী করিতে পার। আমি আর তােমার ও তােমার সন্তানগণের ভরণপােষণ করি না। দীর্ঘতমা পত্নীর সগর্ববচন শ্রবণান্তর কহিলেন, “আমি অদ্যাবধি পৃথিবীতে এই নিয়ম প্রতিষ্ঠিত করিলাম, পজিই একমাত্র স্ত্রীলােকগণের চিরজীবনের আশ্রয় হইবে। স্বামী মরিলে বা স্বামী জীবিত থাকিলে স্ত্রী অন্য পুরুষে উপগত হইতে পারিবে না, ইচ্ছানুরূপ পুরুষান্তর গমন ও বিহার করিতে পারিবে না। অন্য পুরুষে উপগত হইলে তাহাকে পতিতা হইতে হইবে। আজ অবধি যে সকল স্ত্রী পতিকে ত্যাগ করিয়া অন্য পুরুষের সহিত সহবাস করিবে তাহার পাতক হইবে। আর পতিবিহীনা নারীগণের সর্বপ্রকার সমৃদ্ধি ও ধন থাকিলেও এ সকল ভােগ করিতে পারিবে না—নিয়ত তাহাদের অপযশ ও অপবাদ হইবে।” প্রদ্বেষী স্বামীর এইসকল বাক্য শ্রবণ করিয়া অত্যন্ত কুপিতা হন এবং গৌতম প্রভৃতি পুত্রগণকে আদেশ করিয়া দীর্ঘতমাকে গঙ্গায় নিক্ষেপ করেন। অন্ধ দীর্ঘতমাঃ উরুপ মাত্র অবলম্বন করিয়া স্রোতে ভাসিতে ভাসিতে নানাদেশ অতিক্রম করিতে লাগিলেন।

বলিরাজ গঙ্গাস্নান করিতে যাইয়া দীর্ঘতমাকে জল হইতে তুলিয়া সকল বিবরণ শশানেন ও বাড়ী আনিয়া তাহাকে স্বীয় মহিষী সুদেষ্ণার গর্ভে পুত্রোৎপাদন করিতে বলেন। দীর্ঘতম সম্মত হন। কিন্তু সুদেষ্ণা তঁাহাকে অন্ধ ও বৃদ্ধতম দেখিয়া নিজ ধাত্ৰেয়িকাকে তাহার নিকট প্রেরণ করেন। দীর্ঘতমা সেই পাত্রেয়িকার সহিত যৌনসঙ্গম করিয়া এগারােটী সন্তান উৎপাদন করেন। মহারাজ বলি যখন দীর্ঘতমাকে জিজ্ঞাসা করেন, ইহারা তাহার পুত্র কিনা, তখন দীর্ঘতমাঃ তাহা অস্বীকার করিয়া বলেন, আপনার মহিষী আমাকে অন্ধ ও বৃদ্ধতম দেখিয়া অবজ্ঞা করিয়া তাহার ধাত্ৰেয়িকাকে আমার নিকট প্রেরণ করেন এবং আমি এই শুদ্রযােনিতে একাদশ সন্তান উৎপন্ন করিয়াছি; অতএব ইহারা আমার সন্তান।” তখন রাজা মুনিকে প্রসন্ন করিয়া পুনর্বার মহিষী সুদেষ্ণাকে তাহার নিকট প্রেরণ করেন ও ঋষি দীর্ঘতমাঃ তাহার গর্ভে অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পণ্ড ও সুক্ষ নামে পাঁচ পুত্ৰ উৎপাদন করেন। উক্ত পাঁচ সন্তানের নামানুসারে তাহাদের অধিকৃত দেশের ঐরূপ নাম হয় ।

মহাভারতের উপরােক্ত প্রমাণানুসারে স্পষ্ট প্রতিপন্ন হয় যে, প্রাচীনকালে হিন্দুসমাজে বিবাহ বন্ধন বর্তমানের ন্যায় সুদৃঢ় ছিলনা। স্ত্রীলােকগণ কৌমার কাল হইতেই কিংবা বিবাহের পরও যথেচ্ছাভাবে পরপুরুষ সহবাস করিতে পারিত। ইহাতে তাহাদের কোন বাধা ঘটিত না। সাধু সমাজেও উহা ধৰ্ম্ম বলিয়া গণ্য হইত।

…..এই সমস্ত দৃষ্টান্ত দেখাইয়া অতঃপর ভীষ্ম বলেন, “কোন গুণবান ব্রাহ্মণকে ধনদানদ্বারা পরিতুষ্ট করিয়া গৃহে আহ্বান করতঃ তাহার দ্বারা বিচিত্রবীর্যের পত্নীদ্বয়ে সন্তান উৎপত্তির ব্যবস্থা করিতে হইবে। কিন্তু সত্যবতী তাহা চাহিলেন না। তিনি তাঁহার বংশজ কাহারো দ্বারাই বিধবা পুত্রবধুদের ক্ষেত্রে সন্তান উৎপন্ন করিতে চাহিয়া নিজের কুমারী-জীবনের কথা উত্থাপন করেন। একদিন পিতার আদেশক্রমে সত্যবতী লােকজনদিগকে নদী পার করিতে গিয়াছিলেন। সেই সময় তাহার যৌবনােদ্ভেদ হইয়াছিল। মহর্ষি পরাশর তাহাকে দেখিয়া কামার্ত হন ও তাহার সহিত বিহার করেন। ফলে সত্যবতী গর্ভবতী হন। সেই গর্ভ যমুনাদ্বীপে মােচন করিয়া পরাশরের কৃপায় পুনরায় কুমারীত্ব প্রাপ্ত হন। সেই গর্ভজাত পুত্রের নাম হইয়াছিল দ্বৈপায়ন; কিন্তু পরে চতুর্বেদের বিভাগকর্তা বলিয়া তাহার নাম বেদব্যাস হয়। সত্যবতীর সঙ্গে বিহারের পূর্বে মহামুনি পরাশর তিনটা অলৌকিক বিদ্যা প্রদর্শন করেন-(১) তিনি সত্যবতীর গাত্রের মৎস্যগন্ধ দূর করিয়া পদ্মগন্ধ উৎপন্ন করেন, (২) এক কুপ্সটিকার সৃষ্টি করিয়া সত্যবতীর সহিত বিহার করেন–যাহাতে সঙ্গমদৃশ্য কাহারাে চক্ষে না পড়ে, (৩) সত্যবতীকে অক্ষতা কুমারীত্ব প্রদান করিয়া যান। সত্যবতীর কুমারী কালীন প্রসূত পুত্ৰ বেদব্যাস মাতাকে এই বলিয়া যান যে, যখন তাহার প্রয়ােজন হয় স্মরণমাত্রেই সে মাতৃসমীপে উপস্থিত হইবে। এ কাহিনী বলিয়া সত্যবতী ব্যাসকে আহ্বান করিয়া মৃতপুত্রবন্ধুদের ক্ষেত্রে সন্তান উৎপাদন করিতে আহ্বান করিতে চান। ভীষ্মও তাহাতে সম্মতি প্রদান করেন।

সত্যবতীর আহ্বানে বেদব্যাস মাতৃসমীপে উপস্থিত হইলে সত্যবতী বলেন, “ভীষ্ম যেমন পিতৃসম্বন্ধে তােমার ভ্রাতা, তুমিও তােপ মাতৃসম্বন্ধে তাহার ভাতা। কিন্তু ভীষ্ম প্রতিজ্ঞা করিয়াছে দ্বার পরিগ্রহ করিবে না, অতএব আমি তােমাকে বংশরক্ষা কার্যে নিযুক্ত করিতে চাই। রূপযৌবনসম্পন্না তােমার ভ্রাতৃজায়ারা সাতিশয় পুত্রার্থিনী হইয়াছেন, তুমি তাহাদের গর্ভে পুত্রোৎপাদন কর।”

বেদব্যাস সম্মত হইয়া বধুদের তােপাসনার দ্বারা পবিত্র হইতে বলিয়া সংবৎসরকাল অপেক্ষা করিতে বলেন; কিন্তু সত্যবতী অপেক্ষা করিতে না চাহিয়া অচিরকাল মধ্যেই যাহাতে পুত্রবধুগণ গর্ভবতী হয় বেদব্যাসকে সেই ব্যবস্থা করিতে বলেন। তখন বেদব্যাস বলেন, “যদি আপনার পুত্রবধু পরমব্রত স্বরূপ আমার বিরূপতা সহ্য করিতে পারেন, তবে আমি অকালিক পুত্র উৎপাদন করিব।” | ইহার পর সত্যবতী ঋতুয়া পুত্রবধু অধিকাকে যথাকালে শয্যায় শয়ন করাইয়া মৃদুস্বরে কহিতে লাগিলেন, “বৎসে! তােমার এক দেবর আছেন, অদ্য নিশিথে তিনি তােমার নিকট আগমন করিবেন; অতএব তুমি অপ্রমত্তা হইয়া দেবরের আগমন কাল প্রতীক্ষা কর।” | বেদব্যাস পূর্বকৃত সত্য পালন করিবার উদ্দেশ্য ভ্রাতৃবধূ অধিকার শয্যাগারে প্রবেশ করিলেন। অৰিকা শর নির্দেশে পরম রমণীয় শয্যায় শয়ন করিয়াছিলেন। তদীয় বাসরকক্ষ প্রদীপ্ত দীপশিখায় আলােকময় ছিল। অম্বিকা সেই কৃষ্ণবর্ণ মহর্ষির উজ্জ্বল নয়ন যুগল, পিঙ্গলবর্ণ জটাভার, বিশাল শ্মশ্রু প্রভৃতি ভয়ঙ্কররূপ দেখিয়া ভীত ও | বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া চক্ষু বুজিলেন। বেদব্যাস মাতার সন্তোষার্থে তাহার সহিত সহবাস করিলেন; কিন্তু অৰিকা ভয়ে দেবরের প্রতি দৃষ্টিপাত | করিতে পারিলেন না। বেদব্যাস বাহির হইবার সময় সত্যবতী জিজ্ঞাসা করিলেন, বধু গুণবান সন্তান প্রসব করিবে কিনা?: প্রত্যুত্তরে ব্যাস বলেন, “আলৌকিক ধীশক্তিসম্পন্ন বলবান, বীৰ্য্যবান, সুবিধান পুত্র অবশ্যই প্রসব করিবেন এবং ইহার ঔরসে শতপুত্ৰও জন্মগ্রহণ করিবে, কিন্তু মাতৃদোষে এই পুত্র জন্মান্ধ হইবে।” যথাকালে বড়বধূর | ধৃতরাষ্ট্র নামে অন্ধ পুত্রের জন্ম হইল।

