কারুতীর্থ কলিঙ্গ – নারায়ণ সান্যাল

›› বই এর অংশ / সংক্ষেপিত  

……চিত্র—5.2-তে আমরা তিনটি চিত্রের মাধ্যমে এই আভঙ্গঠামের প্রয়ােগকৌশলটুক ব্যাখ্যা করতে চেয়েছি। বামে একটি হিন্দু শিল্পশাস্ত্রসম্মত নায়িকামূর্তি, কেন্দ্রস্থলে তার বাস্তবানুগ রূপ এবং দক্ষিণে ঐ মূর্তির অস্থি-সংস্থাপন বােঝানাে হয়েছে।

………(iii) ত্রিভঙ্গঠাম আমাদের অপিরিচত নয়, ‘কেষ্টঠাকুরের দয়ায়। এখানে মূর্তি তিনবার বাঁক খায়। অবনীন্দ্রনাথ বলছেন, “মৃণালদণ্ডের মতাে অথবা অগ্নিশিখার মতাে পদতল হইতে কটিদেশ পর্যন্ত একদিকে, কটিদেশ হইতে কণ্ঠ পর্যন্ত তার বিপরীত দিকে এবং কণ্ঠ হইতে শিরােদেশ পর্যন্ত পুনরায় অন্যদিকে বাঁক নেয়। যেমন—দেখতে পাচ্ছি | চিত্র—5.3-তে।

……….আমরা এখানে তিনটি উদাহরণ উপস্থাপন করেছি—করবীবন্ধনরতা (চিত্র-5.18) এবং সিন্দুরদানরতা (চিত্র-5.19 এবং 5.20)। প্রথম উদাহরণে শিল্পী তার নায়িকাকে প্রায় একশ আশি ডিগ্রি পাক খাইয়েছেন। যেন মেয়েটির ভঙ্গিমার মধ্যেই তার প্রসাধন-নৈপুণ্যের বিকাশ—অর্থাৎ আজানুলম্বিত বেণী ও দেহকাণ্ড যেন একে অপরের উপমান—একইভাবে পাক খাচ্ছে। মনে পড়ে যায় ‘শ্যামলী’র সেই বর্ণনা ‘বাঁধছিল চুল, বেণী পাকিয়ে পাকিয়ে, কাঁটা বিঁধে বিধে। কাঁটা অবশ্য সবসময়েই বেঁধে পাঠক অথবা দর্শকের বুকে-কী কাব্যে, কী ভাস্কর্যে।

দ্বিতীয় উদাহরণে (চিত্র-5.19) নায়িকা একই ভঙ্গিমায় পিছন ফিরেছে, কিন্তু এখানে শিল্পী আছেন মডেলের পাশে, পিছনে নয়। প্রসঙ্গত বলি, দুটি উদাহরণই (চিত্র-5.18 ও 5.19) খাজুরাহাে থেকে, কলিঙ্গ থেকে নয়। কলিঙ্গে শিল্পী কদাচিৎ এ জাতের সম্পূর্ণ পিছন থেকে ব্যাক-ভিয়ু গড়েছেন। এ-দিক থেকে খাজুরাহাে শিল্পী বৈশিষ্ট্য দাবী করতে পারেন। তৃতীয় উদাহরণ (চিত্র-5.20) নায়িকার বামহস্তে দর্পণ—সে সিঁথিমূলে সিন্দুর লেপন করছে। বলাবাহুল্য। এ নায়িকা পরকীয়া প্রেমে পাগলিনী নয়, স্বামীর সােহাগে গরবিনী।

………ক৷ অলসকন্যা ? ‘অলসকন্যা শব্দটি বহুল ব্যবহৃত। ইংরেজিতে যাকে বলা যায় Lady-in-liesure; এখন অবসর-যাপনের পশ্চাৎপটে নানান ভাব ও রসের দ্যোতনা থাকতে পারেনায়িকার মুগ্ধভাব, অভিমান, প্রতীক্ষা, অথবা রতিক্লান্ত আশেষ শয়নার প্রতিমূর্তি।