পুনরায় ব্যাস মাতা কর্তৃক আহূত হইয়া দ্বিতীয় বধু অম্বালিকার গৃহে সেই মুর্তিতে প্রবেশ করেন। অম্বালিকা সেই ভীষণমুর্তি দর্শনে ভীতা ও পাণ্ডুবর্ণা হন। ব্যাসদেব অম্বালিকার সহিত বিহারান্তর বলেন, “তুমি আমার বিরূপত্ব সন্দর্শনে পাণ্ডুবর্ণ হইয়াছ, অতএব তােমার পুত্রও পাণ্ডুবর্ণ হইবে এবং তাহার নাম হইবে পাণ্ডু। ব্যাস বাহিরে আসিলে সত্যবতী পুত্র বিবরণ জিজ্ঞাসা করিলে ব্যাস উপরােক্ত বিবরণ মাতাকে নিবেদন করেন। সত্যবতী ব্যাসকে আর একবার বড়বধু অম্বিকার ক্ষেত্রে একটা সৰ্বাঙ্গসুন্দর পুত্র উৎপাদন করার কথা বলেন। ইতিমধ্যে ছােটবধু অম্বালিকা পাণ্ডকে প্রসব করার পর জ্যেষ্ঠবধু অধিকার পুনরায় ঋতুকাল | উপস্থিত হইল। দ্বৈপায়ন ব্যাসের সহিত সহযােগ করিবার জন্য সত্যবতী পুনরায় তাহাকে নির্দেশ করিলেন। কিন্তু অম্বিকা ব্যাসের সেই | উগ্ৰমূর্তি ও গন্ধের কথা চিন্তা করিয়া অত্যন্ত ভীতা হন এবং আপনার এক সুন্দরী দাসীকে নিজ অলঙ্কারে ভূষিত করিয়া ঋষির নিকট প্রেরণ করেন। ব্যাস পরম পরিতােষপূৰ্ব্বক সেই রমণীতে বিহারান্তর বলেন,

তুমি দাসত্ব শৃঙ্খল হইতে মুক্ত হইবে এবং তােমার গর্ভজাত পু অসাধারণ বুদ্ধিমান ও পরম ধার্মিক হইবে।” সেই দাসীগর্ভসস্তৃত পুত্র বিদুর নামে মহাভারতে বিখ্যাত। | পাণ্ডুমহিষী কুন্তী স্বামীর আজ্ঞা পাইয়া ধৰ্ম, মারুত ও ইন্দ্র এই তিনজনের দ্বারা যথাক্রমে যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন নামক তিন পুত্র উৎপাদন করেন ও তত্ত্বীয় স্বপত্নী মাদ্রীর ক্ষেত্রে অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের সংযােগে নকুল ও সহদেবের জন্ম হয়।

এতদ্ভিন্ন হিন্দুশাস্ত্রের অষ্টাদশ পুরাণ ও অষ্টাদশ উপপুরাণে ঈশ্বর, ঋষি, মুনি ও দেবতা আদি শ্রেষ্ঠ জীবমাত্রেরই চরিত্র অধ্যয়ন করিয়া আমরা এই সত্যে উপনীত হইতে পারি যে, ইহারা সকলেই অম্লাধিক ইন্দ্রিয় ব্যভিচার দোষদুষ্ট ছিলেন। পুরাণে ব্রহ্মাকেও আপন কন্যার সহিত এবং শ্রীকৃষ্ণকেও কুজা, শ্রীরাধিকা ও অন্যান্য গােপাঙ্গনাদিগের সহিত ব্যভিচার দোষদুষ্ট করিয়াছে। যােগেশ্বর মহাদেব যিনি মদনকে ভস্মীভূত করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, তাঁহাকেও ঋষিপত্নীগণের সহিত ব্যভিচার দোষদুষ্ট করা হইয়াছে। সেইরূপে ইন্দ্রকে মাতাপেক্ষাও গুৰ্বিনী গুরুপীর সহিত, বিষ্ণুকে জালন্ধর পত্নী ও বৃন্দার সহিত, পবনকে অঞ্জনার সহিত, বরুণকে উৰ্বশীর সহিত, চন্দ্রকে তাহার গুরুপত্নী তারার সহিত, বিশ্বামিত্রকে উর্বশীর সহিত ব্যভিচার দোষে লিপ্ত দেখা যায়। | অধিক দূরে যাইবারও প্রয়ােজন নাই। প্রায় আড়াই হাজার বৎসর পূর্বে দৃষ্টি প্রসারিত করিলেই আমরা দেখিতে পাই, যে অহিংসা মন্ত্রের ঋষি অমিয় প্রেমের বাণী ঘােষণা করিয়া জগতের সকলকে আহ্বান করিলেন, বলিলেন, ‘পঞ্চভূতে বিলীন হইবে যে দেহ, সেই দেহকে অস্বীকার করিয়া তবেই আমাদের মুক্তি’ বুদ্ধদেবের এ বাণীতে সেদিন ঘরে ঘরে মা, বােন, প্রেয়সীর বুক অজানা আশঙ্কায় কঁপিয়া উঠিল ; ঘরে ঘরে নিশীথ রাত্রির অন্ধকার মহানিৰ্বাণের ভেরীনিনাদে রিক্তা হইয়া গেল। কিন্তু শতাব্দীও অতিবাহিত হইল না, সৰ্বত্যাগী ভােগ বিমুখতার দৃঢ় সঙ্কল্প এক নারীর কেশের গন্ধে হইল পরাভূত। ফলে বৌদ্ধভ্রমণ মহামশুলগুলিতে যে ব্যভিচারের প্রাচুৰ্য্য উৎকট হইয়া উঠিয়াছিল তাহার তুলনা পাওয়া কঠিন।

প্রথমতঃ সমস্ত মহাযান বৌদ্ধসম্প্রদায়ের মধ্যেই জ্ঞাননিষ্ঠা, ইন্দ্রিয় সংযম ও সন্ন্যাস বৈরাগ্য দ্বারাই নিৰ্বাণপদ লাভের দিকে একমাত্র লক্ষ্য ছিল। কিন্তু বুদ্ধের প্রধান শিষ্য আনন্দ নারীজাতিকেও সন্ন্যাসের অধিকার প্রদান করিয়া যান। ইহার পর বহু বহু বৌদ্ধবিহার ও সঘারামে বহুতর বক ভিক্ষুসঙ্ঘের ন্যায় বহু বহু বিকাও আশ্রয় লাভ করিয়াছিলেন। প্রথমাবস্থায় এই সমস্ত শ্রাবক-শ্রাবিকাগণের উভয়েরই লক্ষ্য ছিল নিবৃত্তি ও নির্বাণমুক্তি লাভের দিকে। কিন্তু মহাপণ্ডিত চাণক্য বলিয়াছিলেন যে, ঘৃতকুম্ভসমা নারী ও তপ্ত অঙ্গারবৎপুরুষ’ এবং উভয়ের একত্র অবস্থানের যে ফললাভ অবশ্যম্ভাবী—এই ক্ষেত্রেও তাহার ব্যতিক্রম দেখা যায় নাই। কাজেই বৌদ্ধবিহার গুলিতে যদিও জ্ঞাননিষ্ঠ জিতেন্দ্রিয় শ্রাবকগণ কামিনীকাঞ্চন ও প্রবৃত্তিমার্গ হইতে দূরে সরিয়াই রহিলেন, কিন্তু অবশিষ্ট শ্রাবকগণ স্ত্রীসংসর্গের ফলে প্রবৃত্তির সাধনা দ্বারা। নিবৃত্তি বা মােক্ষপথ লাভ করিবার উপায় উদ্ভাবনে প্রবৃত্ত হন। ফলে এই নব-সম্প্রদায় অতি গােপনে প্রচার করিতে লাগিলেন‘নিরবচ্ছিন্ন ভােগ সাধনার দ্বারা যে সহজানন্দ লাভ হয়, তাহার দ্বারাই নির্বাণমুক্তি লাভ করা যাইতে পারে। এই মত যখন প্রচারিত হয় তখন বৌদ্ধবিহারগুলিতে প্রবল ব্যভিচারের বন্যা প্রবাহিত হইতেছিল।

এই নব সম্প্রদায়ের বৌদ্ধগণ ‘বন্দ্রযান’ নামে পরিচিত হন। উক্ত সম্প্রদায়ের একখানি অতি প্রাচীন হস্তলিখিত তন্ত্রগ্রন্থ ‘চগুরােষণমহাতন্ত্র’ হইতে এই সহজতত্ত্ব সম্পর্কে যেরূপ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, উহার শ্লীলতাসম্পন্ন অংশের একটু সারমর্ম নিম্নে দেওয়া যাইতে পারে : আনন্দ চারিপ্রকার-আনন্দ, পরমানন্দ, সহজানন্দ ও বিরামানন্দ। ইহার মধ্যে প্রজ্ঞা ও উপায়, পরস্পরের যাহাতে অনুরাগ জন্মে, তাশ লক্ষণাবিশিষ্ট আলিঙ্গন, চুম্বন, স্তনমর্দন, নখদংশন দ্বারা যন্ত্রাঢ়ের ন্যায় বজ্ৰপদ্মসংযােগে যে আনন্দ অনুভূত হয়, তাহাকে আনন্দ কহে। তারপর পদ্মগত বজ্ৰচালন দ্বারা মণিমুল বােধিচিত্ত প্রাপ্ত হইলে তাহাকে পরমানন্দ কহে। এই পরমাননে আনন্দ অপেক্ষা অধিক সুখ হইয়া থাকে। তাহার পর আবার যখন এই মণিমূল হইতে পদ্মদ্বয়ের অন্তর্গত বজ্ৰচালন কাৰ্য্যকরী না হয়, তখন তাহাকে সহজানন্দ কহে। ইহাতে গ্রাহগ্রাহক ও গ্ৰহণাভিমানবর্জিত পরম সুখ উৎপন্ন হয়। ইহার পর নিশ্চেষ্ট হইয়া আমি সুখভােগ করিয়াছি এইরূপ বিকল্প অনুভব করাকে বিরামানন্দ কহে। এই সম্প্রদায়ের দীপঙ্কর ও অন্যান্য শাবকগণই এই গুপ্ত অনিন্দতত্ত্ব প্রকাশ করেন। তাহারা সাধারণকে বুঝাইয়াছিলেন, স্বয়ং ভগবান বজ্রসত্ব তাহার শক্তির সহিত একত্রীভূত হইয়া সহজানন্দ ও সহজেকস্বভাব তত্ত্ব প্রকাশ করিয়াছিলেন। এক সময়ে গৌড়বঙ্গেও এই বজ্রধান সম্প্রদায় বিশেষ প্রবল ছিল। কারণ ইন্দ্রিয় চরিতার্থতারূপ সহজসাধন যখন ধর্মের অঙ্গ বলিয়া গণ্য হইল, তখন আপাতমুখপিপাসী জনসাধারণ যে অতি সহজেই এই সহজধর্ম গ্রহণ করিবে তাহা বলাই বাহুল্য।

তাহার পর এক সময়ে বৌদ্ধ তান্ত্রিক সাধকগণ এতদুর অধঃপাতে পৌছিলেন যাহা শুনিয়া শিহরিয়া উঠিতে হয়। এই তান্ত্রিকগণ এমন সৰ ভয়ানক কথা প্রচার করিতেও কুণ্ঠিত হইলে না, ‘মাতৃযোনিং পরিত্যজ্য বিহরেৎ সৰ্বষােনিযু তাহা ছাড়া নানারূপ বদ বহির্ভূত বা ধর্ম ও সমাজবিরুদ্ধ মত প্রচার করিয়া আপনাদিগকে বীর বলিয়া প্রচার করিতে লাগিলেন এবং বলিলেন, “যাহারা ত্রিসন্ধ্যা বন্দনাদি করেন, যিনি প্রতিদিন মানাদি সমাপনাস্তর মৌনভাব অবলম্বন করিয়া ধ্যান ধারণায় মগ্ন থাকেন, যিনি ঘৃতান্ন নিরামিষভােজী, পশু প্রভৃতির প্রতি হিংসা করেন না ও মদ্য মাংসাদি স্পর্শ করেন না, যিনি জিতেন্দ্রিয় হইয়া ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করেন, যিনি গৃহস্থ হইয়াও কেবল পুলোৎপাদন অন্য ঋতুকালে ধর্মপত্নীতে উপগত হন ও অপর স্ত্রীলােকমাকেই মাতৃবৎ জ্ঞান করেন, তিনিই পশু! ইহাদিগের মধ্যে আবার মাতঙ্গী বিদ্যালৰী তান্ত্রিকগণ পাপের পরাকাষ্ঠা দেখাইয়া মাতাপি নত্যজেৎ’ ইত্যাদি যতদুর নীচ ও নীতিবিরুদ্ধ মত প্রচার করেন।

উপরােক্ত শ্লোক সমূহের সংক্ষিপ্ত অর্থ এই যে : ললাকে যাবৎ লােকলজ্জা, কুললজ্জা ও দেশলজ্জাদি পাশরূপে বদ্ধ থাকিবে অর্থাৎ সে একেবারে বেহ বেহায়া না হইবে, তাবৎ সে পাশবদ্ধ জীব; এবং যখন সে লাজ-লজ্জার মাথা খাইয়া নির্লজ্জ বেহায়া হইয়া সকলের সমক্ষে যদিচ্ছাচরণে প্রবৃত্ত হইবে, তখনই সে শিবত্ব প্রাপ্ত হইবে; অর্থাৎ যতক্ষণ তাহার অন্তরাত্মায় প্রেরণা থাকিবে যে, এ কর্ম করা ভাল অথবা এরূপ অধর্মাচরণ করা কর্তব্য, তাবৎ সে পশুরূপে গণ্য হইবে এবং যখন তাহার হিতাহিত বিবেচনা একেবারেই নষ্ট হইয়া যাইবে এবং কোনরূপ পাপাচরণ করিতে তাহার মনে এতটুকু কুণ্ঠা উপস্থিত হইবে না, তখনই সে শিবত্ব প্রাপ্ত হইবে। এইরূপে যিনি ক্রমাগত সুরাপান করেন ও পরে বেশ্যালয়ে গমন করিয়া সেখানে রাত্রি অতিবাহিত করেন ও অন্যান্য (পাপাচারে) প্রবৃত্ত হন, তিনি বীরাচারীদিগের মধ্যে চক্রবর্তী অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ। যে বীরাচারী মহাশয় সুরাপান করিতে করিতে নেশায় অভিভূত হইয়া অচৈতন্য অবস্থায় ভূমিতে পড়িয়া গড়াগড়ি দেন, তৎপর পুনরায় উঠিয়াই আবার সুরাপানে রত হন, তাহার আর জন্ম হয় না। | ভৈরবীচক্রকালে যিনি ভগিনী আদি স্বজনবর্গের সহিতও ব্যভিচারে কুণ্ঠিত না হইয়া, আমি ভৈরব ও তুমি ভৈরবী এই মন্ত্র বলিয়া ব্যভিচারে প্রবৃত্ত হন, তিনিই মহান সাধক। যিনি রজঃস্বলা স্ত্রী গমন (যাহা সকল শাস্ত্র বিরুদ্ধ ) করেন তিনি পুষ্কর তীর্থ গমনের ফল লাভ করেন। তেমনি যিনি চর্মকারী গমন করেন তিনি প্রয়াগ, যিনি রজকিনী গমন করেন তিনি মথুরা, যিনি পুকসী গমন করেন তিনি অযােধ্যা গমনের ফললাভ করিয়া থাকেন। যে ব্যক্তি মদ্য, মাংস, মীন, মুদ্রা ও মৈথুন এই পঞ্চমকারে প্রবৃত্ত হন, তিনিই মুক্তির অধিকারী। এইরূপ আচরণই যুগে যুগে লােককে মুক্তি দিবে।

ইহাদের উল্লিখিত ভৈরবীচক্র এতদুর কুরুচিপূর্ণ ও অশ্লীল অনুষ্ঠান ছিল, যাহা প্রকাশ করা কঠিন। তথাপি এ বিষয়ে সামান্য একট ইঙ্গিত করা চলে। এই চক্রের অনুষ্ঠান কালে বিভিন্ন জাতীয় তান্ত্রিক স্ত্রীলােক ও পুরুষেরা চক্রাকারে বসিয়া এবং মধ্যস্থলে কোন একজন কৌল চক্রবর্তী পাশমুক্ত অর্থাৎ যে বেহায়া বীরাচারী মহােদয়কে উলঙ্গ করিয়া • বসাইয়া তাহার গুপ্তাঙ্গে কোন একজন সুন্দরী যুবতী নারী সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হইয়া ‘পরম নিষ্ঠার সহিত’ সিন্দুর, ফুল, ফল ও দুৰ্বাদির দ্বারা পূজা করিত। এই সচেতন বীরের অঙ্গকে বীরাচারী মহাশয়েরা জীবন্ত শিবলিঙ্গ বলিয়া অভিহিত কৰিলে। তৎপরে চক্রবর্তী মহাশয়কে সুরা দেওয়া হইত এবং তিনি উহা উচ্ছিষ্ট করিয়া দিলে সেই সুৱা সকলে প্রসাদরূপে পান করিতেন। সুরার পরিমাণ খুব বেশীই থাকিত-কারণ মুরাকে ত তাঁহারা আর সুরাজ্ঞান করিতেন না, তাহারা ইহাকে কারণবারি বা আনন্দময় স্বরূপ জ্ঞান করিতেন। যাহা হউক উক্ত স্ত্রীলােকের পূজা সমাপন হইলে চক্রবর্তী মহাশয় উঠিয়া পুনরায় সেই শ্রীলােকটীকে বিবস্ত্র অবস্থায় বসাইয়া তাহার স্ত্রী অঙ্গকে (কারণ তান্ত্রিকগণ ইহাকে জীবন্ত যােনিপিঠ বলিয়া অভিহিত করিতেন) পূজা করিতেন ও সুরাদি প্রদান পূর্বক প্রসাদ লইতেন। যে সকল সুন্দরী যুবতীকে ইহার জন্য নির্বাচিত করা হইত তাহারা অধিকাংশই চণ্ডালী, চর্মকারী, পুৰুসী, রজকিনী প্রভৃতি শ্রেণীভুক্তাই হইত। কারণ উচ্চবংশীয় ভদ্রকন্যারা সহজে ইহাদের ফাঁদে পা দিত না। তারপর সকলের নেশা যখন বেশ জমিয়া আসিত, তখন দীপ নির্বাপিত করা হইত। ইহার পরে বিভিন্ন নারী ও পুরুষ তান্ত্রিকগণের যে বিভৎস রতিমজলিস জমিয়া উঠিত তাহা বর্ণনাতীত।

শঙ্করাচার্যের জন্মের পরও কিছুকাল এই সকল তান্ত্রিক কাপালিকগণ সমাজের বুকের উপর নারী ধর্ষণের যে তাণ্ডবলীলা চালাইয়া আসিতেছিল ও ধর্মের নামে যে সমস্ত পাপাচরণ ইহাদের দ্বারা অনুষ্ঠিত হইত, তাহা ঐতিহাসিক্ত ব্যক্তিমাত্রেই অবগত আছেন।