(ii) প্রতীক্ষার : প্রিয়ের আগমন প্রতীক্ষায় নায়িকা যখন অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছে। অনুষঙ্গ অনেক কিছু হতে পারে ; অর্থাৎ প্রতীক্ষার গৃহকপাট আধেক খুলে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে ঘরেফেরা মরদের জন্য, তখন তার পশ্চাৎ-পটে হয়তাে তােরণ, হয়তাে দরজার কপাটে সে রেখেছে একটি হাত। কখনও বা নায়িকা ঘরে নয়, পুষ্পবিতানে। প্রতীক্ষারতা ; তখন তার একটি হাত আপাদপে অথবা শালবৃক্ষের শাখায়। তাকে বলি “শালভঞ্জিকা। অনেক সময় ‘বনদেবী’ বা ‘বৃক্ষিকা মাতৃমূর্তিকেও আমরা শালভঞ্জিকা’ বলে ভুল করি (সাঁচী তােরণের সুবিখ্যাত ‘বৃক্ষিকা’)। চিত্র—5,27-এর নায়িকা এমন একটি নায়িকামূর্তি। এরই সামান্য রকমফের চিত্র-5.28। কখনও বা নায়িকা আশ্লেষ-শয়নে শায়িতা (মুক্তেশ্বর তােরণের দু-পাশে এমন দুটি মূর্তি আছে)।

মিথুনাচারের বিবর্তন :
বাৎস্যায়ন তাঁর কামসূত্রে নববিবাহিত দম্পতিকে উপদেশছলে বলেছেন, “বিবাহের পর প্রথম তিনরাত্রি নব-পরিণীত স্বামী-স্ত্রী ভূতলে শয়ন করবে এবং রতিরঙ্গ-বিবর্জিত সংযত রাত্রি যাপন করবে। পরবর্তী সপ্তদিবসরজনী তারা যুগলে আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গে সৌজন্য-সাক্ষাতে যাবে; তারা একসঙ্গে পুষ্প-চয়ন করবে, গান শুনবে, গল্প-গুজব করবে। এইভাবে স্ত্রীর হৃদয় জয় করা সম্বন্ধে নিঃসন্দিগ্ধ হবার পর স্বামী তার সহধর্মিণীর দৈহিক নৈকট্যে আসা প্রয়াস পাবে।” বাৎস্যায়ন বলছেন, “কোনও স্ত্রীলােকই জোর-জবরদস্তি পছন্দ করে না ; অপরিচিত বা অর্ধ-পরিচিত কোনও পুরুষের দৈহিক জবরদস্তিতে যদি সে আত্মদানে বাধ্য হয়, তবে হয়তাে সে সারাজীবন তাকে ক্ষমা করতে পারে না। হয়তাে সে সুরতক্রিয়াকেই ঘৃণা করতে শুরু করে, অথবা শুধুমাত্র তার স্বামীকে। প্রথম ক্ষেত্রে নারী-হিসাবে তার জীবন ব্যর্থ হয়ে যায় ; দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সে পরপুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে।
এই অমূল্য উপদেশটি কলিঙ্গ-ভাস্কর যেন অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গেছেন।
কলিঙ্গ-ভাস্কর্যের একেবারে আদি যুগে, খ্রীষ্টপূর্ব যুগের গুহাভাস্কর্যে তাই দেখতে পাই অপ্রগম্ভ ফুলমূর্তি। বাৎস্যায়নের প্রতিটি দিনকে প্রতিটি শতাব্দী ধরে নিয়ে দেখছি ওরা সাত-আট শতাব্দী সুরতক্রিয়ায়। বিরত ছিল। তারা হাত ধরাধরি করে ফুল তুলছে, গান শুনেছে, পরস্পরের মন ছোঁবার চেষ্টা করছে। ধীরে ধীরে ধাপে-ধাপে।
আমরা এই সাত-আটশ বছরের বিবর্তনকে কয়েকটি পর্যায়ে বিভক্ত করে আলােচনা করতে পারি। যথা
(i) যুগল মূর্তি ; (ii) উত্তেজিত মিথুন ; (iii) শৃঙ্গাররত মিথুন ; (iv) মৈথুনরত মিথুন ; (v) যৌথ-যৌনাচার।

……..II. উত্তেজিত মিথুন : দ্বিতীয় জাতের মিথুনকে আমরা বলেছি উত্তেজিত মিথুন। যাদের সংজ্ঞার্থ ও আলিঙ্গনবন্ধ, চুম্বনােদ্যত অথবা প্রাকমিলনকেলিরত, অথচ যাদের নিম্নাঙ্গ অপ্রকট।