ইহাদের মতে ভজন সাধন করিতে হইলে, প্রথমতঃ একটা সুন্দরী ও নবযৌবনসম্পন্ন পরকীয়া রমণী আবশ্যক। পরে রসিকভক্ত গুরুর নিকট রীতিমত উপদেশ লইয়া সেই নায়িকাতে দেহ-মন আরােপ পূর্বক সাধন ভজন করিলে অর্থাৎ পরকীয়া নারীর সহিত তাহার দেহ-বৃন্দাবনে বিচরণ করিয়া উক্ত বৃন্দাবনে তাহার নিজের জীবন, যৌবন ও দেহ অর্পণ ও তাহার রতিতে নিজ রতি মিশাইয়া ভাষপ্রেম এক করিয়া সেই কামবীজ কাম গায়ত্রীর দ্বারা সেই কামিনীর কামরতি উত্তেজনা পূর্বক তাহার অধরামৃত মন্ত্র লইয়া, তাহার নয়ন রূপ নিধুবনে, বক্ষস্থল রূপ ভাণ্ডারী বনে, কুচস্বরূপ কুমুদবনে ইত্যাদি রতিলীলার সব কিছু তুলনামুলক বর্ণনা করিয়া—এইরূপ ধৰ্ম্ম আচরণে শ্রীকৃষ্ণকে পাওয়া যায় বলা হইয়াছে। ধর্মের মধ্যে দিয়াই যে তৎকালীন সমাজে ব্যভিচার প্রচলিত ছিল তাহার প্রমাণ উল্লিখিত সাধনপদ্ধতিসমূহ হইতে জানা যায়।

পূর্বোক্ত ভৈরবী-চক্রানুষ্ঠান ও সহজিয়া সাধন পদ্ধতি (কিশােরী ভজন নামে) গােপনে কিছুকাল পূর্বে পর্যন্ত নিম্নশ্রেণীর লােকদিগের মধ্যে অনুষ্ঠিত হইত। এতদ্ভিন্ন মুসলমান সম্রাটগণের আমলে বহুরূপ যৌন-ব্যভিচার সমাজের বুকে অনুষ্ঠিত হইত। ঐতিহাসিক্ত ব্যক্তিগণ তাদের রচিত গ্রন্থাদিতে সে সকলের অনেক নজির দেখাইয়াছেন।

 

চতুর্থ অধ্যায় যৌন ও তাহার কার্যাবলী

স্ত্রী-জননেন্দ্রিয় স্ত্রীজননযন্ত্র সমুহকে আমরা তিনভাগে বিভক্ত করিতে চাই।

১। বহিরাঙ্গ—ভগ (Vulva), কামাদ্রি (Monsveneries), ভগৌষ্ঠ (Labia) প্রভৃতি।

২। ভিতরাঙ্গ—যােনী (Vagina), জরায়ু (Uterus), ডিম্বকোষ (Ovaries) প্রভৃতি।

৩। উপাঙ্গন (Breasts বা Mammae)।

প্রথমতঃ বহিরাঙ্গগুলি লইয়া আলােচনা করিলে আমরা এই যন্ত্রগুলি দেখিতে পাই। যথা—ভগ (Vulva বা Prudendum), ভগাঙ্কুর (Clitories), বৃহৎ ভগৌষ্ঠদ্বয় (Labia majora), ক্ষুদ্র ভগৌষ্ঠদ্বয় (Labia minora), piaty (Monsveneris), atata (Female Urethra), সতীচ্ছদ (Hymen), যােনী (Vagina) প্রভৃতি।

দ্বিতীয়তঃ ভিতরাঙ্গের পরিচয় লইলে আমরা এইগুলিকে পাইজরায়ু (Uterus), ডিম্বকোষ (Ovaries), ডিম্ববাহী দুইটা নল (Fallopian tubes)।

তৃতীয়তঃ উপাঙ্গে আমরা পাই স্তনদ্বয় (Breasts বা Mammae) | এবং তাহার বৃন্তদ্বয় বা চুচুক (Nipple)।

এইবার ঐ সকল যন্ত্র সমূহের কার্যাবলীর বিষয় দেখিতে চাই।

(ক) কামাদ্রি (Monsveneries) ভগের উর্ধাংশকে বলা হয়। | যৌবনকালে স্ত্রীলােকের এই স্থান কেশাবৃত হইয়া থাকে। বস্তিকোটরস্থ (Pelvic) বিটপের ঠিক সম্মুখস্থ বা উপাের যে মেদপূর্ণ অংশ, উহাই কামাদ্রি নামে অভিহিত। পুরুষের যেমন লিঙ্গ পিঠ, স্ত্রীলােকের তেমনি কামাদ্রি-উভয়ই একই প্রকৃতির।

(খ) মদনছত্র বা উৰ্দ্ধসন্ধির ইংরাজী নাম Anterior Commissure, ইহা কামাদ্রির নিমে বৃহৎ ভগৌষ্ঠদ্বয়ের উদ্ধা মিলনস্থল।

গ) শিকিামণি বা মদনছত্রের ইংরাজী নাম Clitoris. উর্ধসন্ধির প্রায় অর্ধ-ইঞ্চি নিয়ে ইহা অবস্থিত। ইহা পুরুষের শিশ্নের ন্যায় উত্থানশীল তসমুহে গঠিত বলিয়া এবং অনেকটা পুরুষের শিশ্নের ন্যায় ক্ষুদ্রাকার বিশিষ্ট বলিয়া ইহার নাম শিশ্নিকা। স্ত্রীলােকের প্রতিক্ষুধা জাগাইবার ও ইন্দ্রিয়তৃপ্তি লাভের ইহা একটী প্রধান যন্ত্র বিশেষ। দৈর্ঘ্যে ইহার আকার প্রায় ১•” ইঞ্চির কম নহে, কিন্তু ইহার অধিকাংশই উৰ্ধসন্ধির ভিতর দেশে অবস্থান করে ও ভগপক্ষ বা ক্ষুদ্র ভগৌষ্ঠ (Nymphae বা Labia minora) দ্বারা আবৃত থাকে বলিয়া ইহার ক্ষুদ্র মুণ্ডটুকুই মাত্র পরিদৃষ্ট হইয়া থাকে। উত্তেজনা প্রাপ্ত হইয়া ইহা পুরুষের শিশ্নের ন্যায় উজ্জিত হইয়া উঠে।

(ঘ) বৃহৎ ভগৌষ্ঠদ্বয় (Labia majora) যােনীর বহির্দেশে দুই পার্শ্বে অবস্থিত সুকোমল স্কুল দুইটা ঠোটের ন্যায় পদার্থ। ইহার ভিতরাংশ শ্লৈষ্মিক ঝিল্লিদ্বারা আবৃত। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় এই বহিৰােষ্ঠদ্বয় বালিকা বয়সে পরস্পর সংলগ্ন অবস্থায় থাকে, কিন্তু পরে দুইটা পৃথক হইয়া যায়। ইহারা কামাদ্রির নিদেশ হইতে আরম্ভ হইয়া ক্রমান্বয়ে মলদ্বারের সম্মুখভাগ পর্যন্ত অর্থাৎ যে স্থানের নাম মুলাধার পীঠ (Perineum) সেই স্থান পর্যন্ত নামিয়া দুই মুখ একত্র হইয়াছে। এই মিলিত সন্ধিস্থলকে নিসন্ধি (Posterior commissure) কহে। নিম সন্ধিস্থলটি উদ্ধসন্ধিস্থল হইতে অনেকাংশে ক্ষীণ। এই বৃহৎ ভগৌষ্ঠদ্বয়ের উপরিভাগে যৌবনকালে অল্প অল্প কেশােদগম হইতে দেখা যায়। এক একটা দৈর্ঘ্যে প্রায় ৩ইঞ্চির কম নহে।

(ঙ) মুত্ররন্ধ্র (Female Urethra)। ইহা ভগাঙ্কুরের প্রায় এক ইঞ্চি নিয়ে অবস্থিত ও দৈর্ঘ্যে ইহার গভীরতা প্রায় দেড় ইঞ্চি হইবে। মুত্রর মুখ বা প্রস্রাবদ্বারের (Meatus urinaris) ব্যাস প্রায় } ইঞ্চির কম নহে।

(চ) ক্ষুদ্র ভগৌষ্ঠদ্বয় (Labia minora)—বৃহৎ ভগৌষ্ঠদ্বয়ের ভিতরেই এই ক্ষুদ্র ভগৌষ্ঠদ্বয় অবস্থিত এবং কোমল শ্লৈষ্মিক ঝিল্লিরা আবৃত। ইহারা দৈর্ঘ্যে প্রায় ১” ইঞ্চির মত হয়। ইহাদের পশ্চাৎভাগ বৃহৎ ভগৌষ্ঠদ্বয়ের সহিত মিশিয়া গিয়াছে । ভগাঙ্কুরের নিকট আসিয়া ইহারা দুইভাগে বিভক্ত হইয়া পড়িয়াছে। ইহারাই ভগাঙ্কুরকে আবৃত রাখে বলিয়া ইহাদিগকে ভগপুচ্ছ বলা হয়।

(ছ) সতীচ্ছদ (Hymen)—ইহা প্রত্যাবারের নিয়ে ও যােনীদ্বারের উপরের একখানি পাতলা পর্দা বিশেষ। ইহা কুমারী মেয়েদের যােনীমুখ ঢাকিয়া রাখে—পর্দার ঠিক মাঝখানটায় একটা ক্ষুদ্র ছিদ্র থাকে যাহাতে কেবলমাত্র অঙ্গুলীর অগ্রভাগ প্রবেশ করানাে যাইতে পারে। স্ত্রীলােক পুরুষ-সংসৰ্গা হইলেই ইহা ছিড়িয়া যায়। এতকাল ইহার দ্বারা শ্রীলােকের অক্ষতযােনিত্ব বা সতীত্ব প্রমাণের নজির হিসাবে ইহাকে এই নাম প্রদান করা হইয়াছে। কিন্তু বর্তমানে চিকিৎসকদের গবেষণার ফলে এই সত্য প্রকটিত হইয়াছে যে, সকল ক্ষেত্রে এই নলির মালা চলে না। কারণ অনেক সময় সঙ্গমান্তেও অনেকানেক নারীর ইহা বর্তমান থাকিতে দেখা যায়। আবার সঙ্গমহীনা অনেক বালিকার কোন শক্ত অসুখ বিসুখ কিংবা দৌড়ঝাপ প্রভৃতির দরুণ এই চ্ছদ আপনা হইতেই ছিড়িয়া যায়। কাহারাে কাহারাে জন্মাবধি সতীচ্ছদ থাকে না। কাহারাে কাহারে। এই চ্ছদ এত শক্ত হয় যে, অন্ত্র না করিলে পুরুষ সঙ্গম করিতে পারে না।

(জ) যােনীর ও যােনীর (orifice of vagina ও vagina): মুত্ররন্ধ্রের পরই যােনীদ্বার অবস্থিত। যােনীদ্বার বৃহৎ ভগৌষ্ঠদ্বয়ের দ্বারা কথঞ্চিৎ আবৃত থাকে। যােনী একটা বক্রগামী গহ্বর বিশেষ এবং ইহার গভীরতা ৫-৬ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য। ইহা ভিতরে জরায়ু পৰ্য্যন্ত বিস্তৃত। পক্ষান্তরে জরায়ু হইতে আরম্ভ হইয়া ভগ পর্যন্ত উন্মুক্ত রহিয়াছে। যােনীর রন্ধ্র প্রদেশ শ্লৈষ্মিক বিল্লিদ্বারা আবৃত। যােনীর ঠিক পশ্চাতে সরলা বা মলদ্বার ও বিটপ (পেরিনিয়াম) অবস্থিত। মােনীপথ ভগৌষ্ঠের নিকট সঙ্কীর্ণ, কিন্তু যতই ভিতরে অর্থাৎ জরায়ুর নিকটবর্তী হইয়াছে ততই বিস্তৃত। জরায়ুর নিকট ইহা অতিমাত্রায় প্রসারিত। যােনী সম্প্রসারণশীল ও উত্থানশীল তন্তু (erectile tissue) দ্বারা গঠিত। উহা এমনভাবে তৈয়ারী যে, আবশ্যক হইলে উহা আয়তনে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইয়া থাকে। সঙ্গমকালে সমস্ত পেনিসটী উহার মধ্যে প্রবিষ্ট হইতে পারে এবং পেনিসের অতি দৈর্ঘ্যকার চেহারা হইলেও উহা আয়তনে বৃদ্ধি পাইয়া সমগ্র পেনিসটীকে নিজের মধ্যে গ্রহণ করিতে সক্ষম হয়। যােনী গহ্বরের উর্ষভাগে মুত্রস্থলি (bladder) স্থাপিত রহিয়াছে। ‘

দ্বিতীয়তঃ ভিতঙ্গগুলির মধ্যে যােনীগহ্বরের পরই জরায়ু (uterus) অবস্থিত। ইহা কলসীর ন্যায় উপুর-করা একটা শূন্যগর্ভ থলি বিশেষ যাহাতে সন্তান অবস্থান করে। এই জরায়ু মন্তকের দুই পা হইতে দুইটী করিয়া নালী বাহির হইয়া প্রায় ৪” ইঞ্চি করিয়া দূরে অবস্থিত ও প্রায় ১০” দীর্ঘ দুইটা পাটলবর্ণ ডিম্বের ন্যায় পদার্থের সহিত সংযুক্ত হইয়া আছে। এই নালী দুইটীকে ইংরাজীতে Fallopion tubes বা বাংলাতে ডিম্ববাহীনল এবং ঐ ডিম্বাকৃতি জিনিষ দুইটীকে বলে ডিম্বকোষ বা Ovaries.

(ক) জরায়ু (uterus)। আকারে একটা ক্ষুদ্র উপুর রাখা কলসীর মত এবং ইহার সম্মুখ ও পশ্চাৎ অংশ কিঞ্চিৎ চাপা বা চ্যাপ্টাকৃতি কিন্তু ফাপা। সাধারণ অবস্থায় কুমারী মেয়েদের জরায়ু ১০ ইঞ্চির মত হইয়া থাকে। কিন্তু স্ত্রীলােক একবার সন্তান ধারণ করিলেই ইহার দৈর্ঘ্য ৩” ইঞ্চি এবং প্রস্থ ২” ইঞ্চির মত হইয়া থাকে। আর স্থূলতায় ১” এবং নিম্নাংশ ২ ইঞ্চির মত হয়। ইহা বস্থিকোটরের মাঝে স্থাপিত রহিয়া যােনী কর্তৃক আলম্বিত হইয়া রহিয়াছে। জরায়ুর উৰ্দ্ধভাগে মূত্রস্থলি ও নিম্নভাগে মলাধার স্থাপিত ও মধ্যে জরায়ু অবস্থান করিতেছে। জয়ায়ুর ভিতরটা ফাঁপা হইলেও উহা ত্রিকোণাকৃতি এবং এই ত্রিকোণাকৃতি ফাপা স্থানটায়ই গর্ভ হইয়া থাকে। জরায়ুর প্রধান কাৰ্য্য জ্বণকে ধারণ করা এবং ইহা অতিশয় সম্প্রসারণশীল। সন্তান বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইহা বর্ধিত হয় এবং তখন ইহা বস্তিকোটর ছাড়াইয়া উদ্ধ উদরের অধিকাংশ স্থান ছাইয়া ফেলে কিন্তু পুনরায় সন্তান প্রসবান্তে ইহা স্বাভাবিক অবস্থা প্রাপ্ত হয়। প্রসবান্তে জরায়ু যখন ক্রমান্বয়ে সঙ্কুচিত হইতে থাকে তখন একটা বেদনা হয় যাহাকে চলিত কথায় ‘হেতাল ব্যথা বলিয়া অভিহীত করা হয় অর্থাৎ ইংরাজীতে যাহাকে বলে after pair. জরায়ুর উদ্ধাদেশকে জরায়ু মস্তক (Fundus) আর নিম্নদেশকে বলা হয় জরায়ু দেহ (Body). যােনীর ভিতর দিয়া যে চুলো জিনিষটা হাতে ঠেকে উহা জরায়ুর মুখ (Os বা পুরা নাম Os-uteri externum).

তাহার পর ইহার গ্রীবদেশ বা জরায়ুর বা(Neck Cervix)। রায়ুর গ্রীবাদেশ বেষ্টন করিয়াই যােনীপথে আরম্ভ। জরায়ুর মুখে ক্ষুদ্র ক্ষ আছে। সেই পথ দিয়াই পুরুষসঙ্গম সময়ে অনেক সময় শুক্রমধ্যস্থ কীটাণু জরায়ু গহ্বরে নীত হয়।

(খ) ডিবাহীনল (Fallopian tubes)। জরায়ুর উর্ধাংশে এই নলীয় উৎপন্ন হইয়া কিঞ্চিৎ বক্রভাবে ডিম্বকোষম্বর পর্যন্ত বিস্তৃত রহিয়াছে। ইহার এক একটা নল দৈর্ঘ্যে ৩-৪ ইঞ্চি এবং ইহার ভিতরাংশ ফাঁপা ও নলের শেষাংশ অর্থাৎ যাহা ডিম্বকোষের উপরে অবস্থান করিতেছে—ঐ স্থান ঝালরের ন্যায় রূপ বিশিষ্ট

(গ) ডিম্বকোষদ্বয় (Ovaries)। জরায়ুর দুই পার্শ্বে প্রশস্ত বন্ধনীদ্বয়ের পশ্চাৎ ভাঁজে দুইটা ডিম্বকোষ সংস্থাপিত। এই দুইটা দেখিতে ডিম্বের ন্যায় ও ঈষৎ পাটলবর্ণ। প্রত্যেক অণ্ডাধার প্রায় ২” দীর্ঘ ও + ইঞ্চি চওড়া ২ ইঞ্চি পুরু। ঋতুকালে ইহাদের আয়তন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইয়া থাকে। গর্ভাবস্থায় ইহারা প্রায় দ্বিগুণ আকৃতি প্রাপ্ত হয়। ডিম্বকোষদ্বয়ের মধ্যেই স্ত্রীবীৰ্য্যাণ (Ovam) উৎপন্ন হইয়া থাকে। পুরুষের যেমন অণ্ডকোষ, তেমনি স্ত্রীলােকের এই ডিম্বকোষ একই বস্তু। ইহাদের অন্তর্ভাগও অসংখ্য কোটরবিশিষ্ট। যৌন সময়ে এই সকল কোটরে স্ত্রীবাণু উৎপন্ন ও পরিপক্ক হইয়া থাকে। তাহা ছাড়া উহা হইতে এক প্রকার রসও নির্গত হইয়া এই সকল Ova বা শ্ৰীবীৰ্যাণুর সহিত মিশ্রিত হয়। এই সকল ডিম্বাণু (Ova) পরিপক্ক হইলে ডিকোষ ফাটিয়া যাইয়া কয়েকটা ডিম্বাণু উহা হইতে ছিটকাইয়া উঠে এবং ডিম্ববাহী নলীর সেই খালবিশিষ্ট মুখে স্বতঃ আকৃষ্ট হইয়া উহাতে প্রবেশ করতঃ জরায়ু গরে নীত হয়। তখনই স্ত্রীলােকগণ ঋতুমতী (Menstruation) হইয়া থাকে। খ্রীলােক ঋতুমতী হওয়ার পর প্রায় ১৬ দিন পর্যন্ত ঐ সকল পরিপক্ক ডিম্বাণু সজীব অবস্থায় বিরাজ করে। স্বীবীৰ্যানু গােলাকার আকৃতি বিশিষ্ট। ইহা অণুবীক্ষণ যন্ত্র ব্যতীত দেখা যায় না।

ঐ সময় মধ্যে স্ত্রীলােক পুরুষ-সংসৰ্গা হইলে পুং-বীৰ্য্য জরায়ু মুখে প্রক্ষিপ্ত হয় এবং শুক্রকীট উহার ভিতরে প্রবেশ করে; অতঃপর জরায়ুর মুখে স্ত্রীবীর্যের সহিত মিলিত হইলেই তৎক্ষণাৎ উহা জরায়ু গহবরে চলিয়া আসে—সাধারণতঃ ইহাকেই গর্ভ হওয়া বলে। সুস্থ পুরুষ এক বারে যে বীৰ্য্য ত্যাগ করে তাহাতে ১০,০০০০ পর্যন্ত শুক্রকীট বিদ্যমান থাকিতে দেখা যায় এবং ইহার একটীমাত্র কীটাণু স্ত্রী-ডিম্বাণুর সহিত মিশ্রিত হইয়া সন্তান উৎপাদন করিতে সক্ষম।