ভারতীয় ভাস্কর্যে যুগল-মূর্তিকে ব্যাপকভাবে উত্তেজিত হতে দেখছি ষষ্ঠ শতাব্দীতে, শেষ চালুক্যযুগে নির্মিত আহিওলের দুর্গামন্দিরে এবং লাদখান মন্দিরে। তার পূর্বে যে উত্তেজিত মিথুনের পরিকল্পনা করা হয়নি এ কথা বলব না। আমার অভিজ্ঞতায় প্রাচীনতম ভারতীয় মিথুন-মূর্তিটি আছে লক্ষে, সংগ্রহশালায়—একটি জৈন স্তম্ভে উৎকীর্ণ করা উত্তেজিত মিথুন’। সেটি আনুমানিক দ্বিতীয় খ্রীষ্টপূর্বাব্দের। তার একটি আলােকচিত ত্রৈমাসিক ‘রূপম্ পত্রিকায় (এপ্রিলজুলাই 1925, p.54) প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু সেটি ব্যতিক্রম। প্রথম পাঁচ-ছয় শত বছর—যেন বাৎস্যায়নের নির্দেশ মেনে ওরা শুধু পুষ্পচয়ন করেছে, গল্পগাছা করেছে!

শেষ চালুক্য যুগের মিথুন-মূর্তিগুলি উত্তেজিত হলেও তাদের নিম্নযৌনাঙ্গ ছিল গােপন। সাহিত্যে ততদিন শৃঙ্গার ও মৈথুনের অকপট বর্ণনায় যদি কোনও বিধিনিষেধ ছিল না, তবু ভাস্করদল গুপ্তযুগে অতটা প্রকট হতে পারেননি। হাজার হােক, ভাস্কর্য হচ্ছে দৃশ্যকাব্য-নয়নগ্রাহ্য ললিতকলা।
উত্তেজিত মিথুনের পর্যায়ক্রম বােঝাতে আমরা এখানে পর পর চারটি উদাহরণ উপস্থাপিত করছি। প্রথম দুটি ব্রষ্মেশ্বর মন্দির থেকে। শেষ দুটি আমার
সঙ্গে কলিঙ্গ পরিক্রমায় শিল্প-তীর্থযাত্রী শিল্পী শ্রীইন্দ্র দুগারের একটি লিঙ্গরাজ ও একটি কোণার্ক থেকে।

প্রথম উদাহরণে (চিত্র-5.34) নায়িকার শুধু হাতখানি ধরা হয়েছে, তাতেই সে লজ্জাবনতা। নিজের বাঁ-হাতখানি রেখেছে চিবুকে, কিন্তু স্মিতহাস্যে তার সম্মতির বিজ্ঞাপন। দ্বিতীয় উদাহরণেও দেখেছি (চিত্র-5.35) নায়িকা সরাসরি তার প্রেমাস্পদের দিকে তাকাতে পারেনি। ভাবখানা নহি নহি
বােলবি, মােড়য়িবি গীম। কিন্তু এবার দেখছি, মেয়েটি তার ডান হাতখানি রেখেছে দয়িতের স্কন্ধে। স্বীকার করতেই হবে প্রথম উদাহরণের নায়িকার চেয়ে দ্বিতীয়া একটু বেশি উত্তেজিতা—বিকচ-উরসার মধ্যমাঙ্গের বিচিত্রঠামেও তার সম্মতির স্বীকৃতি। তৃতীয় উদাহরণটি শিল্পী শ্রীদুগার এঁকেছিলেন। লিঙ্গরাজ-বিমানের উপর থেকে (চিত্র—5.36)।
এখানে নায়িকা সরাসরি তার প্রেমাস্পদের দিকে তাকাতে পেরেছে। বিকচ-কলাপ ময়ূরের মতাে সে হাত দুটি লীলায়িত ভঙ্গিমায় মাথার উপরে তুলেছে। দয়িতকে সে স্পর্শ করে নেই কিন্তু তার আভঙ্গাঠামে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, সে চুম্বন-তিয়াসী।
চতুর্থ উদাহরণটি (চিত্র-5.37) কোণার্ক জগমােহন থেকে সঙ্কলিত। নায়িকা এখানে রীতিমতাে রত্যাতুরা।

…….চিত্র—৪.6এবং চিত্র-৪.7 দুটিই পরশুরামেশ্বর মন্দির থেকে সংগৃহীত। একই কালে একই স্থানে দুটি ভাস্কর দেখা যাচ্ছে দুটি দলের। প্রথমটিতে পার্বতী বসেছেন শিবের পাশে, এবং শিবের পরিধানে বস্ত্র। দ্বিতীয়টিতে পার্বতী শিবের বামজানুর উপর উপবিষ্টা এবং মহাদেবমূর্তিতে লিঙ্গটি উৎকীর্ণ করা।

Please follow and like us:

Leave a Reply