তৃতীয়তঃ উপাঙ্গ বা স্তনদ্বয় (Breasts)। যদিও স্তনযুগল। জননেন্দ্রিয়ের অন্তর্গত নহে তথাপি জননযন্ত্র সমূহের সহিত ইহার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রহিয়াছে। স্তনদ্বয় অর্ধ গােলাকার আকৃতি বিশিষ্ট এবং উদ্ধভাগে বর্তুলাকার দুইটী পদার্থ বিদ্যমান—উহাকে চুচুক ( Nipple) বা স্তনের বোটা বলা হয়। স্তনদ্বয় বক্ষের দুই পার্শ্বে সাধারণতঃ ৩য়, ৪র্থ, ৫ম ও ৬ষ্ঠ পঞ্জরাস্থি আবরণ করিয়াও উৎপন্ন হয়। এই কারণে স্ত্রীলােকের স্তনের আকার নানাপ্রকার হইয়া থাকে। ইহাদের অভ্যন্তর ভাগে অগণ্য দুগ্ধ নিঃসারক গ্রন্থি বিদ্যমান রহিয়াছে। যৌবনের প্রারম্ভে স্তনদ্বয় কঠিন ও ক্ষুদ্র থাকে ও চুচুকদ্বয় ক্ষুদ্র গাঢ়লাল রংযুক্ত দেখা যায় ও বয়ােবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উহাদের আকৃতি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। গর্ভাবস্থায় উহা অতিশয় উন্নত ও স্থূল হয় এবং পরিমণ্ডলের (aneola) আয়তন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইয়া থাকে। চলিত কথায় ইহাকে ভেলাপড়া বলে। প্রসবের পূর্ব হইতে আরম্ভ করিয়া প্রসবান্তে প্রায় শতকরা ৯৬ ক্ষেত্রে স্ত্রীলােকের স্তনদ্বয় শিথিলতা প্রাপ্ত হইয়া কাহারাে অনধিক, কাহারাে বা অল্প নত হইয়া পড়ে।

প্রজনন রীতি

এ সম্পর্কে প্রথম অধ্যায় অন্তর্গত সৃষ্টিকাৰ্য্যে নর ও নারী অণুঅধ্যায়ে ইঙ্গিত করা হইয়াছে। তাহা ছাড়া খানিক আগে স্ত্রী-জননেন্দ্রিয় পরিচয়ের মধ্যেও গর্ভপ্রকরণ সম্পর্কে কিছু বলা হইয়াছে। তথাপি এইখানে একটু বিষদভাবে এ বিষয়ে বলা প্রয়ােজন।

পূর্বোক্ত আলােচনাদি হইতে একথা বুঝা কঠিন হয় নাই যে, পুংলীৰ্যাণু স্ত্রী-অণ্ডাণুর সহিত মিলিত হইয়া গর্ভমধ্যে ভ্রুণের সঞ্চার করিয়া থাকে। কিন্তু স্ত্রীসহবাস করিলে প্রতি সহবাসেই যে গর্ভ হয়, তাহা নহে। স্ত্রীসহবাস করিলেই পুরুষের রেতঃ ঋলিত হইয়া থাকে এবং ঐ বীর্যে অসংখ্য শুক্রকীটসকল বর্তমান থাকিতে দেখা যায়, কিন্তু নারীদের বেলায় সঙ্গম সময়ে অতি অল্পসংখ্যক অণ্ডাণুই নির্গত হইয়া থাকে—তাহাও মাসিক ঋতু প্রকাশ পাইবার অষ্টম হইতে দ্বাদশ দিবস পর্যন্ত সতেজ ও কার্যক্ষম থাকে। প্রতি মাসে ঋতুকালীন নারীগণের অণ্ডকোষ (ovary) হইতে ৩:৪টীর অধিক অণ্ডাণু কখনও বাহির হয় না। সাধারণতঃ সম্ভোগ সময়ে রমণীগণের যােনিপ্রদেশে যে রস উত্থিত হয় তাহা রমণক্রিয়াকে সহজ করিয়া দিবার জন্য যােনিপ্রদেশ পিচ্ছিল করিয়া দেয় মাত্র। সঙ্গম সময় ব্যতিরেকেও সৰ্বসময়েই অতি ক্ষীণভাবে রমণীগণের যােনিপ্রদেশে এই রস নিঃসৃত হইয়া থাকে। এই রসের মধ্যে, সঙ্গম সময় ব্যতিরেকে যে রস নিঃসৃত হইতে থাকে তাহা যােনিপ্রদেশে অবস্থিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচ্ছন্ন গ্রন্থনিচয় হইতেই নিঃসৃত হয়, কিন্তু সঙ্গমকালীন রতিক্রিয়ার চরম অবস্থায় আবার ঐসকল নিঃস্রাব ছাড়াও জরায়ুমুখ হইতে আর একপ্রকার ঘনতর রস নিঃসৃত হইয়া থাকে। এই উভয়প্রকার রসই কিন্তু অণ্ডাশুশুন্য ; কাজেই গর্ভসঞ্চারে ইহাদের কোনই সার্থকতা থাকিতে পারে না। অতএব বিশেষ অনুকূল অবস্থা ব্যতিরেকে কখনও গর্ত হওয়া সম্ভব সম্ভোগ সময়ে পুরুষের বীৰ্য্য অলিত হইয়া সবেগে নারীর যনিপ্রদেশে পতিত হয়। খুব বেগে বীর্যপাত ঘটিলে উহা স্ত্রীযােনি অভ্যন্তরে জরায়ু গ্রীবায় গিয়া লাগে, তখন পুংবীৰ্য্যস্থ কীটাণু স্বকীয় চলৎশক্তি বলে তাড়িত হইয়া ক্রমে জরায়ুগহ্বরে প্রবিষ্ট হইয়া স্ত্রী-অণ্ডাণুর সহিত মিলিত হইলেই গর্ভাধান হইতে পারে। ইহা ছাড়া কখনও কখনও রমণীগণের প্রবল কাম-উদ্দীপনার ফলে সমকালীন তাহাদের জরায়ুমুখ বিশেষভাবে প্রসারিত হইয়া পড়ে, ফলে জরায়ুগ্রীবা পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগ আঁকড়াইয়া ধরে ও শুক্র ঋলিত হইয়া সরাসরি জরায়ুগঘরমুখে পতিত হয় এবং জরায়ুমধ্যে স্ত্রীবীজ বা অণ্ডাণু থাকিলে উহার সহিত মিলিত হইয়া অতি সহজেই গর্ভাধানসম্ভব ক্রিয়া সাধিত হয়। দ্বিতীয় প্রকার গর্ভপ্রকরণ ক্রিয়া অনেক সময় স্বামী, বিশেষ করিয়া স্ত্রী অনেক সময়ই বুঝিতে পারেন। কারণ এইপ্রকার জরায়ুগ্রীবা দ্বারা পুংজননেন্দ্রিয় আঁকড়ানাে অবস্থায় সঙ্গমকালে পুরুষের সুখানুভূতি যেমন প্রবলতর হয়, তেমনি নারীর উত্তেজনাও চরম সুখাবহ হইয়া উঠে এবং ইহার ফল অনেক নারী সেই রাত্রিতেই বুঝিতে পারেন।

যে সকল পুরুষের উথিত পুরুষাঙ্গ পাঁচ ইঞ্চিরও অধিক দীর্ঘ হয় ও যাহাদের পত্নীগণ অধিক কামাতুরা, তাহারা সাধারণতঃ এইভাবে সরাসরি জরায়ুর মুখের ভিতরই বীর্যপাত করিয়া গর্ভাধান সম্পন্ন করেন। এই প্রকার গর্ভাধানকে বিশেষ গর্ভাধান নামে অভিহিত করা হয়। কিন্তু প্রথমােক্ত প্রণালীতে অর্থাৎ জরায়ুগ্রীবায় শুক্র পতিত হইয়া শুক্রকীট যেরূপে জরায়ুগঞ্জে প্রবেশ করিয়া গর্ভাধান করিয়া থাকে উহাকে সামান্য গর্ভাধান বলে।

সপ্তম অধ্যায়

যৌনসঙ্গম ও যৌনতৃপ্তি

যৌনসঙ্গমের দ্বারা প্রকৃত যৌনতৃপ্তি অনেক দম্পতিই লাভ করেন না। ইহা লাভ না করিবার মুলে প্রধানতঃ দেখা যায় যৌনকলাজ্ঞানের অভাব। তাহা ছাড়া, যৌন-প্রতিযােগিতা, অত্যুগ্র যৌনক্ষুধা, ইন্দ্রিয়শক্তির অভাব কিংবা শারীরিক অসুস্থতা ও অযােগ্য মিলন প্রভৃতিও প্রকৃত যৌনতৃপ্তি লাভের অন্তরায় হইয়া থাকে। রমণীর রাগসঞ্চার করিবার সঙ্কেতাদি ও রাগলক্ষণাদি চিনিবার ক্ষমতা যে সকল পুরুষ অর্জন না করিয়াছেন, তাহারা কোনদিনই প্রকৃত যৌনতৃপ্তি লাভে সক্ষম হইতে পারিবেন না ও স্ত্রীকেও এই আনন্দ হইতে বঞ্চিত রাখিবেন। তদুপরি স্বামী-স্ত্রী উভয়ের চরমানন্দ (orgasm) একই সময়ে না আনিতে পারিলেও অনেক সময় যৌনতৃপ্তি লাভ করা সম্ভব হইয়া উঠে না। কেবলমাত্র লালসা নিবৃত্তি করিতেই যাহারা যৌন সঙ্গমে রত হন ও কোন প্রকার যৌননীতি না মানিয়া অবিরত সঙ্গমে মাতেন, তাহারাও প্রকৃত যৌনতৃপ্তি কাহাকে বলে তাহা জানিতে পারেন না। | পুরুষের কামলালসা যেমন অতি সহজেই জাগ্রত হয়, তেমনি সহজেই শুক্ৰস্থলনের দ্বারা উহাতে তৃপ্তও হয়। কিন্তু রমণীর পক্ষে উহা হওয়া সম্ভব নহে। পুরুষের কামকেন্দ্র কেবলমাত্র জনন অঙ্গের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কাজেই কামনার সকল অনুভূতি তাহার জনন অঙ্গেই কেন্দ্রীভূত হইয়া থাকে, তাই কেবল জনযন্ত্রের পরিচালনায়ই পুরুষ কাম-পরিতৃপ্তি লাভ করে। কিন্তু রমণীর কামকেন্দ্র কেবলমাত্র জনন অঙ্গেই সীমাবদ্ধ নহে। যদিও কামকেই উহার প্রধান কেন্দ্রস্থল, তথাপি রমণী তাহার সর্বাঙ্গ ব্যাপিয়াই অল্প বিস্তরভাবে কামনার অনুভূতি উপলব্ধি করিয়া থাকেন। স্তনবৃন্তু, গণ্ডমুল, ওষ্ঠ ও জিহ্বায় রমণীগণ অপেক্ষাকৃত নিবিড়ভাবে কামাবেশ উপলদ্ধি করেন। তাই রমণর যৌনলালসা যেমন ধীরে ধীরে জাগ্রত হয় তেমনি ধীরে ধীরেই উহা চরমানন্দের পথে অগ্রসর হইয়া থাকে। কিন্তু স্বামী যদি সঙ্গমের মধ্যপথেই শুক্ৰস্থলনের দ্বারা নিজের তৃপ্তি লাভ করতঃ সঙ্গম-বিরতি করেন, তাহাতে স্ত্রীর পক্ষে তৃপ্তিলাভ করাত সম্ভব হয়ই না, উপরন্তু বুভুক্ষু হৃদয়ে অতৃপ্তবাসনা ধীরে ধীরে দিনের পর দিন তাহার মনের কোণে সঞ্চিত হইতে থাকে। ইহার ফলে এক সময় সে ৰিবিধ স্নায়ুরােগগ্রস্ত হইয়া পড়ে।

যৌনসঙ্গমের দ্বারা স্বামী-স্ত্রী উভয়ের একই সময়ে চরমানন্দ লাভ করিবার ফলে যে সমস্ত সুকুমার বৃত্তি বিকাশ প্রাপ্ত হইবার সম্ভাবনা ছিল এবং উহার ফলে প্রেমকুম পরিপূর্ণরূপে বিকশিত হইয়া উঠিত, অজ্ঞ স্বামীর ঐ প্রকারের সমতাবিহীন যৌনসঙ্গমে ও স্বার্থপরতায় উহার অপমৃত্যু ঘটে। অনেক স্বামীই স্ত্রীর যৌনজীবনের এই বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞ ও উদাসীন। এই কারণেই যৌনমিলনে অনেক নারীকেই একবারে নিষ্ক্রিয়, নির্লিপ্ত ও অতৃপ্ত থাকিতে দেখা যায়। পুরুষের এই অজ্ঞতা ও স্বার্থপরতায় বহু নারীকেই চিরজীবনব্যাপী কামপরিতৃপ্তি-ব্যর্থতা জনিত দুঃখ ভােগ করিতে হয়। যার ফলে স্বামীর প্রতি স্ত্রীর স্বাভাবিক আকর্ষণ এবং দাম্পত্য-জীবনের প্রকৃত সুখ-শান্তি ও মাধুৰ্য ক্রমশঃ লােপ পাইতে থাকে।

রতিশয়নে স্বামীর উচিত প্রথমেই স্ত্রীর রাগসঞ্চার করা এইজন্যই আমাদের প্রাচীন যৌনকলাবিদগণ তাহাদের গ্রন্থনিচয়ে ৬৪ প্রকার শৃঙ্গারের উল্লেখ করিয়াছেন এই শৃঙ্গার বা রমণােপাচারের দ্বারা অগ্রে স্বীর-কাম জাগ্রত না করিয়া সঙ্গমে রত হইলে প্রকৃত যৌনতৃপ্তি লাভ করাত সম্ভব নহেই; উপরন্তু ইহা হৃদয়হীন কাৰ্য্য বলিয়াই গণ্য

প্রত্যেক স্বামীর স্মরণ রাখা কর্তব্য, রতিশয়নে স্ত্রীকে পরিপূর্ণভাবে কামপরিতৃপ্ত করিতে হইলে যৌনমিলনে রত হইবার পূর্বে চুম্বন, দংশন, আলিঙ্গনাদি বিবিধ উপচারে স্ত্রীর দেহ-মনে রতিরাগ বিশেষভাবে জাগ্রত করিয়া তাহার পর মূল-সহবাসে রত হইতে হইবে।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, পশুজীবনেও যাহা সহজ সুলভ দেখা যায়, তাহা অনেক শিক্ষিত মানুষের জীবনেও পরিলক্ষিত হয় না। প্রাণিগণের যৌনসম্মিলন লক্ষ্য করিলে আমরা দেখিতে পাই, মুলসহবাসরত হইবার পূর্বে পুরুষ অনেকক্ষণ ধরিয়া লক্ষন, ঝম্পন, লেহন, দংশন ও আলিঙ্গনাদির দ্বারা স্ত্রীর অন্তরে রতিরাগ সঞ্চারের জন্য কি চেষ্টাই না করিয়া থাকে! তথাপি স্ত্রী সহজেই পুরুষের নিকট ধরা দিতে চাহে না, সে ছুটিয়া কেবল পলাইতে চায়; পুরুষ প্রাণিটা তাহাকে আয়ত্বে আনিবার জন্য তাহার পশ্চাৎধাবন করে। এই সকল ক্রীড়ায় উভয়ের রতিরাগ ক্রমেই বর্ধিত হইতে থাকে। তারপর যখন স্ত্রীর রতিসম্মতির লক্ষণ প্রকাশ পায়, তখন উভয়ে মূল সহবাসে রত হইয়া থাকে। পক্ষী-জীবনেও ইহার ব্যতিক্রম দেখা যায় না। অথচ অনেক জ্ঞান-বিবেকশীল মানুষের জীবনে ইহার ব্যতিক্রম ঘটে।

রতিশয়নে সামান্য উত্তেজনা পুরুষকে যেমন প্রবলভাবে কামােত্তপ্ত করিয়া তােলে তেমনি নারীকে পরিপূর্ণরূপে কামােদ্দীপ্ত করিয়া তুলিতে অনেক যৌন-উপচারের প্রয়োজন হয় এবং সে কাৰ্য পুরুষেরই করা প্রয়ােজন। রতিশয়নে পুরুষ স্বভাবতঃ সক্রিয় ও নারী স্বভাবতঃ নিষ্ক্রিয় থাকে। কাজেই সক্রিয় অংশীদার নিষ্ক্রিয়কে জাগ্রত করিয়া না তুলিলে প্রকৃত যৌনতৃপ্তি লাভ করা কখনই সম্ভব হইয়া উঠিবে না। পুরুষ কেবলমাত্র যৌনাঙ্গের পরিচালনায়ই পরিতৃপ্ত হইতে পারে, কিন্তু নারী তাহা পারেনা। তাই পৃথিবীর অন্যতম যৌনকলাবিদ ডাঃ মেরী কারমাইকেল ষ্টোপস্ তাহার জগৎপ্রসিদ্ধ ‘Married Love’ গ্রন্থে রতিশয়ানের পূর্বে প্রতি স্বামীকেই এই বিষয়ে সচেতন করিয়া দিতেছেন, ‘স্মরণ রাখিও প্রতি সম্ভোগকালেই কোমলভাবে পত্নীর অন্তরে প্রণয়সঞ্চার দ্বারা তাহাকে যৌনকার্যে প্রবৃত্ত করাইতে হইবে। সম্ভোগবৃত্তির জন্য পত্নীর দেহ-মন একান্ত উন্মুখ না হইলে যৌনমিলন সঙ্গত নহে।•••••• প্রত্যেক সহবাসের পূর্বে পত্নীর অন্তরে রাগসঞ্চার কবা স্বামীর একান্ত কর্তব্য কাৰ্য।•••

সহবাসরত হইবার পূর্বে রমণােপাচারেব দ্বারা স্ত্রীকে প্রবলভাবে কামােদীপ্তা করিয়া লইতে পারিলে স্ত্রী অপেক্ষাকৃত অল্প সময়ে অতিপরিতৃপ্ত হইয়া থাকে এবং তাহাতে পরস্পরের রতিসাম্যতা বা চরমানন্দলাভ সহজসাধ্য হয়। যৌন উপচারের দ্বারা রমণীর বিভিন্ন শাখা কামকেন্দ্রগুলি উত্তেজিত হইলে যেমন প্রবলভাবে কামােদীপ্তা হয়, তেমনি নিবিড যৌন-আনন্দও উপভােগ করে এবং তীব্র কামােদ্দীপনার সময় নারীর যৌনাঙ্গ হইতে যে একপ্রকার রস নিঃসৃত হয় তাহা যােনিপ্রদেশ সিক্ত ও পিচ্ছিল করিয়া দেওয়ায় উহা সম্ভোগকাৰ্য্যকে বিশেষ সহায়তা করে।

রমণীকে উপচার দ্বারা সক্রিয় করিয়া তুলিতে পারিলে রমণীও স্বভাবতঃ উহার প্রতিদান দিয়া থাকে। রতি-ক্রীড়ায় নারী পুরুষের সহিত সমান অংশ গ্রহণ না করিলে পুরুষও তৃপ্ত হইতে পারে না। পুরুষের যৌন উপচার যেরূপ নারীর দেহে-মনে অপূর্ব পুলক ও আনন্দসঞ্চার করে, তেমনি নারীর পক্ষ হইতে তাহার প্রতিদানে পুরুষের দেহ-মনেও ঘন আনন্দের সৃষ্টি করে। কাজেই স্বামীর যেমন কর্তব্য স্ত্রীর রাগসঞ্চার করিয়া সহবাসে নিযুক্ত হওয়া, তেমনি খ্রীয় কর্তব্য রতিক্রীড়ার সময়ে উদাসীন না থাকিয়া সক্রিয়-সচেতন হওয়া।

ডাঃ জোচিয়া নির্দেশ করিয়াছেন যে, পত্নীর ভাবলক্ষণের উপর পতির লক্ষ্য থাকা উচিত। তিনি বলিতেছেন, রমণীগণের ভাবসঞ্চার হইলে তাহারা স্বামীকে অতিরিক্ত প্রশংসা করে এবং সােহাগ আদর করে ; শরীরের কোন কোন অঙ্গ হইতে যেন অনবধানতা বশতঃই গাত্রাবরণ উন্মোচন করিয়া ফেলে; তাহাদের স্তন স্ফীত বােধ হয় ; তাহার অত্যন্ত উৎফুল্ল হয় ; তাহাদের মুখমণ্ডল ক্ষণে ক্ষণে রাগরঞ্জিত হয় ও চক্ষু উজ্জ্বল দেখায় এবং অত্যন্ত রাগসঞ্চার হইলে তাহাদের কণ্ঠ ভার হয়, স্বর কম্পিত ও গদগদ হয়, অসংলগ্ন কথাবার্তা বলে এবং নিজেকে আত্মবশে রাখিতে পারে না। স্বামী যতই অনবধান হউক না কেন, এই সকল লক্ষণ দ্বারা সে নিশ্চিত বুঝিতে পারে যে তাহার স্ত্রীর রাগসঞ্চার হইয়াছে।

গাইয়ট বলেন: “রমণীর রাগসঞ্চার হইলে তাহার অধরােষ্ঠ দৃঢ় হয় এবং ঈষৎ কম্পিত হইতে থাকে, স্তন স্ফীত হয় এবং স্তনবৃন্ত উচ্ছিত হয়। স্বামী সুচতুর হইলে ঐ সকল লক্ষণ দেখিয়া কদাচ তুল বুঝিবেন না। যদি এ সকল লক্ষণ উপস্থিত না থাকে, তবে আদর ও সােহাগদ্বারা স্বামীর ঐ সকল লক্ষণ আনয়ন করা কর্তব্য। যদি বিবিধ যৌনােপচারেও রমণীর ঐ লক্ষণগুলি উপস্থিত না হয়, তবে পুরুষ নিজের অভিলাষ দমন করিবে।” রমণীর রাগ সঞ্চার হইলে ঘন ঘন নিঃশ্বাস বহে, গাত্র ঈষৎ উষ্ণ হয় এবং কণ্ঠ শুষ্ক হইয়া থাকে। কখনাে পদাঙ্গুলির কম্পন ও অধরে ঈষৎ হাসির ভাব পরিলক্ষিত হইয়া থাকে। কোন কোন রমণী স্বামীর গাত্র-সংলগ্ন হইতে ভালবাসে এবং কোন কোন অঙ্গ স্বামীর দেহের উপর ন্যস্ত করে ও স্ত্রী যেন আত্মসমর্পণ করিতে ইচ্ছুক হয়। অবশ্য এই সমুদয় লক্ষণই সকল রমণীতে লক্ষিত হয় না; তবে ইহার মধ্যে কোন কোন ভাব উপস্থিত হইলেই বুঝিতে হইবে যে রমণীর রাগসঞ্চার হইয়াছে।

এ সম্পর্কে মহর্ষি বাৎসায়ন বলিয়াছেন: “প্রতি আসন্নপ্রায় হইলে নারীর ব্রীড়া অপনীত হয় এবং সে দৃঢ়ভাবে স্বামী-সংলগা হয়; প্রীতি প্রাপ্ত হইলে তাহার শরীর শিথিল হয় ও চক্ষু মুদ্রিত হইয়া আসে।”

পরস্পর বিরােধীভাবের একত্র সমাবেশ নারীর অপর একটা বিশেষত্ব। সম্প্রয়ােগকালে যে নারী একদিন নিতান্ত নির্ভীক ও নির্লজ্জার ন্যায় আচরণ করিয়াছে, অপর দিন সেই নারীই নিতান্ত ভীরু ও লাজুকতার অভিনয় করে, কিংবা সম্প্রয়ােগ বিদ্বেষিণী হইয়া থাকে। মৃদু মন্দ ব্যবহার যে নারী একদিন পছন্দ করিয়াছে, সেই নারীই অপর দিন স্বামীর জোর-জবরদস্তি কামনা করে এবং সম্প্রয়ােগকালে বল প্রয়ােগ কিংবা কঠোর উপচার প্রয়ােগে তাহার অত্যধিক প্রীতিসঞ্চার হয়।

দম্পতি বিশেষের পরস্পরের যৌনাঙ্গের অসামঞ্জস্যতা হেতু অনেক সময় যৌনমিলন যৌনতৃপ্তি লাভের অন্তরায় হইয়া উঠে কিন্তু যৌনকলাভিজ্ঞ পুরুষের নিকট রতিসনের পরিবর্তনে ঐ সমস্যার সমাধান হয় এবং রতিতৃপ্তি মুখাবহ হইয়া উঠে।

আদিকাল হইতে উন্মেষশালী স্পৃহাবলে দেশ-বিদেশের নর-নারী রতিশয়নে নানারূপ রতি আসনের সৃষ্টি করিয়াছে এবং উহা যে কত বিচিত্র প্রকারের, আজ তাহা নিরূপণ করাও শক্ত। তবে সাধারণতঃ মানুষের রতিশয়নে একটা সাধারণ আসনই বিশেষরূপে পৃথিবীর সর্বত্রই প্রচলিত দেখা যায়। এই সাধারণ আসন রমণীর উৰ্দ্ধমুখী হইয়া শয়ন এবং পুরুষের রমণীদেহের উপর অবস্থান। ইহা সৃষ্টিকাৰ্য্যে বিশেষ সহায়ক আর ইহার বন্ধন প্রক্রিয়াও অতি সহজ ও আড়ম্বরবিহীন। এই সকল কারণে সৰ্ব্বদেশের নর-নারীর পক্ষেই ইহা একান্ত উপযােগী ও প্রশস্ত বলিয়া বিবেচিত। ইহার যে বিপরীত অবস্থা তাহা বিপরীত আসন বলিয়া পরিচিত। বিপরীত আসন বন্ধনে পুরুষের উৰ্দ্ধমুখ হইয়া শয়ন ও

রমণীর পুরুষের দেহােপরি অবস্থান বুঝায়। এতদ্ভিন্ন পাশাপাশি আসন প্রভৃতি অনেক প্রকার প্রতি আসনের কথা বাৎসায়নের কামসূত্রম গ্রন্থেও লিপিবদ্ধ আছে। কাজেই যে সকল দম্পতির মধ্যে যৌনাঙ্গের অসাম্যতা পরিলক্ষিত হয়, তাহারা যদি অবস্থা বিপর্যয়ে তাহাদের উপযােগী আসন বাছিয়া লন তবে তাহাদের পক্ষেও প্রকৃত যৌনতৃপ্তি লাভ করা কঠিন হইবে না।

এমনও দেখা গিয়াছে, অনেক অপরিণত ভগাঙ্কুরবিশিষ্টা ও খর্বকায়। রমণী সাধারণ আসনে মােটেই তৃপ্ত হন না, কিন্তু ইহার অনেকেই আবার বিপরীত অথবা পাশাপাশি আসনে পূর্ণ আনন্দ ও তৃপ্তি লাভ করিয়া থাকেন। যে সকল নারী সাধারণ আসন বন্ধনে বিশেষ অবসন্ন ও শ্রান্ত হইয়া পড়ায় প্রকৃত তৃপ্তিলাভে বঞ্চিত থাকেন, তাহারাই আবার পাশাপাশি আসন বন্ধনে পরিপূর্ণ আনন্দ ও তৃপ্তিলাভে সমর্থ হন। অনেক পুরুষকে দেখা যায়, সাধারণ আসন বন্ধনে হয়ত দুই এক মিনিটের বেশী বীৰ্য্যধারণে সমর্থ হন না, তাঁহারাই আবার পাশাপাশি আসন বন্ধনে অধিককাল বীৰ্য্যধারণে সমর্থ হইয়া থাকেন। গর্ভাবস্থায় প্রথম তিন মাস ও শেষের তিন মাস সঙ্গম একেবারে পরিত্যাগ সবচেয়ে মঙ্গলকর। এতদ্ভিন্ন ঐ অবস্থায় অন্যান্য সময়ে রমণে সাধারণ ও বিপরীত আসন উভয়ই পরিত্যাগ করিয়া পাশাপাশি আসন বন্ধনে রমণলিপ্ত হইলে গর্ভিণীর বিশেষ কোন অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা থাকে না।

দম্পতির মধ্যে রতিকালের স্থায়িত্ব সমান করিতে পারিলে সবচেয়ে ভাল। নচেৎ উভয়ে চরমানন্দ লাভ না করা পর্যন্ত রতি বিরতি করা কোন মতেই বাঞ্ছনীয় নহে। বিশেষজ্ঞগণের অনুসন্ধানের ফলে দেখা গিয়াছে, বয়স্থা স্বাস্থ্যবতী নারীগণ সাধারণতঃ ১০ হইতে ১৫ মিনিট কাল সম্ভোগ ব্যতিরেকে চরিতার্থ হয় না; কিন্তু এ ক্ষেত্রে বয়স্ক স্বাস্থ্যবান পুরুষদিগকে

শাখায় ২ হইতে ৫ মিনিট মাই মিলে । এবার ‘এন পুরুও দেখা যায় । চল তে সর ইলে স্ত্রী ইহার ভিতর একাধিকবার অতিপরিতৃপ্তি লাভ করিয়া থাকেন। এই ক্ষেত্রে স্ত্রীর শক্তিবর্ধনের জন্য ঔষধাদির ব্যবস্থা করা প্রয়ােজন। কিঅর রতিশক্তিসম্পন্ন পুরুষের পক্ষে ঔষধাদির সহিত মনােবল প্রয়ােগে গতিকে বিলম্বিত করা দরকার। বিবাহের মিথুন-সঙ্কেত’ নামক পরবর্তী পুকে আমি এ বিষয়ে বিস্তারিত আলােচনা করিব।

সমাপ্ত

Please follow and like us:

Leave a Reply